পাতা বাহার পর্ব ৫
বেলা শেখ
-” কারো হাতে খাব না। তবে পাতা মিসের হাতে খাব । উনি খুব ভালো। কত আদর করে! আব্বু জানো চাচিমনির মতো তার গা থেকেও আম্মু আম্মু গন্ধ আসে! আব্বু পাতা মিস আমার আম্মু হলে ভালো হতো না?”
শুভ খানিকটা ভাবনায় পড়ে যায়। মিস পাতা! নাম টা চেনা চেনা লাগছে। অরুণের গম্ভীর মুখশ্রীতে আরেকটু গাম্ভীর্যতা ভর করে। বাচ্চা একটা মেয়েকে নাকি আরেকটা বাচ্চা মা বানাতে চাইছে। অরুণ ভোরকে একটু ধমকের সুরে বলে,
-” ভোর আজকাল বেশি কথা বলছো! আর কি আম্মু আম্মু শুরু করে দিয়েছো রাত থেকে? বলেছি না আমিই তোমার আব্বু আবার আমিই আম্মু!”
ধমকে ভোর চুপসে যায় নাকের পাটা ফুলে উঠছে। চক্ষুযুগল ছলছল করে মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। শুভ অরুণকে ধমক দিয়ে বলল,
-” বাচ্চা ছেলেটাকে বকছিস কেন? ওর বয়সী বাচ্চারা মায়ের কোলে পড়ে থাকে। কতশত আবদার করে! সেসব দেখলে ওর মনটা খারাপ হয় না? মায়ের আর বাবার ভালোবাসা আলাদা ভাই। ও সবার কাছে মায়ের ভালোবাসা খুঁজে। কিন্তু সবার কাছে তো পায় না। যার কাছে পায় তার কথা বলেছে। আর ওর মিস পাতা..”
অরুণ ওকে থামিয়ে দেয়,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” তুই চুপ থাক। আমার ছেলের জন্য আমিই সব। আর কারো ভালোবাসার প্রয়োজন নেই!”
ভোর বাবার কথা শুনে চোখ মুছে বলে,
-” আব্বু তুমি বলেছিলে আম্মু এনে দিবে! তাহলে?”
অরুণ ছেলের দিকে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলে,
-” আমি বলি নি তোমাকে!”
-” চাচ্চু বলেছিল। তুমি তো মানা করনি। রাতেও মানা করনি! আগে তো কখনো বলি নি আম্মু লাগবে! এখন আমার আম্মু চাই চাই!”
জোরে চিল্লিয়ে বলে উঠল ভোর। অরুণ চোখ গরম করে শাসানোর ভঙ্গিতে বলে,
-” এই গলার আওয়াজ নিচে। অভদ্র হচ্ছো সাথে বেয়াদবি শিখছো!আমি কিন্তু বেয়াদবি একদম সহ্য করবো না! এটা আমার কর্মক্ষেত্র।”
ভোর কিছু বলে না। চোখ ডলতে ডলতে কান্না করে দেয় অল্প শব্দে। এই অল্প সময়ে সে কত স্বপ্ন বুনিয়ে ছিল মাকে নিয়ে! বন্ধু রোহানকে বলেছে বাবা তার জন্য আম্মু নিয়ে আসবে! আম্মু এলে তার সাথে কি কি করবে ! খেলবে! আম্মুর কোলে শুয়ে শুয়ে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমাবে। আম্মুর হাতে ভাত খাবে! তাঁকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে যাবে তার সব বন্ধুদের মায়ের মতো! স্কুল শেষে আইসক্রিম খাওয়ার বায়না করবে! আম্মু তাকে বকবে ! তাকে গোসল করিয়ে দেবে!তাকে অনেক অনেক আদর করবে!!আরো কতশত বায়না করবে! অথচ এখন আব্বু!!
ছেলের কান্না দেখে অরুণের বুকটা হু হু করে উঠে। ইশ ছেলেটা আম্মুকে নিয়ে না জানি কত স্বপ্ন বুনে রেখেছে একবেলায়।
শুভ অরুণকে চোখ দিয়ে শাসিয়ে ভোরকে নিজের কোলে নিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে আদুরে গলায় বলে,
-” ভোর বাবা দেখি কাঁদে না? তুমি না গুড বয়! অরুণকে বকে দেব আমি! এই অরুণ এই পেপার ওয়েট দিয়ে এমন জোড়ে মারবো মাথায় আলু গজাবে! বাবাকে বকা হচ্ছে হুম? আর তুমি কান্না থামাও! অরুণ তোমার জন্য আম্মু আনবে অতি শিঘ্রই! খুব ভালো আম্মু আনবে একদম তোমার পছন্দের পাতা মিসের মতো! ঠিকাছে?”
ভোর মাথা নাড়ে। কান্নার শব্দ কমলেও চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে কপোল বেঁয়ে।নাক টেনে ক্রন্দনরত গলায় বলে,
-” হুম ! তবে পাতা মিস হলে অনেক ভালো হবে। আবার মিনু খালা,আদু ফুপ্পি, টুম্পা মিস, চাচি মনির মতো হলেও হবে!”
বলেই পরণের টি শার্ট উঁচিয়ে নাক ঝাড়ে।টি শার্টে সর্দি লেগে একাকার। শুভ মুখ কুঁচকে বলে,
-” ইশ কি করলে টি শার্টে সর্দি মেখে! টিস্যু ইউস করতে পারতে?”
ভোর চোখ পিটপিট করে চায়। চোখের জল মুছে শুভর কোল থেকে নেমে পড়ে। অরুণ হাসে খানিকটা। টি টেবিলের উপর রাখা টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে ভোরকে বলে,
-” আব্বু এদিকে আসো আমি মুছে দিচ্ছি।”
ভোর যায় না। মুখ ফুলিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। কথা বলবে না আব্বুর সাথে। অরুণ সোফা থেকে উঠে ভোরকে ধরতে এগিয়ে আসে। ভোর তাকে আসতে দেখে দৌড়ে বেড়িয়ে যায়। দরজা কষ্ট করে খুলতে হয় না ভোরকে । অফিসের পিয়ন খুলে ছিল । হাতে তার বিরিয়ানির প্যাকেট, কোল্ডড্রিংকস, আইসক্রিম ও পানির বোতল। সেগুলোই দিতে এসেছে। ভোরকে দৌড়ে যেতে দেখে ডাক দেয়,
-” ভোর বাবা কোথায় যাচ্ছো! পড়ে যাবে তো!”
ভোর শুনলে তো। আর এই অফিস যে তার আরেকটা বাড়ি। এখানেই দৌড়ে হেসে খেলে বড় হলো, অফিসের স্টাফদের সামনে। প্রায় সবাই তার চেনা পরিচিত। অরুণ দরজায় পিয়নকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
-” আজমল ভেতরে আসো! ওসব টি টেবিলে রেখে প্লেটের ব্যবস্থা করো।”
পিয়ন গোছের লোকটি বসের হুকুম মোতাবেক কাজ করতে উদ্যত হয়। অরুণ কেবিন থেকে বেরোতে নিলে শুভ উঠে এসে বলে,
-” ও থাকুক ওর মতো। অফিসটা ওর জন্য নতুন তো নয়।”
-” টি শার্ট নোংরা হয়ে আছে। পরিষ্কার করতে হবে। আর খাবে তো!”
বলেই বেরিয়ে যায়। সে জানে ভোর কোথায় আছে।
ভোর দৌড়ে এক মধ্যবয়সী মহিলার ডেস্কে চলে যায়। মহিলাটি নিজস্ব কম্পিউটারে কাজে ব্যস্ত। ভোরকে খেয়াল করে নি। ভোর হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
-” রুনা আন্টি! আমাকে লুকিয়ে রাখ তো! তোমার বস আমার পিছু নিয়েছে।”
মিসেস রুনা কম্পিউটার থেকে নজর সরিয়ে ভোরের দিকে তাকালো। খানিকটা চমকে মিষ্টি হেসে বলল,
-” ছোট বস যে! হোয়াট আ সারপ্রাইজ! কেমন আছেন আপনি! আজকাল তো আসেন না অফিসে? আমাদের ভুলে যাচ্ছেন?”
পাশের ডেস্কের লাবিব নামক যুবক বলে,
-” ম্যাডাম আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন আমাদের ছোট বস স্কুলে যায় এখন! সেখানে সমবয়সী বন্ধুদের পেয়ে আমাদের ভুলে গেছে!”
সামনের ডেস্কের ছটফটে একটা যুবতী মেয়ে নাম অপর্ণা! সে ভোরকে দেখে দৌড়ে আসে। ভোরের গাল টিপে বলে,
-” ছোট বস! আপনি দিন দিন এতো কিউট হচ্ছেন কি করে? পুরাই কিউটনেস ওভারলোডেড। আর কি সুন্দর মিষ্টি দেখতে! এই? স্কুলের সব মেয়েরা নিশ্চয়ই আপনার দিকে হা করে তাকিয়ে থাক! ক্রাশ খায়!”
লাবিব মেয়েটির মাথায় চাটি মেরে বলল,
-” চলে এসেছে ন্যাকা রানি! ছোট বস আপনার টি শার্টে কি লেগে আছে?”
ভোর হা করে সবার কথা গিলছিল। লাবিবের কথায় সর্দি লাগা জায়গা হাতের মুঠোয় পুরে ক্লোজআপ হাসি দিয়ে বলে,
-” সস লেগেছে! বিশ্বাস না হলে টেস্ট করে দেখতে পারো!”
অপর্ণা হেসে বলে,
-” টেস্ট করতে হবে না। আই ট্রাস্ট ইউ বস!”
-” থ্যাংক ইউ পরনা আপু।”
অপর্ণা আপু ডাক শুনে মুখ ফুলিয়ে বলে,
-” হায় ভগবান! পূর্ব জন্মে কি পাপ করেছিলাম? যে ক্রাশের ছেলের মুখে আপু ডাক শুনতে হচ্ছে! এই লাবিব একটু বিষ খা তো আমি মরে যাই!”
ভোর খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। মিসেস রুণাও হেসে ভোরের দিকে চাইলো। কি আদুরে বাচ্চা। তার ছোট ছেলের বয়সী। ভোরের জন্য তার অনেক মায়া হয়। তার ছেলে তাকে ছাড়া থাকতেই পারে না। অফিসে আসার সময় কত কান্না কাটি করে। বড় ছেলে মেয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখে। অফিস থেকে গেলে গলা জড়িয়ে থাকবে একদন্ড ছাড়ে না। আর ছোট্ট ভোর মা ছাড়াই জীবন যাপন করছে।
ভোর পিছনে ঘুরে বাবাকে আসতে দেখে লাবিবের পিছনে লুকিয়ে বলে,
-” লাবিব আংকেল,রুণা আন্টি আমায় লুকিয়ে রাখো তো! তোমাদের বসের সাথে আড়ি!”
লাবিব তাকে তুলে ডেস্কের উপর বসিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-” ছোট বস আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন! আমি আছি তো!”
রুণা অপর্ণা মিটমিটে হাসতে লাগলো।
অরুণ গম্ভীর মুখে হন হন করে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করে,
-” কাজ বাদ দিয়ে আপনারা কি করছেন সবাই?”
অপর্ণা সোজা হয়ে তড়িঘড়ি করে বলে,
-” গ্রুপ ওয়ার্ক করছিলাম স্যার!”
অরুণ কপালে গাড় ভাঁজ ফেলে বলে,
-” আই সি! মিসেস রুণা আপনাকে যে ডিজাইন গুলো ইমেইল করেছিলাম দেখেছিলেন?”
-” জি বস! সব গুলোই ভালো তবে ইউনিক নয়! আই থিংক একটু আলাদা সিম্পলের মধ্যে হলে ভালো হয়!”
-” ঠিক বলেছেন। আপনি ম্যানেজারের সাথে কথা বলুন! আর ভোর আমি জানি তুমি লাবিবের পিছনে আছো বেরিয়ে আসো? ফাস্ট!”
লাবিব সরে গিয়ে করুণ চোখে চেয়ে কাঁধ উঁচিয়ে বোঝায় আয় ট্রাই মায় বেস্ট বাট!! ভোর মুখ ফুলিয়ে নেয়। লাবিব তাকে নামিয়ে দিলে ভোর অরুণের দিকে ক্ষানিকটা এগিয়ে এসে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে পালাতে নেয়। অরুণ চেনে তার ছেলেকে। ছেলের মনোভাব বুঝতে পেরে ঝট করে ধরে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা দেয়! ভোর ধরা পড়ে চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে লাবিব ,অপর্ণা ও মিসেস রুণার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” তোমাদের সবাইকে আউট করে দিব চাকরি থেকে!”
ওরা সবাই মিটমিট করে হাসছে ভোরের কথায়। হাত দিয়ে টাটা দেয়। ভোর মুখ ভেটকিয়ে সামনে তাকায়। অরুণ তাকে নিয়ে কেবিনে ঢোকে। ততক্ষণে বিরিয়ানি প্লেটে রেডি। শুভ ওদের দেখে বলে,
-” বিরিয়ানি দেখে আমার পেটের ইঁদুর বেরিয়ে আসছে আর তুমি হাইড এন্ড সিক খেলছো বাবা? আসো বিরিয়ানি শেষ করি জলদি”
ভোর হেসে ওঠে। পেটের ভিতর কখনো ইঁদুর থাকে নাকি! ইঁদুর তো গুহায় থাকে।
-” আঙ্কেল তুমি খাও! আমি খাব না! শুধু আইসক্রিম খাবো!”
অরুণ তাকে সোফায় বসিয়ে টিস্যু দিয়ে টি শার্টে সর্দি মুছতে মুছতে বলল,
-” তুমি খাবে তোমার বাবা শুদ্ধ খাবে!”
সর্দি শুকিয়ে যাওয়ায় উঠছে না। অরুণ রেখে দিল। পরে চেঞ্জ করে দিবে। পরনে সাদা শার্টের উপর কালো কটি খুলে হাতা ফোল্ড করতে করতে ওয়াশ রুমে গিয়ে হাত ধুয়ে আসে। ভোরের পাশে সোফায় বসে বিরিয়ানি লোকমায় তুলে তার সামনে ধরে। ভোর মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
-” খাব না আমি!”
অরুণ শান্ত ভাবে বলে,
-” আব্বু তুমি না খেলে কিন্তু আমিও খাব না!”
ব্যস হয়ে গেল। ভোর অন্যদিকে তাকিয়েই হা করলো। বাবা না খেলে বাবার কষ্ট হবে আর বাবার কষ্ট হলে তারও কষ্ট হবে। শুভ গপাগপ বিরিয়ানি মুখে চালান করে চিবোতে ও বলে,
-” আহা আমাদের ভোর বাবা কি গুড বয়! ভোর বাবা তোমার জন্য লাল টুকটুকে একটা বউ আনবো ! একদম মিষ্টি! ভালো হবে না?”
ভোর লজ্জা পায়। মুখে বিরিয়ানি নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
-” যাহ! আমি তো ছোট!”
অরুণ হেসে উঠে। সাথে শুভও ভোর আরো লজ্জা পায়!
গ্রীষ্মের তপ্ত বিকেল বেলা। আজ আকাশ মেঘলা! রোদ না থাকলেও গরমের ছুটি নেই। জাকিয়ে বসেছে যেন! উফ অস্বস্তিকর গরম। গরমে অনুভব করা যায় শীতকালে কত আরামে ছিলাম। খুব বেশি শীত করলেও লেপের ভিতরে ঢুকে/আগুন ধরিয়ে/ বস্তা বস্তা শীতের কাপড় জড়িয়েও স্বস্তি পাওয়া যায়। রাতে অল্প কষ্ট হলেও মানিয়ে নেয়া যায়! দিনে রোদ উঠলে পরিবেশ গরম হবে। অথচ গরমকালে রাতেও যেমন দিনেও তেমন। বিছানা যেন গরম তাআ। টাংকির পানি যেন ফুটন্ত পানি। ফ্যানের বাতাস মনে হয় গরম ধোঁয়া! আগে তো এরকম গরম ছিল না। গত দু বছর থেকে গরমকালে তাপমাত্রা যেন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে । কাঠফাঁটা রোদে বের হওয়াই মুশকিল। অথচ এই গরমে রিকশা ওয়ালা সহ সকল দিন মজুর যারা তীব্র গরম সহ্য করে রোদের ভিতরে কাজ করে যাচ্ছে পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করতে! বাচ্চাদের ভালো লেখা পড়া, ভালো খাবার, পোষাক, একটু সুখ দিতে! উপর ওয়ালা তাদের হালাল রিজিকে বরকত দান করুন!আমিন!
পাতা স্কুল শেষ করে একটা পদ্ম পুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে। পাশেই বাইক স্ট্যান্ড করে রেখেছে। সে এখানে একা নয়! অনেকেই আছে। বাচ্চা থেকে জোয়ান বুড়ো কিছু কপোত কপোতি । আর ঝালমুড়ি, বাদাম ওয়ালা ঘুরঘুর করছে। শহরের ভিতরেই একটা ফাঁকা জায়গা যার মাঝখানে পুকুর। পুকুর সুন্দর করে বাঁধাই করা হয়েছে। পুকুরে বেশ কিছু পদ্ম ফুল ফুটেছে। পুকুরের চারিপাশে বড় বড় গাছ কৃষ্ণচূড়া, কড়ি, মেহগনি, সেগুন, নারিকেল ইত্যাদি গাছ। গাছের গোড়ায় সান বেঁধে বসার জায়গা করা হয়েছে। সেখানেই সকলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। জায়গাটা কিছুটা শীতল ও স্বস্তিদায়ক। পাতা স্কুটির পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে একজনের জন্য। হাতে বাদামের ঠোঙা। কিনলেও এখনো মুখে দেয় নি। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে ফোনটা বের করে কল লাগায় কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিটিকে। ব্যাক্তি কল রিসিভ করে না।
-” কুত্তা! মহিষ! গন্ডার! শালা! আয় একবার!”
বিড়বিড় করে বলে আবার কল লাগায় । না ধরে না। পাতা আরো একটা ভয়ংকর গালি দিতে নিলে কেউ ডাক দেয়। পাতা সেদিকে তাকায়। ব্যাক্তিটি কান ধরে স্যরি বলতে বলতে এগিয়ে এসে বলে,
-” স্যরি আপু! অনেকক্ষণ ধরে ওয়েট করছো! আই এম রিয়েলি স্যরি। বন্ধুদেরকে বিদায় করতে একটু সময় লাগলো। ভালো আছো তুমি?”
পাতা পাবেলের কথা শুনে হেসে দেয়। তার মাথার চুল গুলো এলোমেলো করে বলে,
-” আলহামদুলিল্লাহ ভালো! তুই কেমন আছিস? প্রিয়ার কি খবর? আব্বু আম্মু?”
পাবেল পাতার হাত থেকে নিজের শখের চুল ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
-” একটা একটা করে বলো? আমি ভালো আছি। আর বাকিরাও। প্রিয় যদি যানতো আমি তোমার সাথে দেখা করবো তাহলে তো ঘারে উঠে পরত। আব্বু আম্মু তোমাকে যেতে বলেছে। কয়েকদিন আমাদের ওখানে থেকে আসো! উই মিস ইউ আপু!”
পাতা হাসে অল্প। সে হাসিতে খানিকটা উদ্বেগ, ভালোলাগা, মন খারাপি,ভয়, হতাশা মিশ্রিত। সে ঢোক গিলে বলে,
-” স্কুল আছে আমার। কিভাবে যাই এখন? ছুটি পাই তারপর যাবো!”
পাবেল মুখ গোমড়া করে বলে,
-” তাহলে হয়েছে। আচ্ছা এই বাচ্চা কাচ্চা পড়াতে কেমন লাগে? ইশ আমার তো ভাবলেই গা কাটা দিয়ে ওঠে। কি দুষ্টু হয় ওরা! একেকটা জ্বালানোর মেশিন। হাড্ডি মাংস এক করে দেয়। প্রথম যখন টিউশনি নিলাম! থ্রির একটা ছেলে। একদিন আমাকে বলে,-‘ স্যার একটা গান বলেন তো!” আমি তো গান পারি না সেটাই বললাম। ছেলেটি তবুও জোর করে! একেবারে নাছোড়বান্দা তাই এককলি গাইলাম। ছেলেটা কানে হাত দিয়ে এক চিৎকার দিল। ব্যস চৌদ্দ গুষ্টি হাজির। ছেলে তাদের বলে কিনা! আমি নাকি সবসময় এই বেসুরো গলায় গুন গুন করে তার কানের বারোটা বাজাই! ব্যস বাচ্চা পড়ানো বাদ। বড় দুই একটা পড়াই। আজকালকার বাচ্চারা যা দুষ্টু না!”
পাতা হেসে বলে,
-” বাচ্চারা দুষ্টুমি করবে নাতো আমাদের মতো বড়রা করবে? ওদের বয়সটাই এরকম। তবে হ্যা সব কিছুর লিমিট থাকে। দুষ্টুমি করতে গিয়ে কোনো প্রকার বেয়াদবি করলে কড়া শাসনে রাখতে হবে। আমার বাচ্চাদের ভালো লাগে। কি সুন্দর নিষ্পাপ ওরা। কোনো প্যাচ কোচ নেই। দিল একেবারে সাফ! স্বার্থহীন ভালোবাসতে জানে!”
পাবেল হাসে। পাতার শেষ কথার অনুধাবন বুঝতে বেগ পোহাতে হয় না। সত্যি বলতে সেও মানে তার বাবা মা এটা ঠিক করে নি পাতার সাথে! কিন্তু তার তো কিছুই করার নেই। পাতা পাবেলের নিরবতা খেয়াল করে। ছেলেটা একাধারে তার ভাই, ছোট বেলার খেলার বন্ধু, বেস্ট ফ্রেন্ড। তাকে বড় বোনের মতোই ভালোবাসে! ছোট বোনের মতো আগলে রেখেছে। পাতার জীবনে ভালো কোনো বন্ধু নেই। ক্লাসমেটদের সাথে টুকটাক কথাবার্তা, কখনো ঘুরতে যাওয়া হতো তবে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে উঠে নি। সে পাবেলের বাহুতে কিল মেরে বলে,
-” তুই হঠাৎ এই শহরে?”
-” বন্ধুদের সাথে ঘুরতে এসেছিলাম। তাই ভাবলাম তোর সাথে দেখা করে যাই!”
-” ভালো করেছিস! তোর বন্ধুরা চলে গেছে? ”
-” হুম ওদের বিদায় করে তবেই এলাম একটু পরেই চলে যাবো!”
-” যাবি কেন? ওই বাড়িতে চল? আজ লতা আপু আসবে! ”
-” না যাবো না আজ। অন্যদিন। আব্বুকে বলে আসি নি। শুধু মা জানে।”
-” ফোন করে জানিয়ে দিস?”
-” জানাবো আগে বল তুমি আমার সাথে যাবে আমাদের বাড়ি?”
পাতা দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
-” বললাম তো স্কুল আছে! আচ্ছা যেতে হবে না ওখানে তোর!নে বাদাম খা!”
পাবেল বুঝলো পাতাকে জোর করে লাভ হবে না। তাই আর প্রসঙ্গ তুললো না। বাদামের ঠোঙা হাতে নিয়ে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে হাতের তালুতে বাদাম ডলে ফু দিয়ে পাতাকে দিয়ে বলল,
-‘” তুমিই খাও! বাদামে আমার কিছু হবে না। এক প্লেট ফ্রাইড রাইস সাথে খাসির মাংস হলেই আমার চলবে। না করবে না খবরদার? বিশ হাজার করে বেতন পাও জানি আমি!”
পাতা হেসে বলে,
-” আচ্ছা চল! তবে এর বেশি নয় কিন্তু। এখন বেশি টাকা নেই হাতে!”
-” ওকে মেরি বেহনা!”
পাতা হেসে ছোট ভাই পাবেলের বাহু জড়িয়ে পাশের একটি রেস্টুরেন্টে ঢোকে। ভাই ই তো! না হোক এক মায়ের পেটের! ছোট থেকে ভাই হিসেবেই জেনে এসেছে ভাই এর মতোই ভালোবেসেছে। যখন জেনেছে আপন নয় তারা খালাতো ভাইবোন! তখনও ভালোবাসা কমে নি তাদের মধ্যে!
রেস্টুরেন্টে ভরপেট দুই ভাইবোন খেয়ে দেয়ে বেড়ালে পাবেল বলে,
-” স্কুটি আমি চালাই? তোকে পৌঁছে দিয়ে আমি রওনা দেব!”
পাতা স্কুটির চাবি তার হাতে দিয়ে বলে,
-” চালা। তবে আগে একজায়গায় যাবো! একটা ভালো শপিং মলে নিয়ে চল! প্রিয় আর লতা আপুর মেয়ের জন্য কিছু কিনব! জলদি চল!”
পাবেল ছোট ছোট করে চেয়ে চাবি দিয়ে স্কুটি স্টার্ট করে বলে,
-” সে ঠিক আছে কিন্তু আমায় প্রিয়োর টা নিতে বলবি না! জানতে পারলে আমার পিন্ডি চটকে দেবে!”
পাতা পিছনে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলে,
-” ওই টুকুতে কিচ্ছু হবে না পাবু সোনা!”
টুকিটাকি গল্প করতে করতে তারা একটা বড় শপিং মলের সামনে থামে। পাতা বলে,
-” এই কোথায় আনলি! এটা বড়লোকের শপিং মল! আমার মতো চুনোপুঁটির নয়! টমটম ঘুরা! আমার কাছে ওত টাকা নেই পাবু!”
পাবেল পার্কিং জোনে স্কুটি রেখে চাবি ঘুরাতে বলে,
-” ফিকার নট আপু ! আমি আছি তো! চল?”
পাতা চুপসে যাওয়া মুখ কাচুমাচু বানিয়ে সাইট ব্যাগটা নিজের সাথে আরেকটু সেটে নিয়ে তার পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। কত বড় শপিং মল! আগে কখনো আসা হয় নি। সে তো ফুটপাতের দোকান গুলো থেকেই বেশিরভাগ জিনিস কেনে। কমদামে বেশ ভালো মানের জিনিসপত্র পাওয়া যায়। আর তাছাড়া তাদের মতো মধ্যবিত্তদের জন্য এতো বড় শপিং মল বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়!
পাতা আশেপাশে তাকায়। সবাই মডার্ন ড্রেসআপে। চলাফেরা হাবভাব দেখে বোঝাই যাচ্ছে কোনো উচ্চবিত্ত পরিবারের। পরনের জামাকাপড় একদম টান টান কুঁচকানো নয় যেন মাত্র ইস্ত্রি করে এনেছে! দামি ঘড়ি ! সাইড ব্যাগ! হাতে আই ফোন! জুতো মনে হচ্ছে মাত্র পলিশ করা। কি সুন্দর মেকাপ! চুল স্ট্রেট করা। পাতা নিজের দিকে চায়! স্কুল ড্রেসের স্কাই ব্লু শাড়ি কেমন মলিন লাগছে সবার ভিড়ে পায়ের জুতো!সেদিকে না তাকানোই ভালো! ঘড়ি পুড়নো মডেলের!
ওরা শপিং মলের ভিতরে প্রবেশ করে। পাতা হা করে আশেপাশে চায়! কত সুন্দর ভিতরে! যেন কোনো প্রাসাদ! প্রত্যেকটা সেকশন আলাদা আলাদা! বাচ্চা, ছেলে-মেয়ে, জামা-জুতো, খেলনা সব কিছুরই আলাদা দোকান! ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট কিড জোন সবই আছে। কত সুন্দর সুন্দর বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক, জুতো, কসমেটিকস, ব্যাগ, স্বর্ণের অলংকার ইত্যাদি ইত্যাদি। পাতার চোখ যেন জুড়িয়ে যায়। ছোট থেকেই তার এসব দামি দামি জিনিস পত্রের প্রতি খুব লোভ কাজ করে! মনে হয় কিনে বাড়ি নিয়ে দেখতে! ব্যবহার করতে! ঘরে সাজিয়ে সবাইকে ডেকে নিয়ে দেখাতে!
পাবেল পাতাকে নিয়ে বাচ্চাদের সেকশনে যায়! পাতা ঘুরে ঘুরে সব দেখে! ছোট ছোট জামা কাপড় , জুতো,খেলনা, চকলেটস, পুতুল, পোকেমন পিকাচু, ওগি, টম জেরী ইত্যাদি ইত্যাদি। পাতার মনে হচ্ছে সব ডাকাতি করে নিজের সাথে নিয়ে যেতে। কিন্ত সেটা সম্ভব নয়। রাতে লাইট ওফ করে ঘুমাতে পারে না সে করবে ডাকাতি ভাবা যায়! পাতা প্রিয় ও লতার মেয়ে রুম্পার জন্য টেডি পছন্দ করছিল। পাবেলও সাহায্য করছিল। পাতা যেটা হাতে নেয় তার প্রাইসটা আগে দেখে। প্রাইস দেখে আস্তে সেটা রেখে দেয়! অনেক গুলো দেখে পছন্দ হলেও দামে মেলে না। আশেপাশে সবাই কেমন করে চাইছে তাদের দিকে। পাতা কাঁদো কাঁদো হয়ে আসে। তার এখানে আসাই উচিত হয় নি। পাবেল বারবার বলে,
পাতা বাহার পর্ব ৪
-” আপু তুমি পছন্দ কর! বিল আমি পে করবো! ”
পাতা এটা কখনো করবে না। দরকার হলে খালি হাতেই ফিরবে। পাবেল হতাশ হয়ে খেলনা দেখে। পাতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে পাবেলের পাশে। কমদামি কিছু পেলে নেবে নইলে রাস্তা মেপে কেটে পড়বে। তার ভাবনার মাঝেই হুট করে কেউ এসে পাতার কোমড় জড়িয়ে ধরে! পাতা ভয় পেয়ে যায়! ‘আম্মু’ বলে সরে পিছনে যেতে নিলে দুজন ফ্লোরে পড়ে যায় ধপাস করে!
পাবেল হা করে তাকিয়ে থাকে। আশেপাশে সবার দৃষ্টিও সেদিকেই!