প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৮০
Drm Shohag
নাছিম সামিয়ার বাড়ির মানুষদের কোনোভাবে খোঁজ নিয়ে তাদের খবর দেয় সামিয়ার ব্যাপারে। এরপর সে নিজেই সামিয়াকে নিয়ে এম্বুল্যান্সে করে সামিয়াকে গ্রামে নিয়ে আসে।
তখন সন্ধ্যা পেরিয়েছে। মাইরা ইরফানের সাথে এসেছে শুদ্ধদের বাড়িতে। সে মূলত সামিয়াকে দেখার জন্য এসেছে। মাইরা ভেতরে এসে ফারাহকে দেখে অবাক হলো। ফারাহ এখানে জানতো না।
এদিকে ফারাহ হঠাৎ মাইরাকে দেখে খানিকটা অবাক হয়।
ফারাহ আর শুদ্ধ ভার্সিটি থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিল। খুব বেশিক্ষণ হয়নি, তারা এসে পৌঁছেছে। শুদ্ধ তাকে বাড়িতে রেখে কি যেন কাজে বেরিয়ে গিয়েছে। বলেছে ফিরতে একটু লেট হবে।
তৃণা বেগম মাইরাকে দেখে অবাক হলো না। এইতো আধা ঘণ্টাখানেক হবে, সে সামিয়ার খবর পেয়েছে। গ্রামে আনা হয়েছে সামিয়াকে। গ্রামে যেকোনো খবর এমনি-ই ছড়িয়ে যায়। তৃণা বেগম মলিন মুখে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। মাইরা এগিয়ে গিয়ে তৃণা বেগমকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে বলে,
– আম্মাজান, সামিয়া আপু…..
ভদ্রমহিলা মাইরাকে জড়িয়ে ধরে। চোখের কোণে পানি। তার পেটে ধরা একটি মেয়ে-ও না থাকুক, কিন্তু তিনটে মেয়ে ছিল তার। মাইরা সামিয়া আর ফারাহ। এদের সাথে তিনি মেয়ের মতো করে সময় কাটিয়েছেন। কখনো ভাবেননি এরা তার মেয়ে নয়। কিন্তু সামিয়া মেয়েটাকে তিনি নিজের অজান্তেই কষ্ট দিয়ে দিয়েছিলেন। আর আজ হঠাৎ-ই সামিয়ার মৃত্যুর খবর মানুষটাকে কেমন যেন নির্জীব করে দিয়েছে।
তৃণা বেগম মাইরাকে ছাড়িয়ে তার ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,
– একটু দাঁড়া মা। গায়ে বোরখা জড়িয়ে আসছি। এরপর সামিয়ার ওখানে যাবো।
মাইরা নাক টেনে সম্মতি দেয়। ইরফান এগিয়ে এসে মাইরার গালে হাত দিয়ে বলে,
– ডোন্ট ক্রাই বার্ডফ্লাওয়ার।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাইরা ভেজা চোখে ইরফানের দিকে চেয়ে রইল। ইরফান দু’হাতে মাইরার মুখ মুছে দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– ইট’স রুলস্। তুমি কান্না অফ কর বার্ডফ্লাওয়ার।
মাইরা নাক টানলো। ফারাহ বোকাচোখে চেয়ে আছে মাইরার দিকে। তার শ্বাশুড়িকে দেখেও ফারাহ’র অবাকের সীমা চূড়ায়। সে আসলে বুঝতে পারছে না, কি হয়েছে। এগিয়ে এসে বলে,
– কি হয়েছে মাইরা?
মাইরা ঘাড় বাঁকিয়ে ফারাহ’র দিকে চেয়ে বলে,
– এই গ্রামে আমার একটা আপু মা’রা গিয়েছে ফারাহ আপু।
ফারাহ মন খারাপ করে বলে,
– ওহ।
মাইরা ইরফানের উদ্দেশ্যে বলে,
– আপনি ঘরে যান। আমি আম্মাজানের সাথে আপুকে দেখতে যাবো।
তৃণা বেগম মাইরা আর ফারাহকে নিয়ে সামিয়াদের বাড়ি এসেছেন। চারপাশে অনেক মানুষ। তৃণা বেগম এগিয়ে গিয়ে সামিয়ার খাটিয়ার পাশে বসে। আশেপাশে সামিয়ার বয়সী কিছু মেয়ে, সাথে সামিয়ার মামি, মামা,, শহরে যাদের বাড়িতে সামিয়া ছিল, তার কাকা কাকি, সকলের চোখে পানি। সামিয়ার কাকার মেয়ে সীমা, যার সাথে সামিয়া এই একবছর ছিল, মেয়েটি সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছে। সে এখন ওই বাড়ি একা একা কি করে থাকবে? সামিয়ার দু’টো দুঃখের কথা না শুনে তার দিন কিভাবে পার হবে? সে সামিয়াকে আর কথা শোনাবে না? বলবে না? – সামিয়া তুই আর কত সেই বিয়াত্তা পুরুষ নিয়ে পড়ে থাকবি?
সামিয়া তাকে পাল্টা জবাবা দিবে না? – আমি পারবো না রে।
কথাগুলো ভেবে সীমার দলা পাকিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল।
তৃণা বেগম সামিয়ার মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেয়। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। ডান হাত সামিয়ার গালে বুলিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– তোর এই খারাপ আম্মাটা কে ক্ষমা করিস মা।
মাইরা আর ফারাহ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। মাইরার চোখজোড়া ভেজা। ফারাহ আশপাশ থেকে দৃষ্টি নামিয়ে যখন মাথা নিচু করে তাকায়, সামিয়ার মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ফারাহ বিস্ময় চোখে তাকায়। সামিয়াকে সে ভুলে যায়নি। এটা তো সেই মেয়ে যার সাথে শুদ্ধর বিয়ে ঠিক করেছিল শুদ্ধর মা। ফারাহ’র এতো খারাপ লাগলো মেয়েটার জন্য! তার পাশ থেকে কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে,
– আমার মনে হয় সামিয়া আ’ত্ম’হ’ত্যা করেছে। ওই যে আমাদের গ্রামে শুদ্ধ নামে যে ছেলেটা ছিল,, ওর জন্য তো এই মেয়ে বিয়ে করছিল না। এখন আ’ত্ম’হ’ত্যা করেছে হয়তো, আর নাম দিয়েছে এক্সিডেন্ট।
– একদম ঠিক বলেছিস।
কথাগুলো কেউ একদম ফারাহ’র পাশে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছিল। কথাগুলো শুনতে পেয়ে ফারাহ’র মাথা কেমন ঘুরে উঠল। সামিয়ার ফ্যাকাশে মুখটার দিকে কতক্ষণ চেয়ে থাকলো। তার কেমন রিয়েকশন দেয়া উচিৎ? সে বুঝতে পারছে না। মেয়েটি তার শুদ্ধর জন্য বিয়ে করত না? শুদ্ধর জন্য কি কোনোভাবে এই অবস্থা? ফারাহ’র কেন যেন কষ্ট হলো। সে কি এই মেয়েটিকে অনেকটা কষ্ট দিয়ে দিয়েছে শুদ্ধর জীবনে এসে?
কিন্তু সে আর শুদ্ধ একে অপরকে ভালোবাসে। তবুও ফারাহ’র চোখজোড়া ভিজল। মেয়েটি শুদ্ধর জন্য এতো কষ্ট পেল কেন? শুদ্ধ তো তার স্বামী! ফারাহ মাইরাকে বলে, তার খারাপ লাগছে, তাই বাড়ি যাচ্ছে। এটুকু বলে দ্রুত জায়গাটা প্রস্থান করে। সে জানেনা তার কেন এতো খারাপ লাগছে।
কিছুদূর গিয়ে দেখল শুদ্ধ তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফারাহ রাতের অন্ধকারে কোনোদিকে না তাকিয়ে শুদ্ধর দিকে দৌড় দিল। শুদ্ধ দু’বার কলিংবেল চেপেছে, তখন-ই পিছন থেকে শব্দ পেয়ে পিছু ফিরে তাকালে ফারাহকে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে অবাক হয়। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই ফারাহ দৌড়ে এসে শুদ্ধকে জাপ্টে ধরে। শুদ্ধ অবাক হয় সাথে চিন্তিত। এতো রাতে তার বউটা বাইরে কেন? আর এভাবে দৌড়েই বা আসছে কেন? যখন বুঝল ফারাহ ফুঁপিয়ে কাঁদছে, তখন ছেলেটা আরও চিন্তিত হয়। দু’হাতের মাঝে ফারাহর মুখ আগলে নিয়ে বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– কি হয়েছে ফারাহ? কাঁদছ কেন?
পিছনে মাইরাকে দেখে অবাক হয়। মাইরা কখন আসলো?এসব ভাবনা রেখে শুদ্ধ মৃদুস্বরে বলে,
– কি হয়েছে মাইরা?
মাইরা ঢোক গিলল। ফারাহ শুদ্ধকে ছেড়ে শুদ্ধর হাত ধরে গেটের সামনে দাঁড়ায়। তখন-ই ভেতর থেকে ইরফান দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। শুদ্ধ ইরফানকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,
– তুই কখন আসলি?
ইরফান বাইরে বেরোতে বেরোতে বলে,
– কিছুক্ষণ আগে।
ফারাহ শুদ্ধর হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে যায়। শুদ্ধ ভীষণ অবাক হয় ফারাহ’র ব্যবহারে। কিন্তু কিছু বলল না। ফারাহ’র পিছু পিছু গেল।
ইরফান বাইরে বেরিয়ে এসে মাইরার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– আর ইউ ওকে?
মাইরা নাক টেনে বলে,
– আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
– মসজিদে যাচ্ছিলাম।
মাইরা চুপ করে ইরফানের দিকে চেয়ে রইল। ইরফান মাইরাকে টেনে জড়িয়ে ধরে। মৃদুস্বরে বলে,
– স্যরি বার্ডফ্লাওয়ার! আই নো, তুমি ওই মেয়েটাকে দেখতে পাওনি বলে তোমার খারাপ লাগছে। আমি ভেবেছিলাম, তোমাকে কিছুক্ষণ পর ওর সাথে মিট করাতে নিয়ে যাবো। বাট..
একটু থেমে মাইরার মুখ তার দু’হাতের আঁজলায় নিয়ে মাইরার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– অ্যা’ম স্যরি লিটল গার্ল!
মাইরা ভেজা চোখে ইরফানের দিকে চেয়ে বলে,
– নিয়তি বলে একটা কথা আছে, জানেন শিসওয়ালা? আসলে সামিয়া আপুর হায়াত এই পর্যন্ত-ই ছিল। সামিয়া আপুর নিয়তি এমন-ই ছিল। তার নিয়তিতে ছিল না, আমি বা তার আপন কেউ তার পাশে থাকুক। তাই সে একা একাই তার বাবা মায়ের কাছে চলে গিয়েছে।
ইরফান মাইরার কপালে চুমু আঁকে। মাইরা নাক টেনে বলে,
– সামিয়া আপু শুদ্ধ ভাইয়ার জন্য অনেক কষ্ট পেত শিসওয়ালা। আপনি জানেন? সামিয়া আপু শুদ্ধ ভাইয়ার জন্য আর কাউকে বিয়ে-ও করেনি। এমনকি অনেকগুলো বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল।
ইরফান বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় মাইরার দিকে। অতঃপর বলে,
– তুমি কিভাবে জানলে?
মাইরা সেদিন সামিয়ার কাজিনের শুনে নেওয়া কথাগুলো ইরফানকে বলল। ইরফান বলার মতো কিছু পায় না। সে একের পর এক অবাক হচ্ছে। এখানে কাকে দোষারোপ করবে? শুদ্ধ তো জানেই না সামিয়া তাকে ভালোবাসে। তাছাড়া শুদ্ধ ফারাহকে ভালোবেসে নিজেই কত স্ট্রাগল করেছে তারা ফ্রেন্ডরা দেখেছে। মাঝখান থেকে সামিয়ার জন্য ভীষণ খারাপ লাগলো তার।
মাইরা ইরফানের বুকে মাথা রেখে বলে,
– নামাজের পর আপুকে কবর দিবে। আপনি জানাজায় যাবেন শিসওয়ালা, প্লিজ!
ইরফান মাইরার মাথায় চুমু এঁকে মৃদুস্বরে বলে,
– যাবো বার্ডফ্লাওয়ার। আর কাঁদবে না, ওকে?
ফারাহ ঘরে এসে সেই থেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শুদ্ধ অসহায় চোখে চেয়ে আছে ফারাহ’র দিকে। কি হয়েছে তার পাখিটার? সে তো ভালো, হাসিখুশি বউকে বাড়িতে রেখে গেল। বাড়ি এসে এমন করছে কেন?
শুদ্ধ ফারাহকে আগলে নিয়ে বলে,
– এ্যাই ফারাহ পাখি, কি হয়েছে বলো? আমি কি কোনো ভুল করেছি? এজন্য কাঁদছ?
ফারাহ ভেজা চোখে শুদ্ধর দিকে চেয়ে বলে,
– আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
শুদ্ধ ফারাহ’কে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
– আমিও আমার ফারাহ পাখিকে অনেক ভালোবাসি তো! এভাবে কাঁদলে আমার কষ্ট হয় পাখি। কি হয়েছে বলো আমাকে?
ফারাহ নিজেকে সামলে আবারও বলে,
– তুমি আমাকে ভালো না বাসলে আমি তোমাকে চাইতাম না।
শুদ্ধ ফারাহ’র দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো। এরপর মৃদু হেসে বলে,
– আমি ভার্সিটি লাইফে কখনো তৃপ্তি করে ঘুমাতে পারিনি, জানো ফারাহ? কারণ আমি জানতাম, আমি তোমার বাবার স্ট্যাটাসে না যেতে পারলে তুমি অন্যকারোর বউ হবে। এই একটা ভাবনা আমার লাইফ থেকে ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।
একটু থেমে আবারও বলে,
– ইরফান বেশ ভালো স্টুডেন্ট ছিল। আমি খারাপ ছিলাম ঠিক তাও না। কিন্তু থাকে না! প্রতিটা মানুষের একটা লিমিটেশন। আমার-ও লিমিটেশন ছিল, আমি টপার হতে পারতাম না। এভাবে চললে কিভাবে হবে? আমি ভার্সিটি লাইফে রাতে কখনো ৫ ঘণ্টাও ঘুমাইনি। প্রচুর পড়তাম। মাঝে মাঝে ইরফানেরা বাইক রাইডে যেত, আমি মেসে থেকে যেতাম। পড়তাম। না পড়লে ফারাহ পাখিকে কিভাবে পেতাম বলো তোহ?
কম ঘুমানোর অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।
কথাগুলো বলে আবারও থামলো। এরপর ফারাহ’কে ছেড়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলে,
– ফাইজ আমার বিজনেস-এ সাপোর্ট কখন করেছিল, জানো? আমি ভার্সিটির লেকচারার হওয়ার পর। এর আগে আমাকে দেয়া তার শর্ত ছিল,, আমি ইস্ট্যাবলিশ হতে না পারলে তোমাকে অন্যকারো সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়া হবে।
ফারাহ অবাক হয়ে তাকায় শুদ্ধর দিকে। শুদ্ধ গায়ের শার্ট খুলে রেখে ফারাহ’র সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
– ফাইজ ভাই হিসেবে তার জায়গায় ঠিক। আমার তার প্রতি কখনো অভিযোগ ছিল না। এখনও নেই। তুমি আমার নিয়তিতে ছিলে, আমি পেয়েছি। কিন্তু ভীষণ ভালোবেসেছিলাম তোমায়। অনেকটা স্ট্রাগল-ও করেছি। তোমাকে আমি ফ্রিতে পাইনি ফারাহ পাখি। তাই তোমাকে ভালোবাসার কোয়শ্চন আর কখনো এভাবে করবে না। আমি কষ্ট পাই।
কথাটা বলে শুদ্ধ ফারাহ’র দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো। এরপর ওয়াশরুমে যেতে যেতে মিটিমিটি হেসে বলে,
– স্পেশাল আইসক্রিম এনেছি তোমার জন্য। খেয়ে বলবে কিন্তু কেমন।
ফারাহ কিছু বললো না। অবাক হয়ে শুদ্ধকে শুধু দেখল।
পরদিন বিকালে নাছিম আর তার মা এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে। আর ঘণ্টাখানেক পর তাদের ফ্লাইট।
নাছিম মূলত ইরফানের সাথে সব ঠিক করতে বাংলাদেশে এসেছিল। কিন্তু ঘটনাটা উল্টো হয়ে গেল। সে এক বন্ধুকে ফেরত পেতে এসেছিল, অথচ এখানে এসে আরও একজনকে বন্ধু হিসেবে না পাওয়ায় আফসোসের পাল্লা বাড়লো। বেশ কিছুক্ষণ পর মেয়ে কণ্ঠে নাছিম বামদিকে ফিরে তাকায়। অন্তরাকে দেখে অবাক হলো না। গতকাল সে অন্তরাকে কল করেছিল।
অনেকদিন পর অন্তরার সেই আগের নম্বর খোলা পেয়ে কল করেছিল। টুকটাক কথা বলেছিল, এরপর এখানে আসতে বলে।
অন্তরা এগিয়ে এসে নাছিমের মাকে সালাম দেয়। টুকটাক কথা বলে। এরপর নাছিমের মা খানিক দূরে গিয়ে বসলে নাছিম অন্তরার দিকে তাকায়। অন্তরা নিজেও তাকায় নাছিমের দিকে। দু’জনেই কিছুটা বিব্রতবোধ করে। তাদের লাস্ট দেখা ছিল, নাছিম অন্তরাকে বেশ কয়েকটা থা’প্প’ড় দিয়েছিল। নাছিম গলা ঝেড়ে বলে,
– থা’প্প’ড় এর জন্য স্যরি বলবো না। ওটা তোর প্রাপ্য ছিল। কাজটা ঠিক করিস নি। বার্বিডল মা’রা যেতে পারতো, যেখানে তোর ক্রেডিট ফিফটি পার্সেন্ট থাকতো। আর বার্বিডল এর কিছু হলে ইরফান সত্যিই পা’গ’ল হয়ে রাস্তায় ঘুরতো। তুই বার্বিডলের কথা না ভাবলেও আমাদের ফ্রেন্ড ইরফানের কথাটা একবার ভাবতি!
অন্তরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মৃদুস্বরে বলে,
– আমি তোদের কাছে অনেক খারাপ মেয়ে তাইনা?
নাছিম অন্তরার দিকে চেয়ে বলে,
– খারাপ কাজ করে ভালো মেয়ের খেতাব কেউ পায়?
অন্তরা মলিন হেসে বলে,
– ভালোবেসে তোর মতো মহান হতে অনেকেই পারে। কিন্তু ভালোবেসে খারাপ ক’জন হতে পারে? আমি নাহয় বন্ধুদের খাতায় খারাপ মেয়ে হিসেবে থাকলাম, পেছনের কারণ টা যখন ভালোবাসা তখন এই খারাপ হওয়ার উপাধি টুকু-ও আমার খারাপ লাগে না!
একটু থেমে আবারও বলে,
– ইরফান তোকে এতো কথা শোনায়, ইগনোর করে, তবুও তুই ওর কথা ভাবিস কেন?
নাছিম হাসলো। প্যান্টের পকেটে হাত রেখে বলে,
– আমাদের ফ্রেন্ডশিপ ছোটবেলার। তোর সাথে পরিচয় অল্প কয়েক বছরের। তাই তুই আমাদের চিনলি না। স্পেশালি ইরফানকে একটুও চিনিস না। ইরফান বার্বিডলের পিছে লাগার জন্য ওর আপন ফুফাতো ভাইকে হসপিটালের বেডে পাঠিয়েছিল ৭ মাসের বেশি সময়ের জন্য। আর আমি ওর র’ক্তের কেউ না। তবুও সুস্থ সবল ভাবে হেঁটে বেড়াই। কানেকশন টা বুঝতে হবে।
শুদ্ধ পিছন থেকে বলে,
– আরে এটা অন্তরা না-কি! কোন গুহা থেকে বেরোলি?
অন্তরা পিছু ফিরে শুদ্ধকে দেখে মৃদু হেসে বলে,
– কেমন আছিস?
শুদ্ধ অসহায় কণ্ঠে বলে,
– ফারাহ ওর সেকেন্ড শ্বাশুড়ি ছাড়া ভালো নেই। আমার একটাই বউ। আমি কেমনে ভালো থাকি বল? তুই কেমন আছিস মা?
– এইতো আছি।
– হারিয়েছিলি কোথায়? তোর ছোট বোনের খোঁজ করতে করতে আমার বউটা আধম’রা হয়ে গেল!
অন্তরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– চট্টগ্রামে ট্রান্সফার নিয়েছিলাম। ওখানেই ছিলাম। আর নুসরাতের বিয়ে হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় থাকে।
শুদ্ধ মাথায় হাত দিয়ে বলে,
– আয়হায় আমার বউ ছাড়া তার বান্ধবীর বিয়ে দিয়ে দিলি? বউটা তো তোদের দু’বোনকে দিয়ে বাথরুমের কমোট পরিষ্কার করাবে রে! বাংলাদেশে বিয়ে দিলে হয়তো একটু ছাড় দিয়ে কাপড় ধুইতো!
শুদ্ধর কথায় অন্তরা হাসতে হাসতে বলে,
– তুই আর ভালো হইলি না ভাই! নুসরাত আর কয়েকদিন পর বাংলাদেশে আসলে আমি ফারাহ’র সাথে কন্টাক্ট করব।
শুদ্ধ হাসলো। অন্তরার ফোনে কল আসায় সে একটু সাইড দিকে যায়। নাছিম শুদ্ধর দিকে চেয়ে আছে। শুদ্ধকে দেখলে তার শুধু সামিয়ার কথা মনে পড়ছে। শুদ্ধ কি জানেনা, সামিয়া মা’রা গিয়েছে? ভাবনা অনুযায়ী বলে,
– তোদের গ্রামে গতকাল একজন মা’রা গিয়েছে জানিস?
শুদ্ধ তার ফোনে ফারাহ’কে মেসেজ পাঠাতে টাইপ করে, – আর ২০ মিনিট পর আসছি পাখি। ওয়েট!
টাইপ করতে করতে শুদ্ধ বলে,
– হ্যাঁ, কয়েকজন মা’রা গিয়েছে শুনেছি। তুই আমার গ্রামের মৃত্যুর হার বের করবি না-কি!
নাছিম শুদ্ধর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলে,
– তোর সাথে একজনের বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তার কথা তোর মনে আছে শুদ্ধ?
শুদ্ধ হেসে বলে,
– এই বউটা মারাত্মক জ্বালায়। বাট বহুত ভালো পাখি আমার।
নাছিম আবারও বলে,
– তোর সাথে একজনের বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তার কথা তোর মনে আছে শুদ্ধ?
শুদ্ধ ফোন পকেটে রাখলো। নাছিমের কথায় সে ভাবুক হলো। বেশ কিছুক্ষণ কি যেন চিন্তা করে বলে,
– হ্যাঁ মনে আছে। নামটা কি যেন ছিল? স বা ছ দিয়ে নাম ছিল মেইবি। ঠিক মনে পড়ছে না।
শুদ্ধর কথায় নাছিম হেসে ফেলল শব্দ করে। শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– হাসছিস কেন? আর হঠাৎ তার কথা আস্ক করলি কেন?
নাছিম মৃদু হেসে বলে,
– এমনি। তোর জন্য ফারাহ অপেক্ষা করছে। যা।
শুদ্ধ নাছিমকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– সাবধানে যাস।
নাছিম শুদ্ধকে জড়িয়ে বলল,
– মাঝে মাঝে আমার সাথে একটু দেখা করতে যাস ভাই।
শুদ্ধ নাছিমকে ছেড়ে বলে,
– তুই তো শা’লা ব্রিটিশ হয়ে গেলি! ব্রিটিশদের আমার ওতো পছন্দ নয়, দেখা করতে হলে বাংলাদেশি হয়ে আসতে হবে! আমি বাংলাদেশি পোলা! একটা ব্যাপার আছে না!
নাছিম শুদ্ধর কাঁধে হাত রেখে বলে,
– আল্লাহ চাইলে আবার দেখা হবে। দোয়া করিস।
শুদ্ধ আবারও নাছিমকে জড়িয়ে পিঠে দু’টো থা’প্প’ড় দিয়ে আবারও নাছিমকে ছেড়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,
– যাহ দোয়া করে দিলাম, তোর কপালে একটা দা’জ্জা’ল বউ জুটুক। আর তোকে উঠতে বসতে লাত্থাবে আর বলবে, এই নাছিমা খালা আমারে ভালোবাসছিস কিনা বল?
শুদ্ধর কথা বলার ধরনে নাছিম শব্দ করে হাসলো। শুদ্ধর কাঁধে থা’প্প’ড় মেরে বলে,
– দেখ ভাই, আমি সুস্থ সবল এক ছেলে। খালা বলবি না একদম। সহ্য হয় না।
শুদ্ধ দাঁত কেলিয়ে হাসলো। এরপর মৃদু হেসে বলে,
– এবার নিজের জীবন টা গুছিয়ে নে।
নাছিম মলিন হেসে বলে,
– মায়ের জন্য একবার চেষ্টা করে দেখব, কিন্তু আমি জানি আমি সফল হব না।
শুদ্ধ মৃদু হেসে বলে,
– চেষ্টা করবি বলেছিস এটাই অনেক।
নাছিম চোখ বুজে বলে,
– অসম্ভব ভাই। আচ্ছা এসব বাদ দে। ইরফান কোথায় রে? আমার সাথে দেখা করবে না তাই না?
শুদ্ধ মাথা নেড়ে বলে,
– জানিনা। সাবধানে যা।
এরপর শুদ্ধ তার বাইকের দিকে এগিয়ে যায়। পিছু ফিরে একবার অন্তরার দিকে তাকিয়ে বলে,
– এ্যাই মেরি মা, বাসায় আসিস। আমার বউ সেই রাঁধে। কিন্তু আমি তোর ছ্যাড়াব্যাড়া রান্না খেতে চাই, তাই চলে আসিস। ডেটল সাবান দিয়ে হাত ধুইয়ে আসবি, বুঝলি?
শুদ্ধর কথায় অন্তরা চোখমুখ কুঁচকে তাকিয়ে রইল। নাছিম মৃদু হাসলো। শুদ্ধর দিকে চেয়ে রইল। শুদ্ধ জানতেই পারল না সামিয়ার কথাটা। নাছিম তার পকেট থেকে সামিয়ার চিঠিটা বের করে একবার সেদিকে তাকালো। এরপর সামনে তাকিয়ে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ-ই ডাকলো,
– শুদ্ধ?
শুদ্ধ বাইকে বসে পিছু ফিরে বলে,
– বল?
নাছিম বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
– কিছু না। যা।
শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– আবার আসিস। বুঝছি, আমার শোকে তুই মারাত্মক কষ্টিত! হয় হয়,, আমার ডিমান্ড এমন-ই।
নাছিম কিছু বলল না। শুদ্ধ হাত দিয়ে বাই বলে বাইক স্টার্ট দেয়। নাছিম শুদ্ধর দিকে চেয়েই সামিয়ার চিঠিটি পকেটে রেখে দিল। কি দরকার চিঠিটি শুদ্ধকে দেয়ার? শুদ্ধ তার লাইফ নিয়ে ভালো আছে। সবচেয়ে বড় কথা ফারাহ’কে পেতে ছেলেটা নিজেই কত ক’ষ্ট করেছে, ক’ষ্ট পেয়েছে,, এখন ভালো আছে। সেখানে সামিয়ার এইটুকু ব্যাপার শুদ্ধর লাইফে এন্ট্রি করানোর কি দরকার? ভালো থাকুক সকলে। তবে একটা কথা ভেবে নাছিমের সত্যিই খারাপ লাগলো,, যে মেয়েটা শুদ্ধর জন্য এতো ক’ষ্ট নিয়ে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। সেই মেয়েটার ব্যাপারে শুদ্ধ কিচ্ছু জানে না। এমনকি নামটা পর্যন্ত ভুলে গিয়েছে। কিন্তু তাতে কি? এখানে তো শুদ্ধর দোষ নেই। বরং সে এক জীবনে ফারাহ’কে ভালোবেসে কত ক’ষ্ট করেছে, সেসবের সাক্ষী তারা ফ্রেন্ড,, স্পেশালি সে আর ইরফান। ফাইজ এখানে মোটামুটি একটা ভিলেনি ক্যারেক্টার ছিল বলা যায়। তবে শুদ্ধ ফাইজের দিকে কখনো আঙুল তুলতে দেয়নি। সবসময় বলতো,
– ফাইজ একজন ভাই। ও ঠিক আছে। আমি ঠিক আমার ফারাহ’কে আমার যোগ্যতা দিয়ে আমার ঘরে আনবো,, তোরা শুধু দোয়া করিস।
শুদ্ধর ভাগ্য ভালো ছিল, তাই সে ক’ষ্ট করেছে যেমন, আল্লাহ তাকে দিয়েছেও তেমন। কিন্তু সে আর সামিয়ার নিয়তি এরকম-ই ছিল।
নাছিম মলিন হেসে বিড়বিড় করে,
– তুমি আর আমি বানে ভেসে আসা অপ্রোয়জনীয় খড়কুটোর মতো সামিয়া। যাদের দিকে মানুষ ফিরেও তাকায় না। তবে তুমি তো মুক্তি পেয়ে গেলে! কিন্তু আমি পেলাম না মুক্তি!
ইরফান মাইরাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছিল। রাকিব তাকে কল করে জানায়, নাছিম আবারও বিদেশ চলে যাচ্ছে। ইরফান কথাটা শুনে তখন-ই এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে গাড়ি ঘোরায়। প্রায় মিনিট ১০ এর মাঝে এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছায় ইরফান। গাড়ি থামিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে মাইরার দিকে তাকিয়ে বলে,
– এখান থেকে বের হবে না, ওকে?
মাইরা মাথা নাড়িয়ে বলে,
– আচ্ছা।
ইরফান দু’হাতের মাঝে মাইরার মুখটা নিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– বের হবে না এখানে থেকে। তুমি গাড়ি থেকে বেরোলে আমি ভীষণ রে’গে যাবো। বাট, আই ডোন্ট ওয়ান্ট দিস।
মাইরা মৃদু হেসে বলে,
– বের হবো না, সত্যি! আপনি এতো ভ’য় পান কেন?
ইরফান মাইরার মুখে দৃষ্টি বুলিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– তোমাকে হার্ট করতে ভ’য় পাই বার্ডফ্লাওয়ার!
মাইরা কপাল চাপড়ে বলে,
– আপনি তো আমাকে হার্ট করেন না।
ইরফান ছোট করে বলে,
– করে ফেলি।
কথাটা বলে মাইরাকে ছেড়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। যেতে যেতে আবারও গম্ভীর গলায় বলে,
– বাইরে বেরোলে পা কেটে গলায় ঝুলিয়ে দিব।
মাইরা হতাশ হয়ে ইরফানের দিকে চেয়ে থাকে।
গ্লাস দিয়ে দৃষ্টি বাইরে দিলে খানিকটা দূরে নাছিমকে দেখতে পায়। ইরফান সেদিকেই এগোচ্ছে। মাইরা কিছুটা আন্দাজ করতে পারে হয়তো। নাছিম আর ইরফানের মাঝে ঝামেলা চলে, কিন্তু কি নিয়ে এটা স্পষ্ট বুঝতে পারে না। আবার একটু একটু বুঝতেও পারে হয়তো।
নাছিম উল্টো ঘুরে দু’পা এগোলে পিছন থেকে ইরফানের কণ্ঠে নাছিমের পা থেমে যায়। দ্রুত পিছু ফিরে তাকায়। ইরফানের দৃষ্টি নরম। নাছিম জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে উচ্চারণ করে,
– ইরফান তুই?
ইরফান এগিয়ে এসে বলে,
– তুই এতে সেলফিশ কেন রে নাছিম?
ইরফানের গলায় জোর নেই। নাছিম অবাক হয়ে দেখে ইরফানকে। ইরফান নাছিমের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলে,
– সেলফিশ! আমার ফ্রেন্ড হয়েছিলি কেন? এন্সার মি!
নাছিম ঢোক গিলল। ইরফান হঠাৎ-ই রে’গে নাছিমের কলার ধরে বলে,
– ফুল ওয়ান ইয়ার আমাকে নিজের খোঁজ দিস নি। আর আজ আবারও পালিয়ে যাচ্ছিস? এ্যাই এতো সেলফিশ পার্সন হয়ে আমার লাইফে আসার মানে কি ছিল?
আমি রা’গ করেছি, তুমি ভাঙাতে যাবি না? স্ট্রেঞ্জ!
নাছিম অদ্ভুদভাবে তাকায় ইরফানের দিকে।
মৃদুস্বরে বলে,
– তোর সামনে গেলে তুই খু’ন করবি বললি!
ইরফান দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– হ্যাঁ, তো? খু’ন হবি!
নাছিম চোখ বড় বড় করে তাকায়। না চাইতেও হেসে ফেলল। ইরফান রে’গে তাকায়। নাছিম নিজেকে সামলে বলে,
– স্যরি! মিস্টেক।
ইরফান নাছিমের কলার ছেড়ে বলে,
– যেখানে যাচ্ছিলি যা। আর একবার যদি আমার আশেপাশে দেখেছি, তোকে সত্যিই খু’ন করে ফেলব আমি।
নাছিম দ্রুত ইরফানকে জড়িয়ে ধরে। ইরফান নাছিমকে নিজের থেকে ছাড়াতে চাইলে নাছিম ছাড়লো না। ভারী গলায় বলে,
– তোকে অনেক মিস করি ব্রো।
ইরফান ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। কিছু বলল না। ঠোঁট বাঁকিয়ে একটু হাসলো। মৃদুস্বরে বলে,
– কবে আসবি?
নাছিম ইরফানকে ছেড়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,
– আসতেই হবে?
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– হবে। আমার ফ্রেন্ড হয়ে ফেঁসে গিয়েছিস। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই ফাঁসির দড়ি গলায় ঝুলবে।
নাছিম হাসলো। অতঃপর বলে,
– হেডমাস্টারের রা’গ না পড়লে সত্যিই আর আসতাম না। কিন্তু এখন আসবো।
ইরফান বিরক্ত চোখে তাকায়। নাছিম মুখ লুকিয়ে একটু হাসলো। এই শব্দ বললে ইরফান রে’গে যায়। ছোটবেলায় তারা স্কুলের হেডমাস্টার কে পেট মোটা হেডমাস্টার বলে ডাকতো। এখন বড় হয়ে ইরফানকে সেই ট্যাগ দিলে এ তো রা’গবেই! ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– ফা’ল’তু বকবক অফ কর।
নাছিম মাথা নেড়ে বলে,
– ওকে! তুই বিজনেস এর কাজে গেলে আমার সাথে কন্টাক্ট করিস।
ইরফান ছোট করে বলে,
– হুম।
নাছিম হাতঘড়িতে সময় দেখে বলে,
– টাইম নেই। যাচ্ছি তাহলে।
কথাটা বলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে ইরফান পিছন থেকে বলে,
– তোর বিয়ে করা উচিৎ।
ইরফানের কথায় নাছিম হেসে ফেলল। প্রবেশ গেইটে দাঁড়িয়ে ইরফানের দিকে চেয়ে বলে,
– ম’রে গেলে ভালো হয়।
কথাটা বলে ইরফানকে হাত নেড়ে ভেতরে চলে যায় নাছিম।
ইরফান অসহায় চোখে নাছিমের প্রস্থান দেখল।
নাছিমের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মাইরা আর সামিয়া। এই দু’জনেই তার জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ। যাদের সমাপ্তি এই বাংলাদেশের মাটিতে। কিছুদূরেই নাছিম তার মাকে দেখে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নাছিমের মা ছেলের ফ্যাকাশে মুখটা দেখে বলে,
– কি হয়েছে বাবা?
নাছিম ঝাপসা চোখে তার মায়ের মুখটা দেখে। মৃদুস্বরে বলে,
– আল্লাহ চাইলেই বার্বিডলকে আমার নামে লেখাতে পারতো তাই না মা?
নাছিমের মা ছেলের কথায় বিষাদ চোখে চেয়ে থাকলো। নাছিম নিজেকে সামলে তার মায়ের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
ইরফান বেশ কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে রইল। ভেতর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তার গাড়ির দিকে এগিয়ে যায় গটগট পায়ে।
অন্তরা ঝাপসা চোখে ইরফান আর নাছিমকে এতোক্ষণ দেখছিল। কতগুলো মাস পর ইরফানকে দেখল!
ইরফান তার গাড়ির দরজা খুলে মাইরাকে বেরিয়ে আসতে বললে, মাইরা বেরিয়ে আসে গাড়ির ভেতর থেকে। হাত বাড়িয়ে ইরফানের বাহু জড়িয়ে ধরে। ইরফান মাইরাকে আগলে নিয়ে উল্টোপথে এগিয়ে যায়।
অন্তরার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। বিড়বিড় করে,
– ইরফান তোমার একটুখানি ভালোবাসা-ও কখনো আমার কপালে জোটেনি। তবে তোমার খারাপ মানুষদের তালিকায় আমি হয়তো প্রথম। এটাই বা কম কিসের? তোমার কোনো না কোনো তালিকায় তো আমার অবস্থান হয়েছে! এই অনেক।
সময় বহমান। চোখের পলকে প্রায় দুই সপ্তাহ পেরিয়েছে।
মাইরা টেবিলে বই পড়ছিল। ইরফান ডিভানে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। মাইরা একটু পর পর ইরফানকে দেখে। ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– যেকোনো একটা কর। পড় নয়তো আমাকে দেখ।
মাইরা থতমত খেয়ে সেজা হয়ে বসে। এরপর চেয়ার থেকে উঠে ইরফানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
– আপনাকে দেখতে আমার বয়েই গেছে! আপনি তো সেই বিদেশিদের মতো সাদা বিলাই। এরকম ছেলে আমার একদম পছন্দ নয়!
ইরফান ল্যাপটট রেখে মাইরার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
– ওহ, আই সি। তুমি যে টেরা এটা আমাকে আগে বলো নি কেন? নেক্সট ডে ডক্টর দেখিয়ে আনবো। ডোন্ট ওয়ারি!
মাইরা চোখ বড় বড় করে তাকায়। কি খারাপ লোক। সে তার স্বামীকেই তো একটুখানি দেখেছে। তাতেই এই লোকটা তাকে কেমন টেরা ফেরা বানিয়ে দিচ্ছে। মাইরা মুখ ফুলিয়ে বলে,
– আপনাকে আমি ছাড়বো না।
ইরফান মাইরার সাথে চেপে দাঁড়িয়ে বলে,
– ওকে। ইউ ক্যান।
মাইরা ইরফানের থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। সে আর কিছু বলবে না। বললেই এই লোকটা অ’স’ভ্য মার্কা কথাবার্তা শুরু করে দেয়। মাইরার কিছু একটা মনে পড়তেই ইরফানের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
– একটা কথার উত্তর দিন তো! একদম সত্যি সত্যি দিবেন।
ইরফান ভ্রু কুঁচকে বলে,
– বলো।
মাইরা কোমড়ে হাত রেখে বলে,
– আমার ভাই মানে লাবিব এর বাবা আমার সাথে আর খারাপ ব্যবহার করে না। এর কারণ কি বলুন তো?
ইরফান ভাবলেশহীনভাবে বলে,
– তোমার ভাইকে মে’রে ফেলতে চেয়েছিলাম। দ্যান তার বাবা ঠিক হয়ে গিয়েছে।
ইরফানের কথা শুনে মাইরা বিস্ময় চোখে তাকায়। অবাক হয়ে বলে,
– মানে?
ইরফান মাইরার দিকে চেয়ে বলে,
– লাবিব কে দুনিয়া থেকে আউট করে দিতে চেয়েছিলাম।
মাইরার চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে। ইরফান কত সহজে কথাটা বলে দিল। মাইরার আপন কে আছে? ওই একটা ছোট্ট ভাই, আর তার সৎ মা। এই লোকটা এমন কেন? মাইরা ভাঙা গলায় বলে,
– আপনি আমার ভাইকে কি করে মা’র’তে চেয়েছিলেন?
ইরফান ভ্রু কুঁচকে বলে,
– লাবিবের বাবার বোঝা উচিৎ ছিল, লাবিব যেমন তার ছেলে। তুমিও কারো মেয়ে।
একটু থেমে আবারও বলে,
– ওই লোকটা আমার বার্ডফ্লাওয়ারকে খেতে দিত না। খাবারের প্লেট ছুঁড়ে ফেলত তোমার সামনে থেকে। তাকে আমি কোনো পানিশমেন্ট-ই দিইনি।
মাইরার সেইদিনগুলোর কথা মনে পড়ে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। ভাঙা গলায় বলে,
– খাওয়াই কি সব না-কি! আমার মায়ের ভালোবাসায় আমার সব ভরে যেত।
এটুকু বলে হঠাৎ-ই মাইরা ইরফানকে ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে বলে,
– আপনি একটা অ’মানুষ। আমার ভাইকে আমি কতটা ভালোবাসি, আপনি জানেন না? আপনার একটা বাচ্চার প্রতিও মায়া হয়না?
ইরফান রে’গে বলে,
– নো।
মাইরা অসহায় চোখে তাকায় ইরফানের দিকে। রে’গে বলে,
– লাবিবের বাবার করা অ’ত্যা’চা’র আপনার চোখে পড়ল? আর আপনি যে আমাকে দিনের পর দিন থা’প্প’ড় মে’রে’ছেন? সেসব ভুলে গিয়েছেন? আপনি আসলেই স্বার্থপর লোক!
কথাগুলো বলতে বলতে মাইরার দু’চোখের পাতা ভেদ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। ইরফান শীতল দৃষ্টিতে মাইরার দিকে তাকায়। ঢোক গিলে এগিয়ে এসে মাইরার সামনে দাঁড়ায়। দু’হাতে মাইরার চোখের পানি মুছে দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– তোমাকে আ’ঘা’ত করা প্রতিটি মানুষ পানিশমেন্ট পাবে বার্ডফ্লাওয়ার। সে আমি হলেও।
একটু টাইম দাও আমাকে।
কথাটুকু বলে মাইরার মাথার চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– লাবিবের বাবাকে যাস্ট ভ’য় দেখিয়েছিলাম।
প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৭৯
মাইরা পিটপিট করে ইরফানকে দেখে। ঢোক গিলল। সে রে’গে ভুলভাল বলে ফেলেছে। ইরফান মাইরাকে কোলে নিয়ে বেডে শুইয়ে দেয়। এরপর ঘরের লাইট অফ করে এসে মাইরার পাশে শুয়ে মাইরাকে টেনে জড়িয়ে ধরে। বেশ কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– আমি মেনে নিয়েছি, বার্ডফ্লাওয়ার আমাকে কখনো বুঝবে না।