পূর্ণতা পর্ব ৩৬
নন্দিনী নীলা
স্মরণ আর দিদান মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।
স্মরণ কে আজকে হঠাৎ দেখতেই চমকে উঠেছে। দিদান মাথা নিচু করে অনুতপ্ত কন্ঠে বলল,“ সেদিন আপনাকে ভুল বলেছিলাম। আমার জীবন পূর্ণতা নষ্ট করেনি করেছি আমি নিজেই। মায়ের অবাধ্য হয়ে পূর্ণতা কে ডিভোর্স দেওয়াটাই আমার সবচেয়ে বড়ো ভুল দিল। নিজেই নিজের জীবনটা শেষ করে দিয়েছি।”
স্মরণ বলল,“ থাক সেসব বাদ দেন। ভালোবাসা আসলে অদ্ভুত। ভালোবাসার জন্য আমরা সব করতে পারি। যেমন আমি পূর্ণতা কে পাগলের মতো ভালোবাসি, ওকে চাই। ওকে পাওয়ার জন্য কেমন পাগলামী করছি।”
“ আপনি এখানে?” বলল দিদান।
“ বিয়ের শপিং করতে আসছি।”
“ পূর্ণতা বিয়েতে রাজি হয়েছে?” অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল দিদান।
স্মরণ হেঁসে উঠল,“ এতোই সহজ? তাকে রাজি করাতে আমার কয় জন্ম অপেক্ষা করতে হবে কে জানে।”
“ কার বিয়ের শপিং?”
“ আমার বিয়ের শপিং হচ্ছে বাট আমি বিয়েটা করব না।” নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল স্মরণ।
দিদান চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,“ মানে?”
“ বাদ দেন। তা আপনার চেহারার এই হাল কেন?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
দিদান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“ জেল থেকে বের হয়েছি গতকাল।”
“ হোয়াট?” বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেল স্মরণ।
দিদান একটা দূর্বল হাঁসি দিয়ে চলে গেল।
হৈমী দৌড়ে এসে স্মরণের হাত চেপে ধরল।
“ তুমি এখানে কি করছ আমাকে শাড়ি চয়েজ করে দিবে চলো।” বলেই ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। স্মরণ আশেপাশের মানুষকে তামাশা দেখাতে চাইছে না। এজন্য রাগে ফেটে পড়লেও
হৈমীকে কিছুই বলল না।
শুধু আলগাছে হাত ছাড়িয়ে নিল নিজের বাহু থেকে। তারপর নিজেই হেঁটে যেতে লাগল। হৈমী শাড়ি পরবে নাকি লেহেঙ্গা পরবে সেই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। স্মরণের সামনে গায়ে জড়িয়ে একেকটা ড্রেস দেখাচ্ছিল। স্মরণ বিরক্তিকর মুখে কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে ছিল। হৈমী নিজেই একটা গাঢ় গোলাপি লেহেঙ্গা চয়েজ করল। ওকে এটা পছন্দ করতে হেল্প করেছে তারিন।
স্মরণ দাঁড়িয়ে থেকে বোরিং হচ্ছিল হঠাৎ ওর চোখ আটকে যায় একটা মিষ্টি কালারের শাড়ির উপর। চোখের সামনে পূর্ণতার মুখটা ভেসে উঠে। শাড়িটা ওর দৃষ্টি কেড়ে নেয়।
বিড়বিড় করে স্মরণ বলে,’ এই শাড়িটা পূর্ণতার গায়ে দারুন মানাবে।’
স্মরণ এগিয়ে এসে শাড়িটা হাতে নিতেই কোথা থেকে ছুটে এসে সেটা এক টানে নিজের হাতে নিয়ে নেয় হৈমী। আচমকা টান পরার রাগ লাগে স্মরণের।
হৈমী শাড়িটা নিয়েই উৎফুল্ল হয়ে উঠল।
“ ওয়াও কি সুন্দর এই শাড়িটা? আমার জন্য পছন্দ করেছ তাই না?” আনন্দে চোখদুটো ছোটো ছোটো হয়ে এসেছে হৈমীর।
স্মরণ শাড়িটা ওর হাতের উপর থেকে নিজের হাতে নিয়ে বলল,“ নাহ।”
“ তাহলে?” মুখ কালো পরে বলল হৈমী।
” যে আমার বউ হবে তার জন্য।”
হৈমী ওর কথায় খিলখিলিয়ে হেসে বলল,” পাগল হয়েছ তুমি? আমিই তো তোমার বউ হবো। তারমানে এটা আমার জন্য। দাও আমার শাড়ি দাও।”
হৈমী শাড়িটা টেনে নেওয়ার জন্য ছটফট শুরু করে দিল।
” এটা তোর জন্য না। তুই অন্য শাড়ি নে।”
“ দাও না প্লিজ। আমি ওটাই নেব।”
“ এটা আমার বউ ছাড়া আর কেউ পাবে না।”
হৈমী থেমে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগল,’ বিয়ের পর এই শাড়ি আমি হাতিয়ে ছাড়ব।’
স্মরণ শাড়িটা নিয়ে চলে গেল কাউন্টারে দিকে তারপর একটা শাড়ির দাম মিটিয়ে বাইরে চলে গেল।
হৈমী বাইরে এসে ঝগড়া মুডে বলল,“ তুমি এমন কেন? একটা শাড়ির দাম দিয়ে চলে এসেছ। আমি ভেবেছিলাম সবারটার দিয়েছ কিন্তু তুমি তো…”
“ তোর বিয়ের বিল আমি মেটাব কেন? তোর জামাইয়ের পকেট ফাঁকা কর।”
হৈমী বলল,“ তোমার উডবি ওয়াইফ আমি। আমার বিয়ের শপিং এর টাকা তুমি দিবে না তো কে দিবে?”
“ আজাইরা কথা বলে আমার মাথা খাস না। যা বিল দিয়ে আয়।”
“ দাও না।”
“ আম্মু তোকে টাকা দিয়ে দিয়েছে না?”
“ মামি দিয়েছে তো কি হয়েছে? তুমি এই শাড়ির বিল প্রে করতে পারলে আমারটা করতে পারবে না কেন?”
“ ফালতু কাজে আমি টাকা খরচ করিনা।”
রাগে গজগজ করে হৈমী বিল পরিশোধ করতে খেল। তারিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,“ হৈমী ভাবির সাথে তুমি সব সময় এমন করো কেন?”
স্মরণ ওর মাথায় চটকনা লাগিয়ে বলল,“ আর একবার ওকে ভাবি বললে তোর ভাবির শখ আমি মিটিয়ে দেব।”
“ তাহলে কাকে বলব?”
স্মরণ ফোনে পূর্ণতার একটা ছবি বের করে বলল,” এই যে এটা তোর আসল ভাবি।”
তারিন আজকেই প্রথম পূর্ণতা কে দেখল দেখেই চমকে উঠল। পূর্ণতা কে দেখে ও বলল,“ এটা কে ভাইয়া?”
“ তোর ভাবি।”
“ কি সুন্দর? কিন্তু হৈমী আপুর সাথে তো তোমার কাল বিয়ে।”
“ কিন্তু বিয়ের আসরে বর পালাবে।”
“ তুমি পালিয়ে যাবে?” মুখে হাত দিয়ে বলল তারিন।
“ হুম কাউকে বলিস না কিন্তু..!”
তারিন চোখ ভরা বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে নিজের ভাইয়ের দিকে। হৈমী ফিরে আসতেই দুজনের কথার সমাপ্তি ঘটল।
হৈমী এসে তারিন কে বিস্মিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে। তারিন ঢোক গিলে বলল কিছু না।
কিন্তু হৈমী তবুও ওর দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে রইল।
বাসায় ফিরে স্মরণের আলাদা শাড়ি কেনা নিয়ে হৈমী বাড়িতে তুফান চালালো।
হৈমীর মা স্মরণের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,“ তুই আমার মেয়েকে রেখে কার জন্য শাড়ি কিনেছি?”
“ আল্লাহ এই বাড়িতে কি আমি কিছুই করতে পারব না?”
“ তোর বাড়ি তুই কিছুই করতে পারবি না কেন?” অবাক কন্ঠে বললেন হালিমা বেগম।
স্মরণ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,“ তুমি আর তোমার মেয়ে কি আমাকে এক দন্ড শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে দিচ্ছ?”
হৈমী এগিয়ে এসে দাঁড়াল ওর সামনে।
তারপর ন্যাকামি সুরে বলল,“ কি বললে? আমার জন্য তুমি শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারছ না? আম্মু দেখো না কি বলছে..”
হালিমা বেগম বললেন,“ স্মরণ আমার এই হাসিখুশি মেয়েটার আনন্দের ক্ষণ এ তুই এভাবে ওকে কাঁদাতে পারছি না। ব্যাগটা ওকে দিয়ে দে না।”
স্মরণ রাগে ছুড়ে মারল শাড়ি হৈমী কে। হৈমী শাড়ি নিয়ে শয়তানি হাসি দিল।
শাড়িটা মাথায় ঘোমটা দিয়ে হৈমী দাঁত কেলিয়ে বলল,“ আম্মু দেখো আমায় কেমন লাগছে?”
হালিমা বেগম কিছু বলার আগেই স্মরণ পাশ থেকে আওয়াজ তুলল।
“ জঘন্য।”
হৈমী ঠোঁট উল্টে ফেলল ওর কথায়। সোমা বেগম এগিয়ে এসে বললেন,“ সুন্দর লাগছে। কিন্তু শাড়িটা বেশি সিম্পুল। বিয়েতে এটা পরবি?”
হৈমী নাকুচ করে বলল,“ না আমি তো লেহেঙ্গা এনেছি।”
স্মরণ গমগমে মুখে ভেতরে চলে গেল। হৈমীর মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।
সকালে উঠে হৈমী চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলেছে। হৈমীর গলা ফাটানো চিৎকার শুনে সোমা বেগম বিরক্তে নাকমুখ কুঁচকে নিল। রাগে বাইরে বের হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,“ কি হয়েছে? সাত সকালে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলেছিস কেন?”
হৈমী কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,“ মামি আমি শাড়িটা হারিয়ে ফেলেছি!”
“ কোন শাড়ি?”
হৈমী সোফায় বসে আছে পড়ল থপ করে। এতো কষ্ট করে স্মরণের কাছে থেকে শাড়িটা নিয়েছিল সেটাই ও হারিয়ে ফেলল। রাতে তো টেবিলের উপর রেখেই ঘুমিয়ে ছিল। আজ আর স্মরণ কে রাত জেগে পাহারা দিতে পারেনি। কীভাবে দিবে? গত পড়শু তো এক ফোঁটা ঘুমও হয়নি। তাই গতকাল রাতে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।
হৈমী শাড়িটা হারিয়ে কাঁদছিল সোফায় বসে শব্দ করে। ওর কান্নায় সবার ঘুম ভেঙে গেল। সবাই এসে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে লাগল।
হালিমা বেগম মেয়ের পাশে বসলেন চমকিত হয়ে।
উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,“ কি হয়েছে কাঁদছিস কেন? একটু পর তোর আর স্মরণের বিয়ে হবে।”
হঠাৎ হৈমী লাফিয়ে উঠল। দৌড়ে গেল স্মরণের রুমে দেখল দরজা চাপানো ও দরজা খুলে ঢুকে চিৎকার করে উঠল,“ সে কোথায়?”
হৈমীকে এমন ছুটাছুটি করে যেতে দেখে সবাই ওর পিছু নিল। সোমা বেগম বিরক্তে নাকমুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলেন শক্ত হয়ে। হৈমী কে তার একটুও পছন্দ না শুধুমাত্র ছেলের মাথা থেকে পূর্ণতাকে নামাতে এই বিয়েতে তিনি মত হয়েছেন। কিন্তু হৈমীর বাড়াবাড়ি ন্যাকামি দেখে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। তার ছেলে এই মেয়ের সাথে সংসার করবে কিভাবে?
তিনি কি রাগের মাথায় ভুল সিদ্ধান্ত নিল? পূর্ণতা কে এখন আর চায়না সোমা বেগম তেমনি এই হৈমী কেউ ও এখন সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু এই মুহুর্ত হৈমী ছাড়া ও আর কোন অপশন নেই।
একটা শ্বাস ফেলে তিনি সোফায় বসতেই ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে কাঁদতে এসে বসল হৈমী।
” কি হয়েছে? মরা কান্না জোরা দিলি কেন?”
” মামি গো আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখন কি হবে?”
সোমা বেগম বিরক্তিকর চোখে ওর কান্না দেখছে। রাগ সংযত করে বলল,“ কি হয়েছে বল ন্যাকামি বাদ দিয়ে।”
“ মামি আমার বর পালিয়ে গেছে। গতকাল ও আমার তাকে পাহারা দেওয়া উচিত ছিল গো। এখন আমার কার সাথে বিয়ে হবে মামি।”
পূর্ণতা পর্ব ৩৫
সোমা বেগম তাকালেন ইব্রাহিম হোসেন এর দিকে।
তিনি বললেন,“ হৈমী কান্না থামা। স্মরণ পালিয়ে গেছে তোকে কে বলেছে? হয়ত বাইরে গিয়েছে।”
“ আমার শাড়িটা নেই। আমি নিশ্চিত উনি শাড়িটা নিয়েই তার ওই ডাইরির প্রেমিকার কাছে চলে গেছে।”
“ ডাইরির প্রেমিকা মানে?” বিস্মিত কন্ঠে বলল সোমা বেগম।
হৈমী নাক টেনে বলল,“ উনার কাছে আমি একটা নীল ডাইরি দেখেছিলাম।”