প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ৯
শার্লিন হাসান
জাইমাকে দেখে প্রথমে তার কার্যকলাপের কথা মাথায় না আসলেও চোখের সামনে জ্যান্ত দাদীকে দেখে ইশরাকের মনে পড়ে যায়, “সেদিন জাইমা দাদীকে মৃত বলেছিল। অথচ দাদী বসে আছে সেই মেয়ের সাথে তার বিয়ে দেওয়ার জন্য। পরক্ষণে আবার মনে পড়ে, জাইমা বলেছিল তার বাবা হসপিটালে ভর্তি অথচ সেদিনই সাজ্জাদ খানের সাথে ইশরাকের দেখা হয়,কথা হয়।”
এই মেয়ে কত বড় ড্রামা ফ্যাক্টরী ভেবেই ইশরাক বিরক্ত হয়। জাইমা মেঝেতে দৃষ্টি রেখে ভাবছে নিজের করা উল্টাপাল্টা কাজকর্মের কথা। একবার যদি ইশরাক তার বাবা আর দাদীর কানে তুলে দেয়, তাঁদের দুজনের একজনকে সে মৃত এবং অন্যজনকে অসুস্থ রোগী বানিয়েছে।”
হায় হায়! তার মানে সেদিন সাজ্জাদ খান এই ইশরাকের সাথে দেখা করতে গিয়েছে। জাইমা কপাল চাপড়ায়। প্রেজেন্টেশন দেওয়ার থেকে বাঁচার জন্য লেট করে ভার্সিটি গিয়ে কারণ হিসাবে নিজের বাবার অসুস্থতার কথা বললেও,সেদিনই তার বাবার সাথে ইশরাকের দেখা হলো।
জাইমা মুখটা ঠিক কোথায় লুকোবে সেটা খুঁজে পাচ্ছেনা। ইশরাত এবং দু’জনই জাইমাকে দেখছে। একটা মানুষ কী পরিমাণ ইমম্যাচিউর হতে পারে সেটা জাইমাকে না দেখলে বুঝত না ইশরাক। এই পিচ্চি মেয়ে নাকী ভার্সিটিতে পড়ে! স্ট্রেঞ্জ না? আবার এই মেয়েকে নাকী সে বিয়ে করবে। আজব ব্যপার তো!
জাইমা আশেপাশে তাকায়। আবার ইশরাকের মুখের দিকে তাকায়। সে তো জাইমার দিকেই তাকিয়ে আছে।
তাঁদের চাওয়াচাওয়ির মাঝে জাইমা চটজলদি উঠে দাঁড়ায়। দাদীর দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি বাসায় যাব।”
তখন ইশরাক গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলে, “কেন?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জাইমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “আম্মু একা,একা ভয় পাচ্ছে। সেজন্য।”
“আপনার মাথায় কী সমস্যা আছে?”
ইশরাকের কথায় জাইমা বিরক্ত হয়। একগাদা রাগ নিয়ে বলে, “সেটা জেনে আপনার কোন কাজ আছে?”
“অবশ্যই আছে। ”
জাইমা রাগে গিজগিজ করতে করতে চলে আসে বাইরে। রাগে জেদে তার কান্না আসছে। কেন যে তখন ইশরাক খান মর্ম সম্পর্কে ভালো করে জানলো না। যদি জানত তাহলে কোনদিনও এ বাসায় সে পা রাখত না। জাইমা গার্ডেনে থাকা বেঞ্চির উপর বসে সুইমিং পুলের দিকে তাকিয়ে আছে। তখন আবার সেখানে উপস্থিত হয় ইশরাক। তার কোলে ইরাকে দেখে জাইমা। মূহুর্তে মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। ইরা এতো কিউট একটা বেবি। জাইমা উঠে দাঁড়ায়। ইরা তখন জাইমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, “পাপা এতা কী দুস্তু আন্নি?”
ইশরাক জাইমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেঁসে জবাব দেয়, “হ্যাঁ।”
জাইমা ইরার দিকে তাকিয়ে মেকি হাসি টানে। এগিয়ে এসে ইশরাকের সামনে দাঁড়ায়। লিলুয়া বাতাসে তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। জাইমা সেগুলো সামলানোর বৃথা চেষ্টা করছে। ইশরাকের নজর জাইমাতে আবদ্ধ। জাইমা ইরার হাত ধরতে ইরা ইশরাকের দিকে তাকিয়ে বলে, “পাপা দুস্তু আন্নি হাত ধুরেছে।”
জাইমা ভ্রু কুঁচকে বলে, “নাম কী তোমার মা? এই গোমড়ামুখো তোমার কী হয়?”
ইরা ইশরাকের দিকে তাকিয়ে রয়। ইশরাক জাইমার চোখের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়, “মাহিরা খানম ইরা।”
“নাইস নেম! মাহিরা আপনার কী হয়?”
“আমার মেয়ে।”
“আপনি ম্যারিড?”
ইশরাক মাথা নাড়ায়। জাইমা মুখ বাঁকিয়ে বলে, “নাটক! অন্যের মেয়েকে নিজের বলে দাবি করেন কেন? ইরা আপনার বড় ভাইয়ের মেয়ে।”
কথাটা বলে জাইমা হাত বাড়াতে ইরা ইশরাকের দিকে তাকায়। ইশরাক চোখ দিয়ে ইশারা করতে ইরা জাইমার কোলো আসে। ইরাকে কোলে নিয়ে জাইমা টুপ করে ইরার দুগালে চুমু দিয়ে বলে, “তুমি ভীষণ কিউট। একদম আমার মতন।”
কথাটা শেষ করে জাইমা ইরাকে নিয়ে বেঞ্চের উপর বসে। ইরার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জাইমা বলে, “মাহিরা আমার সাথে যাবে?”
“কুতায়?”
“আমাদের বাসায়। আমার অনেক খেলনা আছে…
কথাটা বলে ইশরাকের দিকে তাকিয়ে থতমত খেয়ে যায় জাইমা। পুনরায় বলে, ” ওই আরকী, রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি,এয়ারপ্লেন এসব আছে।”
জাইমার কথা শেষ হতে ইশরাক এসে ইরার পাশে বোসে। ইরা জাইমার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমারও খেলনা আচে। তুমি খেলবে?”
“অফ কোর্স, হোয়াই নট?”
জাইমার কথা শেষ হতে ইশরাক জাইমার দিকে তাকায়। ইরার সাথে গল্প গুঁজবে মেতে উঠে জাইমা। জেনো সে ভীষণ খুশি। নিজের টাইপের কাউকে পেয়েছে কথা বলার জন্য। ইশরাক শুধু জাইমা এবং ইরার কার্যকলাপ দেখছে। জাইমা কথা শেষ করে ইরার ছোট্ট হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খায়। গাল টেনে দিয়ে বলে, “আমার তোমার মতো বেবি ভীষণ ভালো লাগে। একদম বোরিং হইনা। কিন্তু কী জানো? এই পড়াশোনার জন্য আমার বিয়েটা আটকে আছে। একবছর আগে বিয়েটা করলে তো গড গিফটেড এতো কিউট বেবি পেতাম। সব স্বৈরাচার!”
ইশরাক দু’হাতে বুকে গুঁজে সামনের দিকে তাকায়। জাইমার উদ্দেশ্যে বলে, “মিস মৈশানী আপনার মতো অদ্ভুত মেয়ে আমি আমার জীবনেও দেখিনি। ইরা ছোট বাচ্চা! আপনি ওকে এসব কী বলছেন?”
জাইমা বিরক্ত হয়ে জবাব দেয়, “মৈশানী খানম ওয়ানপিস। আপনার সমস্যা কোথায়? আপনার বাসার গেস্ট আমি, কোন স্টুডেন্ট না যে টিচার গিরি ফলাবেন।”
“আপনার তো হসপিটালে থাকার কথা ছিলো মিস—মৈশানী খানম।”
জাইমার দৃষ্টি মেঝেতে স্থির। কথা বলার মতো কিছু পায়নি সে। কিন্তু এটার একটা জবাব তো দেওয়া চাই। সেজন্য চকিত চেয়ে বলে, “অসুস্থ ছিলাম, নিজের হবু বরকে দেখার লোভ সামলাতে না পেরে হসপিটাল থেকে ছুটে এসেছি। দেখুন কত ভালোবাসা!”
জাইমার কথায় ইশরাক ম্লান হেঁসে বলে,
“আপনার দাদী মারা গেছে?”
“না।”
“আপনার বাবা হসপিটালে এডমিট?”
“না।”
“আপনি যেদিন আপনার বাবাকে হসপিটালের রোগী বানিয়েছেন সেদিন দুপুরেই সে আমার কক্ষে গিয়েছে। আর কিছু জানতে চান?”
“হ্যাঁ, কীভাবে আপনার প্রেজেন্টেশন এবং এসাইনমেন্টের হাত থেকে বাঁচব সেটাও বলে দেন। আমি জানতে আগ্রহী।”
“তবে আপনি শিওর থাকেন, এসাইনমেন্ট এবং প্রেজেন্টেশন কোনটাতে আপনি মার্ক পাচ্ছেন না।”
“না। আপনি এরকম করতে পারেননা।”
“ভালো থাকবেন মিস মৈশানী খানম।”
কথাটা বলে ইশরাক ইরাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। জাইমা চেঁচিয়ে বলে, “বেঈমানের বেঈমান আপনাকে আমি বিয়ে করব না।”
“আপনাকে বিয়ে করার জন্য আমি বসে নেই। পড়াশোনায় ফাঁকি বাজ মেয়েকে আমি বিয়ে করছিনা এটাই ফাইনাল।”
“আরেহ এটা তো কথার কথা। আপনি….
ইশরাক কানেও তোলেনা সে কথা। জাইমা হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়ে। উঠে ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে পোহা এসে জাইমার হাত ধরে তাকে টেনে পেছনে নেয়। জাইমা হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেয়। তর্জনী উঁচু করে বলে, ” কন্ট্রোল ইউর বিহেভিয়ার। উইদাউট পারমিশনে তুমি আমাকো টাচ করলে কোন সাহসে?”
“ওমাহ্! টাচ করায় গায়ে ফোসকা পড়ে গেলো নাকী?”
“জাস্ট শাট আপ।”
“কেন এসেছ? মর্মকে পাগল করার জন্য? নাকী বিয়ে করার জন্য?”
“মিস, আমি এসব কৈফিয়ত আপনাকে দিতে বাধ্য নই।”
“মিস মৈশানী, যেভাবে এসেছ ঠিক সেভাবে চলে যাও। মর্মকে নিয়ে বিয়ের স্বপ্নও দেখো না।”
“সেটা তোমাকে জিজ্ঞেস করব নাকী?”
“আমি তার গার্লফ্রেন্ড। আর কিছু শুনতে চাও তুমি?”
জাইমা জবাব দেয়না। পোহাকে এড়িয়ে ভেতরে চলে যায়। পোহা জাইমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেঁসে উঠে। পুনরায় এ বাড়ির রাজকীয় নকশায় চোখ বোলায়।
জাইমা ভেতরে এসে রাহেলা খানের হাত ধরে বলে, “আর এক মূহুর্ত এই বাসায় থাকব না আমি। আমাকে দিয়ে আসো প্লিজ।”
“সন্ধ্যায় যাবে। এখন সবার সাথে লান্স করবে তুমি।”
রাহেলা খানের কথায় রাজিয়া আহমেদ বলেন, “জাইমা থাকবে কয়দিন। সন্ধ্যায় যাবেনা।”
“আন্টি, আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।
থেমে,
আমি একাই যেতে পারব।”
“কী হয়েছে জাইমা?”
দাদীর কথায় জাইমার মনে পড়ে পোহার করা ব্যবহার। কিন্তু বলেনা। চুপসে যায় মূহুর্তে। জাইমাকে নিয়ে তর্কবিতর্কের মাঝে উপস্থিত হয় ইশরাক এবং ইরার আম্মু আনায়া। ইরার বাবা বিজনেসের কাজে দেশের বাইরে গিয়েছে। এখনো ফিরেনি! সেজন্য সে অনুপস্থিত।
জাইমা সবার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার এখানে ভালো লাগছেনা— প্লিজ।”
জাইমার কথায় আনায়া বলে, ” আসা অব্দি তোমার নাগাল পেলাম না। কথা বলো সবার সাথে দেখবে ভালো লাগবে।”
রাগে জাইমার প্রতিটা রন্ধ্র ফুলেফেঁপে উঠছে। কিন্তু প্রকাশ করছেনা। রাহেলা খান বুঝতে পারছেনা জাইমার মতিগতি। হেঁসে বেড়ানো মেয়ে হুট করে এরকম করছে কেন? জাইমা ভীষণ মিশুক স্বভাবের কিন্তু এখানে তার সমস্যা কিসের?
ইশরাক জাইমার ঘ্যানঘ্যানে বিরক্ত হয়। ধমকে বলে, “এটা আপনার ক্লাস না যে নাটক সাজাবেন। এখানে বড়রাও আছে। সবাই যেহেতু বলছে, লান্স করতে, লান্স করে এরপর যাবেন। আপনাকে থাকার জন্য জোর করা হবেনা। তবুও প্লিজ দুইমিনিটের জন্য ড্রামা বন্ধ করে শান্তি দিন।”
প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ৮
“এক্সকিউজ মি! ড্রামা মানে? গেস্টদের সাথে কীভাবে বিহেভিয়ার করতে হয় শেখেননি? অবশ্য শিখবেন কীভাবে? যেমন গার্লফ্রেন্ড তেমনি তার বয়ফ্রেন্ড।”
জাইমার কথায় ইশরাক মৃদু চেঁচিয়ে বলে, “গার্লফ্রেন্ড? হোয়াট?”