পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৩৭

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৩৭
সাদিয়া আক্তার

সকাল সকাল পূর্বের কান্নায় ঘুম ভাঙ্গে পুনমের। পুনম চোখ মেলে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে চৌদ্দ দিনের পূর্ব ড‍্যাবড‍্যাব করে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাইয়ের নাকে নাক ঘষে পুনম
— আসসালামু আলাইকুম ভাইয়‍ু শুভ সকাল,,,
প্রতিত্তোরে পূর্ব আরো বড় চোখ করে তাকায় মানে তার খিদে পেয়েছে। পুনম মুচকি হাসে উঠে ফ্লাক্স থেকে পানি নিয়ে ফিটার ধুয়ে দুধ বানিয়ে নেয়। পুনমের ঘরেই এখন পূর্বের সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থাকে।
পূর্বকে খায়িয়ে দুই পাশে বালিশ দিয়ে নিজে ফ্রেশ হতে যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে মোবাইলে সময় দেখে আটটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। পূর্বকে নিয়ে নিচে নামে পুনম রোজিনা বেগম ড্রয়িং রুমেই বসা ছিলেন চাতক পাখির মতো ওয়েট করছিলেন কখন পুনম ঘরের দরজা খুলবে।

— আম্মু ভাইয়ুকে রাখো আমি দেখি চাচীর কোনো কিছু লাগবে কিনা।
রোজিনা বেগম যেনো এই সুযোগেই ছিলেন — হ‍্যা হ‍্যা দে
পুনম মায়ের কোলে ভাইকে রেখে রান্নাঘরে যেতে যেতে দেখল রোজিনা বেগম পূর্বের পুরো মুখে চোখ আদর করছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল পুনম কেনো তার ভাইটা তার মায়ের কাছে থাকে না এটা বুঝতে পারে না পুনম।
— শুভ সকাল চাচী,,, কি করছ?? আমি কিছু সাহায্য করি
— লাগবে নারে মা সব শেষ করা আর সবজি রোজি কেটে দিয়েছে এখন শুধু টেবিলে রাখব চন্দ্র একটু পরেই ভার্সিটির জন‍্য বেরোবে সামনে ওর এক্সাম তো তাই। তোর আজকে ক্লাস আছে??
— না আজ নেই কাল অ‍্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়া লাগবে সেটাই করব বসে বসে আপু উঠে নাই,,,
— নাহ নবাবের মেয়ে কি এতো সকালে উঠে দেখ গিয়ে ঘুম সামনে যে লাষ্ট ইয়ারের পরীক্ষা আসবে সেটা নিয়েও কোনো চিন্তা নেই।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চাচীর কথায় পুনম মুচকি হাসে। হাতে হাতে বাটিগুলো টেবিলে রাখে চন্দ্র দৌড়ে বড় বড় পায়ে সিড়ি দিয়ে নামে — আম্মু দ্রুত খেতে দাও পনেরো মিনিটের মধ‍্যে পৌছানো লাগবে,,,
হাতের ঘড়ির বেল্ট লাগাতে লাগাতে চেয়ারে বসে বলল।
চাদনী বেগম খাবার দিতে নিলে উপর থেকে ডাক পরল কামরুল সাহেবের।
— মা একটু চন্দ্রকে খেতে দে আমি আসছি দেখী তো চাচা ডাকে ক‍্যান,,,
চাচীর কথায় মনে মনে অসন্তোষ হলো পুনম তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল — আচ্ছা
চাদনী বেগম যেতেই পুনম চন্দ্রকে খেতে দিয়ে পাশ থেকে সরে যেতে নিলে চন্দ্র খেতে খেতে বলল — কোনো গাবুররে খেতে দিয়েছিস নাকি যে খেতে দিয়েই চলে যাবি,,
চন্দ্রের কথায় বিরক্ত পুনম তবুও বসে পরল দুই চেয়ার পরে। এরমধ‍্যেই পারভেজ সাহেব বাইরে থেকে আসলেন তিনি ঐ বাড়ি গিয়েছিলেন সকাল সকাল।

— কোথা থেকে আসলা আব্বু??
পারভেজ সাহেবকে বাইরে থেকে আসতে দেখে বলল পুনম। পারভেজ সাহেব একগ্লাস পানি চাইলে পুনম তাকে পানি দিলো
— কাল কাজের জন‍্য যে মেয়েটাকে রাখা হলো ও কই,,
— তিনি ঘুম
রোজিনা বেগমের কথায় অবাক পুনম পারভেজ সাহেব — বল কি??
— সকাল সকাল পুনমের ঘর থেকে এসে আবার সোফায় ঘুমিয়েছে। ভাবী ওরে ডেকে বলল– রুটি বেলে দিতে সে হেলতে হেলতে রান্নাঘরে যেয়ে ধপাস করে শুয়ে বলল — খালাম্মা ডাইকেন না এখন উঠলে আমার চোখের নিচে কালা দাগ পরব,,
— এখন কই রান্নাঘরে তো দেখলাম না আম্মু।
— ভাবী অনেক ডাকাডাকির পর উঠে ঢুলতে ঢুলতে কোথায় যেয়ে ঘুমাইছে নিজেও জানে না।
পারভেজ সাহেব উঠে গেলেন রেডি হতে দোকানে যাওয়া লাগবে। পুনম চন্দ্র পানি চাইতে সেখানে গেলো জগটা সামনেই রাখা
— কুড়ে কোথাকার সামনে জগ এক গ্লাস পানিও ঢেলে খেতে পারে না
বিড়বিড় করে চন্দ্রকে বকে পানি ঢেলে দিলো। চন্দ্র বুঝলো পুনম তাকে উদ্ধার করছে তাই মনে মনে হাসল এই ভেবে যে চন্দ্রের প্রতি যতটা অনিহা শের “এ আলীর প্রতি ততই ভালোবাসা।

আজ বন্ধ থাকলেও হঠাৎই মিহির সাথে বের হওয়া লাগছে পুনমের। মিহি কিছু কেনা কাটা করবে কাল সন্ধ্যার বাসে সে গ্রামে ফিরবে তার দাদী অসুস্থ। গ্রামের কথা মনে করে পুনমের বেশ মন খারাপ হলো অনেক দিন হলো সেই বাড়িটাতে যাওয়া হয়না যেই বাড়িটাতে কেটেছে তাদের শৈশব কৈশোর। তবে সেখানে পুনমের খুব একটা ভালো স্মৃতি নেই যা আছে সব নিজের একাকিত্বের প্রতিচ্ছবি মায়ের লাঞ্চনা। পুনমের মনে পরে একদিন ভুল ক্রমে তিনতলার ভাড়াটিয়াদেয় জানালার গ্লাস ভাঙ্গায় সেদিন পুনমকে দিয়ে আধঘন্টা রোদে দাড় করিয়ে সেটা ঠিক করিয়েছিল রোজিনা বেগম। সেই কথা আজও তার বাবা জানে না।। তবে সে ধৈর্য্য ধরেছিল মায়ের জন‍্য তার মনে কোনো রাগ অভিমান কিছুই নেই সে করতে পারে না রাগ। পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যাদের হাজারো কষ্ট দিয়ে একটু ভালোমতো কথা বললেই তাদের রাগ কমে যায়। পুনম হচ্ছে সেই ক‍্যাটাগরির মেয়ে।
রাগ জিনিসটা তার নেই তবে অভিমান আছে সেটাও সবার ক্ষেত্রে দেখায় না একমাত্র বাবার সাথেই।
বাবার কথা মনে পড়তেই মনে পড়ল অনেকদিন বাবার সাথে কোথাও যাওয়া হয়না আগে পুনম কলেজ থেকেই দোকানে চলে যেতো। সেখান থেকে দুই বাপ মেয়ে এদিক সেদিক ঘুরে চটপটি ফুচকা আইসক্রিম খেয়ে বাসায় ফিরত।

— পুনু এই কালারটা কেমন,,,
সিদুর লাল রঙা একটা জামা পুনমের সামনে রেখে বলল মিহি। মিহির কথায় ধ‍্যান ভাঙে পুনমের। সে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মিহিকে বলল — এটাই লাষ্ট তোর কেনা কাটা
— হ‍্যা,,
— আচ্ছা তাহলে তুই হোষ্টেলে চলে যা আমি আব্বুর কাছে যাব,,
মিহি পুনম সম্পর্কে অবগত তাই আর প্রশ্ন করল না রিক্সা ডেকে চলে গেলো। মিহি যেতেই পুনমও রিক্সা নিলো। দোকানের ঠিকানা বলে উঠে পরল।
শুক্রবার হওয়াতে দোকানে মোটামুটি ভীর ছিলো। পারভেজ সাহেব কাষ্টমার হ‍্যান্ডেল করছিল। তন্মধ্যে মেয়েকে দেখে তাকে ভিতরে গোডাউন রুমে বসার ইশারা করল। পুনম বাবার ইশারায় যেয়ে বসল সেখানে পারভেজ কাষ্টমার বিদায় করেই মেয়ের কাছে গেলো

— কি হয়েছে আম্মাজান হঠাৎই দোকানে আসলে,,
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল পারভেজ সাহেব।
পুনম মুচকি হেসে বলল — ঘুরতে যাব আব্বু তোমার সাথে অনেক দিন ঘুরতে যাই না,,,
— এখন
পুনম মাথা নাড়ায় পারভেজ সাহেব দোকানের ছেলেকে ডেকে সব বুঝালেন। ফের মেয়েকে নিয়ে বের হয় পড়লেন পথিমধ‍্যে কল করলেন রুপশাকে
— হ‍্যালো রূপ মা কোথায় আছো??
— বাসায় আব্বু একটু পর তোমার জামাই অফিস থেকে আসবে তার জন‍্য টুকটাক নাশতা রেডী করছি,,,,
— ওও ফ্রি থাকলে বাপ মেয়েরা মিলে ঘুরতে যেতাম
— ইশশ মিস করে গেলাম নেক্সট টাইম অবশ্যই। রুপশা আফসোস করে ফোন রাখল।
পারভেজ সাহেব পুনমকে নিয়ে সাভার স্মৃতি সৌধে গেলেন। সেখানে কিছুক্ষণ ঘুরে বাপ মেয়ে ছবি টবি তুলল
— ইশশ আব্বু রংতুলি নিয়ে আসলে ভালো হতো,,
— হ‍্যা আর্টিস্টদের সব জায়গাই রংতুলির প্রয়োজন,,

বাবার কথায় পুনম খিলখিল করে হাসল। পারভেজ মন ভরে মেয়ের হাসি দেখল স্মৃতিসৌধ ঘোরাফেরা করে আরো কিছু জায়গাই ঘোরাঘুরি করে বাবা মেয়ে বাজী ধরে ফুচকা আইসক্রিম খেয়ে রাত আটটার দিকে বাসায় ফিরল। এদিকে যে তাদের কোনো খোঁজ খবর না পেয়ে বাড়ির সবাই চিন্তিত বিশেষ করে পূর্ব কেদেঁ কেটে গলা দাবিয়ে ফেলেছে।
পুনম পারভেজ সাহেব। কামরুল সাহেবের সামনে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। কামরুল সাহেব বকে চলেছেন দূইজনকে
— আক্কেল জ্ঞান আছে তোর মেয়েটা নাহয় ছোট তুই তো বুড়ো দামরা হয়েছিস বাসায় কাউকে একবার ফোন করে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলি না,, ছেলেটা সেই কখন থেকে কাদছে। সেই সাথে রোজিনাও কাদছে শেষে না পেরে চাদ আমাকে ফোন দিয়েছে।

— আসলে ভাই সময় কখন চলে গেছে টেরই পেলাম না,,
এবার কামরুল সাহেব ঝাড়ি মেরে বললেন — তা টের পাবি কিভাবে দামরা হয়ে বাচ্চাদের মতো দাপিয়ে বেড়ালে তা টের পাবি কিভাবে,,
চাচার কথায় পুনম এবার গাল ফুলায় বাবাকে ডিফেন্স করে বলে — আব্বুর কোনো দোষ নেই চাচা আমিই নিয়ে গেছিলাম সরি
— হুম আর যেনো না হয়
গম্ভীর স্বরে বললেন কামরুল সাহেব। এই বয়সে ছেলে মেয়েদের সামনে ঝাড়ি খেয়ে পারভেজ সাহেব মুখ লুকিয়ে পালালেন। পুনম যায় ভাইয়ের কাছে। পারভেজ সাহেব পালাতেই পুনম বাদে উপস্থিত চারজন হেসে দেয় উচ্চস্বরে। ঠিক তখনই উপর থেকে আওয়াজ আসে

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৩৬

— আম্মু আমি পড়ছি ডিস্টার্ব হচ্ছে,,,
চন্দ্রের কথা শুনে পুনম মুখ ভেংচি মেরে চলল
— আম্মু আমি পড়ছি ডিস্টার্ব হচ্ছে,, আরে তোর ডিস্টার্ব হলে কানে তুলো গোজ আমরা হাসবই,,, বিড়বিড় করে বলল।

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৩৮