প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ৮
আদ্রিতা নিশি
~এই অরিত্রি গোলাপগুলো কই পেলি বলতো?
অরিত্রিকা চুল বাঁধতে বাঁধতে ইশরার দিকে তাকালো।ইশরা বিছানায় বসে আছে।সে গোলাপগুলো নিয়ে ফুলের সুবাস নিতে ব্যস্ত আবার কিছুটা ভাবুকও ।
অরিত্রিকা চুল বাঁধা শেষ করে হেয়ালি করে বললো~ বলতো কে দিয়েছে?
ইশরা ভাবুক হয়ে অরিত্রিকার দিকে তাকালো।অরিত্রিকা মিটিমিটি হাসছে।এই মেয়েও হয়েছে।সবসময় সন্দেহ করে।তার মনে হয় ইশরার ডাক্তার না হয়ে পুলিশ অফিসার হওয়া উচিত।সব জায়গায় রহস্য খুঁজে বেরাবে।
ইশরা অরিত্রিকাকে হাসতে দেখে তার সন্দেহ গাঢ় হলো।সে কিছুটা ভেবে বললো~ সারহান ভাইয়ের সামনে তোকে ফুল দেয়ার সাহস কেউ করবেনা এটা আমি জানি।তার মানে বাহিরের কেউ দেয়নি। তোর মামাতো ভাই ও দেয়নি এইটা আমি সিউর। তাহলে কে দিলো? সারহান ভাই আর তুই আমাদের অনেক পরে বাড়ি এসেছিস।তাহলে কি সারহান ভাই দিয়েছে?এটা কিভাবে সম্ভব?
অরিত্রিকা মুখ বেঁকিয়ে বললো~ উনি কেনো গোলাপ দিবেন আমায়?অপমান করেই কুল পায় না।
ইশরা অরিত্রিকাকে রাগানোর জন্য দুষ্টুমি হেসে বললো ~ দিতেও পারে। তোরা কিন্তু চাচাতো ভাই বোন।চাচাতো ভাই বোন হলেও কিন্তু প্রেম, বিয়ে দুটোই হয়।এই তুই আবার সারহান ভাইয়ের সাথে প্রেম করছিস না তো?ভাই এই কারণে হয়তো ফুল কিনে দিয়েছে।আমাকেও বললিনা তুই!
অরিত্রিকা ইশরার কথা শুনে মনে পরে গেলো সেই ফুল বিক্রেতা মহিলার কথা। ভাবতেই শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেলো। হৃদস্পন্দনের বেগ বেড়ে গেলো তার।এতোটা অশান্ত কেনো তার মন?সে তো সারহানকে অন্য কোনো নজরে দেখে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইশরা অরিত্রিকাকে অন্যমনষ্ক দেখে বললো~ এই তোর কি হয়েছে?আমি জানি তুই সারহান ভাইয়ের কথা ভাবছিস।
অরিত্রিকার খেয়াল হলো সে কার ভাবনায় বিভোর ছিলো? সারহান তাকে কাল রাতে পাগলী বলেছিলো আফ্রিদির সামনে তখনকার কথা মনে পরে গেলো।মুহুর্তেই রা গ চড়ে গেলো মাথায়।সে ইশরাকে বললো~ তোর সারহান ভাইয়ের সাথে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা নেই আমার। যন্ত্র মানব একটা।তুই যদি আর একটা কথা বলিস আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা।
ইশরা দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো ~আমি তো বলবোই। তুই যে সারহান ভাইকে শয়নে স্বপনে ভাবছিস এটা সাদাতকেও বলে দিবো।
অরিত্রিকা আর সেখানে না দাঁড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে আচমকা মার তে শুরু করলো।ইশরা বেচারী ভাবতেই পারেনি তার ওপর হঠাৎ হাম/লা হবে। সে আর দিশা না পেয়ে বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।অরিত্রিকাও কম কিসে? সেও বালিশ নিয়ে পিছু পিছু দৌড়াতে লাগলো।আজ সে ইশরাকে শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে।
সারহান ব্যস্ত ভঙ্গিতে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে রুম থেকে বেরোতেই দেখলো ইশরা এইদিকটায় দৌড়ে আসছে।তার পিছু পিছু বালিশ হাতে দৌড়ে আসছে অরিত্রিকা। ইশরা সারহানকে পাশ কাটিয়ে সাথী বেগমের রুমের দিকে দৌড়ে গেলো।সারহান বুঝলো দুটোতে কোনো কান্ড বাধিয়ে এখন যু দ্ধ করছে।ইশরা পালাতে পারলেও বিপত্তি বাঁধলো অরিত্রিকার ক্ষেত্রে। টাইলস যুক্ত মেঝেতে জোরে দৌঁড়ানোর কারণে তার পা পিছলে গেলো।সে ব্যালেন্স হারিয়ে পরেই যাবে এমন সময় কেউ তার হাত ধরলো।অরিত্রিকা নিজেকে বাঁচাতে ভীতিগ্রস্ত হয়ে সেই মানুষটির বাহু আঁকড়ে ধরলো।অরিত্রিকা এখনো হাঁপাচ্ছে। মেঝেতে পরলে এতোক্ষণে মাথা ফে টে যেতো।তখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে ছুটোছুটি করতে হতো।একটুর জন্য বেঁচে গেছে সে।
সারহান অরিত্রকাকে এখনো বাহু আঁকড়ে ধরে রাখতে দেখে গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে বললো~ এভাবে কি তোর সারাজীবন থেকে যাওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি?
পরিচিত গলার স্বর শুনে অরিত্রিকা চমকে চোখ তুলে শ্যাম মানবের দিকে তাকালো।দেখলো সারহান তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।এই দৃষ্টিতেই অরিত্রিকা ভড়কে গেলো।নিজের দিকে খেয়াল করতেই দেখলো সে সারহানের বাহু আঁকড়ে ধরে আছে।এতে সে লজ্জাবতী পাতার ন্যায় নেতিয়ে গেলো। অরিত্রিকা শ্বাস টেনে ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে সারহানের থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।
সারহান শার্ট টেনে ঠিকঠাক করতে করতে বিরক্তি নিয়েই বললো~ এটা বাড়ি নাকি চিড়িয়াখানা? বাঁদরের মতো সবসময় লাফাস কেন?এরপর থেকে আমার সামনে এমন দৌড়াদৌড়ি যেনো না দেখি।
অরিত্রিকা সংকোচ নিয়ে সারহানের দিকে তাকালো।আজ সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে মানুষটাকে ভালোই লাগছে।দেখে হার্টবিট ফাস্ট হয়ে গেছে। একজন্যই হয়তো মেয়েরা এই যন্ত্র মানবের ওপর ক্রাশ খায়। ছেলেদের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগে তার উদাহরণ সারহান।যে কোনো মেয়ে এমন সুদর্শন, সুঠামদেহী মানুষটিকে এক দেখায় পছন্দ করে ফেলবে।আজ তার কি হয়েছে?কখনো সে সারহানকে ভালোলাগার নজরে দেখেনি অথচ আজ সবকিছু অন্যরকম লাগছে।
অরিত্রিকাকে এক ধ্যানে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সারহান বিরক্তি নিয়ে বললো~ আমাকে জীবনে দেখিসনি?এমন ভাবে তাকিয়ে আছিস মনে হচ্ছে আমি কোনো আজব প্রাণী?
অরিত্রিকা আনমনে বলে উঠলো ~ আগে তো আপনাকে দেখেছি তখন তো ভালোলাগেনি অথচ আজ লাগছে কেনো বলুনতো?
অরিত্রিকা কথাটা ধীরে বলায় সারহান শুনতে না পেয়ে শুধালো~ কি বললি?
অরিত্রিকার খেয়াল হলো সে সারহানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুখ ফসকে কি বলে ফেলেছে।
~কিছু বলিনি।বলেই অরিত্রিকা সেখান থেকে দৌড়ে পালালো।
সারহান অবাক চোখে তাকিয়ে রইল অরিত্রিকার দিকে।মাঝে মাঝে এমন অস্বাভাবিক ব্যবহারের কারণ সে বুঝতে পারে না।
~মামু এবার যে কোনো মূল্যে তোমাকে ভোটে জিততে হবে। ওই এমপি যেনো এইবার না জিতে।
নয়ন তালুকদার নিশাদের রুমে বসে আছেন।তিনি ভাগ্নেকে দেখতে এসেছেন আজ।আরেকটা কারণও আছে সেটা হলো কিভাবে সারহানকে এমপির কাছে মিথ্যাবাদী বানানো যায় তার পরিকল্পনা করতে হবে। এমপি যদি সারহানকে ভুল বোঝে তাহলেই তাদের ভোটে জেতার থেকে কেউ আটকাতে পারবেনা।সারহানের রাজনীতিতে জনপ্রিয়তা অনেক।রাজশাহী সিটিতে তার নাম ডাক বেশী।সকলেই তাকে চেনে, ভালোবাসে।তিনি জানেন সারহান যদি এমপির হয়ে এভাবেই কাজ করতে থাকে তাহলে তারা ভোটে জিততে পারবেনা। নিশাদের আঘা তের ব্য থা এখনো আছেই।কোনো রকমে একটু হাঁটতে পারে সে।হাতে, কপালে এখনো ব্যান্ডেজ খোলা হয়নি।সারাদিন বদ্ধ রুমে বসে থাকাই তার কাজ।
নয়ন তালুকদার ভাবুক হয়ে বললেন ~ওই সারহানকে রাজনীতি থেকে কিভাবে ছুঁড়ে ফেলতে হয় তার পরিকল্পনা করা হয়েছে।কিন্তু সারহান খুবই ধূর্ত। ও কে এতো সহজে ধরাসই করতে পারবো বলে মনে হয় না।
নিশাদ নয়ন তালুকদারের কথা শুনে বললো~ সারহানকে একবারে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলে কেমন হয়? না থাকবে বাঁশ আর না বাজবে বাঁশি।
~তুমি কি পাগল হয়েছে? সারহানকে মে রে ফেললে সবাই বুঝে যাবে আমরাই মে রেছি।এতে সহজে ফেঁসে যাবো।
~আমায় একটু সময় দাও মামু। আমি কোনো প্ল্যান রেডি করি।তারপর দুজনে মিলে কাজ শুরু করবো। এবার বলো তোমাকে যে কাজটা করতে বলেছিলাম হয়েছে?
~খবর পেয়েছি রাতে। অরিত্রিকা কাল তার কাজিনদের সাথে পদ্মার পাড়ে ঘুরতে গিয়েছিলো।আর সব থেকে অবাক করা বিষয় হলো সেখানে স্বয়ং সারহান উপস্থিত ছিলো।ভাবতে পারছো? যে কখনো পাবলিক প্লেসে সহজে যায়না। সে সামান্য ঘুরতে যাওয়া কাজিনদের জন্য ওখানে চলে গেলো।আমার তো মনে হচ্ছে কোনো কারণ বশত গিয়েছিলো সেখানে। আমাদের লোক যে তাদের ওপর নজর রাখছে জানতে পারেনি তো?
~ জানতে পারলে এতোক্ষণে লোকগুলো সুস্থ থাকতোনা। সবগুলো হাসপাতালের বেডে থাকতো। হয়তো জানতে পারেনি। কারণটা নিশ্চয়ই অন্যকিছু। উম,তুমি এসেই বললে সারহানের সাথে দেখা করতে যাবে।তো কখন যাচ্ছো?
~ হুম যাবো। শুনলাম বিকেলে রাজশাহী ভার্সিটিতে যাচ্ছে। আমিও সেখানেই যাবো ভাবছি।
~ইফা আপু কেমন আছো তুমি?
অরিত্রিকা তার মামাতো বোনকে উচ্ছসিত হয়ে জড়িয়ে ধরে বললো।ইফাও অরিত্রিকাকে জরিয়ে ধরে বললো~ আমি খুব ভালো আছি।তুই কেমন আছিস?
~আমিও ভালো আছি।আমি তো ভেবেছিলাম তুমি বিকেলে আসবে?
~ সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য আগে এসেছি।
অরিত্রিকার মামি আর মামাতো বোন এসেছে একটু আগেই। আজ বিকেলে আসার কথা থাকলেও তারা সকালেই চলে এসেছে তাদের না জানিয়ে। অরিত্রিকার মামী বললো~ আমিও এসেছি।বোনকে পেয়ে আমাকে ভুলেই গেলি।
অরিত্রিকা ইফাকে ছেড়ে দিয়ে হেসে বললো ~তুমিও না মামী।তোমায় কি ভুলতে পারি? এবার বলো কেমন আছো তুমি?
~ আমি অনেক ভালো আছি।তুই কেমন আছিস?
~আমিও ভালো আছি।
সাথী বেগম কথোপকথনের মাঝেই সেখানে হাজির হলেন। মিতা বেগমকে সালাম দিয়ে বললেন~কেমন আছেন ভাবী?
~আমি ভালোই আছি। তুমি কেমন আছো?
~আলহামদুলিল্লাহ ভালো। রাস্তায় আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
~নাহহ তেমন কিছু হয়নি। বড় বাঁদরটা কোথায় আছে দেখতে তো পাচ্ছিনা।
অরিত্রিকা বুঝলোনা কাকে বাঁদর বলা হচ্ছে?এখানে বাঁদর কই থেকে এলো।সাথী বেগম বুঝতে না পেরে বললেন~ ভাবী কাকে বাঁদর বলছেন?
ইফা হেসে বলে উঠলো ~ মা ভাইয়াকে মাঝে মাঝে বাঁদর বলে ডাকে।
এই কথা শুনে সকলেই হেসে উঠলো।সাথী বেগম হাসতে হাসতে বললেন~ আপনার বাঁদর এখনো ঘুমুচ্ছে।
মিতা বেগম কপাল চাপড়ে বললেন~ এই ছেলেকে নিয়ে আর পারিনা। এতোক্ষণ কেউ ঘুমায়।
~ভাবী বাদ দেন এসব। আফ্রিদি ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। চলুন আমার সাথে। রুম দেখিয়ে দেই ফ্রেশ হয়ে নিন।
~চলো।
অরিত্রিকা তার মাকে বললো~ মা ইফা আপুকে আমার রুমে নিয়ে গেলাম।
~ঠিক আছে।
অরিত্রিকা ইফাকে বললো ~চলো আপু।
অরিত্রিকা ইফাকে নিজের রুমের দিকে নিয়ে গেলো।
ইফা হাঁটতে হাঁটতে অরিত্রিকাকে শুধালো ~আসার সময় একজন হ্যান্ডসাম ছেলেকে গেটের কাছে দেখলাম ওটা কে রে?
অরিত্রিকা ইফার দিকে তাকিয়ে বললো~ কোন ছেলে?
~ওই যে সাদা শার্ট পরে আছে।
অরিত্রিকা সাদা শার্টের মালিককে চিনতে পেরে বললো~ ও তুমি যন্ত্র মানবের কথা বলছো?
ইফা ভ্রু কুঁচকে বললো~ যন্ত্র মানব? এটা আবার কি?
~আরে আপু তুমি যাকে দেখেছো উনিই যন্ত্র মানব। যার মনে কোনো ভালোবাসা,ভালোলাগা নেই।উনি শুধু মানুষকে অপমান করেন। তুমি ভুলেও ওনার সামনে পরোনা। পরলেই অপ মান শুনতে হবে। যেমন আমি।আমার মতো নিরীহ বাচ্চা মেয়ে কেও ছাড় দেননা। কথায় কথায় অপ মান করেন। আর রা গের কথা বাদই দিলাম।রাগ লে মনে হয় সামনে যাকে পাবে খেয়ে ফেলবেন।তবে সহজে রাগেন না উনি। মুখ সবসময় গোমড়া করে রাখেন উনি।গোমড়া মুখো একটা।রষকষহীন কাঠখোট্টা মানুষ একটা।
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ৭
ইফা অবাক হয়ে বললো~ এমনও মানুষ আছে? কিন্তু উনি কে হন তোর?
অরিত্রিকা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো~ আমার বড় বাবার ছেলে উনি।সারহান ভাই উনার নাম।
~ ওহহ বুঝলাম।সারহান ভাই বলে ডাকবো? সারহান বললেই তো হয়।
~অপমা নিত হতে না চাইলে সারহানের পাশে ভাই বলতে ভুলো না।
ইফা আঁতকে উঠে বললো~ তুই এতো অপমান সহ্য কি করে করিস?
অরিত্রিকা হেসে বললো ~এক কান দিয়ে শুনি আর আরেক কান দিয়ে কথা গুলো বের করে দেই।