প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ৩৯
আদ্রিতা নিশি
অরিত্রিকা সকাল হতে আজ ভীষণ ব্যস্ত। নিজের প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র, জামাকাপড় সারহানের রুমে এনে হাজির। এখন থেকে এই রুমটাই তো তার। অরিত্রিকা শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুছে নিজ মনে কাজ করে চলেছে।বিছানার ওপর তার জামা কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।একটা জিনিসও নিজ জায়গায় নেই।সে ঠিক করেছে আজ সব নিজের মতো সাজাবে।এলোমেলো রুম তাতে কি? সেদিকে তার খেয়াল নেই। অরিত্রিকা সারহানের আলমারি খুললো।আলমারি লক করা নেই তাই খুলতে বেগ পেতে হলো না তার। পুরো আলমারি জুড়ে সারহানের জামাকাপড় রাখা। সে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো। ঝটপট সারহানের জামাকাপড় একপাশে গুছিয়ে রেখে নিজের জামা কাপড় অপর পাশে গুছিয়ে রাখতে লাগলো।
সারহান রুমে ঢুকতেই কপালে ভাজ পরলো। তার রুমের একি অবস্থা। পুরো রুম এলোমেলো হয়ে আছে।মনে হচ্ছে রুমে যুদ্ধ হয়েছে। সে কিছুটা এগিয়ে আসতেই দেখতে পেলো অরিত্রিকা বাড়ির সুশীল বউয়ের ন্যায় নিজের জামা কাপড় গুছিয়ে আলমারিতে রাখছে। সে গিয়ে পেছনের দিকটায় দাঁড়ালো বুকে হাত গুজে।সরু চোখে অবলোকন করছে সবটা। সে জানতো অরিত্রিকা হয়তো কোনো কাজ সুন্দর গুছিয়ে করতে পারে না। কিন্তু তার ধারণা ভুল। নিজের চোখেই দেখছে সবটা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সারহান বিছানায় বসে পরলো। গলা ঝেড়ে বললো~ এগুলো কি হচ্ছে? আমার রুমের বেহাল দশা কেনো?
অরিত্রিকা হঠাৎ সারহানের কন্ঠস্বর শুনে চমকে পেছনে তাকালো।অনেকটা ভয়ও পেয়েছে।সে দেখলো সারহান তার দিকে ভ্র যুগল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। সে তো কাজে মগ্ন থাকায় বুঝতেই পারেনি কখন সারহান এসেছে।
অরিত্রিকা বুকে ফুঁ দিয়ে বললো~ আপনি তো আমায় ভয় পাইয়ে দিয়েছেন সারহান ভা….
সারহান অরিত্রিকাকে থামাতে বলে গুরু গম্ভীর কণ্ঠে উঠলো~ এই কারণেই কাজিনকে বিয়ে করতে নেই। কোনো কথা বলার সময় হাসবেন্ডকে ভাই বানিয়ে দেয়।
অরিত্রিকা মুখ গোমড়া করে বললো~ এতো দিনের অভ্যাস কি সহজে যায়? এটা ঠিক হতে আমার সময় লাগবে।
সারহান ব্যঙ্গ করে বললো~ হুমম সময় নিতে থাক। এমন না হয় আমাদের সন্তান হওয়ার পর তোর এই ভাই ডাকার চক্করে আমায় না নিজের সন্তানই মামা ডেকে বসে।
অরিত্রিকার লজ্জা লাগলো শুনে। বারবার মুখ ফসকে ভাই বলে ফেলে সে।
অরিত্রিকা লজ্জা ভাব নিয়ে বললো ~ আচ্ছা আর হবে না। এবার থেকে খেয়াল রাখবো।
সারহান বললো~ মনে থাকে যেনো। বাড়ির সবার সামনে ভাই ডেকে বসিস না আবার। তাহলে আর আমার প্রেস্টিজ থাকবে না।
অরিত্রিকা মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে আবার কাজে লেগে পরলো। সারহানের অগোচরে লাজুক হাসতে লাগলো।
সারহান অরিত্রিকার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।হালকা গোলাপী রঙা শাড়ি পরেছে অরিত্রিকা।চুল খোলা।পুরো পিঠ জুড়ে কৃষ্ণ বর্ণের চুলগুলো ছড়িয়ে আছে।চুলগুলো কোমড় ছাড়িয়েছে। গোলাপী শাড়িটা যেনো খুব করে মানিয়েছে মেয়েটাকে। ছোট বাচ্চার ন্যায় মেয়েটাকে আজ বউ বউ লাগছে। সারহানের চোখে মুগ্ধতা ছেয়ে আছে।বিমোহিত হয়েছে তার অর্ধাঙ্গিনীর বউরুপ দেখে। তার একান্ত সুখ। মনের মাঝে শীতল হয়ে আসছে অজানা ভালোলাগায়। ভালোবাসার মানুষটির স্নিগ্ধ রুপ বক্ষ পিঞ্জরে আঁচড় কেটে যাচ্ছে।
সারহান অতি শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো~ তোকে শাড়ি পরিহিত দেখে কেমন লাগছে জানিস?
অরিত্রিকা তার জামা আলমারিতে রেখে পিছু ফিরে বললো ~ কেমন লাগছে?
সারহান মৃদু হেসে মুগ্ধ স্বরে বললো~ আমার বউ বউ লাগছে।
অরিত্রিকা থমকে গেলো।সে স্থির নয়নে অবাক হয়ে সারহানের দিকে তাকালো।সারহান এখনো তার দিকে ওষ্ট কোণে হাসির রেখা টেনে তাকিয়ে আছে বিমোহিত হয়ে। অরিত্রিকার বুকের মাঝে ধুকপুক ধুকপুক করছে। শরীর শিরশির করে উঠলো। ” আমার বউ বউ লাগছে।” কথাটি বাজতে লাগলো কানে। সে তার কল্প পুরুষের বউ। আর ভাবতে পারছেনা সে। লজ্জায় তাকে আড়ষ্ট করে ফেলেছে।
সারহান বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। হাতে থাকা ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। দশটা বেজে গেছে। পার্টি অফিসে যেতে হবে তাকে।সে শার্ট ঠিক করে নিয়ে আয়নায় দেখে নিলো সব ঠিকঠাক আছে কিনা? অরিত্রিকা চুপ করে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো সে।
সারহান অরিত্রিকার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে কোমল বললো~ এইভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে হাসবেন্ডকে হেল্প কর।
অরিত্রিকা ভাবনা বাদ দিয়ে নড়ে চড়ে উঠে বললো~ কি হেল্প?
সারহান বললো~ আমার ফোন এনে দে।
অরিত্রিকা তড়িঘড়ি করে বালিশের পাশ হতে ফোন দিতে যাবে এমন সময় সিম কোম্পানির মেসেজ আসলো। সে ফোনের দিকে একপলক তাকিয়ে চমকে উঠলো।
সারহান শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো~ কি হলো। দে।
অরিত্রিকা ফোন সারহানের দিকে বাড়িয়ে দিলো।সারহান দ্রুত ফোন পকেটে পুরে নিলো।
সারহান বললো~ সাবধানে থাকবি। আমার আসতে এগারোটা বাজতে পারে। ততক্ষণ ইশরার কাছে থাকিস।
সারহান রুম থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় অরিত্রিকা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো~ আপনার ফোনে আমার শাড়ি পরা আগের ছবি ওয়ালপেপার দেওয়া কেনো? এটা তো আমি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে তুলেছিলাম।আপনি কোথায় পেলেন?
সারহান পিছু ফিরে তাকালো।অরিত্রিকার দিকে। সে শীতল কন্ঠে বললো~ যে আমার মনে সবসময় বিরাজ করে তার ছবি ফোনের ওয়ালপেপারে থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর তোর ছবি আমার ফোনে ছিলো। সাদাত আমার ফোন দিয়ে তোর ছবি তুলেছিলো। আরও অনেক ছবি আছে সেইদিনের।পেইনড্রাইভে আছে ওগুলো।
অরিত্রিকা বিস্মিত হয়ে বললো~ আড়াইবছর আগের ছবি এখনো রেখে দিয়েছেন?
সারহান স্বাভাবিক ভাবে বললো~ আমার পরিবারের সকল সদস্যদের ছবি আমার কাছে আছে। সেই হিসেবে তোর ছবিও ছিলো।
অরিত্রিকা বললো~ ওহহ।
সারহান বললো~ আসছি।
অরিত্রিকা মুচকি হাসলো শুধু।
———————
অরিত্রিকা রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সাথী বেগম রান্না করছেন রাতের জন্য। তানিয়া বেগম সাহায্য করছেন। অরিত্রিকা কীভাবে রান্না করছে তা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে।
তানিয়া বেগম তরকারির ধুতে ধুতে হেসে বললেন~ আমার পুত্র বধু আজ হঠাৎ রান্নাঘরে যে?
অরিত্রিকা লজ্জা পেলো। সে হেসে বললো~ বড় মা তুমিও না? আমি তো এমনি দেখতে এলাম কি কি রান্না করছে?
সাথী বেগম মেয়েকে বললেন~ মা জননী অন্যদিন তো রান্নাঘরের আশেপাশেও দেখিনা আপনাকে।
অরিত্রিকা মুখ কাচুমাচু করে বললো~ অন্যদিন না আসলে কি হয়েছে আজ তো এসেছি।
তানিয়া বেগম তরকারির ধুয়ে বললেন~ তা বেশ করেছো। আমায় বড় মা বললি? ভুলে যাস না আমি তোর মা হই এখন।এখন থেকে মা বলে ডাকবি আমায়।
অরিত্রিকা আস্তে করে বললো~ ঠিক আছে।
তানিয়া বেগম বললেন ~ সাদাত আর ইশরার কাছে যা রান্নাঘরে থাকার দরকার নেই।
অরিত্রিকা চুপচাপ ডাইনিং রুমে সোফায় বসলো।ইশরাও তার পাশেই বসা।
অরিত্রিকা ইশরাকে বললো~ মাথা ব্যথা কমেছে? সকালে তো অনেক ব্যথা করছিলো?
ইশরা বললো~ হুমম। ঔষধ খেয়েছি তাই কমেছে।
অরিত্রিকা একটু রেগে বললো~ ওই নিশাদের বাচ্চার জন্য আজ তোর এই অবস্থা। একবার হাতের কাছে পেলে নাক ফাটিয়ে দিতাম। শয় তান লোক কোথাকার।
সাদাত সায় জানিয়ে বললে~ আমিও। এতো বড় সাহস ওর। আমি তো ভাবতেই পারছিনা ওই নিশাদের মনে এসব ছিলো।
অরিত্রিকা বললো~ আমিও। আমি তো ভেবেছিলাম আমার পিছু ছেড়ে দিয়েছে।
ইশরা মলিন স্বরে বললো~ আমি তো ভেবেছিলাম ম রেই যাবো।
অরিত্রিকা ধমকে বললো~ এসব বলিস কেনো? মুখে ভালো কথা নাই?
ইশরা হেসে বললো~ আছে তো।
~ সারহান ভাই ওই নিশাদকে যে মার মে রেছে। আহ! একদম পিটিয়ে সোজা করে দিয়েছে। সেই দৃশ্য কল্পনা করতেই মন জুরিয়ে যায়।
সাদাত আর ইশরা অবাক হয়ে বললো~ সার হান ভাইইইই।
অরিত্রিকা জিভ কাটলো।
সাদাত বড়দের মতো ভাব নিয়ে বললো~ নিজের হাজবেন্ডকে কেউ ভাই বলে?
অরিত্রিকা বললো~ আরে ভুলে বলে ফেলেছি। আগে তো এইনামেই ডাকতাম। বুঝতে পারছিনা কি বলে ডাকবো।
ইশরা ভাবুক হয়ে বললো~ মুভিতে দেখেছি হাজবেন্ডকে ওগো, কি গো, এই যে শুনছো এমন করে ডাকে। তুইও ট্রাই করতে পারিস।
অরিত্রিকা মুখ কুঁচকে বললো~ এগুলো বলে কেউ ডাকে?
সাদাত ইশরার কথা শুনে হেসে উঠলো।
ইশরা চোখ বাঁকিয়ে বলে উঠলো ~ এই হাসছিস কেনো?
সাদাত হাসতে হাসতে বললো~ ওগো, কি গো এগুলো শুনে। অদ্ভুত ডাক সব।
অরিত্রিকা হতাশ হয়ে বললো~ তাহলে নাম ধরে ডাকবো?
সাদাত বলে উঠলো~ এই না। দেখা যাবে তোকে না বেয়াদব বলে চড় মে রে দেয়।
অরিত্রিকা ভ্রুর কুঁচকে বললো~ আমায় রেসপেক্ট দিয়ে কথা বলো দেবরজি। ভুলে যেওনা আমি তোমার ভাবি হই।
সাদাত চোখ গোলগোল করে অরিত্রিকার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। ইশরাও মিটিমিটি হাসছে।
সাদাত অবাক হওয়ার ভান করে বললো~ তাই নাকি ভাবি জি।
অরিত্রিকা হেসে বললো~ জি।
সাদাত হু হা করে হেসে উঠলো।ইশরাও যোগ দিলো হাসায়।
——————–
সারহান বাড়ি ফিরেছে একটু আগে। রাজনৈতিক কাজের চাপে সারাদিন কিভাবে পার হয়ে গেলো বুঝে উঠছে না সে।তার ওপর আবির দলের কয়েকজনের কাছে আটকদের বিষয়টা জানিয়ে দিয়েছে। সবাই অভিনন্দন জানিয়েছে। সে আকদের বিষয়টা পাবলিক করতে নিষেধ করেছিলো। কিন্তু আবির বলে দিয়েছে। এতেই বিরক্ত হয়েছে সে। এতো কাজের চাপে ভুলেই বসেছিলো সে এখন বিবাহিত। বাড়িতে নতুন বউ আছে। বাড়ি ফেরা দরকার।
সারহান ফ্রেশ হয়ে ডিভানে বসলো। মাথা ব্যথা করছে তার।অরিত্রিকাকে কফি আনতে পাঠিয়েছে সে। অরিত্রিকা কফি হাতে প্রবেশ করলো তখনই।দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো সারহানের দিকে। সারহানের সামনে কফির মগ বাড়িয়ে দিলো। সারহান মগ্ন হাতে নিয়ে কফিতে চুমুক দিলো।
অরিত্রিকা তখনই গদগদ ভাব নিয়ে বললো ~ ওগো শুনছো! কফিটা কেমন হয়েছে গো?
সারহান অরিত্রিকার সম্বোধন শুনে কেশে উঠলো। অরিত্রিকা চমকে গিয়ে বললো~ ওগো কি হলো তোমার? হঠাৎ গলায় কফি আঁটকে গেলো কিভাবে?
সারহান স্বাভাবিক হয়ে বিস্মিত হয়ে বললো~ এগুলো কি বলছিস তুই?
অরিত্রিকা শাড়ির আঁচল টেনে লাজুক হেসে বললো~ আপনাকে ডাকছি তো।
সারহান গম্ভীর কণ্ঠে বললো ~ এমন আজব নামে কে ডাকে?
অরিত্রিকা বললো~ মুভিতে তো এইভাবেই ডাকে।তাই তো বলছি। এখন তো ভা… মানে আগে যা বলতাম তা বলা যাবে না। তাই এগুলো বলছি।
সারহান চুপ করে গেলো। বিরক্ত হলো কিছুটা।এমন উদ্ভট নামে কেউ ডাকে?
অরিত্রিকা আবারও বলে উঠলো~ হে গো! আজ অনেক প্রেশার ছিলো বুঝি? বারোটা বাজলো যে আসতে?
সারহান গম্ভীর কণ্ঠে ছোট্ট করে উত্তর দিলো ~ হু।
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ৩৮
সারহানের মুখ গম্ভীর। ওগো, হে গো, শুনছো? এগুলো এখনকার দিনে কেউ বলে? কি বলবে তাও ওই বাংলা মুভি থেকে জানতে হবে? আজব কারবার।
সারহান ওসব আর না ভেবে কফি শেষ করে বললো~ কফিটা টেস্ট হয়েছে।
অরিত্রিকা বললো~ সত্যি বলছো গো?
সারহান দীর্ঘ শ্বাস টেনে বিরক্তি নিয়ে বললো ~ হুম।