পাতা বাহার পর্ব ৩১

পাতা বাহার পর্ব ৩১
বেলা শেখ 

নতুন ভোর! নতুন দিনের সূচনা! পূর্ব দীগন্তে সূর্য মামা উঁকি দিচ্ছে। আকাশ পরিষ্কার নীল মেঘে ছেয়ে আছে। শ্রাবণের শুরু হয়েছে ক’ দিন হলো।‌ নীল আকাশে সাদা মেঘমালা তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে এলোমেলো বাতাসে। রৌদ্রজ্জ্বল দিন! অরুণ হাঁটতে বেড়িয়েছে। এটা তার নিত্যদিনের অভ্যাস! ছাত্রজীবন থেকেই সে এই অভ্যাস লালন করেছে। তার অনেক গুলো বদ অভ্যাসের মধ্যে এটা একটা ভালো অভ্যাস। বাড়ির পাশের মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করেই হাঁটতে বের হবে। আধা বা একঘন্টা অবিরাম হেঁটে বাড়ি পৌঁছে যাবে।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠলে অনেকটা সময় পাওয়া যায় ব্যস্ত জীবনে। যে সময়টা শুধু নিজের! আর সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা, এক দেড় ঘন্টা হাঁটা, টুকটাক ব্যায়াম করা, স্বাস্থ্যের পক্ষে যেমন যথেষ্ট উপকারী তেমনি মনটাকেও সতেজ রাখে। বাকি সারাদিন মনটাকে ফুরফুরে রাখে, একঘেয়েমিতা আসতে দেয় না। আর তুমি বেলা দশটা বারোটায় উঠবে! সময় নিয়ে ব্রাশ ট্রাশ করে ফোন নিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি খাবে! ‘ভাল্লাগে না’ রোগ তোমায় ধরবে না? সারাটা দিন তোমার আলসেমিতে কেটে যাবে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একদিন সকাল বেলা উঠে হাঁটো, স্নিগ্ধ সতেজ ভোরটাকে উপভোগ করো? তুমিও আরলি রাইজার বনে যাবে! অরুণ অবিরাম হাঁটার দরুণ ঘেমে নেয়ে একাকার! পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে নেয় মুখশ্রী। আবার হাঁটা শুরু করে। পথি মধ্যে দেখা হয় তাদের এক প্রতিবেশীর সাথে। সম্পর্কে তার দাদা হয়! বেশ বয়স্ক লোকটি! পঁচাশি কি ছিয়াশি বছরের হবে হয়তো! এখনো বেশ চাঙ্গা! রোজ হাঁটাহাঁটি করে! তার সাথে প্রায়ই দেখা ও কথা হয়! বৃদ্ধার নাম কাবেল! সে অরুণকে দেখে হাতের ইশারায় ডাকে। অরুণ এগিয়ে গিয়ে হ্যান্ডশেক করে। লোকটি হেসে বলে,
-” আজও এসেছো দেখছি! এতো সুন্দর বউ রেখে তুমি সকাল বেলা হাঁটতে বের হয়েছো? তুমি আচ্ছা বেডা মানুষ দেখছি!”

অরুণ কিছু বলে না। মুচকি হাসে শুধু। দুজনেই ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
-” নতুন বউ কেমন? আদর টাদর করে?
ফিসফিসিয়ে বলে লোকটি! অরুণ মুখ গোমড়া বানিয়ে না বোঝায়। লোকটি গম্ভীর মুখে বলে,
-” এটা তো ভারী অন্যায়! আমি তার সাথে কথা বলবো?”
-” না দাদা! আপনার বলতে হবে না সময় হলে আমি নিজেই আদায় করে নেব!”
-” আহ্ হা! এই না হলে পুরুষ মানুষ! শোন? বউকে ভালোবাসবি! বুকে রাখবি! তবে মাথায় তুলবি না! আদর করবি কিন্তু বাঁদর বানাবি না! নইলে পড়ে তোর মাথায় উঠে তবলা বাজাবে! তোকে ইশারায় নাচাবে!”
-” আপনার খুব অভিজ্ঞতা দেখছি?”
বৃদ্ধা লোকটি আফসোস করে বলে,
-” অভিজ্ঞতা না থাকলে বলছি বুঝি?”

অরুণ হাসে কিছু বলে না। টুকটাক কথা বলে অরুণ সরকার বাড়ি প্রবেশ করে।নিজ বাড়ির আঙিনায় কিছুক্ষণ হেঁটে নিজ নীড়ে ফিরে। রুমে প্রবেশ করেই সে হতাশ! পাতা আর ভোর বিছানা জুড়ে ঘুমিয়ে আছে। বিড়াল শাবকটি সোফায় ঘুমুতে ব্যস্ত। বেলা আটটা বাজে এখনো পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছেন দুজন। এতো ঘুম কাতুরে দুজন! ফজরে পাতাবাহারকে এক প্রকার টেনেই তুলেছে নামাজের জন্য। নামাজ শেষ করেই হয়তো আবার চিৎপটাং। তার ঘুমের অভ্যাস খুবই বাজে। পুরো বিছানা জুড়ে মহারানী হা ডু ডু খেলবে। এখন ভোরের পায়ের কাছে মাথা দিয়ে উল্টো হয়ে শুয়ে। অরুণ দুজনকে ডেকে প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে যায় গোসল করতে। গোসল শেষে এসে দেখে দুজন যেমন তেমনি! অরুণ পাতার পা ধরে টেনে কাছে আনে। তবুও ঘুম ভাঙল না। এখন গায়ে কম্ফোর্ট নেই। একটা টপস আর পাজামা। টপস উপরে উঠে ফর্সা পেট উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। অরুণ তার ঠান্ডা হাত সেখানে রাখে। পাতা ঘুমের ঘোরে কেঁপে উঠলো।নিভু নিভু চোখে চায় অরুণকে দেখে পুনরায় চোখ বুজে উল্টো হয়ে। অরুণ হাসে। এতক্ষণ ঠান্ডা হাত রাখলেও এবার একটু দুষ্টুমি করে। কাজ হয়! পাতা লাফ দিয়ে ওঠে। অরুণ হাত সরিয়ে নেয়। পাতা পিট পিট করে চায়। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,

-” কি করছিলেন?”
অরুণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক সুরে বলে,
-” কি করছিলাম?”
পাতা অরুণের হাতের দিকে চায়। অসভ্য লোক!
-” নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য লোক! ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নিচ্ছিলেন?”
অরুণের স্বাভাবিক মুখশ্রী গম্ভীর হয়।
-“আই এম ইওর হাসবেন্ড! সুযোগ নেয়ার কি আছে?”
পাতা অরুণের গম্ভীর গলা শুনে উঠে দাঁড়ালো। অতি শিঘ্রই তাকে ওয়াশ রুমে যেতে হবে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে। সে সেদিকে পা বাড়ায়।

-” হয়েছে হয়েছে! আর ফুটেজ খেতে হবে না। হাসবেন্ড হন তো মিষ্টি করে আদর করে ডেকে তুলতেই পারতেন! এমন অসভ্য ভাবে.. ..আ আম্মু!”
বলতে বলতেই ঠাস করে পড়ে যায় ফুলের টবের সাথে বেজে। পায়ে ব্যাথাও পায় খানিকটা। অরুণ এগিয়ে আসে। ভোর চিল্লানো ও শব্দ শুনে ধরফর করে উঠে বসল। দু হাতে চোখ ডলে ফ্লোরে পাতাকে দেখে বলল,
-” আম্মু কি হলো? পড়ে গেছো?”
অরুণ ঠোঁট চেপে হেসে পাতাকে উঠিয়ে দাঁড় করায়। পা নাড়াতে বলে! পাতা পা নাড়িয়ে ভোরকে বলল,
-” পড়ে যায়নি তো সোনা! ঘুমিয়ে ছিলাম তোমার নাক উঁচু আব্বু টেনে এনে ঠাস করে ফেলে দিলো তো!”
ভোর বিছানা থেকে নেমে এসে অরুণকে সুধায়,

-” তুমি আমার আম্মুকে ফেলে দিলে কেন?”
অরুণ পাতার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেই জবাব দেয়,
-” মিথ্যেবাদী!”
-” কি! আমি মিথ্যে কথা বলছি! ভোর সত্যি বলছি আমি! উনি এভাবে পা ধরে টেনে এনে ঢিল মেরে ফেলে দিল! আমি অনেক ব্যাথা পেয়েছি!”
-” আব্বু!!!আমি যদি তোমাকে ওভাবে ফেলে দেই, তোমার কেমন লাগবে আব্বু?””
-” ফেলে দিয়েছি না? বেশ করেছি! নেক্সট দিন থেকে দেড়িতে ঘুম থেকে উঠলে দু’টোকেই লাঠি পেটা করবো!”
ভোর ও পাতার মুখখানি চুপসে যায়।

ডায়নিং টেবিল বসে অরুণ সরকার। পাশেই ভোর বসে। পাতা সার্ভ করছে। সকলের খাওয়া দাওয়া শেষ তারাই লেট। আরিয়ান, রুবি, আদুরি খেয়ে দেয়ে নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছে গেছে হয়তোবা! আসমা বেগম ও সুরুভি বেগম সকালের নাস্তা সেরে বাগিচায় বসে চা পানের সঙ্গে আড্ডায় ব্যস্ত; আনিকা রূপ তাদের সঙ্গী। শুধু অরুণের ছোট্ট সংসারই লেট লতিফ বনে গেছে। ঈদের ছুটি শেষে আজ থেকে অফিস শুরু হয়েছে। অরুণ জলদি যেতে চেয়েছিল কিন্তু সেটা হলো না। পাতা অরুণের প্লেটে চারটা রুটি দিয়েছে সাথে দুটো ওমলেট, ভাজি ও ডাল! অরুণ পাতার দিকে একবার চেয়ে খাওয়া শুরু করে। ভোর কাঠের ডাইনিং টেবিলের উপর বসে আছে বাবু হয়ে। পাতা পরোটা ছিঁড়ে ওমলেটের সাথে তার মুখে দিতে থাকে একটু পর পর। মাঝে মাঝে অরুণও দিচ্ছে। ভোর খুশি মনে গিলছে। তবে পরোটাটার চেয়ে পানিই বেশি খাচ্ছে। ফলাফল স্বরূপ পেট ফুলে ঢোল। সে বাড়ন্ত পেটে হাত বুলিয়ে বলে,

-” আম্মু আমি আর খাবো না। আমার পেট ভরে গেছে!”
পাতা পুনরায় তার মুখে খাবার দিল।
-” অর্ধেকই শেষ করতে পারলে না! পেট ভরলো কি ভাবে?”
-” আমার টাম্মি তো এইটুকুন এতো বড় বড় পরোটা আমার টাম্মিতে আটবে বলো? আমি কি রাক্ষস নাকি!”
পাতা হেসে বলল,
-” না তো তুমি তো প্রিন্স! শোন বেশি বেশি খেলে জলদি জলদি বড় হবে!”
-” মিথ্যে কথা! আব্বুও তো বেশি বেশি খায়! কই জলদি জলদি তো বড় হয় না! আমি ছোট থেকেই আব্বুকে এতবড়ই দেখছি! আরো বড় তো হচ্ছে না!
ভোর বাবার দিকে তাকিয়ে বলে। তার লজিক শুনে অরুণ খাবারের দিকে চায়। পাতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। ভোর পানি খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
-” আমি আর খাবো না।”

বলেই টেবিল থেকে লাফ দিলো।লাফ দিতে দেখে অরুণ ধমক দেয়। ভোর স্লিপ কেটে পড়ে যায় তবে লাগে না। উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু ঝাড়ি ঠিকই খেল!
-” এক থাপ্পড়ে কানে তালা লাগিয়ে দিবো! বাঁদর ছেলে! ভালো থাকতে ভালো লাগে না, না? গতবার পা ভেঙ্গে একমাস বেডে থেকে শখ মেটেনি?”
ভোরের ছোট্ট মনটা কষ্ট পায় বেশ! এরকম শক্ত কণ্ঠে অনেক দিন পরে বকলো বাবা। পড়ে গিয়ে পা ভাঙলে সে ব্যাথা পেতো! বাবার কি? তার গভীর চোখ জোড়ায় নোনাজল জমতে শুরু করে। নাকের পাটা ফুলিয়ে ‘স্যরি আব্বু’ বলে চুপচাপ চলে যায় মাথা নিচু করে।
পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেলে কে কাঁদতো? অরুণ চোয়াল শক্ত করে সামনে ফিরে। পাতা ভ্রু কুঁচকে তার দিকেই চেয়ে। অরুণ গম্ভীর গলায় সুধায়,

-” হোয়াট?”
-” ম্যানারস জানেন না? ছোট বাচ্চাকে এভাবে কেউ বকে? আমিই তো ভয় পেয়ে গেছিলাম! বেচারা ভোর না জানি..! ধমক ঝাড়ি দেওয়া ছাড়া আর কিছু পারেন না ,নাকি?”
-” আপনি খেতে চান ঝাড়ি?”
ধমকের সুর! পাতা তড়িৎ বেগে মাথা নেড়ে কেটে পড়ে। এ মানুষের গলা নাকি বাঘের গর্জন! গা কেঁপে উঠল তার!
খাওয়ায় আর মন বসে না অরুণের। হাত ধুয়ে সেও চলে যায়। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে নিজের রুমে যায়। অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েই বেরিয়েছে। এখন ফুলানো গালটাকে আদর করা বাকি!
অরুণ রুমে প্রবেশ করা মাত্রই একগাদা অভিযোগ কানে আসে। ভোর পাতাকে জড়িয়ে কাঁদছে আর অভিযোগ করছে!

-” আব্বু সবসময় বকে আমায়! কই চাচ্চু তো আনিকাকে বকে না! রোহানের আব্বু তো রোহানকে বকে না! শুধু আমার আব্বুই আমাকে বকে! মারেও অনেক! পা ভাঙলে আমি ব্যাথা পাবো! আমি কাঁদবো! আব্বুর কি হবে? শুধু বকবে! কিছু বললেই বকবে না বললেও বকবে!”
পাতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” তোমার আব্বু ব্যাথা লাগলে যেমন তোমার মন পুড়ে তেমনি তুমি ব্যাথা পেলে তোমার আব্বুর বুক জ্বালাপোড়া করে বুঝলে? আর কাকে মানুষ বেশি বকে জানো? যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে! চোখে হারায়! তোমার ভালোর জন্যই তো বকে! তখন পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেলে কষ্ট হতো না? তাই বকেছে! আর শুধু বকে তোমাকে আদর করে না? ভালোবাসে না?”
ভোর নাক টেনে কেঁদে কেঁদে বলে,

-” লাগবে না ওমন আদর, ভালোবাসা! মারবে, বকবে আবার আদরও করবে! আমি চলে যাবো যেখানে খুশি! থাকবো না এখানে। তুমি যাবেনা আমার সাথে?”
পাতা ভোরের গাল মুছে দিয়ে চুমু খায়। অরুণ এগিয়ে আসে। অরুণকে আসতে দেখে ভোর আবার মুখ লুকায় পাতার বুকে।

-” থাকবে না, না? আচ্ছা যাও চলে, দুজনই চলে যাও! আমি আনি বুড়ি, রুপ, শুভর মেয়ে শুহানি সহ সব বাচ্চাদের নিয়ে আসবো। আমার কাছেই রেখে দেব! সব্বাইকে বেশি বেশি আদর করবো। তাদের এতো এতো খেলনা আইসক্রিম স্যান্ডউইচ কিনে দেব! ঘুরতেও নিয়ে যাবো। অনেক মজা করবো!”
অরুণের কথা শুনে ভোর শব্দ করে কেঁদে ওঠে হাঁউমাঁউ করে। পাতা মুচকি হেসে চোখ রাঙায় অরুণকে। কটমট করে বলে,

-” আবার কাঁদায় বাচ্চাটাকে! কান ধরে স্যরি বলুন? নাক উঁচু ম্যানারল্যাস লোক! এতো কিউট ছেলেকে কেউ বকে? মারে? বকুনি তো আপনার খাওয়া উচিত। আর উঠতে বসতে এত্তো এত্তো মার! তবেই সোজা হবেন আপনি! সে স্যরি ট্যু হিম!”
বাবাকে বকতে দেখে ভোরের কান্নার বেগ কমে আসে। অরুণ পাতাকে চোখে শাসিয়ে মুখে স্যরি বলে। ভোরের অভিমান গলে না। সে নাক টানে অনবরত। অরুণ হেসে ছেলেকে পাতার থেকে ছাড়িয়ে কোলে তুলে নেয়। ভোর হাত পা ছুড়তে থাকে। অরুণকে কিল ঘুষি দিতে ভুলে না। অরুণ পকেট থেকে রুমাল বের করে ভোরের নাক মুছে দিয়েই গালে মুখে চুমু দিতে শুরু করে। ভোর রেগে অরুণের পরিপাটি চুল টেনে ধরে গালে শক্ত কামড় বসিয়ে দেয়। পাতা চোখ বড় বড় করে বলল,
-” এসব কি ভোর? আব্বু হয় না তোমার? গুরুজন উনি! এভাবে মারছো? কামড়াচ্ছো? এটা তো বেয়াদবি তাই না?”
ভোরের নাকের পাটা আবার ফুলতে শুরু করে। অরুণকে ছেড়ে দেয়; ঠোঁট উল্টে কেঁদে দেবে ভাব। অরুণ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বলে,

-” পাতাবাহার! মারুক, কামড় দিক! ভোরের আব্বু কি ব্যাথা পায় নাকি?”
ব্যস! হয়ে গেল। ভোর আব্বু বলে কান্না জুড়ে দিল! অরুণ পাতাকে চোখ টিপে ভোরকে বাচ্চাদের মতো পাঁজা কোলে নিয়ে গালে মুখে আদর করে।
-” কলিজা! কাঁদছো কেন? হুম? তোমার ব্যাথা লাগলে আমার কিছু না, তাই না? আমাকে রেখে চলে যাবে? তাহলে তো তোমার আব্বু মরেই যাবে!”
ভোর আবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো আব্বু বলে। পাতা হাসে বাবা ছেলের মান অভিমান ভালোবাসা দেখে। বাবার ভালোবাসা এমন হয় বুঝি? হুম এমনি তো! এক ছেলে পাগল বাবার, বাবা পাগল ছেলে!
অরুণ ছেলেকে আদর করে এটা ওটা বলে শান্ত করায়। পেটে মুখ ঘষে। ভোর সুরসুরি লাগায় খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। অরুণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। কেন যে বকলো? না বকলে জল এতো দূর গড়াতোই না। অরুণ ছেলেকে নামিয়ে দেয়। আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল পরিপাটি করে টাই ঠিক করে। ভোর বাবার পা জড়িয়ে আবদার করে,
-” আব্বু আজ অফিস যাওয়া থাকনা? আমি তুমি আম্মু ক্রিকেট খেলবো! আমি ব্যাটার তুমি বোলার আর আম্মু কিপার!”

-” নাহ্ কলিজা! কতোদিন হলো যাই না! আর কাল থেকে তোমার ও তোমার আম্মুর স্কুল শুরু।”
ভোর গোমড়া মুখে চাইলো। অরুণ তার কপালে চুমু খেয়ে পাতাকে বলে,
-” টেক কেয়ার ওফ হিম এন্ড ওলসো ইউর সেলভ! ওহ্ হ্যাঁ। আজ বিকেলে ওর টিচার আসবে টুম্পা নাম! পরিচিত হবেন। আসি টেক কেয়ার!”
বলেই পাতার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায়। পাতা অরুণের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভোর পাতার কোমড় জড়িয়ে আম্মু ডাকে। পাতা তার চুল এলোমেলো করে দিয়ে হাসে। অরুণ বাইরে গিয়ে ফেরত আসে। ভোরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কপালে চোখে মুখে চুমু খায় বেশ গুলো। তারপর পাতার দিকে একপল চেয়ে পুনরায় বিদায় নিয়ে চলে যায়। গিয়ে একটু পরে আবার ফেরত আসে। পাতা ভ্রু কুঁচকে চায়। আবার কি? ভোর জিজ্ঞেস করে,
-” আব্বু কি হলো? যাবে না অফিস?”
অরুণ হেসে বলে,

-” যাবো তো! কলিজাকে রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না। যাবে?”
ভোর পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” আম্মু যে একা হয়ে যাবে!”
-” তাকেও সাথে নিয়ে যাই?”
পাতা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
-” বিকেলে না ভোরের টিচার আসবে?”
অরুণ টাই ঠিক করতে করতে রুমের বাইরে যেতে যেতে বলল,
-” আচ্ছা যেতে হবে না। বাই!”
সেকেন্ড না যেতে আবার ফিরে আসে। ভোর পাতা সন্দেহ চোখে চাইলে অরুণ খানিকটা আমতা আমতা করে বলল,
-” ল্যাপটপ নিতে ভুলে গিয়েছিলাম!”

বলেই বিছানার উপর থেকে ল্যাপটপের ব্যাগটা নিয়ে চলে যায়। পাতা ভোর একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে শব্দ করে। সোফায় বসে আয়েশি ভঙ্গিতে। ফোনটা হাতে নিবে এমন সময় পুনরায় আগমন ঘটে অরুণ সরকারের। পাতা উঠে দাঁড়ালো। কিছু বলবে এর আগে অরুণ ভোরকে বলে,
-” কলিজা? স্টাডি রুমে অনেক পেন্সিল আছে না তোমার? আমার লাগবে একটা এনে দাও তো?”
ভোর ভাবে কি কাজে লাগবে! ভাবতে ভাবতেই বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। পাতা চোখ ছোট ছোট করে অরুণের দিকে চায়। অরুণ ব্যাগটা পাশে রেখে তড়িৎ বেগে এগিয়ে আসে। পাতার কোমড় বেষ্টনীতে দু হাত গলিয়ে বুকের উপর তুলে নেয়। ঘটনা অতিদ্রুত হওয়ার দরুন পাতা ঠাওর করতে পারে না কি হলো! সে ব্যালেন্স ঠিক রাখতে অরুণের গলা জড়িয়ে ধরে। পা তার শূন্যে আর সে অরুণ সরকারের অতি নিকটে। পাতা ঢোক গিলে। অরুণ সময় ব্যয় করে না; পাতার নরম গালে নাক ও ওষ্ঠাধর ডুবিয়ে চুম্বন বসায় সময় নিয়ে। ওভাবে থেকেই ফিসফিসিয়ে বলে,

-” মিসেস পাতাবাহার? কলিজা ও তার আম্মুর খেয়াল রেখো! আসছি!”
ললাটে অধর ছুঁইয়ে ছেড়ে দেয়। ব্যাগ নিয়ে হন হন করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। পথিমধ্যে ভোরের থেকে অ-দরকারী পেন্সিলটাও নিয়ে নেয়।

পাতা বাহার পর্ব ৩০(২)

পাতা স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে।তার হাত পা কাঁপছে অনবরত। বুকটা কেঁপে উঠছে বারংবার। বুকের বা পাশের হৃদযন্ত্রটার স্পন্দন প্রক্রিয়া বেড়েই চলেছে। পাতার এক হাত গালে চলে যায়। মনে হচ্ছে আগুন ছড়াচ্ছে। তনুমন জুড়ে অসংখ্য প্রজাতির রঙ বেরঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। এ কেমন মিষ্টি যন্ত্রণার অনুভূতি হচ্ছে মন কুঠিবাড়িতে? পাতা এই মুহূর্তে অনুভব করে লোকটাতে সে বাজে ভাবে ফেঁসে গেছে। এতো জলদি? বিয়ের এক সপ্তাহও তো গেলো না অথচ তুই পাতু লোকটার জন্য অথৈ সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিস? তোর কি হবে? পাতা গাল থেকে হাতটা এনে অধর ছোঁয়ায় সেথায়। হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। লজ্জায় বালিশে মুখ লুকিয়ে গড়াগড়ি খায় কয়েকবার। হায় আল্লাহ এই মুখ সে দেখাবে কি ভাবে? লোকটা কাজটা কি ঠিক করলো?

পাতা বাহার পর্ব ৩১(২)