নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৬

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৬
সিনথিয়া

“ইডিয়ট! কোনো কমনসেন্স নেই! এই বুদ্ধি ধার করে এসেছ তুমি অ্যাবরোড পড়াশুনো করতে?”
আরশি কিভাবে ঐ কিডন্যাপার লোকটার খপ্পরে পড়েছিল, সেটা শুনেই কথাগুলো বলল শেহজাদ। ফর্সা মুখশ্রীতে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। পারে তো গাড়ি থেকে এক্ষুনি ছুড়ে ফেলে দেয় মেয়েটাকে।
হঠাৎ করে শেহজাদের অমন কড়া কড়া কথায় ঐটুকু মন ভেঙে চুরচুর হয়ে গেলো আরশির।
শা শা গতিতে ব্রুকলিনের ব্যস্ত রাস্তায় ছুটছে ওদের গাড়ি।
জানালা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া এসে ভিড়েছে আরশির খোলা চুলে। এলোমেলো উড়ছে সেগুলো।
মেয়েটা একহাতে কিছু চুল কানের পিছনে গুঁজলো৷ বুকে চিবুক ঠেকিয়ে মিহি স্বরে বলল,
“আমি ধার করে কেন আনবো বুদ্ধি?”
“ও তারমানে কিডন্যাপারের গাড়িতে নিজের বুদ্ধিতে উঠে ছিলে?”
“আপনি কিন্তু-”
আরশির ক্ষীণ প্রতিরোধ শুনতে পেলো না বোধ হয় শেহজাদ। অমন ভাবেই বলল,

“এরকম জানলে আমি ভুলেও তোমাকে বাঁচাতে আসতাম না! তুমি আসলে বয়সেই বড় হয়েছ আরশি! হাবভাব এখনো ছোটবেলার মতোই রয়ে গেছে তোমার।
মাথায় একটুও বুদ্ধি নেই!
যেখানে মানুষ একা বাসে ওঠার সাহস পায় না, সেখানে উনি গেছেন অচেনা একটা মানুষের গাড়িতে উঠতে!
আমি সময়মতো না আসলে তো
আরেকটু পরই হাত-পা, কিডনি সব ভাগাভাগি হয়ে যেতো!”
ভাগাভাগির কথা শুনেই ঠোঁট উল্টালো মেয়েটা। কোথায় ভেবেছিল, এই বুঝি জাম্বুবানটা ডিপজল থেকে মান্না হয়ে গেছে!
আর বুঝি বকবে না আরশিকে। মাথা টা বুকের সাথে মিশিয়ে ড্রাইভ করতে করতে বাসায় নিয়ে যাবে, তারপর
ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখবে সারাদিন।
কিন্তু আরশির ভাবনায় এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে লোকটা কি করলো? খ্যাঁক খ্যাঁক করা শুরু করলো। এখন ও বুঝতে পারছে, কেনো জাম্বুবানটা জখম হাত নিয়েও তখন একা ড্রাইভ করতে পারবে বলেছিল?
মেয়েটা চোখ ছোট ছোট করে মনে মনে দু’হাত কোমরে রেখে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ওরে জাম্বুবানের ঘরে জাম্বুবান! এই ছিল তোর মনে? আমায় ভুলিয়ে ভালিয়ে গাড়িতে তুললি এখন বকাবকি করবি বলে?
তুই জানিস? আরেকটু হলে তো আমার প্রাণটাই চলে যাচ্ছিল ঐ কিডন্যাপারের হাতে! আর কার জন্য যাচ্ছিল? তোর জন্যই তো!”
শেহজাদ স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাতে গিয়ে রিয়ারভিউ মিররে তাকালো। নীলাভ চোখজোড়া খুব সন্তর্পণে দেখলো মেয়েটার রাগে কটমট করতে থাকা চোয়াল।
পান্ডুর মুখখানা লাল হয়ে ফুঁসছে।
শেহজাদ মুখের দুর্বোধ্য হাসিটা আড়াল করে আবার কন্ঠে গাম্ভীর্য এনে বলল,
“আজ যদি কোনো খারাপ কিছু ঘটতো, তাহলে সেটার দায়ভার কাকে নিতে হতো? অবশ্যই আমাকে! আঙ্কেল আন্টিকে আমি কি
জবাব দিতাম তখন?”
এবারটাও মুখ খুললো না আরশি। কিন্তু মনে মনে শেহজাদের চৌদ্দ গুষ্টির এক একজনকে ধরে ধরে বকে দিলো, এই ছেলের মুখে ছোটবেলায় মধুর বদলে করোলার রস দেয়ার জন্য৷
এই যে আরশির কপাল কেটে গেছে! কই সেটা তো একবারও নজরে পড়লো না লোকটার। না একটু ফু দিয়ে দিলো সেখানে।

না একটু আদর! কিন্তু বকা দেয়ার বেলায় এক পায়ে খাঁড়া।
ম্যানহাটন থেকে ব্রুকলিন যেতে যতটা সময় লেগেছিল শেহজাদের, তার চাইতেও যেনো দ্রুত এসে পৌঁছালো ওদের এপার্টমেন্টের সামনে।
দু’জনে একসাথে বাসায় ঢুকলেও শেহজাদ আরশিকে বসার ঘরে ফেলে রেখেই ধুপধাপ পা ফেললো নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে।
আগের থেকেও মনটা খুব করে খারাপ হলো আরশির। ভাবলো এই বুঝি আবার শুরু হয়ে গেছে লোকটার ডিসট্যান্স মেইনটেইন করার বাতিক।
মৃদু কালো চোখজোড়া মেঘাচ্ছন্ন হলো নিমিষেই। সেখান থেকে ঝুপ করে এক পশলা বৃষ্টি নেমে ভিজিয়ে দিলো ওর নরম গাল।

যতবারই ও আঁকড়ে ধরতে চাইবে, ততবারই কি লোকটা এভাবে পালাই পালাই করবে? বেশ! তাহলে এখন থেকে আরশিও শক্ত হবে। আত্মসম্মান ওরও আছে। শুধু শুধু কেনো একটা লোকের অবজ্ঞা সহ্য করবে ও?
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানিটুকু মুছতে মুছতেই ভাবলো মেয়েটা।
আরশির রুম শেহজাদের রুমের উল্টো দিকে। সেদিকে পা বাড়াতে গেলেই পেছন থেকে ‘আরশি’ বলে ডাকলো শেহজাদ।
ডাক শুনেই পিছন ঘুরে তাকালো ও। হরিণের মতো চোখে বিস্ময়ের পাহাড়।
শেহজাদকে হাতে ফার্স্ট এইডের বক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেই বিস্ময়ের পাহাড় আকাশ ছুঁলো আরশির।
মুখ খোলার আগেই লম্বা পা ফেলে পাশ কাঁটায় মানুষটা। সোজা গিয়ে বসে ওর বিছানায়। পাশে হাত রেখে বলে,
“কি হলো! দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বোসো এখানে এসে।”

নির্লিপ্ত কণ্ঠে বিভ্রম কাঁটে আরশির। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বসে শেহজাদের পাশে।
মানুষটার সম্পূর্ণ মনোযোগ তখন তুলোতে অ্যান্টিসেপটিক লাগানোয় ।
নিমিষেই শেহজাদের ওপর হওয়া অভিমান হাওয়াই মিঠাইয়ের ন্যায় মিলিয়ে যায় মেয়েটার।
পলকহীন চোখে নির্নিমেষ চেয়ে রইলো সামনে বসা সেই পুরুষটির পানে। কি নিখুঁত! পলক ফেলতে মনেই চাইলো না আরশির। মন বললো, আরেকটু চেয়ে দেখি তো! যদি একটু প্রেম খুঁজে পাই নিজের জন্য ঐ চোখে!
তখনই আরশির দিকে মুখ তুলে চাইলো শেহজাদ। সমুদ্রের মতো গভীর চোখ জোড়া
জায়গা করে নিলো আরশির চোখে।
ঢোক গিলল সে। তবুও একটু এগিয়ে এসে অ্যান্টিসেপটিক লাগানো তুলো দিয়ে মুছে দিলো আরশির কপালের কাটা জায়গা।
চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো আরশি। হাত দুটো শক্ত করে খামচে ধরলো বিছানার চাদর।
“ব্যাথা লাগছে?”
শেহজাদের উদগ্রীব কন্ঠস্বর। আরশির উত্তর শোনার অপেক্ষা না করে নিজেই ফু দিতে লাগলো কপালে। পরপর অ্যান্টিবায়োটিক

ক্রিম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো কাঁটা জায়গাটাতে।
এখনো চোখ বন্ধ মেয়েটার। পৃথিবীর সমস্ত ভালোলাগা যেনো এসে ভর করেছে সামনে থাকা মানুষটার ছোঁয়ায়। মুখ জুড়ে তৃপ্তির বিস্তর হাসি। মনে মনে শেহজাদের তিন বাচ্চার মা হওয়ার স্বপ্নে যখন বিভোর ও,
তখনই চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে
শেহজাদ বলে উঠলো,
“পাগলের মতো হাসছো কেনো চোখ বন্ধ করে ?”
তড়াক করে চোখ মেলে চাইলো আরশি।
শেহজাদের চোখে চোখ পড়তেই মুখ নামিয়ে দু’দিকে মাথা নাড়লো সজোরে। অন্য দিকে চেয়ে মিহি স্বরে বলল,
“কি-কিছু না”
কিন্তু লজ্জার প্রকোপে সেই কথা গলা দিয়ে বের হলে তো! আরশির হাব-ভাবে শেহজাদের ভ্রু জোড়ার মাঝে সন্দেহের ভাজ পড়লো। তৎক্ষনাৎ একটু দূরে সরে গিয়ে তাড়াহুড়ো দেখিয়ে বলল,
“আজ আর রান্না-বান্না করতে হবে না! আমি বাইরে থেকে অর্ডার করে দিচ্ছি খাবার! ঠিক আছে? ”
আবারও অমন লজ্জা লজ্জা মুখে মাথা হেলালো আরশি।
কিন্তু শেহজাদ পাশ থেকে উঠে যেতে নিলেই বিদ্যুৎ বেগে ধরে ফেললো শক্ত-পোক্ত হাতটা।
গুরুজনদের মতো মুখ করে বলল,
“আপনি কোথায় যাচ্ছেন! চুপচাপ বসুন এখানে!”

বিস্ময় সামলাতে না পেরে আবারও ধপ করে বসে পড়লো শেহজাদ। বাই এ্যানি চান্স, আরশি কি ওকে চোখ রাঙিয়ে শাসন করলো এই মাত্র?
আরশিকে বড়সড় একটা ধমক দেবে ভেবে মুখ খুলতেই দেখলো মেয়েটাও ঠিক ওর মতো করেই তুলোতে অ্যান্টিসেপটিক লাগাচ্ছে।
পরপর শেহজাদের জখম হওয়া হাতটা টেনে নিলো নিজের কোলে। খুব যত্নে ক্ষত হওয়া জায়গাটা মুছে ক্রিম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো। মুখে হাসি মেখে বলল,
“ নিন! হয়ে গেছে! আপনারও যে হাতে লেগেছিল সেটা কি ভুলে গেছিলেন নাকি?”
শেহজাদ তখনও আরশির মুখ পানে চেয়ে।
মোহগ্রস্তের ন্যায় আওড়ালো,
“ভুলে গেছিলাম?”
পরপর সতর্ক হলো কন্ঠস্বর। আরশির থেকে চোখ সড়িয়ে ব্যান্ডেজ করা হাতের দিকে তাকালো। মেয়েটার জন্য হওয়া অদ্ভূতুড়ে অনুভুতির থেকে পালাতে তড়িঘড়ি বলল,
“কে-কে বলেছে ভুলে গেছিলাম!
মোটেই না! রুমে গিয়েই ব্যান্ডেজ করে নিতাম আমি।”

এন্ড লিসেন! কিডন্যাপ হয়ে গেছিলে মানে এই নয় যে, আমি আমার সব শর্ত তুলে নিয়েছি! বিহেভ ইয়র সেল্ফ আরশি! যখন তখন আমার হাত ধরে টানাটানি করা বন্ধ করো!”
কথাগুলো বলেই ঝড়ের বেগে রুম হতে বের হতে নিলো শেহজাদ।
আর তখনই তাড়াহুড়োতে কপাল গিয়ে ঠুকলো আরশির রুমের দরজায়। কপালে হাত দিয়েই ছিটকে পিছনে চলে আসলো দুকদম লোকটা। পরপর আবার আড়চোখে দেখেও নিলো আরশিকে একটু।
ব্যাথা পেয়ে টা-টু শব্দ না করে,
ব্যগ্র কদমে ওভাবেই রুম ছাড়লো মানুষটা।

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫

শেহজাদ রুম থেকেই বের হতেই ফিক করে হেসে ফেললো আরশি। মনে মনে ভেঙিয়ে বলল-
“হাত ধরে টানাটানি করতে বারণ করলেন তো! বেশ করবো না না হয়! কিন্তু আপনি যে আমার মন নিয়ে টানাটানি শুরু করেছেন, তার কি হবে মিস্টার নাকউঁচু জাম্বুবান?

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৭