প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ১৩
আদ্রিতা নিশি
রাতের তৃতীয় প্রহর। নিস্তব্ধতার এক গভীর রূপ মেলে ধরেছে আঁধারাচ্ছন্ন আকাশ। শীতল বাতাসের স্পর্শে প্রকৃতি যেন আরও গম্ভীর হয়ে উঠেছে। দূর অরণ্যের গহীন থেকে ভেসে আসছে নিশাচর পাখিদের অস্পষ্ট, উদ্ভট সুর।যা রাত্রির নিস্তব্ধতাকে ভেদ করেও আরও নিবিড় করে তুলছে।ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথম রাত। শীতের বিদায়বেলায় আচমকা তার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে শহরে। দীর্ঘদিনের উষ্ণতার অভ্যাসে অভ্যস্ত মানুষ শীতের এই হঠাৎ আগমনে পুনরায় জড়োসড়ো হয়ে গেছে। বাতাসে একধরনের অদ্ভুত শূন্যতা। পথে-প্রান্তরে নীরবতার দাপট যেন রাতের রাজ্যে এ সময় অদৃশ্য শাসকের উপস্থিতি।অন্ধকারের চাদরে মোড়ানো এই রাত্রিতে শীত যেন তার তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে মোহময় স্পর্শে। মৃদুমন্দ হাওয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে জানালার শিক গুটিয়ে নিতে বাধ্য করছে আলস্যে মোড়া ক্লান্ত মানুষকে।
সারহানের বেলকনির দরজা আধখোলা। সেদিক দিয়ে শাঁই শাঁই করে হাওয়া রুমে প্রবেশ করছে। জানালার পর্দাগুলো হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। ল্যাম্পের হালকা আলোয় আলোকিত রুমটি। সারহান বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। কপাল কুঁচকে চিন্তাগ্রস্থ মুখে হাতে থাকা মুঠোফোন টির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হোয়াটসঅ্যাপে আঙুল গুলিয়ে আবিরকে মেসেজ দিচ্ছে। সে আজ ভীষণ চিন্তিত। গোপন সূত্রে খবর পেয়েছে তাদের দলের কেউ একজন তথ্য পাচার করছে নয়ন তালুকদারের কাছে। কিন্তু কে সেই বিশ্বাসঘাতক ব্যক্তি এখনো খবর পাওয়া যায়নি। সারহান জানে নতুন কোনো সমস্যায় পড়তে চলেছে সে। নিজেকে নিয়ে তার ভয় নেই। তবে পরিবার এবং দলের প্রতিটা সদস্যদের নিয়ে চিন্তিত। সপ্তাহখানেক আগে সারহান আজমল সাহেবের বাড়িতে গিয়েছিল স্বইচ্ছায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল আজমল সাহেবকে চৌধুরী নিবাসে ফিরে আসার জন্য কনভেন্স করা। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা এবং ভীষন চতুরতার সহিত কাজটা সম্পূর্ণ করেছে সে। অরিত্রিকার জেদ, একরোখা মনোভাব ভেঙে নিমেষেই গুড়িয়ে দিয়েছে সারহান কিন্তু বোকা অরিত্রিকা কিছুই জানতে পারল না। দুই বছর ধরে মেয়েটা তাকে ভীষণ জ্বালিয়েছে আর তার কিছুটা মূল্য তো তাকে দিতেই হবে। সারহান চাইলেই সবকিছু মাফ করে দিতে পারে না। এই দীর্ঘ সময়ে সে নীরবে সব সহ্য করেছে, কিন্তু এবার পরিস্থিতি বদলেছে।গত দুই বছর ধরে সে দূর থেকে পাহারা দিয়েছে চাচা, চাচি, অরিন আর অরিত্রিকাকে। কারও অগোচরে তাদের নিরাপত্তার জন্য ছায়ার মতো মানুষ নিয়োজিত রেখেছিল। কেউ জানেনি, কেউ টেরও পায়নি অথচ প্রতিটি পদক্ষেপ তার নজরে ছিল।
তখন সে ছিল একমাত্র ছাত্রনেতা ক্ষমতার দৌড়ে সদ্য প্রবেশ করা এক তরুণ। কিন্তু এখন? এখন সে একজন সংসদ সদস্য, দায়িত্ব ও ক্ষমতা দুটোই বেড়েছে বহুগুণ।পরিবারের নিরাপত্তা তার কাছে সবকিছুর ওপরে। আর সে কারণেই আজমল সাহেবকে ফিরিয়ে আনা ছিল অপরিহার্য। সে জানে অরিত্রিকা এতে চরম বিরক্ত হবে হয়তো ক্ষুব্ধও। কিন্তু তাতে তার কিছু আসে যায় না। কারণ সে জানে, কিছু সিদ্ধান্ত আবেগ দিয়ে নয় বাস্তবতা দিয়ে নিতে হয়। অরিত্রিকা তার চাচাতো বোন হলেও সারহান বেশ বিরক্তি মেয়েটার প্রতি। উদ্ভট কর্মকাণ্ড, বাঁচাল, চঞ্চলতা, জেদি, উড়নচণ্ডী ধাঁচের মেয়ে। ছোট বেলায় অরিত্রিকা শান্ত থাকলেও বড় হয়ে অশান্ত হয়ে গেছে। সারহান এসব ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। পুনরায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ফোনে। মেসেজিং করা বাদ দিয়ে সরাসরি কল করে আবিরকে। সাথে সাথে আবির কল রিসিভ করে।
“ ব্রো বল।”
সারহান গম্ভীর কণ্ঠে বলল ;
“ মেহমুদ রঈসের কী অবস্থা এখন? ”
“ মোটামুটি ভালো। তবে যে কোনো সময় কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। ”
“ আমাদের আরো কয়েকজন লোক হসপিটালে সেট করে দে। খবর পেয়েছি মেহমুদ রঈসকে হন্যে হয়ে খুঁজছে নয়ন তালুকদার। ”
“ কাজ হয়ে যাবে।”
“ হৈমীর কী খবর? মনের কাছে বাচ্চাটা ভালো আছে তো?”
“ হৈমী ভালো আছে। মুখ বাচ্চাটার ভালো করে খেয়াল রাখছে। ”
“ আগামীকাল সকালের দুইটা মিটিং ক্যান্সেল কর। ”
“ কেন?”
“ একটু বিজি থাকব তাই।”
“ ঠিক আছে।”
সারহান হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। একধ্যানে উদাসীন ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে বেলকনির দিকে। আবির কথা বলছে কিন্তু সারহানের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আওয়াজ শুনলেও উত্তর দিচ্ছে না। কেমন যেন আনমনা ভাব তার মাঝে।
আবির কোনো উত্তর না পেয়ে বলল;
“ সারহান আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস?”
সারহানের গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“ হ্যা। ”
“ কি হয়েছে তোর? কোনো কিছু নিয়ে আপসেট? ”
“ উহু।”
“ তাহলে অন্যমনষ্ক হয়ে আছিস কেন? ”
“ এমনি।”
“ কি হয়েছে বল।”
সারহান ওষ্ঠকোণে মলিন হাসি ফুটে উঠে। ভারী কন্ঠে উত্তর দেয়;
“ আজ চাচারা এসেছে। ”
আবির অপ্রত্যাশিত খবরে ভীষণ খুশি হয়। উৎফুল্লতার সহিত বলে উঠে ;
“ বলিস কি। তাহলে তো আজ তোর খুশির দিন।”
“ হ্যা রে আজ আমার খুশির দিন। আমি আজ ভীষণ খুশি। কিন্তু সেই খুশি প্রকাশ করতে ভয় হয়। জানিস, যেদিন চাচারা এ বাড়ি ছেড়েছিল সেদিন আমি কেমন থমকে গিয়েছিলাম। চোখের সামনে দুই ভাইয়ের বিচ্ছেদ দেখে জ্বলে উঠেছিল ভেতরটা। সুন্দর হাসি খুশিময় বাড়িতে ফাটল ধরেছিল আমার জন্য। তবুও আমি ছিলাম নির্বিকার এবং নিশ্চুপ। সাহসী মানুষটা আকস্মিক ঘটনায় চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। আমার সাহস হয়নি চাচা, চাচীর সামনে দাঁড়ানোর।
সারহানের কন্ঠ আজ কেমন যেন অশান্ত। প্রতিটি শব্দে মিশে আছে বিষাদের সুর। বুকের ভেতরে অগোচরে লালিত হাহাকার, কষ্ট, বিষাদ যেন আজ উগ্রে বাহিরে আসতে চাইছে। একজন কঠিন মনের মানুষ তীব্র কষ্টের কাহিনী শোনাচ্ছে। যে মানুষটা নিজের মনের কথা সকলের অগোচরে রাখে আজ সে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে সেই তিক্ত অতীতের সম্মুখীন হতে।
“ সারহান শান্ত হো। ”
“ চাচার মৃত্যুসম পরিস্থতির জন্য আজও অনুশোচনা হয়। প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে অপরাধী ভাবি। আমি সেদিন দেখেছিলাম বাবাকে হারানোর ভয়ে মূর্ছে যাওয়া অরিন এবং অরিত্রিকাকে। চাচীকে দেখেছিলাম নিজের স্বামীকে হারানোর ভয়ে, কষ্টে কান্না করতে।সেই দৃশ্য এখনো চক্ষুপটে ভাসে। অরিত্রিকা আমাকে ভীষণ ভয় পেত কিন্তু সেদিনের পর থেকে মেয়েটা একদম পাল্টে গিয়েছিল। সাহস নিয়ে এসেছিল আমার কাছে। ক্রোধ, ক্ষোভ নিয়ে বলেছিল, রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে ছিলাম অটল। উত্তর দিয়েছিলাম রাজনীতি ছাড়ব না। ব্যাস, একটা সিদ্ধান্তের জন্য সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল।”
“ সারহান যা হওয়ার হয়ে গেছে। নিজেকে অপরাধী ভাবা বাদ দে। তোর উচিত পুনরায় যেন এমন কিছু না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা।”
“ হয়ত এসব স্মৃতি সহজে ভোলার নয়।”
আবির একটু মৌন রইল। সারহানের কথার প্রতিত্তোরে কিছু বলল না। উল্টো জিজ্ঞেস করে ;
“ চাচা চাচীরা সবাই কেমন আছেন। ”
সারহান শরীরে কম্ফোর্টার জড়িয়ে নেয়। শান্ত কন্ঠে উত্তর দিলো ;
“ সবাই ভালো আছে।”
“ অরিত্রিকার সাথে দেখা হয়েছে?”
“ হুম।”
“ দুজনের ঝগড়া হয়েছে? ”
আবিরের কন্ঠ কেমন যেন কৌতুকপূর্ণ শোনাল। সারহানের ভাবমূর্তি পরিবর্তন হল। বিরক্তির আভা স্পষ্ট ফুটে উঠল ললাটে। ভরাট কন্ঠে বলল;
“ আমাকে কি তোর মেয়েদের মতো ঝগড়ুটে মনে হয়। ”
আবির একটু কেশে উঠল। দাঁত কেলিয়ে হেসে আমতা আমতা করে বলল ;
“ আমি কখন বললাম তুই ঝগড়ুটে। দুজনের যখন দেখা হয় তখনি তো ঠুকঠাক লেগে যায় তাই বললাম।আচ্ছা বাদ দে। ”
“ বেয়াদব মেয়ে আজকে আমায় কি বলেছে জানিস? ”
“ কি বলেছে?”
“ আমাকে লেভির মামা বলেছে।”
আবির বুঝলনা কাহিনী। কৌতুহলী ভাব নিয়ে প্রশ্ন করল ;
“ এই লেভি কে? ”
সারহান চোয়াল শক্ত করে বলল ;
“ লেভি অরিত্রিকার বিড়ালের নাম। ”
“ ওহহ আচ্ছা। ”
আবির মাথা নাড়িয়ে বলল। কিছু খেয়াল করতেই কথা গলায় আঁটকে গেল। চোখদুটো বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। এসব কি শুনছে সে! অরিত্রিকা সারহানকে একটা বিড়ালের মামা বানিয়ে দিয়েছে। ভেবেই পেট ফেটে হাসি বেড়িয়ে আসতে চাইল। পেটে হাত গুঁজে হু হা করে হেসে বলল;
“ বলিস কিরে! শেষ পর্যন্ত তুই একটা বিড়ালের মামা হয়ে গেলি। ”
সারহানের মেজাজ বিগড়ে গেল। ধমকে বলল;
“ একদম হাসবি না আবির। ”
আবির কোনো মতে নিজের হাসি থামিয়ে বলল;
“ আচ্ছা আচ্ছা। এমপি সারহান ইদায়াত চৌধুরী বিড়ালের মামা হয়ে কেমন বোধ করছেন?”
“ তোকে সামনে পেলে পশ্চাতদেশে লাথি মারতাম বেয়াদব। ”
সারহান রাগে গজগজ করতে করতে হঠাৎ কল কেটে দেয়। বিরক্তি আর উত্তেজনায় হাতের ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে বিছানায়। কপালের শিরাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শ্বাস ভারী হয়ে গেছে।আবিরও ঠিক অরিত্রিকার মতো! একই রকম বাচাল, একই রকম জেদি, একই রকম তর্কপ্রিয়। ওদের দুজনের স্বভাব যেন অবিকল! একটা জায়গায় একসঙ্গে রাখলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে ওরা ভাই-বোন নয়। সারহানের মেজাজ আরও গরম হয়ে ওঠে এই ভেবে।
সে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে হাত দিয়ে চুলে একবার আঙুল চালিয়ে নেয়। কিছুতেই যেন আজ মেজাজ ঠিক রাখতে পারছে না। মনে হচ্ছে, চারপাশের সবকিছু তাকে আরও বেশি ক্ষিপ্ত করে তুলছে।
অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত পেরিয়ে ধরনিতে নেমেছে ভোরের আবহ। পাখিদের কাকলি ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।স্নিগ্ধ শীতের প্রকৃতি যেন ধীরে ধীরে আলোর পরশে জেগে উঠছে। তবে শীতের সকালে ছয়টা বাজলেও এখনো প্রকৃতির বুকে আঁধারের মায়া পুরোপুরি কাটেনি।অরিত্রিকার ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ আগেই। সে এখনো বিছানায় উষ্ণ কম্ফোর্টার জড়িয়ে আধশোয়া হয়ে আছে। এক হাতে ধরা বই অন্য হাতে পাতার প্রান্ত ধরে রাখতে রাখতে মনোযোগের সঙ্গে গুঞ্জন করে পড়ছে। গতরাতে ভার্সিটির ক্লাসের পড়া শেষ করতে পারেনি।তাই ঘুম ভেঙেই তা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।পাশেই লেভি গুটিশুটি মেরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার ছোট্ট শরীরটা কম্ফোর্টারের একপাশে মুড়ে রাখা। মুখখানায় প্রশান্তির ছাপ। মাঝে মাঝে আদুরে ভঙ্গিতে নাক ডেকে উঠছে।
অরিত্রিকা প্রায় দেড় ঘন্টা পড়াশোনা করে কাহিল হয়ে গেছে। চক্ষুদ্বয়ে ভীড় করেছে ঘুম। দুই তিন ঘন্টা ঘুমালে হয়ত একটু ভালো লাগবে। কিন্তু এই অকাজ করা যাবে না। এখন ঘুমালে ঘুম ভাঙতে নিশ্চয়ই দুপুর পেরিয়ে যাবে। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে নেমে পড়ল বিছানা থেকে। চপল পায়ে এগিয়ে গেল কাবার্ডের দিকে। কাবার্ড খুলে গরম কাপড় বের করে পড়ে নিল। নাচুনে ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল বেলকনির দরজা দিকে। দরজা খুলে পা রাখল বেলকনিতে। কয়েক কদম এগিয়ে গ্রিল ধরে বাহিরে তাকাল। কুয়াশায় আচ্ছাদিত হয়ে আছে প্রকৃতি। এখনো সূর্য উদিত হয়নি। আকাশেই রাতের চাদর গায়ে লুকিয়ে রয়েছে। ভোরের শীতল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে অরিত্রিকার শরীর। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এবং আবহাওয়ায় মন প্রাণ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। কিছুটা শীত অনুভব হচ্ছে তার। এক ধ্যানে আনমনে তাকিয়ে রইল আবছা কুয়াশায় আচ্ছাদিত গাছপালার দিকে। স্নিগ্ধ প্রকৃতির রুমে মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করছে। নিঃশব্দে হেসে উচ্চকন্ঠে গুনগুন করে গেয়ে উঠল পছন্দসই গান।
❝ কতো কথা বলা হলো না, প্রিয়….
কতো সূর্যমুখীর মন ভার।
আমার শহর জুড়ে কুয়াশা-ঘুম, নীরবে জমা ব্যথার পাহাড়।
কতো পথ হাঁটা বাকি রয়েছে, প্রিয়…
কতো সন্ধ্যের পথ অন্ধকার।
হেঁটে চলি আজ যে পথ ধরে, যে পথ আমার একার।❞
কিছুটা দূরের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। স্থির চক্ষুতে একধ্যানে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েলী অবয়বের দিকে। তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে মেয়েলী সুমধুর কন্ঠে আনমনে গেয়ে ওঠা গান। অসম্ভব সুন্দর লাগছে গান। মানবটি কিছুটা অবাক হয়েছে। অরিত্রিকা যে এতো চমৎকার গান গাইতে পারে তা জানতো না। ভোরে স্নিগ্ধ আবহাওয়া, নিস্তব্ধ প্রকৃতি এবং চমৎকার গানে আজ যেন একটু অন্যরকম দিনের সূচনা। গানের প্রতিটা লাইনে যেন মাধুর্য মিশে আছে। পরিবেশ রোমাঞ্চকর হয়ে উঠেছে। মানবটি বেশ মনোযোগী হয়ে উপভোগ করছে মনোমুগ্ধকর সময়। মানবটি অরিত্রিকার গানে তাল মিলিয়ে অদ্ভুত হেসে শান্ত কন্ঠে আওড়ালো ;
“ কতো কথা বলা হলো না, প্রিয়.. কতো পথ বাকি রয়েছে প্রিয়.. ”
এতটুকু বলেই থেমে যায়। চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে নির্মল বাতাসের ঘ্রাণ নেয়ে। দূর হতে ভেসে আসছে অচেনা কোনো ফুলের সুবাস। ফুলের সুবাসে ম-ম করে উঠল চারিপাশ। মানবটি চক্ষুদ্বয় খুলে তাকায় অরিত্রিকার দিকে। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আবছা কুয়াশা কিছুটা মিলিয়ে গিয়েছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাব কেটে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। অরিত্রিকা চঞ্চল দৃষ্টি ঘুরিয়ে চক্ষুপেয় দৃশ্য উৎফুল্লতার সহিত আশে পাশে তাকিয়ে দেখতে থাকে। পাশের বেলকনিটার কিছুটা দূরে হঠাৎ গোলাপফুল গাছে দৃষ্টি আঁটকে যায়।কিন্তু সেখানে দৃষ্টি স্থায়ী হয় না। পাশের বেলকনিতে কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে তাকায় সেদিকে। দুহাত বুকের কাছে গুঁজে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে সারহান। তার দৃষ্টি স্থির শান্ত, অথচ তীক্ষ্ণ। মুখাবয়বে কোনো অতিরিক্ত ভাবের আভাস নেই—স্বাভাবিক, গম্ভীর।গানের সুরে ডুবে থাকা অরিত্রিকা হঠাৎই চমকে ওঠে। তার চোখ সরাসরি গিয়ে পড়ে সারহানের দিকে। এই বদমেজাজি মানুষটা কখন যে বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে সে বিন্দুমাত্র আঁচও করতে পারেনি! মুহূর্তেই বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে। একটু অস্বস্তিও জাগে।কেন তাকিয়ে আছে ওর দিকে? কিন্তু আজ সে এসব নিয়ে ঝামেলা করতে চায় না। এত সুন্দর একটা সকালে কোনো ঝগড়া কোনো তর্ক নয়। প্রকৃতির এই মুগ্ধকর আবহাওয়া নষ্ট করতে মন চায় না তার।তাই নিজের স্বভাবসুলভ উল্টাপাল্টা কথা না বলে শান্ত থাকার কঠিন চেষ্টা চালিয়ে যায় অরিত্রিকা।
অরিত্রিকা দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়। এলোমেলো চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে নিয়ে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দিকে তাকায়। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও কণ্ঠে অদৃশ্য সংকোচ লুকিয়ে থাকে। ধীর গলায় শুধায়, “সারহান ভাই, আপনি কখন এসেছেন বেলকনিতে?”
সারহান এক মুহূর্ত চুপ থেকে স্থির দৃষ্টিতে অরিত্রিকার দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখাবয়বে কোনো অতিরঞ্জিত ভাব নেই। কণ্ঠস্বরে শীতল দৃঢ়তা এনে বলে;
“তুই যখন গান গাইছিলি তখন।”
“ আমার গান গাওয়ার জন্য আপনার ঘুম ভেঙে গেছে! সরি সারহান ভাই।”
অরিত্রিকার কন্ঠে অনুতপ্ততার রেষ। সে মুখ ভার করে সারহানের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে ছিল না সিঁড়ি ওপাশের প্রথম রুমটায় সারহান থাকে। বেলকনির দুরত্ব খুব বেশী নয়। উচ্চস্বরে কথা বললে স্পষ্ট শোনা যায়।
সারহার শান্ত কণ্ঠে বলল ;
“ ইটস ওকে। ”
সারহানের কন্ঠস্বর আজ অন্যরকম শোনালো। কেমন যেন অতি শান্ত আর অবিশ্বাস্য রকমের স্বাভাবিক। যা মোটেও স্বাভাবিক বিষয় নয়। অরিত্রিকা সৌজন্যমূলক হাসল শুধু। দৃষ্টি ফিরিয়ে গোলাপ গাছের দিকে নিবদ্ধ করল। একটা গাছে প্রায় পনেরো থেকে বিশটা হালকা গোলাপি রঙের গোলাপ ফুটেছে। এতো সুন্দর ফুলগুলো দেখে চক্ষুদ্বয় জুড়িয়ে যাচ্ছে।
“দ্য সঙ্ অ্যাণ্ড দ্য সিঙ্গার’স ভয়েস ওয়ার ইনক্রেডিবলি বিউটিফুল।”
সারহানের আচানক প্রশংসাসূচক বাক্যে মানবটির চকিত দৃষ্টিতে তাকায় অরিত্রিকা। বিস্ময়ে ওষ্ঠযুগল কিছুটা ফাঁক হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে নেত্রপল্লব ঝাপটে কয়েকবার। সারহান ভাই কি তার প্রশংসা করল?হয়তো। যন্ত্রমানবের থেকে প্রশংসা পেয়ে তার কেমন গোলমাল লাগছে। এই মানুষটার বহুরুপ দেখে সে দিশেহারা হয়ে যায়।
অরিত্রিকা বিস্ময় গিলে শুধায় ;
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ১২
“ আপনি কি আমার প্রশংসা করলেন সারহান ভাই?”
সারহান স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওষ্ঠ বাঁকিয়ে বলল;
“ নাহ। সিঙ্গারের প্রশংসা করলাম। ষ্টুপিড কোথাকার!”