পাতা বাহার পর্ব ২৭

পাতা বাহার পর্ব ২৭
বেলা শেখ 

তিমির রাত্রি। চারপাশ ঘনঘটা তিমিরে ছেয়ে আছে। রাতের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। মাঝে মাঝে দূর থেকে কুকুরের ডাকের ক্ষীন আওয়াজ ভেসে আসছে। সরকার বাড়ির সকলে ঘুমে বিভোর। আরিয়ান কিচেনে এসেছে। জগে পানি ছিল না। এদিকে তার মনটা পানির তৃষ্ণায় কাতর। সে ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানি ঢক ঢক করে গিলে ফ্রিজ বন্ধ করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়! হঠাৎ কিছু খচখচ আওয়াজে কান তীক্ষ্ণ হয়। একজন আইনজীবী হওয়ার দরূণ ছোট্ট কোনো ঘটনা ঘিরেই তার সন্দেহ মানসিকতার প্রলুব্ধ ঘটে। সে কান খারা করে; ওই তো আবার আসছে। সে সিঁড়ির একপাশে আড়ালে লুকিয়ে যায়।

একটু পরে দেখা মেলে ভাইয়ের বন্ধু জীবনের। দাঁত বের করে হাসতে হাসতে উপরে উঠছে তাকে খেয়াল করে নি। এতো রাতে উপরে কোথায় যাচ্ছে? গেস্ট রুম তো নিচ তলায়! ভাইয়ের ঘরে? হতে পারে! বাট ওভাবে হাসছে কেন? তাও একা একা! সে সন্দেহ মন নিয়ে সতর্কতার সাথে পিছু পিছু যায়। জীবন ঢুলু ঢুলু পায়ে হাঁটতে হাঁটতে অরুণের ঘরের পাশে স্টাডি রুমে যায়। সেখানে পর্দার আড়ালে আরেকটা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে; কিন্তু উভয় দরজা বন্ধ করার কথা বেমালুম ভুলে যায়। আরিয়ান সেই ভুলের সুযোগ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। হাসাহাসি ও ফিসফিসানির আওয়াজ আসছে। একা নয় সবকটাই আছে মনে হয়!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আজ হাতেনাতে ধরবে! সে দরজা আস্তে ঠেলে উঁকি দেয়। তার ভাবনাই ঠিক সবাই আছে। এই সিক্রেট রুমে শুধু ফ্লোরে পাতানো বিছানা। চারকোনা ঘরের একপাশে দেয়াল নেই। শুধু গ্লাস! সেই গ্লাসে বাইরের পরিবেশ দৃশ্যমান। গ্লাস ঢাকার জন্য পর্দা আছে। সবাই পাতানো বিছানায় এলোমেলো হয়ে বসে, শুইয়ে। একজনের ঠ্যাং আরেকজনের উপর! তার গুনধর ভাইও আছে, সে গম্ভীর মুখে সোজা হয়ে বসে; সবার কথা গিলছে। হাতে তাদের পুরনো সঙ্গী। ল্যাপটপে ‘দা নান’ মুভি চলছে। সেটা দেখেও সবাই হে হে করে হাসছে। কারো পরণেই জামাকাপড় নেই শুধু শর্টস। আরিয়ান ধরাম করে দরজা খোলে। সে শব্দে সকলে বিয়ারের বোতল চটজলদি বালিশের নিচে লুকিয়ে দরজার দিকে তাকায়। আরিয়ান বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে বলে,

-” ভালোই চলছে তোমাদের ব্যাচেলর পার্টি! আমাকে ইনভাইট করো নি? বুড়োকালে বাচ্চা বউ থাকতেও ব্যাচেলর পার্টির আয়োজন?”
মুস্তাকিম দাত বার করে হে হে করে হেসে বলে,
-” বুড়ো কে রে? বুড়ো হবে তোর শশুড়! আমরা সদ্য যৌবনে পা দেয়া টগবগে পুরুষ! সন্দেহ থাকলে প্রমাণ দিতে প্রস্তুত! চল ঘরে?”
আরিয়ানের কান ঝাঁ ঝাঁ করে। না জানি কয় বোতল গিলেছে!

-” তোমাদের ঘরওয়ালি আসুক‌ তাদের জনাই তাদের স্বোয়ামীর গুনগান! আর ভাই তুমি? না করেছিলাম না?”
অরুণ উঠে দাঁড়ায়। লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ অরুণের পরণে হাঁটু অবধি শর্টস। লোমশ ফর্সা পা ও বুক হা করে খোলা। সে গম্ভীর গলায় বলে,
-” আমি এসবে ছিলাম না। ওরা সব অ্যারেঞ্জ করেছে। একটু আগে আমাকে ডেকে বলে এই এই কান্ড। আমি মানা করি শোনে না। জোর করে আমায়ও এক বোতল গিলিয়েছে!”
ওর সব বন্ধুরা হা। কি সুন্দর বানিয়ে মিথ্যে বলছে। ওথচ এসবের গুরু ঠাকুর অরুণ সরকার খোদ! সেই তাদের বলেছে অ্যারেঞ্জ করবে। তারা তো খুশিতে বাকবাকুম করে তার পিছনে পরে ছিল!

মিষ্টি মধুর অপেক্ষায় পাতা প্রহর গুনছে। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসতে যে বেশি সময় নেই। খুব শিঘ্রই পাতা দায়িত্বের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে নিজ আসল গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। শুরু হবে পাতার জীবনের নতুন অধ্যায়। যে অধ্যায় পাতার জীবনের চ্যাপ্টারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পেরিয়ে যাওয়া পঁচিশটা বসন্ত তার ওবাড়ি এবাড়ি বেড়াতে! , দায়িত্ব, পালক সন্তান, অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান, বোঝা ইত্যাদি কটুক্তি আত্মীয় স্বজন ও লোকমুখে শুনতে শুনতে।

°~তোমাদের সেই পালক মেয়েটা না?”
~নিজের সন্তান তো হয়েছেই অন্যের বোঝা কেন টেনে বেড়াবে? বেঁচতে মোটা অঙ্কের টাকা লাগবে না!
~ আল্লাহর রহমতে এক পোলা ও এক মাইয়া হইছে! অভাবের সংসারে পাতারে কেমনে টানি। তোমার বোনের কাছে দিয়া আসো।”
~ তাকে চাই নি! কিন্তু জন্ম যখন দিয়েছি দায়িত্ব পালন করতেই হবে! বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব কাঁধ থেকে নামিয়ে শান্তির শ্বাস ছাড়বো!”
~ ও তো আমারই মেয়েই! দূরে ছিলো বলে লতা লুবমানের মতো টানটা হয়তোবা আসে না! তবে ভালো ওকেও কম বাসি না।°

এরকম আরো অনেক কথা পাতার মস্তিষ্কে গেঁথে আছে। যেগুলো ভুলে যাওয়ার সময় হয়তোবা এসেছে। অবশেষে পাতার নিজস্ব কোনো ঠিকানা হবে। নিজস্বই তো! বিয়ের পর স্বামীর ঘর বাড়িই তো মেয়েদের আসল ঠিকানা। তার নিজ আবাসস্থল! যেখানে স্বামী, সন্তান নিয়ে তার সংসার। বাবা মায়ের বাড়িতে সে আসবে শুধু দু এক দিনের মেহমান হয়ে। পাতা দৃঢ় সংকল্পে আবদ্ধ হয়। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে নতুন জীবন নতুন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেয়ার। স্বামী নামক মানুষটা, স্বামীর কলিজা নামক ছেলে ভোর; তার ভাবি সংসারটাকে আগলে রাখার।
-” আপু মেকাপটা আরেকটু গাঢ় হলে ভালো লাগতো!”

পার্লারের মেয়েটার কথায় পাতার ধ্যান ভঙ্গ হয়। সে বোন লতার দিকে চায়। অরুণ সরকার আজকেও পার্লারের মেয়েদেরকে পাঠিয়েছে। কিন্তু লতা পার্লারের মেয়েদের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছে। তার আলাভোলা সুন্দর বোনকে মেকাপ করে কি মেকাপ সুন্দরী বানিয়ে দিয়েছিল হলুদ সন্ধ্যায়। দেখতে সুন্দর লাগলেও কেমন অচেনা অচেনা লাগছিল লতার কাছে। তাই সে আজকে পার্লারের মেয়েদেরকে পাতার কাছে ঘেঁষতে দেয় নি নিজেই সাজাচ্ছে। সে পাতাকে আইলানার পড়াতে পড়াতে জবাব দেয়,
-” এমনেই সুন্দর লাগছে। ভারী মেকাপ করে কি লাভ; নিজস্ব সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখার? আমার বোন এমনিতেই সুন্দর মেকাপ করে সৌন্দর্য বর্ধনের প্রয়োজন নেই।”

বলে নিজেই সাজিয়ে দেয়। বরযাত্রী আসতে যে বেশি সময় নেই।
-” শোন পাতা? তুই যে পথে যাচ্ছিস সেটা সোজা নয়। হাজারো কাঁটায় ভরপুর।অথচ তুই সেটাকে ফুল সজ্জিত বাগান ভেবে স্বপ্ন বুনছিস! জানি এখন বললে তোর মনটা খারাপ হবে তবুও‌ বলছি; অরুণ ভাইয়া বর্ষা মেয়েটাকে অনেক ভালোবাসতো। ভালোবাসা অনেক ভয়ংকর পাগলি! ওত সহজে ভোলা যায় না। সে বাদ দে; তুই শুধু নিজের উপর ভরসা রাখবি। নিজেকে স্ট্রং বানাবি। সংসার জীবন অনেকটা স্ট্রাগল, স্যাক্রিফাইস, মানিয়ে নেওয়া, মেনে নেওয়া! তার মানে এই না নিজস্ব সত্তাকে হারিয়ে ফেলবি। তোর শাশুড়ি কিন্তু অরুণের সৎ মা; কিন্তু তাকে কখনো হেলাফেলা করবি না। সে যেমনি হোক মুরুব্বি মানুষ।

তাকে সমীহ করে চলবি। তোর একটা ননদ আছে তার সাথে মিশবি; তবে লিমিটের মধ্যে। অতিরিক্ত সবকিছু ভয়ংকর। আর দেবর, তার স্ত্রী বাচ্চা? তাদের সাথেও মানিয়ে চলবি। সংসারে একসাথে থাকলে টুকটাক মনোমালিন্য ঝগড়া হবেই; সব কথা ভাইয়াকে বলবি নি। নিজে সমাধান করার চেষ্টা করবি। ভোর তোর নিজের সন্তান না; তবুও তাকে মায়ের মতোই ভালোবাসবি।তুই ই তো বলেছিলি; মা মা ই হয়! সৎ আপন নয়। এই সম্পর্ক নিয়ে কেউ কটাক্ষ, কটু কথা বললে মাথা ঘামাবি না।সব কথা কানে নিতে নেই। মনে রাখবি কিছু কথার জবাব সময় দিয়ে দেয়। তিনটা বাক্য মনে রাখবি,

~ উইক পিপলস রিভেঞ্জ
স্ট্রং পিপলস ফরগিভ
ইন্টেলিজেন্ট পিপলস ইগনোর°
পাতা গম্ভীর বিজ্ঞ‌ ব্যাক্তিজের মতো মাথা নাড়ে। লতা বোনের গালে মুখে চুমু খায়। বোনকে জড়িয়ে ধরে থাকে বেশ সময়। পাতা তাকে জড়িয়ে বলে,
-” আপু ক্ষিধে পেয়েছে আমার!”
লতা পাতাকে ছেড়ে দিয়ে আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলে,
-” এখন খাওয়ার কথা মুখেও আনবি না। সব সাজ নষ্ট করার ধান্দায়! তোর আদরের জামাই আসুক। সব‌ নিয়ম নীতিমালা মেনে বিয়ে হোক তারপর একসাথে খাবি! আশ্চর্য মেয়েরা বিয়ের দিন নার্ভাসনেসের কারণে পানি পর্যন্ত খেতে পারে অথচ এই মেয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি চারবেলা খেয়েও বলে কি না ক্ষিধে পেয়েছে!”
পাতা গোমড়া মুখে গাল ফুলিয়ে বলে,
-” আশ্চর্য ক্ষিধে পেলে আমার কি দোষ!”

গোধূলি বেলা। আলোকিত মেদিনী জুড়ে অন্ধকার হাতছানি দিচ্ছে। পশ্চিম আকাশ লাল লালিমায় ছেয়ে আছে। সূর্য অস্তমিত হওয়ার আর সময় বাকি নেই। অরুণ সহ বাকি সবাই পাতাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। তিনটা সজ্জিত গাড়ি সাথে। বেশি মানুষ যাবে না। উর্ধ্বে বিশ জন। অরুণের সব‌ বন্ধুরা, আরিয়ানরা, আদুরি ও তার দুই বান্ধবীর, অরুণের মামা স্বাধীন চৌধুরী সহ আর কিছু মানুষ। অরুণ সহ তার সব বন্ধুরা একটা হাইসে। বাকি সবাই অন্য হাইসে। আর বরের গাড়িতে শুধু ড্রাইভার আর মেয়র সাহেব। অরুণ গাড়িতে চুপচাপ ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে। ড্রাইভিং করছে রাসেল; তাই সে চুপচাপ। বাকি সবাই অরুণের উপর ক্ষেপে কথা শুনাতে ভুলছে না। আর তাদের ক্ষ্যাপার কারণ অরুণ শেরওয়ানি না পড়ে সাধারণ সাদা পাজামা পড়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে ‌এমনকি বর টুপি পর্যন্ত পড়ে নি। তাদের কথা তুই পড়বি না যখন কিনলি কেন? আরুণের সিম্পল জবাব,
-” ছেলের জন্য! ওর বিয়ের সময় ও এগুলো পড়ে বিয়ে করতে যাবে। যেই হারে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে; তাই এজ আ বিজন্যাসম্যান আগেই কিনে ফেললাম!”

ভোর বেশ লজ্জা পায়। ফর্সা গাল দুটো টমেটোর ন্যায় লাল আকার ধারণ করে। ইশ সে তো এখন ছোট্ট! অথচ বাবা তার বিয়ের কথা বলছে!! তার বুঝি লজ্জা করে না।সে বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে রাখে। সবাই ভোরের লজ্জা পাওয়া দেখে এটা ওটা বলে আরো লজ্জা দিতে থাকে; সাথে অট্টো হাসির বাক্স খুলে বসে। অরুণও কম না; সেও বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে এটা ওটা বলে। ভোর লজ্জায় কেঁদেই ফেলে,
-” আব্বু? আঙ্কেল? তোমরা সবাই পঁচা। আমি বিয়ে করবো না। কখনো না।”
অরুণ হেসে ছেলেকে জড়িয়ে বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে বলে,

-” এই তোরা থাম! আমার কলিজা লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জায় কেঁদে দিয়েছে। চুপ কর নারে?”
অরুণের ধমকে সবাই চুপ করে; তবে ঠোঁটের আগায় মিটমিট হাসি বিদ্যমান। খুনসুটির মাঝেই তারা বিয়ে বাড়িতে পৌঁছে যায়। ছোঠ ছোট বাচ্চারা গেট ধরে টাকা দাবি করছে। তারা যা আবদার করে অরুণের বন্ধুরা বিনা বাক্যে দিয়ে দেয়। বুড়ো বয়সে ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে কি তারা গেটের টাকা নিয়ে ঝগড়া করবে নাকি।
পিনপিন নিরবতা। সবাই ড্রয়িং রুমে অবস্থান করছে। ছোট্ট ড্রয়িংরুম; মানুষ অনুযায়ী জায়গা সংকুলান। তবুও সবাই এখানেই অবস্থান করছে। ড্রয়িংরুমের সোফা সরিয়ে সুন্দর করে ম্যাট্রেস বিছানো হয়েছে। দু ভাগে ম্যাট্রেস বিছানো হয়েছে। একপাশে অরুণ সরকার, স্বাধীন চৌধুরী সহ আরো কিছু লোক বসে।

অপর পাশ খালি। সেখানে কনে বসবে। মাঝখানে পর্দা। অরুণের সব বন্ধুরা সহ সকলে পাশেই চেয়ারে বসে আছে। অরুণ এভাবে বসে থাকায় বিরক্ত বোধ করছে। ছেলেটাও নেই; সে তো তার আম্মুর কাছে। তবে তার বিরক্তিকর মনোভাব বদলাতে আগমন হয় কনের। সবাই ‘বউ এসেছে’ ধ্বনিতে মুখরিত। অরুণ সেদিকে চায়। পর্দায় আবছা আবছা পাতাকে দেখতে পায়। লাল খয়েরি বেনারসী পরনে। আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ভোর পাতার কাছ থেকে তার কাছে ছুটে আসে; কোল দখল করে বসে পড়ে। পাতাকে নিয়ে বসানো হয় ম্যাট্রেসের উপর। তাকে ঘিরে বসে অনেক রমনী। কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করে। পাতাকে কবুল বলতে বললে পাতা চুপ থাকে কিছু পল। লাবনী আক্তার, পারুল, লতা, লুবমান ও আতিকুর ইসলামের দিকে চায়। আতিকুর ইসলাম পাতার কাছে এগিয়ে আসে। হাঁটু গেড়ে বসে পাতার মাথায় হাত রেখে বলে,

-” অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে। বাবা হয়েও বাবার মতো ভালোবাসতে পারি নি। তুমি কতটা স্নেহের সাথে আব্বু ডাকো অথচ আমি সে ডাকের মর্যাদা রাখি নি। পারলে এই অপরাধী আব্বুটাকে ক্ষমা করে দিও! মন ভরে দোয়া করি অনেক সুখি হও আম্মু!”
পাতা‌ ঝর ঝরিয়ে কেঁদে দেয়; সাথে লাবনী আক্তার ও লতা! আতিকুর ইসলাম পাতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” কেঁদো না। অনেক সুখী হও নিজের নতুন জীবনে! দুঃখ যেন আর ছুঁতে না পারে!”

কাজি সাহেব কবুল বলার তাগাদা দেয়। পাতা নিজেকে শান্ত করে ধীমে সুরে ‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল’ বলে। পরিবেশ আলহামদুলিল্লাহ ধ্বনিতে মুখরিত হয় । এরপর কাজি সাহেব রেজিস্ট্রার পেপারে পাতার সাক্ষর নিয়ে অরুণের কাছে আসে। অরুণ বিনা সময় ব্যয়ে কবুল বলে সাক্ষর করে দেয়। পুনরায় আলহামদুলিল্লাহ ধ্বনিতে মুখরিত হয় পরিবেশ। বিয়ে পড়ানো শেষে সকলের মিষ্টি মুখ করানো হয়। অরুণ পাতার মাঝখানে থাকা পর্দাটা সরে যায়। অরুণ পাতার দিকে চায়। মাথা নিচু করে লাল খয়েরি বেনারসী পড়ে। সাথে লাল খয়েরী দোপাট্টায় মুখশ্রী সম্পূর্ণ ঢেকে। কাজি সাহেব অরুণকে বলে কণের ঘোমটা সরিয়ে নিজের নববধূর চেহারা দর্শন করতে। অরুণ উঠে এগিয়ে আসে ছেলেকে সাথে নিয়ে। দীপ্ত অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-‘ ভাই শুধু মুখ দর্শন করলে হবে না! ভালোবাসার পবিত্র পরশ একে দিতে হবে ললাটে! তাই না কাজি সাহেব?”
অরুণ তার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙায়। কাজি সাহেব দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলে,

-” চোখ রাঙাবেন না। আপনার বন্ধু ঠিক বলেছে! আর তাছাড়া সে আপনার স্ত্রী; আপনার অংশ।”
পাতা ঘোমটার আড়ালে ঢোক গিলে। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে যেন। সারাটাদিনের নার্ভাসনেস যেন এখন উদয় হয়েছে। সে মাথাটা আরো নিচু করে নেয়। অরুণ ছেলেকে সাথে নিয়ে পাতার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। ওড়নায় হাত দিয়ে আস্তে আস্তে ঘোমটা সরায়। দৃশ্যমান হয় নববধূর স্নিগ্ধ শোভন চেহারা। হালকা কৃত্রিম সজ্জায় সজ্জিত। পাতা চোখ মুখ নিচু করে বসে। তার বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। অরুণ সরকার নামক লোকটার দিকে খুব করে তাকাতে ইচ্ছে করছে; কিন্তু তাকাতে পারছে না। সে এক বুক সাহসী মন নিয়ে মাথাটা হালকা উঁচু করে। যেই না তাকাবে তার সম্পূর্ণ শরীরটা যেন কেঁপে ওঠে।

পরনের বেনারসী খামচে ধরে। লোকটার উষ্ণ অধর তার ললাটে ছুঁয়ে। একটু বড় বড় দাড়ি নাক মুখে সুরসুরি দিচ্ছে যেন। স্বামী নামক মানুষটার থেকে পাওয়া প্রথম ভালোবাসার পরশ!! পাতা যেন হারিয়ে যায়। লম্বা শ্বাস টানে। সেদিনের সেই জেন্টস পারফিউম আবারো নাসা গহ্বরে বাড়ি খায়। অরুণ অধর সরায় পাতার ললাট থেকে। পাতা আর নজর ঝুঁকিয়ে রাখে না। অরুণের চোখে চোখ রাখে। মনপ্রাণ ভরে দেখে নেয় তার ভবিষ্যত পথের সঙ্গীকে! অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে পাতার দিকে তাকিয়ে। লাল খয়েরী নাকি মেরুণ; যাইহোক বেনারসীতে পাতা যেন ফুলে পরিস্ফুটিত হয়েছে। চোখে গাড় কাজল, আইলাইনার, নাকে তার দেয়া নথ, মাথায় ছোট্ট স্বর্ণের টিকলি আর ঠোঁটে গাড় লাল লিপস্টিক! আর কিছুই না; তবুও চোখ ফেরানো দায়।

নবদম্পতির এই সুখকর মুহূর্তে সিটি বাজায় ফয়সাল। পাতা অরুণের চোখাচোখি বিঘ্নিত হয়। পাতা নজর ঝুকায়। অরুণ সরে আসে। ভোর পাতার সামনে বাবার মতো করে বসে। পাতার গালে হাত জোড়া রেখে বাবার মতোই পাতার ললাটে চুমু বসিয়ে ডাকে,
-” আই লাভ ইউ আম্মু!”

পাতা বাহার পর্ব ২৬

পাতার আনন্দ অনুভূতি যেন দ্বিগুন বেড়ে যায়। হাত বাড়িয়ে ভোরের কপালেও চুমু দেয়। ভোরের হাসিমুখের হাসি বিস্তার লাভ করে। মাঝখান থেকে শুভ আফসোস করে বলে,
-” এটা কিন্তু দুর্নীতি! ভোর রিটার্ন গিফট পেলো অথচ অরুণ পেল না! আমি অরুণের তরফ থেকে ঘোর বিরোধীতা করছি!”

পাতা বাহার পর্ব ২৭(২)