পাতা বাহার পর্ব ২৮

পাতা বাহার পর্ব ২৮
বেলা শেখ 

গভীর রজনী। ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিঁঝিঁ ধ্বনিতে পরিবেশ ছেয়ে আছে। পরিবেশ থমথমে; একফোঁটা বাতাসের আনা গোনা নেই। গাছপালা স্থবির একটা পাতাও পর্যন্ত নড়ছে না। খরকুটো বাঁধানো বাবুই পাখির বাসায় সদ্য ডিম ফুটে বেড়িয়ে আসা বাচ্চাগুলো চিও চিও করছে। পাশে মা পাখিটাও আনন্দ ধ্বনিতে ডাকছে। নিজের ডানা দিয়ে মুড়িয়ে রাখছে তো কখনো বাসা থেকে বেরিয়ে উড়ে নিজের আনন্দ প্রকাশ করছে। বড় সেগুন গাছের ডালের সাথে লাউয়ের মতো ঝুলে আছে বেশ কয়েকটি খুড়কুটো বাঁধানো বাবুই পাখির বাসা। মা পাখিটার আনন্দে উড়ে বেড়ানো ও চিও চিও আওয়াজে বাকি পাখি গুলোও বেড়িয়ে আসে।তার সাথে মিলিয়ে উড়তে থাকে। মা পাখিটার বাসায় ঢুকে বাচ্চা দেখে আসে। সবাই মিলে আনন্দে মেতে ওঠে। বাটিয়ে নেয় তাদের আনন্দানুভূতি। ওথচ আমরা মুর্খ মানব অন্যের আনন্দ দেখে হিংসেয় জ্বলি!

রুবি ছেলের পাশে শুয়ে আছে। তন্মধ্যে আরিয়ান রুমে ঢোকে। দরজা লাগিয়ে দু হাত উঁচিয়ে হাই তুলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। অনেক রাত এখন ঘুমালেই নয়। পাশ ফিরে রুবির দিকে চায়; অধরকোণে মুচকি হাসির রেশ। রুবি ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” হাসছো কেন?”
আরিয়ান কাত হয়ে রুবির দিকে মুখ করে শোয়। ছেলেটা মাঝখানে গভীর ঘুমে।
-“এমনিতেই। ঘুমিয়ে পড় তো!”
-” হুম। অরুণ ভাইয়া‌ মানলো?”
আরিয়ান আবার চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল।
-” না। তাকে মানানো আমাদের দ্বারা প্রায় অসম্ভব।”
রুবি ঠোঁট চেপে হেসে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” ঠিক! তোমাদের শিরায় উপশিরায় শুধু জেদ! যা বলবে তাই; হাজার বলে কয়ে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়েও সিদ্ধান্ত পাল্টানো যাবে না!”
-” হয়েছে তোমার? এখন আমি ঘুমাবো। গুড নাইট!”
বলেই চোখ বুজে। রুবি দুঃখ প্রকাশ করে বলে,
-” বড় ভাবীর জন্য খারাপ লাগছে। ছোট্ট মেয়ে! বিয়ে, ফাস্ট নাইট নিয়ে তো সকলেরই ফ্যান্টাসি থাকে। ওরও ছিল হয়তোবা! কিন্তু ভাইয়া একটু বুঝলো না।”
আরিয়ান চোখ খুলে। রুবির দিকে বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে বলে,
-” বড় ভাবী? হুহ! ওইটুকুন মেয়েকে বড় ভাবি ডাকতে হবে নাকি এখন! আম পাতা জোড়া জোড়া! ঘুমাও তো!”
রুবি হেসে উঠলো। তার হাসির শব্দে আরিয়ান বিরক্ত হয়ে বালিশ কানে ঠেকায়। রুবি সেটা টান দিয়ে নিয়ে নেয়। হাসিমুখে বলে,

-” অবশেষে অরুণ ভাইয়া আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসলো! আচ্ছা আরিয়ান আমি যদি তোমাদের ছেড়ে চলে যাই তাহলে‌ তুমিও আবার বিয়ে করবে?”
আরিয়ান গম্ভীর গলায় সুধায়,
-” ছেড়ে যাবে মানে?”
রুবি একটু ঘাবড়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
-” এই যে মানে মানুষ মরণশীল আমিও যদি.. তুমি কি আরেকটা বিয়ে করবে?”
-” আরো দশটা করবো!”

শক্ত গলা। রুবি জিভে কামড় দেয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না রেগে আছে মহাশয়।কি দরকার ছিল এসব কথা বলে রাগিয়ে দেওয়ার? সে ছেলের পাশে কোল বালিশ রেখে আরিয়ানের পাশে আসে। বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আরিয়ান সরিয়ে দেয়। রুবিও আবারো জড়িয়ে ধরে।
মিনমিন করে বলে,

-” স্যরি উকিল সাহেব! আর বলবো না। প্লিজ মন খারাপ কোরো না।”
আরিয়ান কিছু পল চুপ থাকে। রুবিকে সরিয়ে দেয় না আবার আগলেও নেয় না। শান্ত গলায় বলে,
-” স্যরি‌ বললেই সব ঠিক হয়ে যায় তাই না? তুমিও দেখেছো আমিও দেখেছি বর্ষা ভাবির সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর ভাইয়ের ও তার ছেলের জীবন চলা। ভোরটা মা মা করে কাঁদতো। অরুণ ভাই তাকে বুকে জড়িয়ে কত সান্ত্বনা দিতো! তবুও কেঁদেই যেতো। ভাই চুপ থেকে ছেলেকে নিয়ে হাটতো এটা ওটা দেখিয়ে ঘুম পাড়াতো। তারপর সব শান্ত। ভাই ও ভোর দুজনেই। আমরা শুধু বাইরেরটাই দেখেছি। তাদের ভেতরের অন্তরস্থল ঝাঁকিয়ে দেখিনি সেখানের কি অবস্থা। আমার দুটো কলিজা! তুমি আমার সাথে এসব নিয়ে মজা করছো নাকি ভাইয়ের জীবন দেখে কটাক্ষ করছো?

রুবি অনুতপ্ত হয় বেশ। এভাবে বলা ঠিক হয় নি। সে আরিয়ানকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” কটাক্ষ করছি না। আমি ওতশত ভেবে বলি নি। রাগ কোরো নাতো! ভুল হয়েছে।”
আরিয়ান রুবিকে আগলে নেয়। পিঠে হাত গলিয়ে বাঁধন আরো শক্ত করে। রুবির ঘারে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে ,
-” আর কখনো এসব বাজে কথা বলবে না।আমি সহ্য করবো না‌।”
রুবি আরিয়ানের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে সায় জানায়। ধীরে ধীরে দুজন একে অপরের সাথে মিষ্টি আলিঙ্গনে মিশে নিদ্রায় তলিয়ে যায়।

পাতা শুয়ে আছে বিছানায়। তাকে জড়িয়ে ভোর ঘুমিয়ে। ঘুম এখনো গাঢ় হয় নি, সদ্যই ঘুমোলো। বিড়াল শাবকটি বিছানার কিনারা ঘেঁষে শুয়ে আছে। পাতা ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।‌ কি সুন্দর করে ঠোঁট উল্টিয়ে ঘুমুচ্ছে বাচ্চাটা! পুরাই কিউটনেস ওভারলোডেডে। পাতা গালে চুমু দিতে ভুলে না। এতো আদুরে বাচ্চাকে আদর না করে থাকা যায়! পাতা শুন্য দৃষ্টিতে চায়। কি হবে এ সম্পর্কের ভবিষ্যত? তার লতা আপুর কথা মনে পড়ছে। আপু ঠিক বলেছে। সে সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক ভাবে মন থেকে মেনে নিলেও অরুণ সরকার সেটা পারে নি। ছোট্ট একটা জীবন! সে জীবনে না পাওয়া গুলো নিয়ে আফসোস করে, ভেবে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না।

বরং যা পেয়েছি তাতেই শোকরিয়া আদায় করে আগে বাড়তে হয়। পাতা হাত পা কেমন শিথিল হয়ে আসে; কাঁপছে মৃদু। সে সবকিছু মেনেই পা বাড়িয়েছে। সে চায় সংসার টা মন প্রাণ দিয়ে করতে। কিন্তু তার একার প্রচেষ্টায় তো সেটা সম্ভব নয়! সে দু কদম বাড়িয়েছে এখন অরুণ সরকারকেও পা বাড়ানোর কথা ছিল! সে সম্পর্কে জড়ানোর আগে অরুণকে সুধে ছিল যে সে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না? তখনতো লোকটা মাথা উঁচু করে জবাব দিয়েছিল। তাহলে এখন তার আচরণ বিধি দেখে সন্দেহ কেন হচ্ছে। পাতার বুকটা ধ্বক করে ওঠে অজানা আশঙ্কায়। দায়িত্ব বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আরেকটা দায়িত্বের ফ্যাসাদে আটকে পড়লো নাতো? তেমনটা হলে পাতা দম আটকে মারা যাবে। ভাবতেই পাতার দম বন্ধ বন্ধ লাগে; কান্না পায়। আঁখি যুগল ভরে ওঠে তার।

বারংবার পলক ফেলে সেটা আটকানোর প্রচেষ্টায়। এরই মাঝে অরুণ সরকার বিছানায় আসে, উন্মুক্ত গায়ে। ভোরের অন্যপাশে শুয়ে পাতার দিকে ফিরে বলে,
-” ঘুমিয়ে পড়েছে?”
-“হুম। এখনো গাড় হয়নি ঘুম!
অনেক কষ্টে গলা দিয়ে আওয়াজ বের করে জবাব দেয় পাতা। অরুণ পাতার হালকা কম্পিত কণ্ঠস্বর খেয়াল করে। বুঝতে অসুবিধা হয় না কান্না আটকানোর প্রচেষ্টায়। আঁখি যুগলের টলমলে অশ্রু তার সাক্ষী। আর অরুণের এটাও বুঝতে বাকি থাকে না যে আঁখি জোড়ায় কেন বর্ষণের মেঘে আচ্ছন্ন! প্রশ্ন হলো সে কিভাবে ওই মেঘে আচ্ছন্ন আঁখি যুগলে রৌদ্দুরের হাতছানি বয়ে আনবে? পাতাবাহার নামক বিড়ালটি বিছানার কিনারা থেকে উঠে অরুণের পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়ে।সেটা দেখে পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। গা ঘেঁষা বিড়াল কোথাকার। অরুণ বিছানার পাশ থেকে কম্ফোর্ট এনে পাতা ও ছেলের গায়ে জড়িয়ে দেয়। পাতার এতক্ষণে খেয়াল হয় তার শীত অনুভূত হচ্ছিল। সে কম্ফোর্ট টা নিজের ও ভোরের সাথে জড়িয়ে নেয়। এসির টেম্পারেচার লো অনেকটা,অরুণ একটু বাড়িয়ে দেয় টেম্পারেচার। তারপর পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” ওকে আমার কাছে দাও? তোমার অসুবিধা হবে। ”
পাতা প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝতে পারে ভোরের কথা বলছে। সে মৃদু হেসে বলে,
-” আমার কাছেই থাক না? অসুবিধা হবে না। ভালো লাগছে আমার!”
অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে পাতার দিকে চায়। ভোরকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। মেয়েটা তার সম্মুখে ভোরকে বেশ এবং যথেষ্ট স্নেহ করে। তার অলক্ষ্যেও কি এরকম স্নেহ করবে ভালোবাসবে? সেটাই দেখার বিষয়। অরুণ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার জন্য হাত বাড়ায়। পাতা খানিকটা সরে যায় ঘাবড়ে গিয়ে। অরুণ ভ্রু যুগল কুঁচকে চায়। ছেলের মাথায় হাত রাখে। কি ভেবেছে মেয়েটা? পাতা গালে জিভ ঠেকায়। পাতা মনে মনে নিজেকে গালি দেয়। ! সে নজর সরায় ; নজরে আসে অরুণের উন্মুক্ত পেশল বাহু, লোমশ চওড়া সিনা, মেদহীন বলিষ্ঠ উদর , কণ্ঠস্বরে অবস্থিত ল্যারিংস বা আদম’স অ্যাপল!! পাতা ঢোক গিলে চোখ বুজে নেয়। পাতু হেইট ইউর মাইন্ড! অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। অরুণ পাশ ফিরে রিমোট বের করে লাইট অফ করে। লাইট ওফ করার সাথে সাথে পাতার চোক্ষুযুগল বড় হয়। সে তড়িঘড়ি করে বলে,

-” কারেন্ট চলে গেল কি?”
-” না ! লাইট অফ করে দিয়েছি। আর কারেন্ট গেলেও সমস্যা নেই। জেনারেটর আছে।”
শান্ত কণ্ঠে বলে অরুণ। পাতা আমতা আমতা করে বলে,
-” লাইট টা জ্বালিয়েই রাখুন মি. ভোরের বাবা।”
অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে।
-” কেন? আলোয় ঘুম হয় না আমার। এনি প্রবলেম?”
পাতা ঢোক গিলে বলে,
-” অন্ধকারে ভয় করে আমার! প্লিজ লাইটটা জ্বালান না?”

-” ওহ্। বাট ভয়ের কি আছে। অতোটাও ঘনঘটা অন্ধকার নয়; বেলকনির লাইট জ্বলছে। আবছা আলোয় সব স্পষ্ট তো! আর তুমি একা নও। আমি, ভোর তোমার সখি পাতাবাহারও আছে!”
পাতা গাল ফুলিয়ে নেয়। কম্ফোর্ট টা আরেকটু টেনে নিয়ে বলে,
-” ওই বিড়ালের বাচ্চা আমার সখি নয়। অন্ধকারে ও নিজেই তো ভয়ংকর! লাইট জ্বালানো যায় না?”
-” নাহ!”

পাতার মুখটা ছোট হয়ে যায়। সে চোখ বুজে পা ভাঁজ করে আরেকটু গুটিয়ে যায়‌। ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করতে থাকে। তবে তার এই চেষ্টাকে বিফলে দিয়ে অরুণ সরকার কম্ফোর্টের ভিতর দিয়ে হাত পুরে এক হাতে পাতার কোমড় জড়িয়ে নেয়। পাতা কেঁপে ওঠে। বক্ষস্থল ধ্বক করে ওঠে। হাত পা যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে ক্রমাগত। ভয় উত্তেজনায় বুক ধরফর করছে। লোকটার মতলব তো সুবিধার না। সে অরুণের হাতের উপর হাত রেখে সরিয়ে দিতে চায়। অরুণ ছাড়ে না বরং বাঁধন শক্ত করে। পাতার কন্ঠনালীতে শব্দ আটকে আসে তবুও মিনমিনে গলায় বলে,
-” কি করছেন? ছাড়ুন?”

-” তুমিই তো বললে অন্ধকারে ভয় পাও তাই আগলে নিলাম। যা ভাবছো সেরকম কিছু না। ভয় নেই!”
শান্ত কন্ঠে স্বান্তনা বানী দেয় অরুণ সরকার। পাতা একটু স্বস্তি পেলেও ভয় দূর হয় না। প্রিয়র দাদি আকলিমা বেগমের কথা স্মরণে আসে তার, ‘পুরুষ মানুষ বউ পাইলে হুস থাকে না’ পাতা ঢোক গিলে ভোরের দিকে সেটে যায়। অরুণ পাতার অস্বস্থি, আশংকা, ভয় বুঝতে পেরে মজা পায়। মন কুঠির শয়তান খোঁচা দেয়। কোমড়ের কাছটার আঁচল সরিয়ে উন্মুক্ত করে সেথায় হাত রাখে। পাতা চোখ খিঁচে নেয় উষ্ণ খসখসে হাতের ছোঁয়ায়। শিরায় শিরায় বহমান রক্তকণিকার সাথে যেন শীতল স্রোত বয়ে গেল। বক্ষস্থলের কম্পন বেড়ে যায় শতগুণ। কপোলজোড়া লালিমায় ছেয়ে যায়। কর্নাধারে তীব্র গরমে তালা লাগার উপক্রম। অরুণ পাতাকে খানিকটা ঘাবড়ে দেওয়ার জন্য এই পদক্ষেপ নিলেও বেহায়া মন বেইমানি করে বসে।

হালকা চাপ প্রয়োগ করে বেহায়া আঙ্গুল গুলো নড়াচড়া করতে থাকে। ব্যস পাতা শেষ। তার পক্ষ থেকে তীব্র বাঁধা দিয়ে কড়া বাক্য শুনিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও পাতার মন মস্তিষ্ক থমকে যায় যেন। শালার জামাই! অন্ধকার থেকে ভয় পায় বলে আগলে নিয়েছে!! এই তার তার আগলে নেয়ার নমুনা। পাতা কম্ফোর্ট দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে নেয় নিজেকে। তার লজ্জা লাগছে বেশ সাথে সুড়সুড়ি অনুভূত হচ্ছে। পাতা চোখ বুজে মটকা মেরে শুয়ে থাকে। এমন এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে কারো ঘুম হয়? হয় পাতার হয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে পাতা গভীর নিদ্রায় শায়িত হয়।

অরুণের আঙ্গুলের নৃত্যের ছন্দে রচিত হয় পাতার উন্মুক্ত কোমড় ও উদর। পিপাসায় কাতর পুরুষালী মনটা যেন আরো বেহায়া হতে চায়। নারী স্পর্শ চেনা পুরুষালী মন নারী সংস্পর্শে মাতোয়ারা হতে চায়। অরুণ ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে নিল। পাশ ফিরে নিজের মনকে শাসায়। বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে ঘুমানোর প্রচেষ্টায়। রাত ফুরোলো বলে অথচ চোখে ঘুম ধরা দেয় না; বুকটা খালি খালি লাগে। অরুণ পাশ ফিরে। পাতাকে আস্টেপিষ্টে জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছেলের দিকে চায়। তারপর ঘুমন্ত পাতার দিকে।

আবছা আলোয় ফর্সা মুখশ্রী দৃশ্যমান সাথে কপালে পড়ে থাকা কয়েক গোছা ছোট ছোট চুল। অরুণ হাত বাড়িয়ে সেগুলো সরিয়ে দেয়। কনুই ভর দিয়ে উঠে বসে। পাতার গালে হাত রেখে ঝুঁকে যায় মুখাবয়বের উপর। তপ্ত ওষ্ঠাধর নামিয়ে ঘুমন্ত বধুর ললাটে পরম স্নেহে অধর ছোঁয়ায়, সে ছোঁয়ায় শুধু স্নেহ বিদ্যমান, নেই কামনা পুরুষালী মনের কোন আকাঙ্ক্ষা। ঘুমন্ত পাতাও যেন কেঁপে ওঠে খানিক। গম্ভীর অরুণের অধরকোণে মলিন‌ হাসি। পাতার দিকে ঝুঁকেই ধীমে সুরে অধর নাড়িয়ে বিড়বিড়ায়,
-” তোমাকে অন্ধকার বিষাদ রাজ্যে স্বাগতম পাতাবাহার। আশা করি খুব শীঘ্রই বিষাদ রাজ্যে সুখ পাখি ডানা মেলে উড়তে উড়তে রৌদ্দুরের খোঁজ পাবে। ততক্ষণে একটু মানিয়ে নিও!”

বলে ভোরকে পাতার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওপাশ ফিরে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। ছোট্ট ভোর ঘুমের ঘোরে অরুণের মুখাবয়বে হাত বুলিয়ে ডাকে ‘আব্বু’। অরুণ হাসে! ছেলের গালে মুখে চুমু খায়। ভোর ঘুমের ঘোরে অরুণের দাড়ির খোঁচায় মুখ কুঁচকে ওপাশ ফিরে অরুণের হাত বুকে জড়িয়ে হাতের তালুতে গাল ঠেকিয়ে শোয়।অরুণ ছেলের পিঠ বুকে জড়িয়ে চোখ বুজে। এখন ঘুম আসবে। বিড়াল নামক পাতাবাহার কম্ফোর্টের ভিতরে অরুণের পা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। আর পাতা ঘুমের ঘোরে গড়িয়ে এসে অরুণের পিঠের সাথে লেগে যায়। অরুণের সদ্য তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হতে যাওয়া আঁখি জোড়া খুলে যায়। পাতার একহাত উঠে এসে অরুণের মেদহীন উদর জড়িয়ে ধরে। অরুণ হতাশ হয়; এই মেয়েটাও না!

তীব্র রোদ্দুরে ফেটে পড়া মধ্যাহ্নের সময়‌। নীল দিগন্তে অবস্থিত মাথা বরাবর তীব্র তেজে অরুণ চোখ পাকিয়ে চেয়ে আছে যেন। নীল দিগন্তের বুক ভেসে সাদা সাদা মেঘমালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হালকা বাতাস না থাকলে এই ভ্যাপসা গরম সহ্য করা অনেক কষ্ট সাধ্য হতো। এই ঠাডা পড়া রোদের ঝলকানিতে দিগন্তের দিকে চোখ উঁচিয়ে তাকানো দায়। তাই চোখে কালো সানগ্লাস পড়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে অরুণ সরকার। মধ্যাহ্নের সময় হওয়ায় বাজারে ভিড় ভাট অনেকটা কম! গাড়ি ঘোড়াও তেমন দেখা যাচ্ছে না। অরুণ পকেটে হাত গুজে সামনে চালের আরতের সামনে দাঁড়িয়ে। এদিকে সেদিকে তাকিয়ে সব পর্যবেক্ষণ করতে ভূলে না। বড় বড় পা ফেলে আরতের ভিতর প্রবেশ করে।বেশ বড়সড় গোডাউন। বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে চালের বস্তা। আটাশ, ঊনত্রিশ, মিনিকেট, হিরা, স্বর্না সব চালের বস্তাই দেখা যাচ্ছে। কিছু মধ্যবয়স্ক লোকেরা গোডাউনের এক কিনারে পাটিতে বসে মধ্যাহ্নের আহার কার্যে ব্যস্ত। অরুণ কে দেখে ভ্রু কুঁচকে চায়। সাধারণ মানুষ হলে এক ধমক দিয়ে পাঠিয়ে দিতো খাবারের সময় ডিস্টার্ব করায় কিন্তু সাহেব গোছের লোক দেখে নরম স্বরে বলে,

-” আপনে কেডা? কিছু কইবেন? এখন তো বিরতির সময়! চাউল লাইগবো?”
একসাথে এতো প্রশ্ন। অরুণ সেসবের জবাব না দিয়ে বলে,
-” মি. রহিম মিয়া আছেন? তার সাথে দরকার ছিল?”
গোল হয়ে বসে খাবার খাওয়া সাত আটজন লোকের মধ্যে একটি লোক মুখে ভাতের লোকমা তুলে এঁটো হাত দিয়ে কোনার দরজার দিকে ইশারা করে বলে,
-” ওই ছোট্ট ঘরেই আছে রহিম ভাই ও তার ভাই করিম। কিন্তু আপনি যাইতে পারবেন না! ওনারা দুপুরের খাবার খাইতেছে!”
তার পাশে বসা লোকটা ফিসফিসিয়ে বলল,

-” এই বললি ক্যান? যদি ম্যাজিসটেট ফেট কিছু হয় ?”
এবার লোকটার হুঁশ ফিরে। মুখ ভর্তি ভাত নিয়ে অরুণের দিকে চায়। শুট বুট পড়ে আছে ম্যাজিস্ট্রেট হলেও হতে পারে। অরুণের এসবে খেয়াল নেই। সে কর্নারের দরজায় গিয়ে টোকা দেয়। ভিতর থেকে ভেসে আসে,
-” কেডা?”
-” অরুণ সরকার!”
রহিম মিয়া হাত ধুয়ে গামছায় হাত মুছতে মুছতে দরজা খুলে দেয়। খাওয়া দাওয়া শেষ দুই ভাইয়ের। দরজায় সাহেব গোছের লোক দেখে খানিকটা ঘাবড়ে যায় রহিম মিয়া। দু দিন আগেই চেয়ারম্যান সাহেব বিশ বস্তা রিলিফের চাল স্বল্প মূল্যে বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছিল। মুনাফা দেখে সেও লুফে নেয়। পুলিশ, প্রেস বা ম্যাজিস্ট্রেট আবার রেড না বসিয়ে দেয়। সে আমতা আমতা করে বলে,

-” কে আপনে? চিনলাম না?”
অরুণ সন্দেহ নজরে চায়। লোকটা ভয় পাচ্ছে কেন? সে গম্ভীর গলায় বলে,
-” আপনি মি. রহিম মিয়া?”
-” জি!”
-” আমি আপনার অ্যাডোপ্টেট আই মিন টু সে কি যেন বলে? ওহ হ্যা পালক মেয়ে পাতার হাসবেন্ড অরুণ সরকার! চিনতে পেরেছেন?”
শান্ত স্বর। রহিম মিয়ার চিনতে অসুবিধা হয় না। করিম মিয়া চটজলদি এগিয়ে আসে। হেসে বলে,
-” আরে তুমি! আসলে চিনতে পারি নি। ভিতরে আসো? বসো বাবা?”
অরুণ ভিতরে যায় তবে বসে না। গম্ভীর মুখে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে থাকে।

সরকার বাড়ির ড্রয়িং রুমে আড্ডা হৈ হৈ পরিবেশ বিরাজ করছে। বাচ্চারা খেলনা‌ বন্দুক হাতে দৌড়ে চোর পুলিশ খেলতে ব্যস্ত। ভোর বড় রাইফেলের মতো খেলনা নিয়ে আসমা বেগমের বোনের দুইটা নাতির সাথে খেলছে। ভোর পুলিশ আর তারা চোর। তো পুলিশ চোরকে ধরতে ধাওয়া করছে। পাতাবাহার নামক বিড়াল শাবক ভোরের পিছু পিছু ছোটে চৌকিদার হিসেবে। আর চোর লুকোচুরি খেলছে। কেউ কেউ তাদের খেলায় বিরক্ত তো কেউ অধির আগ্রহে তাদের প্রাণোচ্ছ্বল খেলায় মেতে ওঠা আনন্দে বিভোর হয়ে নিজ শৈশবের স্মৃতি চারণে মুখর। তবে এসবের মাঝে আনিকা গাল ফুলিয়ে বসে আছে সোফার এক কোনায়, কারণ তাকে খেলায় নেয় নি ভোর সরকার। তাই সে বড়দের মাঝে বসে আছে গোমড়া মুখে। পাতা ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছে ঘোমটা মুখে।

নববধূ সে তাই প্রতিবেশী সহ সকলে নববধূর মুখ দর্শন করে আড্ডা দিচ্ছে। আড্ডার বিষয় বস্তু বিবিধ। কখনো অরুণ সরকারের নতুন বধুর সাথে প্রাক্তন বধুর সৌন্দর্যের তুলনা, যোগ্যতা, ফ্যামেলি স্ট্যাটাস, উচ্চতা ইত্যাদি। পাতা অবাক হয় খানিকটা। হাই ক্লাসের লোকেরাও এরকম স্বভাবের হয়? কি সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি করে হাসিমুখে কথার বাণ ছুঁড়ে! একেবারে অন্তঃপুরে গিয়ে লাগে। বারংবার তার সামনে অরুণ সরকারের প্রাক্তন স্ত্রীর কথা তুলে। গুনেগান গায়! ‘অরুণ কত পাগল ছিল তার জন্য! মাথায় তুলে রাখতো। ভালোবাসার কোন কমতি ছিল না কিন্তু ওই হতভাগী বুঝলে তো! ফুটফটে ছেলেটাকে রেখে ডিভোর্স নিল!’ পাতা শান্ত মলিন মুখে তাদের কথা কর্নপাত করে।

টু শব্দটি করে না। আসমা বেগম তাদের নিষেধ করে এসব কথা তুলতে।আসমা বেগম দরকারি কাজে উঠে গেলে আবার শুরু হয়ে যায়। পাতা অসহায় বোধ করে। ভালো লাগছে না এভাবে বসে থাকতে তার উপর এদের কাঁস্তের ধারের মতো জুবান। পাতা আশে পাশে চায়। প্রিয় টারও খোঁজ নেই। কাল রাতে তার সাথে এসেছিল তাকে সঙ্গ দিতে অথচ উনি নতুন সঙ্গ জুটিয়ে তার ধারের কাছেও আসছে না। বয়সের পার্থক্য থাকলেও আদুরির সাথে বেশ বনে গেছে প্রিয়’র। তার সাথেই বাড়ি ঘর, আঙ্গিনা ঘুরে দেখছে। বেশ সুন্দর পরিবেশ! পাতা যদিও দেখে নি ঘুরে, তবে সকালে বেলকনিতে গিয়েছিল। গিয়েই অবাক! টবে টবে বিভিন্ন ফুল ও ঔষধি, সৌন্দর্য বর্ধক গাছ!

যার বেশিরভাগরই নাম পাতা জানে না। আর বাইরে বিভিন্ন গাছ গাছালি, ফুলের বাগানে ভরপুর আঙ্গিকে সাজানো হয়েছে। বেলকনির গ্রিল জুড়ে বাগানবিলাস, বিভিন্ন সাইকাস! যেন কোনো বোটানিক্যাল গার্ডেন! পাতার অভিলাষী মন চাইছিল বাইরে গিয়ে সব ঘুরেফিরে দেখতে কিন্তু নব বধু হওয়ার দরুণ নিজের অভিলাষ মন কুটিরের পুষে রাখে। তার বাড়ি, তার আঙিনা ফুরে তো যাচ্ছে না। মহান আল্লাহ তায়ালা যদি চান তবে এটাই তার স্থায়ী ঠিকানা বর্তাবে! পাতার ভাবনাচ্ছেদ ঘটে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকা আরিয়ানকে দেখে। আরিয়ানও একপলক পাতার দিকে চায়। পাতা অপ্রস্তুত হয়, সঙ্গে সঙ্গেই নজর ফেরায়। আরিয়ান সেটা দেখে খানিক মুখ বাঁকায়। পাতা আড়চোখে দেখে নেয় তার মুখ বাঁকানো! পাতা নিজেও মনে মনে মুখ বাঁকা করে। ঝগরুটে বলদ! আড্ডায় মসগুল আরিয়ানের খালা আসমানী বেগম আরিয়ানকে ডাকে।

-” এই আরিয়ান এদিকে আয়! কোথায় যাচ্ছিস? নতুন ভাবী এলো গপ্পো সপ্পো কর? তোর ভাইটা তো নতুন বউ রেখে ফুরুত!! কই গেছে জানিস?”
আরিয়ান এসে পাতার সম্মুখে আনিকার পাশে বসে। মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে খালার উদ্দেশ্যে বলে,
-” অরুণ ভাই? গেছে কোথাও দরকারি কাজে। আমাকে তো বলে যায় নি তার নতুন বউকে জিজ্ঞেস করো? তার পারমিশন বিনা বোধহয় যাবে না!”

পাতা খানিকটা রুক্ষ দৃষ্টিতে চায় আরিয়ানের দিকে। তাকে খোঁচা মেরে কথা বলল লোকটা! সব দোষ ওই নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটার! বলা নেই কওনা নেই গায়েব মুড অন। তার পারমিশন নিবে? সে তো জানেই না কখন গিয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে পায় নি লোকটাকে। এখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যার পথে অথচ তার খোঁজ নেই! কোথায় গেছে কেউ বলতে পারে না। আভারি নামক লোকটাকে বলে গেছে যে কাজ আছে ফিরতে দেরী হবে ভোরের খেয়াল রাখতে! পাতার কথা কিছু বলে নি? পাতা ভেবে পায় না কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ? যে এতো সকালে যেতে হবে। যাবি যা বলে যাবি না? বলে গেলে এতোগুলো লোকের কথা শুনতে হতো না।

সাথে ফোনটাও অফ করে রেখেছে।সকালে খালা শাশুড়ি মামি শাশুড়ি সহ সবাই বেশ কথা শুনিয়েছে। ছেলেটা নিশ্চয়ই এমনি এমনি যায় নি। কিছু না কিছু হয়েছেই। নইলে না বলে কখনো কোথাও যায় না। শাশুড়ি আড়ালে ডেকে নিয়ে না বকলেও কড়া সুড়ে জিজ্ঞাসাবাদ সেরেছে। স্বামী নামক লোকটার নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার পেছনে যেন পাতাই দায়ী। পাতা কাঠ পুতুলের মতো সব অবলোকন করেছে। এসব বিষয়ে সে বড়ই অনভিজ্ঞ কি বলবে করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। সম্পর্কে তার ছোট জা রুবি তার হয়ে কিছু বলতে নিলে নিজ মায়ের চোখ রাঙানিতে চুপ করে যায়। পাতা সেটাও খেয়াল করে। এত শত মানুষের ভিড়ে সম্পূর্ণ বাড়িতে পাতা যেন একলা অনুভব করে। মাথাটা কেমন ভোঁ ভোঁ করে অজানা পরিবেশে। আঁখি যুগল আবেগে টইটম্বুর হয়! গড়িয়ে পরবে তখনই বাঁচিয়ে নেয় ছোট্ট ভোর। কোথা হতে দৌড়ে এসে পাতার কোমড় জড়িয়ে দাদিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” দাদু আমার আম্মুকে বকছো কেন তোমরা? আমি কিন্তু রেগে যাবো বলে দিলাম। খবরদার কেউ বকবে না।”
সবাই তার আকস্মিক কথায় যেন মুক। ছোট্ট চাঞ্চল্যকর ছেলেটার গলায় গম্ভীর সুর! এ যেন সেই ছোট্ট জেদি রাগি ছোট্ট অরুণটি। ভোর পাতাকে টেনে নিয়ে যায়। কেউ আর কিছু বলার সুযোগ পায় না। যেখানে বিয়ের পরদিন নতুন পরিবেশে যতই জড়তা থাকুক স্বামী নামক সঙ্গী সাহারা হয় স্ত্রী লোকের, একলা অনূভুত না করে সেজন্য কতকিছুই না করে। আর তার বেলায়? আচ্ছা লোকটা কোথায় গেছে? প্রাক্তন স্ত্রীর স্মরণে..আর ভাবতে পারে না। আসমানী বেগমের ডাকে হুঁশ ফিরে। তিনি পাতার বাহুতে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলে,

-” কিরে বউ কোথায় হারাইলা? অরুণ কোথায় গেছে জানো না?”
পাতা মাথা নাড়ল উদাস ভঙ্গিতে। আরিয়ানের কোল থেকে আনিকা নেমে পাতার কাছে যায়। পাতা তাকে কোলে বসিয়ে কয়েকটি চুমু খায়। বাচ্চা মেয়েটা পুরাই পুতুল!! মায়ের মতো হয়েছে বোধকরি। বাপ তো ঝগড়াঝাঁটির এক্সপার্ট। আরিয়ানের খালা পাতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” সত্যিই করে বলতো বউ? রাতে কিছু হয়েছিলো তোদের মধ্যে? না মানে ঝগড়া কথাকাটাকাটি বাচ্চা ডারে নিয়া! দেখ আসমা অরুণের সৎ মা হলেও কখনো সৎ ছেলে ভাবে নাই। নিজের ছেলের মতোই ভালোবেসে বড় করছে। আমরাও নিজের ভাগ্নের মতোই ভালোবাসি। কিছু হলে বল? সব ঠিকঠাক করে দেব নি! আর কয়েক ঘন্টার পরই তো রিসেপশন শুরু। ফোনটাও ধরছে না বন্ধ। শুধু আরিয়ানকে মেসেজে বলে দিয়েছে অফিসে ব্যস্ত আছে। ভোরের রাতে থাকা নিয়ে কিছু হয়েছে?

পাতা বিরক্ত হয় বেশ। সেই সকাল থেকে এক কথা। সে ভালোভাবে জানিয়েছে যে তেমন কিছুই হয় নি। তবুও এরা নাছোড়বান্দা! সে বিরক্ত হলেও বিরক্ত প্রকাশ না করে ভদ্র নমনীয় সুরে খানিকটা কঠোরতা ঢেলে বলে,
-” সেরকম কিছুই না খালামনি! আমাদের মধ্যে কোনো ঝগড়াঝাঁটি কলোহ কিছুই হয়নি। আপনা মনগড়া কথা বানাবেন না। ওনার হয়তো দরকারি কাজ আছে তাই চলে গেছে। আমি ভোর ঘুমিয়ে ছিলাম তাই বলে যেতে পারে নি। ব্যস এইটুকু!

আর ভোরকে নিয়ে কলহ সৃষ্টি হবে কেন? ছোট্ট বাচ্চা ভোর। আমি ওতটাও খারাপ নই যে ছোট্ট বাচ্চার থাকা নিয়ে কথাকাটাকাটি করবো! মা কেমন হয়? কিভাবে ভালোবাসে? আমি না জানলেও ভোরকে মায়ের মতোই ভালোবাসার চেষ্টা করবো! মায়ের মতো কেন হবে? আমি তো তার মা’ ই! আম্মু ডাকে সে আমায়।”
পাতার কথায় আরিয়ান ভ্রু উঁচিয়ে চায়।‌বেশ গুছানো কথাবার্তা এ মেয়ের। সারাটা বেলা সবার কথা শুনে টু শব্দ না করলেও এখন কিভাবে জবাব দিল! আসমানী বেগম অসন্তোষ হলেন ঢের। নতুন বউ হয়ে এভাবে কথার জবাব দিল? পাতার দূর ভাগ্যক্রমে আসমা বেগম সব শুনতে পায়। তিনি ড্রয়িংরুমেই আসছিলেন নাতি রুপকে কোলে নিয়ে। বোন ও পাতার সব কথাই তার কানে বাজে। আসমা বেগমের ভাইয়ের বউ ফরিদা আখতার মুখ বাঁকিয়ে বলেন,

-” বাহ্ নতুন বউয়ের মুখে কথা ফুটছে দেখছি! এতক্ষণ তো মেনি বেড়াল সেজে ছিলে। আসমা তোমার দিন ফুরিয়ে এলে বলে! বউয়ের কথার কি ধার শুনেছো? আমরা তো ভালো কথাই বললাম। আগের বউটা কিন্তু এমন মুখের উপর কথা বলিত নে!”
পাতা মামি শাশুড়ির চাহনি দেখে ঘার মুড়িয়ে পিছনে চায়। শাশুড়িকে দেখে খানিকটা ভিত হলেও সে ভাবে সে তো ভুল কিছু বলে নি। তাহলে ভয় কেন পাবে? আসমা বেগম এসে পাতার সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় শাসনের সুরে বলে,

-” আপা ভুল কিছু বলেছে বলে তো আমার মনে হলো না! তাহলে এভাবে মুখের উপর উপর কড়া কথা বলার মানে কি? গুরুজন হয় উনি তোমার। ভালোর জন্যই বলল এভাবে অপমান করলে? আমি আমার আত্মীয় স্বজনের অপমান সহ্য করবো না। সে স্যরি টু‌ হার?”

পাতা অবাক চোখে শাশুড়ি নামক মহিলার দিকে চায়। সে কখন অপমান করলো? কি এমন বলেছে? তারা সবাই এতো এতো কটুক্তি করলো! কই তখন তো তিনি ভাবলেন না পাতা অপমানিত বোধ করতে পারে। পাতা দাঁত দাঁত চেপে মাথা নিচু করে রাখে। এখন দোষ না করেও কি মাথা ঝুকাবে?
আরিয়ান উঠে এসে মায়ের কাঁধ জড়িয়ে বলে,
-” মা? কথাগুলো মোটেই অপমানজনক নয়! না ওরকম টোনে বলেছে। পাতার কথাগুলো যথার্থই। তোমরা সকাল থেকেই মেয়েটাকে এমন ভাবে জিজ্ঞাসা করছো যেন ওই ভাইকে কিডন্যাপ করে রেখে দিয়েছে। হয়েছে এখন এসব বাদ দাও তো!”

আসমানী বেগম হালকা নারাজ হলেও আরিয়ানের কথায় সায় জানিয়ে বলে বলেন,
-” আরিয়ান ঠিক বলেছে। আমি কিছু মনে করিনি আপা। আর আরিয়ান পাতা কাকে বললি বড় ভাবি হয় তোর! বয়সে ছোট হলে কি হবে সম্পর্কে বড়! ”
আসমা বেগম আর কিছু বলেন না‌। তবে তিনি পাতার ব্যবহারে খানিকটা নারাজ। অরুণের সৎ মা ও তার সম্পর্কীয় আত্মীয় বলেই কি এভাবে বললো! পাতা নতমুখে বসে। ঝগরুটে দেবর ওতটাও খারাপ নয়। পাতা বুঝতে পারে সংসার জীবনটা যতটা সহজ সে ভেবেছে ততটা সহজ নয়। বরং ক্যালকুলাসের ইন্টিগ্রেশনের মতো ফর্মুলায় ভরপুর।

ভোর বন্দুক হাতে চোর খুঁজতে খুঁজতে পাতার কোলে আনিকাকে দেখতে পেয়েছিল। ভোর শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখেছে। আম্মু কিভাবে আনি কে আদর করেছে। কেন করবে? তার আম্মু শুধু তাকেই আদর করবে। আর কাউকেই না, ওই আনি শয়তানকেও না। কিভাবে তার আম্মুর আদর খাচ্ছিল? চাচিমনি যখন তাকে একটু আদর করতে নিতো, কোলে নিত, খাইয়ে দিতে চাইতো আনি শয়তানটা চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিতো। তার মায়ের আদর কেন ভোর পাবে? ভোরের যদি আদর চাই তো তার মায়ের কাছে যাক না? ভোর কিছু বলতো না। চুপিচুপি ঘরে ঢুকে বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদতো। তার মা কেন তাকে আদর করে না। একটু পর কান্না থামিয়ে মিনুর কোল দখল করে বসে থাকতো।এটা ওটা আবদার করতো। মিনুও হাসিমুখে তার সব আবদার পূরণ করতো। আনিকাকে পাতার কোলে দেখেই ভোর বন্দুকটা নিয়ে বাড়ির মেইন ফটক পেরিয়ে বেড়িয়ে যায়। বন্দুকটা আঁছড়ে ভেঙ্গে ফেলে রাগে। তার আম্মু কেন আনিকে আদর করবে! তারপর গম্ভীর মুখে হাফপ্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ডেকোরেশনের কাজ করতে আসা কিছু লোকেরা ভোরের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,

-” কি হয়েছে, খেলনা ভাঙলো কেন?”
ভোর গম্ভীর মুখে জবাব দেয়,
-” কিছু হয়নি। যাও তোমরা।”
লোকেরা মুখ বাঁকা করে চলে যায়। আলালের ঘরের দুলালের তেজ! যা চায় বলার আগেই পায় তো। সেজন্যই ভাঙচুর আসে। গরীবের ঘরে জন্ম নিলে সব তেজ ছুটে যেত!
তারা চলে যেতেই ভোর গাড়ির হর্ণের শব্দে গেইটের দিকে তাকায়। একটা গাড়ি ভিতরে এসে থেমে যায়। সেখান থেকে নেমে আসে অরুণ সরকার। নামার সাথে সাথে গাড়িটা গ্যারেজের দিকে চলে যায়। ভোর বাবাকে দেখেও দৌড়ে যায় না। ওভাবেই বড়দের মতো গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। অরুণ এগিয়ে আসে ছেলের দিকে। নিচে খেলনা বন্দুকের খন্ডাংশ দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

-” ভাঙলো কি করে?”
ভোর কিছু বলে না। বাবা তার কথা জিজ্ঞেস না করে ওই বন্দুকের কথা জিজ্ঞেস করছে? কেউ তাকে ভালোবাসে না। অরুণ ছেলের থমথমে মুখশ্রী দেখে কোলে তুলে নেয়। গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” কি হয়েছে আব্বু? গাল ফুলিয়ে রেখেছো কেন?”
ভোরের গম্ভীর মুখ স্বাভাবিক হয়ে আসে। বাবার গলা জড়িয়ে বলে,
-” তুমি আমায় না বলে কোথায় গিয়েছিলে? ভোর মিসড ইউ সো মাচ আব্বু!”
অরুণ ছেলের ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলে,

-” অফিসে ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ছিল তাই গিয়ে ছিলাম। তুমি ও তোমার আম্মু ঘুমুচ্ছিলে তাই ডিস্টার্ব করি নি। এন্ড আই অলসো মিসড ইউ কলিজা!”
ভোরের মিষ্টি মুখে মিষ্টি হাসি ফুটে ওঠে।বাবার দু গালে ঠোঁট চেপে আদর করে। আদর পেয়ে অরুণের অধরকোণও বেঁকে যায়। শান্ত গলায় সুধায়,
-” খেলনাটা ভাঙলে কেন কলিজা?”
ভোর একনজর ভাঙ্গা বন্দুকের দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে নালিশের সুরে বলে,
-” আম্মু আনিকাকে অনেক গুলো আদর করেছে।”
অরুণ আঁখি যুগল ছোট ছোট করে বলে,

-” করতেই পারে!”
-” না পারে না। আমার আম্মু শুধু আমাকেই আদর করবে। কোনো আনি ফানি কাউকে না। ভোরের আম্মুর আদর শুধু ভোরের! আর কারো নয়!”
ঘোর বিরোধীতা করে আঙ্গুল তুলে বলে ভোর। অরুণ ছেলের আঙ্গুলে আলতো কামড় দিয়ে চুমু খেয়ে বলে,
-” হিংসুটে ছেলে! তুমি না তোমার চাচি মনির আদর খাও! আর পাতাবাহারও তো আনি মামনির চাচিমনি হয়! আদর করতেই পারে কলিজা!”
ভোর চিল্লিয়ে বলে,
-” না পারে না। চাচিমনি আদর করতে চাইলে আনি করতে দিতো না চিল্লাতো! আমি ওর বড় ভাই হই না ? তবুও বকতো আমায়!”

অরুণ শান্ত হতে বলে‌ ভোরকে। আশেপাশে সবাই এদিকে তাকিয়ে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বলে,
-” আগে তো কখনো বলো নি যে আনি মামনি ওমন করতো?”
-” কেন বলবো? তুমি এখন চুপিচুপি আম্মুকে বকে দেবে ঠিকাছে?”
অরুণ ছেলেকে পাজা কোলে নিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করার উদ্দেশ্যে পা চালায়। ছেলের কথা শুনে বলে,
-” বকে দেব? সিওর?”
ভোর অরুণের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে বলে,

-” হুম! তবে বেশি না কিন্তু? এই এইটুকুন? মিষ্টি করে বকে দেবে? বলবে ‘পাতাবাহার তুমি শুধু আমার কলিজাকে আদর করবে আর কাউকে না! যদি আদর করো কলিজা ও কলিজার আব্বু তোমাকে অনেক পানিশ করবে!’
অরুণ ছেলের কথা শুনে হাসে খানিক। বড় বড় পা ফেলে ড্রয়িংরুমে যায়। ছোটমা, আরিয়ান, পাতা সহ সকলেই নীরব ও থমথমে। কিছু হয়েছে কি? সে পাতার নতমুখশ্রী দেখে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
-” কি হয়েছে? সবাই চুপচাপ?”

আসমা বেগম সহ সকলে ঘার ঘুরিয়ে অরুণের দিকে চায়। খানিকটা চমকেও যায়। পাতার সাথে এমনভাবে কথা বলা শুনতে পায় নিতো? পাতা অরুণের গলার আওয়াজ শুনেও মাথা উঁচিয়ে দেখে না একবার। আরিয়ান হেসে ভাইয়ের দিকে এগিয়ে যায়। হাসিমুখেই বলে,
-” কি হবে? তুই কোথায় উধাও হয়েছিলি সেসব নিয়েই কথা হচ্ছিল! সকাল থেকেই লাপাত্তা তাও বিয়ের পরদিনই! একটু পরেই রিসিপশন।”
অরুণ সবাইকে উদ্দেশ্য অরে বলে,

-” একটা ক্লায়েন্টের ফোন এসেছিল ভোরে। সিনেমার জন্য কিছু অ্যাথেন্টিক গয়নার কালেকশন দরকার ছিল খুবজলদি! ফোন করে অনেক অনুরোধ করলো তাই যেতে হলো! ফোনেরও চার্জ ছিল না সাথে পাওয়ার ব্যাংকও ছিল না। আরিয়ানকে একটা মেসেজ করার পরই বন্ধ হয়ে যায়। আর কোনো প্রশ্ন?”
আসমা বেগম গম্ভীর গলায় বলে,
-” এভাবে কাউকে না বলে চলে যাওয়াটা একদম উচিত হয় নি। কাল বিয়ে হয়েছে আজ রিসিপশন একটা দায়িত্ব আছে না তোমার? যাও ঘরে যাও!”

অরুণ প্রতিত্তরে কিছু বলে না। ছেলেকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে চলে যায়। কিচেনে থাকা পাতাবাহার বাপ ছেলেকে দেখে দৌড়ে এসে তাদের পিছু পিছু যায়। এতক্ষণ সে ভোরকে খুঁজছিল।
আরিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে নতমুখে বসা পাতার কোল থেকে আনিকাকে নিয়ে বলে,
-” এই আম পাতা জোড়া জোড়া ভাই এসেছে! ঘরে যাও, এভাবে বসে আছো কেন?”
পাতা মাথা উঁচিয়ে আরিয়ানের দিকে চায়। কি বলল? আরিয়ান দাঁত বের করে হাসে সাথে আনিকাও। আসমা বেগম ধমক দেয়,
-” বড় ভাবী বলবি! আর তুমি ঘরে যাও?”

পাতা কিছু বলে না। আস্তে ধীরে উঠে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়। আজ নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটার হচ্ছে! পিটিয়ে কিমা না বানিয়েছে তো তার নাম বদলে মতিবানু রাখবে! শালার জামাই! সে হন হন করে ঘরে যায়। ঘরটা ভালোভাবে না চিনলেও রাগের মাথায় গজ গজ করতেও সঠিক ঘরেই পৌঁছায়। চুপিসারে ঘরে প্রবেশ করতেই কিছু একটা এসে মুখটায় পড়ে। কাপড় জাতীয় কিছু; কাপড়টা থেকে পুরুষালী ঘামের গন্ধ ও জেন্টস পারফিউমের গন্ধে নাক মুখ কুঁচকে যায়। সেটা মুখ থেকে সরিয়ে হাতে নেয়। এতো শার্ট তাও ওই নাক উঁচু লোকটার। বিছানায় ভোর দাঁড়িয়ে ফ্লোরে ব্লেজার, জুতো, টাই গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর বিড়ালের বাচ্চাটা সেগুলো টানাটানি করছে! যেন সেই ঘরের কর্তী ও তার কর্তা মশাইয়ের সেবায়! আর এই লোক এগুলো ছুড়ে ফেলছে কেন? ছোট বাচ্চা নাকি? সে অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” এগুলো ছুড়ে ফেলছেন কেন বাচ্চাদের মতো? গুছিয়ে রাখলেই তো হয়!”
বলেই সব একে একে তুলে সোফায় রাখে। অরুণ বিছানায় বসে মুজো খুলতে থাকে। পাতা কপাল কুঞ্চিত হয়। সে এসেছিল বড়সড় ঝাড়ি মারবে বলে! চুপ‌ করে গেল কেন তাহলে? সে বাপ ছেলের দিকে চায়। চুপচাপ গম্ভীর মুখে? অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
-” কিছু বলবেন?
পাতা যেন বলার পথ খুঁজে পায়‌ মাথার আঁচল ফেলে কোমড়ে গুঁজে দরজা বন্ধ করে এসে আঙ্গুল তুলে বলে,
-” নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক কোথাকার! অফিসে যাবেন বলে যাবেন না? আপনার জন্য কতকিছু হলো! সব আপনার দোষ! আপনাকে তো আমি..”
বলে দাঁত কিড়মিড় করে। অরুণ মুজো খুলে সোফার উদ্দেশ্য করে ঢিল দেয়। পাতার কথার প্রেক্ষিতে বলে,
-” আমাকে কি? আর কি হয়েছে?”

স্বরটা সিরিয়াস শোনায়। পাতা দমে যায়। লতা আপুর কথা স্মরণে আসে ‘সংসারে একসাথে থাকতে গেলে টুকিটাকি মনোমালিন্য কথাকাটাকাটি হবেই। সব কথা ভাইয়াকে বলবি না। নিজে সমাধান চেষ্টা করবি!’ পাতা অরুণকে কিছু বলে না। চুপ করে যায়। ভোরও বলে না যে দাদি সহ সবাই আম্মুকে বকে ছিল। আব্বুকে বললে আব্বু দাদির উপর রেগে যায় যদি? অরুণ পাতাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কড়া গলায় বলে,
-” কি হয়েছে বলো? চুপ করে গেলে কেন?”
পাতার নাকের পাটা ফুলে ওঠে। লোকটা তাকে ধমক দিল।
-” ধমকাচ্ছেন কেন? কি হবে? প্রতিবেশীরা গুসুর ফুসুর করছিল। বিয়ের পরদিনই বর উধাও! কেন উধাও জানতে চোখ রাখুন সরদার বাড়ি!”
কথাটা কৌশলে ঘুরিয়ে দেয় পাতা। সাথে নিজের বুদ্ধির বাহবা দেয়। অরুণ বুঝতে পারে ব্যাপারটা। তবে কিছু বলে না। ছেলের পরনের টি শার্ট খুলে দিয়ে ডাকে,
-” পাতাবাহার?”

পাতা ‘জি’ বলে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে নিচের দিকে চায়। বিড়াল শাবকটিও মিও মিও করছে। যেন কর্তাটা তাকেই ডাকছে! সে পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেয় প্রাণীটিকে। অরুণ সেটা খেয়াল করে বলে,
-” লাথি লাগলো তো ওর মিস পাতাবাহার!”
-” লাগুক! আমার সাথে ঘেঁষলে লাথি কেন ঝাটা পেটাও খাবে!”
বিড়াল শাবক কি বুঝলো কে যানে। লেজ নাড়িয়ে চলে গেল বেলকনিতে। সে রাগ করেছে! পাতা অবাক হয় বেশ। রাগ করলো নাকি বিড়ালের বাচ্চা? কিন্তু তার কথা বুঝলো কিভাবে? সে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” কি যেন বলতে চাইলেন?”
অরুণ পাতার সামনে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে বলে,
-” আপনার নামে ইয়া বড় নালিশ আছে!”
পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। কিসের নালিশ? কেইবা করলো? অরুণের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে অরুণ গম্ভীর মুখে বলে,

-” ভোর করেছে নালিশ! তুমি নাকি আনিকাকে অনেক গুলো আদর করেছো?”
পাতা ভোরের দিকে চায়। ভোর নালিশ করেছে? আনিকাকে আদর করেছে এতে নালিশের কি আছে? অরুণ পুনরায় গম্ভীর গলায় ভোরের বলা কথা গুলো কপি করে পেস্ট করে বলে,
-” পাতাবাহার তুমি শুধু আমার কলিজাকে আদর করবে আর কাউকে না! যদি আদর করো কলিজা ও কলিজার আব্বু তোমাকে অনেক পানিশ করবে!”
বলে ভোরের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” মিষ্টি করে বকে দিলাম এখন হয়েছে?”
ভোর মাথা নাড়িয়ে বোঝায় হয়েছে। পাতার মস্তিষ্ক বিষয়টা ক্যাচ করতে পারে। আনিকাকে আদর করেছে বলে ভোর গাল ফুলিয়ে নিয়েছে। এতো বাপের মতোই জেলাসিতে ভরপুর। সে ভোরকে কোলে নিয়ে গালে টপাটপ চুমু দিয়ে বলে,

-” কি হিংসুটে ছেলে! একটু আদর করেছি তো কি হয়েছে? কি কিউট পুতুল মেয়ে তাই আদর করেছি। সে তো তোমার বোন হয় তাই না? ওকে একটু আদর করেছি তোমাকে বেশি বেশি আদর করবো!”
বলেই ফুলো গালে আদর করে। ভোরের মন গলে না। সে গোমরাহ মুখে বলে,
-” নাহ্। তুমি শুধু আমাকেই আদর করবে। আর কাউকে না। করলে ভোর রেগে যাবে!”
বলেই পাতার কোল থেকে নেমে বেলকনিতে চলে যায়। পাতা হা করে দেখে। এই টুকুনি ছেলের এতো অভিমান। অরুণ পাতার হা করা মুখটা দু আঙ্গুল দিয়ে আটকে দেয়। পাতা যেন স্বয়ংবৎ ফিরে পায়। অরুণ পাতার কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে,

পাতা বাহার পর্ব ২৭(২)

-” ও এমনি।এতো বুঝাই তবুও নাছোড়বান্দা! আমাকেও কোনো বাচ্চাকে আদর করতে দেখলে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। তখন কিছু বলবে না, পরে তুফান বনে যায়। সামলানোই দায়। বুঝলে পাতাবাহার? সামলাও জেদি ভোরকে!”
পাতা নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে। এই লোক মোটেও সুবিধার নয়। তাঁকে শ্বাস আটকে মারতে চায়। তাই তো এরকম উন্মুক্ত শরীরে তাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করছে। পাতার ছোট্ট নরম শরীরটা কেমন ঝিমিয়ে আসছে। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। হাত পায়ের শক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে। গরম গরম লাগছে। এমন কেন হচ্ছে?

পাতা বাহার পর্ব ২৯