প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ২৫

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ২৫
আদ্রিতা নিশি

সময় কখনো কারো জন্য থেমে থাকেনা।নদীর স্রোতের ন্যায় সময়ও প্রবহমান।চোখের পলকে দেখতে দেখতে কেটে গেছে পনেরোদিন।সকলের জীবন তাদের স্বাভাবিক নিয়মেই অতিবাহিত হচ্ছে।কিন্তু অরিত্রিকার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা। আগের থেকে কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। আগের মতো চঞ্চলতা নেই তার মাঝে। উচ্ছ্বাস, উদ্দিপণা কোনো কিছুই তার ভাবভঙ্গিতে ফুটে ওঠে না।সারাক্ষণ রুমবন্দি করে রাখে নিজেকে। নিশ্চুপ,মনমরা, উদাসীন ভঙ্গিতে সময় কাটে তার।বাড়ির সকলের সাথেও কথাবার্তার পরিমাণ অনেকটা কমে গেছে।সবাই কারণ জানতে চাইলে তখনও অরিত্রিকা নিশ্চুপ থাকে। আপাতত অরিন অসুস্থ তাই অরিত্রিকার এমন আজব ব্যবহার কেউ আমলে নিচ্ছেনা। অন্য সময় হলে কি হয়েছে তা সাথী বেগম মেয়ের থেকে জেনে নিতেন।

অরিত্রিকা ক্লান্ত শরীরে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। চক্ষুদ্বয় তার বন্ধ। বাহির থেকে আসায় ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা প্রায়। ঘর্মাক্ত শরীরে জামাও বিচ্ছিরিভাবে আটকে আছে। প্রচন্ড রোদে মুখ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। কপাল বেয়ে পরছে নোনা পানির কণা। বাহিরের আবহাওয়া আজ অনেক উত্তপ্ত। মনে হচ্ছে বৈশাখ মাসের কাঠ ফাটা রোদ। চারিদিকে যেনো অন্ধকার দেখছে সে। ফ্যানের ঠান্ডা হাওয়ায় যেনো এখন একটু ভালোলাগছে অরিত্রিকার।
তানিয়া বেগম অরিত্রিকার জন্য শরবত নিয়ে এসে বললেন~ এই নে শরবত খা। দেখবি ক্লান্তি নিমেষেই গায়েব হয়ে গেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরিত্রিকা ক্লান্ত চক্ষুদ্বয় মেলে স্বাভাবিক ভাবে উঠে বসলো। তানিয়া বেগমের থেকে শরবতের গ্লাসটা নিয়ে ক্লান্ত কন্ঠে মৃদু হেসে বললো~ ধন্যবাদ বড় মা তোমার হাতের সুইট শরবতের জন্য।এটারই অভাব বোধ করছিলাম।
তানিয়া বেগম অরিত্রিকার মাথা নেড়ে দিয়ে হেসে বললেন~ হয়েছে। এবার খেয়ে নে।
~হুমম খাবোই তো।তুমি বসো তো।
তানিয়া বেগম সোফায় বসলেন। অরিত্রিকা এক চুমুকে পুরো গ্লাস শরবত শেষ করে দিলো।টেবিলে গ্লাসটি রেখে শুধালো~ মা এখনো আসেনি অরিন আপুর বাড়ি থেকে?
~নাহহ আসেনি।হয়তো রাতে আসবে।
~ওহহ।
~এডমিশন দিতে গিয়েছিলি তো কেমন হলো?
~ভালোই দিয়েছি তো।এখন দেখা যাক।
~ইশরার কেমন হলো পরীক্ষা?
~ভালোই হয়েছে।
~কোনো সমস্যা হয়নি তো এডমিশন দিতে গিয়ে?

~সাদাত ছিলো কোনো সমস্যা হয়নি। ইশরা আর আমাকে রুম দেখিয়ে দিয়েছিলো।
~যাক ছোট ছেলেটা দায়িত্ববান হচ্ছে ধীরে ধীরে। আমি তো চিন্তা করছিলাম তোদের নিয়ে। তিনজন সব সামলাতে পারছিস নাকি তা নিও ভয় কাজ করছিলো।ভার্সিটিতে কতো মানুষ এসেছে দূর থেকে। সারহান থাকলে চিন্তা হতো না। সব এক হাতে সামলে নিতো।
সারহানের কথা শুনতেই অরিত্রিকার মুখ অন্ধকার হয়ে এলো।মুখশ্রী মলিন বর্ণ ধারণ করেছে।মনে অভিমান যেনো জোরালো ভাবে বাসা বাধলো পুনরায়।
তানিয়া বেগমকে কিছু বুঝতে না দিয়ে অরিত্রিকা শুকনো মুখে বললো ~ তোমার বড় ছেলে সত্যি অনেক দায়িত্বশীল। তা না হলে নিজের কথা না ভেবে আগে দলের কাজ করতে যায় কেউ। ছেলে হিসেবেও পারফেক্ট। বড় বাবাকে ব্যবসার কাজে কতো হেল্প করে। সাদাতকেও তো খুব ভালোবাসে।
তানিয়া বেগম হেসে বললেন~ তা ঠিক বলেছিস রে।আমার ছেলেটা আসলেই অনেক ভালো। সোনার টুকরো ছেলে আমার। কিন্তু এসব প্রশংসা ভুলেও সারহানের সামনে করিস না।

~ তুমি কি যে বলো বড় মা। তোমার নাক উঁচু ছেলের সামনে আবার তারই প্রশংসা করবো! কখনই না।
~ তুই আমার ছেলেকে দেখতে পারিস না কেনো বল তো?
~ তোমার ছেলেকে দেখে কোনো পছন্দ করার মতো গুন পাইনি তাই।
~ হয়েছে হয়েছে। ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়। আমি খাবার বাড়ছি।
~ ঠিক আছে।
অরিত্রিকা ক্লান্ত শরীরে নিজ রুমের দিকে রওনা হলো।তানিয়া বেগম রান্নাঘরে খাবার আনতে গেলেন।
অরিত্রিকা গোসল করে এসে মাত্রই বিছানার ওপর বসলো।মাথায় এখনো তোয়ালে পেঁচানোই আছে। চোখ দপদপ করে জ্বলছে।বেশ কয়েকদিন যাবৎ ঘুমও তার চোখের রাস্তা ভুলেছে।চোখে যেনো ঘুমের কোনো অস্তিত্ব নেই। মাথাও ঝিমঝিম করছে।প্রচন্ড গরমের কারণে এমন হচ্ছে। প্রচন্ড গরম আর ঘুম না হওয়ার কারণে মাথা হ্যাং হয়ে গেছে একদম।অন্যসব ভাবনা সাইডে ফেলে সে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো কেউ কল করেছে কিনা? তেমন কেউ তো নেই খোঁজ নেওয়ার মতো কল করে বলবে এক্সাম কেমন হয়েছে? কেউ নেই কেউ নেই।শূন্যতা আর শূন্যতা। চারিদিকে এতো শূন্যতা আর হাহাকার কেনো? আগে তো কারও ম্যাসেজ বা কলের জন্য এতোটা উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করেনি? তবে এখন কেনো একজনের কল আর ম্যাসেজের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে হয়।তবুও তো প্রহর ফুরায় না। অপেক্ষার প্রহর এতো দীর্ঘ হয় কেনো? শ্যাম মানবের কি তার কথা মনে পরছে না?হয়তো মনে পরেনি। তাই তো কল বা ম্যাসেজ না দিয়ে উল্টো ফোন বন্ধ করে রেখে দিয়েছে।

অরিত্রিকা উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। চুল থেকে তোয়ালে খুলে ভেজা চুলগুলো সুন্দরভাবে আঁচড়াতে লাগলো। বেশ কয়েকদিন চুলের যত্ন না নেওয়ায় অগোছালো হয়ে গেছে। অনেকটা সময় নিয়ে আচড়ে চুলের একপাশে সিঁথি করে ক্লিপ দিয়ে আঁটকে নিলো।মুখে স্নো দিয়ে আয়নায় নিজের মুখের দিকে আনমনে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পরেছে।মুখও কেমন মলিন, শুষ্ক হয়ে গেছে।গুটি কয়েক ব্রণও ফর্সা মুখে স্থান পেয়েছে।নিজের চেহারার বেহাল অবস্থা দেখেই নিজেই হেসে উঠলো অরিত্রিকা। হাসিতে নেই কোনো মাধুর্যতা,নেই প্রাণ।আছে শুধু বিতৃষ্ণা,অসম ক/ষ্ট আর বিরহ। আজ প্রায় পনেরো দিন পর অরিত্রিকা নিজের একটু যত্ন করেছে।আজ কেনো যেনো ইচ্ছে হলো পরিপাটি অবস্থায় নিজেকে দেখতে।
~কিরে তোকে না বললাম নিচে যেতে। এখনো এখানেই আছিস?

তানিয়া বেগম খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে অরিত্রিকার রুমে প্রবেশ করে বললেন। অরিত্রিকার মনে ছিলোনা তানিয়া বেগম তাকে খেতে ডেকেছিলো। সে তানিয়া বেগমের পাশে দাঁড়িয়ে জিভ কেটে বললো ~ দেখেছো তো আবারও ভুলে গেছি। এই মনের কি যে হয়েছে বুঝতে পারছিনা। সব মন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
তানিয়া বেগম চিন্তিত হয়ে বললেন~ তোর কি হয়েছে বলতো? কোনো কিছু নিয়ে কি দুশ্চিন্তা করছিস? শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে,ঠিকমতো খাবার ও খাচ্ছিস না আবার দেখেও মনে হচ্ছে ঘুম ও ভালোভাবে হয় না।কোনো সমস্যায় থাকলে বল।কোনো কিছু চেপে রাখতে নেই মা।
অরিত্রিকা ইচ্ছে করছে সব বলে দিতে। কিন্তু কিভাবে বলবে সে।যদি সবাই তাকে সত্যিটা জেনে ভুল বোঝে?
অরিত্রিকা মিথ্যা বললো~ এই কয়েকদিন রাত জেগে পড়াশোনা করেছি তাই হয়তো এমন লাগছে।দেখবে এখন তো পড়াশোনা নেই ঠিক হয়ে যাবে।

~ বুঝলাম। বিছানায় বস আমি তোকে আজ খাইয়ে দিচ্ছি।এই কয়েকদিনে শরীরের কি অবস্থা করেছিস। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিস।
অরিত্রিকা বিছানায় লক্ষী মন্ত মেয়ের মতো বসে পরলো।তানিয়া বেগম বসে নিজ হাতে অরিত্রিকাকে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিতে লাগলেন।
~ তুই তো তাও ছোট আছিস এখনো। আর আমার বড় ছেলে হয়েছে একজন।কত বড় হয়েছে তবুও তার জন্য চিন্তা করতে করতে প্রেশার হাই করে ফেলি।বাড়ি থেকে বেরিয়েছে কতোদিন হয়ে গেলো। একবারও কল করার ও সময় হয়নি। আবির কে কল দিলে ওই বদমাইশটার খবর পাওয়া যায়।
বড় মা তোমার ছেলে বড্ড পঁচা হয়ে গেছে। ঢাকায় গিয়েছো আমায় একবারও জানায়নি।ফোনও বন্ধ করে রেখেছে।এতো ক/ষ্ট কেনো দেয় বলো তো।আমি কি এতো টেনশন নিয়ে থাকতে পারি?!!কতো ক/ষ্ট করে এডমিশনের পড়া পরেছি। বিনিদ্র রাত পার করেছি সেই খবর কি তোমার ওই পা/ষন্ড ছেলে জানে?অরিত্রিকা মনে মনে অভিযোগের ঝুলি মেলে বসেছে। এবার মানুষটা সুস্থ ভাবে ফিরে আসুক কথা বলবে না সে। সামনেও যাবে না।

ঢাকায় ফাইভ স্টার হোটেলের একটা কক্ষের জানালা বরাবর দাঁড়িয়ে আছে নিশাদ।হাতে তার ড্রিংকসের গ্লাস। গভীর ভাবনার মাঝে মাঝে দুই এক চুমুক খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছে সে।কালো কোর্ট, প্যান্টের আবরণে নিজেকে জরিয়েছে। ফর্মাল গেটআপে আজ সুদর্শন লাগছে বটে। দৃষ্টি তার যানবাহনে পরিপূর্ণ রাস্তার দিকে। মুখ গম্ভীর।মনের মাঝে এঁকে চলেছে নীলনকশা সারহানকে শেষ করার।
~নিশাদ এতো টেনশন করো না তো দেখবে তোমার মামা নমিনেশন পেয়ে যাবে।
সুমধুর মেয়েলী কন্ঠস্বর পুরো রুম জুড়ে প্রতিধ্বনিত হলো।কন্ঠস্বরে যেনো মায়া জড়ানো।তবুও নিশাদের সেদিকে কোনো ইন্টারেস্ট নেই।মেয়েলী স্বরে সাথে কথা বলে আগ্রহ দেখানোরও কোনো ইচ্ছে জাগলো না নিশাদের।
মিহি নিশাদের কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য না করতে পেরে মনে মনে ক/ষ্ট পেলো।আহত দৃষ্টিতে নিশাদের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। নিশাদ হাতে থাকা ড্রিংকস শেষ করে মিহির দিকে তাকিয়ে কন্ঠ শক্ত করে বললো~ তোমায় যে কাজটা বুঝিয়ে দিয়েছি করতে পারবে তো?

মিহি নিজের খারাপ লাগা আড়াল করে বললো~ কাজটা একটু বেশী রিস্ক হয়ে যাবে।যদি ধরা পরি তাহলে আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। আর সারহান যদি একবার বুঝতে পারে এর পেছনে তুমি আছো ভাবতে পারছো কি হবে?
~তোমায় বেশী ভাবতে হবে না।কাজটা করে দাও তারপর আরও টাকা পেয়ে যাবে।
~ ভেবে নাও কাজ হয়ে গেছে।সারহান আর ওই এমপি এবার নমিনেশন পাবেনা।
নিশাদ ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বললো~ গুড গার্ল।এই জন্য তোমাকে আমার এতো ভালো লাগে।
মিহিও হাস্যরত অবস্থায় বললো~ শুধু তোমার কাজ করে দেই বলে ভালো লাগে আমায়? ভালোবেসে দেখো ঠকবে না। সারাজীবন তোমায় ভালোবেসে যাবো।
নিশাদ হাসি থামিয়ে বললো~ সিরিয়াস কাজের মাঝে ফান করোনা। এখন আমি ফান করার মুডে নেই।
মিহি চেয়ার টেনে আরাম করে বসে বললো~ মরিচীকার পেছনে ছুটোনা নিশাদ। আমার মন বলছে তুমি তাকে পাবে না।কিন্তু তুমি যে দিকে হাত বাড়িয়েছো তা তোমার জন্য খুবই খারাপ কিছু বয়ে আনবে দেখো।
~ আমি অরিত্রিকাকে যে কোনো মূল্যে চাই।আমার পাখি এখন অন্য জনের বক্ষে বাসা বানানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিভাবে তা দেখেও চুপ করে থাকবো? চেয়েছিলাম জোর করে কোনো কিছু করবোনা। এখন এটা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছিনা।

~ সারহান ব্যক্তিটাই প্রেমে পরার মতো।যে কোনো মেয়ে তার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পরতে বাধ্য। আফসোস আমি সারহানের মতো সুপুরুষের প্রেমে পরিনি তোমার মতো একজন মানুষের প্রেমে পরেছি।
নিশাদ এবার পরিপূর্ণ দৃষ্টি ফেলে মিহির দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো।মিহির হাস্যরত মুখখানা আরেকটু প্রশস্ত হলো। টপস আর জিন্স পরিহিত লাবণ্যময়ী মেয়েটিকে মোটেও মন্দ লাগে না নিশাদের কাছে।যেখানে মানুষ নিজেকে সুন্দর দেখানোর জন্য মেকআপ দ্বারা মুখে আস্তরণ তৈরী করে সেখানে মিহি নিজেকে সিম্পলভাবে রাখতে বেশী পছন্দ করে। চুল আধুনিক মেয়েদের মতো কালার করা নয়। কালো কোমড় ছাড়িয়ে চুল।নিশাদ জানে মিহি তাকে ভালোবাসে কিন্তু সে তো আরেকজনকে চায়।মিহিকে নিজের কাজের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে শুধু।
নিশাদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো~ আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখো না মিহি। এই যে কাজটা হয়ে গেলে তুমি আবারও তোমার দেশে ফিরে যাবে। আমাদের আবার কবে দেখা হবে সেটাও অজানা।আমার মতো মানুষকে ভালোবেসে তোমায় পস্তাতে হবে যা আমি চাই না।

মিহির চোখ বেয়ে পরছে অশ্রু। তবুও হাসি সরছেই না তার।সে হেসেই বললো~ তোমার পিছে আমি পাঁচ বছর ধরে পরে আছি।ভালোবাসি তোমায়। দেখো তুমি যে অরিত্রিকাকে ভালোবাসো তা জেনেও নির্লজ্জের মতো এখনো তোমার পিছনেই পরে আছি।আমায় একটু ভালোবাসলেনা কেনো বলো তো নিশাদ?
নিশাদ উত্তর দিলো না।সে মিহির দিকে সুক্ষ্ম নজরে একবার তাকিয়ে আবারও থাই গ্লাস ঠেলে ব্যস্ত নগরী দেখতে লাগলো।চলন্ত গাড়ির দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো~ তোমার আর আমার পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন মিহি। আমার সাথে জরিয়ে তোমায় বরবাদ করতে চাই না। আমি যে প্রতিশোধের নেশায় মজেছি সেখান থেকে বেরোনো কষ্টসাধ্য। তোমায় আমি ভালোবাসি না। কিন্তু তোমার চোখের অশ্রু আমার সহ্য হয় না।আমাকে ভালোবেসে শুধু কষ্ট পাবে কিন্তু আমাকে পাবেনা। কাজ শেষ করে তোমায় তোমার দেশে পাঠিয়ে দেবো।এখানে তোমার ফেঁসে যাওয়ার রিস্ক আছে।

অন্ধকারাচ্ছন্ন রুম। আলোর কোনো অস্তিত্ব নেই।ফ্যান ঘুরে চলেছে তার নিজ গতিতে।বাহির হতে কিছুটা আলো অরিত্রিকার রুমে প্রবেশ করছে। রুমে মানুষের কোনো অস্তিত্ব আছে কি না বোঝার উপায় নেই। রুম জুড়ে পিনপিনে নিরবতা বহাল রয়েছে। অরিত্রিকা উদভ্রান্তের ন্যায় মেঝেতে বসে আছে চুপচাপ। দৃষ্টি তার দেয়ালের দিকে স্থির।আবছা আলোয় তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবুও অপলক চেয়ে নিজের মনে বিভিন্ন আকৃতি অনুধাবন করছে সেগুলোই দেয়ালে ফুটে উঠছে যেনো।মনের মাঝে একাকিত্ব হানা দিয়েছে অরিত্রিকার। মস্তিষ্কে সারহান নামক শ্যাম মানবের চেহারা,স্মৃতি জেঁকে ধরেছে জোকের মতো। অবাধ্য মন মানবটিকে কাছে পেতে চাইছে।পুরুষালী বক্ষে মাথা রেখে মনের কথা বলতে ইচ্ছে করছে? কিন্তু মানুষটি নেই। রাত বারোটা বাজে এখনো ঘুম মহাশয়ের আসার কোনো নাম নেই।আজও আসবে না হয়তো।নির্ঘুম রাত আজও কাটবে।

~অরিত্রিকা ঘুমিয়েছিস?
অরিত্রিকা সাদাতের কন্ঠস্বর শুনে নিজেকে স্বাভাবিক করে তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো~ নাহহ ঘুমাইনি। কেনো কি হয়েছে?
~দরজা খোল দ্রুত।
অরিত্রিকা হুর মুড়িয়ে উঠে দরজা খুলে দিলো।সাদাত রুমে ঢুকে বললো~লাইট অন কর। এমন মরা বাড়ির মতো রেখেছিস কেনো?
অরিত্রিকা রুমের লাইট অন করলো।সাদাত অরিত্রিকার চোখের দিকে খেয়াল করতেই আঁতকে উঠে বললো ~তোর চোখ এতো লাল হয়ে আছে কেনো? আবারও কেঁদেছিস?
অরিত্রিকা আমতা আমতা বললো~ আরে না। মাথা ব্যথা করছিলো। এখন বল কেনো এসেছিস?
সাদাত জিভে কামড় দিয়ে বললো ~ এই রে আসল কথা তো বলতে ভুলেই গেছি। তোর সাথে কথা বলবে। এই নে ফোন।
অরিত্রিকা সাদাতের হাতে ফোন দেখে বললো~ কে কল দিয়েছে?

~ভাই তোর সাথে কথা বলতে চায়।ফোন রাখ।কথা বলা হয়ে গেলে তোর কাছে রেখে দিস সকালে নিয়ে যাবো।
সাদাত অরিত্রিকার হাতে ফোন গুঁজে দিয়ে চলে গেলো।অরিত্রিকা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে।কল রিসিভ করা হয়েছে প্রায় আধা ঘণ্টা আগে। হয়তো সাদাতের সাথে কথা বলেছে মানবটি।অরিত্রিকার এখন কাঁদতে ইচ্ছে করছে।রাগে,অভিমানে কান্না ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে আসছে। কথা বলতে চায় না সে পা/ষন্ড পুরুষের সাথে। পনেরোদিন পর তার কথা মনে পরলো?বুকের মাঝে অসহনীয় ব্যথা হচ্ছে, শ্বাস আটকে আসছে। গাল বেয়ে বিন্দু বিন্দু অশ্রু কণা গাল বেয়ে পরছে।মনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে অশান্ত মনকে শান্ত করতে ফোন কানে রাখলো অরিত্রিকা।
ফোনের অপর পাশ হতে শীতল কন্ঠ ভেসে আসলো~ কান্নাকাটি করছিস কেনো? সবাই তো বাড়িতেই আছে তাও মন খারাপ করে আছিস? নিজেকে রুম বন্দি করে রাখছিস কেনো? উত্তর যেনো পাই।বাড়িতে নেই তবুও বাড়ির সকল খবর আমার কাছে থাকে।
অরিত্রিকা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বললো~ আপনাকে বলবো না।

~ঠিক আছে বলতে হবে না।একটা কাজ কর যার ওপর অভিমান করেছিস তার নাম্বারে অভিমান করার কারণটা লিখে সেন্ড করে দিস। দেখবি ভালোলাগবে।আমি জানি কোনো মানুষের জন্যই নিজের বেহাল অবস্থা করেছিস।
অরিত্রিকা বিস্ময়ে থ হয়ে গেলো।কিভাবে বুঝলো সে অভিমান করেছে?
সারহান ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো~ তোর হাতে সময় আছে পাঁচ মিনিট যা বলার বলে ফেল। এরপর কল দিলেও পাবি না।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ২৪

অরিত্রিকার সব তালগোল পাকিয়ে গেলো।কি বলবে সে।মনের মাঝে অনেক কথা আছে সেগুলো বলবে কি? নাকি অভিমান কেনো করেছে বলে দিবে?সারহান ভাই কি তবে বুঝতে পেরেছে তার ওপরই অরিত্রিকা অভিমান করেছে।মন বলছে বুঝেছে মানুষটা। অরিত্রিকার বুকের মাঝে যেনো তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।
অরিত্রিকা মনে থাকা সকল কথা ভুলে শুধু মিহি কন্ঠে আওড়ালো~ আপনি কবে আসবেন সারহান ভাই?
তখনি জবাব এলো না।অরিত্রিকা ফোন চেক করলো। নাহ কল কাটেনি এখনো। লাইনে আছে সারহান ভাই।
সারহান কিয়ৎ চুপ থেকে জবাব দিলো~ খুব শীঘ্রই।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ২৬