পাতা বাহার পর্ব ৪৩

পাতা বাহার পর্ব ৪৩
বেলা শেখ 

ভালোবেসে বাড়িতে কুকুর পোষেন অনেকেই। আবার নিত্যদিনের চলার পথেও কুকুরের দেখা মেলে হরহামেশাই। প্রভুভক্ত হিসেবে খ্যাত বেশিরভাগই কুকুরের শরীরেই রয়েছে র‌্যাবিস ভাইরাস। র‌্যাবিস আক্রান্ত কুকুরের কামড় বা আঁচড়ে হতে পারে জলাতঙ্ক।

কুকুর হচ্ছে রেবিড অ্যানিমেল। বিড়াল, শিয়াল, অন্যান্য হিংস্র বণ্যপ্রাণী এবং বাদুড় এগুলো সবই রেবিড অ্যানিমেল। রেবিড অ্যানিমেল কামড় বা আঁচড় দিলে জলাতঙ্ক রোগ হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে র‌্যাবিস আক্রান্ত কুকুর কামড় দিলে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে।
তবে কুকুর কামড় দিলেই যে জলাতঙ্ক রোগ হবে তা কিন্তু ঠিক নয়, কুকুরের মধ্যে জলাতঙ্কের জীবাণু থাকতে হবে। র‌্যাবিস ভাইরাসে আক্রান্ত কুকুরের লালা থেকে ভাইরাসটি ছড়ায়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কুকুরের লালা যদি কামড়, আঁচড় বা শরীরের ক্ষতস্থানের সংস্পর্শে আসে আর লালার মধ্যে যদি র‌্যাবিস ভাইরাস থাকে তাহলেই জলাতঙ্ক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেহেতু কুকুর রেবিড প্রাণী, সেহেতু তার মধ্যে র‌্যাবিস ভাইরাস থাকতেই পারে। তাই কুকুর কামড় দিলে ঝুঁকি না নিয়ে অবশ্যই দেরি না করে জলাতঙ্কের টিকা নিতে হবে।
জলাতঙ্কের ইনকিউবেশন পিরিয়ড থাকে অর্থাৎ কুকুরের কামড়ের কারণে র‌্যাবিস ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পর লক্ষণ বা উপসর্গের বিকাশে যে সময় লাগে সেটি এক বছর পর্যন্তও হতে পারে। তবে সাধারণভাবে এই সময়কাল ৩ মাস ধরা হয়। অনেক সময় ইনকিউবেশন পিরিয়ড ক্ষতস্থান কোথায় তার ওপর নির্ভর করে। কুকুরের কামড় বা আঁচড় যদি ঘাড় বা মাথায় হয় তাহলে ইনকিউবেশন পিরিয়ড কমে আসবে। সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের যত কাছাকাছি কামড় বা আঁচড় দিবে তত তার ইনকিউবেশন পিরিয়ড হ্রাস-বৃদ্ধি হবে।

জলাতঙ্ক রোগ হলে প্রথম যে লক্ষণ দেখা দেয় সেটি হলো হাইড্রোফোবিয়া মানে পানি ভীতি দেখা দেয়। রোগী পানি খেতে পারেনা। পরবর্তীতে অন্যান্য লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে। এরোফোবিয়া দেখা দেয় যার কারণে রোগী বাতাস সহ্য করতে পারেনা। আলোও সহ্য করতে পারেনা, অস্বাভাবিক আচরণ করে, মস্তিষ্কের প্রদাহ দেখা দেয়, রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়।
কুকুর কামড়ালে বা আঁচড় কাটলে করণীয়:

কুকুর কামড় দিলে বা আঁচড় কাটলে যদি কোন ধরনের ক্ষত তৈরি হয় তাহলে ক্ষতস্থান তাৎক্ষণিকভাবে ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় নিয়ে কাপড় ধোয়ার ক্ষারযুক্ত সাবান দিয়ে ফেনা উঠিয়ে ধুতে হবে। আতঙ্কিত হওয়া যাবে না, কুকুরের কামড় বা আঁচড় দেয়ার ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যে অবশ্যই টিকা নিতে হবে।
ক্ষতস্থানের ক্যাটাগরি:

কুকুরের কামড় বা আঁচড়ের ফলে সৃষ্ট ক্ষতস্থানকে ৩টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। যেমন-
ক্যাটাগরি ১: শরীরে যেখানে কোনো ক্ষতস্থান থাকে না। কুকুরের সংস্পর্শে আসা, কুকুরকে খাওয়ানোর সময়, আদরের সময় লালা লেগে গেছে কিন্তু কোনো কামড় বা আঁচড় হয়নি বা কোনো ক্ষতস্থানে লালা লাগেনি সেক্ষেত্রে এটি ক্যাটাগরি ১। এর জন্য টিকা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। জায়গাগুলো সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললেই হবে।
ক্যাটাগরি ২: এক্ষেত্রে কুকুরের কামড় বা আঁচড়ের ফলে শরীরে ক্ষত থাকে, কিন্তু রক্তপাত হয় না। এর জন্য অ্যান্টি র‌্যাবিস ভ্যাকসিন (এআরভি) নিতে হবে।

ক্যাটাগরি ৩: এক্ষেত্রে শরীরে ক্ষত থাকে এবং রক্তপাত হয়। এ ছাড়া মাথায়, বুকে বা ঘাড়ে কুকুরের কামড় বা আঁচড়ে রক্তপাত হোক বা না হোক, সেটিকে ক্যাটাগরি ৩ ধরা হয়। কারণ এই জায়গাগুলো মস্তিষ্কের একদম কাছাকাছি। র‌্যাবিস ভাইরাসটি মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে প্রদাহ সৃষ্টি করে ফলে মৃত্যু হয়। এক্ষেত্রে রোগীকে জলাতঙ্কের টিকা নিতে হবে। বিশেষ করে ক্যাটাগরি ৩ বাইটের জন্য অ্যান্টি র‌্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন (আরআইজি) ইনজেকশনও নিতে হবে।
জলাতঙ্ক শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য, আবার শতভাগ প্রাণঘাতী। র‌্যাবিস আক্রান্ত কুকুর কামড় বা আঁচড় দিলে সঙ্গে সঙ্গে টিকা নিলে জলাতঙ্ক শতভাগ প্রতিরোধ করা যাবে। আর তা না হলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই শুধু টিকার মাধ্যমেই সুরক্ষা সম্ভব।

হাসপাতালের এক কেবিনের বেডে বসে আছে অরুণ সরকার। কোলে তার কলিজা। পাতা কেবিনের অপর বেডে বসে আছে। চোখ মুখ তার ফুলে লাল হয়ে আছে। অস্বাভাবিক রকম শান্ত হয়ে আছে পাতার মুখশ্রী। শান্ত নজর বাবা ছেলের উপর নিবদ্ধ। ঘুমন্ত জখমি ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে আছে লোকটা। সেই যে পাতার কাছ থেকে কোলে নিয়েছে এপর্যন্ত কোল ছাড়া করে নি। হাসপাতালে এসেই যেন সব মাথায় তুলে নিয়েছিল। চিল্লাফাল্লাতে পুরো হাসপাতালের মানুষজনের বিরক্তের কারণ হয়েছে সে। ডাক্তারদের তো মাথায় উঠে যেন নেচেছে। ছাড় পায় নি ফিমেল ডাক্তারও। এক ফিমেল ডাক্তার তো সেইরকম রেগে যায়। অরুণের সাথে তর্কে বিতর্কে বেশ কথা আগায়। পাতা ও শুভ ব্যাপারটাকে সমঝোতার মাধ্যমে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসে।

অরুণ একদন্ডের জন্যও ছেলেকে ছাড়বে না। এমনকি ডাক্তাররা অরুণের কোলেই ভোরকে রেখে তার চিকিৎসা করেছে। ভোর এখন মোটামুটি সুস্থ। হাতে আর পায়ে চার জায়গায় কুকুর দাঁত বসিয়েছে তবে মাংস তুলে নেয় নি। জিন্সের প্যান্ট হওয়ায় কুকুরের দল খুব একটা সুবিধা পায় নি। কোমড়ে এক জায়গায় নখ বসিয়েছে হিংস্র ভাবে। সেখান থেকেই বেশি রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। আর পা থেকে বুক অবধি বেশ জায়গায় আঁচড়ের চিহ্ন। ডাক্তাররা পাতাকে আলাদা কেবিনে নিয়ে তারও চিকিৎসা করে।

পাতার পায়ে ও পেটে দাঁত বসিয়ে আঁচড় কেটেছে গভীর ভাবে। হাতেও আঁচড় লেগেছে। ডাক্তার পাতার কাছে ইন ডিটেইলস কুকুরের বর্ননা নিয়েছে। পাতা শান্তভাবে সব খুলে বলেছে। এতে ডাক্তার ধারনা করে কুকুরটি সুস্থ হবে। কোনো জলাতঙ্ক বা ভাইরাসে আক্রান্ত নয়। আর এটাও বুঝতে পারে কুকুর দুটো আর কুকুরের দলের মতো স্বাভাবিক মোটেই না। কুকুর গুলো লম্বা, পরিষ্কার, মাংসল সাথে বেশ হিংস্র। তাঁরা ধারনা করে এগুলো ট্রেইনিং প্রাপ্ত কুকুর। বিভিন্ন সুরক্ষা কর্মীরা কুকুর ট্রেইনার দিয়ে ট্রেইনিং করিয়ে আর্ম বা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। পাতার বর্ননা শুনে তাঁরা শুভ কাছে সব খুলে বলে। শুভ সব শুনে বেশ চিন্তায় পড়ে তবে অরুণের কাছে ব্যাপারটা চেপে যায়। শালা এমনি ক্ষেপে আছে! এসব শুনলে কি করবে তা সবার ভাবনার বাইরে।

অরুণ ছেলের ব্যাথায় কাতর ঘুমন্ত মুখটার দিকে পলকহীন তাকিয়ে। ছেলেটাকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। তবেই না তার কলিজাটা ঘুমুচ্ছে। ডাক্তার ভোরের পুরো শরীর বেশ সময় নিয়ে স্যাভলন পানি দিয়ে পরিষ্কার করেছে। ছেলেটা গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করে কেঁদেছে।
~আব্বু ব্যাথা! কষ্ট হচ্ছে! আমি মরে যাবো আব্বু!

বলে চিৎকার করেছে। ছেলের সাথে অরুণের কান্নার করুণ শব্দে সবাই মূক বনে গেছে। এ কেমন বেদনাদায়ক দৃশ্য! ড্রেসিং করানোর আগে ডাক্তার হাল্কা ডোজের ঘুমন্ত ইনজেকশন পুশ করে। এতেও অরুণ সরকারের ঘোর আপত্তি ছিল! তার ছেলে এমনি ব্যাথায় কাহিল তার উপর ইনজেকশন? শুভ অরুণকে সামলাতে গেলে বেচারা এক থাপ্পড় খেয়ে ফিরে এসেছে। তবে ডাক্তার হাল ছাড়ে নি। এসব তাদের কাছে ডালভাতের মতোন। কৌশলে অরুণের অগোচরেই পুশ করে। বোঝায় এভাবে ড্রেসিং করলে ছেলেটা কষ্ট পাবে। ভোর ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে সাথে অরুণ সরকার শান্ত হয়ে আসে। ড্রেসিং করানোর পর কেবিনে শিফট করেছে। সেখানেই বসে আছে তাঁরা। অরুণ একটু পর পর ছেলের মুখে চুমু খায়।

গা থেকে চাদরটা সরিয়ে জখমে ফুঁ দিয়ে আবার ঢেকে নেয়। বিড়বিড় করে দোয়া দরুদ পাঠ করে ছেলেকে ফুঁ দেয়। তার ভেজা চোখ শুকায় না। অরুণ ঢোক গিলে পাশে তাকায়। পাতার চোখে চোখ পড়তেই দু’জনেই নজর লুকানোর চেষ্টা করে। আড়চোখে চাইলে আবার নয়নে নয়নে মিলন ঘটে। দুজনেই বেশ অপ্রস্তুত হয়। পাতা দরজার দিকে নজর ফেরায় আর তাকায় না এদিকে। অরুণ একটু পর পরই পাতার দিকে চায়। তবে চোখের দিকে না। হাতের আঁচড়! পিংক কালারের লেডিস জিন্স গুটিয়ে রেখেছে। সেখানে ব্যান্ডেজ। পরনের লং কুর্তির পেটের দিকটার ছিঁড়ে যাওয়া অংশ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সাদা ব্যান্ডেজ। অরুণের দম যেন বন্ধ হবার উপক্রম হয়। হা করে শ্বাস টানে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে। আঁখি যুগলে ভরে ওঠে আবার। গড়িয়ে পড়বে অরুণ ছেলের গলায় মুখ গুঁজে দেয়। চাদড়ে চোখ মুখ মুছে নেয়। বুকটা অনুতাপের অনলে পোড়ে দাউদাউ করে।

এরমধ্যে শুভসহ অরুণের বন্ধুরা প্রবেশ করে। অরুণ মাথা তুলে তাদের দিকে তাকালো। ফয়সাল এসে অরুণের পাশে বসে কাঁধে হাত রাখে। কি বলে সান্ত্বনা দেবে একে? সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই তার কাছে। সে অরুণের মনের অবস্থা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফয়সাল বলে,
-” সিনক্রিয়েট মোটেও করবি না। ডাক্তার আসছে! ভোরকে..”
-” কি?”

-” ভ্যাক্সিন দিবে দুইজনকেই! পাঁচ ডোজের। আজ দিবে এরপর তিনদিন পর! তার পর ক্রমান্বয়ে সাত, চৌদ্দ, আটাশ তম দিনে! সাথে আর আই জি ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইনজেকশন পুশ করবে।”
অরুণের মুখের রঙ উড়ে যায়। যেন টিকা তাকেই দেওয়া হবে। তাকে দিলে হয়তো মুখটা এমন হতো না। তার মানিক টাকে দিবে। এই অসুস্থ শরীরে এতো গুলো ইনজেকশন?
অরুণ ঘন ঘন শ্বাস ফেলে বলে,

-” আজ থাক। ছেলেটা আর সহ্য করতে পারবে না। কাল দিলে..”
শুভ তেড়ে আসে। আঙুল উঁচিয়ে শাসিয়ে বলে,
-” তুই তোর মুখ বন্ধ রাখ! নইলে একটা মারও জমিনে পড়বে না। শালা সার্কাস বানিয়ে রেখেছে! দে ভোরকে?”
অরুণের কোল থেকে ভোরকে নেওয়ার চেষ্টা করে। অরুণ দেয় না। এরমধ্যে ডাক্তার নাজনীন চলে আসে। অরুণ তাকে দেখে গম্ভীর মুখে বলে,
-” দেখুন ডক্টর আমার..”
-” একদম চুপ! এই বদমেজাজি লোক এখানে কেন? এটাকে সরিয়ে নিয়ে যান! একে দেখলেই আমার রাগ লাগছে!”

ডাঃ নাজনীন এমনভাবে বললেন যেন অরুণ কোনো পাগল। পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে এসেছে। অরুণ মুখটা অসম্ভব রকমের গম্ভীর হয়ে যায়। এই মহিলা আবার?
পাতা উঠে আসে। ডঃ নাজনীনের সাথেই তখন অরুণের তর্ক লেগেছিল! শুভ অরুণের কোল থেকে ভোরকে নিতে চায় অরুণ নাছোড়বান্দা! সে দেবে না। ডাঃ নাজনীন পাতাকে ইশারা করে। পাতা শুভকে ইশারায় কিছু বলে। অরুণের কোল থেকে সাবধানে ভোরকে টেনে নেয় নিজের কাছে। অরুণ বাঁধা দেয় না। পাতার কাছে দিয়ে চুপচাপ তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। শুভ ও ফয়সাল অরুণকে জাপটে ধরে নিয়ে যায় কেবিন থেকে। ডাঃ নাজনীন হেসে দরজা বন্ধ করে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,

-” এই পাগলকে কিভাবে সামলান মিসেস পাতা? পুরাই বদমেজাজি! একরোখা নাছোড়বান্দা!”
পাতা ঠোঁটে হাসি ফুটতে চায় না তবুও ঠোঁটের আগায় সৌজন্য মুলক হাসি ফুটে ওঠে।
-” আমি বসছি! আপনি আগে আমাকে দিন! আগে ওকে দিলে উঠে যাবে। তখন সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে!”
-” ঠিক আছে।”
ডাঃ নাজনীন পাতার মাংসপেশীতে ইনজেকশন পুশ করে। এরপর ভোরের। এবার ভোর চোখ খোলে বড় বড় করে। খুলেই আব্বু বলে হাঁউমাঁউ করে কান্না শুরু করে। ডাঃ নাজনীন অনেক কষ্টে বাকি ইনজেকশন দেয়। ভোর আরো জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। ইনজেকশন দেয়া জায়গায় পাতা আলতোভাবে তুলো ঘঁষে আদুরে গলায় বলে,
-‘ বাবা কিছু হয় নি! ঠিক হয়ে যাবে। আম্মু আছে না! কাঁদে না কলিজা! এই যে আম্মুর দিকে তাকাও দেখি? দেখি তাকাও?”

ভোর কাঁদতে কাঁদতে পাতার দিকে তাকায়। পাতার তার কপালে চুমু দিয়ে বুকে জড়িয়ে নেয়।
-” ভোর সোনা অনেক স্ট্রং তাই না? কাঁদে না বাবা ‌ একটু সময় নাও সব ঠিক হয়ে যাবে!”
ভোর পাতার বুকে মুখ গুঁজে ফোপাতে ফোপাতে বলে,
-” পঁচা ডাক্তার ব্যাথা দিয়েছে আম্মু!”
-” তাই? ডাক্তারকে আমরা গণধোলাই খাওয়াবো। কতবড় সাহস আমার ছেলেকে ব্যাথা দেয়! তুমি একটু শান্ত হও বাবা?”

ভোর শান্ত হয়ে আসে। তবে তার ফোপানো বন্ধ হয় না। পাতা তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে গালে চুমু দেয়। ভোর পুরোপুরি শান্ত হয়ে যায়। পাতার বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে শান্ত ভদ্র বাচ্চার মতো চেয়ে থাকে পাতার দিকে। আড়চোখে ডাক্তারের দিকেও চায়। পাতার বুকে পুনরায় মুখ গুঁজে বলে,
-” আম্মু এই পঁচা ডাক্তার কে যেতে বলো! কিভাবে দেখছে আমাকে!”
ছেলেটার পরনে শুধু ছোট হাফপ্যান্ট। পাতা পাশ থেকে চাদর নিয়ে ঢেকে দেয় গা। ছেলেটার এতো লজ্জা! ডাঃ নাজনীন হেসে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” ভোর লজ্জা পাচ্ছে বুঝি? আচ্ছা আমি পঁচা ডাক্তার চলে যাচ্ছি! মিসেস পাতা আপনার ছেলেটা ভারী কিউট! একদম আপনার মতোই। ভাগ্যিস বাপের মতো হয় নি।”
পাতা মুচকি হাসলো। ডাঃ নাজনীন আবার বলে,

-” আপনি খুবই ভালোভাবে বাচ্চা সামলাতে পারেন! আমার একটা মেয়ে আছে এরচেয়ে একটু ছোট। কি দুষ্টু আর কি চঞ্চল। একটুও আমার কথা শুনবে না। যা বলবো তার উল্টো টা করবে!”
-” আমার ছেলেও চঞ্চল! তবে মোটেও দুষ্টু নয়। হিরের টুকরো ছেলে আমার।”
-” আচ্ছা আমি যাচ্ছি। আপনাদের কাল সকালে রিলিজ দেওয়া হবে। রাতটা এখানেই ম্যানেজ করবেন। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে ফোন করবেন এনি টাইম। আসছি!”

বলে দরজা খোলে। অরুণ দরজা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে ছিল। ডক্টরকে দেখে কটমট করে চায়। তার ছেলেটা কাঁদছিল সে স্পষ্ট শুনছে। ডাক্তাররা আসলেই নির্দয় হয়। তার জখমি ছেলেকে ইনজেকশন দিয়ে ব্যাথা দিলো! ডাঃ নাজনীন অরুণের দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হনহন করে চলে গেলো! অরুণ হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে।
ভোর পাতার কাঁধ গলিয়ে উঁকি দেয়। অরুণ ছেলের কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখে।
-” আব্বু ব্যাথা পেয়েছিলে?”

বলতে বলতেই ঝরঝর করে কেঁদে দেয় যেন কোনো বাচ্চা ছেলে। পাতা ঘুরে বসে গোল গোল করে চায়। শুভ ফয়সাল সহ বাকিরা হতাশ হয়ে অপর বেডে বসে পড়লো। ভোর বাবার কান্না দেখে ঠোঁট উল্টায়! পাতা লক্ষন বুঝতে পেরে ভোরের গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” ভোর তুমি না স্ট্রং বয়। একদম কাঁদবে না। স্যার? আপনার বন্ধুকে চুপ করতে বলুন!”
শুভর উদ্দেশ্য শক্ত গলায় বলে। অরুণ দু হাতে নাক মুখ মুছে ওয়াশ রুমে যায়। ভোর আর কান্না করে না। অরুণ একটু পর ফিরে আসে ভেজা মুখে। পাতার পাশে বেডে পা তুলে উঠে বসে। আস্তে আস্তে হাত বাড়ায় পাতার ওড়নার উদ্দেশ্যে; ভেজা মুখটা মুছবে। কিন্তু হাত এগোয় না। জড়তা এসে ভিড় করে। এরমধ্যে পাতা পাশে তাকায় অরুণ ঝট করে হাত গুটিয়ে নেয়।

-” আম্মু? বাড়ি যাবো না?”
-” না বাবা। আজ আমরা এখানেই থাকবো!”
ভোরের মন খারাপ হয়। আজ না তার বার্থডে? কেক কাটা হবে না? সব বন্ধুদের সাথে খেলা হবে না? মজাও হবে না। সে গোমড়া মুখে বলে,
-” আজ না আমার বার্থডে? কেক কাটবো না?”
কি জবাব দেবে পাতা? কি বলেই বা সান্ত্বনা দিবে! পাতা ঝুঁকে কোলে মাথা রাখা ভোরের কপালে চুমু দেয়। কিছু বলবে এর আগে অরুণ বলে,

-” আব্বু আমরা এখানেই কাটবো কেক! আমি অর্ডার করছি!”
বলে ফোন বের করে বিছানা থেকে নামল। ভোর তার হাত দেখে। ব্যান্ডেজ করা। আঁচড়ের দাগ লাল হয়ে ফুলে গেছে। সে নাক টেনে বলে,
-” আব্বু আমি কাটবো না কেক! আমার হাতে ব্যাথা করে!”
অরুণের বুকটা খা খা করে। কান্নায় গলা জড়িয়ে আসে। সে আর ফোন করে না। ছেলের হাত আস্তে ধরে ছোট ছোট চুমু দেয়। পাতা ভোরের হাতটা আলগোছে ছাড়িয়ে গম্ভীর মুখে বলে,
-” ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে ডাক্তার।”

অরুণ আড়চোখে পাতার দিকে তাকিয়ে সরে আসে কিছু বলে না। তবে তার ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে তুলে বুকে জড়িয়ে নিতে। কিন্তু সাহস হয় না ওই কোল থেকে উঠিয়ে নিতে। আশ্চর্য সে কি ভয় করছে পাতাবাহারকে? অরুণ বন্ধুদের পাশে গিয়ে বসে। ফয়সাল জীবন মুখে হাত দিয়ে আছে। অরুণ এখানে বসায় তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
-” ভাই এইজন্যই বলে ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। এখন বোঝো মজা!”
ফয়সাল কন্ঠ আরেকটু খাদে নামিয়ে বলে,
-” তখন আবেগের ঠেলায় মেরে দিলি থাপ্পড়! বাঘের মতো গর্জে উঠছিলা মাম্মা! এখন বিড়ালের মতো মিও মিও করো কেন? কি পাওয়ার ফুস?”

বলেই কিটকিটিয়ে হেসে ওঠে দু’জন। অরুণ চোখ রাঙায়। দু’জন পরিস্থিতি বিবেচনা করে চুপ করে। তবে এইরকম পরিস্থিতিতেও তাদের অধরে হাসি যেন থামে না। তাই বেড়িয়ে যায় কেবিন থেকে। শুভ গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। পাতার কাছে গিয়ে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” ভোর বাবা এখন কেমন লাগছে? বেশি ব্যাথা করছে?”
ভোর পিটপিট করে চায়। বিড়বিড় করে উত্তর দেয়,

-” একটু একটু ব্যাথা করছে। ভালো লাগছে না।”
সহজ সরল জবাব। পাতার চোখ আবারো ভরে ওঠে। ইশ্ যদি একজনের ব্যাথা আরেকজনের ভিতর ট্রান্সফার করা যেতো! শুভ তার গালে হাত রেখে বলে,
-” সব ঠিক হয়ে যাবে।”

বলে সেও বেড়িয়ে যায়! কেবিনে ওরা তিনজন! পাতা অরুণ ও ভোর! ডাবল বেডের কেবিন এটা। ঘরের দুই প্রান্তে দুই বেডে দু জন বসে আছে। পাতা ভোরের মাথা কোলে নিয়ে বেডে হেলান দিয়ে বসে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অপর বেডে অরুণ চুপচাপ বসে। দৃষ্টি পাতাতেই। সে ভাবে কথা বলে সব ঠিক করে নেবে এভাবে আর থাকা যাচ্ছে না। সে রাগে আবেগের বশে হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে থাপ্পড় মেরে খুব বড় অপরাধ করেছে। সে স্বীকার করে। মেয়েটা নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেয়েছে। পাবে না? মেয়েটার যে কোনো দোষ নেই। বরং তার ছেলেকে বাঁচাতে নিজের ব্যাপারেও একবার ভাবে নি। ঝাপিয়ে পড়েছিল। শুধু একটা শুকনো স্যরি বললেই ব্যাপারটা মিমাংসা হবে না।

তবে কিছুটা হলেও তার অনুতাপ বোধ কমে যাবে। সে উঠে আসে। গলা খাঁকারি দেয় কিছু বলবে এর আগে দরজায় নক করে কেউ। ভিতরে প্রবেশ করে আসমা বেগম, আদুরি, আরিয়ান, লতা , লাবনী আক্তার, লাবিব ও আতিকুর ইসলাম। অরুণের আর কিছু বলা হয় না। পুরো কেবিন লোক সমাগমে ভরে যায়। সবাই ভোরের সাথে টুকটাক কথা বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ছলছল চোখে। লতাও তার ব্যাতিক্রম নয়। সে ভোরের সাথে কথা বলে পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” তুই ও তো অসুস্থ! রেস্ট করা প্রয়োজন! এককাজ কর তুই আমাদের সাথে বাড়ি চল! ভোরের খেয়াল রাখার জন্য তার বাবা আছে। নিজের ছেলের খেয়াল আশা করি সে খুব ভালো ভাবেই করতে পারবে। তুই নিজেই অসুস্থ হয়ে আরেকজনের খেয়াল রাখবি যদি এদিক সেদিক হয় তাহলে তো আবার থাপ্পড় জুটবে।”
স্পষ্ট ও ভদ্র ভাষায় খোঁচা। উপস্থিত সকলেই বুঝতে পারে এ খোঁচার হকদার কে! অরুণ গম্ভীর মুখে পকেটে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লাবনী আক্তার মেয়েকে চোখ রাঙিয়ে চুপ থাকতে বলে। লতা চুপ থাকার মেয়ে মোটেও না। লোকটা তার বোনকে সবার সামনে থাপ্পড় মারবে, ধাক্কা দেবে, চিল্লাচিল্লি করবে আর সে এমনি ছেঁড়ে দেবে?

-” কি হলো? উঠছিস না কেন? উঠ?”
পাতা কিছু বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। ভোর উঠে বসে পাতার গলা জড়িয়ে বলে,
-” আম্মু তুমি গেলে আমিও যাবো!”
পাতা তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” আমি যাবো না!”
লতা ক্ষেপে যায়।
-” কেন? লাত্থি গুঁতা খেতে ভালো লাগে? অপমানিত হয়ে সুখ পাস? উনি সবার সামনে তোকে মারার সাহস কিভাবে পায়? নাকি এসবে অভ্যস্ত তুই?”

অরুণ হনহন করে বেড়িয়ে যায় কেবিন থেকে। পাতা তাঁর যাওয়া দেখে বোনের দিকে তাকিয়ে শক্ত করে বলে,
-” আপু? এটা হসপিটাল! আর বাচ্চার সামনে কিসব বলছো? আমি যাবো না তোমরা যাও! এটা আমাদের পার্সোনাল ব্যাপার আমরা মিটিয়ে নিবো!”
-” কাকে কি বলছি আমি! তোর তো আত্মসম্মানবোধটাই নেই! বাঙালি বউ! হাসবেন্ডের শত খুন মাফ!..”
ভোরের চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। পাতা ঠাহর করতে পারে। ছেলেকে বুকের সাথে আরেকটু সেঁটে নিয়ে বলে,

-” এখন আত্মসম্মানবোধ নেই তো কি করবো? জন্ম হওয়ার আগেই যার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে সে কিভাবে দাঁড়াবে? তিন বেলা খাওয়ার খোঁটা শোনার পরেও ক্ষুধা নামক মহামারির কাছে হেরে ভাতের থাল নিয়ে বসতে হয়েছে তার আবার কিসের আত্মসম্মানবোধ আপু?”
উপস্থিত সবাই বাকহারা। লতা মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। আতিকুর ইসলাম আস্তে করে বেড়িয়ে আসে। কোন মুখে দাঁড়িয়ে থাকবে ওখানে? আসমা বেগম, আদুরি, আরিয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। লাবনী আক্তার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে পাতার মাথায় হাত রেখে বেড়িয়ে যায় কেবিন থেকে। লতা বোনের হাত মুঠোয় ভরে বলে,

-” পাতু তোর এই বড়বোন সবসময় তোর সাথে আছে। আসছি ভালো থাকিস।”
সেও চলে যায় লাবিবকে নিয়ে। পরিবেশ থমথমে। ভোর ফোপাচ্ছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। পাতা তাকে বালিশে শুইয়ে দেয়। আসমা বেগম একটা ব্যাগ পাতার দিকে বাড়িয়ে বলে,
-” এতে ড্রেস আছে তোমার আর অরুণের। চেঞ্জ করে নাও! আর ওই ব্যাগে খাবার আছে।”
পাতা ব্যাগটা নেয়! সত্যিই চেঞ্জ করা প্রয়োজন। তার কুর্তিটা ছিঁড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। ওড়নার অবস্থাও নাজুক! সে বেড থেকে নামবে ভোর তাঁর ওড়না টেনে ধরে বলে,

-” আম্মু তুমি চলে যাবে না তো?”
-” না বাবা। চেঞ্জ করে আসছি। আদুরি ওর কাছে বসো তো?”
পাতার কথায় আদুরি ভোরের শিয়রে বসে। আসমা বেগমও তাঁর কাছে বসে টুকটাক কথা বলে। পাতা ওয়াশ রুমে যাবে এরমধ্যে বাইরে থেকে কেমন গন্ডগোলের আভাস আসে। উঁচু গলায় আওয়াজ শোনা যায়। পাতার বুকটা ধ্বক করে ওঠে। লতা আপু আবার ওনার সাথে কথাকাটাকাটি করছে না তো?
পাতা ব্যাগটা রেখে দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়। তাঁর পিছনে আরিয়ানও বেড়িয়ে আসে।

-” কিসের গন্ডগোল শোনা যায়?”
আরিয়ানের কথায় পাতা বিরক্ত হয়ে বলে,
-” আপনি যেখানে আমিও সেখানে কিভাবে বলবো?”
আরিয়ান বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যায়। পাতা পিছনে। তাদের কেবিনের চার কেবিন পরের কেবিনে দুটো লোক টাকা নিয়ে ঝগড়া করছে উঁচু গলায়। পাতা আরিয়ান স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে ব্যাক করে।
-” আমি ভেবেছিলাম ভাই তোমার বোনের সাথে ঝগড়া করছে!”
-” আমিও!”

বলেই পাতা আরিয়ানের দিকে তাকায়। আরিয়ানও চায়। হঠাৎ দুজন হেসে উঠলো শব্দ করে।
অরুণ গম্ভীর মুখে এগিয়ে আসছে। হাতে কিছু ফলফলাদি, আইসক্রিম, কেক, পানির বোতল সহ আরো কিছু জিনিস। তার সাথে তার বন্ধুরা। সবাই মিলে অরুণকে লেগপুল করছে। অরুণ কিছু বলছে না দেখে যারা আরো আস্কারা পেয়ে বসে। অরুণ বিরক্ত হয়। তার মন মেজাজ বিক্ষুব্ধ! এখন লেগপুল করার মতো পরিস্থিতি আছে? কিন্তু এই বন্ধু নামক আজব প্রাণী দের এটা কে বোঝাবে!!এরইমধ্যে হঠাৎ দেখে লতা লাবিবের হাত ধরে হনহন করে আসছে।অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। শুভ লতার উদ্দেশ্যে বলে,

-” কোথায় যাচ্ছো এমন করে? আন্টি আঙ্কেল কই?”
লতা‌ জবাব দেয় না। থমথমে মুখে হাঁটতে হাঁটতে তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। রাসেল কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-” এর আবার কি হলো?”
অরুণও জবাব দেয় না । হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। লেফট টার্ন নিতেই চোখে পড়ে পাতা ও আরিয়ানকে। অরুণ বড় বড় পা ফেলে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-” এখানে তোরা? কি হয়েছে?”
-” ওদিকে দুটো লোক ঝগড়া করছে কিছু নিয়ে। তোমার আম পাতা জোড়া জোড়া ভেবেছে তার বোনের সাথে লেগেছে তোমার!”

আরিয়ান হেসে বলে। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে।এদের কি কমন সেন্সের অভাব? তার ছেলেটা ব্যাথায় কাতরাচ্ছে আর এদিকে এরা হাসছে? তার ছেলের ব্যাথার কাতর মুখটা দেখে মায়া হয় না!! তারা রাইট টার্ন নিয়ে কেবিনের উদ্দেশ্যে হাঁটা দেয়। পাতা পায়ে ও শরীর ব্যাথা হওয়ার দরুন আস্তে হাঁটতে থাকে। অরুণ লক্ষ্য করে হাঁটার গতি কমিয়ে দেয়। পাতার পায়ে পায়ে ধীরে হেঁটে যায়। হঠাৎ অরুণ পাতার বাহু ধরে। পাতা সেটা দেখে ঝটকায় সরিয়ে দেয়। অরুণ হাত পকেট ঢুকিয়ে বলে,

-” সত্যিই অসুস্থ তুমি! রেস্ট প্রয়োজন। লতার সাথে যেতে পারতে!”
এ কথা মোটেই বলতে চায় নি অরুণ। মুখ ফসকেই বেড়িয়ে গেল যেন। পাতার পদযুগল থেমে যায়। অরুণ পাতার হাত ধরে বলে,
-” স্যরি। একদম বলতে চাই নি। চলো পাতাবাহার?”
পাতা আস্তে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উল্টো পথে হাঁটা দেয়। অরুণ এগিয়ে এসে তার বাহু ধরে আটকায়,
-” স্যরি বলছিতো! প্লিজ সিনক্রিয়েট করো না। চলো?”
পাতা ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে অরুণের পেটে হাত রেখে ধাক্কা দেয়। অরুণ পিছিয়ে যায় দুই কদম। পাতা একপ্রকার চিল্লিয়েই বলে,

-” সিনক্রিয়েট করছি আমি? একদম এগোবেন না!”
অরুণ থেমে যায়। শান্ত গলায় বলল,
-” পাতাবাহার কুল! আমি সব দোষ স্বীকার করছি! চলো? ভোর..”
-” আমি গিয়ে কি করবো? আপনার ছেলে! আপনি আছেন তো!”
পাতা শান্ত গলায় বলল। অরুণ এগিয়ে আসে। পাতার হাত ধরে বলে,
-” তোমারও ছেলে! চলো?’
পাতা আবার ধাক্কা দেয়,

-” আমার ছেলে! হ্যাঁ আমার ছেলে।ভোর আম্মু ডাকে আমায়। আমি তার মা! সেটা ভোর মানে! আমি মানি! কিন্তু আপনি অরুণ সরকার মানেন না। আপনার কাছে তো আমি ভোরের আয়ার মতো। শুধু মাসে মাসে বেতন না দিয়ে একটু আকটু যত্ন নেন।”
ইতিমধ্যেই ঘটনাস্থলে মানুষের ভিড় জমে গেছে। শুভ, ফয়সাল রাসেল ও জীবন আগেই উপস্থিত হয়েছে। অরুণের চোয়াল শক্ত হয়। ধমক দিয়ে বলে,
-” বেশি হয়ে যাচ্ছে। ভিতরে চলো?”
পাতা তার চেয়েও গলা উঁচিয়ে বলে,
-” যাবো না আমি কি করবেন? এখন অপমান ফিল হচ্ছে? অপমান বোধ শুধু আপনার আছে আমার নেই? ভোরের কষ্টে শুধু আপনার বুকে ব্যাথা হয় আর কারো না? কথায় কথায় ধমক ঝাড়ি! আরে আমি শালা ভাবি যে ভালোবেসে শাসন করে। ”

হাসে পাতা। চোখের পানি বাঁধ ছেড়ে দিয়েছে। পাতা হাতের উল্টো পিঠে সেটা মুছে নিয়ে বলে,
-” আমি ভোরের আম্মু! আপনি মনে রাখবেন মা হই আমি তাঁর। ছেলের জন্য আমার বুকটাও ধুকপুক করছিলো। শ্বাস আটকে আসছিলো। কিন্তু আফসোস আপনার চোখে পড়ে নি। আপনি একজন স্বার্থপর লোক। আমাকে বলেন ভোরের মা হতে অথচ নিজেই আমাকে তার মা ভাবতে পারেন না।
আমি মানছি আমার আরো খেয়াল রাখা উচিত ছিলো। তবুও আমি আমার সর্বচ্চটা দিয়ে প্রোটেক্ট করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ভাগ্য বলতেও একটা কথা আছে না? এখন যদি আপনি থাকতেন বাড়িতে তারপরও এমন ঘটনা ঘটতো তখন আপনি কার উপর দোষ বর্তাতেন?”

পিনপিন নিরবতা। অরুণের মুখে কথা নেই। চোখ মুখ স্বাভাবিক। যেন আয়নার প্রতিচ্ছবিতে তার দোষ গুলো তুলে ধরা হচ্ছে। শুভ পাতার কাছে আসে। তার মাথায় হাত রেখে বলে,
-” পাতা যথেষ্ট হয়েছে। অরুণ যা ভোরের কাছে। আমি আছি!”
পাতা চোখ মুখে মুছে। শুভ নির্দ্বিধায় তার হাত ধরে নিয়ে যায়। পাতাও বাধ্য মেয়ের মতো তার সাথে হাঁটতে থাকে।
অরুণ তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু পল। তারপর উল্টো ফিরে কেবিনেটের দিকে চলে যায় সুর সুর করে। ফয়সাল জীবন তার পিছু পিছু।

হাসপাতালের পাশে এক চা স্টলে বসে আছে পাতা ও শুভ! একটা অল্পবয়সী ছোকরা দু কাপ চা দিয়ে যায় তাদের হাতে। শুভ চায়ে চুমুক বসিয়ে পাতাকে বলে,
-” খাও? ফ্রেশ লাগবে।”
পাতা ফুঁ দিয়ে চুমুক দেয়। শুভ পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে। হালকা হেসে বলে,
-” তুমি খুব ভালো মেয়ে পাতা!”
পাতা তার দিকে চায়। শুভ সামনে দৃষ্টি রেখে বলে,
-” কিন্তু আমার বন্ধুটা মোটেও ভালো না। সত্যিই ভালো না! তুমিই বলো ভালো?”
পাতা পিটপিট করে চায়। সে কি না বলবে? শুভ পাতার জবাবের আশা না করে বলে,
-” ভাবতে পারো বন্ধুর হয়ে সাফাই গাইছি! বা ইমোশনাল গল্প শুনিয়ে ওর দোষ ঢাকতে চাইছি! তবুও বলবো আমি!”
পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে থাকে। শুভ বলতে থাকে,

-” ওই শালার ট্রাস্ট ইস্যু আছে! কাউকেই সহজে ভরসা করতে পারে না। ভরসা করলেও খুঁত খুঁত স্বভাবের! অরুণের সাথে আমাদের পরিচয় কিশোর বয়স থেকেই। একসাথে থেকেছি, খেলেছি ,মারামারি, বিড়ি, সিগারেট সব। তাই বলে ভাববে না উচ্ছন্নে যাওয়া লোক আমরা। উঠতি বয়সে ফ্যান্টাসিতে ভুগে ওসব টেস্ট করেছি একবার করে। অরুণ খুবই চাপা স্বভাবের। কাউকে কিছু বলবে না। আমাদেরকেও কখনো কিছু বলে নি। ওর মায়ের স্মৃতি খুব একটা মনে নেই ওর। কিন্তু ওর মা’কে খুব ভালোবাসতো! আসমা আন্টি অরুণ কে ভালোই বাসতো! তবে আঙ্কেলের সামনে বেশি বেশি কেয়ার করতো আঙ্কেলের অনুপস্থিতিতে কেয়ার কমে যেত একটু আকটু। ব্যাপারটা অরুণের মনে বেশ দাগ কাটে। তবুও কিছু বলতো না। প্রতিবেশীরা অরুণের সামনে সহানুভূতি দেখালেও আড়ালে আসমা আন্টির কানে বিষ ঢালতো! পরের ছেলে পরই হয়।

সময় হলে কালসাপ হয়ে দংশন করতে দ্বিধাবোধ করবে না। অরুণের নিজ কানে শোনা। থাক সেসব কথা! আরিয়ান এলে অরুণ আসমা আন্টির কেয়ারনেসে বিরাট ফারাক খুঁজে পায়। অরুণ তবুও মেনেই চলতো। আরিয়ানের সাথে পড়তো না। আঙ্কেল বকতো মাঝে মাঝে উত্তম মধ্যম দিতোও। ওই শালা যেন মজা পেত। আঙ্কেল যা বারণ করবে সেদিকেই তার ঝোঁক বেশী। আরিয়ানের সাথে ওর কিছু নিয়ে মারামারি হয় সেদিন আসমা আন্টি অনেক কথা শোনায়। অরুণের সবচেয়ে কানে বেজেছিল তার মরহুম মায়েকে নিয়ে কটুক্তি। ব্যস! অরুণের ভোল ভাল পাল্টাতে শুরু করে। তারপর আমাদের সাথেই থাকতো।

বর্ষার সাথে ওর ভালোই ভাবসাব হয়। আঙ্কেলের কাছে বললে পজিটিভ উত্তর পায়। মাঝে আঙ্কেলের চলে যাওয়া। অরুণ ভেঙে পড়ে সেবার। আসমা আন্টি তখন স্নেহের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। অরুণ লুফে নেয়। বর্ষার সাথে ধুমধাম বিয়ে হয়। ভোর আসে সব ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ শুনি ডিভোর্স নেবে দু’জন। আমরা সবাই অবাক। অরুণ কখনো কিছু বলে নি যে তাদের মধ্যে ঝামেলা হয়। ডিভোর্সের পর টুকটাক কিছু বলে। ভোরকে নিয়ে ও খুবই পসেসিভ। ওর গায়ে একটা পিঁপড়া বসলেও পিঁপড়ার চৌদ্দ গুষ্টির ব্যান্ড বাজিয়ে দিবে। কোলে কোলে রাখতো। নিজে বকবে মারবে ইটস ওকে। অন্য কেউ টোকা দিলে লন্ডভন্ড করে দেবে। ছোটবেলায় মা কে হারানো! তারপর বাবাকে হারানো। ভালোবাসার বিয়ের পর ডিভোর্স। সবমিলিয়ে ও মোটেই স্বাভাবিক নয়।”

পাতা বাহার পর্ব ৪২

থামে শুভ। পাতার দিকে আড়চোখে চায়।
-” আমি ইঞ্জেকশন দেওয়ার কথা বলায় দেখেছো কিভাবে মারলো? ও এমনিই! ছেলের বেলায় হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে অবুঝ বনে যায়। আমি একটুও ওর সাফাই গাইছি না। তুমি ওকে একটু টাইট দিবে। ওর আজকের ব্যবহার খুবই দৃষ্টিকটু ছিলো। মানছি ছেলের এমন অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিল তবুও কাজটা মোটেই ঠিক করে নি।ওকে ওর ভুল বুঝতে হবে। ও অনুতাপে পুড়ুক একটু। তবে তুমি দূরে ঠেলে দিও না। ও স্বার্থপর ঠিক কিন্তু তোমাকে ভালোবাসে। মিছে বলছি না। ট্রাস্ট মি!”

পাতা বাহার পর্ব ৪৩(২)