পারমিতা পর্ব ৯

পারমিতা পর্ব ৯
Nabila Ahmed

নিজের রুমে বসে আছে পারমিতা। ডাইনিং রুম থেকে অরিয়ন উঠে চলে যাওয়ার পর শায়লাকে দিয়ে খাবার পাঠালেও তা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে অরিয়ন। নিজের রুমে আসার সময় ও অরিয়নের রুমের দিকে তাকালে লাইট অফ করা দেখতে পেয়েছে মিতা।
“তোমাকে এভাবে দেখলে কেনো আমার এতো কষ্ট হয়?” নিজের মনে মনে ভাবে মিতা।
আধা ঘণ্টা ধরে বিছানায় শুয়ে থাকলেও মিতার চোখে যেন ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই। এপাশ-ওপাশ হয়ে নড়েচড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ মিতা। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দাঁড়ায় বেলকনিতে। নভেম্বরের শেষের দিকে রাত হলেই হালকা হালকা শীত পড়তে শুরু করেছে। শরীরে শীতের পরশ অনুভব করতেই পরণের ওড়না দিয়ে নিজেকে যতোটা সম্ভব ঢেকে রাখার চেষ্টা করে মিতা।

চারপাশ পুরো অন্ধকার। এতো রাতে সকলেই ঘুমাতে ব্যস্ত কিন্তু ঘুম নেই মিতার চোখে, শান্তি নেই মনে। “অরিয়ন ভাইয়ার ও কি একই রকম অস্থিরতা কাজ করে?” হুট করেই ভাবে মিতা। ইদানীং মিতার সব চিন্তা ভাবনা যেন অরিয়ন থেকে শুরু আর অরিয়নেই শেষ হচ্ছে। কতক্ষণ এই ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে ছিলো মিতা তা জানেনা শুধু জানে এই রাতের আকাশটা কিছুটা হলেও মনটা শান্ত করেছে মিতার।
রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ফিরলেই দেখতে পায় অরিয়ন নিজের বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকার হওয়াতে আশেপাশে না তাকিয়ে সরাসরি তাকিয়ে আছে অরিয়ন। হঠাৎ করে অরিয়নকে দেখেই যেন বুকের মধ্যে কেমন করে উঠলো মিতার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিজের বাম হাত মুখের কাছে নিয়ে লাইটার ধরাতেই বুঝতে পারছে নিকোটিনের ধোঁয়ায় নিজের অস্থিরতা কাটাতেই এসেছে অরিয়ন। সি*গারেট ধরিয়ে টানতে থাকা অরিয়ন লক্ষ্য করেনি দূর থেকে কেউ একজন সব কিছু দেখে যাচ্ছে। বেলকনির রেলিংয়ে নিজের হাত দিয়ে নিচের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে অরিয়ন। কিছু একটা ভেবে আকাশের দিকে তাকায়।
অরিয়নের আকাশের দিকে তাকানো দেখে মিতার বুকের মধ্যে এক অজানা ভয় কাজ করছে।
“কি ভাবছো তুমি?” আগ্রহ নিয়ে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে থেকে একটু এগিয়ে যায় মিতা। কিছু একটা ভেবে অরিয়ন রুমে যেতে নিতেই মিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পায়।
এই শীতের রাতে অন্ধকারে কারো সাথে কারো চোখাচোখি হলো না কিন্তু একে অপরের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো মিতা তা জানেনা। শুধু জানে হুট করেই রুমে চলে যায় অরিয়ন।

২ মাস পর।
আফরিন চলে যাওয়াতে অরিয়ন না যতটা কঠোর হয়েছিলো তার থেকে বেশি কঠোর হয়ে গেলো যখন হাবিব চৌধুরী মিতাকে অরিয়নের স্ত্রী হিসেবে মানিয়ে নিতে বললো।
এই দু মাসে অরিয়ন বাড়িতে মাঝেমধ্যে এসে থেকেছে অন্যসব দিন নিজের ফার্মহাউসে কাটিয়েছে। মিতার সাথে দেখা হয়েছে হাতে গুনা ৪/৫ বার।
এই দুই মাসে কেনো মিতা অরিয়নের ঐ কঠোর আর গম্ভীর চেয়ারাটা দেখে প্রতিরাত কান্না করেছে তা মিতা জানেনা। শুধু জানে বিছানায় নিজের গা এলিয়ে দিতেই চোখের সামনে শুধু অরিয়নের সেদিন আকাশের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকাই ভেসে উঠে।

গাড়ি থামতেই গাড়ি থেকে নেমে আসেন গম্ভীর চেহারার হাবিব চৌধুরী। কোনো কথা না বলে সোজা বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়েন।
–অরিয়ন কোথায়??
কাজের ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন হাবিব চৌধুরী।
–স্যার নিজের রুমে।
মাথা নিচু করে জবাব দেয় ছেলেটি।
আর অপেক্ষা না করে সরাসরি অরিয়নের রুমের দিকে চলে যায় হাবিব চৌধুরী।
নিজের রুমে বসে নতুন প্রোজেক্ট এর কাজ করছিলো অরিয়ন। বাড়িতে যাওয়া হয় না আজ ৮ দিন। ৮ দিন ধরে ফার্মহাউসে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে দিচ্ছে অরিয়ন। যদিও আনিকা চৌধুরী প্রতিদিন আসেন আর আবরার মাঝে মধ্যে তবুও যেই উদ্দেশ্যে অরিয়নের এই ডিসিশন নেওয়া সেই কাজটা সফল হলেই হলো।

–অরিয়ন!!
হাবিব চৌধুরী রুমে ঢুকেই চেচিয়ে উঠে।
হঠাৎ করে নিজের বাবাকে দেখে কিছুটা অবাক হলেও তা প্রকাশ করলো না অরিয়ন।
–জি?
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে অরিয়ন।
–এসব কতদিন চলবে?
গম্ভীর কন্ঠে বলে হাবিব চৌধুরী।
–কিসব?
হাবিব চৌধুরীর কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে অরিয়ন।
–কিসব মানে? তোমার এভাবে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া।
বলে হাবিব চৌধুরী।
–আমি কোনো দায়িত্ব এড়িয়ে যাই নি।
অনায়াসে বলে ফেলে অরিয়ন।

–মিতা তোমার দায়িত্ব।
রাগ হয়ে বলে হাবিব চৌধুরী।
–না…ও আমার দায়িত্ব না। ও তোমাদের দায়িত্ব যা তোমরা আমার উপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছো।
চেচিয়ে বলে অরিয়ন।
–ও তোমার স্ত্রী, অরিয়ন।
–যাকে আমি বিয়ে করতে চাইনি বাবা।
চেচিয়ে বলে অরিয়ন।
–অরিয়ন!
হাবিব চৌধুরী ও রেগে গিয়ে চেচিয়ে বলে উঠে।
–কি বাবা? তুমি কি দেখছো না? আমার সাথে সাথে পরীকেও তুমি এসবে জড়িয়ে নিয়েছো? ও মাত্র ১৮ বছরে পা দিয়েছে বাবা। ওর এখন নিজের জীবন উপভোগ করার সময়, অকে কেউ ভালোবাসবে এমন কারো সাথে অর বিয়ে হওয়া উচিত ছিলো..
হাবিব চৌধুরীর সামনে এগিয়ে গিয়ে কথাগুলো বলে থেমে যায় অরিয়ন।

–কিন্তু তুমি অকে আমার মতো একজন ভাঙ্গা আয়নার সাথে জড়িয়ে দিয়েছো,যেখানে ও নিজের চেহারা দেখতে পারলেও আমার ভাঙ্গা দাগটা অর মুখে সারাটা জীবন লেগে থাকবে।
আবারও বলতে শুরু করে অরিয়ন।
–তুমি ভালোই জানো কেনো বিয়ে দিয়েছি তোমার সাথে।
একটু শান্ত কন্ঠে বলে উঠে হাবিব চৌধুরী।
–আমি জানি…আমি জানি। বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো হয়ে গেছে এখন যা করার করো। এসব থেকে আমাদের মুক্তি দেও।
অনুরোধের সুরে বলে অরিয়ন।

–সবকিছু এতো সহজ না অরিয়ন। আর মিতার কথা একবার ভাব…
–পরীর কথা ভেবেই বলছি..আমি অকে মেনে নিতে পারবো না। শি ইজ এ ফা*কং চাইল্ড বাবা।
–ও বাচ্চা না অরিয়ন, ওর মধ্যে আফরিন থেকেও অনেক বেশি ম্যাচুরিটি আছে। আর সব থেকে বড় কথা ও…ও তোকে..
কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায় হাবিব চৌধুরী।
–ও আমাকে??
কি বলতে চাচ্ছে জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে অরিয়ন।
–ও তোর জন্য সব কিছু করতে পারে।
বলে হাবিব চৌধুরী।
–আমি জানি বাবা, তাই বলে আমি তার ফায়দা লুটে নিবো তা তুমি ভেবো না।
জানিয়ে দেয় অরিয়ন।
–আগামীকাল আমার বন্ধু মাহফুজ আহমেদ এর ছেলে নোয়ার বিয়ে। আমাদের সবাইকে যেতে হবে।
বলে হাবিব চৌধুরী।
–হুম।

–যেহেতু সবাই জানে তুমি আর মিতা স্বামী-স্ত্রী তাই তোমাদের এক সাথে যেতে হবে।
হাবিব চৌধুরীর কথা শুনে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই হাবিব চৌধুরী আবারও বলে উঠে।
–ওখানে আমার অনেক বন্ধু, বিজনেস পার্টনার সবাই থাকবে, তাই তোমার আসাটা জরুরি। আশা করছি নিজের বাবার মাথা নিচু করতে দিবে না তুমি।
কথাটা বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে যায় হাবিব চৌধুরী।
রাগন্ত অরিয়ন ল্যাপটপ বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে। দু হাত দিয়ে নিজের চুল টেনে ধরে বলে উঠে –
–পরী।

–বিয়েতে তুমি যাবা??
আবরারকে জিজ্ঞেস করে মিতা।
আবরার বিয়েতে কী পরে যাবে তা ঠিক করছে আর মিতা রুমে রাখা চেয়ারে বসে একটার পর একটা কথা জিজ্ঞেস করছে।
–আমার ইচ্ছার দাম থাকলে আমি তো যেতাম না কিন্তু তাও যেতে হবে।
বলে আবরার।
–ঐ পাগলা তোমাকে আবার মারবে না তো?
কথাটা বলেই খিলখিল করে হাসতে শুরু করে মিতা।
–হাসবি না একদম মিতা।
রাগ হয়ে বলে আবরার।
–আচ্ছা,হাহাহাহাহহাহাহাহাহ।
বলে আবারও হাসতে থাকে মিতা।
–গতবার অকে ছোট ভেবে কিছু বলিনি।
ভ্রু কুচকে বলে আবরার।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ জানি সব।
হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করতে করতে বলে মিতা।
–তুই বসে আছিস কেনো? রেডি হয়ে নে যা। দেরি হলে মা কিন্তু রাগ করবে।
–তাই তো, আমি যাচ্ছি বাই।
বলেই তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে যায় মিতা।

সবাই রেডি হয়ে ড্রয়িং রুমে অপেক্ষা করছে আনিকা চৌধুরীর জন্য। আবরার সাদা পাঞ্জাবি পরেছে, হাবিব চৌধুরী কালো রং এর স্যুট পরেছে। মিতা কপার কালারের শাড়ি আর তার ম্যাচিং জুয়েলারি পড়েছে। কিছুক্ষণ পরেই আনিকা চৌধুরী নিচে নেমে আসেন। পরণে তার কালো শাড়ি।
–চলো তাড়াতাড়ি।
বলে আবরার।
–দাঁড়া, অরিয়নকে আসতে দে।
বলে আনিকা চৌধুরী।
–ভাইয়া? ভাইয়া বাসায়??
প্রশ্ন করে অরিয়ন।
–হুম।

জবাব দেয় হাবিব চৌধুরী।
অরিয়নের নাম শুনেই যেন হুট করেই হার্টবিট বেড়ে গেলো মিতার। নিজের অজান্তেই খোলা চুলগুলো আর শাড়িটা ঠিক করে নিলো মিতা।
একটু পরেই রুম থেকে বেড়িয়ে আসে অরিয়ন। সিড়ি দিয়ে নামতে থাকা অরিয়নকে দেখে যেন কিছুক্ষণের জন্য সব থেমে গেলো মিতার জন্য। কালো পাঞ্জাবি পরা অরিয়নের চুলগুলো জেল দিয়ে পেছনে সেট করা। ডান হাতে ঘড়ি পড়া। এক হাত দিয়ে পাঞ্জাবির অন্য হাতা ঠিক করতে থাকা অরিয়নকে দেখে মনে হচ্ছে সৌন্দর্যের সবটাই যেন অরিয়নকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরক্ষণেই ঘোর কাটে মিতার।
“কি আজেবাজে ভাবছি ” মনে মনে ভাবে মিতা।
–চলো।
সবার সামনে এসে বলে অরিয়ন।
আনিকা চৌধুরী ও হাবিব চৌধুরী আগে আগে হাটা শুরু করলেই পেছনে মিতার কাধে হাত রেখে হাটা শুরু করে আবরার। আবরার আর মিতার পেছন পেছন হাটছে অরিয়ন।

–আমরা এটায় যাচ্ছি, পিছনের গাড়িতে তোরা আয়।
বলে হাবিব চৌধুরী।
–ওকে বাবা।
বলে আবরার।
–আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।
কথাটা বলেই গাড়ি আনতে আবরার চলে যায়।
মিতা নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। আড় চোখে একটু পর পর অরিয়নকে দেখছে। অরিয়ন কিছুক্ষণ মিতার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা ভেবে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
–অরিয়ন ভাইয়া?
আমতা আমতা করে বলে উঠে মিতা।
অরিয়ন কোনো জবাব না দিয়ে মিতার দিকে তাকায়। মিতাও অরিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকে।
–তুমি কি আবার ফার্মহাউসে চলে যাবে?
কি ভেবে কথাটা জিজ্ঞেস করলো তা মিতাও জানেনা। হয়তো কথা বলার একটা বাহানা খুজছিলো মিতা।

–জানিনা।
আনমনে বলে উঠে অরিয়ন।
–ওহ।
অরিয়নের কথায় একটু হতাশ হয়ে বলে মিতা।
–তাড়াতাড়ি আসো, দেরি হলে বাবা রাগ করবে।
গাড়ি নিয়ে এসে বলে আবরার।
আবরারের কথা শুনে গাড়ির দিকে হাটা শুরু করে মিতা।
–পরী!
পেছন থেকে ডাক দেয় অরিয়ন।
–জ্বি?
অরিয়নের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে মিতা।
–সুন্দর লাগছে।
বলে অরিয়ন।

পারমিতা পর্ব ৮

অরিয়নের কথা শুনে কোনো কথা বললো না মিতা। মিষ্টি এক হাসি ফুটে উঠে ঠোঁটের কোণে।
হাসিমুখেই আবরারের সাথে গিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে মিতা।
গন্তব্য নোয়া আহমেদ এর বিয়েবাড়ি।

পারমিতা পর্ব ১০