প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ১২

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ১২
আদ্রিতা নিশি

সময় নদীর স্রোতের ন্যায় বহমান। নদীর স্রোত যেমন কারো জন্য অপেক্ষা করেনা ঠিক তেমনই সময়ও কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। এর মাঝে পেরিয়েছে প্রায় এক সপ্তাহ। সকলে নিজেদের মতো নিজেদের জীবনে চলমান কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে। চৌধুরী দুই বাড়ির লোকজন বেশ ভালো সময় কাটাচ্ছেন। এর মাঝে আরশাদ সাহেব, তানিয়া বেগম, সাদাত, ইসমা বেগম ও ইশরা এসেছিল অরিত্রিকাদের বাড়িতে। দুইদিন আগে অরিত্রিকার বন্ধুমহল এসেছিল। কিন্তু রুহান ছিল লাপাত্তা। সবাই মিলে অনেক আড্ডা দিয়েছে তারা। অরিত্রিকার সপ্তাহ খানেক বাড়িতে রেস্ট করার কথা থাকলেও তা অপমান্য করে ভার্সিটিতে যাওয়া আসা করছে। সেদিনের পর অরিত্রিকার সাহস হয়ে উঠেনি সারহানের সাথে কথা বলার আর না দেখা হয়েছে। আগের মতো জীবন চলছে তার যেখানে সারহান নামক কাঠখোট্টা, রগচটা মানুষটা কোথাও নেই। সবাই আগের মতো জীবনযাপন করছে। কিন্তু অরিত্রিকার জীবনে হঠাৎ পরিবর্তন এসেছে।

গোধূলি লগ্ন পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে ধরনীতে। সূর্য অস্তমিত প্রায়। পাখিরা নিজেদের নীড়ে ফিরছে। ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে মাত্র বাড়িতে ঢুকল অরিত্রিকা। ক্লান্ত শরীরে দুর্বল চিত্তে হেলেদুলে গুনগুন করতে করতে সদর দরজা পেরোয়। শুকনো বদন, ঢুলুঢুলু চক্ষুদ্বয়ে আশে পাশে তাকাল। তাকাতেই চমকে গেল। আরে এটা তো তার বাড়ি নয়। ভুল করে কী অন্য বাড়িতে চলে এসেছে? সে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বাড়ির ভেতরটা। ক্লান্তি ভুলে চঞ্চল পায়ে পুনরায় সদর দরজার নেমপ্লেট দেখতে যায়। দুই চক্ষু বড় বড় করে নেমপ্লেটের নাম দেখতে থাকে। সেখানে লেখা : মোঃ আজমল চৌধুরী। নাহ, সে তো ঠিক বাড়িতে এসেছে। তাহলে বাড়ির ভেতর এতোটা অচেনা কেন। অরিত্রিকা ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে ভেতরে গেল। কিচেন, নিচের রুম গুলো পরখ করল সব ফাঁকা। বাড়ি খালি, জিনিসপত্র সব উধাও! মনে হচ্ছে একটা ফাঁকা বাড়িতে সে একা একা অবস্থান করছে। গা ছমছম করে উঠল। তাহলে কী বাড়িতে চুরি হয়েছে? ভাবতেই গলা শুকিয়ে গেল। উপর তলা থেকে ধপধপ শব্দ আসছে। মনে হচ্ছে কেউ আছে। সে সাহস নিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা স্টিলের লাঠির ন্যায় কিছু একটা তুলে নিয়ে দ্রুততার সহিত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। নিশ্চয়ই বজ্জাত চোর ওপরের তলার জিনিস প্যাক করছে তবে এবার আর পালাতে পারবেনা। কারণ সে লাঠি দিয়ে বেদম কেলানি দেবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরিত্রিকা শঙ্কিতবদনে পা টিপে টিপে তার রুমের দরজার দিয়ে তাকাল। দরজা আধখোলা থাকায় ভেতরে কয়জন আছে তা বোঝা মুশকিল। সে লম্বা শ্বাস নিল। ভয়ে কাঁপতে থাকা বুকে পাথর চাপা দিল। সাহস সঞ্চার করে স্টিলের লাঠিটা শক্ত করে দুহাতে উঁচিয়ে ব্যাঙের ন্যায় লাফ দিয়ে রুমের ভেতরে প্রবেশ করল। চিৎকার করে বলল;
“ হারে রে রে রে! এবার চোর কোথায় পালাবি রে। ”
কথাটা শেষ করার সাথে সাথে পিছে দুরুম করে কিল বসিয়ে দিল। অরিত্রিকা ব্যথায় মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠল। হাতে থাকা স্টিলের লাঠিটি স্ব শব্দে মেঝেতে পড়ল। ব্যথায় কুঁচকে ওঠা মুখশ্রীতে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল মানুষটার দিকে। অরিন কটমট করে তাকিয়ে বলল;
“ আমাদের তোর চোর মনে হচ্ছে? ”
অরিত্রিকা বিস্ময়ে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। গোলগোল বিস্ফোরিত চক্ষুদ্বয়ে তাকাল অরিনের রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখের দিকে। পেছনের দিকটায় সাথী বেগম দাঁড়িয়ে আছেন কপাল কুঁচকে। লাগেজে জামা কাপড় গোছাচ্ছেন। অরিত্রিকা ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। সে বোকা বনে গেল। ভাবল কি আর এসে দেখল কি! হাত দ্বারা পিঠ নাড়তে নাড়তে রুমে চোখ বোলাতে লাগল। পুরো রুম ফাঁকা। সে তো ভেবেছিল বাড়িতে চোর ঢুকেছিল কিন্তু এসে দেখল বাড়ির মানুষ চোরের মতো কাজকর্ম করছে।
অরিত্রিকা কৌতুহল নিয়ে শুধায় ;

“ বাড়ির রুম গুলো ফাঁকা কেন? রুমের আসবাবপত্র কোথায়?”
অরিন মুখ বাঁকিয়ে বলে ;
“ আইছে বাপ্পারাজের ফিমেল ভার্সন। ”
“ আগে বলো আমার রুমের জিনিসপত্র কোথায়?”
“ সব আসবাবপত্র ট্রান্সফার করা হয়েছে। ”
“ নাহ আমি বিশ্বাস করি না।”
অরিত্রিকা নাটকীয় ভঙ্গিতে উচ্চস্বরে বলল। অরিন ঝামটি মেরে বলল;
“ নাটক কম করো পিও। ”
অরিত্রিকার ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হলো। সে এবার কিছুটা সিরিয়াস হলো। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ;
“ আমরা কী অন্য কোনো জায়গায় সেটেল্ড হচ্ছি?”
“ হ্যা।”
“ কোথায়?”
“ চৌধুরী নিবাসে। ”

অরিত্রিকার কর্ণকুহরে কথাটা প্রবেশ করতেই হতবিহ্বল হয়ে গেল। মুখশ্রী অস্বাভাবিক কঠোর এবং মলিন হয়ে উঠল। অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকাল অরিনের দিক। দুই কদম এগিয়ে গিয়ে মলিন মুখে বলল;
“ তুমি আমার সাথে মজা করছো আপু? ”
“ নাহ।”
“ হঠাৎ ওই বাড়িতে কেন যাচ্ছি। ”
“ বাবার সিদ্ধান্ত এটা।”
অরিত্রিকা নিজেকে স্বাভাবিক করল। শান্ত কন্ঠে বলল ;
“ আব্বু বলেছিল আমরা আর ওই বাড়িতে ফিরব না। ”
অরিন বিরক্তি প্রকাশ করে বলল;
“ তোর ব্ল্যাকমেইলের কারণে এসব ছেলে ভোলানো কথা বলেছিল। ”
“ আপু আমি ওই বাড়িতে যাবো না।”

অরিন কিছু বলতে যাবে এমন সময় সাথী বেগম রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন ;
“ আবার যদি আগের মতো নাটক শুরু করিস তাহলে কিন্তু তোকে রেখে চলে যাব।”
অরিত্রিকা চটে যায়। তিরিক্ষি মেজাজে বলে ;
“ ঠিক আছে। আমার জিনিসপত্র রেখে যাও আমি এখানেই একা একা থাকব। ”
অরিত্রিকার অবুঝের ন্যায় জেদ দেখে সাথী বেগম বেশ রেগে গেলেন। তিরিক্ষি মেজাজে বলল ;
“ দুগালে দুইটা থাপ্পড় মারলে সব জেদ পানি হয়ে যাবে বেয়াদব মেয়ে। একটু পড়ে গাড়ি আসবে আমাদের নিতে। ফ্রেশ হয়ে নাও দ্রুত। ”
অরিত্রিকা বিরক্তির সঙ্গে মুখ গোমড়া করে ধপধপিয়ে অন্য ঘরে চলে যায়। আবার সেই চৌধুরী নিবাসে যেতে হবে, আবার সেখানে থাকতে হবে এমন ভাবনায় তার রাগে-অভিমানে বুকটা কুঁচকে ওঠে। সারহান ভাইয়ের বকুনি, তিরস্কার, সেই চিরচেনা কঠোর আচরণ সবকিছু যেন নতুন করে দুঃসহ বাস্তবতা হয়ে সামনে দাঁড়িয়েছে। অপমানিত হতে হবে, সহ্য করতে হবে অবজ্ঞার তীর।এই জীবন থেকে মুক্তি নেই, এই আবদ্ধতা থেকে নিষ্কৃতি নেই।এ যেন চিরস্থায়ী শৃঙ্খল। এতদিন যে শান্তির জীবন গড়ে তুলেছিল, আজ তার ওপর যেন তালা পড়ে গেল। আর কোথাও নেই অবাধ স্বাধীনতা, নেই প্রশান্তির আশ্রয়। আছে শুধু এক ঘোরতর যন্ত্রণার যাঁতাকল। যেখানে তাকে পিষ্ট হয়েই থাকতে হবে।

চৌধুরী নিবাসে আজকে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। সব বয়সী মানুষদের মাঝে আমেজের ভাব। ছোট বড় সকলের হাসি ঠাট্টা-তামাশা বাড়িটা যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। দীর্ঘ দুই বছর পর চৌধুরী বাড়ির ছোট ছেলে এবং স্ত্রী, সন্তান নিয়ে পদার্পণ করেছেন। তাদের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন পদের খাবারের গন্ধে ম-ম করছে গোটা বাড়ি।
দীর্ঘ দিন পর লিভিং রুমে আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। এতোদিনের জমানো নানা কথায় আসর যেন জমে উঠেছে। তানিয়া বেগম, সাথী বেগম এবং অরিত্রিকার ফুফু ইসমা বেগম ড্রাইনিং টেবিলে খাবার সাজাচ্ছেন। অরিন, ইশরা এবং সাদাত ইশরার রুমে আড্ডা দিচ্ছে। অরিত্রিকা মুখ গোমড়া করে বাবা চাচার সামনের সোফায় বসে আছে লেভিকে নিয়ে। সে আদুরে ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কোলে শুয়ে থাকা লেভিকে। লেভিও মালকিনের আদরে যেন আরও আদুরে হয়ে উঠেছে। লেভি হলো অরিত্রিকার পোষা পার্সিয়ান বিড়ালের নাম।
“ আম্মা কোনো কারণে কি তোমার মন খারাপ? ”
আরশাদ সাহেবের কথা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অরিত্রিকার ধ্যান ভেঙে যায়। সে স্বাভাবিক ভাবে তাকায় সামনে। হালকা হেসে বলে ;

“ উহু মন খারাপ না। ”
আরশাদ সাহেব হাসলেন। বললেন ;
“ তুমি আসবে বলে তোমার রুমটা স্পেশাল করে ডেকোরেট করিয়েছি। পছন্দ হয়েছে? ”
অরিত্রিকা উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রত্যুত্তর করল ;
“ অনেক পছন্দ হয়েছে বড় বাবা। ডেকোরেশনটা জাস্ট ওয়াও হয়েছে। আইডিয়াটা কার? ”
“ সাদাতের। ”
“ আমি জানতাম। ”
বলেই হেসে দিল অরিত্রিকা। তানিয়া বেগম এর মাঝে লিভিং রুমে হাজির হলেন। সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন খেতে যাওয়ার জন্য। আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব আড্ডার সমাপ্তি ঘটিয়ে উঠলেন। অরিত্রিকা লেভিকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে ক্যাটফুড আনতে গেল।

ঘড়ির কাঁটায় বারোটা বেজে বিশ মিনিট। সকলে যে যার রুমে ঘুমে বিভোর। সারহান এখনো রাতে ফেরেনি। ছেলের জন্য লিভিং রুমে বসে অপেক্ষা করছেন তানিয়া বেগম। স্মার্ট টিভিতে নিউজ দেখছেন আজকের। প্রতিদিন তানিয়া বেগমের রাতের রুটিন সারহান আসা,অব্দি জেগে থাকা এবং নিজ হাতে খাবার বেড়ে খাওয়ানো। সারহানের প্রতিদিন আসতে গভীর রাত হয়। সকলে তখন গভীর ঘুমে মগ্ন থাকে। কিন্তু তানিয়া বেগমের মায়ের মন। ছেলে সারাদিন রাজনৈতিক কাজে থাকে কিন্তু বাড়ির কারো সাথে সময় কাটানোর সময় হয় না তাই সারহান রাতের খাবার খেতে খেতে মায়ের সাথে দুই চারটা কথা বলে নেয়।
অরিত্রিকা ঘুমুঘুমু চক্ষু ডলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেছে। মুখাবয়বে ফুটে উঠেছে বিরক্তিভাব। মাথা ব্যথায় জীবন আধমরা হয়ে যাচ্ছে। ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছিল কিন্তু তাও মাথা ব্যথা কমছে না। কফি বানিয়ে খেলে হয়ত মাথা ব্যথা থেকে নিস্তার পাবে সে। সিঁড়ি থেকে নেমে এলোমেলো পায়ে সোজা কিচেনের দিকে যেতে লাগল।

“ অরিত্রিকা এখনো ঘুমাসনি? ”
তানিয়া বেগমের কন্ঠ কর্ণকুহরে প্রবেশ করল। সে ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে তাকাল। তানিয়া বেগমকে সোফায় বসে থাকতে দেখে এগিয়ে গেল। ধপ করে বসে পড়ল তানিয়া বেগমের পাশে৷ মাথা ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে বলল;
“ মাথা ব্যথা করছে বড় মা।”
তানিয়া বেগম বিচলিত হলেন। হাতের উল্টো পিঠ দ্বারা অরিত্রিকার কপাল ছুঁয়ে দেখলেন। নাহ! জ্বর আসেনি। তিনি হাত নামিয়ে বললেন ;
“ মাথা ব্যথা করছে আগে বলিসনি কেন? ঔষধ খেয়েছিস?”
“ হুম খেয়েছি কিন্তু কমছে না। তাই কফি বানাতে আসলাম। ”
“ তুই এখানে বস আমি বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
“ আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে।”
“ ঠিক আছে চল। ”

তানিয়া বেগম আর অরিত্রিকা কিচেনে চলে গেল কফি বানানোর জন্য।
সারহান ক্লান্ত ভঙ্গিতে সদর দরজা খুলে প্রবেশ করল। মুখাবয়ব অতিশয় শক্ত এবং গম্ভীর। ললাট জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘামের আবির্ভাব। জবজবে ঘেমে যাওয়া ব্ল্যাক শার্ট সুঠাম দেহী প্রশস্ত শরীরে। শার্টের দুহাতা কনুই অব্দি গুটানো। পুরুষালী ইস্পাত-দৃঢ় পেশীবহুল হাত দ্বারা বিরক্তির সহিত শার্টের ওপরের বাটন খুলে ফেলল। শাণিত পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অবলোকন করল চারিপাশ। কিচেন থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। সারহান বুঝলো তানিয়া বেগম হয়ত কিচেনে আছেন। সে এসে বসল সোফায়। ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিল সোফায়। চোখ বন্ধ করে নিরব চিত্তে। কিছু সময় পর ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসল। কোলের ওপর গরম কিছুর অনুভূতি হচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে কোলের ওপর হাত রাখল। নরম তুলতুলে অনুভব হচ্ছে। বোঝার চেষ্টা করল কি।
“ ম্যাও ম্যাও। ”

আওয়াজ কর্ণকুহরে প্রবেশ করল সারহানের। তৎক্ষনাৎ চক্ষুদ্বয় মেলে তাকাল। পায়ের ওপর বিড়াল বসে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকে গেল। বিরক্তির সহিত সে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। ধারালো হয়ে উঠল দৃষ্টি বিড়ালটা লাফিয়ে পড়ল মেঝেতে। বেশ ভাব নিয়ে ঘুরঘুর করতে থাকল সারহানের আশেপাশে। সারহান বিরক্তি সূচক চাহনিতে তাকিয়ে আছে বিড়ালটির দিকে। তার বাড়িতে তো বিড়াল ছিল না আসল কীভাবে। এটা কার বিড়াল? ইশরার নয়ত! হতে পারে। সারহানের এসব বিড়াল ভীষণ অপছন্দনীয়। ইশরাকে বলতে হবে এই বিড়াল যেন তার আশেপাশে না আসে।
“ আমার বেবিটা উঠে গেছে। নিশ্চয়ই আমাকে কাছে না পেয়ে নিচে চলে এসেছো। আমার কাছে আসো…. ”
সারহানের কর্ণকুহরে অপ্রত্যাশিত মেয়েলী কন্ঠস্বর পৌছালো। সে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকাল কিচেনের দিকে। অরিত্রিকা কফি হাতে এগিয়ে আসছে এদিকে। বেশ অবাক হলো কিন্তু প্রকাশ করল না। শুধু সরু চোখে তাকিয়ে থাকল। অরিত্রিকা এসে দাঁড়াল দুরত্ব বজায় রেখে।সে সারহানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিব্রতবোধ করল। কি বলবে কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। হাতে থাকা কফির মগটি বাড়িয়ে দিয়ে মিনমিন করে বলল;

“ কফি খাবেন? ”
সারহানের ভ্রুযুগল বেঁকে যায়। গম্ভীর কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করল;
“ নট ইন্টারেস্টেড।”
অরিত্রিকা মুখ বাঁকাল। দুকদম পিছিয়ে গিয়ে বসল সোফায়। লেভি একলাফে গিয়ে আরামপ্রিয় ভঙ্গিতে মালকিনের পাশে ঘেঁষে বসল। সারহান বুঝল এই বিড়ালটা অরিত্রিকার।
সারহান অগ্নিশিখার মতো ঝলসে ওঠা চোখে বিড়ালটি আর অরিত্রিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই এখানে কি করছিস?”
অরিত্রিকা তীব্র বিরক্তিতে আক্রমণাত্মক সুরে পাল্টা উত্তর দিল,
“আমার বাড়িতে আমি আসব, এর জন্য আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি! আজব!”
অরিত্রিকা ত্যাড়া কথা বলে চুমুক দিল গরম কফির কাপে। আহ! কতোদিন পর বড় মায়ের হাতে টেস্টি খেলো। মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল যেন। সারহান বসল পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে। বিদ্রুপাত্মক হেসে বলল ;
“ দুই বছর পর বাড়ির কথা মনে পড়ল!”
অরিত্রিকা কফি গিলে ত্যাছড়া স্বরে বলল;

“ উহু। প্রতিদিন মনে পড়ত কিন্তু আপনি এই বাড়িতে থাকেন তাই আসতে মন চাইত না।”
“ তাহলে আজ আসলি কেন?”
“ আমার মর্জি তাই এসছি। ”
সারহান দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। অরিত্রিকা চিল মুডে কফি খেতে লাগল। লেভি সোফা থেকে নেমে লেজ নাড়িয়ে সারহানের পায়ের কাছে ডেকে উঠল। সারহান ভরাট কন্ঠে বলল;
“ তোর বিড়ালকে আমার সামনে থেকে সরা নয়ত তুই আর তোর ঢংগী বিড়ালকে বাড়ির বাহিরে রেখে আসব। ”
অরিত্রিকা এক চুমুকে পুরো কফি খেয়ে নিল। ক্রোধে গজগজ করতে করতে সোফা থেকে উঠে এসে লেভিকে দুহাতে তুলে নিয়ে আগলে নিল। গমগমে কন্ঠে বলল ;
“ একদম আমার বেবিকে ঢংগী বিড়াল বলবেন না সারহান ভাই। এটা আমার বেবি। ”
সারহান হতবিহ্বল হয়ে গেল। বিস্মিত কন্ঠে বলল;

“ তোর বেবি? ”
অরিত্রিকা মৃদু হেসে লেভির গায়ে হাত বুলিয়ে বলল;
“ হ্যা আমার বেবি। আমার বেবিকে একদম বিড়াল বলবেন না ওর নাম লেভি বুঝলেন। ”
“ ওহহ গড কি সময় আসল! একটা বিড়ালের মা নাকি একটা মেয়ে মানুষ।”
“ আমি লেভিকে নিজের বাচ্চার মতো ভালোবাসি। ”
সারহান যেন অন্য দুনিয়ায় চলে গেছে। হতবুদ্ধির ন্যায় অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রয়েছে অরিত্রিকা আর বিড়ালটার দিকে। সারহানে অদ্ভুত চাহনি দেখে হাসল অরিত্রিকা। লেভিকে উদ্দেশ্য করে বলল;
“ লেভি বেবি মামুকে হাই বলো। ”
সারহান খুকখুক করে কেশে উঠল। দ্রুততার সহিত সোফা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। এখানে থাকলে নিশ্চয়ই আজ তার মাথা পাগল হয়ে যাবে। সে দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধ মিশ্রিত কন্ঠে বলল ;
“ আমি তোর বিড়ালের বাচ্চার মামা নই। আর একদিন যদি আজেবাজে বকেছিস তাহলে দুটোকে পাবনায় ভর্তি করে আসব। ”
অরিত্রিকা অবাক হয়ে শুধায় ;

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ১১

“ ওমা আমি তো আমার বেবিকে আপনার সাথে পরিচয় করাচ্ছিলাম। ”
সারহান গরম চোখে তাকাল। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। রাগান্বিত ভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল। অরিত্রিকা খিলখিলিয়ে হেসে দিল। বজ্জাত ব্যাডাকে প্রথম দিনেই শায়েস্তা করেছে সে। বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে লেভিকে নিয়ে ছুটল রুমে।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ১৩