প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ২৩
অনন্যা
-‘আরে আয়ান! কেমন আছিস?
আয়ান মুচকি হেসে বললো
-‘ভালো আছি।তোমার কি খবর বলো?
-‘বিন্দাস।
আয়ান হাসলো।কুহুর পাশে এসে বসলো সে।এরপর বললো
-‘তোর ফোন কোথায়? কতবার কল করলাম!
কুহু বলে উঠলো
-‘দেখেছি আমি।
-‘তো রিসিভ করিসনি কেন?
স্বর খানিকটা গম্ভীর হলো আয়ানের।কুহু বললো
-‘ইচ্ছা হয়নি তাই।
আয়ান ব্যথিত নয়নে তাকালো ওর দিকে।রাইফা সবটা পর্যবেক্ষণ করছে।আয়ানের কুহুর প্রতি অনুভূতি সম্পর্কে সে অবগত।তবে কোনো একটা কারণে সে চায়না আয়ান এই বিষয়টা নিয়ে এগিয়ে যাক।আয়ান যথেষ্ট ভালো একটা ছেলে।এমন নয় যে কুহু খারাপ।কুহুও অনেক ভালো তবে তার যে সর্বনাশ হয়েছে সেটা তো সে অস্বীকার করতে পারবে না।এই পাপের ভার তাকে সারাজীবন বয়ে যেতে হবে।আয়ান এখনো আবেগে পড়ে রয়েছে।আবেগ দিয়ে জীবন চলে না।তাই রাইফা খুব করে চায় যেন আয়ান তার সিদ্ধান্ত বদলাক।এতে কুহুরও ভালো হবে।কারণ কুহু নিজেও আয়ানকে সেই স্থানটা দিতে পারবে না।আয়ানকে সে ভাইরূপে মানে এটা রাইফা জানে।আয়ানের আচরণে কুহুর অস্বস্থি ভাবও সে লক্ষ করেছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-‘ও আপু!
-‘হুঁ?
ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো রাইফা।
-‘কি ভাবছো এতো? দুলাভাইকে পেয়ে গেছো নাকি?
কুহু দুষ্টু হেসে বললো।রাইফা হেসে বললো
-‘ইহ! শখ কতো! আমার বাবা ওসব বিয়ে টিয়ের ইচ্ছা নেই।সিঙ্গেল লাইফ’ই বিন্দাস।
আয়ান বলে উঠলো
-‘তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করছি এবার।যদি ভালো পাত্র না পাই তাহলে পাশের বাড়ির জমিল দাদুর সাথে বিয়ে দিয়ে দিব।কি বলিস, সুহাসিনী?
আয়ান আর কুহু হেসে কুটিকুটি হলো।রাইফা বলে উঠলো
-‘ওরে বাবা! না..না..ওসব বুড়ো লোকের সেবা আমি করতে পারবো না।বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে কচি ছেলে দেখে করবো।হুহ্!
কুহু বলে উঠলো
-‘জুনিয়র ছেলে?
-‘ছেলে ভালো হতে ক্ষতি কি!
রাইফা মজা ছলে কথাটা বলে হাসলো।ভাগ্যের কথা বলা বড়’ই মুশকিল।আয়ান বলে উঠলো
-‘তুই ফোন রিসিভ না করে নিজের’ই ক্ষতি করলি রে, সুহাসিনী।
কুহু এক ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।আয়ান বলে উঠলো
-‘তোর জন্য আইসক্রিম আনতে চেয়েছিলাম।কয়টা আনবো সেটাই জিজ্ঞাসা করতে কল করেছিলাম।কিন্তু তুই তো…
দুঃখী হওয়ার ভান করলো আয়ান।কুহুর মনে প্রচুর আফসোস হলো ব্যাপারটা নিয়ে।যা! এটা কি হলো! কুহু দুঃখী স্বরে বললো
-‘এটা কোনো কথা! আপনি নিয়ে আসতেন দশ-বারো বক্স।এটা আবার জিজ্ঞাসা করা লাগে!
আয়ান দুই কাঁধ উঁচু করে বললো
-‘আমার আর কি! তুই’ই..
কুহু হাতের কিন্ডার জয়টা দিয়ে আয়ানের বাহুতে মেরে বললো
-‘আপনি ভাই নামের কলঙ্ক।যান ভাগেন…
বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো আয়ান।হতবিহ্বলিত স্বরে বললো
-‘ভাই!
রাইফা মাঝে বলে উঠলো
-‘অন্যকিছু নাকি?
আয়ান ভুলেই গিয়েছিল রাইফার উপস্থিতির কথা।আমতা আমতা করে মেকি হেসে বললো
-‘ইয়ে মানে..নাহ্ আর কি হবে!
আয়ান ভাবলো এখানে থাকাটা আর ঠিক নয় তার জন্য।সে উঠে দাঁড়ালো।যাওয়ার আগে পিছে ফিরলো একবার।এরপর বললো
-‘ফ্রিজে আপনার প্রিয় চকলেট ফ্লেভারের আইসক্রিম রাখা আছে।মন খারাপ করিয়েন না আর।
কুহু খুশিমনে বলে উঠলো
-‘ধন্যবাদ ভাইয়া।
আয়ানের মনে হলো ওর বুক বরাবর কেউ তীর ছুড়লো।কুহুর মুখে ভাইয়া শব্দটা খুব কম শোনা হয় তার।আজ একটু বেশিই বলছে মেয়েটা।আয়ান আর এক মুহূর্ত না থেকে চলে গেল।রাইফা বলে উঠলো
-‘তোদের ভাই-বোনের খুনশুনি দারূন লাগে আমার।
কুহু খুব প্রসন্ন হলো।আয়ানকে তার ভাই বললে তার ভালো লাগে।অথচ বোকা আয়ান সেসব বুঝে না।সে কুহুকে নিয়ে উল্টোপাল্টা ভাবে।এতে কুহুর যে কতটা অস্বস্থি হয় সেটা যদি ওর চোখে পড়ে!
হতাশার শ্বাস ছাড়লো কুহু।রাইফার সাথে টুকটাক কথা বলতে লাগলো।মাঝে আনোয়ারা বেগম নাস্তা দিয়ে গেলেন।তিনিও একটু যোগ দিয়েছিলেন ওদের আড্ডায় পরে আবার কাজ আছে বলে চলে গেলেন।
আকাশে আজ মস্ত বড় এক চাঁদ উঠেছে।তারাগুলো মিটমিট করে জ্বলছে আকাশের বুকে।আজ এই চাঁদের সৌন্দর্য রোদেলাকে মুগ্ধ করতে পারলো না।একবার তাকিয়েই নজর সরিয়ে নেয় সে।কানে গুজে রাখা ফোন।বিছানায় হেলান দিয়ে বলতে লাগলো
-‘আমার ভালোবাসাটা ছিল একপাক্ষিক।আমি যাকে ভালোবাসি সে অন্য কাউকে ভালোবাসে।আবার সে যাকে ভালোবাসে ঐ মেয়েটা অন্য একজনকে ভালোবেসে নিঁখুতভাবে ঠকেছে যার দরূন সে ভালোবাসায় অবিশ্বাসী।আমি পুড়ছি তার বিরহে আর সে পুড়ছে ঐ মেয়ের বিরহে।ঐ মেয়ে কিনা আবার আমার’ই বেস্ট ফ্রেন্ড হয়।লড়াই করার শক্তিটুকুও বুঝি সেই জন্য নেই।
রোদেলা তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো।ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটা বলে উঠলো
-‘আর পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা? সেই যন্ত্রণার থেকে কি এই যন্ত্রণা বেশি?
রোদেলা নিশ্চুপ।ফোনের ওপাশ থেকে গম্ভীর পুরুষালি স্বরটা আবার ভেসে এলো
-‘যেখানে মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই সেখানে মায়া কাটাতে হয়।
রোদেলা বললো
-‘এতোই সহজ মায়া কাটানো?
রাহুল ‘চ’ সূচক শব্দ করে ফোনটা কান থেকে সরিয়ে সামনে আনলো।যথাসম্ভব মাথা ঠাণ্ডা করে বললো
-‘তোমার কি উচিত না ওদের ঘৃণা করা? বিশেষ করে তোমার ঐ ফ্রেন্ডকে।ও’ই তো মূল বাঁধা হয়েছে।জঘন্য!
-‘আপনার মতন।
রোদেলার এহেন কথা শুনে খানিকটা ভড়কালো রাহুল।পরমুহূর্তেই বললো
-‘আমি জঘন্য?
-‘ওদের নিয়ে বাজে কথা বলবেন না আগেও বলেছি।আহনাফ ভাইকে নিয়ে তো নয়’ই।কারণ সে চাইলেই পারতো অমার ফিলিংস নিয়ে খেলতে।যেভাবে আমার ফ্রেন্ডের ফিলিংস নিয়ে ঐ ইতরটা খেলেছিল।কিন্তু তিনি তা করেননি।তিনি দিনের পর দিন আমাকে ইগনোর করেছেন।যখন বুঝলেন আমি উনার প্রতি অনেকটা দুর্বল তখন বাড়ি ছেড়েই চলে গেলেন।আমাকে সবভাবে এড়িয়ে গেছেন তিনি।আর কুহু! ওকে আমি দোষ দিব না।কারণ ও এখনো রাজিই হয়নি।আর না ও আহনাফ ভাইকে উসকিয়েছে।আহনাফ ভাই’ই ওর পেছনে পড়ে আছে।
রাহুল ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো।এরপর বললো
-‘তোমার না আরেক চাচাতো ভাই এসেছে।সে কেমন?
রোদেলাকে একটু বাজাতেই সে কথাটা বললো।কারণ তার জানা মতে রোদেলা তাকে চিনে না।রোদেলা এখনো রেনান আর রাহুলকে আলাদা হিসেবেই জানে।বান্ধবীর প্রতিশোধ নিতেই তো রেনানের সাথে ভাব করেছে সে।ভেবেছে রাহুল বুঝবে না সেটা।অথচ বোকা রাহুল রোদেলাকে এখনো ঠিক করে চিনতেই পারেনি।রোদেলা রাহুলের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বললো
-‘উনিও বেশ ভালো।তবে ফ্ল্যার্ট করে অনেক।ভালো লাগে না তাই।
রাহুল হাসলো।তার মানে একটু হলেও মন জয় করতে পেরেছে সে?গ্রেট! রাহুল এর আগে প্রেম করেছে অনেক।অবশ্য সেসবের কারণ আছে যথেষ্ট। তবে ভালো বোধহয় এই প্রথম বেসেছে।এর আগে তার হৃদস্পন্দন কারো জন্য স্পন্দিত হয়নি।অথচ রোদেলাকে দেখলেই আজকাল তার হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক হয়ে যায়।মাঝে মাঝে তার হাসি পায়।তার মতো ছেলে কিনা শেষমেষ ভালোবেসেই ফেললো! রোদেলার মন পেতে সে উদগ্রীব।সে রোদেলাকে চায়।তবে অন্যমেয়েদের মতন নয়।সে রোদেলাকে পবিত্রভাবে চায়।সবটা উজাড় করে দিতে চায় সে রোদেলার পানে।তার মাধ্যমে সে নিজের অতীতগুলো ভুলতে চায়।রাহুলের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।রোদেলা বলে উঠলো
-‘রেনান, আছেন?
-‘হুঁ?
ভাবনা থেকে বের হলো রাহুল।রোদেলা বলে উঠলো
-‘আমার এই ভগ্ন হৃদয় নিয়ে এখন কোথায় যাই বলুন তো?
-‘আমার কাছে চলে এসো।
রোদেলা ক্ষেপে বললো
-‘চুপ করুন, অসভ্য পুরুষ।
রাহুল হো হো করে হাসতে লাগলো।রোদেলা আরকিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দিল।দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে।আজ বোধহয় পূর্ণিমা।জানালা দিয়ে চাঁদের আলো রোদেলার বিছানায় পড়ছে।রোদেলা বেলকনিতে গেল।নিরব আকাশের পানে তাকিয়ে বলতে লাগলো
-‘আপনাকে না পাওয়ার আক্ষেপ আমার ইহজনমে ফুরাবে না, আহনাফ ভাই।এমন একজনকে আপনি মন দিয়ে বসেছেন যার বিরুদ্ধে লড়াই করাটা অসম্ভব আমার পক্ষে।না চাইতেও আপনাকে পাওয়ার লড়াইয়ে আমাকে পরাজয় স্বীকার করতে হচ্ছে।অবশ্য লড়াইটাই বা কোথায় করতে পারলাম!
তাচ্ছিল্য করে হাসলো রোদেলা।না চাইতেও আঁখিযুগল পানিতে টইটুম্বর হলো মেয়েটার।ভাঙা স্বরে বলতে লাগলো
-‘আপনাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা মরণসম আমার কাছে, আহনাফ ভাই..মরণসম।নিজেকে শেষ করে দিতে কতবার যে হাতে ছুড়ি তুলে নিয়েছিলাম তা আপনি কোনোদিনও জানবেন না।বেঁচে আছি তো কেবল একটা কারণে।উদ্দেশ্য সফল হোক একবার।আর থাকবো না এখানে..অনেক দূরে পারি জমাবো এরপর…অনেক দূরে।ভাগ্যে না থাকলেও আপনি আমার হৃদয়ে রয়ে যাবেন সর্বদা, আহনাফ ভাই..সর্বদা…
রোদেলা ধপ করে নিচে বসে পড়লো।ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মেয়েটা।নিশুতি রাতটা তার কান্নার শব্দে তোলপাড় হলো।চাঁদটাও বোধহয় মায়াভরা দৃষ্টিতে তার পানে তাকিয়ে।
ঘড়ির কাটা দুইয়ের ঘরে এসে পৌঁছালো।আঁধারে মোড়া ঘরটাতে ফ্যানের শো শো শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না।কুহুর চোখে আজ ঘুম ধরছে না।মনটা বড্ড অস্থির লাগছে।এপাশ ওপাশ করছে বারবার।রাইফা তার পাশেই শুয়ে।তারও ঘুম আসছে না।হঠাৎ জায়গা পরিবর্তন হওয়ায় ঘুম আসতে সময় লাগছে।সেই জন্য সেও জেগেই। কুহুকে এরকম বারবার এপাশ ওপাশ করতে দেখে ও উঠে বসলো।এরপর বলে উঠলো
-‘এমন করছিস কেন? কি হয়েছে?
কুহু তাকালো ওর দিকে।রাইফা বিছানা থেকে নেমে লাইট অন করলো।এরপর ওর অভিমুখে এসে বসলো।কুহু ধীরে ধীরে উঠে বসলো।অসহায় স্বরে বললো
-‘ঘুম আসছে না।মনটা বড্ড অস্থির অস্থির লাগছে।
-‘ওমাহ কেন?
-‘কি জানি!
কুহুর মনমরা উত্তর।রাইফা ভাবুক হলো খানিকটা।হঠাৎ বলে উঠলো
-‘তোর ফোন কোথায়?
কুহু কপাল কুচকালো।এত রাতে সে ফোন নিয়ে কি করবে? পাশ থেকে তাও ফোনটা নিয়ে রাইফার দিকে দিল সে।রাইফা ফোনটা একপ্রকার ছিনিয়ে নিল।কুহু হতভম্ব হলো।রাইফা কুহুর হোয়াটস্অ্যাপে গেল। আহনাফ খাটাশ লেখা নামটা দেখে বিশ্বজয়ের হাসি দিল।কুহু বুঝতে পারছে না রাইফা কি করতে চাইছে।তবে সে যতক্ষণে বুঝলো ততক্ষণে অনেকটা লেইট হয়ে গেছে।কুহু চেঁচিয়ে উঠলো
-‘এই নাআআ…
রাইফা খিলখিল করে হেসে ফোন উঁচু করে ফেললো।কুহু ফোন নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে।
আহনাফ কুহুর সাথে করা আগের ম্যাসেজগুলো পড়ছিল।রোজরাতে এখন এটাই করে সে।তবুও কুহুকে নিজ থেকে ম্যাসেজ, কল করে না।এটা ওর শাস্তি।কিন্তু এখন আহনাফ বুঝতে পারছে যে শাস্তিটা আসলে কে পাচ্ছে।তিলে তিলে সে মরছে তিলোত্তমার স্বর না শুনে, তাকে একটাবার না দেখে।অথচ ঐ মেয়ের কোনো হুশ নেই।সে তো ভালোই আছে।আয়ান ভাই আছে না তার! এই একটা নাম আহনাফের মাথায় আগুন ধরিয়ে নেয়।বলবে না কথা তার তিলোত্তমার সাথে।
আহনাফের অনুপস্থিতি সে বুঝুক।বেহায়ার মতো পেছনে পড়ে থাকলে সে কখনো বুঝবে না।তবে আহনাফ একটা জিনিস ভেবে পায় না যে দুনিয়ায় এতো মেয়ে থাকতে সবাই তার’টার পেছনেই কেন পড়ে।দুনিয়ায় মেয়ের অভাব! রাহুলও আবার ওকেই ফাঁদে ফেলেছিল।এই ব্যাপারটাও তাকে রাগিয়ে তুলে।আর মেয়ে পেল না! আহনাফের ভাবনার মাঝেই ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠলো।খানিকটা চমকালো সে।তবে তার চেয়ে বেশি চমকালো নামটা দেখে। “তিলোত্তমা” নামটা জ্বলজ্বল করছে।হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক গতিতে চলতে লাগলো তার।মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন দেখছে।তিলোত্তমা কল করেছে তাকে! আহনাফের বিশ্বাস হচ্ছে না।এ কেমন অনুভূতি আল্লাহ! আহনাফের চেহারা খুশিতে ঝলমল করে উঠলো। রিসিভ করলো সঙ্গে সঙ্গে।নিজেকে যথাসম্ভব গম্ভীর রাখার চেষ্টা করলো।রাশভারী স্বরে বললো
-‘হ্যালো….!
কুহুর ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো এতোদিন পর পরিচিত কণ্ঠস্বরটা শুনে।রাইফা ফোনটা ওর হাতে দিয়ে মুখে হাত চেপে হাসতে লাগলো।কুহু ভাবলো কলটা কেটে দিবে কিন্তু রাইফা হাসির মাঝেই চোখ রাঙালো ওকে।দিশেহারা হলো মেয়েটা।এদিকে আহনাফ কারো আওয়াজ না পেয়ে আবার বললো
-‘হ্যালো!..তিলোত্তমা?
কুহুর অস্থির মনটা শান্ত হলো বুঝি এবার।আহ্! তিলোত্তমা! কতগুলো দিন পর শুনলো নামটা।মনের ভেতর শান্তির স্রোতধারা বয়ে গেল তার।রাইফার দিকে নজর যেতেই দেখলো ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টু হাসছে।কুহু আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না এখানে।বিছানা থেকে সাবধানে নামলো।এরপর দ্রুতকদমে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।রাইফা হো হো করে হেসে ফেললো তা দেখে।সে ঠিক’ই ধরেছে কুহু আহনাফকে পছন্দ করে।সেও খুব করে চায় আহনাফের সাথে তার মিল হোক।কুহুর কাছে আজ সারাদিন সে আহনাফের সম্পর্কে শুনেছে।শুনে যতদূর সে বুঝেছে,,ছেলেটা খারাপ নয়।তাহলে আর অসুবিধা কোথায়? আয়ানেরও একটা ব্যবস্থা করা উচিত এবার।কুহুর ধ্যান ছাড়ানো উচিত ওর মাথা থেকে।রাইফা শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো কি করে কি করা যায়।
কুহু এই মাঝরাতে পা টিপে টিপে ছাদে এসেছে।ঘরে কথা বলাই যাবে না।ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক তাই ছাদে চলে এসেছে।ছাদে এসে স্বস্থির শ্বাস ছাড়লো সে।ঝিঁঝি পোকার শব্দ শোনা যাচ্ছে।চাঁদের আলোয় পুরো শহর আজ আলোকিত।সবটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কুহু।মনটা প্রসন্ন হলো খুব।ফোনের দিকে তাকালো সে।আহনাফ এখনো লাইনেই আছে।ভেতর ঢিপঢিপ করছে কুহুর।কানের কাছে ফোনটা নিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো
-‘হ’হ্যালো!
আহনাফ চোখ বুজে ফেললো।আহ্! স্বর শুনেই এতো শান্তি লাগছে তার! এই মেয়েটাকে কাছে পেলে না জানি কি হবে! তবে এই ক’দিন কেন কল করলো না তাকে? আহনাফের অভিমান হলো।সে অভিমানী স্বরে বললো
-‘আজ মনে পড়লো এই অধমের কথা!
কুহু বলে উঠলো
-‘আপনার তো মনেও পড়েনি।কল তো সেই আমাকেই দেওয়া লাগলো।
আহনাফ হাসলো।এরপর বললো
-‘আমার আপনাকে মনে পড়েনি!! আপনার তাহলে এখনো আমাকে অনেক বোঝা বাকি।অবশ্য বুঝার ট্রাই’ই তো করেননি কোনোদিন।
কুহু কিছু বলতে পারলো না।ভালোবাসতে যে এখন বড্ড ভয় হয় তার।রেনান তাকে অনেক যত্নসহকারে ঠকিয়েছে।যে ভালোবাসায় পূর্ণতা নিশ্চিত ছিল সেই ভালোবাসার বিচ্ছেদ ঘটেছে।কুহুর তাই এখন ভয় হয়।তার ভাঙা হৃদয়টা আবার কেউ ভাঙলে সে আর বাঁচবেই না।তার ভাবনার সুঁতো ছিড়লো আহনাফের কথায়
-‘এসব বাদ দিন আপনি এখন আমার অভিমান ভাঙান।আমি আপনার উপর অভিমান করেছি।
ইশ! কি নিষ্পাপ আবদার! আমার অভিমান ভাঙান! আহনাফের বাচ্চাসুলভ আচরণে কুহু না চাইতেও হেসে ফেললো।আহনাফ কুহুর হাসির শব্দ শুনলো।তখন সে বলে উঠলো
-‘এই..এই ! আপনি হাসছেন? আমার হাসার মতো কিছু কি বলেছি? আমার অভিমান ভাঙাবেন এখন আপনি।
কুহু হাসি চেপে বলে উঠলো
-‘আমিও অভিমান করেছি।
আহনাফের ঠোঁটের কোণে হাসি লেপ্টে রয়েছে।সে বললো
-‘এই এক মিনিট! আপনি অভিমান করেছেন মানে? আপনি তো আমাকে ভালোইবাসেন না। তাহলে অভিমান কিসের?আপনার অভিমান তো জায়েজ নয়।আমার অভিমান করাটা মানা যায়।
কুহু কিছুক্ষণের জন্য নিরব হয়ে গেল কথাটা শুনে।সত্যিই তো! সে কেন অভিমান করবে? কুহুর এবার রাগ লাগছে।রাগে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে।নিজের গালে থাপ্পর মারতে মন চাইছে।আবার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে সে।ভেতরের সত্ত্বাটা বিদ্রুপ করে বলে উঠলো
“একবার ঠকেও তোর শিক্ষা হলো না! যা আবার প্রেমে পড়..আবার যখন ঠকবি তখন বুঝবি।”
কুহু ঠোঁট কামড়ে ধরলো।মনের মাঝে রাইফার সকালে বলা কথাটা বেজে উঠলো—-” মনকে জোর করিস না।যেটা হচ্ছে হতে দে।জোর করে হ্যাঁ কে না করিস না।” কুহু কি আরেকবার ঝুঁকি নিবে? ঐদিকে আহনাফ হ্যালো হ্যালো করছে।কুহু হুশে ফিরলো যেন।
-‘হুঁ?
-‘হুঁ? হুঁ কি? আমার একটা কথাও কি আপনি শোনেননি নাকি? কি করছেন আপনি?
আহনাফ রাগ-অভিমান করলেই আপনি আপনি করে কথা বলে। কুহুর আহনাফের এই জিনিসটা বড্ড ভাল্লাগে। সে হঠাৎ বলে উঠলো
-‘আচ্ছা একটা কথা বলবো?
-‘হাজারটা বলুন।
আহনাফের উত্তরে মুচকি হাসলো কুহু।এরপর বললো
-‘আমাকে ভালোবাসার কারণ বলেন।আমি শুনতে চাই।
আহনাফ কপাল কুচকে টুচকে বললো
-‘কারণ? ভালোবাসতে কারণ লাগে? জানা ছিল না তো।
-‘মজা করবেন না একদম।
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো
-‘ভালোবাসতে কারণ লাগে না, ম্যাডাম।
-‘উঁহু..কিছু তো আছে যার জন্য পেছনে পড়ে আছেন।
আহনাফ এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে পায় না।কুহুকে প্রথম যেদিন ভার্সিটিতে দেখেছিল তখন কিছু একটা হয়েছিল তার হৃদয়ে।কুহুর সিক্ত আঁখি তাকে বিমুগ্ধ করেছিল।ঐ ভাসা ভাসা নয়নে তাকিয়ে ভুলে বসেছিল সবটা।কেন এমন হয়েছিল সে জানে না।শুধু জানে এই মেয়েকে তার চাই।কুহু তাড়া দিল তাকে
-‘বলছেন না কেন?
-‘তোমাতে শান্তি খুঁজে পাই আমি, তিলোত্তমা।এর কারণ আমার নিজের’ই অজানা।তোমার চোখে তাকালে আমার হৃদ…
-‘হয়েছে..হয়েছে… আমি তেল কম খাই।সো তেল দিবেন না।আচ্ছা আপনি কি আমার সাথে প্রেম করতে চাইছেন নাকি ভালোবাসতে?
আহনাফ হাসলো।এরপর বললো
-‘প্রেমের জ্বালে ফেলে ভালোবেসে বিয়ে করে বাচ্চার মা বানাতে চাই।
-‘কিন্তু আমি তো কোনোদিন মা হতে পারবো না।
আহনাফ জিহ্বে কামড় দিল।নিজের উপর রাগ হলো তার।ব্যাপারটা বুঝে বলা উচিত ছিল।কুহুর মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল আবার।আহনাফ নিজেকে গালিগালাজ করে শান্ত হয়ে বললো
-‘আমাকে পালবে।আমিও বাচ্চার থেকে কম কীসের? তোমার দামড়া খাটাশ বেবি।সুন্দর না?
কুহু ফিক করে হেসে ফেললো।আহনাফ যেন স্বস্থি পেল।কুহু ওমন সময় বললো
-‘আমার ভাঙা হৃদয় আপনার হাতে তুলে দিলে আপনি তা ঠিক করে দিতে পারবেন, আহনাফ?
আহনাফ চমকে উঠলো যেন।তিলোত্তমা তাকে আহনাফ ডাকলো?তার হৃদয় দিতে চাইছে! আহনাফের খুশিতে লুঙ্গি ডান্স দিতে মন চাইল।তবে সে নিজেকে সামলে বললো
-‘ঠিক মানে…একদম সুপার গ্লু..না..না..আহনাফের স্পেশাল পিরিতের গ্লু দিয়ে ঠিক করে দিব।একটাবার আমার কাছে দিয়েই দেখো না কতটা যত্ন, কতটা ভালোবেসে মুড়িয়ে রাখি!
কুহুর চোখ আচমকা ছলছল করে উঠলো।নিজের হৃদয়কে আর মানাতে পারছে না সে।যা হওয়ার হবে এবার।আল্লাহ’র উপর ছেড়ে দিবে এবার সে।আহনাফ খানিকটা আমতা আমতা করে বলে উঠলো
-‘উম..আ-ম..হবে আমার?তোমার ভগ্ন হৃদয় ঠিক করার সুযোগ দেবে কি?
কুহুর গাল বেয়ে উষ্ণ তরল গড়িয়ে পড়লো।বলে উঠলো
-‘দিব…তবে এবার ঠকলে আমি আর বাঁচবো না, আহনাফ।নিজেকে আর স্বাভাবিক করতে পারবো না আমি।
আহনাফ দৃঢ় গলায় বলে উঠলো
-‘তোমার হৃদয় ভাঙার সাধ্য আমার নেই, তিলোত্তমা।যে পর্যন্ত বেঁচে আছি আমার হৃদয় শুধু তোমার নামেই স্পন্দিত হবে।মৃত্যুর আগ অবধি…ধুরো বা/ল সামসামনি বললে ভালো হতো।আচ্ছা তিলোত্তমা আমি এক্ষুণি আসছি।ফোনে ভাল্লাগছে না।তুমি দাঁড়াও হ্যাঁ? আমি আসছি, তিলোত্তমা…
প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ২২
কুহুকে কিছু বলতে না দিয়েই আহনাফ কল কেটে দিল।কুহু হতভম্ব হলো।এ পাগল নাকি! পরক্ষণেই হেসে ফেললো সে।হঠাৎ পেছনে দিকে ফিরতেই আত্মাটা লাফিয়ে উঠলো তার।আয়ান!!! চাঁদের সোনালি আলোয় কুহু স্পষ্ট তার চোখে পানি দেখতে পেল।ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছেলেটা।
