প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ৩২

প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ৩২
মুসতারিন মুসাররাত

কিচেনে রুটি বানাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে নিতি। রুটি বেলতে গিয়ে রুটির সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করছে সে। কপালের উপর থাকা বেবি হেয়ারগুলো হাতের উল্টোপাশ দিয়ে সরিয়ে শেষ বার বল প্রয়োগ করে মেয়েটি বিশ্ব জয় করার মতো আনন্দে আত্মহারা হয়। কিন্তু আনন্দটুকু বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। পাশে থাকা তনুজার বানানো রুটির দিকে নজর পড়তেই মুখটা থমথমে হয়। ঝুড়িতে রাখা তনুজার বানানো রুটির সাথে এ রুটি দেখে নিতির একটা কথাই মনে হচ্ছে, ঝুড়ির রুটিগুলো দারাজ থেকে কোনো ড্রেস অর্ডার করার সময়কার রুপ, আর আমার বানানোটা হলো হাতে পাওয়ার পর ড্রেসের আসল রুপ। নিতির ভাবনার চরকায় টান পড়ে তনুজার কথায়। তনুজা ঠোঁট টিপে হেসে মজার ছলে বলল,

-” এ মা! এটা কোন দেশের ম্যাপ হয়েছে? দেখে তো বাংলাদেশের ম্যাপের মতোই লাগছে।”
নিতি ঠোঁট উল্টাল। বলল,
-” ধ্যাত। আর বলো না তো এমনিতেই নিজের বানানো রুটি দেখে নিজেই লজ্জা পাচ্ছি। বলে আর লজ্জা দিও না।”
তনুজা এগিয়ে এসে শাড়ির আঁচলের আস্তিন হাতে তুলে নেয়। মুখে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে আলতো হাতে নিতির কপালে লেপ্টে থাকা আটার ডো মুছে দেয়। অমায়িক হেসে বলল,
-” স্যরি! এমনি মজা করে বলেছি। আর রুটি বানানো, ঘরকন্নার কাজ এগুলো করতে করতেই শেখা যায়। আজ প্রথম করেছো তাই এরকম হয়েছে। ধীরে ধীরে সুন্দর হবে। এবার তুমি দাও তো আমার কাছে, আমি করে দিচ্ছি। তুমি দেখো, কেমন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” সুইট ভাবিমণি আমি কিচ্ছুটি মনে করিনি। তবে আমি আরো ট্রাই করতে চাই।”
তনুজা প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসে। নিতি তার সর্বোচ্চ মনোযোগ, প্রচেষ্টা চালিয়ে আরেকটা রুটি বানায়। কিন্তু এবারেও আঁকাবাঁকা মানচিত্র হয়। রুটির দিকে কিছুপল তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিতির মুখে অর্ধ চন্দ্রের ন্যায় বাঁকা হাসি ফুটল। খুঁজে খুঁজে একটা বড় বাটি বের করে সেটা বসিয়ে ঝট করে কে’টে নেয়। পরপর কা’টা অংশ তনুজাকে দেখিয়ে ভাব নিয়ে বলে,
-” টান.টা.নান। এই দেখো এটা চলবে।”
তনুজা মজা করে জবাব দেয়,
-” শুধু চলবে নয়। একদম দৌড়াবে।”

ডায়নিং টেবিলে পাশাপাশি চেয়ারে ইভান-দিব্য বসে। বড়রাও আছে। তনুজা নিতি সার্ভ করছে। দিব্য ইভানের দিকে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” আমার মনে হচ্ছে তৃষার এই ব্যাপারটার সাথে তুই কোনো না কোনোভাবে কানেক্ট আছিস। পরশু রাতেই আমার ডাউট হয়েছিলো, আজকে তোর মুখের এক্সপ্রেশন দেখে সন্দেহটা তীব্র হচ্ছে।”
সকালে চায়ের আলাপনে নজরে আসে খবরের কাগজের উপরের পাতায় থাকা চেনা একটা মুখ। সাথে বড়বড় অক্ষরে লেখা হেড লাইন দেখে উপস্থিত বড়রা উৎসুক হয়ে পড়তে থাকে। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী***** এর মেয়ে তৃষা চৌধুরীর বাসগৃহ থেকে মা’দ’ক’দ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। মা”দ”ক”দ্র”ব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
দিব্যর প্রশ্নে ইভানের মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। দিব্য উত্তর না পেয়ে ফের বলল,

-” পরশু রাতে তৃষার সাথে আমার রাস্তায় দেখা হয়।”
ইভান খাবার চিবুতে চিবুতে বলল,
-” আমি শুধু ভাবছি তোর হাতের চ’ড় থা”প্পড় খেয়েও এখনো কী করে সুস্থ আছে।”
-” কথায় আছে না মেয়ে মানুষের প্রাণ হলো কৈ মাছের মতো। এই মেয়ে তার জ্ব’লন্ত উদাহরণ।”
থেমে সন্দিহান স্বরে ফের বলে দিব্য,
-” ভাগ্য ভালো ছিলো ওর ঐ মূহুর্তে তোর ফ্রেন্ড আসে। পু’লি’শ ভ্যানের শব্দে আমি প্রথমে চমকাই। পরে সেখান থেকে সজীবকে নামতে দেখে একটু হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। পরপর অবাক হই তৃষাকে অ্যা’রে’স্ট করায়। আমার তখনই মনে হয়েছিলো এরমধ্যে কিছু একটা আছে। আচ্ছা এবার বল, এরকম ছোট-খাটো ব্যাপার তো অহরহ ঘটছে তা পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপানো তারপর..”
ইভান থামিয়ে দিয়ে বলল,

-” সবসময় সব অপরাধের বিচার প্রকৃতির উপর ছেড়ে দিতে হয় না। ও যা যা করেছে সেই তুলনায় এটা কিছুই না। ওর একটা শা’স্তি পাওয়া দরকার ছিলো। চাইনি যা ঘটেছে নতুন করে সবার সামনে আসুক। দিদুন তারপর সোসাইটিতে বিষয়টা ঘাটাতে চাইনি। যেখানে সবকিছু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। ওর সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে প্রমাণ পেয়েছি ও ড্রা’গ অ্যা’ডি’ক্টেড। আর একটা মস্তিষ্ক তখনই বিকৃত হয়, কুরুচিপূর্ণ হয় এর জন্যই। তাই ওর এই বিষয়টাকে হাতিয়ার করে একটু সাজা দিতে চেয়েছি, এর বেশি কিছু নয়। মা’দ’ক’দ্র’ব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ অনুযায়ী ই’য়া’বা___________অ্যা’লকোহল জাতীয় মা’দ’কের ব্যবহার, সেবন, বহন, বাজারজাত করা এসবের সাথে জড়িত ব্যক্তিকে প্রমাণের ভিত্তিতে অর্থদণ্ড, কারাদণ্ড দেয়া হয়। সজীবের সহযোগিতায় এটা সহজ হয়েছে।”
কথার মাঝেই দিব্য ঝট করে বলে উঠল,

-” উকিল ধরে টাকা দিয়ে জামিন নিয়ে নিবে।”
-” অতটা সহজ হবে না, এইজন্য খবরটাকে রমরমা করতে পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে। আপাতত দু-তিন বছরের কারাদণ্ড যাতে হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।”
দিব্য বাঁকা হেসে বলল,
-” গ্রেট আইডিয়া।”
সেদিন লিমনের থেকে সবটা শুনে ইভান ওর ফ্রেন্ড এএসপি সজীবের সাথে পরামর্শ করে।
নিতি বাহু দিয়ে তনুজাকে গুঁতা দিয়ে ইশারা করে। তনুজা বোকা বোকা চোখে চেয়ে ইশারায় বোঝায়,
-” কী”
নিতি নিম্নস্বরে বলে,
-” সবাই খাবার খেতে ব্যস্ত। ওনারা দু’টো কী এত ফিসফাস করছে বলো তো।”
তনুজা চোখের কালোমণি ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক চাইল। ঠোঁট উল্টে বলল,
-” আই হেভ নো আইডিয়া।”

কয়েকদিন পর….
কনকনে শীতের সকালে মাটিতে থাকা আর্দ্রতা উপরে ওঠে কুয়াশার আকার নেয়। ধীরে ধীরে কুয়াশার ধ্রুমজাল চারিদিকে বিস্তৃত হয়। সেইসময় প্রকৃতিতে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতির সৃষ্টি হয়। একফালি মিষ্টি রোদ্দুর ধীরে ধীরে কুয়াশার চাদরকে গ্রাস করে রোমাঞ্চকর অনুভূতিকে তীব্র করে তোলে। শীতের সকালে মিষ্টি রোদের সোনালী আভায় রুমজুড়ে দারুণ পরিবেশ বিরাজ করছে। এই রোমাঞ্চকর অনুভূতি সম্পন্ন পরিবেশেও রুমে ঢুকতেই তনুজার কপালে বিরক্তির ছাঁট পড়ল। বিছানায় নজর পড়তেই মূহুর্তেই বিরক্তির ছাপ চোখেমুখে প্রকট হয়। সামনে দাঁড়ানো ইভানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
-” ইয়া আল্লাহ! রুমটাকে তো জঙ্গল বানিয়ে ফেলেছেন দেখছি। এত শার্ট! সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে কী করেছেন এসব?”
ইভান শার্টের বাটন লাগাতে লাগাতে তনুজার দিকে একপল চেয়ে বলল,
-” তোমাকে তো সেই কখন থেকে ডাকছি। তুমি তো কাজে মশগুল ছিলে। সবদিকে তোমার নজর থাকলেও আমার দিকে নেই। সাদা শার্টটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।”
তনুজা প্রশ্ন ছুঁ’ড়’ল,

-” পাছে পেলেন কীভাবে?”
ইভান মুখটা কাঁচুমাচু করে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
-” সোফায় নজর পড়তেই দেখতে পাই।”
তনুজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এলোমেলো শার্ট গুছাতে গুছাতে বলল,
-” আপনার ড্রেস তো সেই সকালেই বের করে রেখে দিয়েছি। রুম থেকে বেরুনোর আগে বলেও দিয়েছি।”
ইভান পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তনুজাকে। কাঁধে থুতনি রেখে বলল,
-” স্যরি তখন ঘুমের রেশ ছিলো তাই পরবর্তীতে খেয়াল হয়নি।”
তনুজাকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে নেয়। হাত থেকে শার্ট নামিয়ে দিতে দিতে বলে,
-” রাখো তুমি এগুলো। বুয়া গুছিয়ে দিবে।”
তনুজা সরু চোখে চায়। কপট রাগের আভা চোখেমুখে নিদারুণ ফোটানোর তোড়জোড় চালায়। তনুজার রাগি চোখে চেয়ে ইভান মুচকি হাসে। পরপর তনুজার নাকে টোকা দিয়ে ওর কাঁধের উপর দিয়ে দুই হাত রেখে আলতো স্বরে বলল,

-” এসব রেখে তোমার বরের দিকে নজর দাও। সে অফিস যাচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ দেখা হবে না। এখন প্রাণ ভরে তাকে তার মিসেসকে দেখতে দাও।”
ইভানের গলায় ঝুলিয়ে রাখা টাই দুই হাতে ঠিক করতে থাকে তনুজা। ত্যাড়া করে বলল,
-” তার দেখা তো ইহজন্মেও শেষ হবে না। এদিকে আমার কাজ আছে।”
ইভানের বদনখানি ম্লান হলো। বলল,
-” তোমাকে দেখার মাঝে কী পরিমাণ যে শান্তি পাই! তা তোমাকে বলে বোঝানো যাবে না।”
থেমে তিন সেকেন্ড পরপরই প্রশ্ন করে উঠল ইভান,
-” ডু ইউ ফিল মাই অ্যাবসেন্স হোয়েন আই অ্যাম নট অ্যারাউন্ড?”
তনুজা মনেমনে হাসল। টাইয়ের নাট টাইট করতে করতে ছোট করে জবাব দেয়,

-” হুঁ।”
ইভান আহত হয়ে আফসোস নামাল কণ্ঠস্বরে,
-” এক শব্দে ‘হুঁ’। আমি তো এক্সপেক্ট করেছিলাম, আমি যখন তোমার আশেপাশে থাকি না তোমার কেমন শুণ্যতা অনুভব হয়; সেটা মিনিমাম রচনাকারে বলবে। আমি তো রোজই বলি, ভেবেছিলাম আজ তোমার থেকে শুনবো তোমার অনুভূতি।”
ইভানের গলা আলগোছে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে তনুজা। স্মিত হাসি চাঁদ বদনখানিতে রেখে মিহি স্বরে বলল,
-” ইয়েস। হোয়েন ইউ ইউথ মি আ’ম ফরগেট অল মাই সরোস এন্ড পেইন। ইউর প্রেজেন্স গিভ পীস টু মাই সোল। আই ওয়ান্ট টু অলওয়েজ বি উইল ইউ।”
-” আই অল সো।”

সুন্দর রোমান্টিক কথাবার্তার মাঝে কর্কশ ফোনের রিংটোনটা ভি’লে’ন হয়ে দাঁড়ায়। ইভানের ফোনটা ক্রিং ক্রিং ক্রিং শব্দ তুলে বাজতে থাকে। মূহুর্তেই ইভানের মুখে বিরক্তিতে ছেয়ে যায়। ফোন তুলে কথা বলে গায়ে কালো রঙের ব্লেজার জড়াতে জড়াতে তনুজাকে ডাকল,
-” তনুজা?”
শার্ট ভাঁজ করতে করতে মাথা ঘুরিয়ে পিছু তাকায় তনুজা। উত্তরে বলল,
-” হুঁ।”
-” সন্ধ্যায় রেডি হয়ে থেকো। ডক্টরের কাছে যাবো। তোমাকে চেকাপ করাতে।”
তনুজা আমতাআমতা করে বলল,
-” এ-এক্ষুনি এসবের দরকার ছিলো না। আর এমনিতে আমার তেমন কোনো প্রবলেম নেই।”
ইভান কাটকাট গলায় বলল,

-” দরকার আছে কী নেই আমি বুঝব। যা বলছি তাই করবে। নো মোর এসকিউজ।”
তনুজা বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় কাত করে ইশারায় হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়। ইভান প্রত্যুত্তরে স্মিত হাসে। পরপর ঠোঁট গোল করে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে। তনুজা কৃত্রিম চোখ পাকিয়ে চায়। ইভানের ঠোঁটের কোণের হাসি চওড়া হয়। বলল,
-” বাই মিসেস।”
তনুজা বিনিময় মিষ্টি হাসি উপহার দেয়। মুখে বলল,
-” বাই।”

নরম তুলতুলে কমফোর্টের উষ্ণতা ছেড়ে আয়েশিভঙ্গিতে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায় দিব্য। চোখ তুলে চাইতেই নজর পরে খানিকটা দূরত্বে নিতির দিকে। আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু ঘুটুরঘুটুর করছে নিতি। মূহুর্তেই বিরক্তিতিতে ‘চ’ শব্দ কাটল দিব্য। পরপর ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হামি দিয়ে একহাতে ব্রাশ আর পেপসোডেন্ট তুলে নেয়। ব্রাশে পেস্ট লাগাতে গিয়ে দিব্যর গা ঘিনঘিন করে উঠল। পরপর মস্তিষ্ক সজাগ হতেই মেজাজ চ’ট’ল। সেকেন্ডেই মস্তিষ্ক ঠাহর করে এটা একমাত্র নিতি ছাড়া কারোর কাজ না। রাগে দাঁত কটমট করে অজগরের মতো ফোঁসফোঁস নিঃশ্বাস ফেলে রুমে নিতির দিকে এগোয় দিব্য।
আলমারির ড্রয়ার থেকে লাল রঙের বক্স হাতে নিয়ে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে,
-” দো লাভজোমে লিখদি মায়নে অ্যাপনি প্রেম কাহানি।
তু মেরা দিলকা রাজা বানজা ম্যা তেরা দিলকা রানি”

আলমারির পাল্লাটা বাম দিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ওদিকে যাবে বলে স্থির করে নিতি। গানটা মুখেই রয়ে যায়, পাল্লাটা ঠেলে দিতেই ‘আহ্’ শব্দে চমকে উঠে নিতি। সামনের মানবকে দেখে চোখদুটো কপালে ওঠে, সাথে কণ্ঠনালী শুকিয়ে চৌচির হয়। এদিকে নিতিকে জিজ্ঞেস করবে বলে এদিকে আসছিলো দিব্য। আর আচমকা আলমারির পাল্লা গিয়ে কপালে বারি খায়। ব্যাথায় কপাল কুঁচকে নেয় দিব্য। একহাতে কপাল ডলতে ডলতে চাহনি আ”গু”নের স্ফু’লিঙ্গ বানিয়ে নিতির দিকে চায়। নিতি ভ’য়ে থরথরিয়ে কাঁপছে। উপরে নিজেকে শক্ত দেখাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ফাঁকা ঢোক গিলে গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে তড়িৎ বেগে দিব্যর দিকে দু’পা এগিয়ে কপালে হাত রাখতে রাখতে শুধালো,
-” এই রে। তুমি এখানে! তোমার লাগেনি তো। দেখি দেখি, খুব বেশি লেগেছে কী?”
দিব্য এক ঝটকায় নিতির হাত সরিয়ে দেয়। কর্কশ গলায় বলল,

-” কীপ ডিসটেন্স।”
নিতি আড়ালে ভেংচি কা’ট’লো। দিব্য হাতে থাকা ব্রাশ নিতির সামনে ধরে জিজ্ঞেস করল,
-” ব্রাশের এই হাল হলো কী করে?”
ভেতরে ভ’য়ে ঠাসা নিতি উপরে শক্ত আবরণ ধারণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে জড় গলায় বলল,
-” আ-আসলে বাইরে যাওয়ার খুব তাড়া ছিলো। শাওয়ার নিয়ে এসে চুল চিরুনি করতে গিয়ে মনে হলো চিরুনিটা পরিষ্কার করা জরুরী। এদিকে চিরুনি পরিষ্কার করার জন্য হাতের কাছে পুরাতন ব্রাশ-ট্রাশ কিচ্ছু পাচ্ছিলাম না। তা..”
দিব্যর ধ’ম’কে নিতির মুখের কথা থেমে যায়। দিব্য রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
-” তোর চিরুনি পরিষ্কার করার জন্য আমার ব্রাশটাই ন’ষ্ট করতে হলো।”
নিতি ঘনঘন চোখের পলক ফেলে বলল,

-” আরে সামান্য একটা ব্রাশ ন’ষ্ট করেছি তারজন্য তুমি এভাবে বলছো। যেখানে বাইরে বেরুলে হকার মামারা ডেকে ডেকে সেধে সেধে দিতে চাইবে, এই জোড়া বিশ..জোড়া বিশ। যাও এইযে বাহিরে যাচ্ছি তোমার একটার বিনিময়ে জোড়া ব্রাশ পাবে।”
দিব্য একহাত কোমড়ে রাখল। অন্যহাতে কপাল চেপে ধরে রাগ কমানোর চেষ্টা করল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” এটা তোর জোড়া বিশ টাকা দামের ব্রাশ ছিলো।”
নিতি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
-” কত আর হবে একশো টাকার বেশি তো আর নয়।”

নিতি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে দিব্যকে পাশ কাটিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। পরপর গলায় লকেটসহ চিকন চেইনটা পরে নেয়। অতঃপর প্লাজুটা কিঞ্চিৎ উঁচুতে তুলে পায়ে পায়েল পড়তে থাকে। নিতির সক্কাল সক্কাল সাজগোজ দেখে দিব্যর কপালে ভাঁজ পরে। দিব্য ভাবে এই মেয়ের সাথে কথা বললেই মেজাজ তুঙ্গে উঠবে। তাই সিদ্ধান্ত নেয় কিছুই বলবে না। হাতের ব্রাশটা শব্দ করে ছুঁড়ে ফেলে গটগট পা ফেলে ব্যালকনিতে যায়। দুই হাত ট্রাউজারের পকেটে গুঁজে রাস্তার দিকে চেয়ে দিব্য। এমন সময় কর্ণগোচর হয় মেয়েলি রিনরিনে স্বর,
-” কার্ড দাও।”
গায়ে অফ হোয়াইট সালোয়ার সুট, হালকা ব্রাউন কালার করা সিল্কি খোলা চুল। কাঁধের একপাশ দিয়ে ওড়না ঝুলানো, অপরপাশে একগাছি চুল। শ্যাম্পুর ঘ্রাণ দিব্যর নাকে বারি খায়। খোলা যায়গায় বাতাসে ছড়িয়ে তীব্র হয় ঘ্রাণ। সম্বিত ফিরে পেয়ে দিব্য কপাল গুটিয়ে শুধোয়,

-” কার্ড! কিসের কার্ড?”
সামনে থাকা চুলগুলো একহাতে বারি মে’রে পিছনে দেয় নিতি। তীক্ষ্ণ চাউনিতে চেয়ে ত্যাড়া জবাব দেয়,
-” যেভাবে বলছো মনে হচ্ছে এই প্রথম কার্ডের নাম শুনছো। আর আমাকে দেখে কী তোমার মনে হচ্ছে আমি তোমার কাছে রেশন কার্ড চাইছি।”
দুই হাত নিজের ড্রেসের দিকে ধরে দেখিয়ে বলতে থাকে,
-” সেজেগুজে আমি তোমার কাছ থেকে রেশন কার্ড নিয়ে লাইনে দাঁড়াবো চাল-ডাল তুলতে।”
-” বাজে ব’ক’ব’কানি রাখ।”
চেঁচিয়ে উঠল দিব্য। নিতির মুখটা থামল। মুখটা থমথমে করে বলল,

-” এটিএম কার্ড দাও। সাথে পিন নম্বর বলে দাও।”
দিব্যর কপালের রেখা মিলিয়ে যায়। সটান দাঁড়িয়ে সিটি বাজিয়ে নেয়। তারপর বলল,
-” মগের মুল্লুক নাকি! তুই বললেই আমি পিন নম্বরসহ কার্ড দিয়ে দিবো।”
নিতি দুই হাত বুকে ভাঁজ করে। পাল্টা বলে,
-” মগের মুল্লুক নয়; এটা বউয়ের মুল্লুক। হুঁ।”
হঠাৎ কিছু ভেবে দিব্য নিতির দিকে ঘুরে চায়। নিতির আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে প্রশ্ন করল,
-” তা এই সক্কাল সক্কাল পেত্মী সেজে কই যাচ্ছিস শুনি? আবার কার্ড চাইছিস।”
-” ঘড়িতে এগারোটা বাজতে আর তিন মিনিট বাকি আছে। এখনো তোমার কাছে সকাল রয়েই গেছে। সবার দুপুরের ভুঁড়িভোজের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আর তোমাকে বলে কী লাভ তোমার তো রাত চারটের সময় রাত শুরু হয়, আর বেলা বারোটার সময় সকাল শুরু হয়।”
দিব্য মোটামোটা চোখে চাইতে নিতি থামে। নিতি গাল ফুলিয়ে বলল,
-” ইউ আর গুড ফর নাথিং।”
-” হোল্ড ইউর টঙ।”
দিব‌্য শাসিয়ে বলে। নিতি মুখ বাঁকিয়ে বলল,

-” বিয়ে করেছো। কোনো দায়িত্ব আছে তোমার? আমার ফ্রেন্ডের বার্থডে গিফট কিনতে হবে। এখন যদি আমি মাম্মার কাছে গিয়ে টাকা চাই। তাহলে কেমন দেখাবে বলো তো।”
-” তুই বলেছিস আমাকে? না বললে জানবো কী করে তোর ফ্রেন্ডের বার্থডে কবে? তোর কী লাগবে? না লাগবে।”
দিব্য রুমের দিকে পা বাড়ায়। নিতি পিছুপিছু যেতে যেতে বলল,
-“‘তুমি কী বাচ্চা শিশু নাকি! হাতেখড়ি দিয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে হবে। বলে-কয়ে দিতে হবে। রোমান্টিকতাটাও তো জানো না, সেটাও কী শিখি..”
দিব্য ঘাড় ফিরিয়ে চাইতেই নিতি জিভ কা’টে। দিব‌্য পাঁচটা একহাজার টাকার নোট নিতির দিকে বাড়িয়ে দেয়। নিতি হাতে নিয়ে গুণে চোখ উপরে তুলে বলল,
-” ইয়া আল্লাহ! আম্বানি মন আমার। আর কপালে জুটেছে এমন ফকির। ফকিরের তো তাও একটা পেশা আছে, এর তো তাও নেই। এ তো পুরাই খাঁটি বেকার।”
ঠোঁট গোল করে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে দিব্য। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,

-” নিতি উল্টাপাল্টা বলে আমার মেজাজ খারাপ না করলে তোর পেটের ভাত পরিপাক হয় না নাকি?”
-” সত্যি কথা বললে কেউ যদি রাগে তাতে আমার দোষ কোথায়! দিদুন সেদিন সকালে ডেকে বলল, অফিসে জয়েন করতে। ইউএসএ যাওয়ার ভূ’ত মাথা থেকে সরলেও বিসিএস ক্যাডার হওয়ার ভূ’ত একচুল নড়েনি। সারাদিন বন্ধুদের সাথে টইটই করে ঘুরলে ক্যাডার কেনো নাইট গার্ডের চাকুরীও পাবে না, হুম।”
-” ও গড!” অতঃপর নিতির দিকে রাগি দৃষ্টিতে চেয়ে। গলার স্বর চড়িয়ে ফের বলল,
-” রাখ তোর সত্যি কথা।”
তারপর আরো পাঁচ হাজার টাকা বের করে নিতির হাতে ধরিয়ে দেয়। নিতি মুখটা ম্লান করে বলল,
-” আরেকটা সত্যি কথা বলেই নেই। এইযে বিয়ে হয়েছে বউয়ের সাথে কেমন খ্যাত খ্যাত আচরণ করো। তুই-তোকারি করে বলো। কেমন বি’শ্রী লাগে।”

-” তোকে কী এখন ম্যাডাম ম্যাডাম করে ডাকতে হবে?”
একহাতে কপাল চাপড়ে আফসোস করে বলে নিতি,
-” ওহ্! বউয়ের সাথে কীভাবে মিষ্টি করে কথা বলতে হয় জানবে কী করে। জন্মের পর তো খাঁটি মধু মুখে ওঠেনি।”
দিব্য সরু চোখে চেয়ে প্রশ্ন করল,
-” সেই সময় তুই দেখেছিলি?”
নিতি থতমত খায়। দিব্যর জন্মের সময় ও কীভাবে দেখবে। যেখানে গুনে গুনে প্রায় তিন বছরের বড় দিব্য। নিতি ঠোঁট উল্টে বলল,
-” দেখা লাগে না, কথা শুনেই বোঝা যায়।”
-” অনেক দেখা হয়েছে এবার তুই যেতে পারিস।”
-” যাচ্ছি যাচ্ছি।”
বলে দু’কদম এগিয়ে আবার তড়াক করে পিছায় নিতি। কিছু মনে উঠতেই বলল,

-” ভালো পাঞ্জাবী নিতে কোথায় গেলে বেটার হয়; বসুন্ধরায়? নাকি আড়ং এ?”
-” আড়ং।”
কথাটা বলেই আচমকা দিব্যর কপালে সুক্ষ্ম রেখার উদয় হয়। প্রশ্ন করলো,
-” পাঞ্জাবী দিয়ে তুই কী করবি?”
-” বললাম না ফ্রেন্ডের বার্থডে গিফট করবো।”
অস্ফুটে বলে দিব্য,
-” ছেলে ফ্রেন্ড?”
-” হ্যা। তাছাড়া মেয়ে ফ্রেন্ডকে কেউ পাঞ্জাবি গিফট করে নাকি। আচ্ছা এবার বলো তোমার পাঞ্জাবির মাপ কতো? আমার ফ্রেন্ডের হাইট আর বডির মাপ তোমার মতোই হবে। তোমার মাপটাই এ্যকুরেট হবে। জলদি তোমার মাপটা বলে ফেল।”
দিব‌্যর রাগের মাত্রা আচমকা তরতরিয়ে আকাশ ছুঁলো। কষিয়ে ধ’ম’ক দিয়ে বলল,

-” তুই যাবি আমার সামনে থেকে। সেই তখন থেকে লাগাতার বকবক করেই যাচ্ছিস।”
নিতি নির্বোধের মতোন চাইল। কিছুপল পর অভিমানের সুরে বলল,
-” আরে যাচ্ছি যাচ্ছি। তোমার সামনে থাকতে আমার বয়েই গিয়েছে।”
যেতে যেতে শুনিয়ে-শুনিয়ে ফের বলল,
-” না চাইতেই পেয়েছো তো। তাই আমার মূল্য বুঝতে পারছো না। ঠিকঠাক কদর করছো না। একটু খোঁজখবর নিয়ে দ্যাখো; এখনো হয়তো কেউ আমাকে পাওয়ার জন্য, দুইচোখ সাগর বানিয়ে গাল ভাসাচ্ছে।”

প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ৩১

নিতির শেষের কথাটা দিব্যকে ভাবাতে থাকে। অবচেতন মন আওড়ায়,
-” একে পাওয়ার জন্য এখনো কে আবার কান্না করে বন্যা বয়ে দিচ্ছে?”
না চাইতেও আচমকা রাগের পারদ উঁচুতে উঠল দিব্যর।

প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ৩৩