প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৫৯

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৫৯
Drm Shohag

মাইরা সকাল সকাল উঠে ইরফানের জন্য এক কাপ ব্ল্যাক কফি বানিয়ে এনে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে দিয়েছে। ইরফান ঘরে নেই। মাইরা রান্নাঘরে গিয়েছিল, একেবারে বানিয়ে এনেছে।
আজ অনেক দিন পর করলা পেয়ে মেয়েটা খুব খুশি। করলা, লবণ মরিচ এর দু’টো বাটি সেন্টার টেবিলে রেখে সোফায় বসেছে মাইরা। লবণ, মরিচ এর গুঁড়ে একসাথে মিশিয়ে করলা তৃপ্তি করে খায় মেয়েটা।
কিছু সময় পর ইরফান ঘরে প্রবেশ করে সরাসরি ওয়াশরুমে যেতে গিয়েও মাইরাকে দেখে থেমে গেল। মাইরা খুব মনোযোগ সহকারে করলা খেতে ব্যস্ত। ইরফানের মুখ বিকৃত হয় খানিক। মাইরা মুখ ভর্তি করলা চিবোতে চিবোতে ইরফানের দিকে তাকিয়ে ইরফানের এক্সপ্রেশন দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। টেবিলের উপর আরও চারটে করলা একটি বাটিতে রাখা। দ্রুত সেই বাটি হাতে নিয়ে দু’হাতে ঢেকে নিল। মুখের টুকু শেষ করে ইরফানের দিকে চেয়ে বলে,____”এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? একদম এগুলো ফেলার চিন্তা করবেন না। আমাকে বাবা এনে দিয়েছে এগুলো।”

ইরফান মাইরার সামনে এসে দাঁড়ায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,_____”এসব অখাদ্য খাওয়া কোথা থেকে শিখেছ স্টুপিট?”
মাইরা মাথা উঁচু করে ইরফানের দিকে চেয়ে থাকে। মুখ বাঁকিয়ে বলে,____”এটা অখাদ্য নয়, এটা সবচেয়ে সুস্বাস্থ্য খাবার বুঝেছেন?”
ইরফান বিরক্তি কণ্ঠে বলে,___”নো। এসব খাবে না তুমি। ফেলো বলছি।”
মাইরা হাতের বাটিটা পিছনে লুকিয়ে নেয়। ছোট বাটির কোণায় কিছু করলা ব্লেন্ড করে রাখা আছে। মাথা নিচু করে মাইরা কিছু একটা ভেবে মিটিমিটি হাসলো। তাকে ফেলতে বলে, মাইরা এবার বুঝাবে মজা। অতঃপর বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় সোফার উপর। ইরফান ভ্রু কুঁচকে তাকায়, মাইরা সোফার উপর দাঁড়ানোয় ইরফানের থেকেও বেশ লম্বা দেখায়। ইরফান ভ্রু কুঁচকে কিছু বলার জন্য হা করতেই মাইরা বাটি থেকে বেটে রাখা করলার কিছু অংশ হাতে করে নিয়ে ইরফানের মুখে ঠুসে দেয়। ইরফান চোখ বড় বড় করে তাকায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাইরাকে আর কে পায়, করলার বাটি শক্তহাতে ধরে সোফার উপর থেকে এক লাফ দিয়ে দৌড় লাগায়। ইরফান কেশে ওঠে। মুখ থেকে তরল অংশ ফেলে দেয়। মাইরার দিকে রেগে তাকায়। মাইরা দৌড়ে গিয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ইরফানের দিকে তাকায়।
ইরফান সমানে কাশছে, তরল হওয়ায় গলার ভেতর কিছু অংশ চলে গিয়েছে। মাইরাকে ধরার জন্য এগিয়ে যেতে গিয়েও পিছিয়ে এসে সোফায় বসে। কি জঘণ্য এই করলা! এই স্টুপিট কে তো সে পরে দেখে নিবে।
মাইরা ইরফানের এক্সপ্রেশন দেখেই চলে যেতে চেয়েছিল, কিন্তুু ইরফানকে এভাবে কাশতে দেখে মাইরার মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে যায়। দ্রুত দরজা ঠেলে ভেতরে এসে বেডের উপর থেকে কয়েকটা চকলেট এনে ইরফানের সামনে দাঁড়ায়। ব্যস্ত হাতে চকলেট ছিঁড়ে ইরফানের মুখের সামনে ধরে বিচলিত কণ্ঠে বলে,____”এটা খেয়ে নিন। তাহলে আর খারাপ লাগবে না।”

ইরফান মুখের সামনে হাত নিয়ে আরও কয়েকবার কেশে নিল মাইরার দিকে তাকিয়ে। এরপর মাইরার হাত ধরে টেনে তার পাশে বসিয়ে দেয়। মাইরার হাত থেকে চকলেট নিয়ে সত্যি সত্যি মুখে পুড়লো। এটা আসলেই প্রয়েজন। যে জঘণ্য খাবার মুখে পড়েছে, এর রেশ না কাটলে বমি হয়ে যাবে নিশ্চিত! মুখের চকলেট টুকু চিবিয়ে গিলে নেয়। এরপর কিছুটা রেগে বলে,____”এসব বাঁদরামি অফ করবে না তুমি?”
মাইরা মাথা নিচু করে ঢোক গিলে মিনমিন করে বলে,______”স্যরি!”
বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পরও ইরফানের কোনো রেসপন্স না পেয়ে মাথা তুলে তাকালে দেখল ইরফান তার দিকেই চেয়ে আছে। মাইরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,____”দেখুন আপনি যেমন সিগারেট খান, আমি তেমন করলা খাই। এই দু’টোর মধ্যে অখাদ্য আপনার ফেবারিট সিগারেট। আর আমার করলা শরীরের জন্য খুবই ভালো খাবার, শরীরে পুষ্টি দেয়। আর আপনার সিগারেট তো হার্ট পুড়িয়ে দেয়। তাহলে কোনটা অখাদ্য হলো আপনিই বলুন?”

ইরফান চোখ ছোট ছোট করে তাকায় মাইরার দিকে। মাইরা একটা যুক্তিগত উত্তর দিতে পেরে মনে মনে বেশ প্রফুল্ল হয়। ইরফান টেবিলের উপর থেকে গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে মাইরার সামনে ধরে বলে,____”মাউথ ওয়াশ কর।”
মাইরার কৌতূহলী চোখে চেয়ে বলে,____”কেন?”
ইরফানের গম্ভীর স্বরে সহজ উত্তর, ____”আমি বলেছি তাই।”
মাইরা কথা বাড়ালো না। এমনিতেও তার পানি পিপাসা পেয়েছে। ইরফানের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে পানি খেয়ে গ্লাসটি টেবিলের উপর রাখলো। এরপর ডানহাত উঠিয়ে ঠোঁটে লেগে থাকা পানি মোছার জন্য হাত উঠাতে নিলে ইরফান টান মেরে মাইরাকে তার কোলে বসায়। কোনো কথা ছাড়াই মাইরার দু’হাত পিছনে নিয়ে তার দু’হাতের মাঝে বেঁধে মাইরার ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরে।

বেশ কিছু সময় পর ইরফান মাইরাকে ছেড়ে দেয়। মাইরা মাথা নিচু করে রেখেছে। ইরফান ডান হাতের বুড়ো আঙুলের সাহায্যে মাইরার ভেজা ঠোঁট মুছে দেয়। মাইরার সামনে হেলে পড়া চুলগুলো পিছন দিকে নিতে নিতে গম্ভীর স্বরে বলে,
“সিগারেট হার্ট পুড়ানোর ব্যাক ডেটেড ভার্সন। বাট, ইউ….
বলতে গিয়েও থেমে গেল মাইরার দিকে তাকিয়ে। মাইরা পিটপিট করে চেয়ে আছে ইরফানের দিকে। ইরফান ইংলিশ শব্দগুলো গুটিয়ে রাখলো জিহ্বার ভাঁজে। এরপর মাইরাকে কোলে নিয়ে বেডের দিকে যেতে যেতে আবারও গম্ভীর গলায় বলে,
“তুমি হার্ট পুড়ানোর আপডেট ভার্সন।”
এরপর মাইরাকে বেডে বসিয়ে কিছুটা রেগে বলে,____”আর একবার সোফায় বসতে দেখলে থাপ্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলব তোমার স্টুপিট।”

কথাটা বলে ইরফান ওয়াশরুমের দিকে যায়। মাইরা নিরব চোখে চেয়ে রইল ইরফানের দিকে। ইরফানের কথাটা বোঝার চেষ্টায়। ভাবলো এটা নিয়ে পরে ভাববে।
কিছু একটা ভেবে বেড থেকে নেমে ইরফানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,____”আমার একটা প্রশ্ন আছে।”
ইরফান ভ্রু কুঁচকে তাকায় মাইরার দিকে। মাইরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,___”আপনি আমাকে সত্যিই চিনতেন না?”
ইরফান তার সামনে মাইরাকে দেখে থেমে যায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,____”I am not interested talking about this topic.”
মাইরা বিরক্তি কণ্ঠে বলে,____”বাংলায় বলতে পারেন না?”

ইরফান নিজেও বিরক্তি কণ্ঠে বলে,____”এই টপিকে কথা বলতে আমি ইন্টারেস্টেড নই। আন্ডারস্ট্যান্ড?”
মাইরা কপাল চাপড়ালো। এই লোকের ইংলিশ ওয়ার্ড আর এ জনমে যাবে না। আবারও বলে,___”আমি গ্রামে যখন হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। আপনি এগিয়ে আসেননি কেন?”
ইরফান অবাক হয় মাইরার করা এই প্রশ্নে। মাইরা উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে আছে। ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– থা’প্প’ড় খাওয়ার শখ জেগেছিল?
মাইরা বোকা চোখে তাকালো ইরফানের দিকে। এটা আবার কেমন উত্তর! অবাক হয়ে বলে,
– মানে?
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– ইট মিনস্ , ইউ আর অ্যা স্টুপিট গার্ল।”
ইরফান কথাটা বলে মাইরাকে পাশ কাটিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।
মাইরা বিরক্ত চোখে ইরফানের দিকে চেয়ে রইল। ইরফানের মতো গম্ভীর গলায় এক্টিং করে,
– ইউ আর অ্যা গন্ডারের এক নম্বর দাদা।
মাইরার কথা শুনে ইরফান পিছু ফিরে তাকিয়ে রে’গে বলে,

– হোয়াট?
মাইরা থতমত খেয়ে তাকায়। সে আস্তে বলতে চেয়েছিল। জোরে হয়ে গিয়েছে। মাইরা কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ইরফান কিছু বলল না। ওয়াশরুমের দরজা আটকে দেয়। মাইরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
এরপর এগিয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসল মাইরা। নোট করার জন্য যে কাগজগুলো কাজে দেয়, তার মাঝে থেকে একটা ছোট্ট লাল কাগজ নিয়ে সেখানে লিখল ~
❝সিগারেট হার্ট পুড়ানোর ব্যাক ডেটেড ভার্সন। বাট, তুমি হার্ট পুড়ানোর আপডেট ভার্সন।❞
“স্বীকারোক্তিতে ~ শিসওয়ালা”

লেখাটা লিখে মাইরা অনেকক্ষণ চেয়ে রইল লেখাটার দিকে। বোঝার চেষ্টা করছে কথাটার অর্থ। বেশ অনেকক্ষণ চেয়ে থাকার পর কথাটার অর্থ বোধয় বুঝলো। না চাইতেও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। কখন যে চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে, মাইরা টের পায় না। হাতের কাগজটি বইয়ের ভাঁজে আলতো হাতে রেখে দেয়।
টেবিলের উপর মাথা রেখে চোখ বুজে নেয়। সেই রাতের কথা মনে পড়ে, যেদিন দাদিমা তাকে সাজিয়ে দিল। ভীষণ ভ’য় পাচ্ছিলো সে। মাইরার আবারও কান্না পায়। মাইরা বারবার বলছিল সে ছোট। সে নিজেকে কেন ছোট দাবি করছিল, এইটুকু কি ইরফান বোঝে নি?

মাইরার খা’রা’প লাগে। ইরফানের বলা কথাটি অস্পষ্ট শুনেছিল,__’ইউ আর মাই ফেবারিট ডিশ।’
মাইরার চোখ থেকে পানি গড়ায়। বিড়বিড় করে,
“মেয়েরা তো রে’পি’স্ট দের কাছেও ফেবারিট ডিশ হয়।”
কথাটা বলে মাইরা বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। এরপর আবারও বিড়বিড় করে,
“আমি আপনার ফেবারিট ডিশ হওয়ার আগে হৃদয়ের টুকরো হতে চাই শিসওয়ালা।”
লাস্ট লাইনটা বলতে বলতে চোখের কোণ ঘেষে পানি গড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ঠোঁটের কোণে এক স্নিগ্ধ হাসি ফুটে ওঠে।

রাত বাজে ১১ টা। মাইরা পড়ার টেবিলে বসে আছে। কিন্তু পড়ায় তার মন বসছে না। বারবার মিলার বলা কথাটা মনে পড়ছে। মাইরা তার নোট করার ছোট্ট কাগজে লেখাটি লিখল।
‘ছেলেরা মৌমাছির মতো। এক ফুলে মধু না পেলে, মধুর সন্ধানে আরেক ফুলের উপর গিয়ে বসে।’
লেখাটির উপর বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। চোখ থেকে টুপ করে দু’ফোঁটা পানি কাগজটির উপর গড়িয়ে পড়ে। মাইরা হাতের কলম দিয়ে লেখাটি কালো কালির আবরণে ঘষতে থাকে। পুরো লেখাটি একদম কালো কালির নিচে চাপা পড়ে গেলে মাইরা বসা থেকে দাঁড়ায়। এগিয়ে গিয়ে কাবার্ডের এক সাইডে রাখা তার কাপড়গুলোর মাঝ থেকে ইরফানের দাদির দেয়া শাড়ি, ব্লাউজ সব বের করে। একা একাই শাড়ি গায়ে জড়ায়। ইরফানের দাদি যেভাবে পরিয়ে দিয়েছিল একদম সেভাবেই পরল। বেশ খোলামেলাভাবে। পুরো শাড়ি পরা শেষ হলে আয়নায় নিজের অবয়ব দেখে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। দু’হাতে চোখ মুছে নেয়। এরপর শাড়ির সাথেই ম্যাচ করে ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক দেয়, আর চোখে কাজল। আর কিছু করল না। বারবার চোখ ভিজছে। মাইরা বড় করে শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলায়। মাইরা আয়নার সামনে থেকে সরে এসে এক সাইডে দাঁড়ায়। তখনই দরজা ঠেলে ইরফান ভেতরে প্রবেশ করে।

মাইরা ইরফানের দিকে তাকালো না। মাথা নিচু করে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। ইরফান খুব স্বাভাবিক ভাবেই ঘরে প্রবেশ করে, তবে মাইরাকে দেখে স্তম্ভিত হয়। তার পা থেমে যায়। চোখ বুজে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। নিজেকে সামলে মাইরাকে দিকে এগিয়ে গিয়ে মাইরাকে বা হাতে জড়িয়ে ধরে ডান হাতে মাইরার মুখ উঁচু করে ধরে। মাইরার চোখ বন্ধ। ইরফান মাইরা মুখপানে চেয়ে মৃদুস্বরে বলে,____”আবার এসব পরেছ কেন? গ্রান্ডমা কে নিষেধ করনি কেন?”
মাইরা চোখ মেলে ইরফানের দিকে তাকায়। মাইরার শরীর কাঁপছে। সে জানেনা কেন। ইরফান বোধয় বুঝলো। কিন্তু সে ছাড়লো না মাইরাকে। দু’হাতে মাইরাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। মাইরার গলায় নাক ঘষে ছোট করে বলে,___”গ্রান্ড মা কে নিষেধ করে দিব। ডোন্ট ওয়ারি।”

মাইরা ঢোক গিলে মিনমিন করে বলে,___”দাদিমা পরিয়ে দেয়নি। আমি নিজেই পরেছি।”
ইরফান মাইরার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকায় মাইরার দিকে। মাইরা ঢোক গিলে নেয়। ইরফান মাইরাকে আবারও জড়িয়ে ধরে। ঠোঁট বাঁকিয়ে সূক্ষ্ম হাসে। মাইরা হাসফাস করে। তার স্বভাবসুলভ বলে ওঠে,___”ছাড়ুন।”
ইরফান বিরক্তি হলো। একে কি করা উচিৎ। মাইরাকে ছেড়ে রেগে বলে,___”স্টুপিট, নিজেই সব খুলে আসবে, আবার ছাড়ুন ছাড়ুন করবে?”
মাইরা মাথা নিচু করে নেয়। সে তো চাইলোই অনেককিছু। ইরফান মাইরাকে কোলে তুলে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,___”ছাড়বো না। আন্ডারস্ট্যান্ড?”

মাইরা আবারও ভ’য় পায়। ইরফান মাইরাকে বেডে শুইয়ে দিয়ে তার পরনের ব্লেজার খুলে ফেলে। শার্ট খুলতে নিলে মাইরা ঢোক গিলে দ্রুত বেড থেকে নেমে দাঁড়ায়। ইরফান রে’গে তাকায় মাইরার দিকে। মাইরা অসহায় চোখে তাকায়। ইরফান অপর পাশ দিয়ে মাইরার কাছে আসতে নিলে মাইরা চেঁচিয়ে ওঠে,___”মা, আমার পেট ব্য’থা। আমি পানি খাবো।”
ইরফান ততক্ষণে মাইরার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলে,____”কোথায় ব্য’থা?”
মাইরা মিনমিন করে বলে,___”পেটে মাথা ব্য’থা।”
ইরফান ভ্রু কুঁচকে বলে,___”হোয়াট?”
মাইরা জিভেয় কা’ম’ড় দেয়। টেনশনে ভুলভাল বলে ফেলছে। আমতা আমতা করে বলে,____”পেটে পেটে। আমি ঘুমাই?”
ইরফান শাড়ির ভাঁজের নিচে পেট বরাবর হাত হাত রাখে। মাইরা কেঁপে ওঠে। থেমে থেমে বলে,____”কি করছেন?”

ইরফান মাইরার পেটে মৃদু চাপ দেয়। মৃদুস্বরে বলে,____”ব্য’থা সারিয়ে দিই আগে। দ্যন ঘুমাবে।”
মাইরা দু’হাতে ইরফানের হাত সরাতে চায়। ইরফান বা হাতে মাইরার দু’হাত ধরল। এরপর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে,___”পেটের কোথায় ব্য’থা করছে?”
মাইরা বাচ্চাদের মতো করে অসহায় কণ্ঠে বলে,___”পুরো পেট, পুরো পেট। সত্যি বলছি। এবার ছাড়ুন।”
ইরফান মাইরার পেটে রাখা হাত পুটো পেটে বিচরণ করায়। মাইরা মাথা নিচু করে ঢোক গিলে। ইরফানের এমন আচরণে তার শরীর শিরশির করছে। সে নিজের জালে নিজেই ফাঁসলো। ইরফান ঠোঁট বাঁকালো। বিড়বিড় করে,___”লিটল গার্ল।”

এরপর মাইরার পেট থেকে হাত সরিয়ে আনে। দু’হাতের আঁজলায় মাইরার মুখ নিয়ে মাইরার ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরে। মাইরা চোখ বুজে নেয়। একটু সময় পেরোতেই ইরফান মাইরাকে ছেড়ে মুখ কুঁচকে বলে,___”স্টুপিট এসব কি লাগিয়েছ?”
মাইরা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে। একটু পর চোখ তুলে ইরফানের দিকে তাকালে দেখল ইরফানের ঠোঁটে লিপস্টিক মাখানো। না চাইতেও শব্দ করে হেসে দেয় মাইরা। ইরফান বিরক্তি চোখে মাইরার দিকে চেয়ে থাকে।
বড় বড় পা ফেলে ওয়াশরুমে চলে যায়। মাইরা মুখ টিপে হাসলো। এটা তো কমদামি একটা লিপস্টিক দিয়েছিল সে। এজন্যই ইরফানের ঠোঁটেও লেগে গিয়েছে। ইরফান ওয়াশরুমে যেতেই মাইরা দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ায় এক কোণায়। দ্রুত শাড়ি চেঞ্জ করে জামা পরে নেয়। এরপর বেডে গিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঠাস করে শুয়ে পড়ে। অনেক বড় হওয়ার কাজ করে ফেলেছে ভুল করে। এসব তার দ্বারা হবে না। মিলার বাচ্চার উপর রা’গ হলো। কালকে কলেজে গিয়ে আগে ওকে লাথি দিবে। বে’দ্দ’প মহিলা!

আজ ভার্সিটি বন্ধ। শুদ্ধ ইরফানদের বাসাতেই। তার মা এখানেই আছে। তাই সেও আর তার বাড়ি যায়নি। তার মনে হাজার টা প্রশ্ন। ইরফানের সেই দিনের বলা কথাগুলো মনে পড়ে। মাইরার কোটিপতি হওয়ার ব্যাপার ইরফান দু’বছর আগেই জানে। এসবের উত্তট নিত সে ইরফানে ঘরে এসেছে। কিন্তু ঘরে এসে কিছু একটা মনে পড়তেই ইরফানের উদ্দেশ্যে বলে,
“সৌভিকের অবস্থা ভালো না রে, জানিস?”
ইরফান বেডের উপর বসে ল্যাপটপে কাজ করে সাথে গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে,___”আই নো।”
শুদ্ধ চোখ ছোট ছোট করে তাকায় ইরফানের দিকে। ভাবুক ভঙ্গিতে বলে,____”প্রায় বছর খানেক আগে আমাদের গ্রামের কয়েকটা ছেলের এক চোখ করে তুই কানা করেছিলি তাই না?”

ইরফান ভাবলেশহীনভাবে বলে,____”ইয়াহ!”
শুদ্ধ চোখ বড় বড় করে বলে,____”কিহহ! তুই এসব কি করে বেড়াস? সৌভিকেরও সেইম অবস্থা, তবে ওর চোখটা হয়তো বেঁচে যাবে।”
একটু থেমে বলে, ___”মানুষের অঙ্গহানি করা ভালো কাজ নয় ইরফান।”
ইরফান বিরক্তি কণ্ঠে বলে,____”আমি ওদের দুইবার ওয়ার্ন করেছিলাম। অবাধ্য হয়েছিল, শাস্তি দিয়েছি। দ্যটস ইট। এটা ওদের প্রাপ্য। ফা’ল’তু নলেজ ডিলিট করে রাইট নলেজ মাথায় নে।”
শুদ্ধ রেগে বলে,____”আমি ঠিকই আছি। তুই ভুল। মানুষ হ তো বা’ল।”
ইরফান রে’গে তাকায় শুদ্ধর দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,____”আমি ওদের ছোটোখাটো শাস্তি দিয়েছি। প্রাণ তো নিইনি। শাস্তি দিয়ে লাইফে সুযোগ দিয়েছি। দ্যন ওরা আর বার্ডফ্লাওয়ার কে ডিস্টার্ব করেনি।”
শুদ্ধ চোখ ছোট ছোট করে বলে,____”বার্ডফ্লাওয়ার কে?”
ইরফান থতমত খেয়ে বলে,___”নাথিং।”

শুদ্ধ হিসাব মেলাতে ব্যস্ত হয়। ব্যাপারটা কি হলো? একবছর আগের কাজের সাথে বর্তমানের কাজের যোগসূত্র পাচ্ছে মনে হচ্ছে। তীর তো মাইরার দিকে যায়। আবার কিসব কাব্যিক নামও বলছে। শুদ্ধ ইরফানের সামনে বসে ইরফানকে খোঁচায়।
ইরফান বেশ কিছুক্ষণ পর ল্যাপটপ অফ করে চোখ বুজে নেয়।
বেশ কিছুক্ষণ পর শুদ্ধ ইরফানকে ঝাঁকিয়ে বলে,
– কি রে, কোন জগতে হারালি? আমি এইবার একটু একটু বুঝেছি তোর আর মাইরার ক্যালকুলেশন। এক লাইন বলিস, আর দশ লাইন ভাবিস। কি খাপছাড়া কথা। এখন আমার প্রশ্নের উত্তর দে।”
ইরফান চোখ মেলে তাকায় শুদ্ধর দিকে। শুদ্ধ ইরফানের দিকে কোতূহলী চোখে তাকিয়ে বলে,
– তুই মাইরাকে চিনেই বিয়ে করেছিস, ঠিক বললাম তো? শুধু চিনে না। একদম পছন্দের মানুষকে। ওয়াহ! হাউ কিউট!”

ইরফান বেড থেকে নেমে দাঁড়ায়। দু’হাত প্যান্টের পকেটে রেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,
– নো।
শুদ্ধ বেডের উপর দু’পা তুলে ভাঁজ করে বসে। ভ্রু কুঁচকে বলে,
– ওহ হ্যাঁ। কিন্তু যা যা করলি ওর জন্য। এরপরও মাইরাকে অন্যকেউ ভেবে বিয়ে করলি কেন?
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– টেস্ট করতে চেয়েছিলাম। অন্য কাউকে বিয়ে করে ওকে ভুলতে পারি কি-না!
শুদ্ধ গালে হাত দিয়ে বলে,
– তুই যা মানুষ। এ জীবনে মাইরাকে ভুলতি না। মাইরার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গেলে কি করতি?
ইরফান বিরক্তি কণ্ঠে বলে,

– হত না। অলরেডি ১০ টা বিয়ে ভেঙ্গেছি।
শুদ্ধ চোখ বড় বড় করে তাকায়। কিছু একটা ভেবে বলে,
– আমি যতদূর জানি মামা তোর বিয়ে মাইরার সাথেই ঠিক করে রেখেছিল। তাহলে মাইরার জন্য পাত্র কে আনতো?”
শুদ্ধ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– ওর বে’য়া’দ’ব বাবা।
শুদ্ধ বোঝার ভঙ্গিতে মুখ গোল করে। অতঃপর বলে,
– তুই নিজে অন্যকাউকে বিয়ে করার কথা ভাবলি। তাহলে মাইরার বিয়ে আটকাতি কেন?
ইরফান ভাবলেশহীনভাবে বলে,

– মাই উইশ!
শুদ্ধ বিড়বিড় করল,
– বে’দ্দ’প পোলা। এর বদঅভ্যাসের জন্য ওকে বিয়েও করবে না। আবার ওর-ও বিয়ে হতে দিবে না।
অতঃপর শুদ্ধ গলা ঝেড়ে বলে,
– মাইরার জায়গায় অন্য মেয়েকে বিয়ে করার পর মাইরাকে ভুলতে না পারলে, তোর বিয়ে করা বউয়ের কি হতো?
ইরফানের সহজ উত্তর,
– ডিভোর্স দিয়ে দিতাম।
শুদ্ধ বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– ওর জীবন নষ্ট হয়ে যেত। কে বিয়ে করতো ডিভোর্সি মেয়েকে?
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– হতো না। তুই ওকে বিয়ে করতি।
শুদ্ধ চোখ বড় বড় করে বলে,
– কিহ! আমার ফারাহকে রেখে অন্যকাউকে বিয়ে করতাম আমি?
ইরফান ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,

– ফারাহকে ভুলিয়ে দিতাম।
শুদ্ধ কটমট চোখে তাকালো। রেগে বলল,
– তুই কাউকে ভোলার জন্য অন্য কাউকে এট লিস্ট বিয়ে করবি না। খুব ভালোই জানা আছে আমার। মিথ্যা গল্প শোনানোর জায়গা পাসনা?
ইরফান সূক্ষ্ম হাসলো। অতঃপর বলে,
– জানিস-ই তো। তাহলে স্টুপিট দের মতো আস্ক করছিস কেন?
একটু থেমে ইরফান সিরিয়াস হয়ে বলে,
– আম্মু সিক হয়ে গিয়েছিল তাই বিয়ে করেছি। বাচ্চা কে মানতাম না।
একটু থেমে আনমনে বলে,
– বার্ডফ্লাওয়ার ছাড়া কাউকে মানতাম না।
সেদিন-ই ডিভোর্স পেপার রেডি করতাম। উকিলের সাথে কথা হয়েছিল।
দ্যন ওকে এক গুড পার্সনের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতাম। বাট তার আগেই জেনেছি এটা ওই স্টুপিট।
শুদ্ধ মিটিমিটি হেসে বলে,

– এখন ডিভোর্স পেপার রেডি কর। মাইরাও তো বাচ্চা। আমি হেল্প করব সোনা?”
ইরফান শুদ্ধর দিকে রেগে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– সাটআপ।
শুদ্ধ বেখেয়ালি থাকায় ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। মুখ বেঁকিয়ে বিড়বিড় করে,
– পাইছে এক বা’লআপ।”
ইরফান শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
– তোকে বেঁধে রেখে, তোর বউয়ের পিছে কু’ত্তা লেলিয়ে দিব আমি।
ইরফানের কথা শুনে শুদ্ধ চোখ বড় বড় করে তাকায়। এই কথা তো সে ইরফানের বিয়ের পর পর শুনেছিল। বিয়ের পর ক’দিনের মাথায় তাদের গ্রামের এক ছেলেকে তো খু’ন করতে যাচ্ছিল এই ইরফান।
শুদ্ধ সেই ছেলেকে বাঁচিয়েছিল বলে ইরফান এই কথা বলেছিল। শুদ্ধর মাথায় হাত। চোখ বড় বড় করে বলে,

– ইয়া আল্লাহ! তার মানে তুই ওদের মাইরার জন্য ওতো মেরেছিলি? পরে হসপিটালে তুই পাঠিয়েছিস? মরণের সাথে লড়েছে বেচারা। তোর একটুও মায়া নেই রে!
ইরফান তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলে,
– না নেই। বার্ডফ্লাওয়ারের টপিকে কেউ জড়ালে সেখানে এসব ফা’ল’তু মায়া দেখানোর টাইম নেই। লাইক, তুই এখন আমার হাতে বেহিসাব থা’প্প’ড় খাবি।
শুদ্ধ দ্রুত বেড থেকে নেমে বলে,
– এই না না। আমি জানতাম না, ও মাইরাকে উল্টাপাল্টা বলেছে। এমন করিস ক্যান?
এসব ঠিক নয়। এটা এখনো মনে রেখেছিস কেন? এসব মনে রাখলে আল্লাহ পাপ দেয় সোনা।”
ইরফান দু’হাতের শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে এগিয়ে আসলে শুদ্ধ বলে ওঠে,
– আমি তোর ভাই। আর তুই আমায় মারবি? ছ্যাহ! তোর স্মৃতিশক্তি গেছে। আহারে! তোর জন্য আমার কষ্টে কষ্টে কষ্টিত হয়ে হাঁটু কেঁপে ওঠে সোনা।”
ইরফান রে’গে বলে,
– শুদ্ধর বাচ্চা।
শুদ্ধ দৌড়ে ঘরের বাইরে যেতে যেতে বলে,
– নামাজ পড়ে দোয়া করে দে সোনা, যেন বাচ্চা টা খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। এ জীবন আর সহে না।
আর তুই একদম আমার বউয়ের পিছে কাউকে লাগাবি না, বউটাকে পেতে না পেতেই হারানোর ভ’য় দেখায়। শা’লা সবগুলো ব্রিটিশ!

দু’বছর আগে ~
ইরফান অনার্স শেষে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। টুকটাক বাবার ব্যবসা দেখে। তারেক নেওয়াজ ইরফানকে ঠেললেও শোনে না। ঠেলতে ঠেলতে একটু-আধটু ইরফানকে অফিসে পাঠাতে পারে। তিনি উপায় খুঁজলেন ইরফানকে ব্যবসায় বসানোর। ভাবনা অনুযায়ী ব্যবসার ডিড পুরো ইরফানের নামে করে দেয়। এবার অন্তত ইরফান তার কথা শুনবে। কিন্তু তিনি হতাশ। ইরফান কে কে কথা শোনাতে পারে? তার যখন ইচ্ছে হবে সে তখন ব্যবসা দেখবে। এখন নয়।
দেখতে দেখতে মাস্টার্সের বেশ কয়েক মাস পেরিয়ে যায়। ইরফান শুদ্ধদের বাড়িতে আসতে চায় না। গ্রাম পরিবেশে মানিয়ে নিতে তার বেশ কষ্ট হয়। কিন্তু তার বাবা মা জোর করত আসার জন্য। তবে সে এজন্য আসতো না। সে আসতো গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি করতে। তার পছন্দের ক্যামেরা [Sony ZV-E10]
এই ক্যামেরা তার গ্রামের সঙ্গী।

ইরফানের মাস্টার্সের যখন তিনমাস পেরিয়েছে, তখন সে তার বাবা মায়ের সাথে গ্রামে এসেছে। ফজর নামাজ পড়ে বাড়িতে ফিরেছে। ঘরে এসে কোনোদিকে না তাকিয়ে তার ক্যামেরা টা বের করে বাড়ির বাইরে বের হয়। দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। শুদ্ধ ফোন গুতায়, সাথে চা খায়। ইরফানকে দেখে এগিয়ে এসে বলে,____”তোর বাচ্চা টা কেমন আছে রে?”
ইরফান বিরক্ত চোখে তাকায় শুদ্ধর দিকে। শুদ্ধ ইরফানের হাতের ক্যামেরায় হাত বাড়াতে নিলে ইরফান রেগে বলে,___”ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।”
শুদ্ধ চায়ে চুমুক দিয়ে ইরফানের সামনে ধরে বলে,___”নে সোনা খা। বিশ্বাস কর, এ কোনো সাধারণ চা নয় লা…
এ হল আমার কুলি করা ভালোবাসা মেশানো চা।”
ইরফান চরম বিরক্তি নিয়ে বড় বড় পা ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। শুদ্ধ হেসে আবারও চায়ে চুমুক দেয়।

আকাশ হালকা নীলচে রঙে রাঙানো। সূর্যের আলোর কমলা আভা আড়াল থেকে একটু একটু করে উঁকি দেয়।
ইরফানের মুখাবয়ব গম্ভীর। সকালের সৌন্দর্য ঘেরা আকাশের প্রতিটি দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি করে নেয়। এরপর হাঁটু মুড়ে বসে শিশির ভেজা ঘাসের উপর। মিটমিট করা রোদের আলোয় ঘাষের উপর বিদ্যমান শিশির জ্বলজ্বল করতে থাকে। ইরফান বা পায়ের হাঁটু ঘাষের উপর ঠেকিয়ে ডান পা সামান্য উঁচু করে রেখে ক্যামেরায় বেশ অনেকগুলো পিক ক্লিক করল। পাশেই একটি ঘাসফড়িং চুপটি করে এসে বসে শিশির ভেজা ঘাষের উপর। ইরফান এটাকেও তার ক্যামেরায় বন্দী করে নিল।
এরপর উঠে দাঁড়ায়।

পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে ইরফান তাকায় চারপাশে। কেউ গাছের ডালে বসে, কেউবা খোলা আকাশে মনের আনন্দে ডানা মেলে উড়ছে, কেউবা গাছের এ ডান থেকে ও ডালে নেচে বেড়ায়। ইরফান প্রতিটি দৃশ্য খুব নিপুণভাবে তার ক্যামেরায় ক্লিক করে।
গ্রামের রাস্তায় দু’একজন কৃষক লুঙ্গি পড়ে নিজ নিজ মাঠের দিকে অগ্রসর হয়। কেউ বা মাছ ধরতে এক হাতে পাতিল, আরেক হাতে জাল নিয়ে এগোয়। ইরফান তাদেরকেও তার তার ক্যামেরায় বন্দী করে নিল।
বেলা গড়িয়েছে বেশ। ইরফান ধীরে ধীরে এগোয়, আশেপাশে টুকটাক যা চোখে পড়ছে, তা ক্যামেরায় বন্দী করে নেয়। হঠাৎ-ই পুকুড় পাড়ের ধারে একজন মেয়েকে বসে থাকতে দেখল, যে পুকুরের পানিতে দু’পা ডুবিয়ে রেখেছে। সামান্য ঝুঁকে ডান হাতে আলতো করে পানিতে ভেজায়। মাথায় করা খোঁপা আধখোলা হয়ে পিঠে নেমেছে। ইরফান পুকুরের ডান পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে দৃশ্যটা এতো সুন্দর লাগলো। সে সেখানে দাঁড়িয়েই পুরো ৫০ টা পিক ক্লিক করেছে মেয়েটার। একটুর জন্যও দৃষ্টি এদিক-ওদিক হয়নি।

মাইরা পুকুর থেকে ডান হাতের মুঠোয় এক মুঠো পানি নিয়ে চোখেমুখে ছিটিয়ে দেয়। ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ মৃদু হাসি। বন্ধ চোখ, ফর্সা গোলগাল মেয়েটার মুখ থেকে পানির বিন্দু বিন্দু ফোঁটা বেয়ে পড়ে। ইরফানের চোখেমুখে মুগ্ধতা! ঘোরের মাঝে থেকেই আরও অনেকগুলো পিক তুলল মেয়েটার।
মাইরা হাঁটু উপরে দিকে তুলে এনে হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে পুকুরের পানি দিকে নিরব দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ভীষণ শান্ত এক মেয়ে হয়ে চুপটি করে বসে থাকে। যার নড়চড় নেই কোনো। ইরফান অদ্ভুদভাবে চেয়ে থাকে মাইরার পানে। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা। বিড়বিড় করে আওড়ায়,

“কিউট গ্রীণ বার্ডফ্লাওয়ার।”
বেশ কিছুক্ষণ পর মাইরা উঠে দাঁড়ায়। সামান্য নিচু হয়ে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত গুটানো চুড়ি পায়জামা নিচে নামিয়ে দেয়। খোপা করা চুলগুলো সম্পূর্ণ খুলে যাওয়ার দু’হাতে হাত খোপা করে নেয়।
ইরফান এভাবেও মাইরার পিক উঠায় অনেকগুলো।
মাইরা চুলগুলো খোপা করে আশেপাশে তাকায়। এরপর এগিয়ে যায় বাড়ির পথে।
ইরফান দেখল মাইরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। সবুজ গোল জামা, সবুজ পায়জামা সাথে সবুজ ওড়না পরনে মেয়েটার। ভেজা পা জোড়া শুকনো মাটিকে ভিজিয়ে দেয়। মৃদু বাতাসে মাইরার জামা দুলে ওঠে, মাথা থেকে কাপড় পড়ে যায়। মাইরাকে যতক্ষণ দেখা যায়, ইরফান ততক্ষণ মাইরার দিকে চেয়ে রইল। থেকে থেকে ক্যামেরায় মাইরার হাঁটার দৃশ্য ক্লিক করে। আবার কিছু ভিডিও করে।

ইরফান বাসায় ফিরে তার ক্যামেরায় ক্লিক করা পিকগুলোসহ ভিডিও সব ল্যাপটপে সেভ করে। এই পুরো ঘটনা শেষ হওয়া পর ইরফান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। তার কাজে সে চরম বিরক্ত। এটা তার ক্যারেক্টারের সাথে যাচ্ছেনা। টোটালি যাচ্ছে না।
ঘাড় ঘুরিয়ে ক্যামেরা আর ল্যাপটপ এর দিকে তাকায় গম্ভীর মুখে। এতো রাগ লাগছে নিজের উপর। রেগেমেগে বেডের কোণায় একটা লাথি বসায় তার এই অদ্ভুদ ক্যারেক্টার সে নিতে পারছে না। দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে,
“স্টুপিট গার্ল। হু আর ইউ? ইউ আর ডিস্টার্বিং মি। আ’ইল কি’ল ইউ। ডিজগাস্টিং!”

ইরফান সেদিন-ই দুপুর পর গ্রাম থেকে শহরে তাদের বাড়ি চলে আসে। এরপর আবারও গ্রামে আসে মাইরার জন্য। তার মনে ভাবনা, মেয়েটি কিউট, বাট বাচ্চা। এটাই তার মাথা বিগড়ে দিচ্ছে। অশান্তিতে ঘুম হা’রা’ম হয়ে গিয়েছে। ইরফানের ইচ্ছে করে মাইরাকে পটাপট থা’প্প’ড় দিয়ে বড় করে দিতে। সে বুঝেছে তার ফিলিংস এর ব্যাপারে। বাট ও বাচ্চা। তাই ইরফান যথাসাধ্য ট্রাই করল মাইরাকে তার মন থেকে ছুঁড়ে ফেলতে। বাট সে পারছে না। উল্টে তার নিজের মাথায় বারি দিতে ইচ্ছে করে। অনেক ভেবেচিন্তে ইরফান মাইরার একটা পজিটিভ দিকে খুঁজে পেল। মেয়েটা ভীষণ শান্ত। মাইরাকে মানার জন্য সে হাতিয়ে হাতিয়ে এই দিকটা পেল। মাইরা বাচ্চা, মাইরা শান্ত। দু’টো বৈশিষ্ট্য পাশাপাশি রেখে ভাবলো, বাচ্চা টুকু মানিয়ে নিবে, সাথে এই যে শান্তশিষ্ট এটার জন্য তাকে মেনে নেয়া যায়। কথাটা ভেবে ইরফান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এবার একটু শান্তি লাগছে।
এক সপ্তাহ পর ইরফান আবারও গ্রামে আসে। বিকেলবেলা আসর নামাজ পড়ে পুকুর পাড়ের দিকে আসলে দেখল মাইরা আজ একটা গাছতলায় বসে আছে। কি যেন বিড়বিড় করে। ইরফান মাইরার পিছনে মাইরার থেকে বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়েছে।

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৫৮ (২)

মাইরা’র কণ্ঠে বিষাদ সুরে এলোমেলো শব্দ ভেসে আসে,
“আমি যদি কোটিপতি হতাম! কত ভালো হত! আল্লাহ তুমি একদিন আমায় কোটিপতি বানিয়ে দিবে?”
কথাগুলো বলতে বলতে মাইরার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। ইরফান পিছন থেকে তা দেখতে পেল না। তবে মাইরার চাওয়ার ধরণ তার কাছে পছন্দ হলো।
পিঠ ফিরিয়ে রাখা মাইরার পানে চেয়ে ইরফান বিড়বিড় করে,
“It’s ok. One day, You’ll be a millionaire.”
[আচ্ছা ঠিকাছে। তুমি একদিন কোটিপতি হবে।]

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬০