প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ২৯
Drm Shohag
দেখতে দেখতে মাইরার এক্সাম শেষ। মাইরা তো মহাখুশি। এতোদিন এক্সামের প্যারায় মন খুলে কিছু করতে পারেনি। আজ যা মন চায় করবে, শান্তিতে একটু মজা করবে। ভাবতেই শান্তি লাগছে।
“আম্মাজান আমি শাড়ি পড়তে চাই।”
মাইরার কথা শুনে তৃণা বেগম মৃদু হেসে বলল,
“কেন?”
মাইরা আমতা আমতা করে বলে,
“আমার বান্ধবীর সাথে মেলায় ঘুরতে যাবো। যাই? এক্সাম তো শেষ।”
তৃণা বেগম হেসে বলল,
“পাগলি মেয়ে। পারমিশন চাইছিস কেন? তোর মন চাইলে পরবি, ঘুরবি।”
মাইরা মন খা’রা’প করে বলে,
“কিন্তুু আমার শাড়ি নেই। তোমার শাড়ি আছে? আমি পরতেও পারিনা। আমায় পরিয়ে দিবে?”
তৃণা বেগম হেসে ফেললেন। এগিয়ে গিয়ে আলমারি থেকে সবুজ রঙের একটি সিল্কের জর্জেট শাড়ি বের করে আনে। মাইরা অবাক হয়ে বলে,
“ওয়াও! এই শাড়ি টা তো অনেক সুন্দর আম্মাজান। এটা তোমার?”
তৃণা বেগম শাড়ির ভাঁজ খুললেন ধীরে ধীরে। মৃদু হেসে বলেন,
“এটা আমার ইরফানের বউয়ের জন্য কিনেছি। শুদ্ধ আর ইরফানের বউয়ের জন্য একইরকম শাড়ি কিনে রেখেছিলাম। আজ তুই নিজেই পরতে চাইছিস, তাই বের করে দিলাম।”
মাইরা খুশি হয়ে বলে,
“শুদ্ধ ভাইয়ার বউ কে হবে তুমি ঠিক করে রেখেছ আম্মাজান? কোথায় সে? আমার সাথে তো পরিচয় করালে না?”
তৃণা বেগম মৃদু হেসে বলেন,
“তুই তোর বান্ধবীর সাথে ঘুরে আয়। এরপর শুদ্ধর বউকে দেখাতে নিয়ে যাব। এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয় ওদের বাসা।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাইরার চোখ উজ্জ্বল হলো। ওয়াও! এই গ্রামেরই মেয়ে? ভালোই হবে। তার সাথে জমবে ভালো। মাইরা শাড়ির ভেতরের কাপড় পরে আসলে তৃণা বেগম খুব সুন্দর কুঁচি করে মাইরাকে শাড়ি পরিয়ে দেয়। জর্জেট হওয়ায় সময় লাগলো পরিয়ে দিতে। বেশ অনেকগুলো সেফটিপিন লাগিয়েছে। মাইরা খুব মনোযোগ সহকারে দেখছে শাড়ি পরানো। যেন এরপর কখনো পরতে ইচ্ছে করলে নিজে নিজেই পরতে পারে। ভালোই লাগে শাড়ি পরতে। তৃণা বেগম শাড়ি পরানো শেষ করে মাইরার আঁচল ঠিক করে দিল। জিজ্ঞেস করল, ‘আঁচল ছেড়ে রাখবে না-কি কুঁচি করে কাঁধে তুলে দিবে!’
মাইরা ছেড়েই রাখতে বলে। তৃণা বেগম মাইরার কথায় শাড়ির আঁচল কাঁধে ছেড়ে দিল। সম্পূর্ণ শাড়ি পরানো শেষ করে মাইরার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। ফর্সা শরীরে গাঢ় সবুজ রঙের শাড়িতে মাইরাকে ফুটেছে বেশ।
তৃণা বেগম শব্দ করে বলে ওঠে, ‘মাশাআল্লাহ সুন্দর লাগছে তো আমার ইরফানের বউটাকে।’
মাইরা লজ্জামাখা হাসি হাসলো। সুন্দর বলার চেয়ে ইরফানের বউ বলায় বেশি ল’জ্জা পায় মেয়েটা। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
“এসে কিন্তুু শুদ্ধ ভাইয়ার বউকে দেখতে যাব আম্মাজান। তুমি রেডি হয়ে থাকো।”
তৃণা বেগম মৃদু হাসে মাইরার চঞ্চলতায়। মনটা বেশি ভালো হলো শুদ্ধর জন্য পছন্দ করা মেয়েকে দেখতে যাবে ভেবে।
মাইরা মাথার উপর শাড়ির আঁচল টেনে মিমের বাড়ির দিকে যায়। হাঁটতে একটু একটু প্রবলেম হলেও খুব বেশি হচ্ছে না। এর আগে একবার পরেছিল, দ্বিতীয়বার সামলে নিতে পারছে মোটামুটি। মিমের বাড়ি গেলে তাকে পায় না। মেয়েটা না-কি তার খালার বাসায় বেড়াতে গিয়েছে। মাইরার মন খা’রা’প হয়। তাহলে সে একা একা শাড়ি পরল কেন? মন খা’রা’প নিয়েই উল্টো পথে হাঁটা ধরে। নিজে নিজেই ঘুরে বাড়ি যাবে এই ভেবেই ধীরপায়ে হাঁটতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে মাঠ দিয়ে ফাঁকা জায়গায় একটা ছোট্ট পুকুরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আশেপাশে তেমন কেউ নেই।
মাইরা পুকুরের একদম পাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। বিকেলের আবছা রৌদ্রের ঝলকানি পুকুরের পানিতে পড়েছে। পুকুরের টলটলে পানিতে পাড়ে দাঁড়ানো মাইরার শাড়ি পরিহিত প্রতিচ্ছবি জলজল করছে। মাইরা নিজ প্রতিচ্ছবির পানে চেয়ে রইল। মুখে হাসি ফুটল না, বরং মন খা’রা’প হলো ভীষণ। ইরফান গত সপ্তাহে আসেনি। তার এক্সামে প্রতি সপ্তাহে একবার হলেও আসতো। কিন্তুু গত সপ্তাহে না আসায় মাইরার মন খা’রা’প হয়ে আছে। কেন যে, নিজেই বুঝে পায় না। এসে তো সেই ধমকা ধমকি করে। তবুও মাইরার ইচ্ছে হয়, সে আসুক।
কিন্তুু আসে না। বিড়বিড় করল, ‘আসবেই না তো। পছন্দ করে না, আসবে কেন! পা’ষা’ণ লোক কি-না!’
পাশ থেকে একটা বিড়ালের বাচ্চা মিআউ করে ডেকে ওঠে। মাইরা ঘাড় বাঁকিয়ে মাথা নিচু করে দেখে তার পায়ের কাছে একটা ছোট্ট বিড়াল ছানা তার দিকে জলজল চোখে চেয়ে আছে। মাইরার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। নিচু হয়ে ছোট্ট বিড়াল ছানাকে কোলে তুলে নেয়। বিড়ালের বাচ্চাটা যেন আদুরে কোল পেয়ে গুটিয়ে গেল মাইরার শরীরের সাথে। মাইরা হেসে ফেলল। কি সুন্দর! কি কিউট! ডান হাতটা উঠিয়ে আলতো করে বিড়ালের পশমি শরীর বুলিয়ে দিল।
বিড়াল ছানা মাইরার দিকে চেয়ে মিআউ মিআউ করে ডেকে ওঠে। মাইরার মনে হলো তাকে কিছু বলছে। হঠাৎ-ই শব্দ করে হেসে বলে,
“আল্লাহ এটা কোথায় ছিল এতোদিন। কি কিউট!তোকে তো আমি আমার সাথে নিয়ে যাবোই। কোনো চিন্তা নেই সোনা।”
বিড়াল ছানা আবারও মিআউ মিআউ করে। মাইরা হাসে। ভীষণ খুশি মেয়েটা। বিড়ালকে কোলে নিয়েই হঠাৎ-ই দৌড়ায় ধীর গতিতে। মিটিমিটি বাতাসে ভীষণ ভালো লাগলো। আশেপাশে বেশ গাছপালা। বিড়াল ছানাকে একটা জায়গায় রেখে মাইরা পাখিদের মতো হাত মেলে দৌড়ায়। পিছু পিছু বিড়াল। মাইরা খিলখিলিয়ে হাসে। মাথা থেকে আঁচল পড়ে যায়। খোপা করা চুলগুলো উম্মুক্ত হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর মাইরা পুকুড় পাড়ে দাঁড়িয়ে খানিক হাঁপায়। পাশেই বিড়াল ছানা তার শাড়ি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। মাইরা টলটলে জলের উপর কল্পনার ইরফানকে গম্ভীর মুখ দেখতে পেল যেন,, যে তার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে,, যে দৃষ্টিতে মাইরাকে পিপাসা ঘিরে ধরে। মৃদু হেসে কি যেন ভেবে গাইতে শুরু করে,
“পড়ছে কেনো বিনা মেঘেই বাজ,
পদ্য লেখা আমার তো নয় কাজ,
চাইছি দিনে অল্প দেখা তোর,
পাল্টে দিতে আমার গল্পের মোড়।
কিছুতেই উপায় মেলে না……ও….
মন বোঝে না…. বোঝে না… বোঝে না
ইচ্ছে করে একটা ঘরে থাকবো দু’জনায়,
গড়বো ভিটে খুশির ইটে সঙ্গী হবি আয়
কলের পাড়ে জলের ধারা ঘরের পরে তুই,
চারটে হাতে খেলনা পাতে একজোড়া চড়ুই।
সে ভাবনারা চোখ খোলে না…ও….
মন বোঝে না… বোঝে না…বোঝে না
রোজ বিকেলে আতর ঢেলে তোকে সাজাবই,
মেলায় যাব রিক্সা চড়ে বসবি পাশে তুই
বন্দি আছে হাজার আশা বুকের মাঝে দেখ
একটু চিনে নিলেই হব দু’জন মিলে এক…..
পিছন থেকে শান্ত কণ্ঠে গম্ভীর স্বর ভেসে আসে,
“আচ্ছা?”
মাইরা থেমে যায়। মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে যায়। ভাবছে ইরফান তার কল্পনা না-কি সত্যি? সত্যি হলে সে আর জীবনে ওই লোকটাকে মুখ দেখাতে পারবে না। হায় হায় সে তো তার ফ্রেন্ড ছাড়া কারো সামনে গান গায় না ল’জ্জায়। বিড়বিড় করছে, ‘আল্লাহ এইবার শুধু কল্পনায় পাঠিয়ে দাও লোকটাকে। কান ধরে উঠবস করব, আর জীবনে গান গাইবো না।’
ইরফান মাইরার পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলে,
“এতো ফাস্ট বড় হয়ে গেলে? ভেরি ইন্টারেসটিং!”
মাইরা চোখমুখ খিঁচিয়ে নিল। ইরফান আবারও একই সুরে বলে,
“অ্যান্সার মি। কাকে মিন করে গান গাইছিলে?”
মাইরা চোখ বুজেই আমতা আমতা করে বলে,
“কাউকে না। এমনি এমনি। স্যরি! আর গাইবো না।”
ইরফান তীক্ষ্ণ চোখে মাইরাকে পিছন থেকে অবলোকন করল। ডান হাতে মাইরাকে তার দিকে ফেরায়। মেয়েটার ল’জ্জায় কাঁদতে ইচ্ছে করছে। দু’পায়ের নখগুলোর উপর অ’ত্যা’চার চালাচ্ছে।দু’হাত জমা করে মোচড়ায়।
ইরফান মাইরার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলায়। শক্ত কণ্ঠে বলে,
“অন্যকেউ হলে তোমাকে সহ তাকে মেরে মমি বানিয়ে রাখবো, আন্ডারস্ট্যান্ড?”
মাইরা ঢোক গিলে। এসব কানে যাচ্ছে না তার এখন। তার তো এই ইহজীবনে এমন ল’জ্জা লাগেনি। ইরফান দু’পা পিছিয়ে গিয়ে প্যান্টের পকেটে দু’হাত গুঁজে দাঁড়ায়। বেশ কয়েকবার মাইরার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। মাইরার হাতের দিকে তাকায়। ঠোঁট বাঁকায় একটুখানি।
“শাড়ি পরেছ কেন?”
মাইরা মাথা তুলে তাকায় না। জিভ দিয়ে বারবার ঠোঁট ভেজায়। ইরফান মাইরার নত মাথা, হাত কচলানো, বোবা পাখির মতো নিশ্চুপ দেখে তীক্ষ্ণ চোখে।অতঃপর ঠাণ্ডা গলায় বলে,
“আই ডোন্ট লাইক ইউ, বাট আই লাইক ইট।”
মাইরা চোখ মেলে তাকায়। কি বললো? আবার বললো, আই ডোন্ট লাইক ইউ। একে তো একশদিন পর এসেছে, এসে বলছে তাকে পছন্দ করেনা। লজ্জারা পালিয়ে গেল। তড়াক করে মাথা তুলে তাকায়। দেখল ইরফান তার দিকেই চেয়ে আছে। মাইরা কোমড়ে দু’হাত রেখে বলল,
“কি বললেন?”
ইরফান বোধয় শুনলো না মাইরার কথা। নড়চড় বিহীন মাইরার দিকেই চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। বিমোহিত দৃষ্টি মাইরার পানে নিবদ্ধ করে রাখে। ঘোরের মাঝেই হঠাৎ-ই শব্দ করে বলে ওঠে,
“মাই গ্রীন-বার্ডফ্লাওয়ার।”
মাইরা বোকাচোখে তাকালো ইরফানের দিকে। ভ্রু কুঁচকে বলে,
“কি বললেন?”
ইরফান থতমত খেয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলে,
“নাথিং।”
কথাটা বলে মাইরার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল তুলে মাথা ঢেকে দেয়। শক্ত কণ্ঠে বলে,
“আর একদিন এভাবে বের হলে সব চুল কেটে ফেলব, স্টুপিট।”
মাইরা মুখ বাঁকায়। এগিয়ে গিয়ে বিড়ালের বাচ্চাকে কোলে তুলে নেয়। মাইরার কোলে বিড়াল দেখে ইরফানের ভ্রু কুঁচকে যায়। গম্ভীর গলায় বলে,
“এটাকে কোলে নিয়েছ কেন স্টুপিট? ফেলো এটাকে। কত জীবাণু আছে এদের বডিতে, কোনো আইডিয়া আছে?”
মাইরা বিড়ালটাকে তার সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
“বাড়ি গিয়ে গোসল করিয়ে দিব। ওকে আমি নিয়ে যাব।”
ইরফান এগিয়ে গিয়ে বিড়ালের মাথায় তার দু’আঙুল দিয়ে চিমটি দিয়ে ধরে। বিড়াল মিআউ করে ওঠে। মাইরা চেঁচিয়ে ওঠে,
“হায় হায়, ছাড়ুন ওকে।”
ইরফান শুনলো না। বরং বা হাতে মাইরার হাত টেনে সরিয়ে বিড়াল ছানার টুঁটি ধরে মাটিতে নামিয়ে দিল। এরপর মাইরার হাত ধরে হাঁটা ধরে। মাইরা ইরফানের হাত ধরে আটকাতে চায়, চেঁচিয়ে বলে,
“ছাড়ুন বলছি। আমি ওকে নিয়ে যাবো। উফ! নির্দয় লোক। বিড়ালের ছানাটার প্রতিও মায়া নেই। ছাড়ুন।”
ইরফান দাঁড়িয়ে মাইরার দিকে এগিয়ে আসে। মাইরা ইরফানকে দেখে আমতা আমতা করে বলে,
“আপনার কি প্রবলেম? ওকে আমার কাছে রাখবো।”
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে, “নো।”
মাইরা রেগে বলে,
“আমি ওকে না নিয়ে যাব না। আপনি যান।”
কথাটা বলে বিড়াল ছানার দিকে এগিয়ে যেতে নিলে ইরফান মাইরাকে কোলে তুলে নেয়। মাইরা চেঁচিয়ে ওঠে।
“কি করছেন? ছাড়ুন। নামিয়ে দিন আমায়।”
ইরফান তার মতো হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে ফাঁকা জায়গাটা থেকে মানুষের মধ্যে আসে। মাইরা ল’জ্জায় কুঁকড়ে যায়। মিনমিন করে বলে,
“প্লিজ নামিয়ে দিন।”
ইরফান বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
“আমার কাজ আছে। বাঁদরামি করবে না। নয়তো গালের মানচিত্র পাল্টে দেয়ার মিশনে নামবো।”
মাইরা ঢোক গিলে। ইরফানের বুক দু’হাতে ঠেলে বলে,
“আপনি আপনার কাজে যান। উফ! আমায় নামিয়ে দিন।”
ইরফান কিছু বললো না। দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে। মাইরা আশেপাশে অনেক মানুষ দেখল। তাকে কেউ যদি চিনে ফেলে। তবে সে তাদের মুখ দেখাবে কি করে? মিনমিন করে বলে,
“আমি নিব না বিড়ালকে। এইখানে অনেক মানুষ। নামিয়ে দিন।”
ইরফান বিরক্ত হলো। শক্ত কণ্ঠে ধমকে বলে,
“সাট আপ। আমি অন্যের বউকে কোলে নিয়েছি? স্টুপিট।”
মাইরা ধমক খেয়ে কেঁপে ওঠে। মুখটা একটুখানি হয়ে যায়। দোয়া করছে এই গ্রামের চেনা কেউ যেন তাকে দেখে না নেয়। ভয়া’নক কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে তাহলে। ভাবনার মাঝেই কেউ একজন বলে ওঠে,
“কিরে তুই মাইরা না?”
কথাটা মাইরার কানে যেতেই মাইরা চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। ইরফানের বুকে মুখ লগিয়ে সিটিয়ে যায়। যেন ঢুকে যেতে চাইছে, তাহলে আর কেউ তাকে চিনতে পারবে না। ইরফান তার হাঁটা থামায়নি। মাইরাও মুখ তোলেনি। বরং ইরফানের বুকে মুখ লাগিয়ে বা হাত দিয়ে পাশ থেকে মুখ ঢেকে রেখেছে। ভদ্রমহিলা ভাবলেন মাইরা নয় হয়তো, হলে তো কথা বলতো।
মাইরা ভাবছে ইরফান গায়ে কি মেখেছে এটা সে শুনবে ইরফানের থেকে। তার তো এমন সুন্দর স্মেলে ঘুমিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। চোখ বুজলো মেয়েটা। যদি ঘুমাতে পারতো এখানে! কিন্তুু এই খ’বিশ লোক একটু পরেই তাকে ছুঁড়ে ফেলবে।
ইরফান চোখ নামিয়ে মাইরার দিকে তাকায়। ঘুমিয়ে গেল না-কি? এই বাঁদর এক সেকেন্ড চুপ থাকলেও ঘাবলা লাগে। ভাবনার মাঝেই মাইরা চোখ তুলে ইরফানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনার শরীর থেকে বিশ্রী গন্ধ আসছে। আমায় নামিয়ে দিন।”
ইরফান রেগে বলে,
“হোয়াট রাবিশ!”
মাইরা মনে মনে হাসে। ইরফান রেগে মাইরার পিঠের নিচে ধরে রাখা বা হাতে মাইরার মুখ তার বুকে চেপে ধরে। মাইরা উমউম করে। কি পরিমাণ খ’বিশ লোক। তাকে নিঃশ্বাস টাও নিতে দিচ্ছে না। দু’হাতে ইরফানকে ঠেলে। ইরফান হাত খানিক আলগা করে তবে মাইরাকে ছাড়ে না। মাইরা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ইচ্ছে করল এই খ’বিশ লোকের বুকের মানচিত্র পাল্টে দিতে। কিন্তুু কিসব কোট ফোট পরনে বলে সেটা পারল না। দম বন্ধ লাগছে না বলে আরামেই চোখ বুজল। মিটিমিটি হাসলোও। এই লোকটাকে অনেক সহজেই রাগানো যায়।
কি সুন্দর স্মেল! বা হাতে কোটের একটুখানি আলতো হাতে আঁকড়ে ধরে অনিচ্ছায়।
ইরফান তাকালো মাইরার হাতের দিকে। মাইরার মাথার পিছন থেকে তার হাত আলগা করে দিল। তবে মাইরা সেভাবেই চোখ বুজে থাকলো। ইরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার ফুপির বাড়ির সামনে দাঁড় করানো গাড়ির পাশে মাইরাকে নামিয়ে দেয়। মাইরা পিটপিট করে ইরফানের দিকে তাকায়। ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
“সব গুছিয়ে আনো। ফাস্ট।”
মাইরা অবাক হয়ে বলে,
“কেন? কোথায় যাবো?”
“বাসায়।”
মাইরা বুঝলো ইরফানদের বাসায় যাওয়ার কথা বলছে। কিন্তুু সে আজকে মেলায় যেতে চেয়েছিল। এই গ্রামে ছোট্ট একটা মেলা হচ্ছে। মিম তো নেই, ভেবেছিল শুদ্ধর মায়ের সাথে যাবে। তাছাড়া শুদ্ধ ভাইয়ার বউকেও দেখবে। ইরফানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি আজকে যাব না। আপনি চলে যান।”
ইরফান ধমক দিয়ে বলে,
“স্টুপিট আমায় রাগিয়ো না। দ্রুত ব্যাক করতে হবে। ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে আমার।”
মাইরা বিরক্ত হয়ে বলে,
“তো কাজ ফেলে আসলেন কেন? আমি যাব না আজকে। ওই জেলখানা আমার ভালো লাগে না। আবার কবে আসতে পারবো এখানে কে জানে। আমি আজকে যাব না।”
ইরফান শক্ত চোখে তাকায় মাইরার দিকে। এরই মাঝে ইরফানের ফোনে কল আসলে কল রিসিভ করে কথা বলায় ব্যস্ত হয়। মাইরা ইরফানের দিকে চেয়ে আছে। তার খুবই খা’রা’প লাগছে এখন। ওই বিড়াল টাকেও ফেলে আসলো। সে একদিন থাকতে চাইছে গ্রামে সেটাও দিচ্ছে না। দিবে না-ই তো। একটু আগেই তো বললো তাকে পছন্দ করে না। সব মিলিয়ে না চাইতেও মেয়েটার চোখে পানি জমলো। পা’ষা’ণ লোক’ ইরফানের দিকে ভেজা চোখে তাকিয়েই কথাটা বিড়বিড় করল।
ইরফান কথা বলতে বলতে মাইরার দিকে চোখ পড়লে অবাক হয়। ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিকে হোল্ড করতে বলে দ্রুত দু’পা এগিয়ে এসে মাইরার গালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড? কাঁদছ কেন?”
মাইরা চোখের পাতা ফেলে ইরফানের দিকে তাকিয়ে বাচ্চাদের মতো আবদার করে,
“আমি মেলায় যেতে চাই। কালকে বাসায় যাব, প্লিজ!”
ইরফান স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে মাইরার পানে কিছু সময়। কিছু বলে না। ফোনের ওপাশের ব্যক্তিতে বলে,
“ক্যান্সেল এভরিথিং।”
ওপাশ থেকে কিছু বলে হয়তো। ইরফান বিরক্তি কণ্ঠে বলে, “ডোন্ট টক।”
বলেই কল কেটে দেয়।
মাইরা বুঝলো না। ইরফান কি তাকে নিয়েই যাবে? আজ থাকতে দিবে না? ইরফান মৃদুস্বরে বলে,
“গাড়িতে ওঠো।”
মাইরা মাথা নেড়ে বলে,
“প্লিজ! একদিন-ই তো থাকতে চাইছি। কালকেই চলে যাবো সত্যি।”
ইরফান মাইরার ঝাপসা চোখজোড়া মুছে দিয়ে বলে,
“যাচ্ছি না।”
মাইরা খুশি হলো। সাথে সাথে মুখে হাসি ফুটে ওঠে। অতঃপর বলে,
“ওকে ওকে থ্যাঙ্কিউ।”
ইরফান অবাক হয়। এই মেয়ে এইতো কাঁদলো আবার হাসছে। বিড়বিড় করল, ‘পুচকি’
মাইরা বাড়ির ভেতরে যেতে নিলে ইরফান হাত টেনে ধরে মাইরার। মইরা পিছু ফিরে বলে,
“আমি আম্মাজানের সাথে যাব। হাত ছাড়ুন। আপনার সাথে গাড়িতে যাবো না। ভ্যান নয়তো রিক্সায় যাব বুঝলেন? আপনি ঘুমান।”
ইরফান বিরক্ত হয়। রেগে বলে,
“আমার সাথেই যাবে তুমি।”
মাইরা মন খা’রা’প করে। গ্রামের মেলায় এই গাড়িতে করে যাবে ভাবতেই অ’স’হ্য লাগলো। রেগে বলল,
“উফ! আমি এই গাড়িতে যাব না। ছাড়ুন তো।”
ইরফান বিরক্ত হয়। এই মেয়ের চাওয়ার শেষ নেই। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলে,
“ইট’স ওকে। রিক্সায় চলো।”
মাইরা অবাক হয়ে বলে,
“আপনি যাবেন রিক্সায়? উঠেছিলেন কখনো?”
ইরফান বিব্রতবোধ করে। আসলেই রিক্সায় কখনো ওঠা হয়নি। ছোটবেলা থেকে তো গাড়িতে চলাচল করেই অভ্যাস। কিছু বললো না মাইরাকে। মাইরার হাত ধরে হাঁটা ধরে চুপচাপ। মাইরার পিছুপিছু যায়।
রিক্সার এক কোণায় মাইরা বসেছে, পাশে ইরফান। ইরফানের মনে হচ্ছে সে পড়ে যাবে। একটু পর পর মাইরার দিকে রেগে তাকাচ্ছে। মাইরা ইরফানের অবস্থা দেখে এতোক্ষণ মিটমিট করে হাসলেও এবার শব্দ করে হেসে দেয়। ইরফান রেগে চলন্ত রিক্সা থেকেই নেমে দাঁড়ায়। মেজাজ চড়ে গিয়েছে তার। মাইরা চোখ বড় বড় তাকায়। চেঁচিয়ে বলে,
“এই মামা দাঁড়ান দাঁড়ান।”
এরপর মাইরাও রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়ায়। ইরফান এগিয়ে এসে রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দেয়। এরপর মাইরার হাত ধরে তার গাড়ির দিকে হাঁটা ধরে। মাইরা আর কিছু বললো না। তার ইচ্ছে এই ইহজীবনে পূরণ হবেনা। থাক, তাকে মেলায় নিয়ে যাবে এটাই অনেক।
গ্রামের মেলা। খুবই সাদামাটা। তবে মাইরা ভীষণ খুশি। তার গ্রামে এমন মেলায় কত এসেছে। মন জুড়ায়। মেলার সবচেয়ে পছন্দের খাবার বড় বড় ভেজে রাখা হলুদ পাপড়। হাঁটছে আর সেটাই খুঁজছে আশেপাশে। অনেককিছুই আছে এখানে। নাগরদোলা দেখল। মিম থাকলে উঠতো। দু’জন দু’জনকে সাপ্টে ধরে চিৎকার দেয়। ভয়ও পায় তবুও ওঠে। মজাই লাগে। ভেবেই হাসল। ইরফান অদ্ভুদ চোখে আশেপাশে চোখ বুলায়। কোনো মেলায়-ই এই জীবনে গিয়েছে কি-না সন্দেহ। এই বাচ্চার চক্করে তাকে আরও যে কি কি বাচ্চামিতে সামিল হতে হবে আল্লাহই ভালো জানে।
মাইরা খুঁজে খুঁজে তার কাঙ্ক্ষিত পাপড় পেয়ে যায়। দ্রুত সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। পিছু ফিরে ইরফানকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইরফানের হাত ধরে টেনে আনে দোকানের সামনে। আঙুল দিয়ে পাপড় দেখিয়ে দিয়ে বলে,
“কিনে দিন।”
ইরফান অবাক হয়ে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
“ইউ নো, তুমি আসলেই পুচকি।”
মাইরা ভ্রু কুঁচকে তাকায় ইরফানের দিকে। সে কিছু খেতে চাইলেই সে বাচ্চা হয়ে যায়? কোমড়ে হাত দিয়ে বলল,
“আপনি কিনে দিবেন?”
ইরফান তার ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে এগিয়ে দেয় দোকানওয়ালার দিকে। ফোনে কল আসায় মাইরাকে বলে,
“এখানেই ওয়েট কর। আমি আসছি।”
মাইরা মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। হাতে একটা পাপড় তুলে নিয়ে একটু একটু করে খায়। কিছুক্ষণের মাঝেই পিছন থেকে ডাক শুনতে পায়,
“হেই বার্বি ডল!”
মাইরা পিছু ফিরে চোখ বড় বড় করে তাকায়। নাছিম কে দেখে অবাক হয়। এই ছেলে এখানে কেন? নাছিম হেসে বলে,
“কেমন আছো বার্বি ডল?”
মাইরা রাগতে গিয়েও রাগলো না। এটা তো ইরফান আর শুদ্ধর ফ্রেন্ড। আর লোকটা জানেই সে ইরফানের বউ। তাই কিছু না বলে ভালোভাবেই উত্তর করল,
“ভালো।”
নাছিম মাইরাকে আগাগোড়া দেখে পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“তোমাকে তো নতুন বউ লাগছে। কিউট বার্বি ডল।
মাইরা কিছু বললো না। নাছিম আবারও বলে,
“কি খাও এটা?”
“পাপড়।”
নাছিম কিছু একটা ভেবে বলে,
“ওয়েট, আসছি।”
একটু পর একটা ছোট ব্যাগে বেশ অনেকগুলো চকলেট আর আইসক্রিম এনে মাইরার পাশে দাঁড়ায়। হাতের ব্যাগ মাইরার দিকে এগিয়ে দিলে মাইরা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নাছিম হেসে বলে,
“নাও। এসব তোমার ফেভরিট, জানি। ফিরিয়ে দিও না। আমি কিন্তুু ইরফান শুদ্ধর ফ্রেন্ড।”
মাইরা নিতে চায়নি। তবে নাছিম এর লাস্ট কথায় মৃদু হেসে বলল,
“থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া। আপনি কি করে জানলেন এগুলো আমার ফেভরিট?”
নাছিম এক চোখ টিপে বলে, ওইভাবেই। আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
“কার সাথে এসেছ?”
মাইরা বলতে নেয়, তার আগেই নাছিমকে কেউ ডাকলে ছেলেটা হেসে বলে,
“বাই বাই বার্বি ডল। আবার দেখা হবে। সাবধানে বাড়ি যেও।”
বলতে বলতে চলে যায়।
মাইরা দোকানের সামনে থেকে সরে গিয়ে এক সাইডে গিয়ে দাঁড়ায়। অনেক চকলেট দেখল। বাইরের সব খাবার-ই তার ফেভরিট, বাড়ির কোনো খাবার-ই ভালো না। পাপড় খাওয়া শেষ। ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বের করে ছিঁড়ে এক কা’ম’ড় দিয়ে দিয়ে কয়েকবার চিবোয়, তখনই তার সামনে এসে ইরফান দাঁড়ায়। মাইরা ইরফানকে দেখে মৃদু হেসে কিছু বলার আগেই ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
“এসব কোথায় পেলে?”
মাইরা মুখের টুকু না গিলেই বলে,
“আপনার বন্ধু এসে দিয়ে গিয়েছে। উনি খুব ভালো মনে হয়। একটু মজা করে হয়তো। দেখুন আমার ফেভরিট চকলেট আইসক্রিম কিনে দিয়েছে।”
ইরফান অবাক হয়। শুদ্ধ তো এখানে নেই। রেগে বলে,
“কোন ফ্রেন্ড?”
মাইরার নাম মনে পড়ে না। কি যেন নাম বলেছিল, একটু ভাবতেই মনে পড়লে বলে ওঠে,
“ওই তো নাছিম।”
কথাটা বলার সাথে সাথে ইরফানের চোখেমুখে মুহূর্তেই ক্রোধ জমা হয়। শক্ত মুখাবয়বে মাইরার দিকে তাকায়। হাতের সব চকলেট আইসক্রিম ছুঁড়ে ফেলে দেয়। দু’হাতে মাইরার গাল চেপে ধরে শক্ত হাতে। হুঙ্কার ছেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ২৮
“তোর সাহস কি হয় অন্যের চকলেট মুখে নেয়ার?
ফেল মুখ থেকে এসব। এ্যাই স্টুপিট ফেল।”
মাইরা চোখ বড় বড় করে তাকায়। ইরফান তার ডান হাতের তিন আঙুল মাইরার মুখে ঢুকিয়ে মাইরার মুখ থেকে জোর করে চিবানো চকলেট বের করে ছুঁড়ে ফেলে। মাইরা খুকখুক করে কেশে ওঠে। ইরফান বা হাতে মাইরাকে তার সাথে শক্ত করে চেপে , অপর পাশ দিয়ে মাইরার মুখ নিচু করে নেয়। মাইরার মুখের সামনে ডান হাত পেতে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“সব থুতু ফেলবি। নয়তো খাওয়ার জন্য এই মুখ রাখবো না স্টুপিট গার্ল।”
মাইরা হতভম্ব। তার সাথে কি হচ্ছে। এই লোক পা’গল? তার সামনে হাত পেতে বলছে থুতু ফেলতে। পাশেই তো মাটি।