পিঞ্জিরা পর্ব ১৫
জান্নাত সুলতানা
রিহান এর শরীর থেকে আসমানী রঙের হসপিটালের পোষাক টা খুলতেই থমথম খেলো মিরা। লজ্জায় অস্বস্তি মাথা নত করে। বলিষ্ঠ শক্ত-পোক্ত চওড়া বুক টা ঘন কালো পশম ভর্তি। মিরা’র মাথা ঝিম ঝিম করে।সেকেন্ড সময় এর দেখা সেই দৃশ্য মিরা’র চোখের সামনে এখনো ভাসছে। রিহান মিরা’র অবস্থা দেখে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়ে টার নতজানু করে রাখা মুখের দিকে। মিরা চোখ তুলে না তাকিয়ে বেড থেকে কালো রঙের শার্ট টা হাতে নিয়ে রিহান এর পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে শার্ট টা পড়িয়ে দিলো।বোতাম লাগাতে এসে আরো লজ্জায় মিইয়ে যায় মেয়ে টা।
কাঁপা কাঁপা হাতে বোতাম লাগিয়ে শেষ করে সরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই রিহান ওর হাত টেনে ধরে।হাতের উলটো পিঠে চুমু খেলো। মিরা’র শরীর শিরশির করে উঠলো।রিহান কিছু বলবে তার আগেই হুড়মুড়িয়ে কেবিনে বেশ কয়েকজন প্রবেশ করলো।মিরা চমকে উঠলো।দূরে সরে গেলো রিহান এর কাছ থেকে। অপ্রস্তুত হলো সবাই কে দেখে।আতিক চৌধুরী এসেই রিহান কে জড়িয়ে ধরলোা।রিহান মৃদু হাসলো।বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-“কিছু হয় নি মামা।”
আতিক চৌধুরী রিহান কে জড়িয়ে ধরে রেখেই শুধালো,
-“সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।”
শিশির এসে মিরাকে জড়িয়ে ধরে। কাল রাতেই খবর পেয়েছে সবাই। বিয়ে করেছে রিহান।আতিক চৌধুরী রিহান কে ছেড়ে মিরা’র দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। মিরা অপ্রস্তুত হলো।আগে কখনো এই নেতা সাহেব কে এভাবে সামনা-সামনি দেখা হয় নি।তবে গ্রামে উনার কথা সবাই বলে।বেশ ডাকনাম তার।তাই কিছু টা অস্থির হয়ে পড়লো।কি বলবে কি বলা উচিৎ মনে করতে পারলো না। আতিক চৌধুরী হাসে।মেয়ে টা সহজ-সরল মুখে কেমন মায়া ভর্তি। বাচ্চাসুলভ ভাবটা এখনো যায় নি চেহারা থেকে। এই মেয়ে ভীষণ ভাগবতী। সে জানে এটা? তার ভাগ্নে মেয়ে টাকে কি পরিমাণ ভালোবাসে ধারণাতীত মেয়ে টার।
অধরে হাসির রেখে ফুটে উনার।রিহান আঁড়চোখে দেখলো।মনে মনে অবাক হলো।মামার কত বড় লস করেছে সে।তারপরও মানুষ টার বিন্দু পরিমাণ রাগ ক্ষোভ নেই।আতিক চৌধুরী মিরা’র মাথায় হাত রাখে।
বললো,
-“কালকে আসার ইচ্ছে ছিলো।যা-ই হোক সে-সব কথা বাদ।নতুন জীবনে পথ চলা দীর্ঘ ও সুখময় হউক। সুখী হউ দু’জন।”
মিরা অপ্রস্তুত হাসার চেষ্টা করে। ইফাদ শিশির এর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। আতিক চৌধুরী ইফাদ কে ইশারা করতেই ইফাদ নিজের পকেট থেকে একটা ছোট বক্স বের করে।আতিক চৌধুরীর সামনে খুলে ধরতেই সেটার ভেতর ঝলঝল করে উঠলো এক জোড়া ডায়মন্ড এর চুড়ি।মিরা’র চোখে লাগলো আলো টা।অবাক হয়।শিশির মিরা’র হাত এগিয়ে সামনে আনে।আতিক চৌধুরী সেগুলো মিরা’র হাতে দেয়।মৃদু হেঁসে বলে উঠলো,
-“আমার প্রচুর শখ ছিলো এই ব্যাটার শ্বশুর হওয়ার।আজ বানিয়ে নিলাম।কাল হয়তো খেয়াল করো নি সাক্ষর নামায় মেয়ের দ্বিতীয় বাবা টার নামের যায়গায় আমার নাম ছিলো। ছোট একটা উপহার আমার মেয়ের জন্য।”
মিরা অবাক হলো।এতো দামী উপহার আর বলছে ছোট? কিন্তু মিরা’র এটার থেকেও মনে বেশি দাগ কেটে গেলো “বাবা” শব্দ টা শুনে।কত বছর পর এমন করে মিরা’র সাথে কেউ কথা বললো।মিরা আবেগি হলো।চোখ টলমল করে। আতিক চৌধুরী সেটা দেখে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে মিরা কে।মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
হসপিটালের সব ফর্মালিটি পূরণ করে সকাল নয়টার মধ্যে বেরিয়ে এলো সবাই। আতিক চৌধুরী এসছে ভোরে আবার চলে গিয়েছে আটটার দিকে।সাথে গার্ড নিয়ে আসে নি।শুধু নিজের বিশ্বস্ত এক কর্মচারী নিয়ে এসছে।তাই ব্যাপার টা জানাজানি হওয়ার আগেই তিনি আবার ঢাকা ফিরেছে।
ইব্রাহিম শেখ এসছে। তবে তিনি হসপিটাল থেকে অফিস চলে গিয়েছে।সাথে এখন শিশির আর ইফাদ। গাড়িতে ইফাদ ড্রাইভিং সিটে বসলো।ওর পাশে শিশির। মন না চাইতেও বসতে হয়েছে। কেমন জানি এখন আর আগের মতো পুরুষ টার সামনে থাকতে ইচ্ছে করে না।মানুষ টাকে দেখলে বুকের ভেতর অনল যেন দাউদাউ করে জ্বলে উঠে। আসার সময় বাবা-র সাথে সে পেছনের সিটে বসে ছিলো। তবে এখন সেটা সম্ভব নয়।অগত্যা বাধ্য হয়ে সামনে বসতে হয়েছে। মিরা রিহান কে গাড়িতে বসার জন্য তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে দিতে গিয়ে মাথা দরজার সাথে বেশ জোরেই ধাক্কা লাগলো।মেয়ে টা ব্যথার চোটে নাক লাল হয়।রিহান ক্ষেপে উঠলো।ধমক দিয়ে বললো,
-“মরে যাচ্ছি না আমি।সুস্থ আছি।তোকে কে বলেছে এতো বড়দের মতো ব্যবহার করতে?”
মিরা’র একে-তো ব্যথা পেয়েছে তারউপর রিহান ভাই এর ধমক মেয়ে টার কান্না যেন ভেতর থেকে উপচে পড়তে চাইলো।তবে কান্না করলো না।গাড়িতে বসে মাথা নিচু করে রাখলো।রিহান আঁড়চোখে ব্যাপার টা লক্ষ করলো। তবে পাত্তা দিলো না বিশেষ।বরং নিজের ঘাড় সামন্য কাত করে মিরা’র কাঁধের উপর মাথা রাখলো।আরেক হাতে পেট জড়িয়ে ধরে ঘনিষ্ঠ করে নিজের সাথে মেয়ে টাকে।মিরা চমকে উঠলো।কালকে রাতের সেই ভয়াবহ দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো।রিহান সারারাত তাকে জড়িয়ে ধরে ছিলো।মিরা’র লজ্জায় প্রথমবারের ন্যায় কোনো পুরুষের বক্ষদেশে সারারাত তার একটু ঘুম হয় নি। কতশত কল্পনা জল্পনা করেছে।ভোরের দিকে যা-ও একটু চোখ লেগে ছিলো।তবে নার্স এসে ঔষধ দেওয়ার জন্য ডাকছিল বিধায় ঘুম টা আর হয় নি।
গাড়ি চলছে। রিহান নিজের একটা হাত মিরা’র কোলের উপর রাখা।তার হাতের মুঠোয় মিরা’র এক হাত।
হসপিটাল থেকে শেখ বাড়ি পৌঁছাতে দশ মিনিট এর মতো সময় লাগে। এই পুরো টা সময় রিহান চোখ বন্ধ করে মিরা’র কাঁধে মাথা রেখে ছিলো।শেখ বাড়ির গেইটে গাড়ি থামতেই দু’জন দারোয়ান বড়ো গেইট টা খুলে দিলো।কিন্তু গাড়ি টা রিহান বাড়ির ভেতর নিতে বারণ করলো।শিশির ও ইফাদ দু’জনেই অবাক হয়।মিরা’র তেমন ভাবান্তর ঘটেনা না।যেন এটার জন্য সে আগে থেকে প্রস্তুত ছিলো।শিশির মিরা’র মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করলো।কিন্তু কিছু বুঝতে পারে না।রিহান কে জিজ্ঞেস করলো,
-“মিরা যাবে না আমাদের সাথে?”
-“না।ইফাদ ওকে বাড়ি পৌঁছে দিবে। আপাতত তোরা দু’জন গাড়ি থেকে নেমে পড়।”
শিশির ঘাড় নাড়ে।ইফাদ গাড়ি থেকে নামার আগে রিহান এর হাতে একটা ছোটখাটো শপিং ব্যাগ দিয়ে গেলো।মিরা ততক্ষণে রিহান এর থেকে অনেক টা দূরত্ব বজায় রেখেই বসেছে। রিহান ব্যাগ টা নিয়ে নিজের বা পাশে রাখলো।ফিরে মিরা’র দিকে তাকিয়ে রইলো।মিরা মাথা নিচু করে বসে আছে। রিহান হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসার আগেই মিরা’র সাথে কথা হয়েছে। মিরা এখন নিজেদের বাড়িতে থাকবে।রিহান সুস্থ হলে তবেই মিরা কে শেখ বাড়িতে নিয়ে আসবে রিহান।যদিও রিহান এর তেমন একটা মত ছিলো না।শুধু রমজান শেখ এর কথায় রাজি হয়েছে। বিয়ে টা তার কথামতো হয়েছে। কিন্তু এটা খুব বেশি কেউ বিষয় টা জানে না।তাই অনুষ্ঠান করে আনলেই ব্যাপার টা সুন্দর দেখাবে। রিহান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। মিরা হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে রিহান এর দিকে তাকালো। মেয়ে টার চোখ টলমল করছে।তবে অদ্ভুত বিষয় মেয়ে টা বারবার অধর দাঁত দ্বারা চেপে ধরছে।মনে হচ্ছে কিছু নিয়ে অপ্রস্তুত। ভয় পাচ্ছে। রিহান দুই হাত বাড়িয়ে মিরা’র মুখ টা নিজের হাতের আঁজলে নিলো।ভ্রু উঁচিয়ে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হয়েছে তো,,,”
হঠাৎ কথা স্বর হারিয়ে গেলো।চারদিক থেকে কোনো শব্দ এলো না আর।কান শোঁশোঁ শব্দের সাথে গরম ধোঁয়া বেরিয়ে এলো যেন।নরম অধর ছুঁয়েছ পুরুষ টার সিগারেটে পোড়া অধর।বিষয় টা বুঝতে যেন কয়েক পলক সময় লাগলো রিহান এর।যতক্ষণে বুঝতে সক্ষম হলো ততক্ষণে মিরা নিজের কাজ শেষ করে সরে যাচ্ছিল।কিন্তু সামনে বসা বলিষ্ঠ পুরুষ সেটা হতে দিলো না। দুই হাতে মেয়ে টার কোমড় চেপে ধরলো।এক টানে নিজের কোলের উপর তুলে কিছুক্ষণ আগে মিরা’র অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে ব্যস্ত হলো।পুরুষ টার অধর স্পর্শে মেয়ে টার বেসামাল হলো।মস্তিষ্ক খুব করে এটার জন্য নিজে কে দায়ী করলো।
সেধে সেধে নিজের বিপদ টা যে নিজেই হাতে পায়ে ধরে টেনে এনেছে বুঝতে পেরে নিজের গালে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করলো।শরীর যে এদিকে অবশ হচ্ছে। নিজে কে ছাড়ানোর বিন্দু পরিমাণ শক্তি শরীরে অবশিষ্ট নেই।নিজের স্বামীর এমন রূপ রীতিমতে মিরা’র অন্তরে উতালপাতাল হচ্ছে। কত সময় কাটলো কেউ হিসাব করার মতো অবস্থায় ছিলো না। ছাড়া পেয়ে মিরা’র শ্বাস-প্রশ্বাস এর বেগ দ্রুত হলো।মুখ ঘুরিয়ে বসলো।রিহান স্বাভাবিক। কোনো পরিবর্তন ঘটে নি।ঠিক আগের মতো স্বাভাবিক। শুধু চোখের চাহনি মারাত্মক। মিরা একবার তাকিয়ে ফের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো।রিহান নিজের নিচের অধর দাঁত দ্বারা চেপে ধরে হাত বাকিয়ে পাশ থেকে শপিং ব্যাগ টা নিলো।মিরা’র কোলের উপর রেখে বাহিরের দিকে তাকিয়ে শান্ত অথচ গম্ভীর শোনালো পুরুষ টার কণ্ঠ,
-“তোমার একবার স্বেচ্ছায় ছোঁয়ায় তৃষ্ণা বাড়িয়ে গেলে জান।এখন তোমাকে একান্ত নিজের করে পাবার অপেক্ষার দিন দ্রুত ইতি টানতে হবে।”
মিরা’র দু’টো ঝটকা এক সাথে নিতে পারলো না। থম মেরে বসে রইলো।রিহান আবার বললো,
-“ফোন আছে। সব সেটিংস করাই আছে। কল করলে রিসিভ করবি।”
মিরা কিছু বলার অপেক্ষা করে না।রিহান তার আগেই বেরিয়ে গেলো।ইফাদ এসে গাড়িতে বসলো।চমৎকার একটা হাসি উপহার দিলো মিরা কে।মিরা অপ্রস্তুত হাসলো।ইফাদ গাড়ি স্টার্ট করে।
পিঞ্জিরা পর্ব ১৪
শিশির রিহান কে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলো।সদর দরজায় যেন অপেক্ষা করেই ছিলো সবাই।শিশির রিহান বাড়ির ভেতর গেলো।রিহান গম্ভীর। গিয়ে সোফায় বসলো।শরীর টা দুর্বল লাগছে। মাথা টাও অল্প চিনচিন ব্যথা করছে।তাই চুপ করে চোখ বন্ধ করে নিলো।তাকে ঘিরে সবাই বসলো।কি খাবে শরীর কেমন লাগছে এসব জানতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নিনা বেগম আর রিহান এর ছোট চাচি। শিশির সবার সাথে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে কিন্তু সবার সাথে কথা শেষ সোফায় বসা রিহান এর পাশে তাকিয়ে আচমকাই সবার ভীড়ে শিশির অস্ফুটে ডেকে উঠলো,
-“টাইসন।”