পাতা বাহার পর্ব ৪১(২)
বেলা শেখ
সময় মানবজীবনের মুল্যবান সম্পদের মধ্যে একটি। সময় মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এটা কারো পক্ষপাত করে না। আমাদের মানবসমাজের একটা প্রচলিত রীতি আছে। তেলা মাথায় তেল ঘষা! যার টাকা পয়সা প্রতিপত্তি ক্ষমতা আছে সমাজে মানুষ তাকে মুখ্য মনি মানিয়ে চলে। তার নিকট মাথা ঝুঁকিয়ে বশ্যতা স্বীকার করে জি হুজুর করে বেড়ায়। হাজার অন্যায় অবিচার করলেও তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস রাখে না। তার পদতলে বসে বরং আজ্ঞাবহ হয়ে মেনে নেয়। তার বিরুদ্ধে হাজার অভিযোগ থাকলেও কেউ মুখ ফুটে বলতে পারে না।
তারা তাদের ক্ষমতা, প্রভাব আর টাকা দিয়েই আইন কানুন কিনে নেন। সবাইকে নিজের গোলাম বানিয়ে ভালোমানুষী মুখোশ পড়ে থাকে। পার্থিব সব কিছুই তাঁরা টাকা যশ ক্ষমতা দ্বারা ক্রয় করলেও সময়ের কাছে তারা বশীভূত। সময় মানবজীবনের একটা অধ্যায়। সময় মানুষকে সঠিক পথ দেখাবে। সেই সঠিক পথে পরিচালিত না হতে পারলে বা ভুল রাস্তায় পর্যবসিত হলেও সময় থামাবে না। তাকে যেতে দিবে। তাকে স্মরণ করিয়ে দিবে যে, সে যে রাস্তায় যাচ্ছে সেটা ভূল। এখন ব্যাক্তি যদি তার ভূল বুঝতে পেরে ফিরে আসে তাহলে তো তুমি বুদ্ধিমান। আর তুমি ব্যাক্তি না ফিরে মোহমায়ায় ডুবে যাও তো তুমি প্রস্তাবে। সময় কিভাবে, কখন তোমাকে মুখ থুবড়ে রাস্তায় ফেলবে সেটা উপর ওয়ালাই ভালো জানেন। কেননা উপর ওয়ালা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। তাই সাবধান! মানবজীবনের প্রতিটি কদম গুরুত্বপূর্ণ! প্রতিটা ন্যানো সেকেন্ড অমূল্য!
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
শ্রাবনের বর্ষণ শেষে ভাদ্রের চ্যাংটা গরমেও পুড়লো মানব! আশ্বিন মাসে গা’ শিন শিন না করলেও সে বিদায় নিয়েছে কিছু দিন পেরিয়ে গেছে। কার্তিকের সপ্তাহ খানিক চলে গেছে বর্ষপুঞ্জি থেকে। কাঁচা ধানে শীষের দেখা মিলছে। আকাশ চিরে নীলাভ মেঘের দেখা মিলে ক্ষণে ক্ষণে। কখনো তুফান ছোটা পবন তো কখনো কাঠফাঁটা স্তব্ধ রোদেলা দিন। তো কখনো ঝিরিঝিরি বর্ষন। সবেরই দেখা মিলছে এই শরতের কার্তিক মাসে। সরকার বাড়ির আঙিনায় আজ তুফান ছুটো পবনের ছোঁয়ায় পরিবেশ একদম ছটফটে। বাচ্চারা ক্রিকেট খেলছে। ভোর বল হাত বল ছুঁড়ছে ক্রিজে। আনিকা আনাড়ি হাতে ব্যাট ধরে। কখনো কখনো বল ব্যাটে লাগছে। কখনো সে পা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু স্ট্যাম্পে লাগছে না। এতেই ভোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বল ছুঁড়ে মারে। কিন্তু বরাবর ব্যর্থ। আর এই ব্যর্থতার ছাপ তার ছোট্ট মুখে স্পষ্ট।তবে সে হার মোটেই মানে নি। আভারি এখানে বল বাহক হিসেবে কাজ করছে। দূরে বল চলে গেলে বাচ্চাদের কুড়িয়ে এনে দিচ্ছে। মিনু দূরে ছায়ায় বসে তাদের খেলা দেখছে। ভোর আজকাল তার আশেপাশে তেমন ঘেঁষে না। একটু দূরে দূরেই থাকে। আগের মতো আবদারও করে না। কোলে উঠে আদরের জন্য গাল বাড়িয়ে দেয় না। সে জিজ্ঞেসও করেছে ভোরের সাদাসিধে জবাব,
-” তুমি তোমার বাবুকে নিয়েই এখন ব্যস্ত থাকো। তাকেই আদর করো বেশি বেশি। ভোরকে তো ভুলেই গেছো! ভোর বাবা ডেকে কোলে নাও না! আদর করো না। খাইয়ে দাও না।”
মিনু ছুটিতেই আছে আজকাল। ছয়মাস পেরিয়ে গেছে তার। পেটটা বেশ উঁচু হয়ে আছে। হাঁটা চলা তেমন করে না। পা দুটো ফুলো হয়ে আছে। ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছে তবুও ফলাফল মিলে নি। ডাক্তার বলেছে ইটস নরমাল। ঠিক হয়ে যাবে। পাতা বেলকনিতে বসে আছে চুপচাপ।তার নীরবতার সঙ্গী পাতাবাহার! সে পাতার পায়ের আছে চুপটি করে বসে। পাতার চেহারায় তার লাবণ্য ফিরেছে। আগের চেয়ে হালকা স্বাস্থ্য বেড়েছে যার দরূণ গায়ের রঙটা আরো ফুটেছে। সৌন্দর্য যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়! কাঁধ সমান চুল গুলোও বড় হয়েছে। পিঠের নিচে নেমে এসেছে। সে মোটেও চুল বড় করার পক্ষে না। তবে যেখানে স্বয়ং অরুণ সরকারের আদেশ সেখানে তার চলে না।
চার চারটা মাস পেরিয়ে গেল অথচ আজও সে লোকটাকে ভালো করে চিনতেই পারে নি। এ লোক যেন ক্ষণে ক্ষণে তার রূপটা চেঞ্জ করে। এই একজন আদর্শ স্বামী, তো এই এক কঠোর গার্ডিয়ান। আদর যত্নে ডুবিয়ে দিবে; অতিরিক্ত আদর যত্নে যেই না পাতা একটু আহ্লাদী হবে। অরুণ সরকার এক ধমকে বসিয়ে দিবে পূর্বের জায়গায়। পাতা ধমক শুনে শান্ত হয়ে যায়। তো কখনো কখনো কোমড়ে আঁচল বেঁধে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়।
মাঝে মাঝে পাতা ঝাড়ি খেয়ে গাল ফুলিয়ে নেয়। অভিমান করে কথা বলে না। ভাবে লোকটা তার অভিমান ভাঙ্গাবে। কিন্তু না! অভিমান ভাঙ্গানো দূরের কথা! আরেকটা ঝাড়ি দিয়ে বসিয়ে রাখবে। পরে মহারাজের রাগ কমে গেলে মাথায় হাত বুলিয়ে বাচ্চাদের মতো বুঝ দিবে! কিসের যেন জাদু করে বশে আনে! অবুঝ পাতা বশীভূত হয়ে বুঝ মেনে নেয়। পাতা মাঝে মাঝে ভাবে সে আগের পাতু টি নেই। তার পরিবর্তনের সাধিত হয়েছে।সে তো এমন ছিল না! আগের পাতা শ খানেক অবহেলা, তাচ্ছিল্য, কটুক্তি র সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আবেগ ধরে রাখতে জানতো! লোকসম্মুখে তার দূর্বলতা লুকিয়ে নিতো হাসি মুখে। অথচ বর্তমান পাতা চিমটি পরিমাণ অবহেলার স্বীকার হলেও নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। নেত্রযুগল আবেগে টইটুম্বুর হয়ে যায়। দূর্বলতা চোখে ভাসতে থাকে উজানের ঢেউয়ে। সামনের মানুষ টি খুব সহজেই বুঝে নেয় সেই দূর্বলতা!
পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বর্তমান নিয়ে তার তিল পরিমাণ অভিযোগ নেই। সে বেশ আছে স্বামী সন্তান নিয়ে। এরকম হাসিখুশি আগের পাতু কখনোই ছিল না। তার জন্য এতো গুরুত্ব, এতো যত্ন ভালোবাসা সে যে কখনো কারো চোখেও দেখেনি। তবে মাঝেমধ্যে ভয় হয়! এসব সময়ের সাথে সাথে কর্পূরের মতো উবে না যায়। তার ভাগ্যটা খুবই প্রসন্ন কি না!! সুখপাখি তার মন প্রসূণে আসে, বসে! প্রয়াত কাল পর ঘটা করে বিদায় নিয়ে চলেও যায়। আজকাল পাতার কেমন অদ্ভুত ধরনের অনুভূতি হয়। কিছু একটা শূন্যতা অনুভব করে। কিন্তু সেই শূন্যতা কি ঠাহর করতে পারেনা। কিন্তু শূনতা’টা তাকে খুব পোড়ায়।
সে লক্ষ্য করেছে যখন ওই নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটা তার আশেপাশে থাকে তখন অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে। মনে হয় সর্বক্ষণ তার সাথেই লেগে থাকতে। লোকটার সাথে থাকলে সে সব কিছুই ভুলে যায়। মস্তিষ্কের ভিতরে লোকটাই কিলবিল করে। লোকটা দূরে গেলেই বুকটা হাহাকারে ভরে ওঠে। এই তিনমাসে পাতার সাথে আরেকটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। যে শাশুড়ির সামনে যেতে তার বুকটা দূরু দূরু করতো তার সাথেই তার সখ্যতা গড়ে উঠেছে। কাওছার ভাই ও পাবেল ব্যাতিত তার নতুন এক অসমবয়সী বন্ধুর আগমন ঘটেছে। অরুণের অনুপস্থিতিতে ভোর, আনি,রূপ ও আসমা বেগমের সাথেই তার সময় বেশি কাটে।
বাচ্চারা খেলায় ব্যস্ত থাকে। সে আর তার শাশুড়ি টুকটাক কথা বলতে বলতে কিভাবে যেন তাদের মাঝে অনেক ভাব চলে আসে। হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকে। পাতা খেয়াল করেছে আসমা বেগম মোটেও গম্ভীর নন। সে গাম্ভীর্যের ভান ধরে থাকে। সেও এক প্রাণোচ্ছ্বল ভালো মনের মানুষ। অনেকটাই নারকেলের মতো উপরে শক্ত হলেও ভিতরে নরম। সে আরেকটা বিষয় খেয়াল করেছে তার শাশুড়ি তাকে অনেক স্নেহ করে! রুবি আপুর থেকেও বেশি! কেন? সে উত্তর পায় না। তবে তার ভালো লাগে তার সাথে মিশতে। তার স্নেহ উপভোগ করতে। মাঝে মাঝে মা মা গন্ধ পায় তার থেকে। তাঁরা বউ শাশুড়ি বাচ্চা কাচ্চা সহ বেশ কয়েকবার ঘুরতে বেড়িয়েছে। সাফারি পার্ক, নদীর ঘাট, রেস্টুরেন্ট, শাপলা বিল সহ শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছে।
বাড়ির আঙিনা থেকে ভেসে আসা তীব্র গাড়ির হর্নের শব্দে পাতা ভাবনাচ্ছেদ ঘটে। সে ভ্রু কুঁচকে চায়। কে এলো? আরিয়ান ভাই নাকি! নাহ্। সে না! পাতার অধর কোণে মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে ওঠে। এই নাক উঁচু লোক আজ এতো জলদি? সবে তো চারটা বাজে। পাতার ইচ্ছে করে ভোরের মতো দৌড়ে গিয়ে লোকটাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সে যায় না। গ্রিল ধরেই পলকহীন তাকিয়ে থাকে। কালো স্যুট বুট পড়ে লোকটা গম্ভীর মুখে ভোরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভোর বাবাকে দেখে নিত্যদিনের মতো সব কাজ ফেলে দৌড়ে তার কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে।
অরুণ ছেলেকে কোলে তুলেই আদরে আদরে ভরিয়ে তোলে। কিন্তু ছেলের বিষন্ন মুখটা দেখে বলে,
-” কি হয়েছে আব্বু? মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন?”
-” কিছু না!”
বলে ভোর বাবার গলার ভাঁজে মুখ লুকায়। অরুণের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। এরমধ্যে আনিকা ব্যাট হাতে এগিয়ে আসে। ছোট প্যান্ট আর টিশার্ট পরনে। মাথায় স্পোর্টস ক্যাস! অরুণ ছেলেকে একহাতে সামলিয়ে অপর হাতে আনিকাকে টেনে কোলে তুলে আদর করে। ভোর মাথা তুলে গম্ভীর মুখে চায়। আব্বু আনি’কে আদর করবে কেন? আনিকা তার চাচ্চুর গলা জড়িয়ে বলে,
-” বড় চাচ্চু তুমি আজ এতো জলদি এলে কেন? এসেছো ভালো হয়েছে! চলো আমরা ক্রিকেট খেলি?”
-” উম্। খেলা যায়! দাঁড়াও আমি চেঞ্জ করে আসি। তোমরা ততক্ষণে খেলো! আচ্ছা?”
আনিকা খুশি হয়ে মাথা নাড়ে। কোল থেকে নেমে ব্যাট নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বলে,
-” চাচ্চু? আমি আর তুমি এক টিমে কিন্তু!”
অরুণ সায় জানিয়ে ভোরের দিকে তাকায়। ভোর গাল ফুলিয়ে তার গলা ছেড়ে দিয়ে বলে,
-” তোমরাই খেলিও! আমি খেলবো না।”
অরুণ ছেলেকে পাঁজা কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
-” আমার কলিজাটা এতো হিংসুটে! আচ্ছা বাবা খেলবো না। এখন বলো তো আমার চড়ুই পাখিটা চুপ করে আছে কেন?”
ভোর পিটপিট করে তাকালো। অবাক সুরে বলল,
-” আব্বু তোমার চড়ুই পাখি আছে?”
অরুণ মুচকি হেসে ঝুঁকে আসে। ছেলের ঠোঁটে চুমু বসিয়ে বলে,
-” এই তো আমার ছোট্ট চড়ুই পাখি।”
ভোর হেসে উঠলো খিলখিলিয়ে। সে চড়ুই পাখি? কই তার তো ডানা নেই? সে তো উড়তেও পারে না! না তার পাখির মতো ঠোঁট! অরুণ চঞ্চল প্রাণোচ্ছ্বল ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বলে,
-” এখন বলোতো কলিজা? কি হয়েছে আমার মানিকের?”
ভোরের হাসি থেমে যায়। পিটপিট করে বাবার দিকে তাকালো। চোখটা নিমিষেই নোনাজলে ভরে ওঠে। প্রতিবারের মতো আজও স্কুল ছুটির শেষে আম্মুর সাথেই ছিল। আম্মু তাকে টিচার্স রুমে বসিয়ে দিয়ে প্রতিবারের মতো ক্লাস নিতে চলে যায়। ভোরের একা বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগছিল না। তার উপর সব টিচাররা কেমন করে তাকাচ্ছিল যেন সে চুরি করতে এসেছে। তাই সে ব্যাগ রেখে গুটি গুটি পায়ে বেড়িয়ে আসে। এদিকে ওদিকে হাঁটতে হাঁটতে আম্মুর ক্লাসরুমে গিয়েছিল। তখন ক্লাসের শিক্ষার্থীরা কিউট ভোরকে দেখে চিল্লিয়েই উঠেছিল একপ্রকার। তাকে টেনে এ কোলে ও কোলে নেয়ার জন্য হৈ হুল্লোড়ে মাতিয়ে দিয়েছিল! শান্ত পাতা তাদের ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে। ভোরকে হালকা শক্ত গলায় বলেছিল,
-” ভোর যাও টিচার্স রুমে? এভাবে ক্লাসে ঢুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির করবে না।”
ভোর স্যরি বলে টইটম্বুর চোখে বেড়িয়ে এসেছে। তার রাগ হয়েছিল বেশ। তবে আম্মু এলে আবার স্যরিও বলেছিল। পাতা অবশ্য আর কিছু বলে নি। বুঝিয়ে বলেছে এভাবে ক্লাসে এলে তো পড়ানোয় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। তাই যেন না আসে। ভোর বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে ছিল। পাতাও মুচকি হেসে তাকে আদর করেছিল। কিন্তু ভোরের মনে হচ্ছে আম্মু তাকে পঁচা দুষ্টু ছেলে ভাবছে। তাকে এড়িয়ে চলছে। তাঁর সাথে রাগ করেছে।তাই সেও মনে মনে রাগ করে। অরুণ গম্ভীর মুখে পুরো কাহিনী শোনে। তবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। ভোর পুনরায় বলে,
-” আব্বু তুমি কিন্তু আম্মুকে বলবে না এসব?”
অরুণ তার কথার জবাব না দিয়ে বলে,
-” কাল থেকে তোমার স্কুল ছুটি হলেই তুমি বাড়ি ফিরবে। ইটস মাই অর্ডার। কোনো জেদ না! আমি আভারি ভাই ও ড্রাইভারকে পাঠাবো!”
-” আব্বু..”
-” নো মোর ওয়ার্ডস!”
ভোর চুপ হয়ে যায়। বুঝতে পারলো আব্বুকে বলা মোটেও উচিত হয় নি। তার ফুলো গাল আরো ফুলে ওঠে। অরুণ ছেলেকে কোলে নিয়েই রুমে প্রবেশ করে। তার আগমনের শব্দে পাতা ও বিড়ালটি এগিয়ে আসে। বিড়ালটিও তার সখির মতো গুলুমুলু হয়েছে বেশ। বড়ও হয়েছে কিছুটা। সে লেজ নাড়িয়ে পাতার আগেই অরুণ অবধি পৌঁছে যায়। মিও মিও করে খুশি প্রকাশ করে যে তার আগমনে সে কতটা খুশি। পাতা এসে হাসিমুখে সুধায়,
-” আজ জলদি এতো ফিরলেন যে?”
-” তো ফিরে যাবো পাতাবাহার?”
তীক্ষ্ণ কথার ধারে পাতার নাক মুখ কুঁচকে যায়। এই নিরস লোকটার মুখে রসের ছিটেফোঁটাও নেই।
-” রোজ দেড়ি করে আসেন। আটটার আগে দেখাই পাওয়া যায় না। আজ জলদি ফিরলেন তাই জিজ্ঞেস করলাম। ভুল হয়ে গেছে আমার কৃপা করে ক্ষমার চোখে দেখবেন!”
অরুণ ছেলেকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে পাতা মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
-” আলমারি থেকে জামা কাপড় বের করো। গোসল করবো!”
বলেই ব্লেজার, কটি, শার্ট একে একে খুলে ছুঁড়ে ফেলে। বিছানায় বসে শু মুজো খুলে গা এলিয়ে দেয়। পাতা হতাশ ভঙ্গিতে ফ্লোর থেকে সব তুলে ভোরের পাশে রাখে আলমারি থেকে কাপড়চোপড় বের করে ওয়াশ রুমে রেখে দেখে লোকটা ওভাবেই শুয়ে আছে। ভোর সোফায় বসে বিড়ালটিকে আদর করতে ব্যস্ত। পাতা বিছানায় পা তুলে বসে নির্দ্বিধায় অরুণের কপালে হাত রেখে সুধায়,
-” খারাপ লাগছে? মাথা ব্যাথা?”
অরুণ লম্বা শ্বাস টেনে কপালে রাখা পাতার হাত টেনে অধর ছোঁয়ায়। ইচ্ছে করে ছোট্ট কোলটায় মাথা রেখে বলতে ‘একটু মাথায় হাত বুলিয়ে চুলগুলো টেনে দাও পাতাবাহার!’ কিন্তু অরুণ করে না। যত্ন হীন বড় হওয়া অরুণের স্বভাব না বিগড়ে যায় আদরে। সে উঠে বসল।
-” না! একটু টায়ার্ড লাগছে। ফ্রেশ হলেই ঠিক হয়ে যাবে! ক্ষুধা লেগেছে আমার।”
বলেই ওয়াশ রুমে চলে যায় অলস পায়ে। পাতা তড়িঘড়ি করে নিচে চলে আসে। সুফিয়াকে ডাকে ব্যস্ত গলায়। অথচ সুফিয়ার সাড়া নেই। সুফিয়া এ বাড়িতে নতুন কাজের মেয়ে। সে বিরক্ত হয়। আসমা বেগম রূপের ছোট্ট হাত ধরে এগিয়ে আসেন। ছোট রূপ এখন হাঁটতে পারে টলোমলো পায়ে। পাতাকে দেখেই রূপ ‘আমা আমা’ বলে এগিয়ে আসে দাদির হাত ছেড়ে। পাতা কোলে তুলে নিয়ে ফুলো গালে চুমু খায়। আসমা বেগম হেসে বলে,
-” হয়েছে টাকি পাতু? সুফিয়াকে ডাকছো কেন?”
পাতা অসহায় ফেসে বানিয়ে বলে,
-” উনি এসেছে একটু আগে।গোসলে আছেন। ফ্রিজে ভাতের বোল ফাঁকা রুটিও দেখছি না।”
-” তাই সুফি সুফি ডাকছো! উনি টা তোমার। তার খাবার দাবারের দায়িত্ব কি সুফির? সুফি নেই!”
পাতার মুখখানি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়। আসমা বেগম কিচেনের দিকে যেতে যেতে বলে,
-” মহারানী পাতা! আপনি বোধহয় জানেন না পুরুষ মানুষকে হাতে রাখতে চান তো ভালোবেসে রান্না করে পেট পুরিয়ে খাওয়ান।”
পাতা রূপকে কোলে নিয়ে তার পিছু পিছু যেতে যেতে জবাব দেয়,
-” রান্নার প্রতি আমার ছিটেফোঁটা আগ্রহও কাজ করে না। রান্নাবাদে আমায় যে কাজ দাও আমি রাজি তবে রান্নার কথা বললেই অলসতা ঘিরে ধরে। রান্না করা এক আকাশ সাধনার ব্যাপার!”
আসমা বেগম আলু ও ডিম সিদ্ধ দেয় দুটো। ফ্রিজ থেকে দুপুরে রান্না করা কষা মাংস বের করে গরম করতে দেয়। আটার বড় বৈয়াম বের করে গুলে খামি বানায়। পাতা রূপকে নিচে নামিয়ে বলে,
-” আমিও সাহায্য করি! বলো কি করতে হবে?”
-” থাক! আপনার উনি দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তার রাজ্যের রানিকে দিয়ে আমি রান্না করাচ্ছি!!”
পাতা মুচকি হেসে বললো,
-” বেশি বেশি বলো তুমি! আমি হেল্প করছি বলো?”
আসমা বেগম আলু সিদ্ধ দেয়া কড়াই থেকে আলু ও ডিম নামিয়ে বাটিতে রাখে।
-” এটা পানি ঢেলে ঠান্ডা করে ছিলে দাও!”
পাতা তার কথামতোই কাজ করে। আসমা বেগম আলু ছেনে নিয়ে বিভিন্ন মশলার গুঁড়োর সহীত ভর্তা বানিয়ে আটার সাথে মাখিয়ে বেলে নেয়। ঘিয়ে ভেজে বানিয়ে নেয় আলুর পরোটা। পাতা তার পাশে দাঁড়িয়ে সবটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে। আসমা বেগম পাতাকে দিয়ে প্লেট আনিয়ে সাজিয়ে দেয় সব খাবার। দুটো সিদ্ধ ডিম, চারটা আলুর পরোটা, কষা মুরগির মাংস। ব্যস! পাতা শাশুড়ি নামক নতুন বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে খাবার নিয়ে রুমে যায়। দেখে বাবা ছেলে সোফায় বসে বিড়াল নামক জঞ্জালটিকে আদর করছে। পাতার গা টা জ্বলে উঠলো। কি দিনকাল পড়লো পাতু ওই বিড়ালের বাচ্চাকে দেখে হিংসায় জ্বলিস!
সে এগিয়ে এসে বলে,
-” ওটাকে সরান? খাবার এনেছি! ওর লোম উড়ে এসে পড়বে।”
ভোর কিছু না বলে বিড়ালটিকে বাবার কোল থেকে নামিয়ে দেয়। বিড়ালটি মিও মিও করে সরে গিয়ে বিছানায় বসে আড়চোখে চায়। পাতা টি টেবিলে খাবার রেখে বিছানায় থেকে ভেজা তোয়ালে নিয়ে অরুণের সামনে দাঁড়ায়। অরুণ ভ্রু কুঁচকে কিছু বলবে পাতা তোয়ালে তার মাথায় রেখে সযত্নে মুছে দেয়।
-” ভালোভাবে মুছেন নি! ঠান্ডা লেগে যেতো!”
অরুণের অধরে হাসি ফুটে তে তউঠতে চায় গম্ভীর অরুণ অগোচরে লুকিয়ে রাখে। পাতা তোয়ালে বেলকনিতে মেলে দিয়ে আসে। দেখে অরুণ খাবারে হাত দেবে।
-” আরে আরে ভোরের বাবা করছেন টাকি! বিড়াল ধরে ছিলেন। হাত না ধুয়েই..”
অরুণ উঠে দাঁড়াবে পাতা তাকে থামিয়ে দিয়ে ওয়াশ রুমে গিয়ে নিজে হাত ধুয়ে এসে প্লেট হাতে তুলে নেয়। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। মুখ খুলে কিছু বলবে এর আগে পাতা তাঁর মুখে খাবার পুরে দেয়। অরুণ খাবার চিবানো ভুলে যায়। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। পাতার ওসবে ভাবান্তর নেই। সে এবার ভোরের মুখে দেয় পরোটা। ভোর মিষ্টি হেসে চিবোতে থাকে। অরুণ নিজেকে ধাতস্থ করে খাবার গলাধঃকরণ করে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” বাহ্ পাতাবাহার! আজ এতো যত্ন আত্তি।ব্যাপারখানা কি?”
পাতা তার মুখে পুনরায় খাবার পুরে দিয়ে বলে,
-” বিশটা সিতাহার! পনেরো জোড়া বালা! পাঁচ জোড়া ঝুমকা আবদার করবো! তাই একটু আকটু.. নিন ভালো করে খান তো?”
অরুণ সোফায় গা এলিয়ে দেয়। ভোর চিন্তা ভাবনার পর বলে,
-“ও আম্মু এতো কিছু দিয়ে তুমি কি করবে?”
পাতা মুচকি হেসে সিরিয়াস গলায় বলল,
-” ছেলের বউ পছন্দ করে রেখেছি! তাকে আনতে হবে না? তার জন্যই এতোসব। এই ভোর কম হবে গয়না?”
ছোট্ট ভোরের ফর্সা মুখশ্রী নিমিষেই লাজে রাঙা হয়ে যায়। সে কাঁদো কাঁদো মুখ বানিয়ে বলে,
-” তোমরা একটুও ভালো না। বলেছি না? করবো না আমি বিয়ে। আব্বুকে করাও বিয়ে!”
বলেই দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অরুণ হেসে উঠলো শব্দ করে। পাতা ভোরকে পিছু ডাকে খাওয়ার জন্য ভোর শুনলে তো! পাতা অরুণের দিকে তাকালো। অরুণ হাসি থামিয়ে গম্ভীর মুখে বলো,
-” খাবার নিয়ে বসে থাকবে?”
পাতা ভেংচি কেটে খাবার মুখে দেয়। অরুণ আস্তে ধীরে সবটুকু খাবার শেষ করে। পাতা গ্লাসে পানি ভরে গ্লাস দেয়। সব গুছিয়ে রুম থেকে বেড়োবে অরুণের কথায় কদম থেমে যায় তাঁর।
-” স্কুলে কি হয়েছিল আজ? ভোরকে বকেছিলে কেন?”
পাতার বুকটা কেমন যেন করে উঠলো। অজানা অনুভূতি টগবগিয়ে বেড়ে গেল। সে নিজেকে শান্ত করে। অরুণ আবার বলে,
-” বাচ্চা ছেলে! তখনই ভালোভাবে বুঝিয়ে বললেই হতো! ক্লাসের সকলের সামনে শক্ত করে কথা না বললেও পারতে পাতাবাহার!ছেলেটা কষ্ট পেয়েছে!”
পাতার নিঃশ্বাস যেন আটকে গেলো। সে বকেছিল? শক্ত গলায় কথা বলেছে? অথচ লোকটা সর্বক্ষণ ছেলেটাকে ধমকাবে , শাসন করবে। বেশি জেদ করলে গায়ে হাত অবধি তোলে। পাতা একটু শাসন করেছে। সেই হক কি তার নেই? কৈফিয়ত দিতে হবে! পাতা পলক ঝাপটে নিজেকে ধাতস্থ করে। ঢোক গিলে পিছনে ঘুরে শান্ত চোখে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” আই এম স্যরি! আর কখনোই হবে না!”
অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফা থেকে উঠে আসে। পাতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে তাঁর মাথায় হাত রেখে নম্র কন্ঠে বলে,
-” ডোন্ট মাইন্ড বাট প্লিজ ওর সাথে রূড বিহেভ করবে না। ও খুবই সেনসিটিভ! ভাববে যে আমি বকি, শাসন করি, মারি! তাহলে তুমি কেন করতে পারবে না! ইটস আ ফ্যাক্ট। ও ছোট থেকেই আমার কোলে পিঠেই বড় হয়েছে। ও শাসন, বকাঝকা, মার যেটা বলো আমার কাছ থেকেই পেয়েছে। আমি ব্যতিত মনে হয় না খুব কেউ ওকে বকেছে বা শাসিয়েছে! মারা তো দূরের কথা! আর কেউ যদিও বকা দিয়ে থাকে ও খুব রিয়েক্ট করে বসে। রিয়েক্ট বলতে চিল্লাচিল্লি না। ও ব্যাপারটা নিয়ে মনে মনে ভেবে অনেক কষ্ট পাবে। লোক সম্মুখে হাসলেও মনটা তার বিষন্নতায় ভরে থাকবে। একা একা কাঁদবে কাউকে বুঝতে দিবে না! ও তোমার থেকে সবসময় আদর ভালোবাসাই পেয়েছে। মনে হয় না কখনো মিছেমিছিও বকেছো! হুট করে এভাবে বিহেভ করেছো তাই কষ্ট পেয়েছে বেশ! ওকে আবার বলো না যে আমি বলেছি তোমাকে! আর হ্যাঁ কাল থেকে ও ছুটি হলেই বাড়ি ফিরবে। ডিস্টার্ব করবে না তোমায়! ”
-” মনে থাকবে!”
বলে পাতা পা বাড়ায়। ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সে রূঢ় আচরণ করেছে ভোরের সাথে? করেছেই তো! ওভাবে শক্ত করে কথা বলা ঠিক হয় নি। ভোর কষ্ট পেয়েছে অনেক। বাবার কাছে নালিশ করেছে! পাতা কিচেনে সব রেখে আসে। ভোরকে খুঁজতে থাকে। বাইরে গিয়ে দেখে মিনু আপার কাছে বসে আছে চুপচাপ। সে এগিয়ে যায়। পথিমধ্যে আসমা বেগম এগিয়ে আসে রূপকে পাতার কাছে দিয়ে বলে,
-” মুখটা মলিন হয়ে আছে কেন? কি হয়েছে?”
পাতা হালকা হেসে বলে,
-” কিছু না!”
আসমা বেগমের সন্দেহ হয় তবে গুরুত্ব দেয় না। রূপকে রেখে আনিকার কাছে যায়। নাতনি আবদার করেছে তার সাথে ব্যাট বল খেলতে! পাতা রূপকে নিয়ে ভোরের কাছে যায়। ছোট রূপ পাতাকে পেয়ে খুব খুশি। পাতাকে পেলে তার চোখে মুখে আলাদা দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে যেন! রূপকে পাতার কোলে দেখে ভোরের চোখে মুখে আঁধার নামলো যেন! নাকের পাটা ফুলিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। পাতা ভোরের পাশ ঘেঁষে বসে রূপকে নামিয়ে দিল! রূপ একটু হেঁটে গিয়ে আবার ফিরে আসে ‘আ’মা আ’মা’ বুলি আওড়িয়ে। ব্যস! ভোরের সহ্যের সীমা লঙ্ঘন করলো। তার আম্মুকে কেন মা বলবে? সে তড়িৎ বেগে পাতার কোলে বসে গলি জড়িয়ে তার জায়গা দখলে নিলো! পাতা প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাসে! রূপ সেটা দেখে আর এগোয় না! ধপ করে মাটিতে বসে ‘আ’মা আ’মা’ বলে চিল্লিতে থাকে। ভোর ঘার ফিরিয়ে তাকে জিভ উল্টিয়ে ভেঙায়। ব্যস রূপের চিল্লানো বেড়ে যায়! পাতা ভোরকে কোলে রেখেই উঠে দাঁড়ালো। ছেলেটা সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরেছে। যেন রূপ তাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে! সে রূপের সামনে দাঁড়াতেই রূপের কান্না থেমে যায়! সে কুটুর মুটুর পাতার দিকে তাকিয়ে ফোকলা দাঁতে হেসে আ’ মা ডাকে।
-” পঁচা রূপ! তোর মা অফিসে। তার কাছে গিয়ে ডাক! খবরদার আমার আম্মুকে আ’মা’ ডাকলে তোর ওই তিনটে দাঁত আমি ভেঙ্গে ফেলবো!”
ভোরের ভর্ৎসনা শুনে রূপ খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে ঘাসে আচ্ছাদিত জমিনে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পাতা হেসে বলল,
-” ভোর দেখো কি সুন্দর করে হাসছে? একদম তোমার মতো লাগছে!”
ভোর তাকালো না।
-” ও আম্মু বাড়ি চলো!”
রূপ হাসি থামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পাতার পা জড়িয়ে ধরে। মানে সেও যাবে! কোলে নাও! পাতা নেয় না। মিনুর দিকে তাকিয়ে বলে,
-” মিনু আপা? রূপকে দেখো একটু! আমি আসছি!”
বলে হাঁটা শুরু করে। রূপ আ’মা আ’মা বলে পাতার পিছনে হাঁটতে থাকে। মিনু আস্তে আস্তে উঠে রূপকে কোলে তুলে নেয়।
পাতা ভোরকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নরম গলায় ডাকে,
-” ভোর?”
-” হুম?”
-” স্কুলে আমি তোমাকে বকে ছিলাম?”
ভোরের ছোট্ট বুকটা কেঁপে উঠলো। পাতা আবার বলে,
-” আমার কথায় কষ্ট পেয়েছে ভোর সোনা?”
-” আম্মু আমি একটুও কষ্ট পাই নি। আব্বু এমনি এমনি বলেছে! আব্বু আব্বু..”
কথা জড়িয়ে আসে ভোরের। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস টানছে। পাতা ভোরকে নামিয়ে দিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। ভোর নাক ডলে বলে,
-” আম্মু আমি একটুও কষ্ট পাই নি!”
বলে দৌড় লাগালো বাড়ির দিকে। পাতা ডাকে শোনে না। ভোর এক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে ওঠে রুমে গিয়ে বাবাকে খোঁজে ,পায় না। স্টাডি রুমের দরজা ধরাম করে খুলতেই দেখতে পায় বাবাকে। অরুণ ফোনে কথা বলছে ডিভানে বসে! ভোরের ক্রন্দনরত ফোঁস ফোঁস করে করা আদুরে মুখটা দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে। ফোন কেটে দিয়ে বলে,
-” ভোর কি হয়েছে? ওভাবে শ্বাস টানছো কেন?”
ভোর দৌড়ে এসে অরুণকে এলোপাথাড়ি কিল থাপ্পড় লাগাতে থাকে। অরুণ উদ্বেগ প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করে ‘কি হয়েছে ?’ ভোর মারের গতি বাড়িয়ে দিল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
-” মানা করেছিলাম না আমি? বলেছিলাম না আম্মুকে না বলতে! তুমি পঁচা আব্বু! আম্মুকে বকেছো তুমি? আম্মু কষ্ট পেয়েছে! তুমি একটুও ভালো না আব্বু!”
অরুণ বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। পাতাবাহার নিশ্চয়ই ছেলেটাকে বলেছে। সে ভোরকে কোলে তুলে নেয় জোড় করে। ভোর হাত পা ছুড়তে থাকে। কামড় বসিয়ে দেয় অরুণের বুকে। অরুণ কিছু বলে না। এরমধ্যে পাতা আসে। ভোরকে ডাকতেই ভোর বাবাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে। অরুণ পাতার দিকে তাকায়। যার অর্থ মানা করেছিলাম আমি! পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভোরকে কোলে তুলে টেবিলের উপর বসিয়ে দেয়। ছোট্ট মুখটা আঁজলায় ভরে ছোট ছোট চুমু দিয়ে আদরে ভরিয়ে দিল।
-” এটা ওটা সব বলো!রোহানের আম্মুর কথায় কষ্ট পেয়েছিলে! রোহান কথা বলে না কষ্ট পেয়েছিলে! মিনু আপা কোলে নেয় না কষ্ট পাও। আব্বু বকলে মারলে কষ্ট পাও! সব কষ্টের কথা আম্মুকে বলো আর আম্মুর কথায় কষ্ট পেয়েছো সেটা কেন বলোনি আম্মুকে? হুম?”
ভোর ছলছল চোখে বলে,
-” আম্মু বিশ্বাস করো আমি একটুও কষ্ট পাই নি!”
-” পাও নি?”
-” না!”
-” সত্যিই পাওনি বাবা?”
ভোর মাথা নিচু করে নেয়। পাতা হাসে। ভোরকে বুকে জড়িয়ে আদুরে গলায় বলে,
-” আই এম রিয়েলি স্যরি বাবা! আমার ওভাবে বলা মোটেই ঠিক হয়নি! আমার সোনা বাবাটা কষ্ট পেয়েছে! আম্মু অনেক স্যরি!আর কখনো হবে না বাবা!”
ভোর পাতাকে জড়িয়ে কেঁদে ওঠে শব্দ করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-” আম্মু আমি পঁচা ছেলে নই! আমি একটু একটু কষ্ট পেয়েছিলাম!”
পাতা তাকে শক্ত করে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত হতে বলে।
-” আমি জানি তো! ভোর সবচেয়ে গুড বয়! একটুও পঁচা না। পঁচা তো ভোরের আম্মু! ভোরকে বকে..”
-” আমার আম্মু একটুও পঁচা না। খুব খুব খুব ভালো!”
পাতাকে বলতে না দিয়ে ভোর ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে। পাতা হেসে ওঠে। অরুণ হামি তুলে ঘার এদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে বলে,
-” হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি! ভোর আর ভোরের আম্মু খুউব ভালো! শুধু ভোরের আব্বুটা পঁচে গেছে!”
ভোর মাথা তুলে উঁকি দিয়ে একবার বাবাকে দেখে নেয়। নাক টেনে কান্নার মাঝেই হেসে দেয়।অরুণ এগিয়ে এসে টিস্যু দিয়ে নাক পরিষ্কার করে দেয়। পাতার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে মিছে বিরক্তের শ্বাস নিয়ে বিড় বিড় করে,
-” ছিঁচকাদুনে পরিবার আমার!”
ছেলেকে কোলে নিয়ে রুমে চলে যায়। পাতা টিস্যু দিয়ে ভিজে যাওয়া চোখ মুখ মুছে নিলো। নাক টেনে সর্দি মুছে বিনে ছুঁড়ে ফেলে সেও ঘরে চলে যায়!
নিস্তব্ধ রজনী। আকাশের ক্ষীণ চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। জোনাকির দল পুকুরের চারপাশে জ্বল জ্বল করছে। মিটমিটে আলোয় পরিবেশ আলোকিত না হলেও বেশ আকর্ষণীয় দেখতে। পুকুরে প্রতিফলিত হয়েছে ক্ষীণ চাঁদ! সব মিলিয়ে যেন এক অতুলনীয় সৌন্দর্য বিরাজ করছে এই নীরব পুকুর ঘাটে। পাতা ভোরকে নিয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। ভোর পাতাকে জড়িয়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। পাতার চোখেও ঘুম টইটুম্বুর। চোখ ছোট ছোট হয়ে এসেছে। হামি তুলছে বারংবার কিন্তু ঘুমোচ্ছে না। সে কারো অপেক্ষায়! আশ্চর্য লোকটা আসছে না কেন? পাতা ভোরের কপালে গালে চুমু দিয়ে আস্তে ধীরে ভোরের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে বিছানা থেকে নামল।
এসি বন্ধ করে গায়ে ভালোভাবে কম্বল জড়িয়ে দিল। কার্তিক মাস চলছে। দিনের বেলায় শীতের ছিটেফোঁটা না থাকলেও রাতে তার প্রকোপ কিছুটা ঠাহর করা যায়। পাতা গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে আসে। দূরু দূরু বুকে স্টাডি রুমে উঁকি দেয়।না এখানেও নেই। পাতা উপর থেকেই ড্রয়িং রুমে উঁকি দেয়। লাইট জ্বলছে কিন্তু কেউ নেই। পাতার গা ছমছম করে কিন্তু তবুও সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। এদিকে ওদিকে মাথা ঘুরিয়ে খুঁজতে থাকে। হঠাৎ কিচেন থেকে টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসে। পাতা ভয় পায়। দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে। অর্ধেক যাওয়ার পর ভাবে লোকটা কিচেনে নয়তো? ভিতু পাতা আবার নেমে আসে । উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। লোকটা তবে কিচেনে! কিন্তু এতো রাতে কিচেনেই বা কি করছে? সে নক করে। অরুণ ঘার ফিরিয়ে তাকে দেখে পুনরায় নিজের কাজ করতে করতে বলে,
-” ভোর ঘুমিয়েছে?”
-” হুম!
পাতা এগিয়ে আসে। পুরো কিচেনে নজর বুলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে কি রান্না করছে! তবে জিজ্ঞেস করলো না। অরুণ আবার প্রশ্ন করে,
-” তুমিও ঘুমিয়ে যেতে?”
-” আপনি আসছিলেন না! তাই!”
-” ওহ্। আমার জন্য ওয়েট করছিল মহারানী?”
পাতা মাথা নাড়ল ছোট করে।
-” কি রান্না করছেন?”
অরুণ পাতার দিকে তাকালো। চোখে মুখে তার প্রফুল্লচন্দ্র ছেয়ে আছে।
-” কেক বানাচ্ছি! চকলেট ফেবারের! কাল ভোরের বার্থডে। এখন দশটা বাজে, বানিয়ে ফ্রিজে রাখবো। ঠিক বারোটায় ডেকে সারপ্রাইজ দিবো! আইডিয়া কেমন?”
পাতা অবাক হয়। কাল ভোরের বার্থডে? হ্যাঁ তাইতো! টুয়েন্টি থার্ড অক্টোবর তো কালই! ইশ্ সে তো ভুলেই গেছে। লোকটা বলতে পারতো তাকে! সেও হেল্প করতো!
-” তারজন্য আজ জলদি ফিরলেন!”
-” হুম! সবাইকে ইনভাইটও করেছি!”
-” ওহ্!”
এতো কিছু প্ল্যান করেছে লোকটা অথচ তাকে জানায় নি। সে আর কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। অরুণ নিজ মনে কাজ করতে থাকে। তবে আড়চোখে পাতার বিষন্ন মুখটা নজর এড়ায় না। সে সব কাজ সম্পন্ন করে কেকের ফর্মা ওভেনে দেয়। গ্লাফস খুলে শেফদের এপ্রোনটাও খুলে রাখে। বেসিন থেকে হাত ধুয়ে পাতার শাড়ির আঁচলটায় মুছতে মুছতে বলে,
-” আবার কি হলো? গাল ফুলিয়ে রেখেছো কেন?”
পাতা হাসার চেষ্টা করে বলে,
-” গাল ফুলাই নি মোটেও! ঘুম পাচ্ছে আমার। আমি যাই আপনি কাজ শেষ করুন!”
বলে পা বাড়ায়। অরুণ যেতে দেয় না। কাঁধ জড়িয়ে বাহু বন্ধনে আটকে নেয়।
-” বিকেলের কথায় কষ্ট পেয়েছো? আমি কিন্তু ওভাবে বলি নি। আর এক্সপ্লেইনও করেছি!”
পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-” না কষ্ট পাই নি। তবে ভালো লাগছে না। ছেলেটা আমার কথায় কষ্ট পাবে আমি একটুও ভাবি নি। আমি ক্লাস শেষেই তাকে আদর করে বুঝিয়েছি। তখনও হাসিমুখেই ছিল। কিন্তু তার হাসিমুখের আড়ালের মন খারাপি দেখতে পাই নি। এটাই পোড়াচ্ছে আমাকে। আমি কেন তার বিষন্নতা উপলব্ধি করতে পারলাম না। ছেলেটা শুধু কষ্ট পায় নি বরং তার ছোট মনে অনেক দাগ কেটেছে আমার ওই আচরণ। আমি..”
বলতে বলতে পাতা যেন হাঁপিয়ে ওঠে। গলা কেঁপে ওঠে। অরুণ তাকে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে নিয়ে আশ্বস্ত করে বলে,
-” আরে পাগল! ইটস ওকে।ও সব ভুলে গেছে। তুমি আদর করে বুকে টেনে নিয়েছো ব্যস ওর বিষন্নতা সেখানেই সমাপ্ত হয়ে গেছে। এখন এসব ভেবে কষ্ট পেও না তো!”
পাতা নাক টেনে হুম বলে। আঁচলে চোখের পানি মুছে নেয়। অরুণ তার মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে জড়িয়ে রাখে। পাতার বুকটা একটু হালকা হয়। অরুণের বুকটায় আরেকটু সেটে গিয়ে নাক মুখ ঘষে। অরুণ হাসে অল্প। তাদের এই মিষ্টি মধুর আলিঙ্গন বোধহয় একজনের সহ্য হয় না। অরুণের ট্রাওজার নখ দিয়ে টেনে ধরে মিও মিও করতে থাকে। অরুণ নিচে তাকিয়ে পাতাকে বলে,
-” দেখো তোমার সখি ডাকছে তোমায়!”
পাতা অরুণকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালো। বিড়ালটির চৌদ্দ গুষ্টির পিন্ডি চটকিয়ে বিরস মুখে দাঁড়িয়ে বলল,
-” এটাকেও সাথে এনেছেন তবে। তাই তো বলি আপনার ছা’ পোষা বিড়ালের খোঁজ নেই কেন!”
-” আমি আনি নি! ও নিজেই পিছু পিছু এসেছে।”
-” আসবে না! পারলে আপনার সাথে চুইংগামের মতো লেগে থাকে!”
অরুণ বোঝে না পাতার বিড়বিড় করে বলা কথা! ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-” কিছু বললে?”
পাতা মাথা নেড়ে বিড়ালটির দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
-” না! কাল ভোরের বার্থডে। আপনি তো সব কাজ সেরেই ফেলেছেন। আমাকে একবার জানাতে পারতেন?”
অরুণ কেকটা বেক হয়েছে কি না চেক করে। না এখনো হয় নি! সে আবার ওভেনে দিয়ে আটকে দেয়। পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ভেবেছিলাম দুজনকে একসাথে সারপ্রাইজ দিবো! কিন্তু আপনি জেনে গেলেন রানিসাহেবান!”
পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে । অরুণ হঠাৎ করে এগিয়ে আসে। পাতার কোমড়ে হাত রেখে কেবিনেটের উপর বসিয়ে দেয়। এখন দুজনের উচ্চতা ঠিক ঠিক। অরুণ দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয় নিমিষেই। মিলিত হয় অধরযুগল। বেপরোয়া অরুণের হাত থেমে নেই। ছুঁয়ে দেয় যত্রতত্র। বিড়াল শাবক পিটপিট করে তাকিয়ে অবলোকনে করে সব। মিয়াও মিয়াও বলে কেবিনেটের উপরে উঠে গা ছড়িয়ে বসে চেয়ে থাকে পলকহীন। অরুণ অধর ছেড়ে গলায় মুখ গুঁজে দেয়। আলতো কামড়ে চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকে। পাতা চোখ বুজে নিয়েছে আদিতেই। লোকটার স্পর্শ তার কাছে নতুন নয়। তবে প্রতিবার যেন তনমন জুড়ে শিহরণ জাগিয়ে দেয়। মাতাল মাতাল লাগে নিজেকে। অরুণ যেন ভুলে যায় তাদের অবস্থান। মেতে ওঠে উন্মাদনায়। আঁচল খসে পড়ে। পাতা এবার ছটফট করে ওঠে। লোকটা কি শুরু করে দিয়েছে কিচেনে। সে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। অরুণ বিরক্ত হয়ে শক্ত কামড় বসিয়ে দেয় বক্ষ বিভাজনে। ব্যাথায় পাতা মুখ কুঁচকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।
পাতা বাহার পর্ব ৪১
-” রাক্ষুসে লোক!”
অরুণের চোখে মুখে আকাশসমান বিরক্ত এসে ভিড় করে নিমিষেই। আচ্ছা খাচ্ছা মুডের বারোটা বাজিয়ে দিল মেয়েটা! অরুণ ঘারে হাত রেখে মাথা বাকায়। এগিয়ে আসবে; পাতা কেবিনেট থেকে নেমে দৌড়ে কিচেন থেকে চলে যায়। এই লোক মহা অসভ্য। সভ্যতার লেশটুকুও নেই এর মাঝে। নাক উঁচু অসভ্য ম্যানারলেস লোক!