পাতা বাহার পর্ব ২১(২)
বেলা শেখ
-” শুধু পাতাকেই দেখতে পাস তোরা! আমাকে নজরে আসে না? বড় ভাই এসেছে পায়ে পড়ে সালাম করবি তা না! পাতুপু পাতুপু!! এই পাতুপু আবার কেমন ডাক শুনি? পাতু আপু বললেও ভালো শোনা যায় কিছুটা।”
আহ্লাদি প্রিয় লুবমানের বাহুতে কিল বসিয়ে ভেংচি কেটে বলে,
-” আমার পাতুপু কে আমি যা খুশি ডাকবো। এতে তোমার কিসের সমস্যা লুব ভাই! আর তুমি কেন এসেছো? জানো না বিনা দাওয়াতে মেহমানদের পিঠে ঝাটার বাড়ি!”
পাতা চোখ রাঙায় প্রিয়কে। প্রিয় হি হি করে হেসে উঠে। লুবমান মুখ খানা গম্ভীর বানিয়ে বলে,
-” দাওয়াত খেতে আসি নি। বোনকে রাখতে এসেছি। নইতো তোদের মতো ফকিন্নিদের বাড়ি আসার মতো মেহমান আমি না।”
পাতা লুবমানকেও চোখ রাঙায়।
-” লুব ভাই থামবি? বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছিস! আর প্রিয় সবাই বাড়িতে?”
প্রিয় লুবমানকে ভেঙ্গিয়ে পাতাকে টানতে টানতে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায়।
-” বাবা ,ছোট বাবা নেই! তাছাড়া সবাই আছে। কাওছার ভাই, ফরহাদ, মা, ছোট মা , বুড়ি ।”
বলতে বলতেই ফরহাদ এসে দাঁড়ায় সামনে। চোখ বড় বড় করে চায়।
-” পাতা আপু! কেমন আছো তুমি কতদিন পরে এলে। আমাদের মনে পড়ে না, তাই না?”
পাতা প্রিয়র হাত ছাড়িয়ে ফরহাদের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে গাল টেনে বলে,
-” ভালোই আছি। আর মনে পড়ে তার জন্যই তো এলাম। আমি এলেই তোদের পাতা আপুর কথা মনে পড়ে। কই একবারও তো দেখতে যাস না? ফোন করারও নাম নেই । খালি মুখেই!”
ফরহাদ ঘোর বিরোধিতা করে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” আপু আর কারো কথা বলতে পারবো না কিন্তু আমি আর প্রিয় তোমায় সবসময় মিস করি। আর আমাদের তো ফোন নেই কল দিব কিভাবে?”
-“হয়েছে আর সাফাই গাইতে হবে না।”
লুবমানকে দেখে ফরহাদ মুচকি হেসে সালাম দিয়ে বলে,
-” ভালো আছেন ভাইয়া?”
লুবমান হেসে তার পিঠ চাপড়ে দিল।
-” ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? বড় হয়ে গেছো দেখছি!”
ফরহাদ লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকায়। পাতা এখন বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। তন্মধ্যে বাড়ির বাকি সদস্যরা বেড়িয়ে আসে। পারুল পাতাকে দেখে বেশ খুশি হয়। এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে। পাতা নাক টেনে ঘ্রাণ নেয়। মায়ের শরীরের নিজস্ব মা মা ঘ্রাণ। যেটা সে ও বাড়িতে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করে।
-” কেমন আছিস?”
মায়ের কথায় পাতার চোখে নোনাজল ভিড় করে। মুচকি হেসে বলে,
-” ভালো আছি মা! তুমি কেমন আছো?”
পারুল পাতাকে ছেড়ে গালে হাত বুলিয়ে বলে,
-” আমিও ভালো আছি। একটু গায়ে পায়ে হয়েছিস। সুন্দর হয়েছিস আরো। আমারই নজর না লাগে!লুব কেমন আছিস?”
পাতা মুচকি হাসে। লুবমান মাথা নাড়ে।আকলিমা খাতুন ও ফাতেমা জোহরাকে দেখে বলে,
-” তোমরা ভালো আছো দাদি, ছোট মা?”
আকলিমা গম্ভীর মুখে পাতাকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
-” আছি ভালোই। তা পোঁটলা নিয়ে আইসোস যে কতদিন থাকবি? একেবারে আসিস নি তো আবার?”
পাতার হাসিমুখ মলিন হয়। সাথে পারুলের মুখশ্রীতে আঁধার নামে।লুবমান গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে পাতার পাশে। পাতা ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলে,
-” না দাদি। কিছুদিন থাকবো। বাবা বেশ কয়েকদিন হলো ফোন করছিল আসার জন্য। তাই আসা।”
-” ওহ! ভালো!”
পারুল শাশুড়ির মুখের উপর কখনো কথা বলে না। তবে এবার চুপ করে থাকলেন না।
-” আম্মা মেয়েটা আমার কতদিন পর এলো। এভাবে না বললে হয় না!..”
পাতা মায়ের হাত ধরে থামিয়ে দেয়,
-” মা হয়েছে। আমি কিছু মনে করি নি। ছোট মা কেমন আছো বললে না?”
ফাতেমা মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে তোলে মুখশ্রীতে। পাতাকে তার পছন্দ না আগে থেকেই। এখন তো আরো না। ভাসুর যে কেন পাতাকে আনার জন্য লেগে পড়েছে জানে সে। কাওসারের বাবা কাওসারের জন্য পাতাকে ঘরে তুলতে চায়। এতে তার সাথে ফাতেমার অনেক বাক বিতণ্ড হয়। করিম মিয়া এতে যেন আরও জেদ করেই উঠে পড়ে লেগেছে।বড় ভাইকেও জানিয়েছে । কিন্তু সে এটা হতে দিবে না। ছেলে কাওসার এ সম্বন্ধে অবগত নয়। তবে বাবার কথায় অমত করবে না সেটাও জানে। তাই শাশুড়ির কানে কথা পাড়ে। তিনিও পাতাকে ছোট থেকেই সহ্য করতে পারে না। তবে সেটার ভয় এখন আর নেই। সে পাতার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
-” ভালোই আছি। তুই? এই কিছু কিছু কথা কানে আসলো সত্যিই?”
পাতা লুবমানের দিকে চায়। এতোদূর পর্যন্ত কথা ছড়িয়েছে? পারুল ছোট জায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ফাতেমা সকালে বললাম তো আমি সব। লাবনী আপা ফোন করে বলেছিল সকালে। এখন ওর থেকে আলাদা করে শুনতে হবে?”
ফাতেমার মুখটা চুপসে যায়। প্রিয়, ফরহাদ কিছু বোঝে না। কিসের ব্যাপারে কথা বলছে। তবে বড়দের মধ্যে জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না। পরে পাতা আপুকে জিজ্ঞেস করে নিবে। পাতা বুঝতে পারে আম্মু সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। আকলিমা খাতুন পানের পিক ফেলে উঠানে। লুবমান তাকে সালাম দিয়ে ফাতেমার সাথেও কুশল বিনিময় করে। আকলিমা খাতুন লুবমানের উদ্দেশ্যে বলে,
-” তা বোনের বিয়া হইলো জামাই সাথে নিল না ক্যা?”
পাতা লুবমানের দিকে তাকিয়ে শান্ত হতে বলে। লুবমান দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে। এই বুড়িটাকে তার একদম সহ্য হয় না।
-” দাদি বোন জামাই বিত্তশালী ব্যক্তি। বোনকে সাদামাটা ভাবে ঘরে তুলবে নাকি। ধুমধামের সাথে তুলে নেবে। আপনারাও দাওয়াত পাবেন।”
পাতা ফরহাদ অবাক হয়।আকলিমা মুখ মোচড়ায়।
-” বড়লোক হইলে কি হইবো।শুনলাম বুইড়া ব্যাটা। একটা বাচ্চাও আছে!”
পাতা শক্ত কণ্ঠে রসিকতার সুরে বলে,
-” দাদি বুড়োরা অল্পবয়সী বউকে ভালোবাসে বেশি। মাথায় তুলে রাখে। আর ওতটাও বুড়ো না সে। দেখতে কিন্তু হেব্বি । একদম হলিউডের হিরো। তুমি দেখলে ফিট খেয়ে যাবে। তোমার মরা জামাইরে ভুলে তার জন্য পাগল না হয়ে যাও। তবে সাবধান হ্যা পাতার জামাইয়ের দিকে নজর দিবা না!”
আকলিমা কটমট করে পাতার দিকে চেয়ে চলে যায় লাঠি হাতে। পাতা হেসে দিল শব্দ করে। ফাতেমা জোহরা তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
-” আমাদের পাতা দেখি জামাই পাগল বনে গেছে!”
-” ছোট মা একমাত্র জামাই আমার পাগল হবো না।”
পাতাও হেসে বলে। তবে ধুপধাপ শব্দে হাসি বন্ধ হয়ে যায়। ফরহাদ, প্রিয় চলে যাচ্ছে মাটিতে শব্দ করে পা ফেলে। তার মানে তারা বেশ রেগে আছে। আর থাকবে না? তাদের প্রিয় পাতা আপু তাদের না জানিয়ে বিয়ে করে নিল? এই দুঃখ তারা কোথায় রাখবে। পাতা ওদের ডাকতে নেয়।পারুল তার হাত ধরে বলে,
-” ওদের কথা বাদ দেতো! একটু পর পিছনে পিছনে ঘুর ঘুর করবে। তুই চল হাত মুখ ধুয়ে নে। এই লুব তুই ও আয়! তুই কাওসারের ঘরে যা। ও ঘুমিয়ে আছে দেখ। ডেকে দে!”
পাতা লুবমান সায় জানায়।
ড্রয়িং রুমে গালে হাত দিয়ে বসে আছে রাতুল ভুঁইয়া। পাশে লাবিব বাবাকে অনুকরণ করে বসে আছে গালে হাত দিয়ে। রুম্পা ফ্লোরে খেলনা সামগ্রী নিয়ে বসে খেলছে আর ফেকছে। মাঝে মাঝে চিল্লাচিল্লি করছে। কিন্তু এতে লাবিব বা রাতুল কারো রি ভাবান্তর হচ্ছে না। রাতুল গভীর চিন্তায় ব্যস্ত। পাতা যাওয়ার পর লতাকে বলেছিল
-” পাতা তো চলে গেল।আমরাও যাই ? দেখ অনেক দিন হলো এসেছো? এখন বাড়ি ফিরতে হবে না? ঈদের পরেই তো মনে হয় পাতাকে তুলে নিবে তখন আসবা তো!”
লতা সাফ সাফ মানা করে দেয় ।সে যাবে না। ঈদ এখানেই কাটাবে। রাতুল কয়েকবার অনুরোধ করে লতা শোনে না। তার কথায় সে অটল। রাতুলের রাগ হয় বেশ। রাগের বশে বলে ফেল,
-” ঈদ পর্যন্ত না সারাজীবন পড়ে থাকো। যেতে হবে না আর। আমি ছেলে মেয়ে নিয়ে চলে যাবো!”
ব্যস লতা রেগে ফায়ার। মেয়েকে রাতুলের কোলে দিয়ে বলে,
-” যাও মেয়ে ছেলেকে নিয়ে। এখনি বের হও আমাদের বাড়ি থেকে। আমি যাবো না কখনো। সারাজীবন এখানেই পড়ে থাকবো। আমার বাবা মার কাছে কখনোই বোঝা হবো না। গেট আউট?”
রাতুল বেচারা বউয়ের রাগ দেখে চুপসে গেছে। নিজের দোষ স্বীকার করেছে। লতা শোনার পাত্রী নয়। তার এক কথা! রাতুলের আর কি করার। বসে আছে ছেলে মেয়ে নিয়ে। লতা নিজের মতোই আছে। লাবিব বাবার বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে বলে,
-” আব্বু চলো আমরা চলে যাই। দারাজ থেকে নতুন মা অর্ডার করে নিবো ভালো দেখে। যে বকবে না একদম পাতা খালা মুনির মতো!”
রাতুল ছেলেকে কোলে তুলে চুমু খেয়ে বলে,
-” আস্তে বল বাপ তোর মা শুনতে পেলে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ হয়ে যাবে। আর দারাজে বউ পাওয়া যায়? সত্যি?”
বলে ছেলের দিকে চায়। ছেলে চোখ বড় বড় করে সামনে চেয়ে। রাতুল ভ্রু কুঁচকে ছেলের চাহনি পরখ করে সেদিকে চায়। তার চোখ জোড়াও কপালে। ছেলেকে বসিয়ে হে হে করে হেসে বলে,
-” মজা করছিলাম তো। তুমি তো আমার সোনা কলিজার বউ।”
লতা কটমট করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।তারপর মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে চলে যায়।
লাবিব রাতুল মুখ গোমড়া করে তার চলে যাওয়া দেখে। তারপর একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টায়! ইয়া আল্লাহ একে কোন মাটি দিয়ে বানিয়েছো? তারা তো মাইনকার চিপায় পড়ে গেছে।
সরকার জুয়েলারি ফ্যাশন হাউজের সকল কর্মীরা গোমড়া মুখে কাজ করছে। এমন বৃষ্টির দিনে কার কাজ করতে ভালো লাগে? তার উপর ঈদেরও যে দেড়ি নেই। কেনাকাটা শপিং আছে না? ছুটি দেওয়ার নাম নেই শুধু বস্তা বস্তা কাজ। আর আজ যেন কাজের চাপ আরো বেশি। ভোর মিসেস রুণার ডেস্কটপের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। জ্বরের কারণে মুখটা শুকিয়ে আছে। তবে তার হাসিমাখা সোনার মুখখানি যেন মায়া আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে। জ্বরের সঙ্গে ফ্রিতে সর্দি।
যার কারণে টিস্যু বক্স হাতে নিয়ে বসে। একটু পরপর নাক মুছতে। ফলে নাক টকটকে লাল একদম কৃষ্ণচূড়ার ন্যায়।এতে দেখতে আরো কিউট লাগছে। মিসেস রুণা অরুণের কপালে হাত দিয়ে একটু পর পর তাপমাত্রা পরখ করছে। বস বলে গেছে কি না! তার পাশের ডেস্কটপ থেকে লাবিব একটু পর পর উঁকি দিচ্ছে। সামনের ডেস্কটপ থেকে অপর্ণা হাই দিচ্ছে ভোরকে। ভোর হাসিমুখে তাদের সাথে হাই হ্যালো ও উঁকি দিচ্ছে।
-” পরনা আপু? লাবিব আংকেল? তোমরাও আসো না এখানে আমি বোর হচ্ছি!”
ব্যস ভোরের বলতে দেড়ি তাদের আসতে দেড়ি না। ছোট বস হুকুম করেছে মানতে বাধ্য কিনা! লাবিব কদমবুসি করে ভোরকে বলে,
-” বলুন ছোট বস কি করে আপনার মনোরঞ্জন করতে পারি?”
অপর্ণা তার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলে,
-” ছোট বস গান গাইতে বলো!”
মিসেস রুণা নিজের কাজ করতে করতে তাদের দুজনকে বলে,
-” কাজ বাদ দিয়ে আড্ডা দাও বস এসে ঈদ বোনাস কাট করে দিবেনি!”
ভোর লাবিবের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। লাবিব তাকে কোলে তুলে চুমু খায়। মিসেস রুণার কথার প্রেক্ষিতে বলে,
-” বোনাস দিয়ে কি করবো ম্যাম ! বউ তো দূর একটা গার্লফ্রেন্ডও নেই! বোনাস আমার লাগতো না! তবে বোনাস সরূপ একটা বউ দিলে ভাবা যেত!”
অপর্ণা তার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” দাদা আপনার দুঃখ বুঝি আমি। আন্টির ফোন নাম্বার দিতে পারেন আমি কথা বলতে পারি যে আপনার ছেলে বিয়ের জন্য নাচছে।”
-” না ম্যাডাম তার দরকার নাই। সিঙ্গেল আছি বেশ আছি!”
ভোর দুজনের কথাবার্তায় বিরক্ত হয়। তার ছোট্ট মাথাটা এমনিতেই ব্যাথা করছে এদের বকবকানিতে সেটা বেড়ে যাচ্ছে।
-” তোমরা চুপ করবে একটু! আমার ভালো লাগছে না।”
সবাই ব্যস্ত হয়। বস ছেলেকে দিয়ে বলে গেছে একটু খেয়াল রাখতে। সে ইন্টারভিউ নিচ্ছে। মিসেস রুণা এসে আবার ভোরের কপাল গলায় হাত রেখে বলে,
-” খারাপ লাগছে? শুয়ে পড়বে?”
ভোর তার হাত সরিয়ে লাবিবের গলা জড়িয়ে বলে,
-” শুবো না। আমার ক্ষিধে পেয়েছে। আব্বুকে ডাকো!”
অপর্ণা হেসে বলে,
-” এই ব্যাপার? কি খাবে বলো ছোট বস?”
ভোর সেভাবেই লাবিবের গলা জড়িয়ে বলে,
-” তোমরা মেনু বলো আমি ডিসাইড করবো!”
মিসেস রুণা হেসে দেয়।
-” আমার লাঞ্চ বক্সে নুডুলস আছে। খাবে?”
-” না। ওটা খেতে ইচ্ছে করছে না!”
লাবিব বলে,
-” আমার মা ভুনা খিচুড়ি দিয়েছে। সাথে সর্ষে ইলিশ খাবে?”
ভোর লাবিবের মুখোমুখি চায়।
-” তোমার মা দিয়েছে? উনিই রেঁধেছে?”
লাবিব মাথা নাড়ল। ভোরের খাওয়ার লোভ হয়। রোহান বলে মায়ের রান্না টেস্টি টেস্টি হয়। ভোর শুষ্ক ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,
-” খাবো!”
লাবিব তাকে মিসেস রুনার ডেস্কটপের উপর বসিয়ে লাঞ্চ বক্স আনতে যায়। অপর্ণা ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” তোমার তো এলার্জি আছে। ইলিশ মাছ খাওয়া যাবে না। আমার বক্সে চিকেন ফ্রাই আছে আনবো?”
ভোর ঠোঁট চৌখা করে বলে,
-” তোমারও মা রেঁধেছে পরনা আপু?”
অপর্ণা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ,
-” না! আমি নিজে রেধেছি!”
-” তোমার মা রেঁধে দিল না কেন?”
-” আমার মা তো নেই! ভগবান নিয়ে গেছে।”
ভোরের মুখ মলিন হয়ে যায়। চোখ ভিজে যায়। সে টিস্যু দিয়ে নাক মুছে কাঁপা গলায় বলে,
-” স্যরি পরনা আপু!”
অপর্ণা হেসে ভোরের কপালে চুমু খায়।
-” তুমি স্যরি কেন বলছো ছোট বস! স্যরি তো ভগবানের বলার কথা ! বাবা মা দুজনকেই নিয়ে গেল। তুমি বস আমি লাঞ্চ বক্স আনছি!”
বলেই চলে যায়। ভোরের মনটা খারাপ হয়ে যায়। পরনা আপুর বাবা মাকে তার ভগবান কেন নিয়ে গেল? সে একা কিভাবে থাকবে! মিসেস রুনা হাসে। মেয়েটা চঞ্চল ,হাসিখুশি থাকে সবসময়।দেখে বোঝার উপায় নেই বুকের গহীনে কতটা কষ্ট লুকিয়ে। এরমধ্যে লাবিব আসে পানির বোতল ও বক্স হাতে।
ভোর আবদার করে তাকে খাইয়ে দিতে হবে।মিসেস রুণা চামচ ধুয়ে বক্সের ঢাকনায় অল্প খিচুড়ি নিল। সবটুকু খেতে পারবে না শুধু এটো করার কি দরকার। সে মাছ নেয় না। অপর্ণার বক্স থেকে চিকেন ফ্রাই নিয়ে চামচ দিয়ে খাইয়ে দেয়। ভোর অল্প একটু খেয়ে আর খাবে না। মিসেস রুণা জোর করে না। পানি খাইয়ে মুখ মুছে দেয়। ভোর ডেস্ক থেকে নেমে লাবিবের কোলে উঠে। লাবিব তাকে কোলে নিয়ে ডেস্কে বসে কাজ করতে থাকে।
ভোর উশখুশ করতে থাকে একটু পর। লাবিব কি হয়েছে বলতেই লাবিবের কোল থেকে নেমে ফ্লোরে গরগর করে বমি করে দেয়। লাবিব ধরে তাকে। অপর্ণা,মিসেস রুণা , পিয়ন সহ বেশ কয়েকজন ছুটে আসে। ভোর বমি করে অস্থির হয়ে গেছে। লাবিব মুখে পানি দিলে ভোর কুলকুচি করে ফেলে কেঁদে বলে,
-” আব্বুর কাছে যাবো! আব্বু?”
লাবিব পানি তার মুখ ধুয়ে রুমাল দিয়ে মুছে দেয়। কোলে করে নিয়ে ইন্টারভিউ রুমের সামনে যায়। সেখানে মেয়েদের ভিড় গয়নার ফটোশুটের নতুন মুখের জন্য। দরজার সামনে এক কর্মী বসে। সে প্রার্থীদের ভিতরে যাওয়ার জন্য বলছে। তার কোলে ভোরকে দেখে দরজা খুলে দেয়। সে নক করে ভিতরে ঢোকে। ভোর বাবাকে দেখে আব্বু বলে কেদে দেয়। অরুণ ক্রন্দনরত ছেলেকে দেখে উঠে এসে বুকে টেনে নিল। গলায় কপালে হাত রাখে। লাবিব স্যারের অস্থিরতা দেখে বলে,
-” ক্ষিধে পেয়েছে বলছিল। অল্প খাওয়ার পর বমি করেছে। এখন কাঁদছে আপনার কাছে আসার জন্য! আমি যাচ্ছি স্যার!”
অরুণ মাথা নাড়ে। ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলে,
-” খারাপ লাগছে আব্বু? জ্বর আসছে আবার। আল্লাহ আমার ছেলেটাকে সুস্থ করে দাও!”
ভোর বাবার বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে নেয় আরামে।
-“এখন মালো লাগছে আব্বু!
ম্যানেজার সুজন উঠে আসে। একজন প্রার্থী বসে আছে।তার ইন্টারভিউ চলছিল। সুজন স্যারের কাছে গিয়ে বলে,
-” স্যার ইন্টারভিউ কি ওফ রাখবো?”
অরুণ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” না। কন্টিনিউ করো!”
বলে কেবিনের চেয়ারে বসে বুকে ছেলেকে নিয়ে। বাকি ইন্টারভিউ সে ছেলেকে বুকে নিয়েই করে। ইন্টারভিউ শেষ হলে সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি চলে যাবে। আর যাওয়ার আগে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে ভোরকে। যেই ভাবা সেই কাজ। ব্যাগে কিছু ফাইল ভরে। বাড়ি গিয়ে দেখা যাবে। নিজের কেবিনের দরজা খুলার সাথে সাথেই হুড়মুড়িয়ে ঢোকে একদল লোক। অরুণের কপাল কুঞ্চিত হয়। বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,
-” তোরা এখানে?”
সবাই স্বমস্বরে বলে,
-” তোকে কনগ্রেটস করতে এলাম বি..”
অরুণের ইশারায় থেমে যায় সব। ভোর দূর্বল চোখে সবাইকে দেখে। হাসিমুখে বলে,
-” তোমরা সবাই ভালো আছো?”
ব্যস সবাই ভোরের উপর হামলে পড়ে। অরুণের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে সবার কোলে ঘুরতে থাকে। একবার এ কোলে নিয়ে চুমুতে ভরিয়ে দেয় তো তার থেকে আরেকজন নিয়ে। ভোরের আদর খেয়ে ভালো লাগলেও শরীর চলছিল না। বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে মলিন মুখে। অরুণ ছেলের চাহনি বুঝে ওদের কাছ থেকে নিল।
-” জ্বর ছেলেটার। নইলে শান্ত থাকে!”
শুভ এসে কপালে হাত রেখে বলে,
-” তাইতো! ওষুধ খাইয়েছিস? আর তোকেও বলিহারি অসুস্থ ছেলেকে টেনে আনতে হবে অফিসে?”
অরুণ কিছু বলে না। বন্ধুদের দিকে চায়। শুভ, রাসেল, জীবন, মুস্তাকিম, ফয়সাল ও দ্বীপ্ত! মোট সাত জনের বন্ধু মহল তাদের। আরো তিনজন ছিল পরশি, তমা ও দোয়েল। তারা স্বামী বাচ্চা সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ওদের সাথে কথা কম হয় এই যা। অরুণ সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
-” দেখ কথাবার্তা সাবধানে বলবি ওর সামনে। সময় হলে জানাবো আমি। তোরা নিজেদের মুখে ব্রেক লাগা!”
মুস্তাকিম তাকে চোখ টিপে বলে,
-” মামা তুই তো গ্লো করছিস! ফেয়ার এন্ড লাভলী মেখে নাকি কোনো ঔষধি পাতার রসটস খেয়ে? হুম হুম?”
অরুণ ছেলেকে নিয়েই এগিয়ে আসে । মুস্তাকিমের পিঠে এক ঘা লাগিয়ে বলে,
-” বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু?”
মুস্তাকিম থেমে যাওয়ার লোক নয়।
-” বুঝতে পারছি রস টস খেয়েই এমন হয়েছিস।”
অরুণ চোখ রাঙায়। মুস্তাকিম সহ সকলে হেসে ওঠে। শুভ হাসি থামিয়ে দুঃখি ভাব নিয়ে বলে,
-” ভাই এটা কিন্তু তুই ঠিক করিস নি। বিষধর রাসেলস ভাইপারকে সাথে নিয়ে গেলি অথচ আমরা সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হলাম!”
রাসেল কটমট করে চেয়ে বলে,
-” শালার ঘরের সম্বন্ধি অশুভর বাচ্চা!”
শুভ বত্রিশ পাটি দেখায়। জীবন সবার মধ্যে শান্তশিষ্ট ও ভদ্রগোছের। সে অরুণকে সিরিয়াস গলায় জিজ্ঞেস করে,
-” রাসেলের থেকে শুনলাম হুট করে সিদ্ধান্ত নিলি ভেবে নিয়েছিস ভালোভাবে? পরে পস্তাতে না হয়!”
অরুণ গম্ভীর ইবলে,
-” ভেবেচিন্তেই নিয়েছি। কলিজার সাথে জড়িত কোনকিছুতেই হুট করে কিছু করি না। আর শুভ তো ব্যাপারটা নিয়ে উঠে পরে লেগেছিল তাই ওর কথা রাখতেই সব!আফটার ওল বন্ধু বলে কথা!”
সবাই শুভর দিকে চায়। শুভ চোখ বড় করে চায়।
-” শালা! তুই ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছিস এখন আমার নাম গাইছিস? মিস পাতাবাহার মিস..”
ফয়সাল তার মুখ চেপে ধরে। অরুণ চোখ রাঙিয়ে চেয়ে। শালাদের মুখে ব্রেক কবে লাগাবে। কিন্তু ভোরের রেসপন্স নেই। সে ঘুমিয়ে গেছে। তাই সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। তবে অরুণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কলিজাটা অসুস্থ কিনা!!
বর্ষাকাল ঋতুতে দ্বিতীয়। আষাঢ় শ্রাবণ মাস বর্ষা কাল। ক্যালেন্ডারে আষাঢ় মাস চলছে। চারদিকে বর্ষণের গুঞ্জন শোনা যায়।কখনো ঝিরিঝিরি তো কখনো মুষলধারায়। টিনের চালে মুষলধারে বৃষ্টির ফোঁটা ঝমঝমিয়ে পড়ায় যে শব্দের ঝংকার সৃষ্টি হয় তার কোনো তুলনা নেই। ভালো ভালো মিউজিকেও হার মানায়। এখন মুষলধারায় বর্ষণ হচ্ছে প্রিয়র ঘরের চালের উপর। পাতা চিৎ হয়ে শুয়ে পাশে প্রিয় বোনকে জড়িয়ে। গায়ে কাঁথা টানা। পাভেল ,ফরহাদ সোফায় বসে। কাওসার একটু আগেই চলে গেছে মা এর ডাকে। লুবমান পাতাকে রেখে খাওয়া দাওয়া করে চলে গেছে। সবাই থাকতে বললেও সে সরাসরি মানা করে দেয়।
ভর সন্ধ্যায় পাতা সব ভাইবোনদেরকে বিয়ের ঘটনাটা কাটছাঁট দিয়ে শোনায়। প্রিয়, ফরহাদের রাগ গলে পানি পানি হয়ে গেছে। তবে প্রিয় রেগে আছে অরুণ সরকার নামক লোকের উপর। তার পাতুপুকে নিয়ে যাবে!! পাবেল, ফরহাদ খুশি হয়েছে। ফয়সাল পাতাকে বলে,
-” পাতা আপু? তোমার কাছে দুলাভাইয়ের ছবি আছে? একটু দেখাবে? আচ্ছা বেশিই বুড়া?”
পাতা আড়চোখে ভাইদের দিকে আয়।
-” খবরদার বুড়ো বলবি না! আর ছবিটবি নেই!”
পাবেল আগ্রহ নিয়ে বলে,
-” আমি দেখেছি ওনাকে। বুড়ো নয় মোটেও। হ্যান্ডসাম আছে বেশ। পুরাই সুদর্শন পুরুষ গাম্ভীর্যে ঘেরা। কম কথা বলে হাসেও কম! আর এসব তার পারসোনালিটির সাথে বেশ যায়।”
প্রিয় বিরক্ত হয়। ফরহাদ আগ্রহের সাথে সব গলাধঃকরণ করছে। পাভেল আরো কতশত গল্প জুড়ে দেয় অরুণ সরকারকে ঘিরে। পাতা হাসে সেসব শুনে। হঠাৎ মনে আসে ভোরটার জ্বর এসেছিল। কমেছে কি? ছেলেটার জন্য কেমন যেন উদ্বিগ্নতা মিড় করে মনকুঠিরে! আগে তো এমন হতো না! এখন কেন হচ্ছে? নতুন সম্পর্কে জুড়ে গেছে তাই কি? পাতা আসছি বলে ফোন হাতে নিয়ে বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে। বৃষ্টি পড়ছে বাইরে ঝমঝমিয়ে। পাতা বারান্দার সিমেন্টের খুঁটির পাশে দাঁড়িয়ে কল লাগায় অরুণ সরকারের নাম্বারে। প্রথম বার রিসিভ হয় না। দ্বিতীয় বারের বেলায় কেটে দেয়। পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। কেটে দিল কেন? তার ভাবনার মাঝেই কল আসে অরুণের নাম্বার থেকে। পাতার ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। ওহ নাক উঁচু লোক কল দেওয়ার জন্য কাট করেছিল। নহ কিছুটা হলেও ম্যানারস জানে। সে রিসিভ করে সালাম দেয়। অরুণ সালামের উত্তর মনে মনে নিয়ে গাম্ভীর্যের সঙ্গে প্রশ্ন করে,
-” পৌঁছে গেছেন?”
পাতা এক হাতে ফোন কানে ধরে অপর হাতে বৃষ্টির পানি মুঠোয় ভরে।
-” হুম। সেই বারোটায়। ছেলেটার জ্বর কেমন? কমেছে?”
অরুণ ঘুমন্ত ছেলের শিয়রে বসে জলপট্টি করছে। ফোন স্পিকারে দিয়ে বিছানায় ফেলে রেখেছে।আর পাতাবাহার ফোনে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। কোথা থেকে আওয়াজ আসছে বোঝার জন্য। সন্ধার আগ দিয়েই বাড়ি ফিরেছে বাবা ছেলে। ছেলেটাকে ডাক্তার দেখিয়ে এনেছে। জ্বর বেশ, একশ এক! ডাক্তার ওষুধ লিখে দিয়েছে। অরুণ বাড়ি এসেই ছেলেকে একগ্লাস দুধ খাইয়ে ওষুধ দিয়েছে। আর কিছুই খাওয়াতে পারে নি। ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে ছেলের কপালে চুমু খায়। গলায় হাত বুলাতে থাকে।মিস পাতাবাহার ফোন করে ছেলের খোঁজ নিচ্ছে। অধরকোনে হাসির ঝিলিক দেখা যায়। নাহ চিনতে ভুল করে নি!
-” কমেছিল! বিকেল থেকে আবার জ্বর এসেছে। বমি করেছিল! ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। এক গাদা ওষুধ দিল। শুধু দুধ খেয়েই ওষুধ খেল। আর কিছুই খাচ্ছে না!”
পাতা চিন্তিত হয়ে পড়ে।
-” জ্বরে মুখে ভালো লাগে না হয়তো! আপনি একটু জোর করে অল্প অল্প করে একটু পর পর খাইয়ে দেবেন বাবা সোনা বলে। আর জ্বর বেশি হলে জলপট্টি দিবেন! আর..”
থেমে যায় পাতা। অরুণ আগ্রহ নিয়ে শুনছিল। থেমে যাওয়ায় কপাল কুঁচকে যায়। গম্ভীর কণ্ঠ হালকা নরম করে বলে,
-” আর?”
পাতা মুঠো ভর্তি পানি শুন্যে ছুঁড়ে।
-” আর টেনশন করবেন না। ঠিক হয়ে যাবে। নরমাল জ্বর!”
অরুণের অধরকোনে পুনরায় হাসি ফুটে ওঠে।
-” হুম! কি করছেন?”
-” এই তো বৃষ্টি দেখছি! এখানে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে।”
-” আমাদের এখানেও ।তবে হালকা! এই আপনি কোথায় আছেন? মানে আমি..”
পাতা হেসে বলে,
পাতা বাহার পর্ব ২১
-” প্রিয়দের বাড়ি! লতা আপুর খালার বাড়ি!”
অরুণের ভ্রু যুগল কুঁচকে যায়,
-” আপনার খালার বাড়ি না?”
-” নাহ! আমার তো মায়ের বাড়ি?”
-” মানে?”
-” মানে কিছু না। অন্যসময় বলবো! ভোর কি করছে?”
অরুণ ছেলের গায়ের কম্ফোর্ট ঠিক করে দেয়। বিড়াল শাবকটি বারবার টেনে সরিয়ে দিচ্ছে।
-” ঘুমুচ্ছে