নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫২
সিনথিয়া
সবার এতো হাসি-কান্নার মাঝেও একজোড়া নিকষকালো চোখ শুধু উদগ্রীব ছিল শেহজাদের জন্য। দেখতে চাইছিল তার পুরুষালী গম্ভীর আননে সেই অপার খুশিটুকু। কিন্তু মানুষটা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল নিজের জায়গায়। একটুও নড়ল না৷ অনুভূতির প্রকাশ তো দূর, একটা কথাও বললনা কারোর সাথে।
আরশি চোখ ফিরিয়ে নেয়। শ্বাস ফেলে। তাড়াহুড়ো সে করবে না। শেহজাদকে নিজে থেকে কিছু বলবেও না। ছেড়ে দেবে তাকে তার মতোন করে।
অনেকক্ষণ পর ধাতস্থ হলো হাসান ভিলার সবাই। মায়ের কোলে লেপ্টে রইল ভীতু বিড়াল ছানাটির মতো জারা। মরিয়ম মেয়েকে বুকে রেখেই তাকালেন আঞ্জুমানের দিকে। বিনয়ী হেসে বলে উঠলেন,
“আপনার কাছে যে আমার ঋণের শেষ নেই আপা। আমার মেয়েটাকে আপনি বাঁচিয়েছেন। নিজের মেয়ের মতো করে গড়ে পিঠে মানুষ করেছেন! রুশা যে বেঁচে আছে এই আশাই তো আমরা একেবারে ছেড়ে দিয়েছিলাম জানেন?”
আঞ্জুমান রোজী স্মিত হাসলেন। প্রৌঢ় মুখটা মলিন ঠেকল হঠাৎ। আভিজাত্য ভাঁটা পড়ল ম্লান এক বেদনায়৷ তবুও সেসব কাউকে বুঝতে দিলেন না ভদ্রমহিলা। গলার শ্লেষটুকু গিলে আওড়ালেন,
“আমি কিন্তু কিছুই করিনি আপা! যা করেছে সব আপনার বউমা! আমার আসার কথা তো এখন ছিল না। ছিল আরো দু’সপ্তাহ পর। একেবারে জারার বিয়েতে। কিন্তু আপনার এই বউমা’টির জন্য আমাকে তাড়াহুড়ো করে ফ্লাইট বুক করে চলে আসতে হলো আগেভাগেই। এই ভীনদেশে। তবে বলব, ভাগ্যিস এসেছিলাম! নইলে এতো মধুর একটা দৃশ্যের স্বাক্ষী হতাম কী করে বলুন?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মরিয়মের বুক থেকে এবার মাথা তুলে ঋজু হয়ে দাঁড়াল জারা। চুল এলোমেলো। চোখের পানিতে ভেজা পুরো মুখ। তবুও দৃষ্টি ফেরাল আরশির দিকে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে আচমকাই জাপ্টে ধরল মেয়েটাকে।
আরশি হকচকায়। আচানক হামলায় পিছিয়ে যায় দু’কদম। তারপর নিজেও হেসে ফেলে। হাত তুলে রাখে জারার পিঠে। কিন্তু কিছু বলার আগেই শোনে জারার ভাঙা কন্ঠ,
“আমি তোকে একটু জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি?”
আরশি সম্মতি দিলো মাথা দুলিয়ে। মলিন হেসে ব্যতিব্যস্ত হাতে আরো শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিলো জারাকে।
“আমি কিন্তু তোকে ভাবি-টাবি ডাকছি না! তুই আগেও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলি আর এখনও আমার বেস্ট ফ্রেন্ডই থাকবি! তাতে যদি কেউ আমাকে বকে, বকুক!”
জারার কথায় ভারী হওয়া পরিবেশটা হালকা হলো সহসা। সকলের হাসির শব্দ দোল খেলো হাসান ভিলার দেয়ালে দেয়ালে। আরশিও মলিন হেসে যখন মেয়েটার চুলে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তখন শেহজাদ গাঢ় চোখে পরখ করছে তার প্রিয়দর্শিনীকে। একটু বলবে রুশাকে তার কাছে পাঠাতে? ছোটবেলার মতো সে-ও মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিত রুশার?
“ধুর! কেন বকবে? আমাদের রুশাকে কেউ বকলে আমরা বুঝি সেটা মেনে নেব?
তুই আর এতো কাঁদিস না তো বাবু! দেখ! চোখ মুখের কী হাল হয়েছে এতক্ষণে? এভাবে কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ঢোল বানালে দেখবি বিয়ের দিন একটাও ছবি সুন্দর আসেনি!”
আরশির কথায়, এতো এতো হাসি আনন্দের মাঝেও ডুকরে উঠলো জারা। হাতের বাঁধন শক্ত করে ঝরঝরিয়ে কাঁদল। এই মেয়েটার কাছে যে সে বড্ড ঋণী হয়ে গেলো সে! বড্ড ঋণী! আরশি না থাকলে আজও কী ফিরতে সে পারত তার পরিবারের কাছে?
আয়ানের চোখের কোটরেও জমেছিল জলের স্রোত। কিন্তু সে কাঁদলে বাকিদের হাসাবে কে? তাই তো ভারী গলায় দুষ্টুমি টেনে আরশিকে বলল,
“রায়বাঘিনী ননদিনীর মিষ্টি কথায় ভুলো না বোন! সব ননদরাই কিন্তু শুরু শুরুতে বেস্ট ফ্রেন্ড-ই হতে চায়!”
জারার কান্নাকাটি শেষ! সে চোখ মুছে আশ্লেষ নিয়ে তাকাল আয়ানের দিকে। মুখ ভার করে চোখ পাকালো। দৃঢ় গলায় শুধাল,
“আমি রায়বাঘিনী ননদিনী?”
আরশি ঠোঁট টিপল হাসি থামাতে। আয়ানের মুখটা দেখার মতো হয়েছে এখন। শত হলেও এ যে না হওয়া বউ তার। এভাবে চটিয়ে দেয়াটা বোধহয় ঠিক হয়নি!
আয়ান সময় নষ্ট করলো না। এক চোখ বুঁজে তড়িঘড়ি দু’হাতে দু’কানের নরম অংশ ছুঁয়ে বলল,
“ এই! সরি সরি! আরে আমি তো মজা করছিলাম! তুমি তো কান্নাই থামাচ্ছিলে না! আমি কী করব বলো?”
আঞ্জুমান ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন জারার কাছে। মেয়েটার কাঁধে আলতো হাত রেখে মুগ্ধ চোখে তাকালেন আয়ানের দিকে। কন্ঠ নামিয়ে মেয়েকে শুধালেন,
“এই বুঝি তোর বানরমশাই?”
জারা এতোক্ষণে আলতো হাসল। চিবুক ঠেকাল গলায়। নিম্নাষ্ঠ দাঁতে চেপে লজ্জা লজ্জা ভঙিমায় মাথা দোলাল ওপর-নিচ।
আঞ্জুমানের ঠোঁটের হাসিও চওড়া হলো। জহুরির চোখ তার। মানুষ চিনতে ভুল করেননা তিনি। তাই যেন এক দেখাতেই বেশ পছন্দ হয়ে গেল তার আয়ানকে মেয়ের জামাই হিসেবে।
শেহজাদ তখনও উশখুশ করছে দূরে দাঁড়িয়ে। গম্ভীর খোলশ টার বাইরে গিয়ে পা চলছে না তার। কীভাবে যাবে বোনের কাছে?
মুখে না বললেও আরশি যেন বুঝে ফেলল শেহজাদের মনের অবস্থা। অমনি চোখের ইশারায় জারাকে অনুনয় করল শেহজাদের কাছেও একটু যেতে। বেচারা যে বলতেও পারছে না কিছু!
জারা বুঝল। সাহস করে এবার এগোলো ভাইয়ের সামনে। কাছে গিয়ে ধরা গলায় ডাকল,
“ভা-ভাইয়া?”
শেহজাদ যেন বহু কষ্টে চেপে রেখেছে চোখের পানি। বুকের হাহাকার। সবাই হাউমাউ করে কাঁদল রুশাকে পেয়ে। আর ও? ও কেন কাঁদতে পারে না সবার মতো করে? তাহলে হয়তে সবার মতো ওর-ও বুকটাও একটু হালকা হতো?
কথা না শোনা জল চোখের কোণ গড়িয়ে গাল ভেজানোর আগেই সেটুকু বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মুছে ফেলল শেহজাদ। ভাঙাচোরা কদমে নিজেও এগিয়ে এলো বোনের কাছে। একখানা হাত বহু সংকোচ আর দ্বিধার দোর পেরিয়ে উঠে এলো জারার মাথায়। শেহজাদ প্রায় অস্পষ্ট কন্ঠে শুধাল,
“কত বড় হয়ে গেলি রে রুশা!”
জারা এবার আর দূরে থাকত পারলো না ভাইয়ের থেকে। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে মাথা ঠেকাল ভাইয়ের বুকে। চোখের জল বাঁধ মানল না আর! ভাঙা স্বরে বলল,
“তুমিও কিন্তু বুড়ো হয়ে যাচ্ছো ভাইয়া!”
শেহজাদ বোনের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতেই হেসে ফেলল এবার। হাসল আরশিও। মনটা আজ কানায় কানায় পরিপূর্ণ তার। এই দৃশ্যটুকু স্মৃতি থেকে কোনোদিন ম্লান না হোক! বড় অমূল্য যে এই মানুষগুলোর হাসিমুখ তার কাছে।
আঞ্জুমান প্রলম্বিত শ্বাস ফেললেন। মরিয়মের কাছে এসে তার দু’হাত নিজের হাতের আঁজলায় নিলেন। অপরাধীর গলায় আওড়ালেন,
“আমার উচিত ছিল সেদিন জারাকে পাওয়ার সাথে সাথেই আশপাশের থানায় যোগাযোগ করা। আপনারাও হয়তো খুঁজছিলেন ওকে! পেয়েও যেতেন! এতোগুলো দিন অপেক্ষা করতে হতো না আপনাদের ওর জন্য! কিন্তু কী করব? অমন পুতুলের মতো মেয়েটার কান্না দেখে ওকে যে আর কোল ছাড়া করতে মন সায় দিলো না। ওর মুখে মা ডাক শোনার এতোটা লোভ তো না হলেও পারত আমার বলুন?”
মরয়িম মাথা নাড়লেন সজোরে! বোনের মতো আঞ্জুমানকে বোঝালেন,
“আপনি যে ওকে আগলে রেখেছিলেন এতোদিন, এটাই আমাদের জন্য অনেক! অনেক! কষ্ট পাবেন না। রুশা তো আপনারও মেয়ে। আগে ওর সাথে আপনার যেমন সম্পর্ক ছিল, এখনও ঠিক তেমন থাকবে!”
জারাও এবার ভাইয়ের বুক থেকে মাথা তুলল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছুটে এলো নিজের মনির কাছে। মুখ ভার করে অনুযোগ করল,
“আমাকে পর করে দিচ্ছো মনি?”
আঞ্জুমান একবুক প্রশস্তির শ্বাস ফেললেন। প্রসন্ন হাসলেন জারার ভার হয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে। তারপর মেয়েটার দু’গালে আলতো চাপ দিয়ে বললেন,
“পর তো করতেই হবে! মেয়ে বড় হয়ে গেলে তাকে বিয়ে দিতে হবে না? তারউপর মেয়ের যদি আগে থেকেই পছন্দ করে রাখা কোনো বানরমশাই থাকে তাহলে তো কথাই নেই!”
আঞ্জুমানের কথায় আবারও লজ্জা পেয়ে গেল নীলাম্বরী। তবে বিয়ের কথা শুনে আয়ান এবার নিঃসঙ্কোচে এগিয়ে এলো আঞ্জুমান আর মরিয়মের সামনে। গলা পরিষ্কার করে নিজের পরিচয় দিতে বিনয়ের সাথে বুকে এক হাত রাখল। কারণ ফার্স্ট ইমপ্রেশন ইজ দ্য বেস্ট ইমপ্রেশন। কিন্তু বেচারা বেখেয়ালে বলে ফেলল,
“আসসালমু আলাইকুম মণি! আমি বানর, না মানে আ-আয়ান! আয়ান হান্টার! ইন্সপেক্টর জেনারেল অব এনওয়াইপিডি!”
আঞ্জুমান হেসে সালামের উত্তর দিলেও মাথায় হাত জারার। আয়ানের চেহারা শঙ্কিত। জারার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে আওড়াল,
“আসলে প্রেকটিস নেই তো! পরেরবার আর ভুল বলবো না! প্রমিজ!”
তবে সবাই আয়ান জারাকে নিয়ে মাতামাতি করলেও শুধু বসার ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে, চুপচাপ দাঁতে দাঁত পিষে গেল এমিলিয়া। এই বাইরের লোকগুলো কিনা এই পরিবারের এতো কাছের মানুষ হয়ে গেল চোখের পলকে? আর সে? সে কেউ নয়? কই? তার কথা তো কেউ জিজ্ঞেসও করল না একবারও?
ঠিক তখনই তার মুঠোফোনে এলো একটা ক্ষুদে বার্তা। এমি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতেই তাকাল হাতে থাকা মোবাইলের স্ক্রিনে। মেসেজটি এসেছে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে। যেখানে লেখা,
“ শত্রুর শত্রু বন্ধু! কথাটা জানো তো? ক্যাফে নিউইয়র্ক! আগামীকাল ঠিক বিকেল পাঁচটায়! আমি অপেক্ষায় থাকব!”
আয়ানকে যেতে দেয়া হয়নি তার বাসায়। সে নিজেও যে খুব একটা যেতে চেয়েছে তা নয়। কারণ জারা এখন থেকে হাসান ভিলাতেই থাকবে ওদের বিয়ের আগ অবধি। বিয়ের আলোচনা হবে আগামীকাল। খুব সম্ভবত এ সপ্তাহের শুক্রবারেই আয়োজন করা হবে আকদের। অবসান ঘটবে এই মিষ্টি প্রতীক্ষার। কিন্তু সমস্যা একটাই। মেহমেদ হাসান!
তিনি নাকি এই এক সপ্তাহ পরীক্ষা নেবেন আয়ানের! একমাত্র মেয়ের বিয়ে সে তো আর যেমন তেমন করোর সাথে দিতে পারেননা! যতই সে মেয়ে আগে থেকে পছন্দ করে রাখুক পাত্র! আয়ানকে এই এক সপ্তাহ নাওয়া, খাওয়া ঘুম, সব করতে হবু শ্বশুরের সাথে!
আয়ান তাতেও হাসিমুখে রাজি! বাটারফ্লাইকে নিজের করে পেতে সে জান পর্যন্ত বাজি রাখতে জানে! আর এ তো সামান্য নিজের যোগ্যতার পরীক্ষা! তার থেকেও বড় কথা, সে জারা আশেপাশেই থাকতে পারবে এই এক সপ্তাহ। আর কী চাই জীবনে?
আঞ্জুমান জার্নি করেছেন। ধকল কাটাতে রাতের খাওয়া দাওয়া পরই তার রুম গুছিয়ে দিল আরশি। ঘুম প্রয়োজন তার।
ওদিকে মরিয়ম জেদ ধরেছেন আজ সে মেয়েকে সাথে নিয়ে ঘুমোবে। অগত্যা– মেহমেদ হাসানকে পাঠিয়ে দেয়া হলো আয়ানের ঘরে। মেহমেদ হাসানও না করলেন না। এই সুযোগে ছেলেটাকে বেশ নাকানিচুবানি খাওয়ানো যাবে! এই বদ পুলিশটার তার মেয়েকে তার থেকে কেড়ে নেয়ার ধান্ধা? এতো সোজা নাকি!
মরিয়ম জারাকে নিয়ে বিছানায় বসতেই ছুটে এলো আরশি। আদুরে বিড়ালের মতো মরিয়মের কোলে মাথা রেখে আবদার ছুড়ল,
“এক মেয়েকে পেয়ে অন্য মেয়েকে ভুলে গেলে চলবে? আমি বুঝি ঘুমোবো না তোমাদের সাথে?”
মরিয়ম বেগম আরশির কথায় হেসে শুধালেন,
“তা আপনি যে ঘুমোতে এসেছেন, আপনার সাহেবের থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছেন?”
আরশি আনমনেই আওড়াল,
“কে সাহেব? কার কথা বলছো বলো তো? আমি কেন তোমার কাছে শোয়ার জন্য কারোর কাছ থেকে পারমিশন নিতে যাবো? মায়ের সাথে শোয়ার জন্য পারমিশন লাগে বুঝি?”
জারা ঠোঁট টিপে হাসি আঁটকে বলল,
“সাহেব মানে তোমার মহামান্য স্বামী! নিয়েছিস পারমিশন আমার ভাইয়ের থেকে! আমার ভাই পারমিশন না দিলে তো আমিও তোকে শুতে দিচ্ছি না এখানে! উহু! নেভার!”
অমনি উঠে বসল আরশি। জারার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আর তোমার স্বামী? তার খোঁজ নিয়েছ? গিয়ে দেখ! বাবাকে রুমে ঢুকতে দেখে কেমন ঘামছে বেচারা! পরীক্ষায় পাস ফেলেরও তো একটা ব্যাপার আছে নাকি?”
জারা পাত্তা দিলো না সে কথার! বাবা যা খুশি করুক! দিনশেষে মানুষটা ওর হলেই হলো! মরিয়ম বেগম বিছানা, বালিশ ঠিক করতে করতে বললেন,
“আয়ানটাকে তো ছোট থাকতে যে-ই জিজ্ঞেস করতাম, তুমি বড় হয়ে কাকে বিয়ে করবে? সঙ্গে সঙ্গে রুশাকে দেখিয়ে দিতো! আর এই নিয়ে শায়ানের কী রাগ! সে কিছুতেই বোনের বিয়ে দেবে না! আর আয়ানটাও হয়েছে তেমন! বন্ধু রেগে যাচ্ছে দেখে আরো বেশি করে বলত, আমি তো বিয়ে করলে রুশাকেই বিয়ে করব! পারলে আঁটকে দেখাস তুই!”
জারা আগ্রহী হয়ে শুধাল,
“তারপর?”
“তারপর আর কি! আয়ানকে মারতে তার পিছে পিছে ছুটত তোর ভাই!”
অমনি জারা আরশির দিকে ঘুরে বলে উঠলো,
“ কী পাঁজি লোক দেখেছিস! ছোট বেলায় যাকে দেখত তাকেই বিয়ে করতে চাইত?”
আরশি হেসেই যাচ্ছে সমানে। পানপাতার মতো ঢলঢলে মুখটা লাল হয়ে এসেছে তার হাসির তোড়ে! হাসি থামিয়ে নিজেকে শান্ত করে কিছু বলতে যাবে, তখনই মোবাইলে এসে ঢুকলো একটা মেসেজ! কপাল গুটিয়ে সেদিকে তাকাতেই হাসি বন্ধ হয়ে গেলো মেয়েটা। গুটিয়ে রাখা কপাল টানটান করে দেখল স্ক্রিনে উঠে আছে শেহজাদের নাম। যদিও জাম্বুবান দিয়ে সেভ করে রেখেছে, তবুও এই মানুষটার একটা ফোন, মেসেজ আজকাল বড্ড বুকে কাঁপন ধরায় ওর। আশেপাশে থাকলে গলা শুকিয়ে আসে। লাজে রাঙা হয় লাজবন্তী!
তারপর আবার মনোযোগী হলো মেসেজটাতে।
“ রুমে এসো!”
আরশি ঠোঁট বাঁকাল। কেন? সে কেন আসবে এখন? তার থিসিসের কাজ এগিয়ে দিতে?
এসব মনে মনে ভেবে মুচকি মুচকি হাসল সে। তারপর ঋজু হয়ে বসে লিখে পাঠাল,
“ কেন? আসলে আমায় আদর করবেন বুঝি?”
“…..”
“চুমু খাবেন আমার গালে?”
“…..”
“আমি আজ কত কত কাজ একা একা করে ফেললাম? আপনার তো উচিত আমাকে একটা নয়, অনেকগুলো চুমু খাওয়া! চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয়া আমার গাল, কপাল, চোখ, ঠোঁ–
বাকিটুকু আর লিখলো না আরশি। এটুকুই পাঠালো। এতেই যে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে মেয়েটা ভিতর ভিতর। আর কিছু লিখলে নিজেই না শব্দ করে হেসে ফেলে! এতক্ষণ পর শেহজাদ লিখে পাঠাল কিছু,
“তুমি আসবে?”
তুমি আসবে? ব্যাস? মাত্র দু’টো শব্দ? আর কিচ্ছু না? আরশি গাল ফোলালো অভিমানে। গাল ফুলিয়ে রেখেই লিখে পাঠাল,
“ আমি আসব না। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন! আমি আজ মা আর রুশার সাথে ঘুমোবো!”
মেসেজটা পাঠিয়ে তো দিলো! কিন্তু মিনিটখানেক আর শ্বাস চলল না আরশির৷ দম আঁটকে বসে রইলো ফিরতি মেসেজটা পাওয়ার আসায়। কিন্তু মেসেঞ্জারের ঐ তিনটে ডট বেশ অনেকক্ষণ ভেসে টেসে গায়েব হয়ে গেলো শেষমেশ। তারপর একেবারে অনলাইন থেকেই গায়েব হয়ে গেলো শেহজাদ। ফেলে গেলো আরশিকে দ্বিধার সাগরে!
বিপাকে পড়ল মেয়েটা। চিন্তার ভাজ পড়ল কপালে। কিছু বলছেন না কেন উনি? তবে কি রেগে গেলো মানুষটা?
জারা এতক্ষণ পাশে বসে খেয়াল করছিল সবটাই। আরশিকে কপাল কুঁচকে বসে থাকতে দেখেই ভ্রু নাচাল। গলা পরিষ্কার করে শুধাল,
“উহুম উহুম! সোয়ামীর সাথে কথা হয়ে গেলে একটু আমার দিকেও তাকান ম্যাডাম!”
মরিয়ম হেসে মনোযোগ দিলেন ওদের জন্য বিছানা ঠিক করতে। আরশির হুশ ফিরলো অমনি। নিজেও দুষ্টুমি করে শুধাল,
“খুব! তাই না? আমাকে পঁচানো?”
জারা মিষ্টি হেসে কাছে টেনে নিল আরশিকে। দু’হাতে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। গালের উপর টুপ করে একটা চুমু রেখেই বলল,
“তুই তো আমার বোন, বান্ধবী, সোলমেট সব! সবকিছু! তোকে আমি পঁচাতে পারি?”
জারার বাহুডোরে থেকেই হেসে উঠলো আরশি। কিন্তু সেই হাসি টিকলো না বেশিক্ষণ। ওদের খুঁনসুটির মধ্যেও রুমের দরজার সামনে এসে উপস্থিত হলো এক বিশাল ছায়ামূর্তি। অফ-হোয়াইট শার্ট-প্যান্ট আর চোখে পাতলা সোনালী ফ্রেমের চশমা পরা মানুষটাকে দেখেই ধক করে উঠল আরশির বুক।
পকেটে হাত রেখে ডোরফ্রেমে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে শেহজাদ। মুখভঙ্গি নির্বিকার। যেন ভিতরে কী চলছে এই মানুষের সেটা বোঝা দূরহ নয়, অসম্ভব!
মরিয়ম ছেলেকে খেয়াল করতেই শুধালেন,
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫১
“কী রে? এই সময় এই রুমে এলি যে? কিছু লাগবে তোর?”
জারা হাসছে মিটমিটি। আরশি ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে আছে শুধু। তার ডাগর চোখের অপার বিস্ময়কে উপেক্ষা করেই মানুষটা তাকাল মায়ের দিকে! জলদ গম্ভীর গলায় বলতে চাইল, তোমাদের দেখতে এলাম! কিন্তু আনমনেই বলে ফেলল,
“আরশিকে লাগবে!”