পাতা বাহার পর্ব ৫৯

পাতা বাহার পর্ব ৫৯
বেলা শেখ 

-” ভোরের বাবা আদুরি আর লুব ভাইয়ের বিষয় নিয়ে আপনার মন্তব্য কি? আপনি ব্যাপারটা কেমন ভাবে দেখছেন? সত্যিটা বলবেন কিন্তু?”
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুঁচি করতে করতে জিজ্ঞেস করে পাতা। অরুণ বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। দৃষ্টি পাতাতে নিবদ্ধ। বেহায়া নেত্রযুগল ব্যাক্তিগত নারীর আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত! পাতার প্রশ্নে দৃষ্টি সরিয়ে গমগমে গলায় বলে,

-” বড় ভাই হিসেবে আমার দায়িত্ব বোনের ভালোমন্দ বিবেচনা করা! আদু সবার প্রথমে আমাকে জানায়।আমি ধমকেছি ওকে। রেগে কয়েকটা কথাও শুনিয়েছি। পরে ঠান্ডা মাথায় বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওই যে জেদ! যা আমাদের সকলের রক্তে বহমান! ওর ওকেই চাই। লাবিবকেও ঝেড়েছি! লাবিব অবশ্য প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। চুপচাপ চলে যায়। আদু আমাকে ম্যানেজ করতে না পেরে আরিয়ানকে জানায়। সেখান থেকে ঝাড়ি খেয়ে ছোট মায়ের পা ধরে লটকে যায় বাচ্চাদের ন্যায়! ভাবতে পারছো? ছোট মা’কে কিভাবে মানিয়েছে ওই জানে! এখন তোমার বাবা ভাই আসুক দেখা যাক কি হয়!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পাতা কুঁচি করা বাদ রেখে হা করে সব কথা গিলছিলো। জল এতো দূর পর্যন্ত গড়িয়ে বন্যা বয়ে পরিস্থিতি থমথমে আর সেখানে সে কিছুই জানতো না!! লোকটা আজ সকালে তোরজোর চালিয়ে সরকার বাড়িতে এনে বলে আদুকে দেখতে আসবে! পাতা স্বাভাবিক নিয়েছিলো, আরে ভাই মেয়ে হয়ে জন্মেছে দেখতে আসবে অতি সাধারণ বিষয়। কিন্তু রুবির কাছ থেকে যখন জানতে পারে ছেলে পক্ষ আর কেউ না তাঁরই পরিবার; সে সবচেয়ে বড় ঝটকায় ছিলো!! আর যখন জানতে পারে আদুরি ও লুব ভাইয়ের মাঝে কিছু চলছে তাও অনেক বছর হলো। তাদের বিয়ের পূর্ব হতেই । পাতা ফিট খেতে নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছে! আদুরি আর লুব ভাই? কেমনে কি! আর সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে আসমা বেগম মত দিয়েছেন। পাতার মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। গত চার মাস তাঁর দুনিয়া দুটো বাচ্চা আর তাদের বাবাকে ঘিরেই ছিলো। পাতা তাঁর এই নব্য জীবনটাকে বেশ উপভোগ করছিলো! তাঁর মাঝেই হঠাৎ এমন একটা ঘটনা! কি হবে আগে? তাদের মধ্যবিত্তের ঘরে এক ধনীর দুলালী!! লুব ভাই কিভাবে জড়িয়ে পড়লো এই সম্পর্কে!! দুই ভাই নিশ্চয়ই তাঁর ভাইকে অনেক হুমকি ধামকি দিয়েছে। তা তো স্বীকারই করলো। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে পাতা শুকনো গলায় বলল,

-” আমি তো এখনো বিশ্বাস করতে পারছি লুব ভাই এরকম কিছু করেছে। রিহ্যাব থেকে ফেরার পর ভাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো। সব বন্ধু বান্ধবদের ইস্তফা দিয়ে নিজের মাঝেই মেতে থাকতো। চাকরির পিছনে ছুটছিলো খুব করে। কিন্তু তাঁর করা ভুলটা তাঁর ক্যারিয়ারের অন্তরায়। এখনো বেকার ঘুরছে। সে আপনাদের আদরের বোন..”
-” একচুয়ালি আদু লাড্ডু ছিলো লুবমানের উপর। ইন্টারমিডিয়েটে আদু’কে এক কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলাম। লুবমান ইসলাম সেখানে টিচার ছিলো বোধহয়। সেখান থেকেই পরিচয়। লুব এড়িয়ে চললেও কিশোরী জেদি আদু পাগলামি করতো! লুব ধীরে ধীরে গলে যায়। যখন আমাদের বিয়ে হয় লুব হয়তোবা প্রথমবার আদুর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জেনেছিলো। এরপর ব্রেক আপ!জেদি আদু তো বোম হয়ে ছিলো।কিছু মাস হলো সেই বোম ফুটেছে। ফলাফল সামনে!”

পাতা অবাক হয়! অরুণ তাঁর অবাক মুখাবয়ব দেখে হাসে অল্প। তাঁর আলা ভোলা আদুরে বউটা! জীবনের মারপ্যাঁচ বোঝে না খুব একটা। অরুণ হামি তুলে বলে,
-” পাতাবাহার? তোমার বান্ধবী রূপ শাশুড়ির সাথে সম্পর্কের অবনতি হতে চলছে। তাই প্রস্তুত রেখো নিজেকে!”
ব্যাপারটা পাতাও বুঝতে পেরেছে। এ বাড়িতে আসার পরে সবাই যেন মাথায় তুলে রেখেছে তাকে এমনকি রুবিও! বড় ভাবী বলে তার সাথে ভাব বজায় রেখেছে। হাত ধরে অনেকবার ক্ষমাও চেয়েছে সেদিনের জন্য। অনুরোধ করেছে ফিরে আসার। তাঁর কন্ঠে অনুতাপের রেশ স্পষ্ট। তবে আসমা বেগমের শীতল আচরণে সে একটু শঙ্কায়! পাতা সব চিন্তা ফেলে পুনরায় শাড়ির কুঁচি ঠিক করে। একা একা বেগ পোহাতে হচ্ছে তাই ব্যস্ততার সুরে বলে,
-” ভোরের বাবা একটু কুঁচি টা ধরে দিন তো? দেড়ি হয়ে গেলো! মেয়েটা কি করছে কে জানে! নতুন পরিবেশে তাঁর কান্নার শেষ নেই! কি হলো?”

অরুণের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে পাতা ঘার ঘুরিয়ে চায়। লোকটা আহাম্মকের মতো বসে আছে। পাতা হতাশ হয়। সেও কাকে বলছিলো? ওই নাক উঁচু লোককে? সে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর শাড়ির কুচি ঠিক করে দিবে? ইগো চুরমার হয়ে যাবে না? শালার নাক উঁচু জামাই! পাতা চোখ উল্টিয়ে নিজেই কুঁচি ঠিক করতে করতে হিসহিসিয়ে বলে,
-” এতো গড়িমা ভালো না বুঝলেন? বউয়ের শাড়ির কুঁচি ধরিয়ে দিলে কেউ ছোট হয়ে যায় না। ছোট ছোট কাজে বউকে সাহায্য করলে বউ খুশিতে বাকবাকুম হয়! তাদের মোহাব্বতের পাল্লা ভারী হয়।”
-” আমি কুঁচি ঠিক করতে গেলে তোমার শাড়ি পড়া আর হবে না পাতাবাহার!”

অরুণের গম্ভীর সুর! পাতা বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে পারফিউমটা অরুণের দিকে ছুঁড়ে মারে! অরুণ ধরে নেয়! হেসে বিছানা থেকে উঠে আসে। পারফিউমের বোতল তাঁর জায়গায় রেখে আয়নায় নিজেকে দেখে নেয়। পরিপাটি চুলে হাত চালিয়ে পাতাকে লক্ষ্য করে। ভাব দেখো লোকটার; পাতা আড়চোখে চেয়ে ভেংচি কেটে শাড়ি পরানোয় মনোনিবেশ করে। অনেকদিন পর আজ শাড়ি পরছে। অরুণ চুপচাপ পাতার পাশে দাঁড়িয়ে অবলোকন করে। পাতার শাড়ি পড়া হয়ে গেলে টুকটাক প্রসাধনী মেখে রেডি হলে অরুণ গমগমে গলায় বলে,

-” আমি সুন্দর ভাবে শাড়ি পড়িয়ে দিতে পারবো! ইউটিউব থেকে শিখেছি! সত্যিই বলছি! ইয়ু ওয়ান্না ট্রায়? ”
পাতা চোখে কাজল লাগাতে লাগাতে সিরিয়াস গলায় বলে,
-” গুড জব ভোরের বাবা। আ’ম প্রাউড ওফ ইয়ু!”
বলেই হেসে দেয় পাতা। অরুণ ছোট ছোট চোখে চেয়ে হুট করে পাঁজাকোলে তুলে নেয়। পাতার হাত থেকে কাজল পড়ে যায়। চোখ বড় বড় করে বলে,
-” হচ্ছে টা কি! নামিয়ে দিন বলছি!”
অরুণ দরজার দিকে যায়। পাতা চোখ রাঙায়। এভাবে কোলে নিয়ে বাইরে যাবে নাকি? তাঁর ধারনার দরজায় খিল দিয়ে অরুণ দরজা লক করে দেয়। পাতা গোল গোল করে তাকিয়ে থাকে। অরুণ ঝুঁকে পাতার হৃষ্টপুষ্ট রাঙা ওষ্ঠাধরে সশব্দে চুমু বসায়।

ফুলো গাল জোড়া ফুলে আছে। নাকের পাটা ফুলে উঠছে বারংবার। বুকে হাত গুজে ভোর সরকার দাঁড়িয়ে! বোঝাই যাচ্ছে নবাব পুত্তুর রেগে আছে অনেক। দৃষ্টি তাঁর ফ্লোরে শুয়ে চার মাসের ক্রন্দনরত বোন! ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদছে। দেড় বছরের আরেকটা বাচ্চা তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে আর ‘বাবু’ বলে ডাকছে। ভোর নয়নকে চোখ রাঙাতেই নয়ন ভাবনাকে ছেড়ে দৌড়ে চলে যায় কিচেনের দিকে। ভাবনার কান্নার আওয়াজ শুনে ছোট্ট রূপ ছুটে আসে হেলে দুলে। ভাবনাকে টেনে তুলতে তুলতে বলে,
-” মিসতি বাবু কাঁদে না। চললেট দিবো। উতো?”
ছোট ভাবনা বুঝলে তো? সে আরো জোড়ে জোড়ে কান্নাকাটি করতে থাকে। আনিকা ছুটে আসে। হাঁপাতে হাঁপাতে ভোরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

-” অরু কে মেরেছিস ভোর? বনু কাঁদছে কেন?”
ভোর নিজ ভেজা টি শার্ট দেখিয়ে নাক সিঁটকিয়ে জবাব দেয়,
-” মারি নি। শিশি করে ভিজিয়ে দিয়েছে আমাকে তাই পানিশড করেছি! পঁচা বনু!”
আনিকা হেসে উঠলো! ছোট ভাবনাকে তুলে সোফায় বসিয়ে এটা ওটা বলে কান্না থামানোর চেষ্টা করে। ভাবনার কান্না থামার নাম নেই। রূপ ভাবনার হাতে একটা চকলেট দেয়। ছোট ভাবনা ছুড়ে ফেলে দেয়। রূপ ভাবনাকে ভেংচি কেটে চকলেট তুলে গপাগপ নিজ মুখে চালান করে ‘মিসতি মিসতি’ বলে।ভোর এগিয়ে এসে ভাবনাকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু দিয়ে বলল,

-” ভাবনা বুড়ি কাঁদে না। ভাই আদর করেছে না? কান্না থামাও? নইলে বকবো কিন্তু?”
তবুও কান্না থামে না। আনিকা বিজ্ঞ দের মতো মাথা নাড়িয়ে বলে,
-” ওর বোধহয় খিদে পেয়েছে! বড় চাচি মনিকে ডাক?”
ভোর কিছু বলবে এর আগে রূপ লাফিয়ে উঠে বলে,
-” আমি দেকে আনছি আমা’কে!”
বলেই হেলতে দুলতে চলে গেলো। ভোর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাঁর যাওয়া দেখে। ততক্ষণে ভাবনার কান্না থেমে গেছে। সে টলমলে চোখে চেয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল মুখে পুরে চুষতে থাকে।
একটু পরেই রুপের দেখা মেলে। অরুণের কাঁধে চড়ে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছে। অরুণ ড্রয়িং রুমের সোফায় রূপকে বসিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। ভোর রাগি গলায় নালিশের সুরে বলে,

-” তোমার পঁচা মেয়ে আমাকে ভিজিয়ে নোংরা বানিয়ে দিয়েছে আব্বু!”
অরুণ মেয়ের মুখ থেকে বৃদ্ধাঙ্গুল বের করে বলে,
-” মা তুমি দিন দিন দুষ্টু হয়ে যাচ্ছো! ভাইকে ভিজিয়ে কেন দিয়েছো? বলতে পারো নি শিশি দিবে? ইশ্ এই কলিজা তোমার বোন তো কথাই বলতে পারে না! বলবে কিভাবে?”
-” তুমি ওকে প্যাম্পাস পরিয়ে কেন দাও নি আব্বু? সব দোষ তোমার!”

অরুণ শান্ত চোখে চায় ছেলের দিকে! ভোর একটা ভেংচি কাটলো। এরইমধ্যে পাতা এসে জিজ্ঞেস করে ‘কি হয়েছে?’ তাঁর গলা শুনেই ভাবনা কেঁদে ওঠে। বাচ্চা যতই অবুঝ হোক মায়ের প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে সে পরিচিত কি না। পাতা মেয়েকে কোলে নিয়ে আধো আধো বুলিতে এটা ওটা বলে। মায়ের বুঝতে বাকি থাকেনা বাচ্চার কান্নার কারণ। সে মেয়েকে নিয়ে সোফায় বসে। রূপ গুটিসুটি হয়ে পাতার পাশে বসে মিষ্টি করে হাসলো। আমা’কে রূপের অন্নেক ভালো লাগে কি না। পাতা তাঁর গাল টিপে গাল ফুলো ভোরের দিকে চায়।
-” দুষ্টু’টা ভিজিয়ে দিয়েছে বাবাকে? বকে দিবো! তুমি তোমার বাবার সাথে গিয়ে চেঞ্জ করে নাও সোনা?”
ভোর মাথা কাত করে সায় জানিয়ে‌ বাবার সাথে যায়। রূপ ভোরের প্রস্থান দেখে আরো খুশি হয়। উঠে দাঁড়িয়ে পাতার গালে টুপ করে চুমু দিয়ে বলে,

-” আমা তুমি কতো মিসতি! চললেতের মতো!”
-” তাই? আপনিও মিষ্টি একদম রসগোল্লার মতো!”
হেসে বলে পাতা। রূপ হা করে তাকিয়ে দেখে! তারপর সেও হেসে দেয়। আনিকা পাতার অপরপাশে বসে বলে,
-” আমি বুঝি টক?”
-” তুমি তো বারবি ডল! কিউট সুইট আনি বুড়ি!”
প্রশংসায় আনিকা বাকবাকুম! সে গল্পের ঝুড়ি খুলে বসে। পাতা আগ্রহী হয়ে শোনে তার গল্প। রূপ হা করে পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে টুপ করে চুমু দেয়। তন্মধ্যে রুবির আগমন ঘটে। হেসে পাতার পাশে বসে। ছোট ভাবনা মায়ের বুক থেকে মুখ বের করে তাঁর দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। রুবি হাত বাড়িয়ে তাকে কোলে তুলে নেয়। রূপ সাথে সাথেই পাতার কোল দখল নিতে ভুলে না। রুবি হেসে বলে,

-” আমার ছেলেটা তোমাকে দেখলে হুঁশে থাকে না বড় ভাবী। তাঁর আমা তাকে কি জাদু করেছে কে জানে!”
রূপ তাঁর ইঁদুরের মতো কুটি কুটি দাঁত বের করে খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। পাতাও হেসে তাঁকে আদর করে।
দূর থেকে ভোর সবটা দেখতে পায়। গম্ভীর মুখে হাঁফ প্যান্টের পকেটে হাত গুজে এগিয়ে আসে। তাঁর পেছনে অরুণ। তাদের আগমনে রূপ বোধহয় খুশি হলো না। পিটপিট করে ভোরকে দেখে সে গুটিসুটি হয়ে পাতার গলা জড়িয়ে ধরে। রুবি আড়চোখে ভোরের মুখাবয়ব দেখে বলে,
-” ভোরের মুড অফ কেন?”

ভোর কিছুই বলে না। চুপচাপ সোফার এককোণে বসে টিভি অন করে দেয়। রুবি সেদিকে তাকিয়ে দেখে। ভোর কথা বলে না তাঁর সাথে। এই টুকু ছেলের এতো রাগ! সে পাতার কাছে ভাবনাকে দিয়ে রূপকে নিয়ে চলে যায়। পাতা হতাশ চোখে অরুণের দিকে চায়। যেমন বাবা তেমন তাঁর ছেলে। অরুণ পাতার চাহনি দেখে নজর সরিয়ে টিভিতে রাখে। আশ্চর্য তাঁর দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? সে কি করেছে? ভোরের দিকে তাকাক না। পাতা ভোরের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” এটা কেমন আচরণ ভোর? গুরুজন কিছু জিজ্ঞেস করলে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়া বেয়াদবির কাতারে পড়ে। তোমার থেকে এটা আশা করি নি!”
ভোর রিমোট ছুঁড়ে ফেলে হনহনিয়ে চলে যায় বাইরের দিকে। পাতা অবাক চোখে ফ্লোরে পড়ে থাকা ভাঙা রিমোটের দিকে তাকিয়ে থাকে। অরুণ কপালে ভাঁজ ফেলে শক্ত গলায় ভোরকে ডেকে তার পিছু যায়। তবে ভোরকে রাতুলের কোলে আসতে দেখে কিছু বলতে পারে না। হাসিমুখে তাদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে ভেতরে নিয়ে আসে!

সরকার বাড়ির পরিবেশ স্বাভাবিক! লুবমান সহ রাতুল, লাবিব,আতিকুর ইসলাম, লুবমানের এক মামা এসেছে। ভালোভাবেই তাদের সাথে আলাপ আলোচনা চলে। অরুণ অতি দরকারে টুকটাক কথা বলেছে। সে জানে আসমা বেগম ব্যাপারটা মেনে নিলেও মন থেকে সে নারাজ! তাঁর জায়গায় অবশ্য তিনি ঠিক আছে। প্রতিটা মা’ই চায় তাঁর মেয়ে সুখী থাকুক ভালো থাকুক। মেয়ের ভবিষ্যৎ পুষ্পে ঘিরে থাকুক কাঁটা যেন ছুঁতেও না পারে! আদুরি সোনার চামচ মুখে নিয়ে বড় হয়েছে! অভাব সংকট কি সেটা জানেই না! সেই মেয়ে মধ্যবিত্ত ঘরে মানিয়ে নিতে পারবে তো? অরুণও দ্বিধায় আছে, আদুরী মানিয়ে নিতে পারবে কি না! যেখানে আদুরীর হাত খরচের পরিমাণ টাকায় লুবদের মধ্যবিত্তের সংসার বিনা ঝঞ্ঝাটে কেটে যায়। অরুণ বরাবরই নারাজ থাকলেও ছোট আদুরে বোনটার হাসিমুখ খানি দেখে সব ভুলে যায়। বোনের মাথায় হাত রেখে দোয়া করে প্রাণ ভরে। আলাপকালে রাতুল স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” ভাই? আপনি চুপ থাকলে হবে? আপনি আদুরি’র বড় ভাই ! লুবমানে’রও বোনের জামাই। সব দিক দিয়েই দায়িত্ব বেশি। কি বলো পাতা?”
পাতা অরুণের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো মেয়েকে নিয়ে। তাঁর আঁচল ধরে ভোর দাঁড়িয়ে আছে। রাতুলের কথায় মুচকি হেসে বলল,
-” ঠিক দুলাভাই!”
-” আরিয়ান বলছে তো! হি রিফ্লেক্টস আব্বু!”

মুচকি হেসে বলে অরুণ। আরিয়ান ভাইয়ের কথায় হাসে। ভাই সবসময়ই বলে একথা। দুই পক্ষের মাঝে অনেক কথাই হয়। অতি শীঘ্রই চার হাত এক করে দেওয়ার সীদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হলে পাতা ভাইকে টেনে নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। লুব কাঁচুমাচু মুখে বলে,
-” দেখ পাতু একদম বকবি না আমাকে! আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ! সব দোষ তোর ননদের। যা বলার ওকে বল!”
-” বকবো কেন লুব ভাই? বকার অধিকার নেই তো আমার।”
অভিমানী গলা পাতার। লুব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-” এভাবে কেন বলছিস?”
-” তো কিভাবে বলবো? এতো এতো ঘটনা ঘটে গেলো আমি কিছুই জানি না! আজ শুনে আমি শকড্!”
লুবমান সন্দেহ গলায় বলে,

-” দুলাভাই বলে নি তোকে? আমি তো ভেবেছি তুই জানিস সব। আচ্ছা স্যরি ! এই কান ধরছি পাতু! রাগ করিস না প্লিজ?”
পাতা হেসে ভাইয়ের মাথার চুল এলোমেলো করে দিল।
-” লতাপু কয়টা ঝাড়ি দিলো?”
এবার লুবমানের মুখটা দেখার মতো হয়েছে। সে অসহায় মুখ বানিয়ে বলে,
-” সেই দুঃখের কথা কি বলি! লতাপু তো এমন রিয়েক্ট করেছে যেন তোর না ওর ননদের সাথে রিলেশনে জড়িয়ে ছিলাম!”
পাতা এবার খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। যেন কিশোরী মেয়ে কোনো মজার কথা শুনে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে! লুবমানও বোনের হাসি দেখে নিজেও হেসে দিলো। তাদের খুনসুটির মাঝে আগমন ঘটে ভোরের। শুধু সে নয় তাঁর পেছনে আদুরিও এসেছে। ভোর এসে পাতার হাত টেনে বলে,

-” আম্মু আব্বু ডাকছে তোমায়! চলো!”
বলে একপ্রকার টেনেই নিয়ে যায়। আদুরি এসে লুবমানের সামনে দাঁড়ালো। লাজুক হেসে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে। লুবমান আশেপাশে একবার দেখে নিল ভালোকরে। না কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। সে খানিকটা এগিয়ে এসে আদুরির উদ্দেশ্যে থেমে থেমে বলে,
-” আই লাভ ইয়ু আদু!”
-” আই লাবু পুপি!”
আদুরি লুব দু’জনে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাদের থেকে একটু দূরে শুধু হাঁফ প্যান্ট পরিহিত রূপ দাঁত বের করে হাসছে! সাথে আনিকাও আছে। সেও মিটমিট করে হাসছে। আদু চোখ রাঙিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এলে দু’জন ভো দৌড়!

ভোর পাতাকে টেনে রুমে নিয়ে আসে। পাতা চুপচাপ পা চালায় কোনো কথা বলে না। ঘরে প্রবেশ করে দেখে ছোট হা করে ভাবনা ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। অরুণ সরকার তাঁর শিয়রে বসে ফোন স্ক্রল করছে। পাতা ভোরের দিকে না তাকিয়ে অরুণ কে জিজ্ঞেস করে,
-” ডেকেছিলেন আমাকে?”
অরুণ পাতার দিকে চায়। পাতার হাত ধরে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেকে দেখতেও ভুলে না।
-” তুমি নাকি ভোরের সাথে কথা বলছো না?বকেছি আমি! তুমি আর রেগে থেকো না পাতাবাহার!”
পাতা ভোরের দিকে চায় না। ভোর কাঁদো কাঁদো গলায় পাতার হাত নাড়িয়ে বলে,
-” ভোর অনেক স্যরি আম্মু। আর হবে না।”

-” আমাকে কেন স্যরি বলছে? আমাকে থোরাই না ছুঁড়ে ফেলেছে! রিমোট ছুঁড়ে ফেলেছে তাকে বলুক না!”
স্বাভাবিকভাবেই বলে পাতা। ভোরের বড় ডাগর ডাগর আঁখি যুগল ভরে ওঠে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। ছেলের নত মুখটা দেখে অরুণের ভালো লাগে না। পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” বকেছি অনেক। রুবিকেও স্যরি বলে নেবে। বিকেল হতে চলল অথচ কিচ্ছুটি খায় নি। রাগ গিলে নিয়ে আদর করে খাইয়ে দাও!”
পাতা এবার ভোরের দিকে চায়। ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে আছে। চোখের পানি নাকের পানি একাকার! পাতা আঁচল দিয়ে মুছে দেয় মুখখানা। ভোর পাতার কোমড় জড়িয়ে কেঁদে দেয় গুনগুন করে। পাতা তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” খেয়ে নিবে চলো!”
-” আম্মু স্যরি আর হবে না। তুমি কথা না বললে ভোরের অনেক কষ্ট হয়।”
-“হুম। হয়েছে কান্নাকাটি! নিচে চলো!”

ভোরের হাত ধরে নিয়ে যায় পাতা। অরুণ তাদের প্রস্থান দেখে অপলক। ছেলের মাঝে সে নিজ সত্তার খন্ডাংশ দেখতে পায় মাঝে মাঝে। তবে ছেলেকে সামলাতে; ছেলের ভুল ধরিয়ে আগলে নেওয়ার জন্য পাতাবাহার থাকলেও তাকে সামলানোর কেউ ছিলো কি?
ভোর গাল ভর্তি খাবার চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে আর আড়চোখে পাতার দিকে তাকিয়ে আছে। এখনো আম্মু তাঁর সাথে ভালোভাবে কথা বলছে না। ভোর বুঝতে পারে সে এখনো তাঁর উপর রেগে আছে। সে তো স্যরি বলেছে তবুও আম্মু কেন রেগে থাকবে? ভোরের দিকে তাকাবে না? ভোরের যে কান্না পাচ্ছে কষ্ট হচ্ছে আম্মু কি বুঝতে পারছে না? ভোরের গলা দিয়ে খাবার নামতে চায় না। সে পানি দিয়ে গিলে নেয় মুখের খাবার! হাতের পৃষ্ঠে মুখ মুছে নিয়ে অভিমানী গলায় বলে,

-” আম্মু পেট ভরে গেছে আমার। আর খাবো না!”
বলেই চেয়ার থেকে নেমে বড় বড় পা ফেলে চলে যায়। পাতা পিছু ডাকলেও শোনে না। পাতা হতাশ হয়ে প্লেট নিয়ে ভোরের পিছু ছোটে!

মেহমান বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছে। বাড়িতে বাচ্চাদের হৈচৈ লেগে আছে। রূপ, আনি মায়ের ফোন নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। ছোট নয়ন ঝগড়া দেখে হাসে খিলখিলিয়ে। হাতে তার রূপের দেয়া চকলেট। এরইমধ্যে ভোরের জন্য এক বাটি নুডুলস নিয়ে আসে মিনু। বাচ্চাটা অনেকদিন পর আবদার করে ‘মিনু খালা ইয়াম্মি নুডুলস বানিয়ে দাও প্লিজ?’ মিনু সব কাজ ফেলে আগে নুডুলস বানিয়ে এনেছে। ভোর খুশি হয়ে গপাগপ মুখে পুরে বলে,
-” অনেক টেস্টি হয়েছে! থ্যাঙ্ক ইয়ু মিনু খালা!”
নয়ন মা’কে দেখে এগিয়ে আসে। ভোরের বাটির দিকে ইশারা করে বলে ‘ মা থাবু?’ ভোর বুঝতে পারে না তাঁর কথা। সে হেসে বলে,

-” কি বলে তোমার ছেলে? থাবু আবার কি?”
-” কিছু না ভোর বাবা! তুমি খাইয়ে নেও জলদি!”
বলে মিনু ছেলেকে নিয়ে চলে আসে। নয়ন কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, ‘উ থাবু!’ ! মিনু ছেলের গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” আব্বা আপনাকে অন্য দিন বানাইয়ে দিবো তহন খাইয়েন!”
নয়ন লক্ষী ছেলের ন্যায় মাথা কাত করে সায় জানালো। হাতের মুঠোয় থাকা চকলেট মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ইশারায় বলে ছিঁড়ে দিতে। মিনু ভ্রু কুঁচকে বলে,
-” আপনে চকলেট পাইলেন কই?”

ছোট নয়ন আঙ্গুল উঁচিয়ে ‘উ’ বলে। মিনু বুঝতে পারে নিশ্চয়ই এটা রূপের। সে ছেলেকে নামিয়ে দিয়ে বলে,
-” যান চকলেট দিয়ে আইসেন? আপনের আব্বারে বইলবো নে আপনেরে এতো গুলো চকলেট আইনে দিবে! যান?”
ছোট নয়ন মাথা নাড়িয়ে চলে যায় গুটি গুটি পায়ে। সোফায় চকলেট রেখে ছুটে আসে মায়ের কাছে। মিনু ছেলেকে কোলে নিয়ে রুমে চলে গেলো। ছোট একটা বৈয়াম থেকে বিস্কুটের প্যাকেট বের করে ছেলের হাতে দেয়। নয়ন নেড়েচেড়ে দেখে ছুঁড়ে ফেলে। বিছানায় মুখ ফুলিয়ে শুয়ে থাকে। মিনু ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে ডাকে।মিনু শঙ্কায়; ধনীর দুলাল দুলালীদের সাথে থাকতে থাকতে ছেলের চোখটা যেন বড় না হয়‌। তাদের বিলাসী জীবন দেখে ছেলেটা খেই না হারিয়ে ফেলে।গরীবের ঘরে জন্ম নিয়ে যেন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন না দেখে! ভুলে যেন না বসে সে কাজের লোকের ছেলে! ভয় হয় মিনুর! তাই তো ছেলেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে।

ভোর নুডুলস খাচ্ছে সানন্দে। সাথে মনোরঞ্জনের জন্য আনিকা ও রূপের ফোন নিয়ে কাড়াকাড়ি ঝগড়া। আনিকা সপাটে দুটো মারছে ; রূপও কম নয়। সে আনিকার চুল টেনে ধরে তো কামড় বসায়। রুবি দৌড়ে এসে দু’টোকেই ধমক লাগায়। ব্যস আনিকার কান্না শুরু; সে কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে চলে যায় নালিশ জানাতে। রূপ এদিকে দাঁত বের করে হাসছে। রুবি তাঁর গালে আলতো চর দিয়ে বলে,
-” রূপ তুমি একটা মিনি শয়তান! সবসময় আপুর পিছনে লেগে থাকো। দুষ্টু হচ্ছো দিন দিন! আগে লক্ষী ছেলে ছিলে!”
‘আগে হুলো বিড়াল ছিলো এখন বাঁদর হয়েছে’ মনে মনে বিড়বিড় করে ভোর! নুডুলসের বাটি পাশে রেখে মিনমিনে গলায় বলে,

-” চাচিমনি একটু পানি এনে দিবে? প্লিজ?”
রুবি অবাক হয়ে চায় ভোরের দিকে। সে কি ঠিক শুনলো? ভোরও অস্বস্তিতে পড়ে। সে হাত বাড়িয়ে বলে,
-” রূপকে আমার কাছে দাও! আর তুমি পানি আনো!”
রুবি অবাক হলেও ভোরের কথায় খুশি হয়। কতদিন পর কথা বললো তাঁর সাথে! সে রূপকে ভোরের কাছে বসিয়ে পানি আনতে যায়। রূপ ভোরের পাশে বসে বলে,
-” ভুল ভাই তুমি চললেতের মতো মিসতি!”
ভোর ভেংচি কাটলো তার তেলে ভাজা কথায়। সে এক চামচ নুডুলস রূপের মুখে দিলে রূপ খুশি হয়ে বলে,
-” আই লাবু ভুল ভাই!”
ভোর হেসে দেয় এবার। রুপের গাল জোড় টেনে বলে,
-” আমার নাম ভোর সরকার! বলতেও পারিস না। বলতো তোর নাম কি?”
-” লুপ!”

বলে আবার হাসে সবকটি দাঁত দেখিয়ে। রুবি আসে পানির গ্লাস সমেত। ভোরকে রূপের মুখে নুডুলস দিতে দেখে খুশি হয়। এটা নিশ্চয়ই বড় ভাবীর জাদু! সে ভোরের অপর পাশে বসে ভোরকে পানি খাইয়ে দিয়ে রূপকেও পানি খাওয়ায়। এর মাঝেই আরিয়ান আসে মেয়েকে কোলে নিয়ে। এসেই উঁচু গলায় বলে,
-” কার এতো বড় সাহস আমার মেয়েকে ধমক দেয়? হুম? ছেলে মারবে আর ছেলের মা বকবে? তা তো হবে না।‌বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিবো দুজনকে!”
ভোর ছোট ছোট করে চায়। রূপ জিভে কামড় দিয়ে দু হাতে মুখ লুকিয়ে নেয়। রুবি আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বরফ শীতল গলায় বলে,

-” রেখে আসো। সেটাই ভালো হবে। মানুষের খোঁচা মেরে কথা শুনতে শুনতে কান পচে গেলো!”
আরিয়ান মেয়েকে নিয়ে অন্য সোফায় বসে বলে,
-” এমন কাজ করো কেন যে লোকের পিঞ্চ মেরে কথা বলতে পারে!”
-” রুবি লোভী হিংস্র! তোমরা তো দুধে ধোয়া তুলসী পাতা। একেক জন ফেরেশতা!”
অবজ্ঞার সুরে বলে রুবি। আরিয়ান তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চায়। ভোর চুপচাপ দুজনকে লক্ষ্য করছিলো। রূপ এখনো দুই হাতে মুখ ঢেকে। মাঝে মাঝে আঙুলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। ভোর বড়দের মতো করে বলে,
-” চাচ্চু? চাচি মনি তোমরা ঝগড়া করছো কেন? চাচিমনির তো কোনো দোষ নেই। আনি আর রূপ ঝগড়া করছিলো। চাচিমনি দু’জনকেই বকা দিয়েছে। আমি এখানেই ছিলাম। সব দোষ পঁচা আনি বুড়ির ও রূপকে অনেক মেরেছে!”
আনিকা রাগি রাগি চোখে ভোরের দিকে চায়। ভোর জিভ বের করে ভেঙায়। আনিকা বাবার কোল থেকে নেমে ভোরের কাছে যায়। আরিয়ান বড় বড় করে চায়। তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ লেগে না যায় আবার। আনিকা ভোরের কোল থেকে নুডুলসের বাটি তুলে নিয়ে বাবার কোলে বসে বিড়বিড় করে নুডুলস মুখে পুরে। ভোর কটমট করে চায়।‌বেয়াদব আনি! তাকে বললেই সে দিতো! এভাবে কেড়ে নিতে হবে? রুবি উঠে বলে,

-” আনি এভাবে কেউ নেয়? ভোর তুমি কিছু মনে কোরো না আমি এখুনি বানিয়ে এনে দিচ্ছি!”
ভোর তাঁর হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বলে,
-” না! আমি খাবো না। তুমি এখানে বসো। ভোর স্যরি হ্যাঁ? আর হবে না!”
সুযোগ বুঝে স্যরি বলে দেয় ভোর। এখন তো আম্মু আর রেগে থাকবে না। রুবি ভোরের গাল দুটো টেনে কপালে চুমু দিয়ে বলে,
-” চাচিমনিও অনেক স্যরি! অনেক কথা শুনিয়ে ছিলাম! আমি সত্যিই অনুতপ্ত ভোর! তোমার এই পঁচা চাচি মনিকে মাফ করে দিও?কেমন?”
ভোরের অধর জুড়ে মিষ্টি হাসি খেলা করে।
-” ভোর লাভস ইয়ু চাচি মনি!”
-” মি ঠ্যু!”
বলে আরেকটা চুমু দেয় রুবি! আনিকা গাল ভর্তি নুডুলস নিয়ে বলে,
-” আনি হেইটস ইয়ু পঁচা ভোর!”
-” ভোর হেইটস ইয়ু ট্যু আনিবুড়ি!”

আরিয়ান হতাশ দু’জনের কান্ডে। এদের মধ্যে ভাব অতি দূর্লভ! ক্ষণে ক্ষণে দেখা মিললেও সেটা তাঁর স্থায়িত্বকাল নগন্য! এরই মাঝে আসমা বেগম আদুরির আগমন ঘটে। আদুরির চোখ মুখ উজ্জ্বল হলেও আসমা বেগমের মুখা মলিন। সে চুপচাপ বসে মিনুকে ডেকে চা দিতে বলে। আদুরি মিনুকে মানা করে নিজেই যায় কিচেনে। সময় নিয়ে সবার জন্য চা বানিয়ে আনে। রুবি চায়ের কাপ হাতে তুলে হেসে বলে,
-” আমাদের আদু দেখছি শশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে! ভালো ভালো!”
আদুরি লাজুক হেসে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। মায়ের হাত মাথায় রেখে বলে,
-” মা তুমি রেগে আছো আমার উপর? তুমি এভাবে মলিন মুখে থেকো না। আমার ভালো লাগে না। তাঁর থেকে বরং মানা করে দিতে!”
আসমা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” যেদিন মা হবি সেদিন বুঝবি! দোয়া করি ভালো থাক সুখী থাক! দুঃখের ছিটেফোঁটাও যেন ছুঁতে না পারে আমার চোখের মনি’কে!”
আদুরি মায়ের কোলে মুখ গুঁজে কেঁদে দেয়। আসমা বেগম হেসে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আরিয়ান উঠে এসে মায়ের আরেক পাশে বসে বলে,
-” অবশেষে আমাদের বাড়ি থেকে পেত্নির বিদায় হবে! পুরো বাড়ি জুড়ে শান্তি আর শান্তি!”
আদুরি কান্না গিলে নিয়ে ভাইয়ের উপর হামলা চালায়। দুই ভাই বোনের খুনসুটিতে ড্রয়িংরুম মেতে ওঠে। তন্মধ্যে অরুণ সরকারের আগমন ঘটে। কোলে ঘুমন্ত মেয়ে! পাতা তাঁর পেছনে লাগেজ হাতে। আরিয়ান কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-” ভাই ডোন্ট সে এখন বাড়ি যাচ্ছো তোমরা! কোথাও যাচ্ছো না আজ। আজ কেন? কাল‌ পরশু কখনোই না‌। আজ থেকে এখানেই থাকছো!”
অরুণ কিছু বলবে এর আগে আসমা বেগম বলেন,

-” অনেক অভিযোগ আমার উপর তাই না অরুণ? ক্ষমা চাওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই আমার! তবুও একটা আবদার করছি! থেকে যাও অরুণ! তোমার বাবা সবসময় চাইতেন মিলেমিশে থাকো তোমরা! প্লিজ অরুণ?”
পাতা অরুণের দিকে চায়। সেও চায় এখানে থেকে যেতে। ভরা সংসার রেখে আলাদাভাবে থাকতে কার ভালো লাগে? পাতা অরুণের শক্ত পোক্ত খসখসে হাত মুঠোয় নিয়ে অনুনয় করে বলে,
-” থেকে যাই না? এটাই তো আমাদের বাড়ি! প্লিজ?”
অরুণ শান্ত চোখে তাঁর দিকে চায়। ভোরও আগ্রহী চোখে চেয়ে। বাবা কি থেকে যাবে? সকলেরই দৃষ্টি অরুণে নিবদ্ধ। আদুরি ভাইয়ের কাছে এগিয়ে এসে বলে,
-” বড় ভাইয়া প্লিজ? তুমি, বড় ভাবী, ভোর আমাদের ছোট্ট অরুণিতা ছাড়া আমাদের বাড়ি অসম্পূর্ণ। থেকে যাও না?”
অরুণ মেয়েকে পাতার কাছে দিয়ে আদুরির কাঁধ জড়িয়ে নরম গলায় বলে,
-” ভালো থাকিস। ছোট মা’র খেয়াল রাখিস! আমাদের দেড়ি হচ্ছে। রাত অনেক হয়েছে এবার ফিরতে হবে! আবার আসবো তোর বিয়ের সময়।”

আদুরি কাঁধ থেকে ভাইয়ের হাত ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে চলে যায়। আরিয়ানও ব্যতিক্রম নয়। পাতার উজ্জ্বল মুখখানি মলিন হয়ে আসে। লোকটা এমন কেন? সবাই কত করে অনুরোধ করছে! তারপরও মানা করে দিলো? কতটা অনুভূতি হীন লোক। পাতাকে কেউ একবার অনুনয় করলে পাতা গলে যায়। না বলতে তাঁর কন্ঠরোধ হয়ে যায়। আর এই নির্দয় লোক সকলের হাজার বার অনুরোধের পরও একফোঁটা গলে নি। গলবে কিভাবে? এতো বরফ নয় এ যে শিলাখণ্ড! অরুণ বাকি সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা হয়।
গাড়িতে পিনপতন নীরবতা বিরাজমান! অরুণ সরকার দক্ষ হাতে ড্রাইভিং করছে। ফ্রন্ট সিট ফাঁকা। পাতা ও ভোর পেছনে বসে। দু’জনেই চুপচাপ। শুধু ছোট ভাবনা ‘আ উ ভু ভু’ শব্দ করছে। পাতা মেয়েকে কোলে নিয়েই সিটে গা এলিয়ে চোখটা বুজে নিয়েছে। মাথাটা ভো ভো করছে তাঁর। ভোর আড়চোখে আম্মুকে পর্যবেক্ষণ করছে। সে চাচি মনিকে স্যরি বলেছে ভাবও করে নিয়েছে! আম্মুকে কি বলবে? বললে আম্মু নিশ্চয়ই খুশি হবে। সে মিনমিনে স্বরে ডাকে,

-” ও আম্মু? ঘুমিয়ে পড়েছো?”
-” উঁহু! কি হয়েছে? কিছু বলবে?”
পাতা চোখ বুজেই জবাব দেয়। ভোর ভাবনাকে নিজ কোলে নিয়ে বলে,
-” আমি চাচিমনিকে স্যরি বলেছি! তাঁর সাথে ভাবও করে নিয়েছি!”
-” ভালো!”
-” তুমি এখনো রেগে আছো আমার উপর? ভোর স্যরি তো!”
পাতা এবার সোজা হয়ে বসে। ভোরের দিকে ছোট ছোট চোখে চেয়ে বলে,
-” আমি রেগে আছি এইজন্য চাচি মনিকে স্যরি বলেছো? সত্যিটা বলবে!”
ভোর একবার উপর নিচ মাথা নাড়ে তো একবার ডানবাম। আম্মু তাঁর উপরে রেগে ছিলো! কথা বলছিলো না তাই সে চাচিমনিকে স্যরি বলেছে। আম্মু না রাগলে কি সে চাচি মনিকে স্যরি বলতো? কি জানি! পাতা শান্ত চোখে চেয়ে থাকে। ভোর কাঁচুমাচু করে বলে,

-” ও আম্মু! তুমি না ভোরের মিষ্টি আম্মু! ভোর তোমাকে অনেক আদর করে দেবে! ও আম্মু। আই লাভ ইয়ু!”
না চাইতেও পাতার অধর জুড়ে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। এতো আদুরে বাচ্চা এতোটা আদর মেখে কথা বললে তার উপর অভিমান করা যায়? পাতা তো পারে না। এরা বাবা ছেলে তাকে পাগল তো বানিয়ে ছাড়বে। পাতা কিছু বলবে এর আগে অরুণের গলা ভেসে আসে,
-” এই পাতাবাহার? তুমিই তো বলো বাচ্চা ছেলে! ভুল করবে আবার সুধরেও নিবে। ভুল করেছে স্যরিও বলেছে তো!”
তাকে থামিয়ে পাতা তেজি গলায় বলে,

-” আপনি চুপ থাকুন! নিজে যখন বকেন অন্য কারো কথা কানে নেন? সবের নাটের গুরু আপনি। ভোর বাচ্চা ছেলে। আর বাচ্চারা বড়দের দেখে দেখে শেখে। আপনার ওই নাক উঁচু স্বভাব দেখেই অবুঝ বাচ্চা শিখছে। তাই ভালোয় ভালোয় সুধরে যান নইলে কাঁচি দিয়ে উঁচু নাকটা আমি কেটে দিবো বলে দিলাম!”
অরুণ যেন নিজ কানকেই বিশ্বাস করতে পারে না। সত্যিই ঝাড়িটা তাকে দিলো? তাও পাতাবাহার? এতো সাহস!! ভোর খিলখিলিয়ে হেসে বলল,
-” আম্মু সব আব্বুর দোষ! তুমি বরং আব্বুকে বেশি করে বকে দাও!”
অরুণ ভিউ মিররে ছেলের দিকে চায়। বাহ্ যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর! তাঁর কাছে কেঁদে কেটে গঙ্গা যমুনা বইয়ে এখন তাকেই ফাঁসিয়ে দেয়া হচ্ছে। পাতা ভোরের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” তুমিও কম যাও না ভোর! এইটুকুন শরীরে এতো রাগ জেদ আসে কোথা থেকে শুনি? বাবা ছেলে রাগে জেদে কানায় কানায় পূর্ণ! আরেকটা এসেছে এনার ছোট থেকেই জেদ; বড় হলে বাবা ভাইকেও ছাড়িয়ে যাবে! আমার সামনে রাগ জেদ দেখালে চাপকে দিবো একটা !”
ভোর গাল ফুলিয়ে বোনের গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” আমাকে বকো! আব্বুকে বেশি করে বকো! বনুকে বকবে না। আমার বোন সবচেয়ে মিষ্টি বোন! একদম তোমার মতো!”
পাতা ভোরের গাল টেনে বলে,

-” ওলে আমাল বোন পাগল ভাইলে! বাবা ও তাঁর দুই চেলাকে উত্তম মধ্যম দিলেই তোমাদের ঘার ত্যাড়ামি ঠিক হবে!”
ভোর গাল ফুলিয়ে বাবার দিকে চায়। অরুণ আড়চোখে পাতার দিকে চায়। মহারানীর মুখে খই ফুটেছে! পাতা আবারো চোখ বুজে সিটে গা এলিয়ে দেয়। ভোর বোনকে কোলে নিয়ে পাতার গা ঘেঁষে বসে! পাতা হেসে দেয়। ভোরকে জড়িয়ে টপাটপ আদর করে।

ভোর কম্ফোর্ট গায়ে বিছানায় শুয়ে আছে। পাতা তাঁর রুমের এলোমেলো খেলনা, ক্রিকেট সরঞ্জাম গুছিয়ে রাখে। এলোমেলো কাপড়চোপড় গুছিয়ে নেয়। বেলকনির দরজা ভালোভাবে লাগিয়ে বিছানায় বসে। এখন আদুরে ছানাকে একটু আদর করা যাক! সারাটা দিন দূরেই ছিলো তো! পাতা ভোরের কপালে চুমু দেয়। ভোর মুচকি হেসে বলে,
-” গুড নাইট আম্মু। হ্যাভ আ সুইট ড্রিম!”
পাতা একহাতে তাঁর ফুলো গাল জোড়া আলতো করে চেপে ধরে। লাল টকটকে অধর জোড়া ফুলে ওঠে। পাতা দুই গালে থুতনিতে নাকের ডগায় চুমু দিয়ে বলে,
-” আমার সোনা ছেলেটা! এতো আদুরে! তুমি ঘুমিয়ে পড়ো আমি এখানেই আছি!”

ভোর যেন হাতে চাঁদ পেল! সে একটু সরে জায়গা করে দেয়। পাতা তার কম্ফোর্টে ঢুকতেই ভোর আস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল তাকে।পাতাও হেসে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। একটু পরেই ভোর ঘুমিয়ে যায়। তাঁর ঘুম গাঢ় হতেই পাতা আস্তে ধীরে ভোরের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে পড়ে। ভোরের কপালে চুমু দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দেয়। ফেইরি লাইট জ্বালিয়ে দরজা চেপে দিয়ে নিজ রুমে প্রবেশ করে। রুমে ঢুকেই দেখতে পায় বিছানার একপাশে হা করে ঘুমিয়ে আছে তাঁর মেয়েটা। আর তাঁর পাহারা দার তাঁর পাশে বসে ল্যাপটপের মাঝে ডুবে আছে! পাতা ওয়াশ রুম থেকে ঘুরে আসে। অরুণের তরফ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পায় না। যেন ঘরে কেউই নেই!সে রেগে বেলকনির দরজা লাগায় ধরাম করে । শব্দে ছোট ভাবনা ঘুমের মাঝেই কেঁপে ওঠে। অরুণ মাথা তুলে চায়। ল্যাপটপের সাটার ওফ করে বলে,

-” কার রাগ কোথায় খাটালে? বেচারা দরজাটার অভিশাপে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছো পাতাবাহার! আহারে আমার গুলমুলু বউটা! আই মিসড হার!”
পাতা যেন ফুঁসে ওঠে। অসভ্য বর্বর লোক! সবসময় তাঁর মজা উড়ানো। তাকে ক্ষেপিয়ে নিজে মজা নিবে। পাতা নিজেকে শান্ত করে; কিছুই বলবে না সে। অরুণ মুচকি হেসে পাতার দিকে চায়। পাতার অসহ্য লাগে হাসিটা। সে দাঁত কটমট করে। অরুণ কম্ফোর্টে নিজেকে আবৃত করে বলে,
-” ওভাবে তাকাচ্ছো কেন? আমার বুঝি ভয় করে না! আজ গাড়িতে যে ঝাড়িটা দিলে! ট্রাস্ট মি ভয়ে আমার লোমকূপ খাড়া হয়ে ছিলো। এতো আদর করে মিষ্টি করে কেউ বকে নি আমাকে!”
বলেই হেসে ওঠে হালকা শব্দে। পাতা রাগের পারদ মাত্রা তরতরিয়ে বেড়ে যায়। সে থমথমে মুখে বিছানায় গা এলিয়ে লাইট অফ করে দেয়। একটু পর অনুভব করে কেউ তাকে ধীরে ধীরে নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে। একসময় নিজ বাহুবন্ধনে আটকে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

পাতা বাহার পর্ব ৫৮

-” এই পাতাবাহার? অমানিশায় প্রজ্বলিত প্রদীপের শিখা হয়ে নিকেতন আলোকিত করার জন্য ভালোবাসি!”
অন্ধকারে অরুণের দাঁড়ি গোঁফ ঢাকা কপোল দ্বয় বুলিয়ে ললাটে অধর ছুঁয়ে বলে,
-” এই ভাগ্যটা আপনার অতি প্রসন্ন জানেন? ভাগ্য করে একটা বউ পেয়েছেন। আপনার উচিত তাকে মাথায় তুলে রাখা!”
-” আসো মাথায় তুলি?”
-” আছাড় মারার জন্য?”
-” আদর করার জন্য!”
পাতা কিছু বলতে পারে না আর। তাকে বলার সুযোগ দেয়া হয় নি!

পাতা বাহার পর্ব ৬০