নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৩

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৩
সিনথিয়া

শেহজাদের অমন গম্ভীর চাওনি, মুখ ফসকে বলে ফেলা, ‘আরশিকে লাগবে!’ বিস্ময়ের চূড়ায় নিয়ে ফেলল মেয়েটাকে। জারা আর মরিয়ম হাসছিলেন মিটিমিটি।
সেদিকে তাকাতেই যে কী ভীষণ লজ্জায় পড়লো আরশি! সে কথা কি একবারও বুঝতে পারছে মানুষটা? আরশি গুটিয়ে গেলো ভিতর ভিতর! কী দরকার ছিল ওনার এখানে আসার?
আরশি তো ভয়েই পা রাখেনি সারাটা সন্ধ্যা শেহজাদের রুমে। যদি রাগ দেখায় মানষটা ওকে? যদি বলে ওঠে, আমাকে না জানিয়ে এতো কিছু করে ফেললে? এ কদিনে একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না আমাকে রুশার ব্যাপারে?

তাই তো কোনোরকমে এড়িয়ে যেতে চাইছিল শেহজাদকে। তারউপর সে শেহজাদের পাশে না থাকলে উল্টে আরো আরামসে ঘুমোতে পারতো জাম্বুবানটা। আরশি যে হারে হাত পা ছোড়ে ঘুমের ঘোরে!
‘ বেশ তো! নিয়ে যা তোর বউকে! আমরা তো আঁটকে রাখেনি তাকে যে তুই উদ্ধার করে নিয়ে যেতে এমন ব্যস্ত হয়ে ছুটে এলি!’
চকিত ভাবনার সুতো ছিঁড়ল আরশির। মরিয়ম যে মেকি থমথমে গলায় দুষ্টমি করছেন সেটা বাকি দুই রমনী ধরতে পারলেও শেহজাদ ধরতে পারলো না মোটেও। হতভম্ব বোনে গেলো তার
নিরেট মুখখানা। অপ্রস্তুতও হলো বটে। ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে চোখের চশমাটা নাকের ডগা থেকে ঠেলে সোজা করলো।
হতভম্ব ভাবটা কাটতেই গলা পরিস্কার করে বলে উঠলো,
‘ আসলে কাল সকাল সকাল আমাকে ক্লাস নিতে যেতে হবে ভার্সিটিতে। দেরি করে ঘুমোলে টাইম মতো উঠতে পারবো না আমি!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অতো থমথমে কথাগুলোর ভিতরেও শেহজাদের কন্ঠের ব্যাকুলতা বুঝতে সময় নিলো না ওরা! বিশেষ করে মরিয়ম তো বেশ মজা পেলেন ছেলের এমন অবস্থা দেখে। নিজেও দুষ্টমি করে আওড়ালেন,
‘ সে কি রে! তাহলে তো আসলেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে!’
অমনি যেন একটু আশার আলো দেখল শেহজাদ। চোখেমুখে আগ্রহ নিয়ে মায়ের দিকে তাকাতেই মরিয়ম বললেন,
‘ তোর যেহেতু কাল সকালে ক্লাস আছে, তুই আর বেশিক্ষণ জেগে থাকিস না! গিয়ে শুয়ে পড়! আমি রবিনকে দিয়ে তোর জন্য দুধের গ্লাস পাঠিয়ে দেবো?’
‘ কিন্তু আর…’

‘ আর কোনো কথা নয়! তুই কিন্তু বড্ড অনিয়ম করছিস আজকাল শায়ান! এই খাওয়া-দাওয়ার জন্য দুই ভাইবোনকে একটা কানমলা না দিলেই আর হচ্ছে না নাকি? দুটোতে কী চেহারা বানিয়েছে দেখেছিস আরশি?’
আরশির আর সেসব দেখার সময় কই? সে তো শেহজাদের চুপসে যাওয়া মুখটার দিকেই তাকিয়ে আছে। থেকে থেকে কী ভীষণ ব্যথায় মুচড়ে উঠছে বুকটা। আহারে! আহারে! মানুষটা এতো বড় একটা ধোঁকা খেয়ে গেলো?
শেহজাদ গেলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো এক জায়গায়। যেন পা দুটো আঁটকে দিয়েছে কেউ সুপার গ্লু লাগিয়ে! মরিয়ম তাগাদা দিলেন ফের।
‘ কি রে? যা! এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? তোর না উঠতে হবে সকাল সকাল?’
এবার আর থাকতে পারলো না শেহজাদ! লজ্জার মাথা খুইয়েই মরিয়মকে বলে উঠলো,
‘ আরশিকে নিয়ে যাই?’
‘ নিয়ে যাবি?’

শেহজাদ ঢোক গিলল। নিয়ে যাবে মানে? শুধু বোনের সামনে নিজেকে সামলে নিচ্ছে সে! নয়তো হাতটা তো সেই কখন থেকেই নিশপিশ করছে একজনকে এক ঝটকায় কোলে তুলে ফেলার জন্য! শেহজাদকে জ্বালানো তাই না? ইচ্ছে করে রুমে না যাওয়া? একবার শুধু একা পেয়ে নিক এই একজনকে সে! তারপর…
মরিয়ম বেগম হাসি লুকিয়ে দুঃখী দুঃখী করলেন গলাটা। বললেন,
‘ কিন্তু আরশি তো আজ ও ঘরে যাবে না বলল। আমার সাথে ঘুমোবে! তোকে বলেনি?’
মায়ের এমন অভিনয়ে জারা ঠোঁট টিপে হাসলেও আরশির হাসি পেলো না মোটেও। তাকিয়ে দেখতে লাগলো শেহজাদের অসহায় মুখখানা। কেমন ক্ষণে ক্ষণে ঝটকা খাচ্ছে বেচারা! আরশি কী গিয়ে একটু আদর করে দেবে তাকে? গাল দুটো টেনে দিয়ে বলবে,‘ আপনি বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে থাকলে আপনার গাল দুটো টেনে দিতে ইচ্ছে করে! ইচ্ছে করে হামলে পড়ে চুমু খাই?’

তবে আরশি কিছু বলতে পারলো না। ঝাপিয়ে পড়ে চুমুর আইডিয়াটাও বাদ দিতে হলো করুন মুখে! এতোদিন যে মানুষ তাকে এতো এতো জ্বালালো, তাকে অল্প একটু জ্বালা ফিরিয়ে দিলে মন্দ হবে না! থাকুক দাঁড়িয়ে বউকে নিয়ে যাওয়ার জন্য! পা টা একটু ব্যথা হোক তার! আরশিকে তিন বছর ধরে দিয়ে যাওয়া কষ্ট গুলো, ঐ একটা চিঠিতে থোরাই কমে যাবে ওর?
জারা পাশ থেকে ফিসফিস করে বললো,
‘ আহারে! ভাইটা আমার কী গোবেচারা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। তাকে কেউ তার বউ দিলো না, এই কষ্ট আমি বোন হয়ে কী করে দেখি? দাঁড়া! ব্যবস্থা করছি!’

জারা কী ব্যবস্থা করবে সেটা বুঝে ওঠার আগেই আরশি থমকালো। শুনলো জারা মরিয়মকে ডেকে বলছে,
‘ ভাইয়া মনে হয় কিছু একটা খুঁজে পাচ্ছে না মা! তাই বোধহয় আরশিকে ডাকতে এসেছে! তাই না ভাইয়া?’
মরিয়ম মুখে ছদ্ম বিস্ময় ঝুলিয়ে তাকালেন ছেলের দিকে। শুধালেন,
‘ ওমা? সে কি? দাঁড়া দাঁড়া! আমি রবিনকে পাঠাচ্ছি! আরশি না জিনিস খুঁজতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে যায়! তারপর দেখা গেল, আর আসতে পারলো না মেয়েটা আমাদের কাছে! গল্পগুলো মিস করে ফেলবে না? আমি রবিনকে পাঠাচ্ছি দাঁড়া!”
‘ রবিন আঙ্কেল তো ঘুমিয়ে পড়েছেন মা! আর যা খোয়া গেছে তা আরশি ছাড়া কেউ খুঁজে দিতে পারবে না ভাইয়াকে! ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন! আরশিকেই যেতে হবে! জিনিস খুঁজে দিয়েই আবার চলে আসবে! ও এই মাত্র বললো আমাকে!’

‘ কখন বললো? আমি তো শুনিনি!’
‘ কানে কানে বলেছে!’
তারপর ফট করেই আরশির দিকে তাকাল জারা। দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করল,
‘ ভাইয়াকে জিনিস খুঁজে দিয়েই আবার চলে আসবি! আজকে কিন্তু আমাদের অনেক গল্প করার বাকি! আমি আর মা কিন্তু ঘুমোবো না তুই না এলে!”
আরশি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো তার ননদ আর শাশুড়ির মুখের দিকে। কী সাংঘাতিক ঢপবাজ এরা দুজন! মেয়েটা ঢোক গিললো। একেই তার যেতে ইচ্ছে করছে এখন আর রুমে! সারাদিনের কাজে, দৌড়াদৌড়িতে পা দুটো টনটন করছে ব্যথায়! তারউপর রুমে নিয়ে গিয়ে না ইন্টারোগেশন শুরু করে দেয় তাকে এই জাম্বুবানটা!
আরশি হ্যাঁ-না করার সুযোগ পেয়ে ওঠার আগেই তুমুল প্রতিবাদ জানালো শেহজাদ। এই যে বোনের কথা শুনে এক প্রকার আঁতকে উঠলো এতো বড় মানুষটা, তার কোনো প্রকার প্রমাণ লুকোনোর চেষ্টা না করেই বলে উঠলো,

‘ তোমরা ঘুমোবে না মানে?’
মরয়িম বেগম বললেন,
‘ শুনলি না রুশা কী বলল? রাতে গল্প করবো তো আমরা!’
‘ হোয়াট? গল্প অন্যদিন করা যায় না? আজকেই করতে হবে? আর করলেও বা! আরশিকেই কেনো লাগবে তোমাদের?’
‘ এভাবে বলতে পারলি মাকে শায়ু? আমরা একটু তোর বউয়ের সাথে গল্পও করতে পারবোনা?’
আরশি ব্যথা ট্যথা ভুলে গেলো। মরিয়মের অভিনয় আর শেহজাদের করুন অবস্থা দেখে দম ফাটা হাসি পেলো তার। তারউপর মা এই মাত্র কী নামে ডাকলেন তাকে? শায়ু? ও মাই গড! আরশি একটু শব্দ করে হাসতে পারছে না কেনো? জাম্বুবানটা যাবে কখন এখান থেকে?

‘ ওকে ফাইন! গল্প করো তোমরা! আমি চলে গেলাম!’
‘ চলে যা! আমি তো যেতেই বলছি তোকে কখন থেকে!’
‘ সত্যি সত্যি চলে গেলাম!’
‘ সত্যি সত্যি চলে যা! কাল সকালের আগে আর আসিস না! তোর জন্য আমাদের কন্সেসটেন্সি ধরে রাখতে সমস্যা হচ্ছে! গল্পের ফোকাস চলে যাচ্ছে বারবার!’
মরিয়ম আর জারা দু’জনেই এমন চেহারা বানিয়ে রাখলো যেনো তারা আসলেই ভীষণ সিরিয়াস শেহজাদকে তাড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে। যেন আসলেই আরশিকে ছাড়া তাদের গল্পের আসর জমবে না। আরশিকে লাগবেই।
তবুও শেহজাদ হার মানলো না। বউ না নিয়ে সে নড়ছে না। মরয়িম আরো কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই ব্যস্ত কদমে রুমে ঢুকলো শেহজাদ। এগিয়ে আসতেই হড়বড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আরশি। শেহজাদ যেন তার নিশ্বাসের চাইতেও কাছাকাছি এলো চোখের পলকে। শক্ত হাতে চেপে ধরলো ওর নরম হাতখানা।
আরশি সেদিক থেকে চোখ তুলে ঐ গাঢ় নীল চোখজোড়ায় দৃষ্টি ফেলতেই স্বর নামালো শেহজাদ। চাঁদের মতো স্নিগ্ধ মুখখানা টানলো তাকে বড্ড। ঘোর লাগা কন্ঠে বললো,

‘ আমার তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে! তুমি কি চাও? আমি সেই কথাগুলো না বলতে পেরে সারারাত ছটফট করি? তোমাকে কাছে না পেয়ে আমার রাতের ঘুম হারাম হোক?’
আরশির বুকটা যেন সজোরে এক খামচি মারলো শেহজাদের কথায়। যে দ্রিমদ্রিম শব্দটা তোলপাড় চালাচ্ছে সেখানে, সেটা শেহজাদ শুনলে কী হতো? কানে তালা লেগে যেতো নিশ্চয়ই ওনার?
পেলব গতরখানা গতরাতের কথা ভেবেই কেঁপে কেঁপে উঠলো ওর। আরশি এবারও ‘না’ বলার ফুরসতটুকু পেলো না। তার আগেই ধরে থাকা হাতে টান পড়লো ওর। শেহজাদ লম্বা কদম ফেলে আরশিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে! পিছে ফেলে গেলো মরিয়ম আর জারাকে।
ওরা বেরিয়ে যেতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মা-মেয়ে।
মরিয়মের হাসতে হাসতে চোখের কোণে জল জমলো। এমনই তো চেয়েছিলেন সে তার সংসারটা! এমন পাগল থাকুক ছেলেমেয়ে দুটো দু’জন দু’জনার! আর কিচ্ছুটি চাই না তার! কিচ্ছুটি না!

শেহজাদের বড্ড তাড়া তার হাঁটার গতিতে। আরশি পা মেলাতে হিমশিম খেলো। যেতে যেতে কয়েকবার উর্ধ্বশ্বাসে শুধালো,
‘ আস্তে হাঁটুন! দৌড়োচ্ছেন কেনো? আপনার কি ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে? নাকি চুলোয় ওমলেট ফেলে এসেছেন, আর সেটা পুড়ে যাচ্ছে বলে আমাকে সহ এভাবে ছুটছেন? আহ!’
শেহজাদ থেমে গেলো হুট করেই। হাঁটায় বিরতি পেয়ে এতক্ষণে যেনো দম ফেলতে পারলো আরশি। হাঁটুতে হাত রেখে হাফ ছাড়তে না ছাড়তেই আরেক দফা পৃথিবীটা দুলে উঠলো ওর। পা দুটো ভাসলো হাওয়ায়। নিজেকে সামলাতে যখন শেহজাদের গলা জড়িয়ে ধরলো তখন বুঝলো মানুষটা কোলে তুলে নিয়েছে তাকে। আরশি শেহজাদের মুখের দিকেই তাকিয়ে থেকেই বিহ্বলতায় পলক ঝাপটায়। বিস্ময়ে কথা বন্ধ হয়ে আসে মেয়েটার। হুশে ফিরতেই ছটফটিয়ে ওঠে সে। কন্ঠ নামিয়ে ব্যগ্র হয়ে বলে,

‘ আপনি কী পাগল? তখন ওভাবে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলেন! এখন কোলে তুলে নিলেন! আপনার কী মনে হয় বাড়িতে শুধু আমি আর আপনি আছি?’
‘ তাহলে আর কে কে আছে?’
‘ ও ঘরে মণি আছে! আয়ান ভাই এসেছে! বাবাও তো তার ঘরে গিয়েছে! কেউ হুট করে বেরিয়ে আমাদের এভাবে দেখে ফেললে কী হবে ভেবেছেন একবারও?’
‘ তোমাকে ছাড়া এই মূহুর্তে অন্য কিছু ভাবতে পারছি না আরশি! না কাউকে দেখছি! ইটস ফিল লাইক আ’ম বিং হ্যালুসিনেটেড বাই ইয়্যুর লাভ! ট্রাস্ট মি স্নোফ্যাক! আই কান্ট ইভেন থিঙ্ক স্টেইট! আ’ম নট থিঙ্কিং স্ট্রেইট! কারণ এই মূহূর্তে তোমাকে আমার ভীষণ আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছে! যেমন আদরে তোমার কান্না পায়, তেমন আদর!’
আরশি চমকালো। থতমত খেয়ে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো মানুষটার মুখের দিকে। শেহজাদের এমন কথাগুলো হঠাৎ হঠাৎ এমন আশাতীত মনে হয় কেনো তার? মানুষটা ওকে এতো ভালোবাসলে ভালোবাসাও যদি লজ্জা পেয়ে ফুরিয়ে যায়? তখন কী হবে?
ধীরে ধীরে চিবুক নামিয়ে বুকে ঠেকালো আরশি! ক্ষীণ স্বরে বলে গেলো,

‘ নামান আমাকে! এক্ষুনি নামাবেন!’
বেখেয়ালে আরশির হাত আলগা হচ্ছিল। টের পেয়ে নিজেই একহাতে আরশির হাত দুটো, গলার দু’পাশে ফের জড়িয়ে নেয় শেহজাদ। আগের মতোই খাদে নামানো স্বরে বললো,
‘ চুপ! একদম চুপ!’
আরশি চুপ করে না। শেহজাদ পা বাড়ালেই অস্পষ্টে বলে উঠলো,
‘ কেনো জ্বালাচ্ছেন আমাকে এতো? ভাববেন না আমি ছেড়ে দেবো আমাকে! সব কিন্তু কাউন্ট করে রাখছি! তারপর একদিন সব সুদে আসলে…’
‘ শোধ তুলবে?’
আরশি বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়লো দু’পাশে।

‘ উহুম! ফিরিয়ে দেবো! আপনি আমাকে যত জ্বালাবেন, তার দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দেবো আপনাকে! এমন ভাবে ফেরাবো যেনো আমাকে দেখলেই আপনি পালিয়ে পালিয়ে বেরান সবসময়!’
‘ পালাবো কেন?’
‘ আপনি যেমন সবার সামনে আমাকে লজ্জায় ফেলে দেন, আমি যদি তেমন সবার সামনে আপনাকে লজ্জা দিয়ে ফেলি, এই ভয়ে পালাবেন!’
আরশির কথার পিঠে গম্ভীর হতে গিয়েও হেসে ফেললো শেহজাদ। সেই হাসি দু-চোখ ভরা প্রশ্ন নিয়ে দেখে গেলো আরশি। অথচ গলার স্বর রুদ্ধ। মুখ ফুটে বলতে পারলো না, ‘কেনো হাসছেন আপনি? আমি কি হাসির কিছু বলেছি?’ যেনো মানুষটা এমন করে হাসলেই ওর কথা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যুগ যুগ ধরে! কী আশ্চর্য!
শেহজাদ আরশিকে কোলে নিয়েই ঢুকলো রুমের ভিতর। পিছন থেকে পায়ের হালকা ধাক্কায় সশব্দে বন্ধ হয়ে গেলো দরজাটা। সাথে সাথে মুখ নামিয়ে ফেলল আরশি! এতো ভয় লাগে কেনো যখন শেহজাদ এভাবে ডোর দেয়? এতো উচাটনই বা কেনো হয় বুকের ভিতর?

গলা শুকিয়ে সাহারা হতেই শেহজাদ বসলো বিছানায়! আরশিকে বসালো নিজের উরুর উপর!
লজ্জায় মিশে যাওয়া মেয়েটার আনত মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অনন্ত সময় ধরে। কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোনো জবরদস্তি নেই! শুধু চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে শেহজাদ দেখে গেলো তার লাজবন্তীকে। তার প্রিয়দর্শিনীকে।
আরশি একবার চোখ তুললো! শেহজাদকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখেই আবার ঝট করে নামিয়ে ফেললো চোখজোড়া!

‘ আ-আপনি ওভাবে তাকাবেন না!’
‘ কেনো তাকাবো না?’
‘ আমার দম বন্ধ হয়ে আসে! মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়! মনে হয় এই বুঝি নিউরনগুলোতে জট বেঁধে গেলো! এই বুঝি আমি মরে গেলাম!’
‘ আমি তাকিয়ে থাকলেই তুমি মরে যাও?’
আরশি দৃষ্টি নামিয়ে রেখেই মাথা দোলালো ওপর-নিচ! শেহজাদের অধরপুট একপাশে সরে এলো তার লাজবন্তীর পানে চেয়ে। তারপর আচমকাই… মুখ বাড়িয়ে ঠোঁট ছোঁয়াল মেয়েটার মোমের মতো গলায়! উত্তপ্ত ঠোঁটজোড়া আরশির গলার সাথে মিশিয়ে রেখেই শুধাল,
‘ আর কখন কখন মরে যাও তুমি?’
‘ আ-আমি বলতে পারবো ন!’
‘ মা আর রুশা অপেক্ষা করছেন না তোমার জন্য? উত্তর না দিলে আজকে ছুটি নেই তোমার!’

রাত জেঁকে বসেছে নিউইয়র্কের আকাশে। বেড়েছে দমকা হাওয়া। গরমকালে হুটহাট আকাশ ভেঙে বৃষ্টির নামার রীতি দেশের বাইরেও তাহলে এক? আয়ান বিশাল জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছোট করে শ্বাস ফেললো! হাতে ধরে রাখা ফোনের জ্বলজ্বলে স্ক্রিনে ভাসছে জারার মেসেঞ্জার। সেই কখন থেকে সে হাজারখানেক টেক্সট করে ফেলেছে মেয়েটাকে রুমের বাইরে আসতে বোলে! এখনো একটা মেসেজও সিন করলো না জারা?
মেঘেদের মন খারাপ হলে আকাশের যেমন বুক ভারি হয়? আয়ানেরও তেমন বুক ভারি হয়ে গেলো। কথা না হোক! শ্বশুরের হাতে বলির হওয়ার আগে বউয়ের মুখটা তো অন্তত দেখতে পেতো সে!

মেহমেদ হাসান মানুষ ভালো! তবে আয়ানকে আজকে যেনো সহ্যই করতে পারছেন না তিনি! বিশেষ করে জারাই যে রুশা এটা জানার পর থেকে তো তার এই ভ্রু কুঁচকে রাখার বাতিকটা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আয়ানকে যে মানুষটা সবসময় ইয়াং ম্যান, ইয়াং ম্যান বলে ডাকতো? সে যেন আজ তাকে শ্যুট করে দিতে পারলে বাঁচে।
পুলিশ হলেও গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো আয়ানের। মনের অলিতে গলিতে ঘুরলো গা ছমছমে অনুভূতিরা। ঠিক তখনই দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন মেহমেদ। মুখটা এমন যেনো মাত্রই তাকে কেউ বোরহানির নাম করে করলার জুস খাইয়ে দিয়েছে!

কপালে ভাজ ফেলে সে আয়ানের দিকে তাকাতেই ঘাবড়ে গেলো বেচারা। মাথা নিচু করে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে। যত যাই হোক! এখন এই রঘুডাকাত টাইপ চেহারা বানিয়ে রাখা মানুষটা জারার বাবা! শ্বশুরকে না পটাতে পারলে বউ হাতছাড়া হয়ে যাবে! এ যেন পুলিশের ট্রেনিং এর চাইতেও কঠিন যুদ্ধ।
মেহমেদ ভারি গলায় শুধালেন,
‘ অতো ঘামছো কেনো? ঘরের এয়ারকন্ডিশনে সমস্যা নাকি আমাকে তোমার বাঘ ভাল্লুক মনে হচ্ছে? কাছে আসো! কাছে এসে আমার পাশে বসো! তোমাকে আমার কিছু জিজ্ঞেস করার আছে!’
আয়ান সত্যি সত্যিই ঘামছিল। কপালে হাত দিতেই বুঝলো তার হাতের তালু অবধি ঘেমেনেয়ে অস্থির অবস্থা। আয়ান সেসবে গুরুত্ব না দিয়ে মেহমেদের পাশে গিয়ে সটান হয়ে দাঁড়াল। বসলো না! পাশে বসলে উনি যদি বলে বসেন শ্বশুরকে অসম্মান করছো? তোমাদের বিয়ে ক্যান্সেল!
আয়ানকে বুক টান টান করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেহমেদ তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠলেন,

‘ এখন এতো সম্মান দেখিয়ে লাভ আছে? তখন তো ঠিকই চোখ মেরেছিলে আমাকে! মনে নেই সে কথা?’
‘ আমি আসলে বাবা…!’
‘ কে তোমার বাবা? কল মি আঙ্কেল!’
আয়ান ভিতরে ভিতরে দাঁত পিষলেও মুখটা হাসি হাসি করে রাখলো। এখন মাথা গরম করা যাবে না! কুল ডাউন আয়ান! কুল ডাউন! বাটারফ্লাইয়ের জন্য তুই সব সহ্য করতে পারিস! সব!
‘ আমি তো আপনাকে চোখ মারিনি তখন!’
‘ তাহলে কাকে চোখ মেরেছিলে?’
আয়ান ফট করে বলে উঠলো,
‘ রুশাকে!’
আঁতকে উঠলেন মেহমেদ।
‘ তুমি আমার মেয়েকে চোখ মারো?’

আয়ান বলতে চাইলো, আরো অনেক কিছু করি রে মেহমেদ! তবে সেসব শুনলে নির্ঘাত তোকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে! তাই বলবো না!
আয়ান যথাসম্ভব নিজের ভদ্রভাবটা বজায় রাখলো। প্রসঙ্গে এড়াতে বিনয়ী হেসে শুধোলো,
‘ আপনি কিছু বলবেন বলছিলেন?’
মেহমেদ দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। তারপর একে একে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ কাল ডিউটি আছে তোমার?’
‘ আপনি এখনো একজন অন ডিউটি পুলিশের সাথেই কথা বলছেন! আপনাদের বাড়ির চারপাশ আমার টিমের লোকেরা পাহারা দিচ্ছে!’

‘ আর তুমি কাকে পাহারা দিচ্ছো? আমার মেয়েকে?’
‘ আদির মতো ধূর্ত একজন ক্রিমিনালের হাত থেকে আপনাদের পুরো পরিবারকে নিরাপদে রাখা আমার দায়িত্ব স্যার! তবে আপনি বোধহয় আমার প্রফেশনাল লাইফের সাথে পার্সোনাল লাইফটা গুলিয়ে ফেলছেন!’
‘ রুশা এদেশে আসার আগ অবধি তুমি অনেক ভদ্র ছিলে আয়ান!’
‘ আই স্টিল অ্যাম স্যার!’
‘ স্যার স্যার করবে না! কল মি আঙ্কেল!’
মেহমেদ তপ্ত চোখ চেয়ে নিজের হাত ঘড়িতে সময় দেখে বললেন,

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫২

‘ তোমাকে আমি আড়াই মিনিট সময় দিলাম! এই আড়াই মিনিটে তোমার সাথে রুশাকে বিয়ে দেয়ার একটা কারণ বলে দেখাও আমাকে! যদি বলতে পারো, তাহলে আগামীকাল তোমাদের বিয়ের কথা বার্তা পাকা করবো আমি! নয়তো কালকেই বেরিয়ে যাবে তুমি আমার বাড়ি থেকে! পুরো এক সপ্তাহ তোমার মতো বাঁদর কে সহ্য করা আমার পক্ষে অসম্ভব!’

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৪