প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৫

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৫
Writer Mahfuza Akter

সৌহার্দ্যের কথাই সত্যি হলো। সে তরীর পাশের ঘরেই একা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র পাশের ঘরে নিয়ে চলে গেল। সারারাত তরীর সাথে দেখা করার প্রয়োজন মনে করলো না। তরী কিছুটা ব্যথিত হলেও সেটা প্রকাশ করতে পারলো না। সেই রাত থেকে সৌহার্দ্য ও তরীর আলাদা ঘরে ঘুমানোর যাত্রা শুরু। বহুদিন একা ঘুমানোর অভ্যাস না থাকায় তরীর রাতগুলো নির্ঘুম কাটে। স্বামী-স্ত্রী দুজন আলাদা ঘরে ঘুমানোর ব্যাপারটা লোকচক্ষুতে অদ্ভুত ঠেকে। তাই মালিহা এবং মধুকে এই ব্যাপারে কিছু জানায়নি তরী।

প্রতিদিনের মতো আজও সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে তরী। কিন্তু বরাবরের মতোই আজও সৌহার্দ্যের সাথে তার দেখা হলো না। মন খারাপ করে বসার ঘরে যেতেই তরীর চোখ কপালে উঠে গেল। মধু সোফায় পা তুলে বসে দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে, আর বিড়বিড় করে কিছু বলছে যা বোঝা যাচ্ছে না। তরী এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“আজ সূর্য কোন দিকে উঠেছে? তুই এতো ভোরে ঘুম থেকে উঠেছিস? আমি কি স্বপ্ন দেখছি? নাকি আমার চোখ দু’টো নষ্ট হয়ে গেল?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তরীর বিদ্রুপ শুনে মধু ভেংচি কে’টে বললো,
“আমি আজ ভোরে উঠে নামাজ পড়েছি। এরপর আর ঘুমাইনি।”
তরী হেসে উঠে বললো,
“আরে, বাহ্! আজ হঠাৎ এতো উন্নতি কীভাবে হলো? কোনো স্পেশাল কিছু আছে নাকি আজকে?”
মালিহা তরীর জন্য সকালের নাস্তা হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
“আজ নাকি তোদের এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে? মধু তো আমায় কাল রাত থেকেই জ্বা’লি’য়ে মা’র’ছে!”
তরী অবাক গলায় বললো, “আজ রেজাল্ট দেবে? আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম!”

মধু মুখ বাকিয়ে বললো, “মেধাবী পোলাপাইন সব এরকমই হয়! রেজাল্টের আগমুহূর্তেও নিশ্চিন্ত মনে নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়। এই দিকে আমার মতো দূর্বল মেধাহীন বাচ্চাগুলো রেজাল্টের চিন্তায় সারারাত ঘুমাতে পারে নাহ্!”
“পরীক্ষার আগে তো পড়াশোনা করিস না! এখন টেনশন করে কী হবে?”
তরীর কথা শুনে মধু আফসোসের সুরে বললো, ” আসলেই! পড়াশোনা করা দরকার। দোয়া কর, আল্লাহ এইবার যেন পাশ করিয়ে দেয়! এরপর থেকে মনযোগ দিয়ে সারাবছর পড়াশোনা করবো।”
মধুর কথায় তরী হেসে উঠে বললো, “এই কথা তুই এসএসসির রেজাল্টের দিনও বলেছিলি। পাশ করে ফেলার পর থেকে তো পড়াশোনার ধারেকাছেও তোকে দেখা যেত না।”

তরীর কথায় মালিহাও মিটমিটিয়ে হেসে ফেললো। মধু রাগী চোখে তরীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মালিহার দিকে তাকাতেই দেখলো, মালিহাও নিঃশব্দে হাসছে। মধু বিরক্ত হয়ে বললো,
“ছোট মা! তুমিও আমার মজা নিচ্ছো? ধুর! এই পৃথিবীতে কেউ আমার দুঃখ বোঝে না।”
মধু বিড়বিড় করতে করতে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। মালিহা তরীকে খাইয়ে দিতে দিতে বললো,
“মেয়েটা এমনিতেই অনেক চিন্তায় আছে! কেন ওর সাথে এমন করিস?”

“আরেহ্, ওর সবসময়ই অহেতুক চিন্তা। ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও সারাবছর বেশ ভালোই পড়াশোনা করেছে ও। টেস্টেও ভালো রেজাল্ট করেছিল। এখন পাশ-ফেলের চিন্তা করছে, কারণ ওভারথিংকিং করার রোগ আছে ওর।”
মালিহা চিন্তিত গলায় বললো, “তোর কী মনে হয়? পাশ করবে এবার?”
তরী হেসে বললো, “ভালো রেজাল্ট হবে ওর।”

“ওয়াও! আজ আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে, অরুণী!”
নিজের নামটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই পা থেমে গেল অরুণীর। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলো, মুগ্ধ ক্লোজআপ হাসি দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আশেপাশের মাঠভর্তি ছেলে-মেয়েরা মুগ্ধ আর অরুণীর দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে। অরুণী সেটা খেয়াল করে মুগ্ধর দিকে রাগী চোখে তাকালো। এগিয়ে এসে বললো,
“আমি তোমাকে নিষেধ করেছিলাম যে, সবার সামনে আমার নাম ধরে ডাকবে না।”
“তাহলে কী বলে ডাকবো? সিনিয়ার আপু?”
অরুণী বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,

“একদম না! আমাকে কিছু বলে ডাকার দরকার নেই তোমার। আমার থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চলবে তুমি।”
কথাটা বলে অরুণী নিজের ক্লাসের দিকে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে মুগ্ধ তার হাত চেপে ধরলো। অরুণী চোখ বড়বড় করে একবার নিজের হাতের দিকে, তো আরেকবার মুগ্ধর দিকে তাকালো। মুগ্ধ ঠান্ডা গলায় বললো, “আপনার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে। আমার কথাগুলো শুনতে রাজি হলে আপনার হাত ছেড়ে দেবো, নয়তো ছাড়বো না।”

নিজের হাত রক্ষার জন্য অগত্যা অরুণীকে রাজি হতে হলো। মুগ্ধ আর সে ক্যান্টিনে মুখোমুখি বসেছে। মুগ্ধ ঝরঝরে হাসি দিয়ে বললো, “ব্রেকফাস্ট করেছেন? না করে থাকলে কী খাবেন বলুন?”
“তোমার কি বলার আছে তাড়াতাড়ি বল! আমার ক্লাস আছে।”
মুগ্ধ টেবিলের ওপর হাতে হাত রেখে সোজাসুজি বসার চেষ্টা করলো। ঠান্ডা গলায় বললো,
“দেখুন, অরুণী! আপনার থেকে দূরত্ব বজায় রাখার কথা আর কখনো বলবেন না।”
অরুণী ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললো, “কেন?”
“কার কথাটা সহ্য হয় না আমার। দম বন্ধ হয়ে আসে।”

মুগ্ধর কথায় অরুণী কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। ইতস্তত করে বললো, “বাজে কথা বলা বন্ধ করো।”
মুগ্ধ শীতল কণ্ঠে বললো, “আমি বাজে কথা বলছি না। আমার ভালোবাসাটাকে এতো হালকাভাবে নিবেন না। আপনাকে নিয়ে আমি প্রচন্ড সিরিয়াস।”
অরুণী হতভম্ব হয়ে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটা দিনদিন লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে। মুখের ওপর চটাং চটাং করে কথা বলতে শুরু করেছে। সিরিয়াস ভঙ্গিতে প্রেমালাপ করতেও শিখে গেছে। মুগ্ধকে এখন আগের মতো বাচ্চা ছেলে বলতেও অস্বস্তি হয় অরুণীর। ছেলেটাকে নিজের থেকেও বড় মনে হয় ইদানীং। এই যে, মুগ্ধর গাম্ভীর্যে তার ভয় হচ্ছে। আগের মতো ঝাড়ি দিয়ে দু’টো কথা শুনিয়ে দিতে পারছে না। আবার তার নিজের ঠিক কী বলা উচিত, সেটাও বুঝতে পারছে না।

মুগ্ধ শান্তভাবে বললো, “আমি জানি, গ্রাম থেকে আসার সময় আমি আপনাকে অনেক কথা শুনিয়ে এসেছি, এখানে আসার পরও অনেক বাজে কথা বলেছি। ওসব বলা উচিত হয় নি আমার। আ’ম সরি। আমি আর কখনো আপনাকে হার্ট করে কিছু বলবো না।”
অরুণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “তোমার কথা শেষ হয়েছে?”
“আমার কথা তো শেষ! কিন্তু যাওয়ার আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান।”
“কী প্রশ্ন?”

“আপনার থেকে কখনো দূরত্ব বজায় রাখতে বলবেন না। কথা দিন।”
অরুণী কথা দিলো না। দ্রুত পায়ে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেল। পরমুহূর্তেই মুগ্ধর ফোন থেকে নোটিফিকেশনের শব্দ শোনা গেল। মুগ্ধ চেয়ারে হেলান দিয়ে অবসন্ন মন ফোন বের করলো। স্ক্রিনে অরুণীর ম্যাসেজ এসেছে,
“আমি তোমায় দূরত্ব বজায় রাখার কথা বললেও তুমি সেটা মানবে না। বড্ড নাছোড়বান্দা তুমি। তাই কথা দিচ্ছি, তোমাকে আর কখনো এমন কথা বলবো না। আর তোমাকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে কথাটা জানালাম, কারণ ইদানীং তোমায় বেশ ভয় পাই আমি। এতো গম্ভীর গলায় কথা বলো কেন তুমি, হুহ্?”
মুগ্ধ একই ম্যাসেজ সাতবার পড়লো। প্রতিবারই হাসলো। ইশ্! এতো আনন্দ সে রাখবে কোথায়?

রিসার্চ সেন্টারে আগে ড. আরমানকে সপ্তাহে তিনদিন দেখা যেত। সৌহার্দ্য জয়েন করার পর এখন রোজই তিনি আসেন। ব্যাপারটা সৌহার্দ্যের বিরক্ত লাগলেও কিছু বলার নেই। এই যে, এখন সৌহার্দ্য কাজ করছে, আর ড. আরমান তার সামনে বসে তাকে দেখছে আর হাসছে। ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তিকর। এক পর্যায়ে সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে বললো,

“আপনি আমার কাজ দেখছেন, ভালো কথা! কিন্তু এভাবে হাসছেন কেন?”
ড. আরমান হাসি মুখেই বললেন, “তোমাকে দেখেই হাসছি।”
“কেন?”
“তরীর সাথে বিছানা আলাদা করেছো তুমি?”
সৌহার্দ্য শক্ত চোখে তাকালো ড. আরমানের দিকে। লোকটার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে অনেক আগে। কিন্তু এখনও তার কালো চুল ও কালো গোঁফ দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। ভদ্রলোকের মুখোশ পরিহিত এই ব্যক্তির আসল চেহারা শুধু সে দেখেছে। চিন্তার মাঝেই বিড়বিড় করে সৌহার্দ্য বলে উঠলো,
“হিপোক্রিট!”

“একদম ঠিক চিনেছো তুমি আমায়। আই’ম আ হিপোক্রিট এন্ড আই বিলিভ দ্যাট হিপোক্রেসি শ্যুড বি প্র্যাকটিসড্ টু বি সাকসেসফুল ইন লাইফ। তুমি যতটা হিপোক্রিট হবে, তুমি ঠিক ততটাই সফলতা পাবে।”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। ড. আরমান আবারও হেসে উঠে বললেন,
“তোমাকে দেখলেই হাসি পায় আমার। ইউ আর আ ইয়াং ম্যারেড ম্যান। অথচ বউকে আলাদা ঘরে রোখে নিজে আলাদা ঘরে ঘুমাচ্ছো? ইউ হ্যাভ সাম ফিজিক্যাল নিডস্, রাইট? তুমি তো নিজের সাথে নিজেই হিপোক্রেসি করছো!”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৪ (২)

সৌহার্দ্য ঘৃণ্য চোখে তাকিয়ে বললো,
“আমার মানসিকতা আপনার মতো নোংরা না।”
ড. আরমান সৌহার্দ্যের কথা কানে তুললেন না। হাসতে হাসতে বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে বললেন,
“তোমায় বিছানা আলাদা করতে বলেছিলাম, তুমি ঘর আলাদা করেছো। ভালোই হয়েছে। তুমি তো খুব বেশি দিন বাঁচবে না! মেয়েটাকে নিজের মায়ায় না বাঁধলেই ও কষ্ট কম পাবে। আবার এমনও হতে পারে যে, মেয়েটাও বেশি দিন বাঁচবে না! তাই দূরত্ব রাখাই ভালো। দূরত্ব যত বেশি, হারানোর বেদনাও তত কম। ইউ নৌ দ্যাট, রাইট?”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৬