পূর্ণতা পর্ব ৩৫
নন্দিনী নীলা
“ এই দেখি তুমি কি পড়ছ?”
স্মরণের হৃদপিন্ড লাফিয়ে উঠল। টানটান উত্তেজনা নিয়ে পড়ছিল। ওর বুকের ভেতরটা ঢকঢক করে কাঁপছিল। সেই মুহুর্তে কারো আওয়াজ আসতেই চমকে উঠেছে। ও চোখ তুলে দেখে হৈমী ভ্রু নাচিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। স্মরণ ঠাস করে ডাইরিটা বন্ধ করে দিল।
হৈমী কপাল কুঁচকে বলল,“এটা কি হলো তুমি আমায় দেখে ডাইরি পড়া বন্ধ করে দিলে কেন? কি আছে ওতো দেখি? এই ডাইরি কি তুমি তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে লিখছ স্মরণ?”
স্মরণ কর্কশ কন্ঠে বলল,“ এক থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব। তুই এখানে কি করছিস?”
“ আমার প্রশ্ন তুমি করছো কেন? আমি তো তোমায় খুঁজতে খুঁজতে আসলাম কিন্তু তুমি আমার চোখে ফাঁকি দিয়ে এখানে আসলে কখন?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ মাইর খেতে না চাইলে আমার উপর নজরদারি করা বন্ধ কর। তোর কিন্তু অতিরিক্ত বার বেড়েছে।” রাগে ফেটে পড়ল স্মরণ। কত ধৈর্য্য নিয়ে ডাইরি পড়তে শুরু করেছিল এই বেয়াদবটা এসে ব্যাঘাত ঘটাল। রাগে মন চাচ্ছে একে তুলে একটা আছাড় মারতে। ফাজিল কোথাকার।
স্মরণ ডাইরি নিজের রুমে পরতে শুরু করেছিল। কিন্তু ভালো লাগছিল না। তাই উঠে বেরিয়ে দেখে এই বেয়াদব চেয়ার পেতে ওর দরজার সামনে বসে ঘুমাচ্ছে। ওর হৈমীকে দেখে মন চায় চেয়ার সহ উল্টে ফেলে দিতে। নিজেকে সামলে ও ডাইরি নিয়ে বাগান চলে আসে। আর লাইটের নিচে দোলনায় বসে পড়তে আরাম্ব করে।
তারপর কীভাবে সময় গড়িয়ে যেতে লাগে ও জানে না। শুধু জানে দুজনের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল কিন্তু বুকে ব্যথা করছিল। যাকে পাগলের মতো ভালোবাসে তার সাথে আরেকজনের প্রণয় মুহুর্তে ওর অন্তর কেঁপেছে। পূর্ণতা লাল শাড়ি পরে কি প্রভাত কে বিয়ে করতে এসেছিল? তারপর কি দুজনের বিয়ে হয়েছিল?
পূর্ণতার সেই চঞ্চল প্রাণবন্ত মুখটা দেখার জন্য স্মরণের বুকটা ফাঁকা হতে লাগল। ইশ কতই না সুন্দর ছিল সেই মুহুর্ত। প্রভাত খুব লাকি এমন একজন ভালোবাসার মানুষকে পেয়েছিল।
প্রভাত এখন কোথায়? কেন তারা এখন আলাদা? কি হয়েছিল সেই চঞ্চল ছেলেমানুষী পূর্ণতার জীবনে? কেন সে এতো কঠিন হয়ে উঠেছে! তার হৃদয় এ কেন ভালোবাসার স্থান নেই। কেন তার জীবনে প্রভাত নেই?
জানার জন্য মনটা আকুলিবিকুলি করছে। কিন্তু ওর পাশে খাম্বার মতো জহুরী নজর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে হৈমী। ও একটা বিরক্তিকর নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল।
হৈমী চট করেই দুইপা এগিয়ে স্মরণের হাত থেকে টান দিয়ে ডাইরি নিজের হাতে নিয়ে নিল। এবং ডাইরি খুলে বলল,“ দেখি তো কি আছে এই ডাইরি তে? তুমি সব ফেলে রাত জেগে এটায় কি এমন পড়ছ?”
স্মরণ রাগে চোখমুখ রক্তবর্ণ ধারণ করে ফেলল। হৈমীকে কষিয়ে একটা থাপ্পর মারতে পারলে শান্তিতে থাকতে পারত। কিন্তু এই মেয়ে যে শেয়ানা থাপ্পর খেয়ে বাড়ি মাথায় তুলবে। এই মাঝরাতে সবার চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে চায়না স্মরণ।
ও হৈমীর হাত থেকে ডাইরি নিয়ে বলল,“ দেখ আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিস না।”
বলেই স্মরণ গটগটে পায়ে হেঁটে ভেতরে চলে এলো।
সময়টা পরদিন সকালের স্মরণ বিরক্তিকর মুখে বসে আছে বসার ঘরে। সবাই গোল হয়ে বসে আছে। সবার কথার টপিকস হলো স্মরণ ও হৈমীর বিয়ে নিয়ে। স্মরণ না কিছু বলে কাউকে বুঝাতে পারছে। না কিছু করতে পারছে। সবাই চলে যেতেই মায়ের পিছু নিজেও মায়ের রুমে এসে ঢুকল তারপর দরজা আটকে বলল,“ মা প্লিজ এসব বন্ধ করো। আমি কিন্তু আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারছি না।”
“ চুপচাপ সবার সাথে শপিং মলে যাও। হৈমী ও নিজের জন্য বিয়ের ড্রেস পছন্দ করে নিয়ে আসো।”
স্মরণ চট করেই মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ল। মায়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলল,“ মা আমি তোমার পায়ে পড়ছি তুমি আমায় এভাবে শাস্তি দিও না। প্রথমেই যদি তুমি এমন কঠিন আচরণ করতে আমি মানতে পারতাম কিন্তু এ তোমার কোন রূপ আমার মা তো এমন না। তার কাছে সবার আগে তার ছেলে। আমি যেদিন পূর্ণতা কে একা পছন্দ করে বাসায় ফিরে বললাম সবাই দ্বিমত করলেও তুমি আমার পক্ষে ছিলে। আমি তোমার পারমিশন নিয়েই ঢাকা গিয়েছিলাম। আমি এখন আর ফিরে আসতে পারব না মা। তখন তুমি দুটো ধমক দিলেই আমি হয়ত মেনে নিতাম কিন্তু এখন আমি অনেক দূরে চলে এসেছি। পূর্ণতা আমার নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে এ মিলে গিয়েছে। আমি ওকে ছাড়া কিভাবে থাকব? ওকে ছাড়া আমি এক সেকেন্ড থাকতে পারব না মা। ও আমার অক্সিজেন হয়ে উঠেছে। ওকে আমি খুব ভালোবাসি। ওর জায়গায় আমি কাউকে বসাতে পারব না। হৈমী কে তো নয়ই।”
স্মরণের বাবা ইব্রাহিম হোসেন দরজায় ধাক্কা দিতেই স্মরণ দরজা খুলে দিল। উঠে চলে গেল। ইব্রাহিম হোসেন ছেলের যাওয়ার দিকে চেয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন,“ কি হয়েছে?”
সোমা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,“ভালোবাসা মানুষকে পাগল করে দেয়। ছেলেটা পাগল হয়ে উঠেছে। ওই মেয়েটার এতো জেদ আমার ছেলেটা ওকে এতো ভালোবাসে আর মেয়েটা ওকে ফিরিয়ে দিচ্ছে? হৈমীর সাথেই স্মরণ কে বিয়ে দেব আমি। ওই অহংকারী মেয়ের জন্য নিজের ছেলের সুন্দর জীবনটা নষ্ট হতে দেব না।”
ইব্রাহিম হোসেন কিছুই বুঝলেন না স্ত্রীর কথা। ছেলের সাথে তিনি কখনোই বন্ধু হয়ে উঠতে পারেননি। জড়তা তাকে ছেলের থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মা ছেলের মধ্যে সম্পর্ক আলাদা।
স্মরণ মায়ের রুমে থেকে বিক্ষিপ্ত মুখে বের হতেই হৈমী সামনে এসে দাঁড়াল।
এসেই বলল,“ তাড়াতাড়ি চলো বিয়ের শপিং করে আসি। ইশ আমার যে কি আনন্দ লাগছে আর একদিন তাই আমাদের বিয়ে। তুমি আমি আমরা হাজব্যান্ড ওয়াইফ হয়ে যাব।”
খুশিতে ওর চোখমুল ঝলমল করে উঠল। স্মরণ চোখ মুখ আঁধার করে ওকে বলল,“ সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাঙের মতো লাফালাফি বাদ দে। মেজাজ খারাপ হচ্ছে তোকে দেখলে আমার।”
মুখ কালো করে ফেলল হৈমী।
“ তোমার আমার মতো উপযুক্ত মেয়ে পছন্দ নয় কেন বলোতো?”
“ তুই আমার জন্য কোনদিক দিয়েই উপযুক্ত না।”
“ তুমি দেখার মতো চোখ দিয়ে দেখলেই দেখতে পেতে আমি তোমার জন্য কতটা পারফেক্ট। তুমি তো আমায় ভালো করে চেয়েই দেখো না।”
“ এতো যখন বুঝিস চেয়ে দেখি না তাও কেন বিয়ের জন্য লাফালাফি করছিস বলতো? তোর কি আমার মতো একজন কে বিয়ে কথা উচিত যে অন্য আরেকজন কে ভালোবাসে। তোকে পছন্দ করে না। আমাকে বিয়ে করে তুই কষ্ট ছাড়া কিছুই পাবি না।”
হৈমী বলল,“ তবুও আমি তোমাকেই বিয়ে করতে চাই।”
স্মরণ রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ল। ঠাস করে হৈমীকে চর মেরে বসল। হৈমী থাপ্পর খেয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল।
“ তুমি আমায় অযথা মারলে কেন?” কান্নারত কন্ঠে বলল হৈমী।
“ অযথা মারিনি।”
“ কি করেছি আমি যে তুমি আমায় এভাবে মেরে কাঁদিয়ে দিলে?”
“ তোর চরম অপরাধ তুই আমায় বিয়ে করতে বেশি লাফালাফি করছিস। তোর মাথা থেকে বিয়ের ভূত নামা না পর্যন্ত আমার হাতের থাপ্পর খাবি।”
” যতোই মারো আমি তো বিয়ে করেই ছাড়ব।”
“ আয় আরেকটা মারি”
বলেই স্মরণ আমার হাত উঁচু করে নিল। হৈমী লাফিয়ে উঠল। এক দৌড় চলে গেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাপ্পর খাবে এতো বোকা নাকি ও।
জোর করেই স্মরণ কে নিয়ে সবাই শপিং মলে এসেছে। শপিং মলে এসে স্মরণের দেখা হলো দিদানের সাথে। লাস্ট যেবার দেখা হয়েছিল দিদানের স্বাস্থ্য ভালো ছিল। এখন একদম রোগা হয়ে গেছে।
দেখেই স্মরণ এগিয়ে এসে কথা বলল,“ আরে কি অবস্থা ভাই আপনার?”
দিদান চমকে উঠল। গতকাল কেই থানা থেকে ছাড়া পেয়েছে। কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি ছারা পেতে। কিন্তু ছারা পেয়েছে। অনেকদিন পর থানার বন্দিজীবন থেকে মুক্ত পেয়ে একটু ঘুরতে বের হয়েছিল কি মনে করে যেন মলে ঢুকল।
হঠাৎ কারো কথায় চমকে উঠে দেখল মিস্টার স্মরণের হাসিমুখ এ দাঁড়িয়ে আছে।
স্মরণ সেই ছেলে যে আয়রা দেখতে যায় এবং পূর্ণতা বাসা থেকে চলে যাবার পর ও যখন বন্ধুর বাসায় শশীকে নিয়ে দুইদিন থাকতে উঠেছিল হঠাৎ এই লোকটা ওর কাছে ফোন করে। জরুরী তলব করে ওর সাথে দেখা করতে চায়।
দিদান আর স্মরণ একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করে।
দিদানের কাছে স্মরণ পূর্ণতার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে।
“ আপনি মিস পূর্ণতার কি হোন সম্পর্কে?”
খেপে যায় দিদান। পূর্ণতা তখন ওর জীবনের বড়ো সমস্যা ছিল। ওর জন্যে ওকে বাসা থেকে বিতারিত হয়ে হয়েছে। রাগে ওর চোখমুখ কঠিন হয়ে আসে।
ওর চেহারা দেখে স্মরণের কপাল কুঁচকে বলে,“কোন সমস্যা?”
“ জি না কেন তার খোঁজ নিয়ে কি করবেন?”
স্মরণ অকপটে বলে দেয়,“ বিয়ে করব?”
দিদান বিস্মিত কন্ঠে বলে,” মানে? আপনার তো আমার ভাগ্নির সাথে সমন্ধ হওয়ার কথা..!”
” সেটা তো আমি মানা করে দিয়েছি। আমি মিস পূর্ণতা কে বিয়ে করতে চাই। শুনলাম আপনি তার খালাতো ভাই।”
দিদান বিমূঢ় হয়ে বলল,“ খালাতো ভাই?”
“ হুম আপনার আম্মু বলেছে। তার বোনের মেয়ে পূর্ণতা।”
দাঁতে দাঁত চেপে দিদান বলল,“ মিথ্যা বলেছে আপনাকে। এই মেয়ে আমার কিছুই হয়না।”
“ হোয়াট মিথ্যা কেন বলছেন? দেখুন আমি আপনার খালাতো বোনের সাথে প্রেম করার জন্য ঘুরছি না। আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।”
“ মিথ্যা বলব কেন? পূর্ণতা আমার কোন খালাতো বোন না। সে আমার এক্স ওয়াইফ। গতকাল পূর্ণতার সাথে আমার ডিভোর্স হয়েছে।” এক দমে বলে থামল দিদান।
চমকে উঠল স্মরণ। চোখ ভরা ফুটে উঠল চরম বিষ্ময়। কথা বলায় যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। এতোক্ষণ কত কথাই না বলছিল। দিদান দেখতে পেল তার চোখের সেই চঞ্চলতা দূর হয়ে গেছে। চোখেমুখে ফুটে উঠেছে অবিশ্বাস।
“ আপনি আমার সাথে জোকস করছেন কেন ভাই?”
থমথমে কন্ঠে বলল দিদান,“ আপনার সাথে মিথ্যা কথা বলে আমার কি লাভ বলেন তো?”
” জানি না।” দূর্বল সুরে বলল স্মরণ।
দিদান বলল,“ ওই মেয়েকে বিয়ে করলে লাইফ বরবাদ হয়ে যাবে আপনার। আমার লাইফ থেকে তো গেছে কিন্তু আমাকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। ওই মেয়ের জন্য মা আমাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে এখন বউ নিয়ে রাস্তায় ঘুরছি।”
“ মিস পূর্ণতা আপনার বউ হলে, আরেক বউ কোথা থেকে আসলো?” আকাশ থেকে পরে বলল।
থতমত খেয়ে গেল দিদান।
স্মরণ বলল,“ বলুন।”
দিদান বলল,“ আসলে পূর্ণতার সাথে বিয়েতে আমি রাজি ছিলাম না। অনেক দিন ধরেই শশী মানে আমার বর্তমান স্ত্রী ওর সাথে সম্পর্ক ছিল। দুজনে একসাথে বিদেশে যাওয়ার পাসপোর্ট ঠিক করি। হঠাৎ মা বিয়ে ঠিক করে ফেলে আর পূর্ণতার সাথে এক প্রকার জোর করেই বিয়ে দেয়। বিয়ে রাতে ওকে আমি স্পর্শ অব্দি করিনা। সকাল হতেই ব্যাগ প্যাক করে ফ্লাইট আজকেই বলে চলে আসি। আসলে আমার আরো দুইদিন পর ফ্লাইট ছিল কিন্তু বাসায় মিথ্যা বলি।
পূর্ণতা পর্ব ৩৪
তারপর পাঁচবছরে শশীকে অনেক ভাবে বিয়ে করতে চাই। ও রাজি হয়না এইদিকে আমি ওখানে একটা বিদেশির সাথে সম্পর্ক এ জড়িয়ে পরি। তারপর থেকে শশী আমাকে খুব চাপে রাখে। ওকে খুব ভালোবাসতাম, সবকিছুতে ভালোবাসা খুঁজে পেতাম। বাংলাদেশ আসার সব ঠিক হতেই শশী আমায় বলে বাসায় গিয়ে মিথ্যে বলতে আমরা বিবাহিত। আমি যদি এই সাহস দেখাতে পারি ও নাকি আমায় বিয়ে করবে আমিও তাই করি। এদিকে বাসায় এসে দেখি পূর্ণতা এখনো বাসায় পড়ে আছে ভয় পেয়ে যায় শশী সব জানার পর কি করবে? তারপর আর কি ভয়টাই সত্যি হয়। শশী সব জানতে পারে কিন্তু তার আগে আমাদের বিয়েটা হয়ে যায়।”