পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৪১

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৪১
সাদিয়া আক্তার

কথায় বলে যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়া পড়শির ঘুম নাই। বাঙালিদের বিয়েতে এই কথাটা যথাযথ উপযুক্ত বিয়ের কণে আছে বিরহে আর বরের কোনো পাত্তা নাই। তবে হইহুল্লোর করে মাতিয়ে রেখেছে সবাই। বিয়ে উপলক্ষ্যে সবাই হাজির চন্দ্রের নানা বাড়ির খুব একটা লোক নেই তদাপি জরুরি তলপে তারা হাজির হতে পারেননি।।
ছোট্ট পরিসরে বিয়েটা হলেও মোটামুটি একশর মতো মানুষের আয়োজন হচ্ছে। বাইরে হলুদের জন‍্য স্টেজ সাজানো হয়েছে পুনম ও চন্দ্রের হলুদ এক স্টেজেই হবে তবে চন্দ্রের আগে পুনমের পরে। সবাই সেটাই আলোচনা করে ঠিক করেছে।।
রান্না ঘরে ঢুকে চাদনী বেগম রেনু ও মিনুর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু আগেও তারা ঝগড়া করেছে। মিনু মতে ঐ খ‍্যাকখ‍্যাক কন্ঠে কথা বলা চন্দ্র অতো ভোলাভালা পুনম আপার বিয়ে কখনো দেয়া উচিৎ না।
আর রেনুর কথা হলো ওমন সুন্দর চাদ ভাইয়ের জইন‍্য অতো ভালা পুনম আপাই ঠিক।

— রেনু রোজিনাকে এইটু ডেকে আন তো,,,
পারভেজ সাহেব বের হয়ে গেলেও রোজিনা বেগম মেয়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটার জন‍্য সে কিছুই করেনি কিন্তু এখন কিছু করতে মন চাচ্ছে।
রোজিনা এগিয়ে পুনমের মাথায় হাত রাখে পুনম মাথা উচু করে তাকায়
— তোমার জন‍্য এই পযর্ন্ত আমি কিছুই করতে পারিনি সবসময় মায়ের দায়িত্বে অবহেলা করেছি যা করেছে তোমার বাবাই করেছে তাকে অন্তত অসম্মান করো না।
পুনম ফের মাথা নিচু করে। কিছু একটা ভেবে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে যায় বারান্দায় দাড়িয়ে এদিন ওদিক দেখে কোনো ড্রোন দেখতে পায় কিনা না পেয়ে হতাশ হলো। সেখানেই বসে পড়ল।
রোজিনা বেগম পুনমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল রেনুর ডাকে সে তার সাথে চলে যায়। রান্নাঘরে ঢোকে রোজিনা বেগম চাদনী বেগমের উজ্জল মুখস্রী দেখে ভালোলাগা কাজ করে এই মহিলাটি পুনমকে ছেলের বউ বানানোর জন‍্যে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন

মাগরিবের পরপরই পুনমকে সাজানোর জন‍্য ঝিনুক রিমি মুক্তি রুপশা আসে। একটু পরেই চন্দ্রের হলুদ শুরু হবে তার পরপরই পুনমকে হলুদের জন‍্য নিয়ে যাওয়া হবে তাই আগে ভাগেই তাকে রেডি করাতে এসেছে।
পুনম সেই দুপুর থেকে বারান্দায় বসে শের “এ আলী সাহেবের অপেক্ষায় আছে। কোনো খবরাখবর পায় না। ওরা এসেই পুনমকে ঘরে খুজল ওয়াশরুমে খুজেঁ না পেয়ে বারান্দায় খোঁজে সেখানে পেয়ে যায়।
— পূর্ণ
রুপশার ডাকে চমকে ওঠে পুনম এলোমেলো ভঙ্গিতে বসে ছিলো পুনম। তাকে দেখেই ডাক দেয় পুনম। রুপশা বেশ অবাক হয় পুনমের অবস্থা দেখে সাথে রিমি ঝিনুক ও। তবে মুক্তি অবাক হয়না সে জানতো পুনম এমন অবস্থায় থাকবে
— আরে রুপ পুনম জানতো না বিয়ের ব‍্যাপারে হঠাৎই জেনে গেছে তাই মানতে কষ্ট হচ্ছে।
মুক্তির কথা শুনে রুপশা মুচকি হাসে পুনমের সামনে বসে ওর কপালে চুমু দিয়ে বলে
— সব ঠিকই হবে ইনশাআল্লাহ,, তুই সুখী হবি পূর্ণ চন্দ্র ভাই তোকে অনেক ভালোবাসে।
পুনম তাকায় রুপশার দিকে আবার মুক্তির দিকে তাকাতে কেনো জানি মুক্তি নজর সরিয়ে নেয়। পুনম চুপচাপ উঠে দাড়ায়।
রিমি ঝিনুক অনেক কথা বলে খুব পচায় পুনম কথা বলে না তারা ভাবে লজ্জা পেয়েছে।
কলাপাতা রঙা পাড়ের হলুদ শাড়ি চোখে মোটা করে কাজ। রজনী গন্ধা ও গোলাপ মিশিয়ে কাচা ফুলের গয়না সাথে হালকা সাজ।
সচরাচর যারা সাজে না তাদের বুঝি হালকা সাজেই বেশ লাগে

— মাশাল্লাহ্ আজ চন্দ্র ভাই চোখ ফেরাতে পারবে না,,,,
রিমির রসিকতায় কোনো তফাৎ হলো না পুনমের। বাইরে থেকে ডাক পরতেই তারা বেড়িয়ে যায় তবে যাওয়ার আগে ঝিনুক একবার পুনমের দিকে তাকায় তার কেমন জানি গোলমাল লাগছে ব‍্যাপারটা। মনের মধ‍্যে হাজারো সন্দেহ বাসা বাধছে তবুও পুনমের স্বভাব অবগত থাকার জন‍্য সেগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে।।
সাদা স‍্যান্ডু গেঞ্জি লুঙ্গি পরিহিত চন্দ্র বিরক্তি আদলে বসে আছে স্টেজে বসার আসনে। ফর্সা মুখখানা হলুদ রাঙা। চোখ ব‍্যতিত পুরো মুখটাই হলুদে ঢাকা একটু আগেই শিহাব লাগিয়েছে।
এবার রিশান উঠে স্টেজে অপর পাশে ঝিনুকের দিকে চোখ মারে। চন্দ্রর সামনে হেসে বলে — ভাই তোর তো হলো এবার আমার একটা হিল্লে কর। তুই বিয়ে করে বউ নিয়ে ঘুরবি আর সিঙ্গেলদের অন্তর পুড়াবি তা কেমনে হয়।
যাহ আমার সেটিং করানোর উপহার হিসেবে তোর মুখে এক খাবলা হলুদ উপহার দিলাম।
বলেই মুঠো ভর্তি হলুদ নিয়ে চন্দ্রর মুখ আরো ভরে দেয়।
এবার রাগে ফেটে পড়ে চন্দ্র লুঙ্গির গিট্টু খানা মুঠ করে ধরে রিশানকে দৌড়ানি মারে। উপস্থিত সবাই উচ্চস্বরে হেসে দেয়।

— চন্দ্র তোর লুঙ্গি
পিছন থেকে শিহাব বলতে চন্দ্র হাতের মুঠো আরো শক্ত করে রিশান হাসতে হাসতে চন্দ্রর সামনে দাড়ায়
— কি হে চাদ মামা,, লুঙ্গি সামলা
পিছন থেকে শিহাব ও আসতে চন্দ্র বাকা হেসে লুঙ্গি ছেড়ে দিয়ে গিট্টু খুলে দেয় ঠাসস করে লুঙ্গি নিচে পরে যায় বের হয় হাটু থেকে দুই ইঞ্চি উপরে ডেনিম প‍্যান্ট। রিশান শিহাব চিৎকার দেয়।
— মোরোন”স চোখ খোল,,, বলেই রিশানের পশ্চাৎদেশে একটা জোড়ালো লাথি মারে।
পরেই শিহাবের পাশ্চাতেও লাথি মারে। দুইজনে লাথি সামলাতে সামলাতে পরপর আরো তিন চারটা মারে চন্দ্র। রিশান শিহাবও সুযোগ বুঝে দৌড় দেয়।
হলুদে উপস্থিত পাড়া প্রতিবেশীদের মধ‍্যে কেউ বিরক্ত তো কারো হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে।
এভাবেই হাসি ঠাট্টার মাঝে শেষ হয় চন্দ্রের হলুদ দেয়া। তার একঘণ্টা পর পুনমের হলুদ হবে। তাই সবাই সেই তোড়জোড়েই লেগেছে। সকল প্রস্তুতি আগেই করা ছিলো তবে লাষ্ট ফিনিশিং দিয়ে রিমি ঝিনুক মিলে পুনমকে আনতে যায়।
নির্জিব পায়ে পুনম হেটে আসে স্টেজের সামনে। পারভেজ সাহেব একটু হেসে মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে প্রথম হলুদ ছোঁয়া দেয়। এরপর রোজিনা বেগম। একে একে সবাই তাকে হলুদের ছোয়া দেয় তবে পুনম প্রত‍্যেক বারেই কেদেঁ ভাসিয়েছে।
পুনমের কান্না দেখে সবাই ভেবেছে বিয়ে হচ্ছে এজন্য কাদছে কিন্তু উপস্থিত কেউ জানে না পুনমের মনে কাল বৈশাখী ঝড় উঠেছে প্রণয় ভাঙ্গা ঝড়।।

রাত তিনটা ঘোর তমসাচ্ছন্ন ধরনী তবে বৈদ‍্যতিক বাতিতে আলোকিত চারপাশ। এরমধ‍্যে পানি কাজ শেষ করে ঘরে যাচ্ছিল রোজিনা আজ পূর্বকে পুনমের সাথে রাখেনি আর পুনমও আজ একা শুয়েছে।। রোজিনা বেগম কি মনে করে উকি দেয় পুনমের ঘরে দেখে পুনম বারান্দায় বসে হাটুতে মুখ গুজে বসে আছে।
রোজিনা বেগম সামনে যেতে শুনতে পায় পুনমের ফুপানি। মাথায় হাত বুলাতে পুনম মাথা তুলে তাকায় মাকে দেখে অস্রুসিক্ত চোখ বিষাদের হাসি হাসে।
— কথা হয়েছে??
পুনম বুঝে কথা হয়েছে এর মানে তবে পুনম কি জবাব দেবে কোন মুখে বলবে লোকটার আজ কোনো খবর নেই।
— সে চিঠি পাঠায়নি আম্মু,,,
রোজিনা বেগমের খারাপ লাগে। — তাহলে আর কি করার চন্দ্রকে বিয়ে করে নাও,,,
— লোকটাকে কোনো সময় সেই নজরে দেখিনি। তার প্রতি কোনো ইন্টারেষ্ট কোনোকালে ছিলো না তার সাথে মানের মিলও নেই কিভাবে সংসার করব আম্মু। আর বড় কথা হচ্ছে শের “এ আলী সাহেব ছাড়া কাউকে মেনে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
বলেই হাউমাউ করে কেদেঁ দেয়। মায়া লাগে রোজিনা বেগমের মায়ের মনতো একটু হলেও টান লাগে।
কিছুক্ষণ পুনমের কান্না দেখে ঘরে যায় আলমারি থেকে কিছু টাকা নিয়ে পুনমের ঘরে আসে একটা ব‍্যাগে পুনমের কাপড় ভরে পুনমের হাত ধরে উঠায়

— কি হয়েছে আম্মু??
প্রশ্নাত্বক চোখে তাকায় পুনম। রোজিনা বেগম ধীর পায়ে তাকে নিয়ে বের হতে হতে বলে
— পালিয়ে যাও পুনম কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাক বিয়ের কথা মিটমাট হলে এসো।
পুনম অবাক চোখে তাকায় মায়ের দিকে। পালিয়ে যাবে সে খুজবে শের “এ আলী সাহেবকে কোথায় খুজবে সে তো কিছুই জানে না সর্বপরি তার বাবা সম্মান ভেবেই থেমে যায় পুনম।
— আম্মু আব্বু,,,
— তোমার আব্বুকে আমি বুঝাব মেয়ের সুখের আগে তার কাছে কিছুই নেই।
বলেই গেইট পেরিয়ে এগোতেই পিছন থেকে ডাক দিলো কেউ
— হেরে যাওয়া যোদ্ধার মতো পালিয়ে যাচ্ছো বুঝি,,,
কন্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে রোজিনা বেগম ও পুনম। সেখানেই দাড়িয়ে পরে পিছন ফিরে দেখার সৎ সাহস হয় না।
পারভেজ সাহেব দাড়ায় পুনমের সামনে মুচকি হাসে। সেই হাসি তাদের নজর ঝুকাতে বাধ‍্য করে।
— তুমি আমার মা। হুবহু আমার মায়ের মতো দেখতে মা পাগল ছেলে ছিলাম আমি মায়ের মৃত্যুর পর সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে ভবঘুরে হয়েছিলাম।
আবার রোজিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল

— মনে আছে বিয়ের পর রুপ মা হওয়ার আগ পযর্ন্ত ও আমি তোমার প্রতি উদাসীন ছিলাম।
রোজিনা বেগম মনে করে বিয়ের শুরুর সময়কাল। সেই সময় গুলো তার কাছে দূর্বিসহ ছিলো। টাকা পয়সার অভাব না থাকলেও ছিলো সুখের অভাব একটু ভালোবাসার অভাব তাদের মধ‍্যকার সম্পর্ক কেমন জানি ফ‍্যাকাশে হয়ে ছিলো। তবে সেটা চেঞ্জ হয়,,,,,,,,,,,
পরোক্ষণেই রোজিনা বেগম পারভেজ সাহেবের দিকে তাকায়। পারভেজ সাহেব রোজিনা বেগমের মনোভাব বুঝে তবে তাকে কিছু বলে না পুনমের দিকে তাকিয়ে বলে — রোজিনার প্রতি আমার এমন মনোভাব দেখে ও ভাবতো মেয়ে হওয়ায় বুঝি আমি এমন করছি। তবে ও ভুল ছিলো শ‍্যামবর্ণা মায়াময়ী ও মমতাময়ী মা হারিয়ে আমি এমন হয়েছিলাম।
তুমি হওয়ার পরে যখন এই মহিলা ছেলে,,ছেলে
করে কান্নাকাটি করেছে। তখন আমি তোমাকে কোলে নিয়ে পেয়েছিলাম এক ফালি সুখ,,,,,
তখন মনে হয়েছিল একটুকরো জান্নাত আমার ঘরে এসেছে। তোমার মধ‍্যে পেয়েছিলাম আমার সেই মমতাময়ী মায়ের প্রতিচ্ছবি।

আল্লাহর এই অমূল্য দানকে আমি অস্বীকার করতে পারিনি। তবে আজ মনে হচ্ছে সেই সময় আসলেই একটা ছেলে হলে ভালো হতো অন্তত এইভাবে মান সম্মান যাওয়ার ভয় থাকত না।
বলেই থামে পারভেজ সাহেব। সারাদিন মেয়ের চিন্তা বিয়ের হাজার কাজকর্ম সব মিলিয়ে কাজ শেষ করে একটু আগেই ঘুমাতে গিয়েছিল তিনি তবে রোজিনা বেগমকে পুনমকে নিয়ে বাইরে যেতে দেখে এগোয়। তখনই সব বুঝতে পারে এও বুঝতে পারে এই কারসাজির পেছনে পুরোটাই রোজিনা বেগমের হাত।
রোজিনা বেগম হাউমাউ করে কেদেঁ ওঠে। পুনম হাটু ভাজ করে আব্বুর পায়ের কাছে বসে পরে

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৪১

— আমাকে মাফ করে দাও আব্বু আমি কোথাও যাব না সব ভুলে যাব শুধু তুমি এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিও না,,,,,,
— তাহলে কাল কোনো ঝঞ্ঝাট ছাড়া বিয়ের পিড়িতে বসবে,,,
পারভেজ সাহেবের কথা শেষ হতেই পুনম দৌড়ে নিজের ঘরে চলে যায়। দরজা আটকে সেখাই বসে পড়ে।
— এই কয়েক মাসের ভালবাসার জন‍্যে আমি আমার আব্বুর আঠারো বছরের ভালোবাসা অবহেলা করতে পারিনা।
নিজের উপর ধিক্কার জানিয়ে বলল — ছিঃ পুনম এই তোর আব্বুর প্রতি ভালোবাসা

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৪২