প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ২১

প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ২১
অনন্যা

আনন্দঘন মুহূর্ত নিমিষেই যেন বিষাদে ছেয়ে গেছে।একটু আগে পর্যন্ত একেকজনের চেহারায় ছিল আনন্দের উচ্ছ্বাস অথচ এখন সবার চেহারায় চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে।ভেতর থেকে না চাইতেও কান্নাগুলো উগড়ে আসতে চাইছে।অপারেশন থিয়েটারের সামনে বসে রয়েছে সবাই।রোদেলার কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে গেছে।রাহুল নিজেও হতভম্ব।সে রোদেলাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে তাও।নিধি কেঁদে কেটে ভাসিয়ে ফেলছিল তাই আরিফ তাকে একটু বাহিরে নিয়ে যায়। আয়ান নিস্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে।তার মাথায় এখনো ঠিক করে ঘটনাটা ঢুকছে না।অযাচিত ভয়ে চোখে অশ্রুর বিন্দুর দেখা পাওয়া গেল। নাতাশা তার হাতের উপর হাত রাখলো।মেয়েটার চোখও ছলছল করছে।আয়ান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পেছনে হেলান দিল।

আহনাফ দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রয়েছে। আহান শাহরিয়ার ছেলের পাশেই দাঁড়িয়ে।কি বলে সান্তনা দিবেন বুঝে উঠতে পারছেন না ঠিক।এমন এক সিচুয়েশনে তো একদিন সে নিজেও পড়েছিল।আল্লাহর কাছে খুব করে চাইলেন যেন তার ছেলের সাথে এমনটা না হয়।ছেলেটা সবেমাত্র একটু একটু করে নিজেকে পরিবর্তন করছিল, বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল তার সাথে এমনটা না হোক।
হঠাৎ’ই তখন ওটির লাল আলোটা নিভে গেল।ডাক্তার বেরিয়ে এলেন।সবাই উঠে দাঁড়ালো।কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পাচ্ছে না।আহান শাহরিয়ার জিজ্ঞাসা করলেন

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘কুহু ঠিক আছে তো?
ডাক্তার বললেন
-‘অপারেশন সাকসেসফুল।গুলি বের করা হয়েছে।ঠিক আছে এখন।কিছুক্ষণ বাদে কেবিনে সিফট্ করা হবে।
সবাই স্বস্থির শ্বাস ছাড়লো।আহান শাহরিয়ার ছেলের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন
-‘চিন্তা করো না আর।ঠিক আছে সে।
আহনাফ বলে উঠলো
-‘তবে এবার অন্য একজন ঠিক থাকবে না।
-‘শান্ত হও।এখন’ই নয়।
আহনাফ ক্ষুব্ধ নয়নে বাবার দিকে তাকালো।আহান শাহরিয়ার কিছু বলতে নিবে তখন হঠাৎ…
-‘আমার মেয়ে…আমার মেয়ে কোথায়?

সাখাওয়াত আলমের কাতর স্বর শুনে সবাই তার দিকে তাকালো।পেছন পেছন দুজন গার্ড আসছে তার সাথে। হকচকিত হলো সবাই।আহনাফ আর আহান শাহরিয়ার ভ্রু কুচকে তাকিয়ে।তাদের জানামতে সাখাওয়াত আলমের কোনো সন্তান নেই।মেয়ে এলো কোথা থেকে?এমপিকে এভাবে আসতে দেখে ডাক্তার নিজেও হকচকিত।তিনি বলে উঠলেন
-‘স্যার এখানে তো অন্য পেসেন্ট।আ’আপনার ভুল হচ্ছে কোথাও।
সাখাওয়াত আলমের দিন-দুনিয়া খেয়াল নেই।তিনি কাতর স্বরে বলে উঠলেন
-‘এখানেই আছে…ক’কেমন আছে ও? ঠিক আছে তো?
ডাক্তার বলে উঠলেন

-‘এই পেসেন্ট তো ঠিক’ই আছে স্যার।কিন্তু আপনার হয়তো কো…
সাখাওয়াত আলম বলে উঠলেন
-‘শানায়া..আমার শানায়ার কাছে নিয়ে চলুন আমাকে।
-‘কিন্তু স্যার এই পেসেন্টের নাম তো কুহু শেখ।
সাখাওয়াত আলম কিছু বলতে নিলে আহনাফ বলে উঠলো
-‘আপনার মেয়েও আছে?ইন্টারেস্টিং…

সাখাওয়াত আলম এতক্ষণে যেন হুশে ফিরলেন।সবার দিকে চোখ বুলালেন।মেয়ের গুলি লাগার কথা শুনে তার আত্মাটাই বেরিয়ে গিয়েছিল।স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল যখন সে শুনেলো যে তার হায়ার করা লোকের দ্বারা গুলি লাগেনি।অন্যকেউ গুলি করেছে। শত্রুপক্ষ হয়তো কিছু টের পেয়েছে। তারাই হয়তো গুলি করেছে। আহনাফের বার্থ ডে পার্টিতে যে আয়ানের সাথে কুহু যাচ্ছে এটার খবর তিনি পেয়েছিলেন।মেয়েকে বারণ করেছিলেন বাসা থেকে বের হতে কিন্তু সে শুনেনি।সাখাওয়াত আলম পরে ভেবেছিলেন যাচ্ছে যাক।বাবার শত্রুর পতন মেয়েও দেখুক।কিন্তু এমন যে হয়ে যাবে তা তিনি কল্পনাও করেননি।তার মেয়ের খবর কি তবে কেউ পেয়ে গেছে?আহনাফ নয়তো সে আবার?
-‘স্যার!

সাখাওয়াত আলমের ভাবনায় ছেদ ঘটলো।তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন
-‘আমার নয়..আমার পিএ হারুনের মেয়ের কথা বলছিলাম আমি।ওর মেয়েকে আমি নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করি।ওর এক্সিডেন্ট হয়েছে শুনেই এসেছিলাম।নাথিং ইলস্…
আহনাফ কপাল কুচকালো।বিশ্বাস হয়নি কথাটা তার।তবে এখন খুব একটা পাত্তা দিতে চাইলো না সে।সাখাওয়াত আলমের নজর রাহুলের দিকে গিয়ে আটকালো।চোয়াল শক্ত হয়ে গেল ভদ্রলোকের।রাহুল রোদেলার দিকে তাকিয়ে তার চোখ মুছে দিচ্ছে।আশেপাশের কিছুতে যেন মনোযোগ দেওয়ার কোনো ইচ্ছাই নেই তার।সাখাওয়াত আলম দাঁতে দাঁত পিষে ডাকলেন হারুন রহমানকে।
-‘হারুন…

কোনো সাড়া নেই।সাখাওয়াত আলম পেছনে ঘুরে তাকালেন।কেউ নেই।হারুন গেল কোথায়? তখন’ই হারুন রহমানকে ছুটে আসতে দেখা গেল।হাতে জুতো নিয়ে ছুটে আসছে সে।বেচারার জুতো ছিড়ে গিয়েছিল বিধায় তখন সাখাওয়াত আলমের সাথে সাথে আসতে পারেন নি।এখন দৌঁড়ে আসছেন।তখন’ই কেউ একজন তাকে ধাক্কা মেরে সামনে যেতে নিলে সে পাশের দেয়ালে সেটাং হয়ে গেল।মাথাটা ঠেকলো দেয়ালে।হারুন রহমানের মনে হলো তার উপর দিয়ে টর্নেডো বয়ে গেল এই মাত্র।উনি এখনো দেয়ালের সাথে চিপকে রয়েছেন টিকটিকির মতো।
-‘কুহুউউউউউ…
আনোয়ারা বেগমের চিৎকারে সবাই কান চেপে ধরলেন।সবাই তার দিকে তাকালো। আয়ান উঠে দাঁড়ালো।আনোয়ারা বেগম কান্নারত স্বরে বলতে লাগলেন

-‘কুহু… মুখপুরি কেমন আছে?ও আয়ান…
-‘ঠিক আছে ও।শান্ত হও তুমি।
আয়ানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন তিনি।হারুন রহমান ধীরে ধীরে সোজা হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এ পর্যন্ত এলেন।
-‘এখন বুঝলাম আপনার হাজবেন্ড কেন বিদেশ থাকে।বিদেশ আছে বলেই এখনো বেঁচে আছে, বেচারা।
আহনাফ ঠোঁট চেপে হাসি আটকালো।আনোয়ারা বেগম ভাগ্যিস খেয়াল করেনি তার কথা।সাখাওয়াত আলম বলে উঠলেন

-‘তোমার মেয়ে এখানে নেই, হারুন।চলো এখান থেকে…
হারুন রহমান ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন যেন।অবাক হওয়া স্বরে বললেন
-‘আমার মেয়ে!
সাখাওয়াত আলম খানিকটা দাঁতে দাঁত পিষে বললেন
-‘হারুননন…এতো ভুলো মনের কেন তুমি?
হারুন রহমান বুঝলেন এবার।সাখাওয়াত আলমের কথাকে সত্যতা দিতে তিনি হঠাৎ কান্না শুরু করে দিলেন।
-‘অ্যা…আমার মেয়ে…ও স্যার আমার মেয়ে….
সাখাওয়াত আলমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন এবার।আহনাফ কপাল কুচকে বললো
-‘আপনার তো দুই ছেলে ছিল।মেয়ে হলো কবে?
হারুন রহমান থেমে গেলেন।তাড়াতাড়ি উত্তর দিতে গিয়ে বলে ফেললেন

-‘আমার একটা ছেলে মনে মনে মেয়ে।
সবাই বলে উঠলো—“অ্যা!”
সাখাওয়াত আলম তাকে ছাড়িয়ে বললেন
-‘চুপ করো বলদ।চলো এখন এখান থেকে…
সাখাওয়াত আলম ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলেন।গার্ড দুটোও পেছন পেছন গেল।হারুন রহমান আনোয়ারা বেগমের দিকে তাকাতেই দেখলেন ভদ্রমহিলা ক্ষিপ্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বোধহয় তখনকার সেই কথার জন্য।হারুন রহমান তার দিকে তাকিয়েই হঠাৎ করে আবার ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লাগলেন।চমকে গেলেন ভদ্রমহিলা।হারুন রহমান খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল।
আহনাফের সন্দেহ এখনো কাটেনি।হারুন আলমের তো মেয়েই নেই।তাহলে কোন মেয়ের কথা বলছিলেন সাখাওয়াত আলম?শানায়া! কে এই শানায়া? সাখাওয়াত আলমের মেয়ে? কিন্তু আহান শাহরিয়ার তো বলেছিল তার বউ-বাচ্চা কেউ’ই আর বেঁচে নেই।তার মেয়ে কি তবে বেঁচে রয়েছে?খটকা লাগলো আহনাফের। এই মেয়েই তাহলে এখন আহনাফের মূল লক্ষ্য হবে।খুঁজে বের করতে হবে এই রহস্য।এই হসপিটালে যেহেতু এসেছে তারমানে এখানেই আছে তার মেয়ে।আহনাফ বিরবির করতে লাগলো—“শানায়া..শানায়া আলম।”

-‘বস টার্গেট মিস হয়ে গেছে।গুলিটা একটা মেয়ের লেগেছে।
অন্ধকার মোড়া ঘরটাতে এসে জানান দিতেই লোকটা হাতে ওয়াইনের গ্লাসটা দূরে ছুড়ে ফেললো ক্রোধে।চেঁচিয়ে উঠলো
-‘ঘোড়ার ঘাস কাটার জন্য রেখেছি তোদের! একটা কাজ ঠিক মতো করতে পারিস না।
গার্ডটা ভয় পেল।মাথা নিচু করে রেখেছে সে।সে বলে উঠলো
-‘সব প্ল্যান মতোই হচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ মেয়েটা সামনে এসে যায়।
লোকটা কপাল কুচকে বললো
-‘ওর গার্লফ্রেন্ড?
-‘জানি না বস।
লোকটা খেকিয়ে বললো
-‘তো জেনে বল আমাকে।এটাও বলে দিতে হবে?

-‘এমপি সাখাওয়াত আলমের সাথে মেয়েটার কোনো সম্পর্ক আছে স্যার।তবে কি সম্পর্ক তা এখনো অস্পষ্ট।
লোকটা বড্ড ভাবুক হলো কিছুক্ষণের জন্য।পরক্ষণেই বলে উঠলো
-‘খোঁজ নে মেয়েটার সম্পর্কে।এ টু জেড সব তথ্য চাই।
গার্ডটা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল।লোকটা ডানে বামে ঘাড় কাত করে বললেন
-‘তোর শাস্তি এখন তোর ছেলে পাবে, আহান।যদি মেয়েটা তার গার্লফ্রেন্ড’ই হয়ে থাকে তবে এবার খেলা আরো জমে যাবে।হাহা..হাহা…
নিস্তব্ধতা দিয়ে ঘিরে থাকা ঘরটাতে লোকটার হাসির শব্দ দেয়ালের প্রত্যেকটা কোণায় গিয়ে বাজলো যেন।

-‘কেমন আছিস, সুহাসিনী?
কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলো আয়ান।কুহু পিটপিট করে তাকালো।আয়ানের সিক্ত চোখজোড়া দেখে কুহু হাসলো।আয়ান বলে উঠলো
-‘একদম হাসবি না।কেন তুই সামনে গেলি?মিস্টার আহনাফকে বাঁচাতে এতো কেন চেষ্টা তোর?
কুহু অক্সিজেন মাস্কটা খুললো।আয়ান বাঁধা দিলেও শুনলো না।কুহুকে উঠে বসতে সাহায্য করলো সে।পেছনে একটা বালিস দিয়ে দিল।কুহু হেলান দিয়ে বললো
-‘অন্যকেউ থাকলেও বাঁচাতাম।
ভেতরের সত্ত্বাটা তাকে প্রশ্ন করলো তখন—“সত্যিই কি বাঁচাতি? আহনাফের প্রতি তোর দুর্বলতা তুই অস্বীকার করতে পারবি?” কুহু নিরুত্তর।সে জানে না সেসব।আয়ান হঠাৎ কুহুর হাত নিজের খসখসে হাতের আগলে নিয়ে বলে উঠলো

-‘আর কখনো এমন করিস না।তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচবো? ছেড়ে যাস না, সুহাসিনী।তোকে ছাড়া আমি বড্ড অসহায় রে..বড্ড অসহায়।
আয়ানের অক্ষিযুগল পুনরায় সিক্ত হলো।কুহু দেখে গেল তা।কিছু বললো না সে।হঠাৎ’ই আয়ান তাকে জড়িয়ে ধরলো।
-‘আমার হয়ে থেকে যাস, সুহাসিনী।আমার তোকে ছাড়া চলবে না রে।
আহনাফ একটু বাহিরে গিয়েছিল সিগারেট খেতে।নেশা হয়ে গেলে যা হয় আরকি! চাইলেও এতো সহজে ছেড়ে দেওয়া যায় না।এসেই কুহুর সাথে দেখা করার কথা তার।সে কুহুর সাথে আগে সে দেখা করবে বলেছিল কিন্তু আয়ান যাওয়ায় তার মেজাজ বিগড়ায়।বিগড়ানো মেজাজ নিয়েই সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। দরজা চাপানোই ছিল। আয়ান আর কুহুকে এভাবে দেখে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল ছেলেটার।হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হলো।কুহু আহনাফের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো।আয়ানের পিঠে রাখা হাতটা ছিটকে সরিয়ে নিল।আহনাফের শক্ত চোয়ালের দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিললো।আয়ানকে ঠেলে সরাতে চাইলো।

আহনাফ রেগে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে চলে গেল ওখান থেকে।আয়ান চমকে উঠলো দরজা বন্ধের শব্দে।কুহুকে ছেড়ে পেছনে তাকালো ছেলেটা।কুহু নিজেও কেঁপে উঠেছে।আহনাফ কি ভুল বুঝলো তাকে? বুঝলে তো ভালোই।তার পিছু ছেড়ে দিবে সে।কিন্তু তার এতো খারাপ লাগছে কেন এতে? সে তো এটাই চায় যে আহনাফ তার পিছু ছেড়ে দিক।
-‘কেউ কি এসেছিল?
আয়ানের কথায় ভাবনার সুতো ছিঁড়ে কুহুর।আনমনে বললো
-‘হয়তো….
কুহু মাথাটা পেছনে এলিয়ে দিল।চোখ বন্ধ করলো।আয়ান বলে উঠলো
-‘খারাপ লাগছে?
কুহু হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।আয়ান ভড়কে গেল।
-‘এই সুহাসিনী! কি হয়েছে? কষ্ট হচ্ছে?ডাক্তারকে ডাকবো?
কুহু দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে না করলো।আয়ান তার গালে হাত রেখে বলে উঠলো
-‘তাহলে?

কুহু নিজেও জানে না এই কান্নার কারণ।আহনাফ চলে গেল তাই কি কাঁদছে? আহনাফ তাকে ভুল বুঝেছে সেই কারণেই কি? আয়ান ভাবলো হয়তো এমন ঘটনা ঘটেছে ভয়টা জেগে উঠেছে আবার মাথায় তাই কাঁদছে।গুলি খেয়েছে সে। এটা কি কম বড় কথা! ভয়ের’ই কথা।কুহুর মাথাটা নিজের বুকে রাখলো সে।এরপর হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো
-‘ভয় নেই।কাঁদিস না।আমার যে বড্ড কষ্ট হয় তুই কাঁদলে।
কুহু থামলো না কেঁদেই গেল।আয়ানের কোনো কথাই সে কানে নিল না।
আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।তারায় ভরপুর থাকা আকাশটা নিমিষেই কেমন মেঘে ঢেকে গিয়েছে।বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।আহনাফ একের পর এক সিগারেট খেয়ে চলেছে।রাগে আজ তার মাথায় আগুন ধরে গিয়েছে।তিলোত্তমা তাকে ইগনোর করছে ঐ আয়ানের জন্য! আয়ান তাকে এতোই ভালোবাসে! আহনাফ একটু ছুঁলেই তো কেমন মোচড়ামুচড়ি শুরু করে আর আয়ানকে ঠিক’ই জড়িয়ে ধরে আছে।কই কখনো তো তাকে জড়িয়ে ধরেনি। হঠাৎ সিগারেটটা কেউ কেড়ে নেওয়ায় তার দিকে তাকালো আহনাফ।

-‘বউমার সাথে দেখা না করে এখানে এসব গোবর খাচ্ছো কেন?
আহনাফ ‘চ’ সূচক শব্দ করে সিগারেটটা নিতে চাইল কিন্তু আহান শাহরিয়ার তা দিলেন না বরং ওটা ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেললেন।আহনাফ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করতেই আহান শাহরিয়ার বলে উঠলেন
-‘হোয়াটস্ রং?
-‘নাথিং..
আহনাফের গুরুগম্ভীর স্বর।সে আরেকটা সিগারেট বের করতেই আহান শাহরিয়ার তা নিয়ে নিলেন।আহনাফ কিছু বললো না।আরেকটা বের করতে নিলে আহান শাহরিয়ার পুরো প্যাকেটটি নিয়ে নিলেন।
-‘কি সমস্যা তোমার?

আহনাফ চেঁচিয়ে বললো।আহান শাহরিয়ার ছেলের কাঁধে হাত দিলেন।উচ্চতায় দুজন প্রায় সমান।আহনাফ হাত সরিয়ে দিতে নিলে আহান শাহরিয়ার শক্ত করে চেপে ধরলেন।এরপর বললেন
-‘কুল! জেলাস ফিল করবা করো।কিন্তু রাগ করে দূরে সরিয়ে দিলে তোমার’ই লস।গভীরভাবে কেন ভাবো না তুমি?
আহনাফ শান্ত হলো যেন এবার।আহান শাহরিয়ার বললেন
-‘ও তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে আজ এখানে এসেছে।নিজের জীবনের কথা একবারও ভাবেনি মেয়েটা।তোমার কি মনে হয় না এটা পজিটিভ কোনো সিগন্যাল?
আহনাফের কুচকানো কপাল সিথিল হলো।

-‘দূরে সরিয়ে না দিয়ে কাছে কিভাবে আনা যায় সেই ব্যবস্থা করো।একটু আগে দেখে এলাম কাঁদছে সে।
-‘কেন?
আহনাফ ভ্রু কুচকে বললো।আহান শাহরিয়ার ওর কাঁধ ছেড়ে বলে উঠলেন
-‘এই তুমি কি আমার’ই ছেলে? আমার মনে তো হচ্ছে না।আমার ছেলে হয়েও কিনা ভালোবাসার বিষয় এতো অজ্ঞ! জিজ্ঞাসা করছো কেন?
আহনাফ ‘চ’ সূচক শব্দ করলো বিরক্তিতে।আহান শাহরিয়ার বললেন
-‘তোমার চলে যাওয়া দেখে অবশ্যই।
আহনাফ জিহ্ব দিয়ে গাল ঠেলে ভাবতে লাগলো কিছু একটা।পরক্ষণেই দুই কাঁধ উঁচু করে বলে উঠলো
-‘কাঁদুক গিয়ে…আমার কি?
আহান শাহরিয়ার ভড়কালেন যেন।আহনাফ হসপিটালের ভেতর আর গেল না সে পকেট থেকে চাবি বের করে গাড়ির কাছে গেল।এরপর গাড়ির ভেতরে বসে জানালার কাচ খুলে বলে উঠলো
-‘আহনাফ শাহরিয়াকে এবার প্রতি সেকেন্ডে উপলব্ধি করবে সে….তবে এবার খেলার মোড় অন্যদিকে ঘুরবে।রিভার্স হবে এবার…
আহান শাহরিয়ার এক ভ্রু উঁচু করে তাকালেন ছেলের দিকে।পরক্ষণেই দুজনে হেসে ফেললো।আহনাফ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।

-‘কেমন আছো, বার্ড?
কুহু চোখমুখ কুচকালো।এরপর কাটকাট গলায় বললো
-‘ডোন্ট কল মি বার্ড।
রাহুল হাসলো।এরপর বললো
-‘আহনাফের সাথে রিলশনে গিয়েছো সেটা তো আজ বুঝাই গেল।
কুহু বলে উঠলো
-‘ বিয়ে করে ওর বাচ্চার মাও হবো।তাতে আপনার কি? আচ্ছা আপনার লজ্জা বলতে কিছু নেই তাই না?
রাহুল হেসে দুই দিকে মাথা নাড়লো।কুহু বলে উঠলো
-‘আপনাকে পুলিশে দিব আমি।
-‘আচ্ছা।
রাহুলের সহমত পোষণ করা ভালো লাগলো না তার।সে বলে উঠলো
-‘আপনার বউয়ের উপর আল্লহর গজব পড়বে।
-‘ভাগ্যিস অবিবাহিত।
রাহুল মুচকি হেসে বললো।কুহু বলে উঠলো
-‘আপনি একটা খাটাশ।
-‘তোমারে কোপাবো আমি, ফাজিল।

রাহুল রেগে যাওয়ার অভিনয় করে বললো কথাটা।কুহুর মনে পড়ে গেল তাদের অতীতের কিছু অংশ। কুহু এইরকম কথা বললেই রেনান তাকে এই কথাটা বলতো।তবে রেনানের ভালো মানুষের আড়ালের হায়নাটার কথা মনে পড়তেই তার আবেগে ভাঁটা পড়লো।চোখমুখ শক্ত করে বললো
-‘চলে যান এখান থেকে।
-‘থাকতে তো আসিনি।
কুহু বলে উঠলো
-‘আপনি এখন রোদের পেছনে পড়েছেন তাই না?
রাহুল হাসলো।অদ্ভুদ সেই হাসি।কুহু বলে উঠলো
-‘আমি থাকতে রোদের কোনো ক্ষতি আপনাকে করতে দিব না।আমার সাথে যা হয়েছে তা আমি ওর সাথে হতে দিব না।
রাহুল বলে উঠলো

-‘এসবের মাঝে এসো না বার্ড। তোমার ক্ষতি আমি করতে চাই না।
কুহু হাসলো।বিদ্রুপ মেশানো হাসি।পরক্ষণেই রাগি স্বরে বলে উঠলো
-‘আমার এতো বড় সর্বনাশ করে এখন বলছেন আমার ক্ষতি করতে পারবেন না! আপনার মতো অমানুষের ফাঁদে আমি রোদকে পড়তে দিব না।দরকার পড়লে আ…
-‘আই লাভ হার, বার্ড।
কুহু থেমে গেল।এরপর হো হো করে হাসতে লাগলো।পরপর’ই ওর শার্টের কলার চেপে ধরে বলে উঠলো
-‘ভালোবাসিস! হ্যাঁ? ভালোবাসা মানে বুঝিস তুই? তোর ভালোবাসা তোর পেছন দিয়ে ভরে দিব বাঙ্গির পোলা।
রাহুল নিজের কলার ছাড়িয়ে বিরক্তমাখা স্বরে বললো
-‘কেমন ভাষা এগুলো?

কুহুর রাগ সপ্তম আসমানে।সে আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খুঁজতে লাগলো।রাহুলের ভ্রু কুচকে এলো।কুহু হাতের সামনে ছুড়ি পেয়ে সেটাই হাতে তুলে নিল।রাহুল উঠে দাঁড়ালো তা দেখে।কুহু
ছুঁড়িটা রাহুলের দিকে ছুড়তে নিলে রাহুল বলে উঠলো
-‘নো বার্ড..
-‘তোর নানি বার্ড..

প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ২০ (২)

রাহুল বুঝলো এর সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।তার কেটে গেছে এর।সে দ্রুত কদমে বেরিয়ে যেতে নিল।কুহু জানে না সে কি করছে।শুধু এতোটুকু জানে সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটা একটা বিষধর সাপ যার বিষে কুহুর জীবন ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।সে ছুড়িটা ছুড়ে মারতেই সেটা গিয়ে লাগলো রাহুলের পশ্চাৎদেশে।রাহুল হতভম্ব হয়ে পেছনে ঘুরলো।এরপর’ই গগন কাঁপানো এক চিৎকার দিয়ে উঠলো সে।কুহুও যেন হুশে ফিরে এলো।রাহুলংর পেছনে রক্ত দেখে সে নিজেও চেঁচিয়ে উঠলো।

প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here