প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে শেষ পর্ব
আদ্রিতা নিশি
দেড় মাস পর…….
দেখতে দেখতে পেরিয়েছে দিন, সপ্তাহ, মাস। নদীর স্রোতের ন্যায় চোখের পলকেই দেড় মাস পেরিয়ে গেছে। চৌধুরী বাড়ির সকলের জীবন নতুনধারায় চলছে। হাসি,আনন্দ মিলিয়ে দিন কাটছে তাদের। আজ রাজশাহী “১” আসনের ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্থগিত ভোট নতুন করে গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাক্তন এমপি মহোদয় মা রা যাওয়ার কারণে সারহান এমপি পদে নির্বাচন করে। ছাত্র রাজনীতিতে সুনাম কুড়িয়েছে অনেক আগেই। এখন জনগনের পরিচিত মুখ হওয়ায় আর সকলের ভালোবাসার জন্য বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে । দলের সকলের মুখে ফুটে উঠেছে হাসি। যোগ্য প্রার্থীকে জনসেবা করার জন্য নির্বাচিত করতে পেরে সাধারণ মানুষসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ আজ আনন্দিত।
টিভির হেডলাইন জুড়ে রাজশাহী “১” আসনের নব নির্বাচিত এমপি সারহান ইদায়াত চৌধুরীর নাম দেখাচ্ছে। টিভির এককোণে হাস্যরত ছবিও দেখা যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের নেতা, আইডল হিসাবে অনেকে সম্বোধন করছেন। বিভিন্ন স্থানের ভোটের কেন্দ্রের ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। ভোট কেন্দ্রে কোথাও কোনো উশৃঙ্খলতা সৃষ্টি হয়নি। ভোট সুন্দর ভাবে হয়েছে। কোনো দুর্নীতি হয়নি বলে পুলিশ মিডিয়াকে বলেছেন। সাংবাদিকরা দলের বিভিন্ন নেতার কাছে তাদের মতামত জানতে চাইছে। সকলেই হাসিমুখে নিজেদের আনন্দ প্রকাশ করছে।ইতোমধ্যে সারহানের এমপি জয়লাভের জন্য রাত এগারোটার পরেও আনন্দ শোভাযাত্রা করছে অনেকেই। তরুণরা বেশী উচ্ছ্বসিত হয়ে আছে প্রিয় নেতাকে এমপি হিসেবে পেয়ে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরশাদ সাহেব আর আজমল সাহেবের মুখে প্রাপ্তির হাসি। দুজনেই ভোটের শেষ খবরাখবর দেখছেন। রাজনৈতিক নেতাদের মুখে সারহানের প্রশংসা শুনে দুজনেই আনন্দিত অনেক। চৌধুরী বাড়ির বড় ছেলে রাজনীতিতে বড় একটা স্থান জুড়ে রয়েছে এতেই সকলে উচ্ছ্বসিত।
সাথী বেগম আরও তানিয়া বেগম সোফায় এসে বসলেন।তাদের মাঝে এখন স্বস্তি ফিরেছে। ভোটের কারণে সকলেই চিন্তিত ছিলেন সারহানকে নিয়ে। ভোট মানেই দ্বন্দ্ব, মা রামা রি, খু নাখু নি, বিশৃঙ্খলা, আতংক। কিছুদিন আগে সারহান এক জনসভায় গিয়েছিলো। সেখানে অপর দলের লোক এসে উগ্র ব্যবহার করে। পরিস্থিতি হাতের বাহিরে চলে গেলেই মা রামা রি শুরু করে দেয়।দু পক্ষের ঝামেলায় বেশ কয়েকজন আহত হয়। তাদের হাসপাতালে এডমিট করা হয়। সারহান কৌশলে নিজেকে এসবে জড়ায়নি। পরবর্তীতে তদন্তে জানা যায় সারহানকে হাম লা করা মূল উদ্দেশ্য ছিল অপরপক্ষের দলের। এসব নিয়েই বাড়ির প্রতিটি সদস্য চিন্তিত ছিলো। সারহানের সাথে তারাও সতর্ক থেকেছে।
আরশাদ সাহেব স্ত্রীকে দেখে হেসে বললেন~ দেখেছো আমার ছেলে এমপি হয়েছে।একেই বলে বাপ কা ব্যাটা।
তানিয়া বেগম ত্যাড়া স্বরে বললেন~ এখন তো আপনার ছেলেই হবে। অন্য কোনো দোষ দেখলেই তো বলতেন এটা তোমার ছেলে।
আরশাদ সাহেব কপাল কুঁচকে বললেন~ সবসময় এতো কথা জিলাপির মতো প্যাচাও কেনো?
তানিয়া বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললেন~ আপনি প্যাচান কথা আমি না।
আরশাদ সাহেব আর কিছু বললেন না তানিয়া বেগমকে। কিছু বললেই এখন রাগ করবে। আজমল সাহেব আর সাথী বেগম হাসছেন। ছোট বিষয় নিয়ে মাঝে মধ্যে এরকম ঝগড়া দেখতে হয় তাদের।
আরশাদ সাহেব বললেন~ বিয়াই সাব আপনার মেয়ের জামাই তো এমপি হয়ে গেলো মিষ্টির ব্যবস্থা করুন দ্রুত।
আজমল সাহেব তা শুনে হেসে উঠলেন। হাসি বজায় রেখে বললেন~ বিয়াই সাব তা আর বলতে হয় নাকি? আমি তো মিষ্টি আনতে বলেছি মজনুকে। কিছুক্ষণ পরেই মিষ্টি নিয়ে হাজির হবে।
~ বাহহ। ছেলের শ্বশুর তো বহুত ফাস্ট।
~ তা আর বলতে।
~ এইদিকে দলের নেতারা কল দিচ্ছে আমায়। সারহান নাকি কল তুলছে না। বারোটা বেজে গেছে ছেলেটা এখনো আসছে না কেনো?
~ চিন্তা করবে না। সারহান একটু ব্যস্ত আছে। একটু পরেই চলে আসবে।
~ ওহহ।
আরশাদ সাহেব অরিত্রিকাকে দেখতে না পেয়ে বললেন~ আমার মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছিনা। কোথায় সে?
সাথী বেগম বললেন~ ভাইজান আজ বিকেলে ইশরা এসেছে ওর সাথে আছে। ডেকে এসেছি এখনি আসবে দুজন।
আরশাদ সাহেব বললেন~ বুঝলাম। কিন্তু সাদাত কই? বিকেল থেকে তো দেখছিনা। আজ কতবার করে বললাম বাহিরে যাওয়ার দরকার নেই। বাহিরের ভোট কেন্দ্র ছিলো উত্তপ্ত। এই ছেলে একটা কথাও শোনে না।
সাদাত বাহির হতে বাড়িতে প্রবেশ করতেই বাবার কথা শুনলো। সে আসতে আসতে বললো~ আমার কথা বলছো?
সকলেই সাদাতের দিকে তাকালো।সাদাত হেলেদুলে এসে বাবার পাশেই বসলো।
আরশাদ সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন~ এতো রাতে কই থেকে আসছো?
সাদাত ক্লান্ত স্বরে বললো~ ভাই ডেকে ছিলো আমায়।
আরশাদ সাহেব সরু চোখে তাকিয়ে বললেন~ সারহান কেনো ডাকবে তোমায়?
সাদাত বললো~ একটা কাজ ছিলো। আমার আর ভাইয়ের ব্যাপার বুঝলে? এসব আমাকে না বলে ভাইকে জিজ্ঞেস করো।
আরশাদ সাহেব শুনে বললেন~ সারহান কোথায়?
~ ভাই বাহিরে দাঁড়িয়ে আবির ভাই আর ইনান ভাইয়ের সাথে কথা বলছে।
অরিত্রিকা আর ইশরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। অরিত্রিকা ডাইনিং রুমে চোখ বুলালো। সারহানকে না দেখে আশাহত হলো সে। মুখ ভার করে সে সবার কাছে এগিয়ে এলো। এই দেড়মাস সারহান রাজনৈতিক কাজে ভীষণ ব্যস্ত ছিলো। সকালে বাড়ি থেকে বের হতো রাত বারোটার পরে আসতো। অরিত্রিকা তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায় শ্যাম মানবের আসার প্রতীক্ষায় থাকতো।কখন আসবে মানবটি তাকে দেখে চক্ষু শীতল করবে সে। দীর্ঘ সময় পর প্রেমিক পুরুষের সাথে কথা বলবে সে।এই ভাবনা নিয়েই দিন পার হতো তার।
অরিত্রিকা আর ইশরা ডাইনিং রুমের একপাশে এসে দাঁড়ালো। সারহান তখনই প্রবেশ করলো। অনেকটাই ক্লান্ত সে। শুভ্র পাঞ্জাবি ঘর্মাক্ত শরীরে সুঠাম দেহী শরীরে আষ্টেপৃষ্টে লেগে আছে। কপালেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। চুল একটু অগোছালো। মুখ গম্ভীর। সারহান সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো পরিবারের সকলে হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে। তা দেখে সারহানের মুখ স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। সে এগিয়ে গেলো সবার দিকে। সে সবার কাছে যেতেই পরিবারের সকলে হাসিমুখে অভিনন্দন জানাতে লাগলো। আজমল সাহেব আর আরশাদ সাহেব সারহানকে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করছে। সারহানও উত্তর দিচ্ছে।
অরিত্রিকা সারহানকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে। মনে হচ্ছে কতোদিন পর মানুষটিকে দেখছে সে। সারহানের মুখ দেখে বিচলিত হলো মন। তার ইচ্ছে হচ্ছে সারহানের ঘর্মাক্ত মুখ শাড়ির আচল দিয়ে সযত্নে মুছে দিতে। নিজ ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখলো। অরিত্রিকার মনে হচ্ছে সারহান অনেক ক্লান্ত সে একপলক দেখে রান্নাঘরে শরবত বানাতে গেলো। সারহানের দৃষ্টিগোচর হলো না সে দৃশ্য। সব ক্লান্তি যেনো প্রশান্তির রুপ নিলো মুহুর্তেই।অব্যক্ত কথাও এক নিমেষে বুঝে নিয়েছে কেমন! অরিত্রিকা বয়সে ছোট হলেও তার ভালোবাসা অনেক দৃঢ়। তার মতো কঠোর মনের মানুষও অরিত্রিকার কারণে প্রেমিক পুরুষ হয়ে যায়।
—————-
আজ আকাশে চাঁদ উঠেছে। গোলাকৃতি থালার ন্যায় চাঁদের আকৃতি। চাঁদের আলোয় পুরো আকাশ আলোকিত হয়ে আছে। সেই আলো শহরকেও আলোয় পরিপূর্ণ করে তুলেছে। হালকা হাওয়া বইছে চারিদিকে। গাছগুলোও নড়ে উঠছে।
অরিত্রিকা ছাঁদে দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে। দৃষ্টি আকাশের পাণে। এক ধ্যানে চাঁদকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অবলোকন করছে। হালকা হাওয়ায় শাড়ির আঁচল থেমে থেমে নড়ছে। সারহান মহনীয় দৃষ্টিতে তার প্রেয়সীকে দেখতে ব্যস্ত। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় অরিত্রিকাকে স্নিগ্ধ গোলাপের ন্যায় লাগছে। সে যেনো এই রুপে বারবার মুগ্ধ হচ্ছে। মুগ্ধতার পরশে যেনো দীপ্তমান হচ্ছে বক্ষস্থল। মোহাচ্ছন্ন নয়নে দীর্ঘ সময় ধরে সে তাকিয়ে আছে। সে তো প্রিয় মানুষটির সৌন্দর্যে প্রেমে পরেনি। সৌন্দর্য দেখে কখনো প্রেম হয় না। মায়া থেকে সৃষ্টি হয় প্রণয়। প্রণয়ের আগমন যে কোনো মানুষের জীবনে হঠাৎ আসে।তখন থেকেই নতুন করে সবকিছু শুরু হয়।
অরিত্রিকা আকাশ হতে দৃষ্টি নামিয়ে সারহানের দিকে তাকালো। সারহানকে তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে ওষ্ঠ কোণে ফুটে উঠলো হাসি। প্রেমিক পুরুষের চাহনিতে এতো মুগ্ধতা! সেখানে নেই কোনো অন্য বাসনা। আছে শুধু ভালোবাসা,ভালোলাগা,মুগ্ধতা।
অরিত্রিকা ভ্রু নাচিয়ে মৃদু হেসে বললো~ কি দেখছেন এমপি সাহেব?
সারহানের ঘোর ভাঙলো যেনো। অরিত্রিকার বলা সম্বোধন তার কানে পৌঁছেছে। নতুন ডাক নামটা যেনো প্রেয়সীর মুখে সুমিষ্ট শোনালো যেনো।নতুন ডাক নামটা সারহানের অনেক বেশী ভালো লেগেছে।
সারহান স্বাভাবিকভাবে বসে চমৎকার হেসে বললো~ এমপি সাহেব তার স্নিগ্ধময়ী রুপে প্রেয়সীকে দেখছে।
অরিত্রিকা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। হাস্যরত ধ্বনি পুরো ছাদ জুড়ে প্রতিধ্বনিত হলো। সারহান অরিত্রিকার হাস্যরত মুখের দিকে বিমোহিত নয়নে তাকিয়ে রইল।
অরিত্রিকা হাসি থামিয়ে বললো~ প্রেয়সীকে আজ নতুন দেখছেন নাকি এমপি সাহেব?
সারহান ঠোঁট টিপে হেসে বললো~ প্রেয়সীকে তো এতোদিন দেখেছি কিন্তু নয়ন ভরে দেখতে পারিনি সময় স্বল্পতার কারণে। তাই আজ চন্দ্র বিলাসকে কাজে লাগিয়ে পুষিয়ে নিলাম।
অরিত্রিকা হেসে বললো~ তাই নাকি। আমি ভেবেছিলাম আপনি ব্যস্ততায় ভুলে বসেছেন বাড়িতে আপনার নব বিবাহিত বউ আছে।
সারহান শীতল কন্ঠে বললো~ আমার প্রিয়তম সুখ কে কখনো ভোলা সম্ভব না। তুই নামক সুখের কারণে আমি আজ পরিপূর্ণ। ব্যস্ত থাকলেও তোর অনুপস্থিতিতে আমার হৃদয়ে তুই বিচরণ করেছিস। মস্তিষ্ক জুড়ে তুই ছিলি। প্রতিনিয়ত মনে পরেছে তোকে। এক মুহুর্ত তুই ছাড়া থাকার কথা ভাবলে দমবন্ধ হয়ে আসে। তোকে এতোটা ভালোবাসলাম কি করে?
অরিত্রিকা লাজুক হেসে মিহি কন্ঠে বলে উঠলো~ জানি না।
দুজনের মাঝেই পিনপিনে নিরবতা বিরাজ করছে। দুজনের দৃষ্টি দুজনের দিকে আবদ্ধ। মৃদু শীতল হাওয়া দুজনকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সেদিকে কারো খেয়াল নেই। দুজনে নিজ মনে চলা নানা ভাবনায় বিভোর।
অরিত্রিকা দৃষ্টি ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলো~ আপনার আসতে এতো দেরি কেনো হলো আজ? আমায় তো সাড়ে দশটার সময় টেক্সট দিয়ে বলেছিলেন বাড়ি আসছেন।
সারহান অদূরে তাকিয়ে বললো~ থানায় গিয়েছিলাম।
অরিত্রিকা চমকে বললো~ থানায় কেনো?
সারহান বললো~ মিহিকে হেল্প করার জন্য গিয়েছিলাম।
অরিত্রিকা প্রথমে বুঝলো না। কিছুক্ষণ পর মিহির কথা মনে পরতেই বলে উঠলো~ মিহি আপু? ওই নিশাদের ফ্রেন্ড?
সারহান ছোট্ট করে বললো~ হুম।
অরিত্রিকা কিছুটা রেগে বললে~ আপনি তাকে কেনো হেল্প করেছেন?
সারহান অরিত্রিকার দিকে তাকালো।সে বুঝলো অরিত্রিকা রেগে গেছে। সারহান শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো~ সারহান কখনো কারো ঋণ অপূর্ণ রাখেনা। মিহির ক্ষেত্রেও তাই। মিহি আমাকে হেল্প করে ঋণী করে রেখেছিলো। আমি হেল্প করে সেই ঋণ পরিশোধ করেছি। ব্যস্ এতোটুকুই।
অরিত্রিকা গমগমে কন্ঠে বললো~ কিসের ঋণ? আর কি হেল্প করেছেন?
~ নিশাদ কিড ন্যাপ করেছিলো তোকে। ঝড়,বৃষ্টির কারণে পুলিশ বা আমার কোনো সোর্স আমি কাজে লাগাতে পারিনি। ভোরে দিকে থানা থেকে বের হয়ে নিশাদের বাড়িতে যাওয়ার পথে কেউ একজন আমায় কল করে। তুই কই আছিস সব ডিটেইলস বলে। আমি বিশ্বাস করিনি প্রথমে কিন্তু পরে হোয়াটসঅ্যাপ তোর পিক পাঠায়। আমিও শিউর হয়ে যাই তুই বগুড়া আছিস। তারপর কাহিনী সব জানা তোর। এবার বল কে কল করেছিলো?
~ কে কল করেছিলো?
~ কলটা মিহি করেছিলো।
অরিত্রিকা বাকরূদ্ধ হয়ে গেছে। এটা সে কি শুনলো। নিশাদের ফ্রেন্ড সকলের অগোচরে থেকে তাকে হেল্প করেছে। কিন্তু মিহি তো বলেছিলো ফোন নেই তার কাছে। সবকিছু গোলমেলে লাগছে তার কাছে।
~ মিহি আপু বলেছিলো ফোন নেই তার কাছে।
~ নিশাদের লোক বাহিরে ছিলো তাই বলেছে।সুযোগ পেয়ে কল করে বলেছিলো আমায়।
~ ওহ। তো মিহি আপুকে হেল্প করতে থানায় গিয়েছিলেন কেনো?
~ নিশাদের আজ জামিন হয়েছে। কিন্তু রাতে থানা থেকে মুক্তি পেয়েছে। জামিন আমি করিয়েছি নিশাদের।
অরিত্রিকা চোখ গরম করে বললো~ নিশাদের জামিন কেনো করালেন?আবার যদি একই ঘটনা ঘটনায়?
সারহান শান্ত কন্ঠে বললো~ উহু। এখন আর এমন কিছু করবে না। ঘরে বউ রেখে অন্য মেয়ের দিকে তাকালে বউ পিটিয়ে বাড়ি ছাড়া করবে।
অরিত্রিকা এক ধাক্কা খেলো।বউ মানে? নিশাদ বিয়ে করেছে?কখন?কাকে? অরিত্রিকা বিস্মিত হয়ে বললো~ বউ? নিশাদ ছাগল কবে বিয়ে করলো?আর কাকে বিয়ে করলো।
সারহান এই কথা শুনে হাসি আঁটকে বললো~ আজ মিহির সাথে নিশাদের বিয়ে হয়েছে। আমিও ছিলাম সেখানে। তাই বাড়ি আসতে দেরি হয়েছে।
অরিত্রিকা কথা বলতে ভুলে গেছে যেনো। মিহির সাথে নিশাদের বিয়ে? কিভাবে সম্ভব?
সারহান আবার বলে উঠলো~ মিহি নিশাদকে আগে থেকে ভালোবাসতো। নিশাদ জেনেও পাত্তা দেয়নি। মিহির ভালোবাসায় কোনো স্বার্থ ছিলো না তাই তো নিশাদকে সারাজীবনের জন্য পেয়ে গেলো। শুধু নিশাদের শ ত্রুতার কারণে কয়েকটা বাজে ঘটনা ঘটেছে।
অরিত্রিকা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো~ আপনি কি কেস তুলে নিয়েছেন?
সারহান ওষ্ঠ বাঁকিয়ে হেসে বললো~ নাহ। জামিন করিয়েছি শুধু। কেস চলবে। অপরাধের শাস্তি তো পেতেই হবে। আমার কলিজায় হাত দিয়েছে মাশুল তো গুনতেই হবে।
অরিত্রিকা জোরে শ্বাস টেনে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো~ ভালো হয়েছে বিয়ে হয়েছে। এবার বাহিরের কোনো মেয়ের দিকে তাকালেই মিহি আপু ঝাড়ু পেটা করবে।
সারহান কিছু বললো না আর। অরিত্রিকা নিশাদকে বকে চলেছে। তা সে শুনছে আর মনে মনে হাসছে।
★
অরিত্রিকা কিছুটা সময় পর দোলনা থেকে উঠে ছাঁদের রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সে খেয়াল করলো চাঁদের আলোয় হাতের আঙুলে থাকা স্বর্ণের আংটি চকচক করছে।স্পষ্ট মানুষের অবয়বও দৃশ্যমান হচ্ছে। তার হাতের তালুর রেখা গুলোও বোঝা যাচ্ছে। আশেপাশের সকল বিল্ডিংয়ে লাইট অফ করা।সকলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শুধু ঘুম নেই এক জোড়া কপোত-কপোতীর। তারা আজ নিজেদের প্রণয়ক্ষণ কাটাতে ব্যস্ত।
সারহান এসে অরিত্রিকার পাশে দাঁড়ালো। অরিত্রিকা বলে উঠলো~ আপনি আমায় এখনো তুই বলে ডাকেন কেনো? আগে তো ডেকেছেন ঠিক আছে। কিন্তু এখন তো আমাদের সম্পর্ক স্বামী স্ত্রীর।
সারহান অরিত্রিকার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি ফেলে তাকালো। বিচক্ষণতা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো এই কথার মর্মার্থ। কিছুটা ভাবতেই বুঝে ফেললো সে।
সারহান ভরাট কন্ঠে বললো~ কেনো তুই ডাক পছন্দ নয়?
অরিত্রিকার ভরকে গিয়ে বললো~ আমি কখন বললাম পছন্দ নয়?
~ তুই বলে সম্বোধন করি কারণ এটা একান্ত আপন লাগে আমার কাছে। তুই কাদের বলে জানিস? কোনো মানুষকে যখন খুব আপন ভাবে তখন তারা তুই বলে ডাকে? আর তুই তো আমার হৃদয়স্পর্শী প্রণয় সুখ। যাকে আমি আমার বক্ষ স্থলে আগলে রাখি সবসময়।এতোটা আপন বলেই তুই বলি তোকে। যদি সম্বোধন ভালো না লাগে চেঞ্জ করবো।
~ না না। আপনি আপনার মন মতো ডাকেন সমস্যা নেই।
অরিত্রিকা আজ খুশিতে আত্নহারা। কল্প পুরুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আজ সে ভাগ্যবতী। কতোজন নিজের ভালোবাসার মানুষকে পবিত্র ভাবে পায়! মাঝে মাঝে ভাগ্যবতী মনে হয় নিজেকে নিজের কাছে। ভালোবাসার মানুষটি যদি সঠিক হয় তাহলে জীবনসুখমিশ্রিত হয়। কিশোরী মনের ভালোবাসার মানুষটি তার পুরো জীবন ভালোবাসা,যত্নে মুড়িয়ে দিয়েছে। অরিত্রিকার ভাবনার মাঝেই সারহান অরিত্রিকাকে পেছন হতে জড়িয়ে অরিত্রিকার কাঁধ বরাবর চিবুক স্পর্শ করালো। অরিত্রিকার চমকে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো নিজেকে। চেনা স্পর্শে বুঝলো এটা সারহান।শীতল শিহরণ বয়ে গেলো রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
~ রাত তিনটা বাজে আর কতোকক্ষণ ছাঁদে থাকবি?ঘুম ধরেনি?
~ আর একটু থাকি?
~ আর বায়না না। নিচে চল। এতো রাত জাগতে নেই।
~ আর একটু থাকি প্লিজ।
সারহান অরিত্রিকার আহ্লাদী কথা শুনে চুপ করে গেলো। সে এই দেড়মাস অরিত্রিকাকে সময় দিতে পারেনি। আজ যেহেতু বায়না করছে তাই আর বারণ করতে মন চাইলো না তার। অরিত্রিকা হাস্যজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। চাঁদের আশেপাশে তাঁরার মেলা লেগেছে।অসংখ্য তাঁরা জ্বলজ্বল করছে। এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।সারহান আজ নিশ্চিত। অরিত্রিকাকে সে সময় না দিতে পারলেও রাত আসলে প্রেয়সীকে বক্ষে আগলে রেখে জড়িয়ে ঘুমায় নি এমন একটা রাত ও বোধহয় নেই। অরিত্রিকাও সংকোচ বিহীন তার কল্প পুরুষের বক্ষে মাথা রেখে ঘুমে বিভোর হয়ে যেতো সারহান অরিত্রিকার গালে অতি সন্তর্পণে ভালোবাসার পরশ একে দিলো।অরিত্রিকা হঠাৎ ছোঁয়াতে থমকে গেলো যেনো। সে ঘাড় বাঁকিয়ে সারহানের দিকে তাকালো। সারহানের ঠোঁটে হাসির রেখা।
সারহান অরিত্রিকাকে ছেড়ে দিয়ে বললো~ কি দেখছিস?
অরিত্রিকা বলে উঠলো~ আপনাকে।
সারহান ভাব নিয়ে বললো~ এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? আই নো আমি হ্যান্ডসাম। তাই বলে চোখ গিলে খাবি নাকি?
অরিত্রিকা চোখ ছোট ছোট করে বললো~ আমার বরকে আমি একশ বার দেখবো তাতে আপনার কি? আপনার অসুবিধে হলে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকুন।
সারহান হেসে ফেললো শুনে। অরিত্রিকার চঞ্চল ধাঁচের কথাগুলো ভালো লাগে শুনতে। এই একমাসে অভ্যাস হয়ে গেছে।
অরিত্রিকার গম্ভীর কণ্ঠে বললো ~ একটু নিচু হন।
সারহান ভ্রুযুগল কুঁচকে বললো~ কেনো?
~আমি বলেছি তাই।
সারহান কথামতো নিচু হলো একটু।অরিত্রিকা দু হাত সারহানের গালে রাখলো।এহেন কান্ডে বিস্মিত হলো সারহান। অরিত্রিকা কি করতে চাইছে বুঝতে পারছে না সে। এর আগে কখনো এমন কিছু করেনি অরিত্রিকা আজ হঠাৎ কি হলো?
অরিত্রিকার হাত কাঁপছে। এই প্রথম সে সারহানের গাল স্পর্শ করেছে।ভেতরে ভেতরে সে অনেক নার্ভাস। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখছে।
অরিত্রিকা ওষ্ঠ ভিজিয়ে সারহানের চক্ষুদ্বয়ে তার দৃষ্টি রেখে মিহি কন্ঠে আওড়ালো~ আপনি আমার প্রিয়তম সুখ। আপনি হীনা আমি অপূর্ণ। আপনি নামক প্রণয়ে আসক্ত আমি। আপনাকে বড্ড ভালোবাসি। সারাজীবন আপনাকে ভালোবেসে যেতে চাই। এইভাবেই আমাকে ভালোবেসে আগলে রাখবেন আপনার বক্ষে। আমি প্রণয়ীনি হয়ে রয়ে যাবো আপনার সেই মনে মাঝারে। আমি আপনাকে বড্ড ভালোবাসি এমপি সাহেব। আমায় সারাজীবন ভালোবাসা, যত্নে আগলে রাখবেন তো? এভাবে ভালোবাসবেন তো এমপি সাহেব?
অরিত্রিকার কন্ঠে আকুলতা।মনে হয়তো তাকে হারানোর ভয় কাজ করছে। সারহানের কাছে কথাগুলো বড্ড করুণ শুনলো। বিচলিত হলো তার অন্তঃকোণ।
সারহান আবেশিত কন্ঠে বললো~ প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে এসে বুঝেছি তুই হীনা আমি অপূর্ণ।তুই নামক ব্যাধিতে ভুগেছি দিনের পর দিন। তুই নামক প্রণয়ে ডুবে কতো রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। সারাজীবন তোকে নিজের কাছে রাখতে চাই।ভালোবাসতে চাই।আগলে রাখতে চাই। তুই আমার হয়ে থাকিস আমি তোর হয়ে থাকবো। ভালোবাসি তোকে। তুই শুনছিস ফাইরুজ! এই গুরু গম্ভীর, রগ চটা, কঠিন মনের সারহান তোকে ভালোবাসে। বড্ড বেশী ভালোবাসে।
অরিত্রিকার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। সারহানের অনুভূতি তার কাছে অনেকটাই অপ্রকাশিত রয়ে যায়। সারহানের বলা একেকটা কথা বুকের মাঝে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। ভালোবাসলে প্রণয় দহনে পুড়তে হয় একটু হলেও। তার গাল গড়িয়ে পরলো অশ্রু। এ অশ্রু ভালোবাসার পূর্ণতার।অরিত্রিকা সারহানের গালে ঠোঁট ছোয়ালো। সারহান স্মিত হাসলো তা দেখে। অরিত্রিকা আবেগপ্রবণ হয়ে সারহানের বক্ষে মাথা রেখে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো।সারহানও প্রেয়সীকে দুহাতে আগলে নিলো। অরিত্রিকা নিরবে অশ্রু ফেললেও সারহান বুঝলো অরিত্রিকা আবেগপ্রবণ হয়ে কান্না করছে। এতে মনের মাঝে অস্থিরতা কাজ করছে সারহানের। অরিত্রিকার কান্নায় বুকের মাঝে সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব হচ্ছে।সহ্য হচ্ছেনা প্রেয়সীর কান্না।তবুও চুপ রইল।
সারহান নিরবতা ভেঙ্গে বললো~ কি নিয়ে এতো আপসেট হয়ে আছিস?
অরিত্রিকা মলিন কন্ঠে বললো~ আপনি রাজনৈতিক কাজে জড়িত।আপনাকে নিয়ে আমি সবসময় টেনশনে থাকি। এখন আপনি এমপি হয়েছেন।এতেই আমার ভয়ের মাত্রা বেড়ে গেছে।প্রাক্তন এমপির কি হয়েছিলো বারবার মনে পরছে।আমি আপনাকে হারাতে চাই না।সারাজীবন আপনার সাথে থাকতে চাই।
সারহান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বোঝানোর স্বরে বললো~ আমার কিছু হবে না। উনার ভাগ্য খারাপ ছিলো তাই মা রা গেছেন। এটা নিয়ে আর টেনশন করিস না। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। যদি তোর সাথে জীবনের পথচলা সুগম হয় তাহলে আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না। এতটুকু ভরসা কর আমায়।
অরিত্রিকা মনোযোগ দিয়ে শুনলো শুধু। কিছুটা সময় পর ধীরে বলে উঠলো~ চলুন নিচে যাই।
সারহানের কর্ণকুহরে তা পৌঁছালো। সে তখনই এক মুহুর্ত দেরী না করে অরিত্রিকাকে কোলে তুলে নিলো। অরিত্রিকা ভয়ে সারহানের গলা জড়িয়ে ধরলো।
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ৩৯
অরিত্রিকা খিঁচে যাওয়া মুখে বললো~ আরেকটু হলেই পরে যেতাম তো।
সারহান প্রতিত্তোর করলো~ তোর এমপি সাহেব তোকে কখনই পরতে দিতো না।
অরিত্রিকা সারহানের পাণে সতৃষ্ণনয়নে তাকালো।ভয় কমে এসেছে তার।সারহান একপলক অরিত্রিকার ভীত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেলো সিঁড়ি ঘরের দিকে।অরিত্রিকা সারহানের গলা জড়িয়ে নিলো দুহাতে।