পূর্ণতা পর্ব ৩৯
নন্দিনী নীলা
পূর্ণতার সতেরো তম জন্মদিন। পূর্ণতার বাবা প্রায় সব জন্মদিনে বাসায় থাকে। মেয়ের জন্মদিনের আগেই তিনি ছুটি নিয়ে আসেন। গতবছর জন্মদিনে কত পাগলামী করেছে পূর্ণতা। রাত বারোটায় ফোন করে প্রভাত কে ডেকে এনেছে ওদের বাসার ছাদে। বাবা মায়ের কেক সমেত উইশ শেষ হলে লুকিয়ে পূর্ণতা ছাদে উঠে এসেছে। প্রভাত কে আসার জন্য রাজী করতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয় নি। বাধ্য হয়েই এসেছে প্রভাত।
আজকেও সেই দিন রাতের খাবার খেয়ে পূর্ণতা বিছানায় শক্ত হয়ে বসে আছে। গতবছরের করা পাগলামী গুলো ভেবে চিত্ত পুলকিত হচ্ছে। প্রভাত কে এবছর একটুও ডিস্টার্ব করছে না। প্রভাত হয়ত ভুলেই গিয়েছে আজ ওর জন্মদিন। গতবছরের মতো তো ও আর মনে করিয়ে দেয়নি। একটা ব্যথিত নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। পূর্ণতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে আছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
শুয়েও ভালো লাগছে না দরজাটা খুলে পূর্ণতা ঘুমের ভান ধরে শুয়ে রইল বারোটা বাজবে তার কিছুক্ষণ আগে। বারোটা বাজতেই ওর আব্বু আম্মু কেক নিয়ে মেয়ের রুমে এসে চিৎকার করে উঠল। পূর্ণতা চমকানোর ভান করল। আজকে ওর মধ্যে কোন আনন্দ চঞ্চলতা বাড়ছে না। নির্জীব হয়েই আছে ওর মনটা। তবুও বাবা মায়ের সামনে খুশি হবার অভিনয় করে গেল।
কেক কেটে বাবা মাকে খাইয়ে পূর্ণতা হাত ধুতে গেল। পূর্ণতা এসে দেখল বাবা মা চলে গেছে এবং মায়ের ফোনটা টেবিলের উপর। হয়ত নিয়ে এসেছিল যাওয়ার সময় আর নেওয়ার কথা মনে ছিল না।
পূর্ণতা ফোনটা হাতে নিয়ে হিম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুযোগ হাতের মুঠোয় একাই চলে এসেছে অথচ আজকে আর কল দিতে ইচ্ছে করছে না। সেদিনের পর পূর্ণতা আর প্রভাতের সাথে বাড়াবাড়ি করেনি। কিন্তু প্রভাতের পাগলামী বেড়েছে। প্রায় ছয় দিনের পাঁচদিন কলেজের সামনে এসে দাড়িয়ে থাকে। পূর্ণতা অবাক হয় প্রভাত এর পরিবর্তন দেখে। দুজনেই কেমন পরিবর্তন হয়ে গেছে। প্রভাত প্রতিদিন কল দিতে বলে পূর্ণতা দেয়না। প্রভাত ওকে ফোন দিতে চেয়েছিল পূর্ণতা নেয়নি।
এভাবেই চলছে প্রভাত এর কেয়ার বেড়েছে পূর্ণতার কমেছে তা না শুধু আগের মতো দেখাতে পারছে না।
বারবার সেই মুহূর্তটা ওকে নাড়া দিয়ে যায়। সেই কষ্ট ও ভুলতেই পারে না। জড়তা এসেছে ওর মধ্যে কিছু করতে গেলেই মন বলে, আবার তার চোখে নিজের জন্য লজ্জা, বিব্রত বোধ দেখতে হবে না তো?
পূর্ণতা প্রভাতের ব্যবহারে অনেক হ্যাপি কারণ ওকে শাসিয়ে এখন নিজেই পাল্টে গিয়েছে। তাই বিষয়টা ইনজয় ও করছে দারুণ ভাবে। এখন প্রায় প্রতিদিন ওদের দেখা হয়। শুধু আজকে হয়নি। পূর্ণতা ভেবেছিল আজকে দেখা হবে। সেদিন থেকে পূর্ণতা নিরব হয়ে প্রভাত কে পাল্টে দিয়েছে। ওর খোঁজখবর নিজে থেকেই নেয় দেখা করা ঘুরতে নিয়ে যাওয়া সবটাই স্বেচ্ছায় করে।
পূর্ণতা অনুভূতি শূন্য হয়ে থাকে। প্রভাত শঙ্কিত ওর চঞ্চলতাকে মিস করে।
পূর্ণতা নাম্বার তুলে দাঁড়িয়ে আছে কল দিতে পারছে না। কল দিয়ে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। তখনি প্রভাত এর নাম্বার থেকে কল আসে। আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়ে আছে পূর্ণতা। প্রভাত কল দিয়েছে?
ওর বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। হাত কাঁপছে রিসিভ ও করতে পারছে না উত্তেজনায়। কল বেজে কেটে গেল। কলের শব্দের ওর হার্টবিট বেড়ে গেছে। ঢোক গিলে পূর্ণতা ফোন সাইলেন্ট করে দিলো। আম্মু আব্বু শুনে ফেলল না তো?
ঢোক গিলে নিল পূর্ণতা।
সঙ্গে সঙ্গে আবার ফোনটা বেজে উঠল। পূর্ণতা রিসিভ করে কথা শুরু করার আগেই ওপাশ থেকে প্রভাত বলে উঠল,” দুই মিনিটের মধ্যে ছাদে আসো।”
পিল চমকে উঠল পূর্ণতার। ও হতবুদ্ধি কন্ঠে সুধাল,“ মানে তুমি কি ছাদে?”
“ হুম এক ঘন্টা যাবত মশার কামড় খাচ্ছি। তোমাদের বাসায় এতো মশা কেন?”
“ তুমি ছাদে কি করছ?”
“ কারো জন্য অপেক্ষা করছি। কেউ একজন গতবছর ছাদে আসার জন্য ব্ল্যাকমেইল পর্যন্ত করেছিল। তাই ভয়ে ভয়ে এবছর রিস্ক নিলাম না। আগেই চলে এসেছি।”
পূর্ণতা বলল,“ আমি তেমন কিছুই করতাম না। তুমি না আসলেও পারতে।”
“ উফ পূর্ণতা আসো না প্লিজ।”
” আমি আসব না। তুমি চলে যাব।”
“ এখন কিন্তু রাগ উঠছে প্রচুর। আমি অনেক কষ্ট করে এসেছি। এমন করো না আমার সাথে আমি এসেছি তোমার সাথে দেখা না করে যাব না। তুমি ভালো করেই জানো তাই দ্রুত আসো।”
পূর্ণতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদে উঠে আসলো। ভয়ে ওর হাত পা কাঁপছিল পাচ মিনিট ওয়েট করেছিল। তারপর আস্তে ধীরে পা চালায়। ছাদে আসতেই দেখতে পায় প্রভাত দাঁড়িয়ে আছে।
পূর্ণতা শক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রভাত পূর্ণতাকে দেখেই একটা মিষ্টি হাসি দিল। তারপর এগিয়ে এসে বলল,“ শুভ জন্মদিন মাই লাভ।”
“ তুমি কেন এসেছ? আমি তো বলেছি আর জোর করব না তোমায় কোনকিছুতে।”
প্রভাত পূর্ণতার হাত ধরে বেসুরো গলায় বলে উঠল,“
‘লক্ষী সোনা রাগ করো না একটু হাসো প্লিজ। ভাল্লাগে না আর হবে না করছি যে প্রমিজ। ‘
পূর্ণতা কপাল কুঁচকে বলল,“ তুমি আবার গান গাইতে শুরু করলে কবে হতে?”
প্রভাত পূর্ণতার হাত ছেড়ে বলল,“ আজকেই প্রথম গাইলাম। সারাজীবন বাথরুম সিঙ্গার ছিলাম আজ একটু গার্লফ্রেন্ডের সামনে গাইলাম।”
“ ঢং। খুব তো ভালোবাসা দেখাচ্ছে। আমি বলতাম তখন তো কম বিরক্তি দেখাও নাই। এখন তো ভালোবাসা উতলে পড়ছে।”
প্রভাত দুহাতে পূর্ণতার গাল ধরে চোখে চোখ রেখে বলল,“ সত্যি পূর্ণতা তুমি কঠিন না হলে আমি তোমার মর্ম বুঝতে পারতাম না। তোমার পাগলামী গুলো আমি কতটা ভালোবাসি এখন বুঝতে পারছি হারে হারে। আগের মতো হয়ে যাও না।”
“ জন্মদিন আমার আর জিনিস চাইছ তুমি?”
“ হুম চাচ্ছি দাও না। তোমার মনটা তো অনেক বড়ো।”
পূর্ণতা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,“ আমার গিফট কই?”
প্রভাত পকেটে থেকে এক জোড়া ছোট্ট কানের ইয়ারিং বের করে দিল।
প্রভার বলল,” দোকানে গিয়েছিলাম একটা রিং কিনতে। কিন্তু এই দুল জোড়া এতোটাই পছন্দ হলো আমি না কিনে পারলাম না। দুটো জিনিস কেনার টাকা ও ছিল না তাই এটাই নিয়ে এলাম।”
পূর্ণতা চোখমুখে আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল। গোল্ডেন ইয়ারিং খুব বড়ো না ছোটো কিন্তু ডিজাইন টা দারুণ। প্রভাত বলল,“ এটা আমার নিজের ইনকাম এ কেনা প্রথম জিনিস তোমার জন্য পূর্ণতা।”
খুশিতে পূর্ণতার চোখজোড়া ছলছল করে উঠল। নিজের কানের দুল খুলে প্রভাত কে বলল,” পড়িয়ে দাও।”
প্রভাত ওকে পড়িয়ে দিল পূর্ণতা প্রভাত কে জড়িয়ে ধরে বলল,“ আমার এই প্রভাত খুব প্রিয়। এই প্রভাত খুব কেয়ারিং। একটু পাগলাটে স্বভাবের কিন্তু সে আমার জন্য উন্মাদ।”
পরদিনটা ছিল আরো চমকপ্রদ।
প্রভাত দুপুর নাগাদ নিজের বাবা মা নিয়ে পূর্ণতা দের বাসায় হাজির হলো। পূর্ণতা তো বিস্ময়ে এ কথা বলতে ভুলে গেল যখন জানতে পারল প্রভাত পরিবার সহ বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছে। বাবা তাদের সাথে বসে কথা বলছে। পূর্ণতা মা এই খবরটা দিয়েই নিচে চলে গিয়েছে। পূর্ণতা কিছুই বুঝতে পারছে না। গতকাল রাতে তো প্রভাত এই নিয়ে কিছুই ওকে জানায় নি। ও এখন কি করবে?
মায়ের ফোনটা লুকিয়ে এনে কল দিল প্রভাত কে। প্রভাত কল রিসিভ করতেই পূর্ণতা হাঁপানি রোগীর মতো নিঃশ্বাস ফেলে বলল,“ প্রভাত তুমি বাসায় এসেছ।”
প্রভাত বলল,“ হুম বাসায় এসেছি। তুমি কোথায়? সেই দিন যেই লাল শাড়িটা পরে ভার্সিটিতে গিয়েছিলে ওটা পরে একটু নিচে আসো না..!”
পূর্ণতা হতবিহ্বল সুরে বলল,” কি বলছ আমি শাড়ি পরে কেন আসব?”
প্রভাত বলল,” তোমার শ্বশুর, শাশুড়ি ও জামাই নিচে তোমাকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে। তুমি তোমার চাঁদ বদল মুখ খানা দেখাতে নিচে আসবে না?”
পূর্ণতা চমকে উঠল। ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো।
হার্টবিট অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গেল। বিস্ময় এ ও কথা বলতে পারল না। প্রভাত ফোন রাখতেই পূর্ণতা কি হলো ও শাড়ি এনে পড়তে শুরু করে দিল। তখনি উপরে আসলেন রোজিনা বেগম।
মেয়ের রুমে উঁকি মারতেই তিনি চমকালেন। মেয়ে শাড়ি পরছে। পূর্ণতা মায়ের উপস্থিতিতে থতমত খেয়ে গেল। শাড়ি আধপরা করে দাঁড়িয়ে আছে শক্ত হয়ে। ভয়ে ওর হাত-পা কাঁপাকাঁপি করছে। মা ওকে যদি জিজ্ঞেস করে ও শাড়ি পরছে কেন? ও কী বলবে? ভয়ে ও শুকনো ঢোক গিলল। রক্ত হিম হয়ে উঠল ভয় উত্তেজনায়।
রোজিনা বেগম মেয়ের হাত থেকে শাড়ির আঁচলটা টেনে কুচি করে দিল দক্ষ হাতে। তারপর সুন্দর পরিপাটি করে আঁচল টেনে দিল। পূর্ণতা থমকানো চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। রোজিনা বেগম বললেন,“ আমার ছোটো মেয়েটা এতো বড়ো কবে হয়ে গেল? সে নিজের জীবনসঙ্গী ও নির্বাচন করে ফেলেছে। একা হাতেই শাড়ি ও সামলাচ্ছে।”
পূর্ণতা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চিবুক গিয়ে ঠেকেছে গলায়।
রোজিনা বেগম পূর্ণতার মুখটা তুলে বললেন,“ আরে মুখ নামিয়ে রেখেছিস কেন? প্রভাত কে কি আমি এমনিতেই বাসায় থাকতে দিয়েছিলাম? তোর মামা তো অনেক আগেই প্রভাত কে দিয়ে তোর বিয়ের কথা বলেছিল এজন্য আমি আর তোর আব্বু মিলে ওকে বাড়িতে রেখেছিলাম ও ছেলে হিসেবে কেমন জানতে।”
পূর্ণতা চোখ কপালে তুলে তাকাল সব খুলে বললেন রোজিনা বেগম। শাহিন আলম প্রভাত এর বাবাকে আগে থেকেই চিনেন। তারা কলেজ ফ্রেন্ড ছিলেন। পূর্ণতা মামা, বাবা, ও প্রভাতের বাবা। পূর্ণতা ছবি দেখে একদিন প্রভাত এর বাবা এই প্রস্তাব দেন। বন্ধুত্ব কে আত্নীয়তায় জড়াতে।
বন্ধুদের এই সিদ্ধান্তের কিছুই প্রভাত ও পূর্ণতা জানত না।
ওরা আলাদা প্রেম ভালোবাসা করে বসে আছে তারা কেউ ই জানে না। রোজিনা বেগম আর শাহিন আলম প্রভাত কেমন জানতেই ওকে বাসায় রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর দেখতে পারে ছেলে আর মেয়ের মধ্যে সাপ নেওলের সম্পর্ক।
কয়েকদিনে প্রভাত পূর্ণতার এই পরিবর্তনে থমকে গিয়েছে।ভয় ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। ও তাই বাসায় ওদের সম্পর্কটা জানাতে আমতা আমতা করতে লাগে।
গত দুইদিন আগেই প্রভাত সাহস সঞ্চয় করে জানিয়েছে সবটা। সব শুনে তারা স্তব্ধ। এবং সঙ্গে সঙ্গে বন্ধু কে কল করে জানায়। সব শুনে শাহিন আলম চমকে উঠে। গতকাল রাতে মেয়ের রুমে ইচ্ছে করেই ফোন রেখে আসেন। আর কল কথা, ছাদে দেখা করা সবটাই তারা স্বামী-স্ত্রী দেখেন। আর আজকে বাসায় ডাকেন এই নিয়েই কথাবার্তা বলতে। প্রভাত বাবা মাকে নিয়ে এসেছিল অপরিচিত পূর্ণতার বাবা মায়ের সাথে কথা বলাতে। কিন্তু এখানে এসে নিজেই চমকে উঠেছে। তারা পূর্বপরিচিত ও তারা বেস্ট ফ্রেন্ড। সব প্লান শুনে প্রভাতের রাগ হলো। কত ভয় নিয়েই না ও পূর্ণতার সাথে সম্পর্ক তৈরি করেছে। কিন্তু এদিকে সবাই রাজি জানলে কী এতো ভয় নিয়ে থাকতে হতো? এই যে আজ সাহস করে বাবা মাকে এখানে আনতে ওকে কতটা টেনশন করতে হয়েছে। সারারাত একফোঁটা ঘুম হয়নি। নিশাচর হয়ে জেগে ছিল।
সব জানা থাকলে এতো ভয় , দুশ্চিন্তা ওকে করতে হতো না।
পূর্ণতা যখন লাল শাড়ি পরে নিচে আসলো প্রভাত সবাইকেই তুচ্ছ করে হা করে তাকিয়ে রইল। সেদিন দেখতে পারে নি আজ মন ভরে দেখবে।
পূর্ণতা পর্ব ৩৮
দিনটা অনেক সুন্দর ছিল। জন্মদিনের দিনটা এতোটা সুন্দর হবে পূর্ণতার জানা ছিল না। পারিবারিক ভাবেও সম্পর্ক টা স্বীকৃতি পেয়ে গেল। প্রভাত এর পড়াশোনা শেষ হলে এদের বিয়ে হবে ততদিন দুজনেই পড়াশোনা করবে।
প্রভাত পূর্ণতার দিকে ঝুঁকে নিচু স্বরে বলল,“পড়াশোনার পাশাপাশি প্রেম করব।”
পূর্ণতা লাজুক হেঁসে ওকে সোজা হতে বলল।