প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬০
Drm Shohag
কথাটা বলে ইরফান জায়গা প্রস্থান করে। মাইরা বেশ অনেকক্ষণ সেখানে বসে থাকে। আজ তাকে তর সৎ বাবা অনেক কথা শুনিয়েছে। বাড়িতে মেহমান এসেছিল। তাই তার মা বেশ ভালো ভালো পদ রান্না করেছিল। মাইরা তাদের টেবিলে বসে পেটপুরে খেয়েছিল। আর মাত্র দু’বার খেলেই খাওয়া শেষ হয়ে যেত। তখনই তার সৎ বাবা তার প্লেট উল্টে ফেলে চিৎকার করে বলে,
– “এই জীবনে খাসনি? তোকে বিদেয় করতেই মানুষদের আসতে বলেছি। তারা আসার আগেই তুই খাবার খেয়ে নিলি। এই বাড়ি থেকে বিদেয় হবি না তুই? ফ্রিতে গিলতে খুব মজা লাগে তাই না?”
মাইরা মুখভর্তি খাবার নিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল। চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। এই জীবন টা আল্লাহ রেখে দেয়ায় মাইরার এতো কষ্ট হলো! সে কেন মরে যায় না? কবে মরবে আর? তার হায়াত এখনো কেন শেষ হলো না? তার সৎ বাবা সেখান থেকে প্রস্থান করলে মাইরা এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে মুখ ভর্তি খাবার ফেলে দিল। মুখের ভেতর ডান হাত দিয়ে বমি করার চেষ্টা চালায়।
পিছন থেকে তার মা তাকে টেনে ধরে। মাইরা কাঁদতে কাঁদতে তার মায়ের বুকে ঢলে পড়ে। সে মরে যেতে চায়। সে আর বাঁচতে চায় না।
কথাগুলো ভেবে মাইরা ফুঁপিয়ে ওঠে। তার টাকা থাকলে সে এই লোকটাকে খাবারের মধ্যে ডুবাতো। তাকে খাওয়ার খোটা দিল!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সন্ধ্যা নামবে নামবে ভাব। মাইরা চোখমুখ মুছে গাছতলা থেকে উঠে বাড়ির পথ ধরে। মুখে হাসি ফোটায়। যাওয়ার পথে পরিচিত যার সাথে দেখা হয়, কথা বলে হেসে হেসে। কাউকে আবার বাচ্চাদের মতো জ্বালিয়ে দৌড় লাগায়।
ইরফান ভার্সিটি + অফিস এর ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলেই গ্রামে চলে আসতো। তবে থাকতো না। রাত হলেও আবার ফিরে যেত। বেশিরভাগ সময় শুদ্ধদের বাড়িতে যেতোই না। মাইরাকে দেখেই চলে যেত, এমন হয়েছে।
তার বাইক ছিল না। তখন এই হুটহাট আসা যাওয়ার চক্করে বাইক কিনেছিল। গাড়ির চেয়ে বাইকে কমফোর্ট লাগে বলে।
দেখতে দেখতে ইরফানের মাস্টার্সের ফার্স্ট ইয়ার শেষ হয়ে যায়। সেকেন্ড ইয়ারের কয়েক মাস পেরিয়ে যায়।
একদিন ভার্সিটি শেষে অফিসের কিছু কাজ শেষ করে বাইক নিয়ে সোজা গ্রামে চলে আসে ইরফান। শুদ্ধদের বাড়ি যায়নি। সে মূলত মাইরাদের বাড়ি চেনে না। এতোদিন সে দিনেই আসতো সবসময়। মাইরাকে সকালে আর বিকালে বাইরে দেখত। কিন্তু আজ রাত হওয়ায় সে বুঝতে পারে না মেয়েটাকে কোথায় পাবে। সেই প্রথম যেই পুকুর পাড়ে মাইরাকে দেখেছিল সেখানে এসে দাঁড়ায়। অস্থির মন নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে। বিরক্ত হয়। আজ ভার্সিটিতে মাস্টার্সের এক্সাম থাকায় দিনের বেলা আসতে পারেনি। রেগে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে গাছে একটা পাঞ্চ মারে। মেয়েটাকে না দেখতে পেয়ে সে চরম বিরক্ত।
বেশ কিছুক্ষণ পর হতাশ হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে শিস বাজায়। ধীরে ধীরে কাঁচা রাস্তায় হাঁটতে থাকে। একটি গানের শিস বাজায়~
“আলো ভরা কালো চোখে…
কি মাধুরী গো কি মাধুরী!
মনো চাহে যে, ধরা দিতে…
মনো চাহে যে, ধরা দিতে…
তবু সে লাজে সরে যায়…..
মধুমালতী ডাকে আয়…”
হঠাৎ-ই তার কান সজাগ হয়। মেয়ে কণ্ঠে কেউ ডাকছে, শিসওয়ালা বলে। ইরফান থেমে যায়। একটু আড়াল হয়ে দাঁড়ায়। অন্ধকার হওয়ায় তেমন স্পষ্ট দেখা গেল না। তবে চাঁদের আলোয় মাইরাকে দেখে চিনতে পারলো সে। ইরফানের চোখেমুখে বিস্ময়। মাইরা শিসওয়ালা বলে ডাকছে সাথে এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজছে। ইরফানের কাছে ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগলো। সে যাকে খুঁজছে, তার যাকে ভালো লাগে, সেই বাচ্চা মেয়েটা তার শিস শুনে তাকেই খুঁজছে। ইরফান আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। তবে মাইরার দিকে ফিরে না। উল্টো ঘুরে শিস বাজাতে বাজাতে তার বাইকের দিকে এগিয়ে যায়। মাইরা এমন ছেলের অবয়ব দেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সাথে সেই শিস। সে আবারও ডাকল,__”শিসওয়ালা?”
ইরফান এগিয়ে গিয়ে বাইকে উঠে বসে। কিছুটা আওয়াজ করে বলে ওঠে,___”ইয়াহ!”
কথাটা বলে আবারও শিস বাজাতে বাজাতে বাইক এক টান দেয়।
ইরফানের কাছে মাইরার ব্যাপারটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং লাগে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছে মাইরার এটলিস্ট ১৭-১৮ বছর হলেই বিয়ে করবে। এতোদিনে বাচ্চা মেয়ের এই ছোট বয়স থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত, তার ভেতরকার একটা নতুন অনুভূতি, এটার সূচনা থেকে ইরফান এনজয় করতে পারবে।
ইরফান সেদিন শুদ্ধদের বাড়িতেই ছিল। এরপর পরদিন সকাল সকাল শুদ্ধদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। গ্রামের গন্ডি থেকে বেরোনোর আগেই রাস্তায় মাইরাকে দেখে বাইক থামায়। মাথায় হেলমেট। ওভাবেই গম্ভীর চোখে মাইরাকে দেখছে।
যে মেয়ে ভীষণ চঞ্চল। খই ফোটার চেয়েও মুখ বেশি চলছে মাইরার। সাথে মাইরার এর ওর সাথে হাজার টা দুষ্টুমি। এর ওর উপর ঢলে পড়ছে হাসতে হাসতে। ইরফান চোয়াল শক্ত করে মাইরার দিকে তাকালো। এতো বেশি কথা বলা মানুষ ইরফানের পছন্দ নয়। শুধু পছন্দ নয়, এমন না।
সে এই ধরনের মানুষকে টোটালি সহ্য করতে পারে না। স্কুল লাইফে এমন অনেক চঞ্চল মেয়ে বা ছেলে তার সাথে কথা বলতে আসলে সে মুখ ফিরিয়ে রাখতো। কেউ বেশি জোর করলে তাকে থা’প্প’ড় মেরে দিত। এজন্য ইরফানকে অনেকেই বিরক্ত চোখে দেখত। ইরফান সেসবকে পাত্তা দিত না।
শুদ্ধর ব্যাপার টা আলাদা। ছোট থেকেই শুদ্ধর সাথে একসাথে পড়ছে, শুদ্ধ একা একা কথা বলে, ইরফান কখনো চুপ থাকে, নয়তো রেগে জায়গা প্রস্থান করে। তবে শুধুমাত্র শুদ্ধকে তার সয়ে গিয়েছে অনেকটা বড় হওয়ার পর। ক্লাস সিক্স থেকে এইচএসসি পর্যন্ত শুদ্ধ ভালোই মার খেয়েছে ইরফানের হাতে, বেশি কথা বলার জন্য। ইরফানের বিচারও বসতো, তার বাবা বকতো শুদ্ধকে মারার জন্য। ইরফানের মাঝে তেমন হেলদোল দেখা যেত না।
তারেক নেওয়াজ শুদ্ধকে ইরফানের পিছে না লাগতে নিষেধ করত। শুদ্ধ ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে মাথা নাড়তো। কিন্তু সুযোগ পেলেই আবার ইরফানের পিছে লাগতো।
মাইরা বাচ্চা হওয়ায় ইরফান প্রথমেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল মাইরার থেকে। সে কি করে ওই হাঁটুর বয়সী মেয়েকে ভালোবাসতে পারে? কি করে মানবে ওকে? কিন্তু নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে টিকতে না পেরে মাইরাকে মানার জন্য একটি বৈশিষ্ট্য খুঁজছিল যেন সে মাইরাকে মানতে পারে। এরপর ইরফান মাইরার প্রতি ফিলিংসকে আশকারা দিয়েছিল একমাত্র মাইরার শান্ত স্বভাবের জন্য। সে যতদিন মাইরাকে দেখেছে, মাইরা ভীষণ শান্ত হয়ে একা একা চুপচাপ থাকতো।
আজ হঠাৎ মাইরার এমন রূপ দেখে ইচ্ছে করল এই মেয়েকে থা’প’ড়ি’য়ে এসব বাজে স্বভাব চেঞ্জ করাতে।
ভাবনার মাঝেই মাইরা দৌড়ে এসে ইরফানের বাইকের সামনের চাকার সাথে ধাক্কা খায়। ডান পায়ে ব্য’থা পেয়ে চিল্লিয়ে বলে ওঠে,___”এই কোন বে’য়া’দ’ব রে! ওমাগো আমার পা!”
ইরফান ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চোয়াল শক্ত করে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। মাইরা ইরফানের দিকে তাকালে দেখল মাথায় কালো হেলমেট, যার ফলে মুখ দেখতে পেল না। গায়ে কালো শার্ট, কালো প্যান্ট, হাতের ঘড়িও কালো, জুতোও কালো, বাইকটাও কালো। মাইরা মাথায় হাত দিয়ে বলে,
– “ওরে আল্লাহ! এ তো দেখি পুরাই কালা মামা। তা কালা মামার সাথে সাথে কি কানা মামা-ও হয়ে গিয়েছেন! চোখে দেখেন না?”
ইরফান চিৎকার করে বলে ওঠে,
– “সাট আপ।”
মাইরা ভয়ে কেঁপে ওঠে। দৌড়ে রাস্তার অপর পাশে চলে যায়। ইরফান এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে হাওয়ার বেগে বাইক নিয়ে বাইক নিয়ে জাগায়টা প্রস্থান করে। রাগের চোটে বাইকের স্পিড বাড়ায় সমানে। দাঁতে দাঁত পিষে বিড়বিড় করে,___”Stupid girl, I Swear, I will forget you.”
ইরফান বাড়ি ফিরে হনহন করে তার ঘরে চলে যায়। তার ক্যামেরা আর ল্যাপটপ দু’টো দু’হাতে নিয়ে সমানে আঁচড়ায়। ওই স্টুপিটকে দিয়ে এই দু’টো ভরে গিয়েছে। রা’গে ল্যাপটপ আর ক্যামেরা দু’টোই একদম গুঁড়ো করে ফেলে।
শুদ্ধ ইরফানদের বাসায় এসেছিল। সে ম্যাচে থাকে। যদিও তার মামা এখানে থেকে পড়াশোনা করার কথা বলেছিল। অনেক জোর করেছে। শুদ্ধ মানেনি। ব্যাপারটা তার কাছে ভালো লাগে নি।
আজ ভার্সিটি নেই তাই সে ইরফানদের বাসায় আসে। কিন্তু ইরফানের ঘরে এসে ইরফানকে ল্যাপটপ আর তার প্রাণের ক্যামেরা ভাঙতে দেখে শুদ্ধ দৌড়ে গিয়ে ইরফানকে সাপ্টে ধরে। অবাক হয়ে বলে,
– “এই ইরফান এগুলো কি করেছিস? হায় রে! তোর এতো সাধের বাচ্চাটাকে মেরে ফেললি!”
ইরফান শুদ্ধর কলার ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
– “ও কেন এসেছিল আমার সামনে? ওকে আমি টলারেট করতে পারবো না। এখন আমার কি হবে?”
শুদ্ধ অবুঝের মতো ইরফানের দিকে চেয়ে থাকলো। কার সাথে আবার কি ঘটিয়েছে এ? ইরফান শুদ্ধকে ছেড়ে তার ঘরের ভেতরে আরেকটি ঘরের ভেতর গিয়ে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে, ভেতরে যা যা ছিল সব টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলে। সবগুলো ঘরের মাঝখানে এনে পকেট থেকে লাইটার বের করে সব জ্বালিয়ে দেয়।
থাই খুলে দেয়। তবুও বন্ধ ঘরে ধোঁয়া সব বেরিয়ে যেতে পারে না। দরজার ওপাশ থেকে শুদ্ধ দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলে,
– “ইরফান কি করছিস? দরজা খোল। কি আছে এখানে? কি পোড়াচ্ছিস?”
ইরফান একটা কথাও বললো না। যতক্ষণ সব পুড়ে ছাই না হয়ে যায়, ততক্ষণ ইরফান সেদিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেলে ইরফান ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। শুদ্ধ ইরফানকে অ’ক্ষ’ত দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল কিছুই নেই। নরমাল সব। ঘরের মাঝখানে ছাইয়ের স্তূপ।
ইরফান তার বেডের উপর জুতো পায়ে নিয়েই চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়ে। চোখ বুজে নেয়। শুদ্ধ ইরফানকে কিছু বলতে তার আগেই তারেক নেওয়াজ ঘরে এসে ল্যাপটপ আর ক্যামেরার এই অবস্থা দেখে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। ক্যামেরা যাক, বাট ল্যাপটপে কত ডকুমেন্টস ছিল। ভীষণ রে’গে যায় তিনি। ইরফানকে অনেক কথা শোনায়। ইরফান শুনেছে কি-না! তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
ল্যাপটপ ভাঙার কারণে ইরফানদের ব্যবসায় কিছুটা লস হয়। তারেক নেওয়াজ এরপর থেকে ইরফানের পার্সোনাল ল্যাপটপ থেকে সব অফিস আর তার ল্যাপটপে কালেক্ট করে রাখে। এই মাথা পা’গ’ল ছেলের জন্য আরও কত কী করতে হবে? কে জানে!
ইরফান সেদিনের পর থেকে আর গ্রামে যায়নি বললেই চলে। তার কানে এসেছিল, মাইরার বাবা মাইরাকে বিয়ে দিতে চায়। কথাটা শুনে ইরফানের ইচ্ছে করল, সেই বাপকে গিয়ে কু’র’বানি করে দিয়ে আসতে।
এরপর ইরফান গ্রামের একটি পরিচিত ছেলেকে মাইরার একটা পিক দেখিয়ে বলে, এর জন্য পাত্র আসলে তাকে যেন খবর দেয়া হয়। ইরফান মাইরার ব্যাপারে কিচ্ছু শোনেনি কখনো। এমনকি নামটা পর্যন্তও না। মাইরার বৈশিষ্ট্য জানার পর তো আরও রা’গ হতো মাইরার কথা মনে পড়লে।
বেশ কয়েকমাস পর ইরফান আর শুদ্ধর মাস্টার্স কমপ্লিট হয়ে গেলে তারা ভার্সিটিতে এপ্লাই করে। রেজাল্ট ভালো থাকায় তারা পাবলিক ভার্সিটির লেকচারার হয়।
ইরফান ব্যবসায় ফোকাস করে পুরোপুরি। মূলত মাইরার সেই কথাকে কেন্দ্র করেই সে ব্যবসায় এতো মন দিয়েছে। নয়তো এক্ষুনি ব্যবসায় হাত দিতো না।
ইরফান আজ গাড়ি নিয়ে গ্রামে এসেছে। মাইরার জন্যই এসেছে। মেয়েটা বাচ্চা, সাথে চঞ্চল মনে পড়লেই যেমনই রা’গ হয়, তেমনি খা’রা’প লাগে। নিজের মনকে মানাতে না পেরে আবারও সেই অপছন্দের মেয়ের জন্যই এসেছে।
আগের ক্যামেরা ভাঙার পর সেইম আরেকটা ক্যামেরা কিনেছে। সে তার মনকে থামাতে পারছে না। মানাতে পারছে না।
বিকেলের রোদ পড়ে গিয়ে প্রকৃতি কিছুটা শীতল হয়েছে। ইরফান গাড়ি সাইড করে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। পরনে সাদা শার্ট, শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত যত্নে ভাঁজ করে রাখা। কালো প্যান্ট, মুখে কালো মাস্ক। এক হাতে ক্যামেরা, আরেক হাতে বার্ডফ্লাওয়ার।
মাইরাকে দেখার পর পর-ই ইরফান অনলাইন থেকে বার্ডফ্লাওয়ারের বীজ কিনে সে বেশ কসরত করে অনেকগুলো গাছ বড় করেছে। তার মাঝে থেকে দু’টি বার্ডফ্লাওয়ার গাছের ডাল ছিঁড়ে এনেছে। যে ডাল দু’টির দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে মোট ৮ টি করে বার্ডফ্লাওয়ার।
ইরফান এগিয়ে যায়। খুব বেশি খুঁজতে হয় না মাইরাকে। ভাগ্যক্রমে মাইরা আজও সবুজ জামা পড়েছে। ইরফান মাইরার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। তবে একটু পর-ই ইরফানের দৃষ্টিতে বিরক্ত ভর করে মাইরার চঞ্চলতায়।
মাইরা বেশ কয়েকজন বাচ্চাদের মাঝে খেলাধুলা করছে। পায়ে ধূলো মাখা। ইরফান ইচ্ছে করল আগে একে ঠাটিয়ে ইচ্ছে মতো থা’প’ড়ে মানুষ বানাতে।
মাইরার বসয় তখন ১৪ বছরের একটু বেশি। মাইরার দেহের গড়ন খুব বেশি চিকন নয়, আবার খুব বেশি মোটা নয়। বয়স কম হলেও মাইরার গ্রোথ ভালো থাকায়, মাইরাকে অন্যান্যদের চেয়ে বেশ বড়ো-ই লাগে।
ইরফান নিজের বিরক্তি নিজের মাঝে চেপে একটা পাঁচ বছরের বাচ্চার হাতে বার্ডফ্লাওয়ার এর ডাল হাতে দিয়ে মাইরাকে হাত দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আর বলে এটা মাইরাকে গিয়ে দিতে।
পকেট থেকে বেশ কয়েকটি চকলেট বাচ্চাটির হাতে দিয়ে বলে, তার কথা যেন না বলে। বাচ্চাটি সব মেনে নিয়ে মাইরার দিকে দৌড় দেয়।
ইরফান সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মাইরার দিকে তাকায়। মেয়েটা ঘেমে গিয়েছে। তবুও লাফঝাপ থামানোর গন্ধ নেই। ইরফানের বিরক্তির মাত্রা বাড়ছে বই কমছে না। সাথে রা’গ-ও হচ্ছে। মেয়েটা শান্তশিষ্ট হলে খুব কি ক্ষতি হতো!
বাচ্চা ছেলেটি মাইরার হাতে বার্ডফ্লাওয়ারের ডাল দু’টি ধরিয়ে দিলে মাইরা বাচ্চাটির হাত থেকে সেগুলো নেয়। ভ্রু কুঁচকে বলে,
– এগুলো কে দিলো তোকে?
বাচ্চাটি বলতে গিয়েও থেমে যায়। বাচ্চা ছেলে। তাকে একজন চকলেট দিয়ে বলতে নিষেধ করেছে। সেও বলবে না। তাই কিছু না বলেই দৌড় দেয়। মাইরা ডাকলেও শোনে না। মাইরা অবাক হয়। হাতের ডাল দু’টির দিকে দিকে তাকালে অবাক হয়। এতো ইউনিক জিনিস এর আগে দেখেনি। মাইরার মনে হলো ডালে ধরে থাকা সবুজ পাতাগুলো একেকটা মুড়িয়ে মুড়িয়ে নিখুঁত হাতে বানানো টিয়া পাখি। যার মাঝে প্রাণ নেই, তবে ভীষন সুন্দর। তার মনে হয়, টিয়া পাখির মতো দেখতে এই টিয়াফুল গুলো এক্ষুনি তার সাথে কথা বলবে বলবে ভাব। মাইরার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তার পাশে থাকা বান্ধবীদের দেখায়।
সকলেই বেশ অবাক হয়। মাইরা তার বান্ধবীদের রাস্তা থেকে নেমে একটি মাঠে যায়, যেখানে মানুষজন নেই তেমন।
এরপর সেখানে ঘাষের উপর পা ভাঁজ করে বসে। তার দু’পাশে তার বান্ধবীরা বসে। মাইরা খোপা করা চুলগুলো খুলে যায়। কিছুটা চুল সামনে হেলে আসে। মুখে হাসি। দু’হাতে বার্ডফ্লাওয়ার।
ইরফান দূর থেকে মাইরার প্রতিটি ভাবভঙ্গি তার ক্যামেরায় বন্দী করে নেয়।
ইরফানের চোখেমুখে মুগ্ধতা। ঠোঁটের কোণে স্বচ্ছ সূক্ষ্ম হাসি। মাইরার পানে মুগ্ধ দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বিড়বিড় করে,
“জীবন্ত বার্ডফ্লাওয়ার এর কোলে ঘুমন্ত বার্ডফ্লাওয়ার। সো কিউট!”
হঠাৎ-ই ইরফানের মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে যায়। মাইরার দিকে চেয়ে চোখমুখ মুহূর্তেই কেমন শক্ত হয়ে যায়।
মাইরা তার হাতে থাকা ডাল থেকে বার্ডফ্লাওয়ার গুলো একটা একটা করে ছিঁড়ে তার বান্ধবীদের দিচ্ছে। ইউনিক জিনিস, আর ভীষণ কিউট, মাইরা সবাইকে ভাগ করে দিল। সবশেষে তার কাছে থাকলো তিনটে। সেগুলো তার হাতে নিয়ে সবাইকে টাটা বলে মাঠ থেকে রাস্তায় উঠে আসে।
ইরফান চোয়াল শক্ত করে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। সে ভালোবেসে তার বার্ডফ্লাওয়ারের জন্য এগুলো এনেছে আর এই স্টুপিট তার ভালোবাসা সবার মাঝে বিলিয়ে দিচ্ছে। ইরফান রা’গ চেপে রাখতে না পেরে সর্বশক্তি দিয়ে হাতের ক্যামেরা ছুঁড়ে ফেলে। মাইরা খুশ বেশি দূরে ছিল না, ক্যামেরাটা একদম তার সামনে গিয়ে পড়ে। মাইরা দু’পা পিছিয়ে যায়। এক্ষুনি তার পায়ের উপর এসে পড়ত এটা।
মাইরা চোখ তুলে তাকালে এক অপরিচিত লোককে দেখল। মুখ দেখতে পায় না মুখে মাস্ক থাকায়।গ্যাটআপ দেখে বুঝল এটা শহুরে ছেলে। আর ক্যামেরা টাও ওদিক থেকেই আসলো। লোকটার-ই হবে। এই ভেবে মাইরা নিচু হয়ে ক্যামেরা টা তুলে ইরফানের সামনে এসে দাঁড়ায়।
ইরফান দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মাথা নিচু করে চোখ বুজে আছে। মাইরা গলা ঝেড়ে বলে,
– ভাইয়া এটা কি আপনার?
ইরফানের রা’গের মাত্রা বোধয় এবার ১৬ কলা পূর্ণ হলো। ভাইয়া সে? সে তার বার্ডফ্লাওয়ারের ভাইয়া? লাইক সিরিয়াসলি? এই মেয়ে আর দু’মিনিট তার সামনে থাকলে থা’প্প’ড় খেতে খেতেই আজ মরবে। ইরফান চোখ বুজেই দাঁতে দাঁতে চিৎকার করে ওঠে,
– আউট
এতো জোরে ধমক মাইরার কাছে আনএক্সপেক্টেড ছিল। মেয়েটা ভয়ে কেঁপে ওঠে। হাত থেকে ক্যামেরাও পড়ে যায়। কোনোদিকে না তাকিয়ে দৌড় লাগায়। এমনিতেই চেনেনা জানেনা, তবুও হেল্প করতে আসলো, উল্টে তাকেই কি জোরেই না ধমক দিল লোকটা। যাওয়ার আগে মাইরা পিছু ফিরে শব্দ করে বলে ওঠে,
– আদব নাই। শা’লা বে’য়া’দ’ব।
ইরফান কথাটা শুনতেই জ্বলন্ত চোখে তাকায় মাইরার দিকে। মাইরা জান হাতে নিয়ে দৌড়ে প্রায় অদৃশ্য হওয়ার পথে। ইরফান দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
– আ’ইল কি’ল ইউ, স্টুপিট গার্ল।
ইরফান মাইরাকে ভুলে যাওয়ার মিশনে নেমেছে বলতে গেলে। কিন্তু পারছে না। তার এতো অশান্তি লাগে। নতুন নতুন কলেজ লেকচারার হয়ে স্টুডেন্ট দের উপর অর্ধেক ঝাল মেটায়। মে’জা’জ সবসময় গরম থাকে, এ তো নতুন নয়। কিন্তু এই অশান্তি আর নেয়া যাচ্ছে না।
ইরফান আবারও গ্রামে যায় মাইরাকে দেখতে। সেই চঞ্চল মেয়েকে দেখে ইরফানের ভীষণ রা’গ হয়। সে এসব হ্যাবিট নিতে পারে না। এই মেয়ে তার আশেপাশে থাকলে তার অজান্তেই মেয়েটা তার হাতে ঠিক কত যে মার খাবে এটা ভেবে নিজেরই গলা শুকিয়ে আসে। সে নিজেকে চেনে। এখন কি করবে? না পারছে এগোতে, না পারছে পেছাতে।
ইরফান আবারও গ্রামে আসে মাঝে মাঝেই মাইরাকে দেখে। প্রায় রাতে সেই পুকুড় পাড়ে গিয়ে শিস বাজায়। ইরফানের নিজেকে এতো অসহায় লাগে! সে এমন অদ্ভুদ কেন? তার নিজের উপর-ই ভীষণ রা’গ হয়।
সে মাইরাকে চায়, বাচ্চা মাইরাও তাকে চায়। বাট ইরফান মাইরাকে নিজের কাছে আনতে পারছে না। কেমন এক বিশ্রী অনুভূতি!
এক রাতে পুকুর পাড়ে প্রায় অর্ধেক রাত পর্যন্ত বসে ছিল। পুরো ১৫ টা সিগারেট একবারেই শেষ করে। রাতের মিটমিট করে জ্বলতে থাকা তারা আর চাঁদের আলোয় পুকুরের পানি টলটল করে। ইরফান স্পষ্ট দেখতে পায়, এই টলটল পানিতে মাইরার মায়াবী মুখটা ভাসা ভাসা মুখ। মৃদু হাওয়ায় গাছের পাতার সাথে সাথে পুকুরের পানি মৃদু দোলে, সাথে জোছনায় মাখা মাইরার মায়াবী মুখ।
ইরফানের ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি ফুটে ওঠে৷ বিড়বিড় করে,
❝তুমি আমার দূরে থাকা অপছন্দের এক চঞ্চল হরিণী,
যাকে ছোঁয়ার তৃষ্ণা আমার হৃদয়ে এক তান্ডবময় অস্থিরতা জাগায়,,
যা আমি চাইলেও থামাতে পারিনা বার্ডফ্লাওয়ার।❞
ইরফান মাইরাদের বাসা চিনতো না। সে পুকুর পাড় থেকে হাঁটতে হাঁটতে একটা উঠানে চৌকি দেখে সেখানে শুয়ে পড়তো। মাঝে মাঝেই এখানে এসে শুয়ে পড়তো। তার ক্যারেক্টারের সাথে এটা একদমই মানানসই নয়। যেখানে সে রাস্তার পাশে বসতেই ১০ বার ভাবে, সেখানে কার না কার চৌকি পাতা সেখানে এসে শুয়ে পড়তো। শিস বাজাতো। মাঝে মাঝে নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে দ্রুত জায়গা প্রস্থান করতো।
একরাতে ইরফান আবারও পুকুর পাড়ে এসে শিস বাজায়। সেদিন সে আবারও শুনতে পায়, মাইরার ডাক। ইরফান ঢোক গিলে। মাইরা দৌড়িয়ে আসছে। ইরফান অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলো। মাইরা হঠাৎ-ই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। ডেকে ওঠে,___”শিসওয়ালা?”
ইরফান এগিয়ে যেতে গিয়েও যায়নি। তার মাইরাকে দেখলে রা’গ হয়। মেয়েটা তার হাতের শক্ত মার খাবে। এই মেয়েটা চঞ্চল না হলে নিশ্চয়ই সুন্দরভাবে আসতো। এমন দৌড়ে আসতো না! আর এভাবে পড়েও যেতো না। ইরফানের রা’গ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ইচ্ছে করল আগে একে উঠিয়ে চারটে থা’প্প’ড় দিতে। এগোলো না।
মাইরার সামনেই একটি কু’কু’র কে দেখে ইরফানের রাগ তড়তড় করে বেড়ে যায়। কু’কু’র টি মাইরার দিকে এগোলে ইরফান চোখ বড় বড় করে তাকায়। সে বার্ডফ্লাওয়ার কে আঘাত করবে বলে বিয়েটাই করছে না, আর এই কু’কু’র তার বার্ডফ্লাওয়ারের দিকে পা বাড়াচ্ছে। কত্ত বড় সাহস! দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করে,___”ডিজগাস্টিং।”
কুকুরটি ইরফানের কথা শুনেছে কি-না। মাইরার পাশ দিয়েই দৌড় দেয়। ইরফান সময় নষ্ট করল না। বড় বড় পা ফেলে তার বাইকে উঠে পড়ে মাইরার থেকে অনেকটা দূরত্বে। এরপর হাওয়ার বেগে জায়গা টা প্রস্থান করে।
ইরফান মূলত কু’কু’রের পিছু নিয়েছে। কিছুদূরে যেতেই দেখল কু’কু’র টি এক গাছের নিচে বসে হাঁপাচ্ছে, তার পাশে দু’টো কু’কু’র ছানা। যেন তারা তার মায়ের সেবা করছে।
ইরফান যে রা’গ নিয়ে এসেছিল তাতে কিভাবে যেন পানি পরল। সে আর এগোলো না কু’কু’র টির দিকে। বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে শুধু তাকিয়েই রইল কু’কু’র ছানাসহ বড় কু’কু’র টির দিকে। তার চোখেমুখে অসহায়ত্ব। সে তার বার্ডফ্লাওয়ার কে এভাবে আদর করে ছুঁয়ে দিতে পারে না। ভীষণ খা’রা’প লাগে তার। তার বিপরীত ধর্মীর মাইরাকে দেখে তার ভীষণ রা’গ হয়।
ইরফান বেশ কিছুক্ষণ পর আবারও মাইরার এখানে আসে, যোখানে মাইরা পড়ে গিয়েছিল। এসে জায়গাটা ফাঁকা দেখল। ইরফান আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজল মাইরাকে। কোথাও দেখতে না পেয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
এগিয়ে গিয়ে তার বাইকের উপর উল্টো দিকে হয়ে দু’পা দু’দিকে দিয়ে বসে। পকেট থেকে সিগারেট এর প্যাকেট আর লাইটার বের করে। পুরো পাঁচটি সিগারেট পোড়ায়।
এরপর বাইকের উপর কোনোরকমে শুয়ে দু’হাত মাথার নিচে রাখে। বাম পা ভাঁজ করে রেখে ডান পা বা পায়ের উপর রাখে। এরপর চোখ বুজে মলিন সুরে গেয়ে ওঠে,
” তোমাকে ছোঁয়ার নেই তো
আমার সাধ্য
দেখতে পাওয়া, সেই তো বড় ভাগ্য!
মনটা অবাধ্য
হচ্ছে প্রায়শ..!
ক’ষ্টের বোঝা বেড়েই
যাচ্ছে ক্রমশঃ
ঘুম চলে যায়
তোমার চোখে বেড়াতে…
থেমে যায় ইরফান। দৃষ্টিজোড়ায় অসহায়ত্ব! চোখের মণি দু’টি অন্ধকার আকাশপানে।
বার্ডফ্লাওয়ার কে ছোঁয়ার সাধ্য তার নেই। ছুঁতে গেলেই যে আঘাত পাবে। কি করে এগোবে ইরফান? আকাশপানে চেয়ে বিড়বিড় করে,
– স্যরি বার্ডফ্লাওয়ার!
তারেক নেওয়াজ ইরফানকে রাজি করাতে পারছেন না মাইরাকে বিয়ের ব্যাপারে। অনেকদিন থেকে বলেছে কিন্তু ইরফান শোনেনা। ওদিকে মাইরার সৎ বাবা মাইরার জন্য দু’দিন পর পর পাত্র আনে। তারেক নেওয়াজ চিন্তিত। তিনি কি করবেন এবার? মনে মনে পরিকল্পনা করলেন কিছু।
তারেক নেওয়াজ, রুমা নেওয়াজ ইরফানকে নিয়ে তৃণা বেগমের বাড়ি যায়। তারেক নেওয়াজ এবার আটঘাট বেঁধেই এসেছে। সে এবার মাইরার সাথে ইরফানের বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। ভাবনা অনুযায়ী তিনি ইরফানকে বলে বিয়ের কথা। ইরফান তো মানবে না। সে এবার রুমা নেওয়াজ কে অসুস্থ হওয়ার এক্টিং করতে বলে। ইরফান উপর থেকে যেমনই হোক। ভেতর থেকে নরম। বিশেষ করে কাছের মানুষদের জন্য। মা অসুস্থ হয়েছে শুনলে ইরফান অবশ্যই বিয়ে করবে। ইরফান বিয়ে করবে না বলে গ্রাম থেকে রওয়ানা হয়েছে। তখনই তারেক নেওয়াজ জানায় তার মা মারাত্মক অসুস্থ। ইরফান গাড়ি ঘোরায়। শুদ্ধদের বাড়িতে এসে দেখে তার মা সত্যিই অসুস্থ। মাকে অসুস্থ দেখে ইরফান আর একটা কথাও বলেনি। তার মাইরার কথা বারবার মনে পড়ছে। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইল জড়বস্তুর মতো।
এ পর্যন্ত মাইরার জন্য আসা প্রতিটি পাত্রর অবস্থা খুব ভালো রাখেনি ইরফান। কেউ মাইরাদের বাড়িতে পা-ই রাখতে পারেনি মাইরাকে দেখার জন্য। যারা বেশি ঘাড়ত্যাড়ামি করতো, ওদের অবস্থা ইরফান সারাজীবন হসপিটালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে।
তারেক নেওয়াজ ইরফানের মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– বিয়ে করলে তোমার জীবন সুন্দর হবে।
ইরফান তার মাথা থেকে বাবার হাত ঝাড়া মেরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– ডোন্ট টাচ মি।
তারেক নেওয়াজ কিছু বললেন না। ছেলে বিয়েতে রাজি হয়েছে এই অনেক। ইরফান হঠাৎ-ই বসা থেকে দাঁড়িয়ে তার বাবার দিকে চেয়ে বলে,
– বিয়ে করলে লাইফ সুন্দর হয়?
তারেক নেওয়াজ বোঝানোর স্বরে বলে,
– হ্যাঁ অবশ্যই।
ইরফান ভ্রু কুঁচকে বলে,
– তুমি চাও তোমার লাইফ সুন্দর হোক?
তারেক নেওয়াজ না বুঝেই বলে,
– হ্যাঁ অবশ্যই চাই।
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– ওকে।
কথাটা বলে ইরফান তার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
– আরেকটা মেয়ে দেখো আম্মু। বাবা বিয়ে করতে চাইছে।
ইরফানের কথা শুনে রুমা নেওয়াজ সহ তারেক নেওয়াজ হতভম্ব হয়ে যান। রুমা নেওয়াজ দ্রুত শোয়া থেকে উঠে বসেন। ইরফান তীক্ষ্ণ চোখে এতোক্ষণ অসুস্থ হওয়ার ভান করা সুস্থ মাকে দেখল। অতঃপর হঠাৎ-ই চিৎকার করে বলে,
– এসব ফা’ল’তু কাজ করে আমাকে বিয়ে দিতে চাইছ? ফান করছ আমার সাথে?
ইরফানের এভাবে কথা বলায় রুমা নেওয়াজের এবার সত্যিই প্রেশার হাই হয়ে যায়। অবস্থা ভালোই খা’রা’প হয়। ইরফানও বুঝেছে তার মায়ের অবস্থা খা’রা’প হয়েছে। তার মা অসুস্থ শরীরে ইরফানের কাছে আবদার করে, সে যেন বিয়েতে রাজি হয়।
ইরফান অসহ্যকর এক অনুভূতি নিয়ে বিয়েতে রাজি হতে বাধ্য হয়।
ইরফান শক্ত হয়ে সোফায় বসে আছে। রা’গে মাথা সহ পুরো বডিতে যেন আগুন জ্বলছে।
তার সামনেই সোফা টেবিলের উপর তার বাবা মায়ের ফোন একসাথে রাখা। ইরফান রাগে ফোন দু’টো সর্বশক্তি দিয়ে আঁছড়ে ফেলল। ফোন দু’টো পুরো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়।
তারেক নেওয়াজ ছেলের রা’গ দেখে অবাক হয় না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করছে, একটু-আধটু রা’গ’বেই। দু’টো ফোনের বিনিময়ে বিয়েতে রাজি হলেও কোনো প্রবলেম নেই।
ইরফানকে কিছু বলতে গিয়েও তারেক নেওয়াজ জিভ গুটিয়ে নেয়। একটু আগের বলা ছেলের উদ্ভট কথা শুনে আর কাছে গেলেন না। কি সাংঘাতিক ছেলে তার! নিজের বাবাকে বিয়ে দিতে চায়!
ইরফান বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে। এরপর শুদ্ধর ঘরে গিয়ে শুদ্ধর বেডে শুয়ে পড়ে। শুদ্ধ তার বেডের একপাশে শুয়ে ফোন স্ক্রোল করছিল। ইরফানের কথা শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় ইরফানের দিকে।
“মেয়েটি কি বিয়েতে রাজি?”
ইরফানের কথায় শুদ্ধ মৃদুস্বরে বলে,
– শুনেছি, মেয়েটি বিয়েতে রাজি নয়। বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। তোকে দেখেওনি।
ইরফান বিড়বিড় করে,
– গুড
শুদ্ধ মৃদুস্বরে বলে,
– ওদের অবস্থা খুব বেশি ভালো না। মানে টাকাপয়সা নেই তেমন। তাই তুই উল্টাপাল্টা কিছু ভাবিস না।
ইরফান কিছু বললো না। চুপচাপ বেড থেকে নেমে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়। তার মাথায় কিছু খেলছে।
মেয়েটি বিয়েতে রাজি নয়, এর মানে মেয়েটিও তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে, সে অফার করলে। ফার্স্ট অপশনে রাখল, মেয়েটিকে ডিভোর্স দিয়ে তার যাবতীয় খরচ এর একটা এমাউন্ট সে মেয়েটাকে দিবে। যেন ডিভোর্স দিলেও কোনো প্রবলেম না হয়।
আর সেকেন্ড অপশন, মেয়েটি স্বামী চাইলে সে তার এক ফ্রেন্ডের সাথে মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দিবে। যে ফ্রেন্ড এর কথা ভাবলো, সে গুড লুকিং। সবদিক থেকেই ভালো। মেয়েটির অবশ্যই কোনো প্রবলেম হবে না।
মেয়েটি যেহেতু তাকে দেখেনি, তাকে নিয়ে ভাবেইনি। সো, এটা একটা গুড পয়েন্ট।
আর মেয়েটির বাড়িতে তেমন কেউ ছিল না, বাবা মা ছাড়া। তাই জামাই বদল হলেও প্রবলেম নেই। সবচেয়ে বড় কথা জামাই বদল হলে তার ফ্যামিলি আর মেয়েটির ফ্যামিলির দু’জনেরই শিক্ষা হবে। এরা এতো চিপ মেন্টালিটির কেন ইরফান বুঝে পায় না। বিয়ের মতো একটা ব্যাপার এভাবে জোর করে দিচ্ছে। স্ট্রেঞ্জ!
ইরফান বাইরে গিয়ে সে এক উকিলের সাথে যোগাযোগ করে।
সে আজকে বিয়ে করছে। যত দ্রুত সম্ভব যেন ডিভোর্সের ব্যবস্থা করা হয়। কথাবার্তা ঠিক করে। এরপর তার সেই পরিচিত ফ্রেন্ড এর সাথেও এই ব্যাপারে আলাপ করলে সে সম্মতি দেয়। সে এমনিতেও মেয়ে খুঁজছে। ইরফানের উপর তার পুরো ভরসা আছে। তাই দ্বিমত করার প্রশ্ন নেই। বন্ধুর জন্য এটুকু করাই যায়। তার ফ্যামিলির প্রবলেম নেই তেমন। এ কারণে সে যেভাবেই বিয়ে করুক না কোনো প্রবলেম নেই।
ইরফান তার মায়ের জন্য আপাতত বিয়েটা করে নেয়।
সে রা’গের মাথায় ধুপধাপ মে’রে দিতে পারে ভেবে শুদ্ধকে বলেছিল যেন মেয়েটার সাথে তার ভাবনা অনুযায়ী আলোচনা করে। কিন্তু শুদ্ধ বাঁদরামি করে বলেনি। ইরফানও দু’দিন টুকটাক অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিল, এরপর মনে মনে ভেবেছিল শুদ্ধকে দিয়ে এসব হবেনা। এই বাঁদর কাজ আরও ঘেঁটে দিবে, সে যে নিজেই মেয়েটাকে বলবে, সে উপায়ও নেই। উপায় আছে, তবে সে কাউকে বুঝিয়ে বলবে, এই ধৈর্য তার নেই। দেখা যাবে সেই মেয়ে বোঝার চেয়ে তার হাতে থা’প্প’ড়-ই খেয়েছে বেশি। না দেখার আগ পর্যন্ত যতবার বুঝেছে ওই অপরিচিত মেয়ে তার বউ, ইরফান নেওয়াজের বউ অন্য একটা মেয়ে, ইরফানের ভীষণ রা’গ উঠে যেত। সেখানে সে কি করে মেয়েটাকে বোঝাবে?
এসব অশান্তির মাঝেই হঠাৎ সেই রেস্টুরেন্টে মাইরাকে দেখে ইরফান অবাক হয়। এই মেয়ে গ্রাম ছেড়ে তাদের শহরে কেন বুঝেনি। তারপর রেস্টুরেন্টে থেকে বাড়ি এসে যখন দেখল তার বউ অন্যকেউ নয়, বরং মাইরা। ইরফান স্তম্ভিত হয়।
মাইরার চঞ্চলতা দেখে ইরফান ধরেই নিয়েছিল এই মেয়েকে সে এই জীবনে মানতে পারবে না। রা’গে সব জ্ঞান হারিয়ে মাইরাকে ধুপধাপ মে’রেও দিতো।
ইরফানের মাথায় কিছু খেলে। মাইরা তো তাকে চিনে না। তাহলে তাকে অন্যকেউ ভেবে বিয়ে করে নিল কেন? হাহ! এইজন্যই বাচ্চাদের মন দিতে নেই। তার শিস শুনে ভালো লেগেছিল, আবেগে ছুটে আসতো। সময় মতো তাকেই আরেকজন ভেবে বিয়ে করে নিয়েছে। রা’গে মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে।
সব ভাবনা রেখে ইরফান সোজা গ্রামে যায় সেই ছেলের কাছে, যাকে মাইরার বিয়ের খবর দিতে বলেছিল। তার মাথায় বারবার এটাই খেলে, আজ তার জায়গায় অন্যকেউ হলে তার বার্ডফ্লাওয়ার কে অন্যকেউ ছুঁয়ে দিতো। মাথার মগজ বোধয় ভেতরে ফুটছে রা’গের চোটে।
মাইরাকে তো সে পরে দেখে নিবে। আগে এই বা’স্টার্ড কে গ্রামে পুঁতে রেখে আসবে।
মাইরার খোঁজ রাখা সেই ছেলেটি গ্রামের এক ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। ইরফান ছেলেটিকে দেখেই গাড়ি সাইড করে রেখে গটগট পায়ে এসে ছেলেটির কলার ধরে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– “কু’ত্তার বাচ্চা, আমারে খবর দিতে বলি নাই তোরে? ওর বিয়ে আর তুই আমারে খবর না দিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরিস? ম’রার পাখনা গজিয়েছে? এজন্য আমারে খবর দিস নাই?”
ইরফানের এমন আক্রমণে ছেলেটি হতভম্ব হয়ে যায়। ইরফানের কথার ধরনেও একটু অবাক হয়। সাথে ভয় ও পায়। সেদিন সে তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে মাইরার ব্যাপারে খোঁজ রাখেনি।
ইরফান হঠাৎ-ই ছেলেটিকে গাছের সাথে ধাক্কা দিয়ে ডান হাতে শক্ত করে গলা চেপে ধরে। ছেলেটি চোখ বড় বড় করে তাকায়। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। দু’হাতে ইরফানের হাত ধরে সরানোর চেষ্টা করে। ইরফান এক চুল ছাড়লো না। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
– আমার বার্ডফ্লাওয়ার কে অন্যকে ছোঁয়ার জন্য অ্যারেঞ্জ করেছিলি? এরপর আবার বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিস। এতো মিথ্যা স্বপ্ন দেখে বাঁচিস কিভাবে? তোকে তো টুকরো টুকরো করে কু’ত্তাকে দিয়ে খাওয়ালেও আমার জ্বালা মিটবে না।”
ছেলেটি বহু কষ্টে মিথ্যে বলে,
– ভাই ভাই, আমারে মাফ কইরা দ্যন। আমি আপনাকে ফোনে পাইনি।
ইরফান চিৎকার করে বলে,
– ফোনে পাস নি, আমার সামনে গিয়ে খবর দিবি। দিলি না ক্যান? এই বল?
ছেলেটি ভীত স্বরে বলে,
– ভাই আপনার টাকা আপনারে ফেরত দিয়া দিমু। আমারে ছাইড়া দেন।
ইরফান ছেলেটির গলা আরও শক্ত করে চেপে ধরে। ভস্ম করে দেয়া চোখে চেয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
– ওই টাকার সাথে তোরে বিষ মিশিয়ে খাওয়াবো বাস্টার্ড। কত বড় সাহস তোর! আমার কথা অমান্য করে বুক ফুলিয়ে চলিস।
গ্রামের কয়েকজন ছেলে এসে ইরফানকে এই অবস্থায় দেখে দৌড়ে আসে। ইরফানকে টেনে ছেলেটির থেকে সরিয়ে আনে। ইরফান জ্বলন্ত চোখে তাকায়। চিৎকার করে বলে,
– তোরাও আমার বার্ডফ্লাওয়ার কে বিয়ে দিচ্ছিলি? তোদের সবগুলোকে শূলে চড়াবো আমি। ওয়েট!
সবগুলো ছেলেই ইরফানের বয়সী, কেউ ইরফানের থেকে ছোট-ই হবে। ইরফানকে দেখে সবাই ভয়ই পেল। অপর পাশের ছেলেটি দুর্বল শরীর নিয়ে গাছের সাথেই হেলান দিয়ে বসে পড়ল। এদিকে একজন ছেলে এগিয়ে এসে ইরফানকে বলে,
– কে রে তুই? কোন বা’লের বার্ডফ্লা…..
আর শেষ করতে পারে না। ইরফান তেড়ে গিয়ে চিৎপটাং করে ফেলে দিয়ে দু’হাতের সর্বশক্তি দিয়ে গলা চেপে ধরে। সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। এবার ইরফানকে দেখে ভালোই ভয় পায় সকলেই। ইরফান জ্বলন্ত চোখে চেয়ে বলে,
– তুই আমার বার্ডফ্লাওয়ারের নাম মুখে নিচ্ছিলি? আমার বার্ডফ্লাওয়ারের নাম? এতো সাহস?
কথাটা বলে তৎক্ষনাৎ ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ছেলেটির নাকমুখ বরাবর তিনটে ঘুষি মারে। মন মতো হলো না বোধয়। রেগে বলে,
– তোর মুখ আগে ভাঙবো। ওয়েট।”
এরপর আশেপাশে কিছু খুঁজে একটা ইট পায়। বা হাতে ইট উঁচু করে ছেলেটির মুখে মারবে বলে।
ওদিকে শুদ্ধ এক কাজে গ্রামে এসেছিল, এক ঘণ্টার জন্য। আবার শহরে ফিরবে। রাস্তায় একজন তাকে বলে তার মামাতো ভাই না-কি কাকে মারছে। খুঁজতে খুঁজতে এসে দেখে ইরফানের সত্যি সত্যি একটি ছেলেকে মা’রা’র জন্য সব প্রিপারেশন নেয়া শেষ। শুদ্ধ দৌড়ে এসে ইরফানের হাত থেকে বড় ইট টা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে।
ইরফান রে’গে তাকায় শুদ্ধর দিকে। শুদ্ধ টেনে তুলল ইরফানকে। মাটিতে শুয়ে থাকা ছেলেটির নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। শুদ্ধ ইরফানকে সাপ্টে ধরে বাকি ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলে,
– একে নিয়ে যাও।
ইরফান কথাটা শুনে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
– তুই ওকে বাঁচিয়ে দিচ্ছিস কেন? ও বাজে কথা বলছিল আমার…
ইরফান থেমে যায়। শুদ্ধ কে ধাক্কা মেরে নিজের থেকে সরিয়ে দেয়। ছেলেগুলো এখান থেকে ততক্ষণে চলে গিয়েছে। ইরফান গটগট পায়ে তার গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। যাওয়ার আগে ইটের বড় টুকরোয় ফুটবলের মতো সট দেয়। ইট টি শুদ্ধর পায়ের কাছে আসলে শুদ্ধ লাফ দিয়ে দু’হাত সরে দাঁড়ায়। ইরফান শুদ্ধর দিকে চেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– One day, তোকে বেঁধে রেখে, তোর বউয়ের পিছে কু’ত্তা লেলিয়ে দিব আমি। যাস্ট ওয়েট।
ইরফান কথাটা বলে জায়গাটি প্রস্থান করে।
শুদ্ধ তব্দা খেয়ে ইরফানের দিকে তাকিয়ে রইল। এখানে তার বউ কোথা থেকে আসলো? লে হালুয়া!
একে তো মাইরা বাচ্চা, তার উপর মাইরার চাঞ্চল্যের কারণে ইরফান সত্যিই নিজের রা’গ কন্ট্রোল করতে পারে না। এর সাথে আরেকটা রা’গ অ্যাড হয়েছে,
সে একদিন খোঁজ নেয়নি, আর এই মেয়ে বিয়ের পিড়িতে বসে গিয়েছে। এটা যেন তার মগজে আগুন ধরিয়ে দেয়।
সে তো বিয়ে করে ঠিকই ডিভোর্স দিতো অন্যকেউ হলে, কিন্তু এই স্টুপিট কে অন্যকেউ বিয়ে করলে তার বার্ডফ্লাওয়ার কে অন্যকেউ ছুঁয়ে দিতো। ভাবতেই মাথায় র’ক্ত উঠে যায়।
সবমিলিয়ে ধুপধাপ মাইরাকে মেরে দেয়। এরপর রা’গ টা একটু কমলে যেই ভাবে আর মারবে না, অমনি মাইরা এসে তার মাথা আবারও বিগড়ে দেয়। এতো এতো মেরে নিজেকে ভীষণ অসহায় এক প্রাণী মনে হয় ইরফানের।
পূর্বের কিছু স্মৃতি নাড়াচাড়া করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইরফান।
দিনের আলো নিভে রাতের অন্ধকার নেমেছে ধরণীতে। ইরফান বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া শূণ্য উড়ায়। দৃষ্টি রাতের কালো আঁধারে।
হঠাৎ-ই ঘরের ভেতর থেকে মাইরার কাশির শব্দ পেয়ে দ্রুত সিগারেট ঠোঁটের ফাঁক থেকে সরিয়ে ডান হাতের মুঠোয় নিয়ে চেপে ধরে। বেলকনির কোণায় ছোট টেবিলের ড্রয়ার থেকে চুইনগাম নিয়ে মুখে দেয়।
আরেকটি ড্রয়ার থেকে রুম স্প্রে বের করে চারপাশে স্প্রে করে দেয়। তখনই মাইরা বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। সে বুঝেছে ইরফান সিগারেট খাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ-ই স্ট্রবেরি ফ্লেবার পেয়ে বেলকনিতে এসেছে। বাইরের লাইটের আলো একটু একটু বেলকনিতে এসে পড়ায় মাইরা ইরফানকে কিছুটা অস্পষ্ট দেখতে পায়। এগিয়ে এসে কোমড়ে হাত দিয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে বলে,
“আপনার সিগারেট এমন স্ট্রবেরি হয়ে গেল কিভাবে?”
মাইরার কথা শুনে ইরফান ঘাড় বাঁকিয়ে মাইরার দিকে তাকায়। হাতের রুম স্প্রে টি টেবিলের উপর রেখে মাইরাকে টেনে বেলকনির রেলিংয়ের সাথে ঠেকিয়ে ইরফান মাইরাকে ঘেষে দাঁড়ায়। মাইরা মাথা উঁচু করে পিটপিট করে তাকায় ইরফানের দিকে। অন্ধকারে খুবই ঝাপসা লাগলো ইরফানকে।
ইরফান তার দু’হাত তুলে মাইরার দু’গালে রাখে। একদম প্রথম দিকে কত থা’প্প’ড় মারতো তার বার্ডফ্লাওয়ার কে। কথাটা ভেবেই চোখেমুখে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে। মনে প্রশ্ন জাগে, সেই দাগগুলো কি এখনো আছে?
অন্ধকারেই মাইরার গালে চোখ বুলায় ইরফান। উত্তর আসে, নাহ নেই। ইরফান মাইরার দিকে চেয়ে আবেগী স্বরে বলে,
❝ তীব্র আঘাতে সৃষ্ট দৃশ্যমান ক্ষত, সময়ের প্রবাহে একদিন মিলিয়ে যায়…
কিন্তু অবয়বহীন ভালোবাসা, অদৃশ্য হয়েও চিরকাল অম্লান থেকে যায়। ❞
মাইরার চোখেমুখে বিস্ময়। একটু নয়, কল্পনার চেয়েও বেশি। ইরফানের মুখ থেকে এমন কাব্যিক শব্দ শুনে মেয়েটা বড়সড় ঝটকা খায়।
ইরফান আবারও ছোট করে বলে,
– স্যরি!
মাইরা আরও খানিকটা অবাক হয়ে তাকায়। বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– স্যরি বলছেন কেন?
ইরফান ঝাপসা কৌতূহলী মাইরাকে তীক্ষ্ণ চোখে পরোখ করে। প্রথমে মেয়েটাকে সে টলারেট করতে পারতো না। দেখলেই রা’গ হতো।
তবে ধীরে ধীরে তার সবচেয়ে অপছন্দের এক বাঁচাল আর চঞ্চল মেয়েকে সে কীভাবে যেন টলারেট করতে শিখে গিয়েছে। কিভাবে? ইরফান জানে না। শুধু জানে এই মেয়েটা তার ভীষণ অপছন্দের। যার প্রতিটি কাজে সে চরম বিরক্ত হয়, রা’গ হয়। আর তারপর….
কিছু ভেবে সূক্ষ্ম হাসে ইরফান। মৃদুস্বরে বলে,
– You are a magical girl.
[তুমি একজন জাদুকরী মেয়ে]
কথাটা বলে দু’হাতে মাইরাকে বেলকনির রেলিংয়ের উপর বসিয়ে দেয়। মাইরা ভ’য়ে মৃদু চেঁচিয়ে ওঠে,
– আল্লাহ! পড়ে যাব আমি। নামান আমায়।
বলতে বলতে দু’হাতে ইরফানের গলা জড়িয়ে ধরে। ইরফান তার বা হাতে মাইরার কোমড় শক্ত করে জড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
– পড়ে যাও। তোমাকে ফেলতেই এখানে তুলেছি।
মাইরা ইরফানের গলায় মুখ ঠেকিয়ে চোখ খিঁচে রাখে। আরও শক্ত করে ইরফানের গলা জড়িয়ে ধরে। থেমে থেমে ভীত কণ্ঠে বলে,
– এখান থেকে আমি পড়ে গেলে মরে যাব। প্লিজ নামান আমায়।
ইরফান মাইরার চুলের ভাঁজে মুখ রেখে বিড়বিড় করে,
– স্টুপিট গার্ল। নিজের হার্ট কে কেউ মে’রে ফেলতে চায়?
মাইরা ভ’য় পায়। ইরফানের উপর রা’গ হয়। রেগেমেগে ইরফানের গলায় কা’ম’ড় দেয় একটা। ইরফানের চোখেমুখে কিছুটা বিস্ময়। তবে মাইরাকে কিছু বললো না, মাইরাকে ছাড়লোও না। আরেকটু শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল তার বার্ডফ্লাওয়ারকে। একটু নিচু হয়ে মাইরার গলায় মুখ গুঁজে নাক ঘষে। এরপর ছোট করে একটা চুমু আঁকে।
মাইরা ইরফানকে একটা কা’ম’ড় দিয়ে আরও ভ’য়ে আছে। তাকে এই লোক এখন কি করবে?
ইরফান হঠাৎ-ই তার ডান হাতে মাইরার কাঁধ বরাবর মোটামুটি জোরে এক ধাক্কা দেয়। মাইরা ছিটকে পিছন দিকে হেলে পড়ে। মাইরা ভ’য়ে চিৎকার করে ডেকে ওঠে,
– শিসওয়ালাআআআআআ?
বলে মাইরা প্রায় কেঁদে দেয়। ইরফান দু’হাতে শক্ত করে মাইরার কোমড় চেপে ধরে আছে। মাইরার মাথা থেকে কোমড় পর্যন্ত রেলিঙের বাইরে হেলে আছে। মাইরা ভ’য় পেলেও একটু পরেই কান্না থামায়, খেয়াল করে সে পড়ে যায়নি। ইরফান তাকে ধরে রেখেছে। নিজে নিজে শক্তি খাঁটিয়ে উঠতে চাইলেও পারলো না। মাইরার মনে হলো সে হাওয়ায় ভাসছে। তবে ধীরে ধীরে তার ভ’য় কমলো। ভেজা চোখে ইরফানের দিকে তাকালো। অস্পষ্ট দেখল ইরফানকে।
ইরফান মাইরার দিকে চেয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছে। মাইরা ইরফানকে সম্পূর্ণ দেখতে না পেলেও আঁচ করতে পারলো, তার শিসওয়ালা হাসছে। ভেজা চোখে চেয়ে অভিমানী কণ্ঠে বিড়বিড় করে,
– নিষ্ঠুর শিসওয়ালা।
ইরফান মাইরার কথাটা বোধয় শুনলো। তবে ঠোঁটের কোণ থেকে হাসি মুছে গেল না। বরং দীর্ঘ হলো খানিক।
মাইরার চোখে চোখ রেখে হঠাৎ-ই সুরেলা কণ্ঠে গেয়ে ওঠে,
প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৫৯
আমি হবো রাত আর…
তুই হবি চাঁদ
জোছনায় এ ঘর আমাদের
তুই হলে রোদ আমি
রংধনু হই
হবে এ শহর আমাদের.!!
তুই হবি ঢেউ আর..
আমি হবো জল
বানাবো সাগর আমাদের.!!
আমি হবো দোল আর..
পূর্ণিমা তুই
রাঙাবো শহর আমাদের.!!