পাতা বাহার পর্ব ১৫

পাতা বাহার পর্ব ১৫
বেলা শেখ 

রৌদ্র উজ্জ্বল তপ্ত বিকেল। অরুণ বাড়িতেই আজ। ছেলের সাথে স্কুল থেকে ফিরে আর অফিসে যায় নি।‌ বাড়িতে বসেই টুকটাক কাজ করেছে।‌ ভোর হুজুরের কাছে আরবি পড়ছে স্টাডি রুমে। অরুণ নিজ হাতে হুজুরের জন্য নাস্তা নিয়ে গেল। তার সাথে কুশল বিনিময় করে চলে আসে। রুমে বসে ভালো না লাগায় বাইরে বাগানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়‌। পকেটে হাত দিয়ে ক্যাপ মাথায় ড্রয়িং রুম পেরিয়ে যেতে নিলে আসমা বেগম ডাক দেয়। ড্রয়িংরুমে আসমা বেগম আর মিনু। মিনু তার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। অরুণ এগিয়ে আসে।

-” কিছু বলবে ছোটমা?”
আসমা বেগমের দৃষ্টি অরুনের দিকে স্থির।
-” হুম বলবো! তখন আরিয়ানের কথায় কিছু মনে কোরো না।”
অরুণ স্যরি বলতে চায় তাকে। কিন্তু কেমন যেন গলায় আটকে গেছে। বলতে পারছে না‌ ঢের জরতা কাজ করছে কণ্ঠনালীতে ।সে ছোট করে শান্ত গলায় বলে,
-” হুম!”
-” কাল বিকেলে তো কথাই হলো না আদুর ট্রিপের চক্করে! তা কি সিদ্ধান্ত নিলে? না মানে শ্রাবনীর সাথে কথা হলো? ঠিক মনে হয়?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরুণ একটু ভাবনায় পড়ে যায়। শ্রাবণী মেয়েটাকে ভালোই মনে হলো। স্ট্রেট ফরয়ার্ড কথাবার্তায়। লুকোচুরি নেই একটু কঠোর মনোভাব এবং সেটা একটা ভালো দিক। দেখে মনে হলো স্ট্রং পারসোনালিটির। কিন্তু তার সাথে যায় না। তার একজন নরম মনের কাউকে চাই। সে তাদের বাবা-ছেলেকে বুঝতে চেষ্টা করবে! আগলে নেবে।
-” ছোটমা সি ইজ গুড! বাট সি ইজ নট রাইট ফর মি এন্ড .. অলসো আই এম নট রাইট ফর হার! তুমি আর এগিয়ো না।”

আসমা বেগমের কপালে ভাঁজ পড়ে। মিনু স্থির হয়ে বসে। অজানা আশঙ্কায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। স্যারের নতুন বউ ভোরকে মেনে নেবে তো! সৎ মা ভালো হয় এটা খুবই কমই দেখা যায়। সে মনে মনে দোয়া করে যে আসবে সে যেন একজন ভালো মনের মানুষ হয়। ভোরকে সৎ ছেলে না নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসে। আচ্ছা নতুন মা আসলে কি ভোর তাদের থেকে দূরে চলে যাবে? মিনু খালা বলে আর আবদার করবে না? কোলে উঠে চুমু খেয়ে তার ভাঙ্গা চোড়া হৃদয়টাকে আর জুড়িয়ে দেবে না?
আসমা বেগম বোঝানোর সুরে বললেন,

-” তোমার মতামতটাই আসল। তুমি যা বলবে তাই হবে। তবে শ্রাবণী মেয়েটা ভালোই কিন্তু! আমি ওদের বাড়িতে , কর্মস্থলে,আবার ওর আগের শশুর বাড়িতেও লোক পাঠিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছি। কেউ খারাপ মন্তব্য করে নি। সবাই ভালোই বলেছে!”
অরুণ তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
-” আমিও খারাপ বলছি না। সি ইজ আ গুড পারসন। বাট.. তুমি না করে দাও!”

পেরিয়ে গেছে কিছুদিন। আষাঢ় মাসের মধ্যবর্তী সময়। কখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তো কখনো মুষলধারে। কখনো সারাদিন সারা বেলা পেরিয়ে যায় থামার অবকাশ নেই। আকাশ এই রৌদ্রজ্জ্বল তো এই মেঘলা। ক্ষেতখামার পুকুর ডোবা সব ভরাডুবি!‌ সেখানে সোনা ব্যাঙের আনাগোনা ঢেড়! তাদের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাকের ধ্বনি ও মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখেই অনুভূত হচ্ছে এটা বর্ষা মৌসুম। ধানক্ষেতের উপর দিয়ে বক উড়ে বেড়াচ্ছে। বৃষ্টির কারণে পুকুরের মাছ ফসলি জমিতে উঠে এসেছে।সেটাই গপাগপ পেটে চালান করতে বক মহাশয় ওৎ পেতে আছে। অনেকেই ক্ষেতের আইল দিয়ে জাল, ধিয়াল( মাছ ধরার সরঞ্জাম ) পেতে রেখেছে। অনেকে রাতে টর্চলাইট সহ পোলো, ফলা/ফোচকা (মাছ ধরার সরঞ্জাম) নিয়ে বের হয় মাছ ধরতে। মাছ ধরা একটা অন্যরকম নেশা। এ নেশায় আসক্ত ব্যক্তিজনই এর আনন্দ উপভোগ করতে সক্ষম।

পাতা ওদের একতলা বাড়ির ছাদে চেয়ার পেতে বসে আছে। একা নয় সেখানে উপস্থিত লুবমান, লাবিব, রুম্পা আর লতার স্বামী রাতুল ভুঁইয়া । ভদ্রলোকটি গতকাল সকালে এসেছে। শশুর, শাশুড়ি, শ্যালক, শালিকা,বউ বাচ্চাদের জন্য ঈদের মার্কেট করে এনেছে। ঈদুল আজহার যে বেশি দেরি নেই এই হাতেগোনা দশদিন! ভেবেছিল দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে বিকেলেই রওনা হবে কিন্তু তার দজ্জাল বউটা হতে দিলে তো! এতো দিন থাকলো তাতেও মন ভরে নি। আরো কটাদিন থাকবে! অগত্যা তাকেও থাকতে হবে। রাতুল ভুঁইয়া পাশে তাকায়। পাতা বাচ্চাদের এক্সামের খাতা দেখছে। লুবমান বাদামের খোসা ছাড়িয়ে পাতা ও ভাগ্নেকে দিচ্ছে। রুম্পা তার কোলে বসে। সে লুবমানের ছাড়ানো বাদাম মুখে পুরে বলল,

-” শালাবাবু তোমরা কিন্তু আমার সাথে অন্যায় করেছো?”
পাতা, লাবিব তার দিক তাকায়। লুবমান ভ্রু কুঁচকে চায়।
-” কিভাবে দুলাভাই?”
রাতুল পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” এতো মিষ্টি শান্ত মেয়ে থাকতে আমাকে ঝড় তুফান প্যাক করে দিলে?”
লুবমান হেসে বলে,
-” দুলাভাই ঝড় তুফান কিন্তু আপনিই বয়ে এনেছিলেন!”
-” জেনে গেছো?”
লুবমান হেসে বলে,

-” প্রথম থেকেই। এমনকি আপনাদের লাভ অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের কথা আপনার শাশুড়ি আম্মাও জানে!”
-” হায় আল্লাহ! বলো কি!”
পাতা হাসে। রাতুল সেদিকে চেয়ে বুকে হাত রেখে বলে,
-” এভাবে হেসো না মেয়ে বুকে লাগে তো!”
পাতা চোখ ছোট ছোট করে চায়।
-” আপু এসে খাঞ্জার দিয়ে আপনার বুক ঝাঁঝরা না করে দেয় সাবধান!”
রাতুল ভুঁইয়া মুখ কুঁচকে বলে,
-” ধ্যাত দিলে তো মুড টা নষ্ট করে! আচ্ছা আমাদের পাতা এতো শান্ত শিষ্ঠ নরম স্বভাবের আর পাতার বোন লতা এতো মেজাজি , খিটখিটে কেন? বিয়ের আগে কি সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতো! বাচ্চা আসার আগ পর্যন্তও ঠিকঠাক ছিল! ”

পাতা মুচকি হেসে রুম্পার গাল টিপে বলে,
-” দুলাভাই এতে দোষ নাইন্টি পার্সেন্ট আপনার। লাভ ম্যারেজে সচরাচর বিয়ের আগে ভালোবাসা টইটম্বুর থাকলেও বিয়ের পর তেমন থাকে না। আর বাচ্চা হওয়ার পর আপনারা বাচ্চাদেরকে প্রায়োরিটি দেন বেশি। স্ত্রী কে ভালোবাসলেও বাচ্চাদের ভালোবাসার ভিড়ে তার ভালোবাসা প্রকাশ করেন না। অফিস থেকে বাড়ি এলে বাচ্চাদের নিয়েই পড়ে থাকেন। তাদের খুনশুটিতে মেতে থেকে আবদার পূরণ করতে করতে ভূলেই যান বাচ্চাদের মায়ের সাথে দুদণ্ড বসে আড্ডা দেয়ার কথা! নিজেদের মধ্যকার সম্পর্কটা আরো একটু গাঢ় করার বদলে একটু করে দূরে ঠেলে দেন! আপুও চাকরিজীবী। চাকরি শেষে বাড়ি ফিরে রান্না বান্না, বাচ্চাদের সামলানো সহ সকল কাজ নিজ হাতে করে। তো মেজাজ আপ থাকবে না? আপনিও কাজে হাত…”

পাতাকে থামিয়ে দেয় রাতুল মুখে বাদাম পুরে বলে,
-” তোমার আপুকে জিজ্ঞেস করো? তার সকল কাজেই আমি সাহায্য করি। রান্না,কাপড় কাঁচা, ঘর মোছা! সব কাজেই! তবে হ্যাঁ বাচ্চাদের সময় দেওয়ার পর ওর দিকে ধ্যান দেয়া একটু কমই হয়!”
পাতা হেসে বলে,
-” এটাই তো! আর আপনি জানেন না? লেডিস এমনিতেই এটেনশনের পাগল! তো আপনার সব এটেনশন বাচ্চারা পেলে বাচ্চার মায়ের মেজাজ কেমন থাকবে? ভালোবাসেন অনেক বেশি তো প্রকাশ করতে কেন‌ কুণ্ঠাবোধ? একে অপরকে সময় দিন । সব ঠিকঠাক তো আছেই সম্পর্ক আরো রঙিন হবে।”
রাতুল মাথা নাড়ে। নাহ পাতার কথা সত্যি! বউটাকে বেশি বেশি সময় দিতে হবে! লুবমান পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” এই পাতু তোর তো ভালোই জ্ঞান আছে দেখছি এসব বিষয়ে?”
রাতুল লুবমানের কাঁধ চাপড়ে বলে,
-” থাকবে না? নতুন সংসারে পা রাখতে তো আর বেশি দিন বাকি নেই! ভালো কথা মনে পড়লো! পাতা আব্দুল করিমকে তো দেখলে ছবিতে! কেমন লাগলো?”
লাবিব বুঝতে পারে না কার কথা বলছে। সে প্রশ্ন করে,
-” আব্বু আব্দুল করিম কে?”
রাতুল ভুঁইয়া ছেলের গাল টিপে উত্তর দেয়,
-” তোমার খালা মুনি চাইলে তোমার খালু হলেও হতে পারে! কি বলো পাতা?”

পাতা লজ্জা লুকাতে চোখের পলক ঝাপটায় অনবরত। আশ্চর্য তার লজ্জা লাগছে কেন? বিয়ের কথা যেহেতু উঠছে তার মনে মনে বেশ খুশি হওয়ার কথা‌ ইভেন লুঙ্গি ডান্স দেওয়ার কথা। অথচ আজ লজ্জা এসে ভিড় করছে। সে কাজের বাহানায় খাতার বান্ডিল সহ নিজের ঘরে চলে আসে ছাদ থেকে। উফ্!
গোধূলি পেরিয়ে ধরণীতে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে।‌ চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা। শেয়ালের হাঁক ভেসে আসছে দূর থেকে। সাথে কুকুরের ঘেউ ঘেউ। আতিকুর ইসলাম বাড়ি এসেছে মাত্রই। হাতে বেশ কিছু শপিং ব্যাগ।ব্যাগ গুলো লতার কাছে দিল প্রথমেই। রাতুলের সাথে টুকটাক কথা বলে লতাকে শপিং ব্যাগ খুলতে বললেন। লতা সব প্যাকেট খুলে দেখতে পায় দুটো শাড়ি ভিন্ন ডিজাইনের। একটা থ্রি পিস, চারটা পাঙাবির সেট। সাথে ছোট একটা ফ্রক। লতা বাবার দিকে চাইতেই আতিকুর ইসলাম বলেন,

-” ঈদের বেশি দিন বাকি নেই। সবার জন্যই এনেছি।”
-” দাঁড়াও লুব ,পাতুকে ডেকে আনছি!”
বলেই ওদের ডাকতে যায়! পাতা, লুবমান, লাবনী আক্তার এলে সবাই শপিং দেখে যার যার টা নিয়ে আড্ডায় জমে গেল।

রাতে পাতা আর লাবিব ঘরে বসে ড্রয়িং করছে। পাতা ড্রয়িং করছে আর লাবিব কালার করছে । পাতা সুন্দর করে হাঁসের দল আকলো যেগুলো‌ পানিতে ভাসমান। লাবিব আর এটা রঙ করতে পারলো না। পাতা নিজেই রঙ করলো। হাঁসগুলো সব সাদা শুধু দুটো চেক চেক কালারের। পাতার রঙ করার মাঝেই লাবিব হাই তুলে বিছানায় শুয়ে পড়ে। পাতা সেদিকে একনজর চেয়ে রঙ করায় মনোযোগ দিল। রঙ করা শেষ করে লাবিব কে ভালো করে শুইয়ে দিয়ে নিজে বালিশে হেলান দিয়ে বসলো। ফোনের লক খুলে গ্যালারিতে ঢুকল। আব্দুল করিম নামক লোকটার ছবি দেখা যাক! দুলাভাই কাল ছবিটা তার ফোনে দিয়েছে। সে শুধু একবার দেখেছে । অতটা ভালোকরে দেখতে পারে নি সবার ভিড়ে । এখন নিস্তব্ধতায় ঘেরা নির্জনে একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে দেখা যাক লোকটা দেখতে কেমন? কিন্তু তার দেখা বোধহয় হলো না । ছবিটা গ্যালারি থেকে ওপেন করার আগেই ফোনটা বেজে ওঠে। পাতা খানিকটা বিরক্ত হয়। আরে ভাই কল আসার আর সময় পেল না! সেভ না! আননোন নাম্বার বাট নাম্বারের লাস্ট ডিজিট দেখে চিনতে অসুবিধা হয় না কে কল করেছে। পাতা দাঁতে দাঁত চেপে ‘শালা’ বলে গালি দিয়ে রিসিভ করে। ওপাশ থেকে অরুণ সরকারের গম্ভীর গলা ভেসে আসে। পাতা চোখ উল্টিয়ে ভেংচি কাটলো।

-” জলদি বলুন আমার সময় নেই। ভিষণ ব্যস্ত আমি!”
অরুণের ভ্রু যুগল কুঁচকে যায়। এতো রাতে কিসের ব্যস্ততা তার! নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ড টয়ফ্রেন্ডের সাথে লেইট নাইট চ্যাটিং-এ প্রেমালাপে ব্যস্ত আছে। তার গম্ভীর মুখটায় আরেকটু গাম্ভীর্য ভিড় করে।
-” কাল ভোরের লাস্ট এক্সাম! শুধু ড্রয়িং করবে?”
-” জি!”
-” তো কি কি ড্রয়িং করতে হবে?”
-” বলে দিয়েছিলাম তো! ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ, ফ্লাওয়ার আর ফিস!”
অরুণ পাশে ড্রয়িং করা ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” হুম! বাট ওর ফিস টা ইলিশ ইলিশ লাগছে না! এটা আদৌ মাছ হয়েছে কি না আই কনফিউজড!”
পাতার ইচ্ছে করে অরুণ সরকারের মাথার সব চুল টেনে ছিঁড়তে! শালা আহম্মক! ছোট বাচ্চা ভোর! কোনো আর্টিস্ট না!
-” মি. ভোরের বাবা ভোর ছোট ! ও কি ইলিশের কার্বন কপি আঁকতে পারবে নাকি? শুধু মাছের মতো দেখতে হলেই হবে!আপনি সেটাই ট্রাই করুন। ”
-” ওহ্” রাখছি তাহলে!”
বলেই কল কেটে দেয়। পাতা ফোনটা বিছানায় রেখে দেয়। ঘুমে চোখ বুজে আসছে। এতো ঘুম কেন পায় তার?

স্নিগ্ধ সকাল! হালকা রোদ্দুরের সাথে এলোমেলো বাতাস। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন না হলেও কেমন যেন গুমট পরিবেশ বিরাজমান। পাতা স্কুলের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছে। আজই লাস্ট স্কুল।কাল থেকে ঈদের ছুটি পড়বে। পরীক্ষা পর যে ছুটি দেয়া হয় সেটা ঈদের ছুটির সাথে যোগ হওয়ায় বেশ লম্বা ছুটি পড়বে। পাতা ভেবে নিয়েছে ছুটি পড়লে প্রিয় দের বাড়িতে যাবে। ঈদটা ওখানেই কাটিয়ে দেবে। ঈদের দুদিন পর আসবে এবাড়িতে! দু দিন? না! আরো কয়েকদিন থেকে আসবে। ভাবতে ভাবতেই পাতা বেশ খানিকটা এগিয়ে যায়। তার স্কুটিটা নষ্ট হয়েছে দুদিন হলো। লুবমানকে বলেছে ঠিক করে এনে দিতে! লুবমান আজ না কাল! কাল না পরশু বলে বাহানা দিচ্ছে। নাহ , তাকেই নিয়ে যেতে হবে গ্যারেজে। সে পায়ে হেঁটে বেশ খানিকটা পথ পেড়িয়ে যায়। এই অটোওয়ালাদের খবর নেই কেন? বেলা তো আটটা বেজে সাত মিনিট! তাদের ঘুম ছাড়ে নি নাকি! পাতা চা স্টলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শুকলা মন্ডলকে দেখতে পায় সেখানে। বিড়ি ফুকছে। পাতা পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল। সেদিন চায়ের দোকানে দেখার পর আর নজরে আসে নি। আজ দেখতে পেল লুচ্চাটাকে।

পাতার পায়ের গতি বাড়িয়ে কাজ হয় না। শুকলা দেখতে পায় পাতাকে। বিড়ি টানতে টানতে বড় বড় পা ফেলে পাতার সাথে হাঁটতে থাকে। পাতা কাঁধের ব্যাগ শক্ত করে ধরে চুপচাপ হাঁটতে থাকে। শুকলা বিড়িটা ফেলে পাতার দিকে লালসা ভরা দৃষ্টিতে তাকায়। জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলে,
-” ভালোই আছোস দেখছি? শরীরে তেল ভালোই জমছে দেখছি! মোটা হইছোস খানিকটা! ব্যাপারটা কি? কেউ শরীর হাতরাইছে নাকি?”
কি জঘন্য অশ্লীল কথা! পাতা রাগে শরীর জ্বলছে। তবে কিছু বলে না । শুকলা হেসে গালে হাত বুলিয়ে আবার বলতে শুরু করে,

-” সেদিনের চর ভুলি নাই বুঝলি? সব সুদে আসলে সোধ দিমু! তোরে একবার হাতের নাগালে পাই? এমন শিক্ষা দিমু কাউরে মুখ দেখাইতে পারবি না মা*গি!'”
পাতার পা থেমে যায়। সে শুকলার দিকে ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে বলে,
-” শালা বারো**রি! এমন জায়গায় লাত্থি দিব না? একেবারে বাতি নিভে যাবে আজীবনের জন্য! সব কুরকুরানি বেড়িয়ে যাবে *** ফাটিয়ে দিলে! শালা আমাকে হুমকি দিস? এক কোপে মাথা আলাদা করে দিব! সর সামনে থেকে?”
বলেই পা চালায়। একটা অটোরিকশাকে আসতে দেখে সেটায় চড়ে বসে। পাতার শরীর এখনো কাঁপছে। ভয়ে নাকি রাগে সেটা বোঝা মুশকিল! মেয়ে মানুষ সে! রাস্তায় একা চলাফেরা করে। যদি কোন বিপদে আপদে পড়ে? সম্মানের ভয় আছে না? নাহ্। পাতা সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি ফিরেই লুবমানের সাথে কথা বলবে এই‌ শুকলার ব্যাপারে।
শুকলা মুখ বুজে অপমান গিলে নেয়। তবে শোধ তো সে নেবেই! যেকোনো ভাবে! শুকলাকে তো চেনে না মা*গি।

তপ্ত দুপুর বেলা। হালকা রোদ্দুর সেন তীব্র হয়েছে। বেশ গরম ছড়িয়েছে। হালকা বাতাস থাকলেও তীব্র গরমে সেটা গা জুড়িয়ে দিতে‌ পারছে না। স্কুল গেটের আশেপাশে রিকশার ঢল। সাথে ঝালমুড়ি বিক্রির প্রতিযোগিতায় নেমেছে কয়েকজন। শরবতের দোকানিও বসে নেই একদন্ড। গরমে ক্রেতাদের চাহিদা বেশ। গার্জেনসহ বাচ্চারা যেন উপচে পড়ছে সেখানে। অরুণ সরকারের গাড়ি এসে থামে স্কুল গেট থেকে একটু আগে পার্কিং জোনে। ড্রাইভার গাড়ি পার্ক করলেই অরুণ বেরিয়ে আসে ফ্রন্ট সিট থেকে।

চোখে কালো খয়েরি ফ্রেমের চশমা। আজ আর ফরমাল ড্রেস আপে নেই। ব্লু হোয়াইট চেক শার্ট কালো জিন্স পরনে। মুখে বিরাজমান চিরচেনা গাম্ভীর্যতা! অরুণ গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেটে পেরিয়ে ভিতরে যায়।‌ ছেলেকে নিতে এসেছে সে। ছেলেটা রোজ আবদার করতো এক্সামের দিনগুলোতে যেন‌ সে স্কুলে আসে তার সাথে। এক্সাম শেষ না হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে। তার পর ছুটি হলে তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে। অরুণ প্রথম এক্সামের দিন থাকতে পারলেও পরের দিনগুলোতে থাকা হয় নি। আজকে লাস্ট এক্সাম, ড্রয়িং শুধু। থাকার চেষ্টা করেছিল পারে নি কাজের চাপ থাকায়। তবে শিডিউল চেঞ্জ করে ছেলেকে নিতে এসেছে।ছেলেটা তাকে দেখে খুশি হবে নিশ্চয়ই!
সে ভোরের ক্লাসরুমের সামনে যায়।‌ সেখানে আভারি দাঁড়িয়ে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। অরুণ তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” আভারি ভাই? কি খুজছো? ভোর কোথায়? এক্সাম শেষ হয় নি?”
আভারি চমকে চায় তার দিকে। সে ভোরের জন্যই দাঁড়িয়ে ছিল বটতলায়। বাচ্চাদের বেরোতে দেখে সে ক্লাসরুমের এদিকে আসে। ভোরও বের হবে এখন। কিন্তু এসে আর ভোরকে পায়নি। রুমের ভিতরেও গিয়েছিল ক্লাস টিচার বাদে কেউ ছিল না। তাকে জিজ্ঞেস করলে বলে কিছুক্ষণ আগেই বের হয়ে গেছে! তাহলে ভোর কোথায়? এমন তো কখনো হয় নি! ভোর বেরিয়েই তাকে খুঁজে নিত! আর সেও প্রতিদিন এক জায়গায়ই দাঁড়িয়ে থাকে তো!
-” স্যার বেরোতে দেখিনাই আমি! ক্লাসরুমেও নাই। স্যার বলল বেরিয়ে গেছে অথচ আমি দেখতে পাই নাই! কোথায় যে গেলো?”
অরুণ আশ্চর্য বনে যায়।
-” কি বলছো তুমি? দেখ নাই মানে কি? কোথায় যাবে? আশ্চর্য! একটা বাচ্চা ছেলের খেয়াল রাখতে পারো না! রুমে দেখেছো ভালো করে? ওয়াশ রুমে?”

অরুণ যেন অস্থির হয়ে পরে। রুমে, ওয়াশ রুমে, বারান্দায়,দোতলা তিনতলা সব জায়গাতেই গিয়ে খোঁজ করে। রোহানের মায়ের কাছে কল করে জিজ্ঞেস করে ওদের সাথেও নেই। মাঠে বাচ্চাদের ভিড়ে, আইসক্রিমের দোকানে, ঝালমুড়ি ওয়ালার কাছেও জিজ্ঞেস করতে ভুলে না। ভোর কোথাও নেই। অরুণের হঠাৎ পাতার কথা মনে পড়ায় দৌড়ে টিচার্স রুমের দিকে যায়। তাকে কষ্ট করে ভিতরে যেতে হয় নি। পাতা বাড়ি যাওয়ার জন্য বেড়িয়ে আসছিল।‌হাতে খাতার বান্ডিল! অরুণকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে চমকায় খানিকটা। একি হাল অরুণ সরকারের? অরুণ পাতার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,

-” মিস পাতাবাহার?”
কি ছিলো কণ্ঠে? পাতার হৃদয় ছুঁয়ে গেল যেন। অরুণ নিজেকে ধাতস্থ করে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে,
-” ভোর আপনার কাছে? দেখেছেন?”
পাতার কপালে গাড় ভাঁজ পড়ে।
-” না! আজকে ওদের রুমের ডিউটি আমার ছিল না‌। সি সেকশনে ছিল। ভোরের সাথে দেখাই হয় নি! কেন কি হয়েছে?”
অরুণ দু হাতে মুখের ঘাম মুছে ছুড়ে ফেলে। চুল গুলো টেনে বলে,
-” পাচ্ছি না ওকে। সব রুম ,প্রত্যেক ফ্লোরের ওয়াশরুম , মাঠেও চেক করেছি কোথাও নেই। ক্লাস থেকে বেড়িয়েছে অথচ আভারি দেখে নি! কোথায় গেল আমার কলিজাটা?”

বলেই প্রিন্সিপাল ম্যামের রুমের দিকে ছুটে যায়। পাতা সেদিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে চেয়ে রয়। কই গেলো ছেলেটা? তখনই আভারি আসে সেখানে। পাতা তাকে ভোরের কথা জিজ্ঞেস করলে সে সব খুলে বলে। বলতে বলতে কেঁদেই দেয়। পাতার তাকে স্বান্তনা দেয়ার সময় নেই। সে ভোরদের ক্লাস রুমে গিয়ে খোঁজ করে। নিচের ফ্লোরের ওয়াশরুম একেবারে কর্ণারে। সে মেয়েদের ওয়াশ রুম চেক করে ছেলেদের ওয়াশ রুমে ঢোকে। সেখানে এক আয়া সব টয়লেটে পানি ঢেলে দরজা বন্ধ করতে ব্যাস্ত। পাতাকে দেখে আয়াটি পান খাওয়া দাঁত বের করে হেসে বলে,
-” আপনে এইহানে ম্যাডাম ? কোনো দরকার?”

পাতা খাতার বান্ডিল ব্যাগে ভরে নিল। ফোন বের করে গ্যালারি থেকে একটা পিক বের করে সামনে ধরল।
-” তা একটু ! এই বাচ্চাটাকে দেখেছো? নার্সারির! নাম ভোর?”
আয়াটি পানের পিক ডাস্টবিনে ফেলে ফোনের দিকে তাকিয়ে ভালোভাবে দেখে বলল,
-” হুম। চিনি তো এইডারে। ভালোই বাচ্চাটা। হাসিখুশি একটু পাজিও। একটু আগেও দেখলাম।”
পাতা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-” কোথায় দেখেছো? জলদি বলো?”
-” এই তো ওদের ক্লাসের পরের ক্লাসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল।”
-” সাথে কেউ ছিল?’
মহিলাটি ভেবে বলল,

-” ছিল তো! ওর মা! আমাকে ডেকেও বলল ‘ আন্টি দেখ আমার মা!'”
পাতা ভাবনায় পড়ে যায়। মা? ভোরের মা এসেছিল?
-” কোথায় গেল তারা?”
-” তা জানি না! আপনি এত কিছু জিজ্ঞেস করতাছেন‌ ক্যান‌ ম্যাডাম? কিছু হইছে?
-” ছেলেটাকে পাওয়া যাচ্ছে না বলল ওর বাবা! তুমি আমার সাথে আসো জলদি!”
বলে পাতা বেরিয়ে আসে সাথে মহিলা আয়া।
প্রিন্সিপাল রুমের সামনে গিয়ে দেখতে পায় দরজা খোলা। ভিতরে অরুণ সরকার,ম্যাম ও স্কুলের কম্পিউটার অপারেটর। তারা তিনজনই কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে। সে পারমিশন চায় ভিতরে ঢুকার। পাতা ভিতরে ঢুকে সাথে মহিলাটিও। অরুণ তাদের দিকে একবার তাকিয়ে স্ক্রিনে নজর দেয়। তারা , ক্লাসরুমের ও বাইরের গেইটের সিসিটিভি ফুটেজ দেখছে। পাতা তাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

-” ভোর ওর মায়ের সাথে বোধহয়!”
অরুণ চকিত পাতার দিকে চায়। প্রিন্সিপাল ম্যাম অরুনের দিকে চেয়ে। বলে,
-” বর্ষার সাথে? অরুণ ও বাংলাদেশে?”
অরুণ মাথা নাড়ল। তার ঘামে ভেজা মুখশ্রী কঠিন হয়ে ওঠে। পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” কিভাবে জানলেন?”
পাতা আয়াকে দেখিয়ে বলে,
-” উনি দেখেছে বারান্দায়। ভোর মা বলেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ওনার সাথে! আপনি কথা বলুন?”
অরুণ আয়ার দিকে চায়। আয়া মহিলাটি ঘাবড়ে যায় খানিক। সে শুনেছে আসামি ও বিপক্ষ বাদি ফুরুত! সাক্ষি থাকো গারত! সে না ফেসে যায় এখন। সে আমতা আমতা করে বলে,

-” হ দেখছি‌ । বাচ্চাডারে চিনি তো আমি! বড়ই আদুরে। একটা মহিলার সাথে কথা বলছিল। আমায় দেইখা বলল তো মা ওর”
পাতা অরুণের দিকে চায়। ফর্সা মুখশ্রী লাল হয়ে আছে।যেন টোকা দিলেই ফেটে রক্ত বের হবে। একদম ভোরের মতোই ত্বক!
কম্পিউটার অপারেটর সেক্টরে কাজ করে যে লোকটি সে শুধু হা করে সবাইকে পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত!
অরুণ ফোন বের করে বর্ষার নাম্বারে ডায়াল করে। একটু পরেই রিসিভ হয়। অরুণ নিজেকে শান্ত করে । ওপাশ থেকে আওয়াজ ভেসে আসতেই বলে,
-” তুমি কোথায়? ভোর তোমার সাথে?”
ওখানেই থাকো আমি আসছি !”
বলেই কল কাট করে। প্রিন্সিপাল মিস অরুণের কাঁধে হাত রেখে বলে,

-” শান্ত হও! ভোর ঠিক আছে! ওখানে গিয়ে রেগে হাত উঠিও না যেন! আমি তোমার সাথেই যাচ্ছি! চলো?”
অরুণ টেবিলে থাকা টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে কপাল ও মুখের ঘাম মুছে। এসি রুমের ভিতরেও তার ঘাম ছুটছে!
-” আপনাকে যেতে হবে না ম্যাম! আপনি থাকুন। আমি যাচ্ছি। আর মিস পাতাবাহার? আপনি চলুন আমার সাথে!”
বলেই গটগট পায়ে বেরিয়ে যায়! পাতা ফ্যালফ্যাল করে চায় সেদিকে! আশ্চর্য তাকে কেন যেতে হবে?মামা বাড়ির আবদার নাকি!সে গিয়ে করবে? ছেলেকে পেয়েছে নিয়ে আসুক ! সে গিয়ে দুজন প্রাক্তনের মধ্যে সারসা ডান্স করবে নাকি! উফ্। প্রিন্সিপাল ম্যাম পাতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,

পাতা বাহার পর্ব ১৪

-” যাচ্ছো না কেন? যাও পাতা! আর শোন! অরুণের মাথা এমনিতেই গরম! ওর আবার হাত বেশি চলে! ভোরকে যেন না মারে। আর বর্ষাকে মারলে মারুক ! আই ডোন্ট কেয়ার!”
পাতা নাখোশ মনে যায় অরুনের পিছু। এদের বাপ ছেলের চক্করে সে না চাটনি হয়ে যায়!

পাতা বাহার পর্ব ১৬