পাতা বাহার পর্ব ১১ (২)

পাতা বাহার পর্ব ১১ (২)
বেলা শেখ

মেঘাচ্ছন্ন বিকেল। আকাশে মেঘমল্লার ঘুরে বেড়াচ্ছে সকাল থেকেই! হালকা বেগে বাতাস বইছে ধরনীর বুকে। সারি সারি ধান ক্ষেত যেন দলীয় নৃত্য পরিবেশন করছে! দলে দলে পাখির ঝাঁক উড়ে বেড়াচ্ছে! ছোট বড় অনেকেই ঘুড়ি, গুড্ডি , কয়ড়া উড়াচ্ছে লাটাই হাতে। মেঘাচ্ছন্ন দিগন্তের বুকে রঙ বেরঙের ঘুড়ি দেখতে বেশ লাগছে! বড় কয়ড়া দিগন্তে জুড়ে ভো ভো শব্দের সমাহার সৃষ্টি করছে। পাখির দল ভয়ে হয়তো সেদিকে যাচ্ছেই না! সাদা বকের এসবে ভয় নেই বোধহয়। বক উড়ে কয়ড়াতে বসছে তো গুড্ডিতে ঠোকড় দিচ্ছে। আবার নিচে নেমে ধানক্ষেতে সার, বিষ ইত্যাদি সাইনবোর্ডের উপর চুপটি করে বসে আছে মাছের খোঁজে। দেখতে পেলেই খপ করে মুখে পুরে নিতে দেড়ি নেই!

শুকলা মন্ডল সহ এলাকার কিছু লোক পাতাদের বাড়ির একটু দূরে মাচায় বসে সিগারেট ফুঁকছে! একটু আগে শুকলা সহ সকলের তীক্ষ্ণ নজর পাতা আর অচেনা লোকের দিকেই নিবদ্ধ ছিল। দূর থেকে সব পর্যবেক্ষণ করেছে‌ ‌। তাদের আলাপ আলোচনা কানে না আসলেও সন্দিহান হয়ে চেয়েছিল সকলে। শুকলা শয়তানি হেসে সিগারেটের ধোঁয়া নাক মুখ দিয়ে বের করে শূন্যে ছুড়ে বলে,
-” ওই সাহেব গোছের লোকটা কেডা? বড় গাড়িও আছে। দেখে ভালো বংশের লাগছে। আমার জানামতে আতিকের এমন উচ্চবিত্ত কোনো আত্মীয় নাই ! তাইলে কেডা?”
আরেকটা লোক বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” হবে হয়তোবা দুঃসম্পর্কের! তয় ওই মাইয়া পাতার সাথে এমন রঙ তামাশা করছিল কেন? এটা শহর না! যে যা মনে চায় তাই করবো! চক্ষু লজ্জার একটা ব্যাপার আছে না?”
সবাই সায় জানালো। পাতা তখন লোকটার অনেকটা কাছে গিয়েছিল। হাতও ধরেছিল যেটা তাদের দৃষ্টিতে কটু লেগেছে।
আরেকটা লোক বলল,

-” মেয়েটাকে নম্র ভদ্রই মনে হয়! আমরা দূর থেকে দেখেছি তাই হয়তো অমন লেগেছে! আর লোকটা তাদের আত্মীয় হওয়ার চান্স বেশি ওদের বাড়ি থেকেই বের হলো তো!”
শুকলা মন্ডল সিগারেটের শলাকা ফেলে পায়ে পিসলেন। শালি তাকে সবার সামনে মেরে অনেক বড় বিপদ ডেকে এনেছে! তুই বুঝতেই পারবি না শুকলা তোর জীবনে কি ঝড় বইয়ে আনে!
-” শোন শামছুল যে বেশি ভদ্রতা দেখায় তার মধ্যেই ঘাপলা আছে! ম্যানা রাই ত্যানা ছেড়ে যানো না? ওই মাইয়ার জন্মেরই তো ঠিক নাই বোধকরি! দেখ না, আতিকের ভায়রা ভাইয়ের ঘরেই বড় হইছে! মেয়ে বানাইয়া নিয়া গেছিল না? ফিরাইয়া দিল ক্যা? নিশ্চয়ই কোনো অকাম কুকাম করছিল! মাইয়াডার বয়সও তো ম্যালা! পচিশ ছাব্বিশ! অথচ বিয়া হওয়ার নাম নাই! দেখতে সুন্দর হলে কি হইবো চরিত্রের ঠিক নাই! শহরে যায়, না জানি কি কাম কাজ করে! সত্যিই মাস্টারি করে নাকি কারো বিছানা.. থাক সেসব না বলি!”

সবাই শুকলার দিকে চায়। একজন চরিত্রহীন লোক অন্যের চরিত্র নিয়ে কথা বলছে! উপস্থিত সকলেরই শুকলার চরিত্র সম্পর্কে অবহিত! তবে কিছু বলল না। পাতা মেয়েটার দিকেও একটু নজর দিতে হবে! যদি খারাপ কিছু পায় তো শালিশ বসাতে সময় নেবে না। দরকার হলে এক ঘরে করে দেবে আতিক দের। তাদের গ্রামে এসব নোংরামি চলবে না।
অথচ তারা গ্রামবাসি এটা ভাবেই না শুকলা চরিত্রের ঠিকানা নেই। সে অন্যের চরিত্রের ইজহার করে! আর মেয়ের চরিত্রে সমস্যা হলে তার নামে শালিশ বসাতে হবে ,এক ঘর করে দিবে। সেখানে শুকলার মতো কত শত ছেলের চরিত্রের গুনাগুণ জেনেও চুপ রয়!

ঠান্ডা বাতাস পাতার শরীরে বাড়ি খাচ্ছে। সে এখনো দাঁড়িয়ে সে জায়গায়। লোকটা তার সামনে তাকে ব্যাঙের বাচ্চা আবার বিড়ালের বাচ্চাও বলে দিল! না সে ব্যাঙের মতো লাফায় না বিড়ালের মতো মিও মিও করে খামচি দেয়! তবে? কোন লজিকে বলে দিল! শালা তুই বিড়ালের বাচ্চা! না বিড়াল কিউট হয়! তুই একটা ক্ষ্যাপা ষাঁড়! সাথে মহিষও! মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে পাতা বাড়ির ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ড্রয়িং রুমে সবাই আলোচনা করছে কিছু বিষয়ে ‌ পাতা কিছু বুঝতে পারলো না। লাবিবের কাছে গিয়ে তাকে ধীরে বলে,
-” কি নিয়ে আলাপ চলছে বোনের ছেলে?”
লাবিব মিটমিট করে হেসে বলে,
-” তোমার বিয়ের আলাপ চলছে মায়ের বোন!”

পাতার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে কথাগুলোতে মনোযোগী হয়। পাতার বিয়ের কথা শুনলে লজ্জা লাগলেও লজ্জার থেকে বেশি ভালোলাগে! ইশ কবে তার বিয়েটা হবে! একটা জামাই হবে! সে কাপল‌ পিক তুলে ফোনের ওয়াল পেপারে দিবে! ফেসবুকে মেরিটাল স্টেটাস দেবে! #পাতার_জামাই ! জামাইকে ভালোবেসে বুকে না, মাথায় তুলে রাখবে সে!বিয়ে ও বিয়ের পর তার সব প্ল্যান তৈরি আছে। শুধু জামাই ও কাজির অপেক্ষায়! পাতা মনে মনে আল্লাহকে স্বরণ করে, “হে উপর ওয়ালা ! আমার জামাইটাকে জলদি আমার বাড়ির আঙিনায় পাঠিয়ে দিও! জামাই ছাড়া আর কতকাল থাকবো! জামাই হীনা দিন দিন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছি যে! জলদি পাঠিয়ে দাও। তবে সাবধানে হ্যা জামাই না আবার ভুলে অন্যের বাড়ির আঙিনায় চলে যায়!”
পাতা সবার সামনে স্বাভাবিক মুখে থাকলেও ভিতরে লুঙ্গি ডান্স দিচ্ছে। মেয়েদের ব্যাপারে একটা সত্যি কথা হলো এরা বাইরে যতোই না না করুক বিয়ে করবো না হ্যান ত্যান অথচ এরাই মনে মনে জামাইয়ের জন্য বিরহে কাতর হয়ে থাকে!!
লাবনী আক্তার রুম্পাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লতা লুবমান ডাবল সোফায় বসে।আতিকুর ইসলাম পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” একটা প্রস্তাব এসেছে তোমার জন্য! ছেলেও তোমার মতো টিচার নাম আব্দুল করিম! হাই স্কুল লেভেলের! বেসরকারি স্কুল কিন্তু পারমানেন্ট চাকরি! খন্ডকালীন নয়! ছেলে তোমাকে দেখেছে কোথাও। ওর পরিবার খোঁজ খবরও নিয়েছে টুকটাক। ওদের থেকে হ্যা বলাই চলে। ওরা আসবে হয়তোবা! তবে এখন না কিছু দিন পরের কথা বলল। ছেলের বোন জামাই আসলে! দেখ তুমি আমার দায়িত্ব! আমি যথাযথ ভাবেই পালন‌ করতে চাই! ছেলেটা ডিভোর্সি নয়! আর যৌতুকের কথা এখনো বলে নি। আমি আর এই প্রস্তাব হাতছাড়া করতে চাইছি না! তুমি কি বলো?”

পাতার হাসিখুশি মনটা নিমিষেই বিষিয়ে যায়। সে শুধু দায়িত্ব? তাদের মেয়ে না? তাদের উপর বোঝাসরূপ যাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় করতে চায়! পাতার আঁখি ভরে ওঠে নোনাজলে‌‌। সে মুচকি হেসে আতিকুর ইসলামকে বলে,
-” আব্বু তোমরা যা ভালো মনে হয় কর! তবে সবটা তাড়াতাড়ি কর কেমন? অন্যের দায়িত্ব হয়ে আর থাকতে মন চায় না!”
বলে হন হন করে নিজের রুমে যায়। সে শুধু সকলের দায়িত্ব! তবে সে মনে মনে চায় যে তার জীবনে যে আসবে সে তার যেন শুধু দায়িত্ব না হয়!

সরকার বাড়ির আঙিনায় দুই তিনটা কোকিল ডাকছে অবিরত। কু কু ধ্বনিতে ভরে গেছে আছে আশ পাশ! একটা কোকিল গলা ছেড়ে কুহ বলছে তো আরেকটা তার চেয়েও উঁচু গলায় কুহ বলছে‌। এভাবে অনবরত হাক ছেড়ে ডেকে যাচ্ছে। যেন কোমড় বেঁধে ঝগড়া করছে একে অন্যের সাথে। মাঝে মাঝে অন্যান্য পাখির গলাও ভেসে আসছে। ভোর গাড়ি থেকে নেমে গলা চড়িয়ে ‘ কুহ কুহ’ ডাকে। কোকিলের দল খানিক চুপ থেকে একসাথে বলে কুহ। ভোর হেসে উঠে আবার কুহ বললেও পাখিও বলে। ভোর অরুণের হাত ধরে বলে,
-” আব্বু দেখ আমি পাখির সাথে কথা বলতে পারি! আই হ্যাভ সুপার পাওয়ার!”
অরুণ ছেলের হাত ধরে ভিতরে নিয়ে যেতে যেতে বলে,

-” ইয়েস ইউ হ্যাভ!”
ভোর খুশি হয়ে বাবার সাথে পা মেলালো। অরুণ ,ভোর মেইন ডোর পেরিয়ে একটু দুরত্বে ড্রয়িং রুমের দিকে যায়। সেখানে আসমা, রুবি, আরিয়ান,আনিকা,আদুরি বাদেও দুটো পরিচিত মুখ দেখতে পায়‌ ভোর বাবার হাত ছেড়ে দৌড়ে তাদের কাছে যায়। অরুণ গম্ভীর মুখে তাদের সামনে বসে বলে,
-” মামা ভাগ্নি একসাথে? আমি বিনা দাওয়াতে মেহমান খাওয়াতে পছন্দ করি না। যা ফুট?”
শুভ হেসে ভোরকে কোলে বসিয়ে আদর করে বলে,
-” বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি! মেহমানকে এখানে? আমি তো দেখতে পাচ্ছি না! ভোর বাবা তুমি দেখতে পাচ্ছ?”
ভোর হেসে মাথা নাড়ায় সে দেখতে পাচ্ছে না! আসমা বেগম হেসে বলে,
-” হ্যা নিজের বাড়ি বলেই তো মাসের পর মাস পেরোয় অথচ দেখা পাওয়া যায় না!”
শুভ হেসে বলে,

-” আন্টি বউ বাচ্চা কাজ নিয়েই পড়ে থাকতে হয়! নিজের জন্যই সময় নেই! তবে সময় পেলেই আমিই আসি কিন্তু! আপনারা তো ভুলেও যাবেননা! গরিবের বাড়ি কিনা!”
আরিয়ান সোফায় গা এলিয়ে বলে,
-” হ্যা শুভ ভাই উত্তরায় পাঁচ তলা বাড়ির মালিক দুটো লাক্সারি কার! ভার্সিটির প্রফেসর যে প্রায় লাখ টাকা বেতন পান! সেরকম গরীব!”
আদুরি ভাইয়ের কথায় তাল মেলায়।
-” ছোট ভাইয়া তুমি ভাবীর কথা ভুলে যাচ্ছো! তিনি তো একজন স্বনামধন্য রেস্টুরেন্টের মালিক! ওদের গরীব বলা যায় না! তার থেকেও খারাপ অবস্থা!”
রুবি হেসে উঠলো।
-” ভাইয়া এমন গরীব বাংলার ঘরে ঘরে হোক!”

শুভ ঠোঁট কামড়ে ধরে দাঁত দ্বারা। কেন বলতে গেল! এরা সবাই এখন তার খিল্লি উড়াবে! অরুণ মিনুকে ডেকে বলে,
-” মিনু আপা গরীবদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করো! আর এই গরীবের ঘরে গরীব রুমে চল? আর ভোর টুম্পা আপুকে নিয়ে স্টাডি রুমে যাও! শনিবার থেকে এক্সাম তোমার!”
ভোর টুম্পার হাত ধরে নিয়ে যায়। টুম্পা মুখ গোমড়া করে পা চালায়! ভোরের মা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে অথচ আপু বনে গেল! এই মি. অরুণ সরকারকে মামার বন্ধুই হতে হলো! অবশ্য মামার বন্ধু না হলে পরিচয়ও হতো না হয়তো!
অরুণ উঠে অনিকার গালে চুমু দিয়ে নিজের রুমে যায়। শুভ সকলের সাথে আরো কিছু সময় কথা বলে সিঁড়ি বেয়ে অরুণের রুমে আসে। নক না করেই ধরাম করে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখল অরুণ তোয়ালে পড়ে প্যান্ট পড়ছে! শুভ দুষ্টু হেসে এক হাত চোখের উপর রেখে বলে,

-” দেখে ফেলেছি!!”
অরুণের ভাবান্তর হয় না। প্যান্ট উপরে তুলে তোয়ালে খুলে শুভর দিকে ছুড়ে মারে। চেন লাগিয়ে বলে,
-” দেখবি আর জ্বলবি লুচির মতো ফুলবি!”
শুভ বুঝলো না। সে কেন জ্বলবে!
-” কেন? বুঝলাম না!”
অরুণ কিছু বলে না ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে অল্প। আলমারি খুলে টি শার্ট বের করে পড়ে নেয়।
শুভ কোমড়ে হাত দিয়ে ছোট ছোট করে চায়!
অরুণ শুভর ঘাড়ে থেকে তোয়ালে নিয়ে বলে,
-” কি দেখছিস? আই হ্যাভ নো ইন্টারেস্ট ওন ম্যান! মেয়ে হলে ভেবে দেখতাম! ”
শুভ অরুণের পিঠে একটা লাগায়।
-” শালা! তোর হাবভাব ভালো না। ভালো একটা পাতা দেখে বিয়ে কেন করছিস না?”
অরুণ তোয়ালে বেলকনির চেয়ারে রেখে এসে বলে,
-” তুই জানিস কি না ! বাট তোর ভাগ্নি টুম্পা ক্রাশড ওন মি! এন্ড ওলসো লাভ মায় চাইল্ড! তার সাথে হলে কেমন হয়?”

শুভর চোখ রসগোল্লার ন্যায় হয়ে যায়! অরুণ সিরিয়াস হয়ে বলে,
-” দিবি না? কেন? দেখ শুভ! তুই যেমন তোর অবিবাহিত ভাগ্নিকে এক বাচ্চার বাপের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হবি না! তেমনি মিস পাতা বাহারের পরিবারও নিশ্চয়ই সেটা চাইবে না! তাই বাজে কথা বলে মাথা গরম করাবি না!
শুভ খানিকক্ষণ চুপ থেকে অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-” দিব! যদি টুম্পা ও তুই দুজনেই চাস! আই হ্যাভ নো‌ প্রবলেম! তুই কি চাস?”
অরুণ গম্ভীর মুখে বলে,
-” আর ইউ ম্যাড! তোর ভাগ্নি আমারও ভাগ্নি!আর তুই দিবি বললেই তো হবে না! তোর বোন‌ বোন‌ জামাই?”
শুভর মুখ চুপসে যায়। অরুণ হেসে বলে,

-” হয়েছে থাম ভাই! মুখ গোমড়া করিস না! কথায় আছে না? যদি থাকে নসিবে হেঁটে হেঁটে আসিবে! আই মাস্ট প্রেয়ার ভাগ্য যদি আবারো কারো সাথে জুড়ে দেয় সে যেনো আমার কলিজাটাকে একটু ভালোবাসে!”
শুভ মাথা নাড়িয়ে বলে,
-” হুম বুঝলাম! আন্টিরা একটা মেয়ে দেখেছে! শ্রাবনী আহসান নাম! ডিভোর্সি! তোর সাথে কথা বলবে এ ব্যাপারে! আমি ছবি দেখলাম বেশ ভালোই দেখতে!”
অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-” মেয়ে পছন্দও করে ফেলেছে! নট ব্যাড! বাট আগে আমি তার সাথে দেখা করতে চাই। কথা বলে নিতে চাই।”
-” ওনারাও এমনটাই ভেবেছে। আগে তোরা দেখা করবি একে অপরকে জানবি দেন এগোবি!”
অরুণ মাথা নাড়ে। তার বুকটা কেমন ভার ভার লাগছে। যেন কিছু বোঝা বেঁধে রাখা হয়েছে! কি হতে চলেছে ভবিষ্যতে?

পাতা নিজের রুমে বসে আছে। এমনি বসে আছে শুন্যে তাকিয়ে। তার মনটা ভিষণ খারাপ! কান্না পাচ্ছে কেমন যেন! কিন্তু কাঁদতে পারছে না। চোখ দিয়ে অমূল্য সম্পদটা বেরোচ্ছে না। পাতা হাত বাড়িয়ে জানালাটা খুলে দেয়। সাথে সাথে শীতল বাতাস বেয়ে আসে। ঘুটঘুটে অন্ধকার বাইরে। কেমন ভুতুড়ে পরিবেশ। ঝিঁঝিঁ ডাকে অবিরত। সাথে ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাক। ব্যাঙ থেকে মনে আসে ভোরের আব্বুর কথা! তাকে ব্যাঙের বাচ্চা বলেছিল! ভাবতেই হাসি পেল! অন্ধকারে তাকাতেই গা ঝেড়ে ওঠে। ঝটপট হাত বাড়িয়ে জানালা লাগিয়ে বুকে থুতু দেয়। সাথে সাথেই দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ আসে। পাতা ভয়ে ‘ও মা গো’ বলে লাফিয়ে ওঠে। ভুত বলতে কিছু হয় না এটা সে দিনের বেলায় ষোলো আনা বিশ্বাস করলেও রাতে এক আনাও করে না। তার চিল্লানো শুনে লতা দরজা আরো জোরে ধাক্কা মেরে বলে,

-” ভুত নই আমি! তোর জামাইয়ের শালী হই।দরজা খোল পাতু!”
পাতা খানিকটা দাঁড়িয়ে থাকে। সে শুনেছে ভুত চেনা মানুষের রূপেও আসতে পারে! তাই দরজায় কান লাগিয়ে অনুভব করে সত্যিই ভূত কি না! পরে ভাবে ভুত হলে তো দরজা ধাক্কানোর প্রয়োজন ছিল না। হাওয়া হয়েই ভিতরে আসতে পারতো। আপুই হবে! তাই দরজা খুলে দিল। লতা কটমট করে চেয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে ভিতরে ঢোকে।
-” এত বড় ধামড়ি মেয়ে কি না ভুতে ভয় পায়! লোকে শুনলে হাসবে!”
পাতা দরজা বন্ধ করে লতার দিকে চায়। বালিশ নিয়ে এসেছে। তার সাথে ঘুমাবে কি?
-” হ্যা তোর সাথেই ঘুমাবো!”
পাতা খুশি হয়।
-” সত্যিই?”
-” না মিথ্যে। বিছানা ঠিক কর জলদি?”

পাতা বিছানা ঠিক করে। লতা মেয়েকে একপাশে শুয়ে দিয়ে মাঝখানে শোয়। পাতার ঘুম খুবই জঘন্য! পাতা এসে বোনের ওপাশে শুয়ে জড়িয়ে ধরে পা তুলে দেয়! লতা ছ্যাত করে ওঠে।
-” এই ছাড় ছাড়! গরমের ভিতর গা ঘেসছিস কেন? আর পা নামা?”
পাতা সরে না। না পা নামায়।
-” ওমন করছো কেন? হুম! দুলাভাই ধরলে নিশ্চই এমন করো না!”
-” সে ধরলে ভালো লাগে। কুলম্বের সূত্রে বিপরীত আধান আকর্ষণ করে পড়িস নি! আর সম আধান বিকর্ষণ!”
পাতা তবুও ছাড়ল না। লতা হেসে বোনকে জড়িয়ে নেয়। ছোট থেকেই পাতাকে সে অনেক স্নেহ করে। পাতাকে মা বাবা খালাকে দিলে সে অনেক কেদেছিল। তার বোনকে কেন ওরা নিয়ে গেল!

-” পাতা বিয়ের কথা শুনে মনে মনে লাড্ডু ফুটছে তাই না? আমি জানি তুই খুব বিয়ে পাগলা!”
পাতা মলিন হাসে।
-” হুম আপা। আমি নিজের একটা ব্যাক্তিগত মানুষ চাই। যার সবটা জুড়ে আমি থাকবো। আমাকে দায়িত্ব না ভালোবাসার চাদরে মুড়ে নিবে! একটু স্বস্তির জীবন দিবে।শত ব্যস্ততার ভিড়েও একটু কেয়ার করবে। যেখানে সেখানে আগাছার মতো যেন থাকতে না হয়! কিছু দিন এ বাড়ি তো কিছু দিন ও বাড়ি । আমি আর কারো বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। না তোমার আব্বুর না প্রিয়োর আব্বুর!”

-” আব্বু?”
-” ঘুমোওনি?”
ভোর বিড়াল ছানার মতো অরুণের বুকে আরেকটু সেটে যায়‌। অরুণে কম্ফোর্ট দিয়ে ছেলেকে ভালোমতো জড়িয়ে নেয়। পাতাবাহার নামক বিড়ালটি কম্ফোর্টের ভিতরে অরুণের পায়ের কাছে ঘেঁষে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে মিও মিও করছে।
ভোর জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস টানলো।
-” ঘুম ধরছে না!”
অরুণ ছেলের চাঁদ মুখখানি আঁজলা ভরে বুক থেকে সরিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে,
-” কি হয়েছে কলিজাটার? ঘুম আসছে না কেন আজ? দিনেও তো ঘুমাও নি? ক্ষিধে পেয়েছে? কিছু খাবে? আমি বানিয়ে আনি?”
ভোর কেঁপে ওঠে।

-” নাহ। ভালো লাগছে না আব্বু!”
অরুণ হাত বাড়িয়ে রিমোট খুঁজে লাইট জ্বালায়। লাইটের আলোয় ভোরের চোখ ছোট ছোট হয়ে যায়। বিড়াল শাবকটি কম্ফোর্টের ভিতর থেকে বেরিয়ে ভোরের কাছে গিয়ে মিও মিও করে। অরুণ তাকে সরিয়ে বলে,
-” এই পাতাবাহার! সরো? যাও শুয়ে পড়ো?”
বিড়ালটা একটু সরে বসে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। অরুণ ছেলেকে বলে,
-” আব্বু? কি হয়েছে তোমার?”
-” ভালো লাগছে না!”

অরুণ যেন অস্থির হয়ে পড়ে। কি হলো ছেলেটার! ভালো লাগছে না কেন? ঠিকই তো ছিল বিকেলৈ শুভ টুম্পার সাথে অনেক মজা‌ করেছে। আনিকার সাথে পুতুলও খেলেছ। রুপকে কোলে নিয়ে আদর করেছে। সবার সাথে হাসিখুশিই ছিল! হঠাৎ? ভোরের গালে মুখে অসংখ্য চুমু দিতে দিতে বলল,
-” আব্বু? কলিজা? আমার সোনা বাবা! কি হয়েছে? মন খারাপ কেন? খারাপ লাগছে? আমরা কার্টুন দেখি চলো?”
ভোর মাথা নাড়ে। দেখবে না। অরুণ নিজেকে শান্ত করে ভোরের দিকে চায়‌ ভোর চুপটি করে তার দিকেই চেয়ে।
-” আব্বু সবার মা কত ভালো! রোহানের আম্মু রোহানকে ভালোবাসে। চাচিমনিও আনি , রূপকে কত ভালোবাসে! পাতা মিসের বোন তার ছেলেকে কত ভালোবাসে! আব্বু তাহলে আমার মা কেন আমাকে ভালোবাসে না?আমার না মার কথা খুব মনে পড়ছে আব্বু?

বলেই ভোর কেঁদে দেয়। অরুণ অসহায় হয়ে পড়ে। চোখের জল মুছে দিয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে‌। তার নিজের চোখও ভরে উঠেছে। ছেলেকে কি জবাব দেবে সে! অনেক কষ্টে ঢোক গিলে বলে,
-” কলিজা বলেছি না আমিই তোমার আব্বু আমিই আম্মু!”
ভোর কান্না থামিয়ে দেয়,
-” আব্বু কাঁদছো তুমি?”
অরুণ নাক টেনে বলে,

পাতা বাহার পর্ব ১১

-” না তো!”
ভোর বাবার বুক থেকে মাথা তুলে অরুণের দিকে চায়। কপোলের অশ্রু মুছে দিয়ে বাবার গালে বেশ কয়েকটি চুমু দিয়ে বলে,
-” ভোর লাভস ইউ সো মাচ আব্বু কলিজা!”

পাতা বাহার পর্ব ১২