প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৭৪
Drm Shohag
পাশ থেকে শুদ্ধ কপাল চাপড়ে বলে,
– ভাই রে, তুই জানিস না বলে ছাড়াছাড়ির উদাহরণ দিয়েছি। আসল কথা হলো, তুই বিয়ে করে কাবিনে বসানো টাকা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত টাইম নিয়ে তোর বউকে দিতে পারবি। কিন্তু ছাড়াছাড়ি হলে সেই সময়-ই সব টাকা পরিশোধ করতে হয়।
ইরফান রে’গে বলে,
– আবার তুই-ও ছাড়াছাড়ির কথা বলছিস?
শুদ্ধ মেকি হেসে বলে,
– আরে এটা তোকে বোঝালাম। কিছুই তো জানিস না। সারাদিন ব্যবসা করে করে এই হাল। অসামাজিক শা’লা।
ইরফান ভাবলেশহীনভাবে বলে,
– বিজনেস তো তুই-ও স্টার্ট করেছিস!
শুদ্ধ চোখ বড় বড় করে তাকালো। গালে হাত দিয়ে আফসোসের সুরে বলে,
– সিসিটিভির উপর একটা পাতলা কাপড় দিলেও তো সিসিটিভি আর কিছু দেখতে পায় না। আর তোর উপর পুরো দেয়াল তুলে দিলেও সব কেমনে জানিস ভাই?
ইরফান ঠোঁট বাঁকালো একটু। শুদ্ধ হতাশ! লুকিয়ে লুকিয়ে কিচ্ছু করা হবে না তার। ভাগ্যিস তার বা’স’র টা এই সিসিটিভি দেখতে পায়নি। এটাই মনে হয়, বাকি আছে। এসব ভাবনা রেখে বলে,
– মোহরানা-র কথা শুনেছিস?
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– আই নো, বউকে মোহরানা পরিশোধ করতে হয়।
শুদ্ধ হেসে বলে,
– ওটাই কাবিন। নে, এবার বল তুই মাইরাকে কি দিবি?
ইরফান শুদ্ধর দিকে চেয়ে বলে,
– ও তো তোর কপি ভার্সন বাঁদর।
শুদ্ধ থতমত খেয়ে তাকায়। এই বেদ্দপ টা তাকে অপমান করছে। ইরফান, শুদ্ধ কথাগুলো মোটমুটি আস্তে বলার কারণে কেউ সেভাবে শুনতে পায়নি। শুদ্ধ রে’গে বলে,
– এই বেদ্দপ কথায় কথায় আমাকে অপমান করবি না তো। তোর বউ বাঁদর, সেটা আমার দোষ?
ইরফান এই ব্যাপারে আর কিছু বললো না। বিড়বিড় করে বলে,
– আমি তো ওকে প্রায় সব-ই দিয়ে দিয়েছি।
শুদ্ধ চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– কি বলছিস?
ইরফান কিছু বললো না। তারেক নেওয়াজ নিজেই কাজি সাহেব কে বলে,
– ১৫ লাখ লিখুন।
ইরফান সাথে সাথে গম্ভীর গলায় বলে,
– প্লাস ইরফান নেওয়াজ।
কাজি সাহেব তারেক নেওয়াজ এর কথায় লিখতে গিয়েও থেমে যায় ইরফানের কথা শুনে। সে ঠিক বুঝতে পারলো না। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করতেও তার মন সায় দেয় না। এই ছেলেকে তার সুবিধার লাগছে না।
শুদ্ধ ইরফানকে গুতিয়ে বলে,
– তোর নাম লিখতে বললি কেন?
ইরফান শুদ্ধর দিকে চেয়ে বলে,
– কজ ও তোর মতো বাঁদরামি করে যদি আমাকে ছাড়তে চায়, দ্যান আমি শর্ত অনুযায়ী আবারও আমাকে দিয়ে দিব ওকে।
শুদ্ধ অদ্ভুদভাবে তাকায় ইরফানের দিকে। মানে এর মাথায় এতো আজগুবি চিন্তা আসে কোথা থেকে?
ইরফানের সব ঠিকঠাক করে কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানোর জন্য কথা বলতে নিলে শুদ্ধ পাশ থেকে বলে,
– ওহে চাচা! আপনি এসব ভুলভাল পদক্ষেপ কেন নিচ্ছেন?
কাজি সাহেব থতমত খেয়ে তাকায়৷ সে যে কাদের বিয়ে পড়াতে এসেছে এটা ভেবেই হাজারো আফসোস হচ্ছে। শুদ্ধ হেসে বলে,
– আমি থাকতে অন্যকারো বিয়ে আগে পড়াবেন, এসব হয় না-কি! এরকম করলে তো আপনি খাবার পাবেন না চাচা। বিয়েতে এসে না খেয়ে গেলে আপনার অপমান হয়ে যাবে। আমি আবার বেশ উদার মনের মানুষ, কাউকে অপমান করতে পারিনা।
নিন নিন আমার বিয়ে আগে পড়ান।
মামা তুমি থাকতে তোমার ছেলে শুদ্ধকে রেখে কুড়িয়ে পাওয়া ইরফানের বিয়ে আগে পড়াচ্ছে, এসব তুমি কি করে মেনে নিচ্ছিলে? আমি পুরাই হতাশ!
শুদ্ধর কথায় সবাই হাসলো। এ কেমন তা তো সবাই জানে। তারেক নেওয়াজ নিজেও হাসলো। ব’জ্জা’ত ছেলেটা তাকে কিসব কথা বলে,, এখন তার মনে হচ্ছে তাকে শুদ্ধর থেকে ট্রেনিং নিতে হবে,, নয়তো ইরফানের সাথে টিকবে কি করে?
ইরফান বিরক্ত চোখে শুদ্ধর দিকে তাকালো, তবে কিছু বললো না।
কাজি সাহেব অদ্ভুদভাবে তাকালো শুদ্ধর দিকে। এদের দুই ভাইয়ের থেকে এমন অদ্ভুদ আচরণ পেয়ে তার মনে হচ্ছে, সে ভুল করে ভিনগ্রহে এসে পড়েছে, না-কি এরাই ভিনগ্রহ থেকে পালিয়ে এসেছে?
ইরফানের দেয়া মোহরানা-র সমপরিমাণ টাকা শুদ্ধর কাবিনেও দেয়া হয়। শুদ্ধর বিয়ে পড়ানো শেষে সে দ্রুত বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলে,
– আমি কি এখন আমার বউ কে দেখতে পারি বাবা?
ফারাহ’র বাবা থতমত খেয়ে তাকায় শুদ্ধর দিকে। নাছিম এগিয়ে এসে শুদ্ধকে টেনে নিয়ে যায়। ফাইজ-ও এগিয়ে গিয়ে শুদ্ধর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
– তোর কি কোনোদিন ল’জ্জা হবে না? আমার বাবা তোর শ্বশুর বুঝতে পারছিস?
শুদ্ধ বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– শ্বশুরের কাছেই তো তার মেয়েকে চেয়েছি। তোর মতো ব্রিটিশ শা’লার কাছে তো আর চাইনি। তোর বাচ্চাকে আমি চার আনার-ও চকলেট কিনে দিব না দেখিস।
ফাইজ বিরক্ত চোখে চেয়ে রইল শুদ্ধর দিকে। এটা বিয়ের দিন-ও ঠিক হলো না। আল্লাহ যে একে কোন পিছলা মাটি দিয়ে বানাইছে তা একমাত্র আল্লাহ-ই ভালো জানে।
নাছিম মলিন মুখে ইরফানের দিকে চেয়ে আছে। কাজি সাহেব বেশ কিছু বললেন এতোক্ষণ। এরপর ইরফানকে কবুল বলতে বলে। নাছিম ঢোক গিলল। তার কষ্ট কেন হচ্ছে? ইরফান আর বার্বি ডলের বিয়ে তো অনেক আগেই হয়েছে। তারা কত সুন্দর কাপল! শুধু তার মানতে কষ্ট হয়।
ভাবনার মাঝেই ইরফানের বলা কবুল শব্দ টুকু কানের পর্দায় এসে বিষের বাণের ন্যায় ধাক্কা খায়। নাছিম চোখ বুজে নিল। ঢোক গিলল বহুকষ্টে। এরপর কোনোদিকে না তাকিয়ে সাইড কেটে দ্রুতপায়ে জায়গাটি প্রস্থান করে।
ইরফান ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তাকিয়ে দেখল নাছিমের প্রস্থান। নাছিমের হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। কারণ ওই মন দিয়ে ও তার বার্ডফ্লাওয়ার কে নিয়ে ভাবে, যেটা ইরফানের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
ইরফান, শুদ্ধর বিয়ে পড়ানোর পর কাজি সাহেব ফারাহ আর মাইরার কাছে এসেছে রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করাতে।
মাইরার পাশে মাইরার মা বসেছে। ফারাহ’র পাশে ফারাহ’র বাবা।
আশেপাশে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফারাহ’কে রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার জন্য পেপার এগিয়ে দিলে ফারাহ কাঁপা হাতে কলম আর পেপার নেয়। তার হাত কাঁপছে। চোখজোড়া ঝাপসা হয়েছে। এইতো এইখানে সাইন করে দিলে সে আর বাবার বাড়ি থাকতে পারবে না। কথাগুলো ভেবে দলা পাকিয়ে কান্না বেরিয়ে আসতে চায়, ওভাবেই কাঁপা হাতে পেপারে সাইন করে দিল,, চোখ থেকে টুপ করে দু’পা পানি গড়িয়ে পড়ে। পাশ ফিরে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে, নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দেয়। ফারাহ’র বাবা মেয়েকে আগলে নেয়,, তার চোখজোড়া কখন যে ঝাপসা হয়, বুঝে পায় না ভদ্রলোক। এই মেয়েটি সারাবাড়ি যে ঘুরঘুর করতো, প্রতিদিন কোনো না কোনো আবদার করতো, এখন এসব আর কে করবে?
এখানে উপস্থিত সকলে বাবা মেয়ের আবেগমাখা মুহূর্তে নিজেরাও ভীষণ আবেগী হয়ে পড়ে। মাইরা মলিন মুখে পাশ ফিরে তাকিয়ে আছে। বাবা মেয়ের সম্পর্ক বুঝি এমন হয়? এতো মিষ্টি হয়?
সে তো জানে না। জন্মের পর কাউকে যে বাবা বলে ডাকবে সেইটুকু-ও পায়নি। বুদ্ধি হওয়ার আগে হয়তো ডেকেছিল লাবিবের বাবাকে। ভুল ভাঙলে আর ডাকেনি তো। বাবা মেয়ের সম্পর্ক কেমন হয়, সেটুকু অনুভব করার সৌভাগ্য টুকু-ও তার হয়নি। মৃত বাবার কথা মনে পড়লো। স্বামী হিসেবে খুব খারাপ হলেও বাবা হিসেবে হয়তো তাকে এভাবেই আদর করতো! ইশ! তার কপালে বাবার একটুখানি ভালোবাসা যদি আল্লাহ দিত! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখজোড়া ঝাপসা হয়েছে, মেয়েটি বুঝতেই পারেনি। তারেক নেওয়াজ মাইরাকে লক্ষ্য করে বলে,
– মনে হচ্ছে আমার মাইরা আম্মু আমাকে ভুলে গিয়েছে।
মাইরা তারেক নেওয়াজ এর কথাটা শুনে দ্রুত ঝাপসা চোখজোড়া মুছে সামনে তাকায়। বসা থেকে দাঁড়িয়ে তারেক নেওয়াজের সামনে এসে হেসে বলে,
– একদম ভুলে যায়নি বাবা, আপনি মিথ্যা বলছেন।
তারেক নেওয়াজ আফসোসের সুরে বলেন,
– তবে বাবার জন্য আক্ষেপ করছিলে কেন? এই যে তোমার জলজ্যান্ত বাবা তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ তুমি আমাকে ভুলে গেলে।
মাইরার কি যে হলো কে জানে। হুট করেই তারেক নেওয়াজ কে জড়িয়ে ধরে। তারেক নেওয়াজ মৃদু হেসে মাইরার মাথায় হাত রেখে বলে,
– এবার মনে হচ্ছে মেয়ে আমাকে পুরোপুরি-ই মনে রেখেছে।
মাইরা হসলো। চোখের কোণ ঘেঁষে পানি গড়িয়ে পড়ে। তার এতো ভালো একটা বাবা থাকতে সে কেন আফসোস করছিল!
মাইরার মা সহ সকলে অপলক চেয়ে রইল শ্বশুর বউমার দিকে। বাইরের কেউ দেখে বিশ্বাস-ই করবেনা, মাইরা তারেক নেওয়াজ এর নিজের মেয়ে নয়।
মাইরা মা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তিনি জানতেন, তার প্রাক্তন স্বামীর বন্ধু তার মেয়েটাকে খুব আদরে রাখবেন, সে মা হয়ে বাবার আদর মেয়েকে এনে দিতে পারেননি, এসব তারেক নেওয়াজ তার মেয়েকে এনে দিবেন। দিয়েছেও তো। তার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। তার মেয়ে এখন সুখী। তার জীবনের অনেক বড় একটি পাওয়া পূরণ করে দিয়েছে আল্লাহ! তার মেয়ের সুখ। এর জন্য কত রাত তিনি কেঁদে ভাসিয়েছেন। অবশেষে আল্লাহ তাকিয়েছেন তার মেয়ের দিকে।
তারেক নেওয়াজ মাইরার হাত ধরে মাইরাকে তার জায়গায় বসিয়ে দেয়, তিনি নিজেই মাইরার পাশে বসে কাজির উদ্দেশ্য বলে,
– আমার মেয়ের রেজিট্রি পেপার দিন।
মাইরার বারবার চোখজোড়া ঝাপসা হয়। কিছুক্ষণ আগে তার বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য আফসোসে চোখ ভিজেছিল। আর এখন সে এরকম একজন বাবা পেয়ে যাওয়ায় আবেগে চোখ ভেজাচ্ছে।
মাইরা রেজিট্রি পেপারে সাইন করতে গেলে তার প্রথম বার বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ল। কতই না কেঁদেছিল বিয়ে করবে না বলে, মায়ের আঁচল থেকে বেরোতে ইচ্ছে করতো না! যদিও তার বাড়িতে দিনগুলো ভীষণ কষ্টে পেরোতো,, কিন্তু সেখানে কত যে মায়ের ভালোবাসা ছিল! এখনো আছে তা মাইরা ভুলবে কি করে? ঝাপসা চোখে একবার মায়ের দিকে তাকালে দেখল তার মা ঝাপসা চোখজোড়া তার উপর থেকে দ্রুত সরিয়ে নিল। মাইরা মলিন হেসে রেজিট্রি পেপারে সাইন করে দেয়।
বিয়ের সব কাজ শেষে ইরফান, মাইরা,, শুদ্ধ, ফারাহ সহ সবার কাজিন একটি বড় টেবিল বুক করে বসেছে। মাইরা যদিও দুপুরে খেয়েছে, কিন্তু এখন না-কি বর বউ একসাথে খেতে হয়। মাইরা অল্প একটু খাবে বলে ঠিক করেছে। ইরফান ঘাড় বাঁকিয়ে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। মাইরা সবাইকে দেখছিল, ইরফানের দিকে চোখ পড়লে দু’জনের চোখাচোখি হয়। মাইরা এগিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
– কিছু বলবেন?
ইরফান ছোট করে বলে,
– হুম।
মাইরা ভাবুক ভঙ্গিতে বলে,
– কি?
ইরফান সাথে সাথে বলে,
– তোমাকে খেতে চাই।
মাইরা কেশে ওঠে। কি অ’স’ভ্য লোক! সবাই আছে, তবুও উল্টাপাল্টা বলছে। শুদ্ধ উল্টোপাশ থেকে চেয়ারে গা এলিয়ে বলে,
– সবাই আমাকে বলো তো, ল’জ্জা ভাঙার ঔষধ আছে না-কি!
মাইরা বলে ওঠে,
– না তো ভাইয়া। এই ঔষধ নেই।
ইরফান হঠাৎ-ই বলে ওঠে,
– আছে।
মাইরা চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– মিথ্যা বলছেন কেন? আমরা সবাই জানি, নেই।
সকলে মুখ টিপে হাসছে। মাইরা বুঝতে পারেনি। শুদ্ধ পিছন দিয়ে হাত দিয়ে ফারাহকে তার দিকে টেনে এনে ইরফানের দিকে চেয়ে বলে,
– ঔষধের নাম বলে দে তো ভাই।
ফারাহ জমে গিয়ে বসে আছে। শুদ্ধর হাত তার কোমর থেকে সরাতে চাইলে শুদ্ধ আরও শক্ত করে ধরল। ফারাহ ঢোক গিলে।
মাইরা ইরফান হাত ঝাঁকিয়ে বলছে,
– ঔষধের নাম বলছেন না কেন? বলুন দেখি, নিশ্চয়ই আপনিই ওই ভুলভাল ঔষধ আবিষ্কার করেছেন।
ইরফান কিছু বলল না। খাওয়ায় মনোযোগ দিল। মাইরা মুখ বাঁকিয়ে নিজেও খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল। কিন্তু কথা হলো, মাইরার গরুর মাংস একদম পছন্দ নয়। তবুও আজ খাচ্ছে। একটু খেতে গিয়ে তার মনে হলো, এই মাংস সিদ্ধ হয়নি। একটা মাংস নিয়ে সেই কখন থেকে গুতাচ্ছে, মেজাজ খারাপ হলো।
রা’গে একটি গ্লাস নিয়ে প্লেটের মধ্যে হাত ধুয়ে নিল। এমনিতেই তার সেরকম ক্ষুধা লাগেনি। কিন্তু এতো খাবার দেখে একটু একটু ক্ষুধা লেগেছিল।
ইরফান তার পাতের সব মাংস টুকরো করেছে, মাইরাকে দিবে বলে। তার আগেই মাইরার এমন কাজ দেখে মাইরাকে ধমকে বলে,
– স্টুপিট, কি করলে এটা?
মাইরা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। মিনমিন করে বলে,
– আমার ক্ষিদে নেই।
ইরফান কিছু বললো না। পোলাও এর সাথে টুকরো করা মাংস নিয়ে মাইরার মুখের সামনে ধরে। মাইরা অবাক হয় ইরফানের কান্ডে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সবার দিকে তাকালে দেখল সবাই মিটমিট করে হাসছে। মাইরা মিনমিন করে বলে,
– আমি খাবো না।
ইরফান ভাবলেশহীনভাবে বলে,
– কোলে বসে খাবে? ওকে।
মাইরা দ্রুত দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
– না না। এখানে বসেই খাবো।
কথাটা বলে হা করলে ইরফান মাইরার মুখে পোলাও তুলে দেয়।
মিথিলা হেসে বলে,
– ভাবি তুমি নিশ্চিন্তে খাও। আমরা চোখের উপর হাত দিচ্ছি। হবে না?
মাইরা মুখের খাবার চিবোতে চিবোতে মাথা নিচু করে নেয়। সবাই শুধু তার সাথে মজা নেয়।
শুদ্ধ মাথা নিচু করে খেতে খেতে বলে,
– একটা ল’জ্জা’শীল বউ পেয়েছি। এবার একটা ল’জ্জা’হীন বউ লাগবে। রাতুল এরকম একটা মেয়ে দেখো তো।
ফারাহ রে’গে তাকায় শুদ্ধর দিকে। শুদ্ধ ঘাড় বাঁকিয়ে ফারাহ’র দিকে চেয়ে হেসে বলে,
– নো টেনশন বউ। তোমার মতামতের ১০০% গুরুত্ব দেয়া হবে।
শুদ্ধর কথা শুনে সবাই হাসছে। মাইরা হেসে বলে,
– আরে ফারাহ আপু, এতো চিন্তা করনা। তুমি একটা ল’জ্জা’হীন বর পেয়েছ, আমি তোমাকে একটা ল’জ্জা’শীল বর এনে দিব।
মাইরার কথা শুনে শুদ্ধ চোখ বড় বড় করে তাকায়। হায় হায় তার মেলায় হারিয়ে যাওয়া বোনটা তার বিরুদ্ধে কথা বলছে!
মাইরার কথা শুনে ফারাহ সহ সকলে শব্দ করে হেসে ফেলল। ইরফান নিজেও একটু ঠোঁট বাঁকালো।
ফাইজ হেসে বলে,
– মাইরা তুমি একদম পার্ফেক্ট।
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– প্রশংসা করার জন্য আমার বোনকে দিয়েছি।
ইনায়া তার ভাইয়ের কথায় হাসলো। বিয়ের প্রথম প্রথম সে কত চিন্তা করত মাইরাকে নিয়ে। সময়ের সাথে সাথে সব কেমন পাল্টে গিয়েছে।
ফাইজ খেতে খেতে ইনায়ার দিকে চেয়ে বলে,
– তোমার ননদ এতো খারাপ কেন লিটল কুইন?
ফাইজের কথা শুনে সবাই আবারও হাসলো। মাইরা বোকাচোখে সবাইকে দেখল। এই লোকটার জন্য তাকে নিয়ে সবাই হাসে।
মাইরা ইরফানের হাতে খেতে খেতে প্রায় অনেকগুলো খাবার খেয়ে নিয়েছে। এরপর পানি খেয়ে দেখে আর দাঁড়াতেই পারছে না ঠিক করে। সে যাক, স্বামীর হাতে খেতে মজাই লাগে।
সন্ধ্যার পর পর রিসপশন থেকে সবাই ফিরেছে। শুদ্ধ গিয়েছে ফারাহ’দের বাসায়। ফারাহদের কাজিন সহ শুদ্ধর ছেলে কাজিনরা সবাই এসেছে। শুদ্ধ এখান থেকে ফারাহ’কে নিয়ে তাদের গ্রামে যাবে। তৃণা বেগম গ্রামে ছেলে-বউমার অপেক্ষায়।
ইরফান আর মাইরা সহ ইরফানের মেয়ে কাজিনেরা এসেছে ইরফানদের বাসায়।
মাইরা একটি ঘরে বসে আছে। তার কোলে লাবিব, আশেপাশে ইরফানের অনেক কাজিন। মাইরা এদের সবাইকে এর আগে দেখেনি। ইনায়ার বিয়েতে এরা আসেনি। অনেক দূরসম্পর্কের সবাই এসেছে। ইরফানের কত কত ফুপি, খালা, মামি এসেছে। মাইরাকে কতজন যে এসে চুমু খেয়েছে। মাইরার মনে হচ্ছে সে মাত্র পৃথিবীতে জন্মেছে, তাই ইরফানের সব ফুপু, খালা এসে তাকে চুমু খাচ্ছে। তবে মাইরার ভালো-ও লেগেছে। এতো আদর তার এই জীবনে সে পায়নি। সে বুঝেছে সবাই ইরফানকে খুব ভালোবাসে, তার বউ হিসেবে মাইরার এতো আদর।
লাবিব মাইরার গালে হাত দিয়ে বলে,
– আপুই সবাই তোমাকে তুমু কায় কিনু?
মাইরা লাবিবের গালে চুমু দিয়ে বলে,
– তুই যেমন আমার কাছে বাচ্চা সোনা ভাইয়া, তাই তোকে আদর করি। তেমন তারাও আমাকে আদর করছে।
লাবিব বিড়বিড় করল,
– বুউকে আদল কলতে হয়।
মাইরা গালে হাত দেয়। তার স্বামী তার ভাইটার মাথা খেয়ে ফেলেছে পুরো। সারাদিন শুধু বউ বউ করবে।
শুদ্ধর সাথে তার কাকা, ফুপি আছে। সাথে সব ছেলে কাজিন আর তার বাবার দিকের সকল কাজিন। শুদ্ধ এতোক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফারাহ’দের বাড়িতে ছিল। এতো এতো মানুষ জামাই আদর করতে এসে তাকে যে ফুটবল ভেবে সট দেয়নি, এজন্য শুদ্ধ স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। বিয়ে করলে বউ এর সাথে সাথে আরও অনেক প্যারা রে! ইশ! জীবনটা পুরো তেজপাতা!
আপাতত সে ফারাহ’র পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মানে এখন তারা বেরবে, কিন্তু ফারাহ কেঁদেকেটে অস্থির। শুদ্ধর অসহায় লাগে। ফাইজের কথা মনে পড়ে গেল। সে তো ইনায়ার সময় মজা করেছিল। এখন বউয়ের এতো কান্না দেখে তার বুক টা ভারী লাগছে।
ফারাহ তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে ছাড়ে না। মেয়েরা বাবার কাছে ভীষণ আদুরে হয় শুনেছে। এই কথাটা ফারাহ’র মাঝে একদম ১০০%-ই আছে। ফারাহ’র বাবার চোখ ভেজে। মেয়েটাকে ছাড়া কিভাবে থাকবেন তিনি? সে যতক্ষণ বাড়ি থাকে, ফারাহ সবসময় তার পাশেই থাকে। কিন্তু মেয়েদের বাড়ি যে এটা ক্ষণস্থায়ী! এটাই মেনে নিতে হবে।
ফারাহ’র বাবা ফারাহ’র মাথায় চুমু এঁকে শুদ্ধর হাতে ফারাহ’র হাত রেখে ভেজা গলায় বলে,
– ফারাহ আমার খুব আদরের মেয়ে বুঝলে বাবা? ওকে কখনো কষ্ট দিও না।
শুদ্ধ এদের বাবা মেয়ের কাণ্ড দেখে ভীষণ ইমোশনাল হয়ে গিয়েছে। মাথা নেড়ে বলে,
– জ্বি বাবা, অবশ্যই। আমার পাখ্…..
আর বলল না। থাক, শ্বশুর মানুষ। মুখে ব্রেক না লাগালে ব্যাপারটা কেমন যেন লাগে।
ফারাহ তার মা সহ আরও সবার থেকে বিদায় নিয়ে শুদ্ধর হাত ধরে এগিয়ে যায়। শুদ্ধ আস্তে করে বলে,
– ভালোবাসি পাখি।
ফারাহ নাক টানলো। গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালে ফাইজ,, শুদ্ধ আর ফারাহ’র পিছে দাঁড়িয়ে বলে,
– ফারাহ সাবধানে যাবি।
ভাইয়ের কথায় ফারাহ পিছু ফিরে ফাইজকে জড়িয়ে ধরল। ফাইজকে বোনকে আগলে নিয়ে শুদ্ধর দিকে চেয়ে বলে,
– আমার বোনকে একদম কাঁদাবিনা বলে দিলাম।
শুদ্ধ ভাবলেশহীনভাবে বলে,
– আমি তো ওকে কাঁদানোর জন্যই নিয়ে যাচ্ছি।
ফাইজ বিরক্ত চোখে তাকায়। আঙুল উঁচিয়ে বলে,
– আমি কিন্তু আমার বোনকে দিব না।
শুদ্ধ ফারাহকে টেনে নিয়ে বিরক্ত হয়ে বলে,
– কষ্ট করে বিয়ে করলাম আমি, আর এই বান্দা না-কি আমার বউকে দিবে না। সর সর, ব্রিটিশদের আশেপাশে আমার বউকে রাখা যাবে না। এসো বউ।
এরপর গাড়ির দরজা খুলে দিলে ফারাহ আবারও তার ভাইয়ের দিকে তাকায়, নিজেকে সামলে গাড়িতে উঠে বসলে শুদ্ধ-ও ফারাহ’র পাশে উঠে বসলে গাড়ি ছেড়ে দেয়। পিছন পিছন আরও চারটে গাড়ি। সবগুলো শুদ্ধদের বাড়ি যাবে।
গাড়ি ছেড়ে দিতেই ফারাহ দু’হাতের মাঝে মুখ নিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। শুদ্ধ অসহায় চোখে তাকায়। তার খারাপ লাগছে। তাকে আপাতত নিজের কাছে নিজেকেই ভিলেন লাগছে। মনে হচ্ছে সে বাবা আর মেয়েকে আলাদা করছে। ভিলেন হলে হোক, তার বউ ছাড়া চলে না। এতো উদার হলে বউটাকে পাবে কোথায়?
মুখ গোল করে শ্বাস ফেলে বলে,
– ফারাহ পাখি, আর কত কাঁদবে বলো তো? রাতেও তো কাঁদতে হবে না-কি! এখন-ই সব পানি শেষ করে ফেলছ। তুমি কি কোনোভাবে ভাবছো, পরে আমার থেকে চোখের পানি ধার নিবে? কিন্তু আমি তো ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদতে পারিনা পাখি, কি করে ধার দিব বলো? তাই বলছি, এখন একটু জমিয়ে রাখো।
ফারাহ কান্নামাখা চোখে শুদ্ধর দিকে তাকায়। রে’গে বলে,
– এতো ফা’ল’তু কথা কিভাবে বলো তুমি?
শুদ্ধ মন খারাপ করে বলে,
– আর কান্না করো না পাখি। আমি তোমাকে গ্রামে গিয়ে গরু, হাস, মুরগি, ছাগল সব কিনে দিব। তুমি গরুর গোবর পরিষ্কার করবে, হাস, মুরগি, ছাগলদের নিয়ে সংসার করবে,, তখন দেখবে তোমার আর কারো কথা মনে পড়বে না। আমি নিজ দায়িত্বে তোমাকে কাজে ব্যস্ত রাখবো।
একটু থেমে বলে,
– জানো পাখি, গোবর দিয়ে অনেক কিউট কিউট জিনিস বানানো যায়, তুমিও বানাবে কেমন? আমি সব ব্যবস্থা করে দিব।
এইতো এভাবেই আমি ‘ফা’ল’তু = মহৎ’ কাজের কথা বলি। বুঝেছ তো?
ফারাহ চোখমুখ কুঁচকে শুদ্ধর দিকে চেয়ে আছে। শুদ্ধ মুখ লুকিয়ে হাসলো। থেমেছে কান্না। উফ এখন একটু শান্তি লাগছে।
ফারাহ’কে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিল। ফারাহ কিছু বললো না। শুদ্ধ ফারাহ’র মাথায় চুমু এঁকে মৃদুস্বরে বলে,
– আমি তো শহরেই থাকি। যখন ইচ্ছে হবে আমাকে বলবে, নিয়ে আসবো আমি।
কথাটা বলে ফারাহ’র মুখ উঁচু করে। অন্ধকারে ফারাহকে দেখতে পায় না। শুকনো ঠোঁটে আলতো করে চুমু আঁকে একটা। ফারাহ একটু নড়ে ওঠে। শুদ্ধ মৃদু হাসলো। দু’হাতে ফারাহ’কে জড়িয়ে নিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
– আমার বউ, আমার ভালোবাসা।
ফারাহ কেঁপে ওঠে। বা হাতে শুদ্ধর শেরওয়ানির একটু অংশ মুঠো করে ধরে। শুদ্ধ চোখ বুজে প্রশান্তিময় হাসলো।
রাত তখন ১০ টা।
ইরফান ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত। নাছিম ছাদে এসেছিল একটু একা থাকতে।
কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার। ইরফানের বাবা তাকে যেতেই দিচ্ছে না। একটু একা থাকতে ছাদে এসে ইরফানকে দেখে আর সামনে এগোয় না।
ইরফান পিছু ফিরে নাছিম দেখল। অন্ধকারে কেউ কাউকে স্পষ্ট দেখতে পায় না। নাছিম ছাদ থেকে নামার জন্য উল্টো ঘুরে এক পা এগোলে হঠাৎ-ই পিছন থেকে ইরফানের কণ্ঠ পেয়ে তার পা থেমে যায়৷ পিছু ফিরে অবাক হয়ে তাকায় ইরফানের দিকে। নিজে থেকেই ইরফানের সামনে এসে দাঁড়ায়। নাছিমের চোখ দু’টো লাল। ইরফান নাছিমকে তীক্ষ্ণ চোখে অবলোকন করল। রা’গে তার শরীর জ্বলছে। এর এই বেহাল দশা তার বউয়ের জন্য। সে কিছুতেই মানতে পারছে না। নাছিম ঢোক গিলে কিছু বলতে চায়৷ তার আগেই ইরফান নাছিমের বাম গালে কষিয়ে একটা থা’প্প’ড় মেরে দেয়। নাছিম বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় ইরফানের দিকে। ইরফান দু’হাতে নাছিমের কলার টেনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– আমার বার্ডফ্লাওয়ার কে নিয়ে ভাবা স্টপ না করলে তোকে আমি খু’ন করে ফেলব নাছিম।
নাছিম ঢোক গিলে বলে,
– তাহলে খু’ন করে দে।
ইরফান নাছিমকে গায়ের জোরে ধাক্কা দেয়। নাছিম দু’পা পিছিয়ে যায়। ইরফান দু’হাতে তার মাথার চুল টেনে রে’গে বলে,
– ইট’স আ বিগ প্রবলেম। আই কান্ট কি’ল ইউ।
নাছিম মৃদু হেসে বলে,
– কেন পারবি না?
ইরফান নাছিমকে আবারও ধাক্কা দিয়ে আওয়াজ তুলে বলে,
– কজ, ইউ আর মাই ফ্রেন্ড।
নাছিম আবারও একটু হাসলো। ইরফান, শুদ্ধর সাথে তার আর ফাইজের ক্লাস সেভেনে পরিচয়। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত একসাথেই। তবে অন্তরা তাদের ভার্সিটি লাইফের ফ্রেন্ড। ইরফান যদিও অন্তরার সাথে যথেষ্ট দূরত্ব রাখত, বেশ অনেক মাস পর ফ্রেন্ড এর মতো তুই + প্রয়োজনে কথা বলতো। এরপর অন্তরার ফা’ল’তু কাজে ইরফান অন্তরার উপর ভীষণ ক্ষি’প্ত হয়।
অন্তরার সাথে ইরফানের ভাই-বোনের সম্পর্কের সূচনাতেই সমাপ্ত হয়েছে। কিন্তু সে, শুদ্ধ, ফাইজ, ইরফান এদের রিলেশন অন্যরকম।
ইরফান নিজেকে শান্ত করে গম্ভীর গলায় বলে,
– তুই বিয়ে করবি।
নাছিম বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় ইরফানের দিকে। ইরফান এগিয়ে এসে বলে,
– এজ সুন এজ পসিবল, তোর বিয়ে হবে।
নাছিম ঢোক গিলে বলে,
– আমি বিয়ে করব না ইরফান। তুই আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার করিস না, এট লিস্ট, এই টপিক নিয়ে তো নয়-ই। আমি বুঝেছি আমাদের ফ্রেন্ডশিপের সমাপ্তি এখানেই। তুই ভুলে যা আমাকে।
ইরফান রে’গে বলে,
– নো। তোর লাইফে ইন্টারফেয়ার আমি-ই করব। আমার ফ্রেন্ড হওয়ার আগে এসব ভাবা উচিৎ ছিল তোর। এন্ড এসব ভোলাভুলি,, আই যাস্ট হেইট দিস টপিক।
নাছিম কি বলবে বুঝলো না। সে জীবনেও বিয়ে করতে পারবে না। ভাবলেই তার কেমন দমবন্ধ লাগে। ইরফান হঠাৎ-ই শান্ত কণ্ঠে বলে,
– নেক্সট ডে একটা রাইড হোক!
নাছিম অবাক হয়ে তাকায় ইরফানের দিকে। ভার্সিটিতে তারা চার বন্ধু মিলে প্রায়-ই বাইক রাইডে যেত। তবে ইরফানকে কখনো হারাতে পারতো না। এটা নিয়ে সে, ফাইজ, শুদ্ধ ভীষণ আফসোস করত। মাঝে মাঝে তারা তিনজন আলোচনা করত, ইরফানের মাথায় বারি দিয়ে ইরফানের মাথা থেকে রাইড করার স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়ে তারা কেউ একবার জিতুক। পরে নিজেদের বোকা বোকা কথায় নিজেরাই হেসে ভার্সিটির মাঠ জমিয়ে রাখতো।
তবে নাছিম একবার ইরফানকে হারিয়েছিল, কিন্তু সে উইন হওয়ার পর দেখে ইরফানের গায়ে জ্বর ছিল, অথচ তারা কেউ বুঝতেই পারেনি। এ জন্ম থেকেই মাথা পা’গ’ল।
এরপর ইরফান হঠাৎ-ই বিজনেসে ফোকাস করায় বাইকের প্রতি যে ঝোঁক ছিল, এটা থেকে একদম-ই সরে এসেছে। তারা সবাই একটু-আধটু অবাক হয়েছিল ইরফানের কাজে।
ইরফানের সাথে সাথে তারাও আর সেদিকে যায়নি। আজ হঠাৎ ইরফানের মুখে রাইডের কথা শুনে নাছিম অবাক না হয়ে পারলো না।
ইরফান তার হাতের অর্ধেক সিগারেট টুকুর ধোঁয়া টেনে শেষ করে। এরপর চুইনগাম মুখে দিয়ে নাছিমের দিকে চেয়ে আবারও বলে,
– ঢাকা বাইপাস থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত বাইক রাইড। যদি তুই রাইডে হেরে যাস, দ্যান তোকে নেক্সট ওয়ান মান্থ এর মধ্যে বিয়ে করতে হবে।
নাছিমের বোধয় এটা শোনাই বাকি ছিল। হতভম্ভ হয়ে বলে,
– তুই কি পা’গ’ল?
ইরফান কিছু বললো না। উল্টো ঘুরে এগিয়ে যেতে নিলে নাছিম অবাক হয়ে বলে,
– তুই হেরে গেলে কি করবি?
ইরফানের পা থেমে যায়। নাছিম একটু হেসে আবারও বলে,
– বার্বিডল কে আমায় দিয়ে দিবি?
ইরফান দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। রা’গে দু’কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে যেন। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– বার্ডফ্লাওয়ার আমার বউ। অন্যের বউকে চাইতে ল’জ্জা করে না তোর?
ইরফানের কথাটা নাছিমের আত্মসম্মানে লাগলো। তবুও বলে,
– ভালোবাসলে তো একটু নি’র্ল’জ্জ হতে হয়।
ইরফান উল্টো ঘুরে নাছিমের দিকে তাকায়। মুখ গোল করে চিবানো চুইনগাম ফেলে দিয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– কখনো যদি বার্ডফ্লাওয়ারের মনে ভুল করেও অন্যকেউ স্থান পায়, সেদিন-ই এই দুনিয়ায় ওর শেষ দিন হবে। যেভাবে ওকে বাঁচাতে এই দু’হাতে আগলে নিয়েছি, সেভাবেই এই দু’হাতে ওকে শেষ করতে একবারও ভাববো না।
এন্ড অপজিট পার্সন কে ঠিক কিভাবে মা’র’বো, এসবের ডেসক্রিপশন দিয়ে কারো ঘুম নষ্ট করতে চাই না।
নাছিম ইরফানের ঠাণ্ডা গলায় বলা কথাগুলো শুনে ঢোক গিলল।
মাইরা ছাদে এসেছিল হাওয়া খেতে। সবার মাঝে থেকে থেকে সে সিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই সে লুকিয়ে লুকিয়ে একপ্রকার পালিয়ে ছাদে একটু ফ্রেশ হাওয়া খেতে এসেছে। কিন্তু ছাদের শেষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ইরফান বলা লাস্ট কথাগুলো শুনে বেচারি ভ’য়ে জমে গিয়েছে। ইরফানের কথা বলার ধরণ কেমন যেন লাগলো।
ইরফান আবারও বলে,
– নেক্সট ডে চলে আসিস। এন্ড বিয়ের প্রিপারেশন নে।
নাছিমের চোখজোড়া ঝাপসা হয়। কিছু বললো না। সে দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে ইরফানের পাশ কাটিয়ে ছাদ থেকে নেমে যায়। মাইরা দাঁড়িয়েছে, বুঝেছে বোধয়,, তবে মাইরার দিকে একবারও তাকায়নি। পাশের সিঁড়িতে গিয়ে শার্টের হাত দিয়ে একবার চোখ মুছে নিয়ে পায়ের গতি বাড়ায়।
ইরফান উল্টো ঘুরলে মাইরাকে দেখে ভীষণ অবাক হয়। রা’গ-ও হয় খানিক। এগিয়ে এসে ধমকে বলে,
– এখানে কি করছ তুমি?
মাইরা ভ’য় পায়। ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। ইরফানের দিকে চেয়ে থেমে থেমে বলে,
– আপনি আমাকে মে’রে ফেলবেন?
ইরফান শীতল দৃষ্টিতে তাকায় মাইরার দিকে। আরেকটু এগিয়ে এসে মাইরাকে দু’হাতে আগলে নিয়ে ছাদের মেঝেতে দাঁড় করায়। মাইরা মাথা নিচু করে নেয়। ইরফান আলতো হাতে মাইরার হিজাব খুলে আলগা করে দেয়। এরপর মাইরাকে দু’হাতে জড়িয়ে গলায় মুখ গুঁজে দু’টো চুমু আঁকে। মাইরা ঢোক গিলল। ইরফান মুখ তুলে মাইরার পানে তাকিয়ে বলে,
– অন্যকাউকে নিয়ে ভাবলে তুমি বেঁচে থাকার রাইটস্ হারাবে।
মাইরা চোখের পলক ফেলে ইরফানের দিকে চেয়ে থাকে। মৃদুস্বরে বলে,
– আপনি ম’রবেন তো? আপনি ম’রলে আমি ম’রতে রাজি।
ইরফান অদ্ভুদ চোখে তাকায় মাইরার পানে। অবাক হয়ে বলে,
– হোয়াট?
মাইরা কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,
– ওমা, আমাকে মে’রে আপনি আরেকজনকে বিয়ে করে তার সাথে ফস্টিনস্টি করবেন? এতো সহজ না-কি! এসব ভেবে থাকলে ভুলে যান। জানেন না? বাঙালী বউরা তার স্বামীদের নিয়ে খুব পজেসিভ হয়।
ইরফান মাইরার কথা শুনে নিঃশব্দে হাসলো। দু’হাতের আঁজলায় মাইরার মুখ নিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– যাস্ট আমাকে নিয়ে ভাববে। তাহলে তোমার হাতে চাঁদ-ও এনে দিব।
মাইরা চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– আমি আপনাকে নিয়েই ভাবি। চাঁদ-টা কবে এনে দিবেন? আমার কিন্তু আসল চাঁদ-ই চাই।
ইরফান থতমত খেয়ে তাকায়। কথাটা দ্বারা সে একটা বোঝালো, আর এই স্টুপিট কি বলছে! বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– স্টুপিট গার্ল। ভালো হবে না তুমি?
মাইরা মুখ বাঁকিয়ে বলে,
– নিজে যে মিথ্যা মিথ্যা ডায়লগ দিচ্ছেন, সে-বেলায় কিছু না। আমি চাইলেই দোষ!
ইরফান কিছু বললো না। সে ভুলে কেন যায়, সে একটা বাঁদরকে বিয়ে করেছে। এসব ভাবনা রেখে মাইরার ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরে। মাইরাকে নিজের দিকে টেনে নেয়। ধীরে ধীরে মাইরার শাড়ি এলোমেলো করতে ব্যস্ত হয়। মাইরা ছটফটিয়ে ধাক্কা দেয় ইরফানকে। ফলস্বরূপ মাইরা নিজেই দু’পা পিছিয়ে যায়। ইরফান প্রচন্ড বিরক্ত চোখে মাইরার দিকে তাকায়। ইরফান এগোতে নিলে মাইরা তার হিজাব হাতে নিয়েই কোনোরকমে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। পিছু ফিরে রে’গে বলে,
– অ’স’ভ্য লোক একটা। আপনার ঘর আমি বেঁচে দিব। ঘর তো কোনো কাজেই লাগেনা আপনার।
ইরফান বিরক্ত চোখে মাইরাকে দেখল।
ঘড়িতে রাত ১২ টার ঘর ছাড়িয়েছে। ইরফান ঘরে প্রবেশ করে দরজা আটকে বেড এর দিকে তাকালে দেখল, বিভিন্ন ধরনের ফুল দিয়ে বেড সাজানো। এগিয়ে গিয়ে দেখল, বেডের মাঝখানে বার্ডফ্লাওয়ার দিয়ে একদম বার্ডফ্লাওয়ারের আকৃতি করে সাজানো। এটা ইরফান নিজেই করেছে তার পেইন্টিং রুমের বেলকনিতে লাগানো বার্ডফ্লাওয়ারের গাছ থেকে। কল্পনায় সে মাইরাকে দেখতে পায়, এই বার্ডফ্লাওয়ার গুলো কে দেখলে।
ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে মাইরাকে না দেখে ভ্রু কোঁচকালো। পেইন্টিং রুমের লাইট জ্বালানো দেখে সেদিকে এগিয়ে যায়। দরজা ঠেলে পুরোটা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলে দেখল মাইরা দোলনায় ঘুমিয়ে গিয়েছে। মাইরার দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে মাইরার সামনে এসে দাঁড়ালো। সেই সকালের সাজ এখনো আছে, আবারও সেজেছে না-কি! একটুও নষ্ট হয়নি। বাম কাত হয়ে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। দু’হাতে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে বুকে জড়ানো।
ইরফান এক পা বাইরে রেখে দোলনার ভেতর মাইরার পাশে বসলো। হাত বাড়িয়ে মাইরার জড়িয়ে রাখা জিনিসটি আলতো হাতে ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখল, তার আর মাইরার পিক,, যেখানে ইরফান হাঁটু মুড়ে বসে মাইরার শাড়ির কুচি ঠিক করে দিচ্ছে।
ইরফানের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। মাইরা ছাদ থেকে এসে এটা এঁকেছে বুঝলো। তার মতো নিঁখুত না হলেও সুন্দর হয়েছে। তবে ইরফানের কাছে মাইরার আঁকা এই পিক-টি তার সব নিখুঁত আঁকা পিক এর চেয়ে ভীষণ ভালো লাগলো। হাতের পিকটি টেবিলের উপর রেখে দু’হাতে মাইরাকে উঠিয়ে তার বুকে জড়িয়ে নিল।
বা হাতে মাইরাকে জড়িয়ে রেখে ডান হাতে ধীরে ধীরে মাইরার সব গহনা খুলে দেয়। নাকের নথ খুলতে গিয়ে মাইরা একটু ব্য’থা পেয়ে ঘুমের ঘোরে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলে ইরফান দ্রুত ছেড়ে দেয়, নাকের পিঠে আলতো চুমু খেয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– স্যরি!
এরপর ইরফান আবারও খুবই ধীরে ধীরে নথ-টি খুলে রেখে দেয়। মাইরার ঘুম হালকা হয়েছে। পিটপিট করে চোখ মেলে তার সামনে ইরফানকে দেখে দ্রুত সোজা হয়ে বসে। ঘুমুঘুমু চোখে ইরফানের দিকে তাকায়। তাকে সবাই বলেছিল, ইরফানের জন্য অপেক্ষা করতে,, সে-ও অপেক্ষা করছিল। কিন্তু কখন ঘুমিয়েছে বুঝতেই পারেনি। নিজের কাজে নিজেই বিরক্ত হলো। দু’হাতে চোখ ডলে ইরফানের দিকে চেয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে,
– স্যরি! আমি ভুল করে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।
ইরফান বিমোহিত দৃষ্টিতে মাইরার দিকে চেয়ে আছে।
মাঝারি চওড়া কপাল, ঘুমুঘুমু চোখদু’টি, তবুও কি স্বচ্ছ! পাতলা ও ঘন পাপড়ি বারবার উঠানামা করছে,, নাকের রেখা সোজা। কোমল ঠোঁটদু’টি হালকা বাঁকানো। ইরফান নিঁখুতভাবে মাইরাকে অবলোকন করে। তার চোখেমুখে ঘোর লেগে যায় তার এই বাচ্চা বউকে দেখলে।
ঘুমানোর কারণে মাইরার চোখমুখ হালকা ফোলা ফোলা। ইরফানের দৃষ্টিতে মুগ্ধতার রেশ বাড়তেই থাকে।
ইরফান ঢোক গিলে মৃদুস্বরে ডাকে,
– বউ?
মাইরা কেঁপে ওঠে। কিভাবে যেন ডাকলো ইরফান। ইরফানের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিললে মাইরা তার লাজুক চোখজোড়া নামিয়ে নেয়। ইরফান মাইরাকে টেনে তার কোলে বসালো। মাইরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। ইরফান ডান হাতে মাইরার কাঁধের আঁচলে আটকানো সেফটিপিন খুলতে নেয়। মাইরা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে ঢোক গিলে। ইরফান হাতের সেফটিপিন খুলে ছুঁড়ে ফেলে, এরপর হুট করেই মাইরার কাঁধ থেকে আঁচল ফেলে দিলে মাইরা দ্রুত ইরফানকে জড়িয়ে ধরে। চোখমুখ খিঁচে কাঁপা কণ্ঠে বলে,
প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৭৩ (২)
– ক.কি করছেন?
ইরফান দু’হাতে মাইরাকে জড়িয়ে নেয়। কানের পিঠে শব্দ করে চুমু এঁকে ঘোরের মাঝে উত্তর দেয়,
– আদর করবো বউ!