প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ১৫
আদ্রিতা নিশি
অরিত্রিকা আনমনে হাঁটছে। তার শরীরে জড়ানো ওড়না হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। হালকা বাতাসে খোলাচুলগুলো নড়ে উঠছে। বিক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে হাতে ধরে রেখেছে একগুচ্ছ লাল গোলাপ আর একটা চিঠি। কিছুক্ষণ আগে ডিপার্টমেন্টের ক্লাস শেষ হয়েছে তাদের। ক্লাস শেষ হতেই রুহান আর রুদ্র কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে চলে গেছে। রাহা আজ ভার্সিটিতে আসেনি। মেয়েটা ভীষণ অসুস্থ। অরিত্রিকা আর তিশা গল্প করতে করতে প্যারেস রোড দিয়ে আসছিল এমন সময় অচেনা একজন ছেলে হঠাৎ এসে অরিত্রিকাকে লাল গোলাপফুলের বুকে এবং একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে প্রস্থান করে। সে কিছু বলবে সে সময়টাও পায়নি। তিশা এহেন কান্ডে অবাক হয়ে যায়। কে এমন করলো বুঝতে পারছে না কেউ।
তিশা অরিত্রিকার চিন্তাগ্রস্ত বদনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ;
“ এই ফুলের বুকে আর চিঠি কি করবি? ”
অরিত্রিকা আনমনে হাঁটছে। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে উঠল ;
“ জানি না কি করব। ”
“ লাভ লেটার আর ফুলের বুকে কে দিতে পারে? আমার জানা মতে তোর তো কোনো প্রেমিক পুরুষ নেই। ”
“ কোন গাধা দিলো এটাই তো বুঝতে পারছি না। এসব নিয়ে বাড়িতে ঢুকলে নিশ্চয়ই তুলকালাম বেঁধে যাবে। কি করব আমি। ”
তিশা কিছুটা ভাবুক হয়ে গেল। কিছুক্ষণ মৌন থেকে চটপটে ভঙ্গিতে বলল;
“ বলবি পহেলা ফাল্গুন উপলক্ষে আমি তোকে গিফট করেছি। আগামীকাল ছুটি তাই অগ্রীম গিফট দিয়েছে। ”
অরিত্রিকা ভাবল কিছুক্ষণ। গোমড়া মুখে উত্তর দিলো ;
“ সবাইকে এসব ভুজুংভাজুং বোঝানো গেলেও সারহান ভাইকে পারব না। উনি যদি একবার সন্দেহ করে আমি শেষ। তার থেকে ফুলগুলো কাউকে দিয়ে দেই আর চিঠিটা রেখে দেই বাড়িতে গিয়ে পড়ব। ”
তিশা মাথা নাড়িয়ে বলল ;
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ আচ্ছা।”
❝চুমকি চলেছে একা পথে
সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে?
হার মেনেছে দিনের আলো
রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালো
চুমকি চলেছে একা পথে
আরে, সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে?
হার মেনেছে দিনের আলো
রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালো।❞
অরিত্রিকা আর তিশা কথার মাঝেই হঠাৎ থমকে গেল। কোথাও থেকে ভেসে এলো এক বেসুরো কণ্ঠস্বর।চড়া স্বরে বিকৃত সুরে কোনো গানের টুকরো। অবচেতনেই তারা দুজন পেছনে ফিরল দৃষ্টি আটকে গেল তিনজন তরুণের ওপর।
ভার্সিটির আমবাগানের পাশে তিনটি বাইকের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা। ঠোঁটে কুৎসিত হাসির রেখা। চোখে একপ্রকার নির্লজ্জ দৃষ্টি। তাদের চেহারায় ছড়িয়ে রয়েছে বখাটেপনার স্পষ্ট ছাপ।রঙিন শার্টের উদ্ভট বাহার, চোখে কালো চশমার আড়াল, গলায় ঝুলছে সাদা চেইন, আর হাতে বাঁধা কালো ফিতে। তাদের চাহনিতে এমন দৃষ্টিভঙ্গি যা অরিত্রিকা আর তিশার শরীরে বিদ্যুতের মতো কাঁপন ধরিয়ে দেয়।এরা কারা তা বুঝতে দেরি হলো না। রাজশাহীর স্থানীয় বখাটে গোষ্ঠীর সদস্য এরা।এই শহরের অন্ধকার অলিগলিতে যারা চুপিসারে মেয়েদের পথ আগলে দাঁড়ায় এবং বিকৃত আনন্দে তাদের উত্যক্ত করে। অরিত্রিকা আর তিশা পরস্পরের চোখের ভাষা পড়ল। এখানে প্রতিবাদ করার অর্থ নেই। এসব মানুষকে কিছু বলা মানেই অহেতুক ঝামেলা ডেকে আনা।তাই তারা কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নাক-মুখ কুঁচকে এগিয়ে চলল সামনের পথে দ্রুত এবং নিশ্চুপ ভঙ্গিতে।
“ ও সুন্দরী আমাদের পাত্তা না দিয়ে কোথায় যাও? ”
বখাটে একজনের কন্ঠস্বর হতে ভেসে আসা কথাগুলো কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অরিত্রিকার মেজাজ বিগড়ে যায়। পিছু ফিরে কটমট করে তাকায় তিনজনের দিকে। বখাটেরা স্ব শব্দে হেসে উঠল। তিশা ও ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায় পেছনে। অরিত্রিকার এক হাত চেপে ধরলো। ধীর কন্ঠে বলল ;
“ বইন চল এখান থেকে। এদের সাথে লাগতে যাস না। ”
অরিত্রিকা ক্রোধে গজগজ করে বলল;
“ এদের তিনজনের মাথা ফাটিয়ে দিতে হচ্ছে। জানোয়ার গুলো। ”
“ চল।”
অরিত্রিকা তিশার কথা শুনলো না। ক্রোধে জর্জরিত হয়ে বখাটেদের উচ্চস্বরে বলে উঠল ;
“ ভরা ক্যাম্পাসে ইভটিজিং করছিস? যদি চিৎকার করি তোদের কি হবে ভেবে দেখেছিস? ”
তিনজন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। যেন মজার কোনো কথা শুনছে তারা।তাদের মধ্যে একজন বলে জঘন্য ইঙ্গিতে বলে উঠল ;
“ আরে আরে ভয় দেখাচ্ছে কেনো? আমরা তো ভয় পেয়ে গেলাম। ওমাগো কে কোথায় আছো বাঁচাও। ”
পরক্ষণেই দাঁত কেলিয়ে বলল;
“ তোমার রাগী চেহেরাটা ভালো লাগছে না দেখতে। আসো আমাদের কাছে, একটু ছুঁয়ে দেই। তখন দেখবে রাগী চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে যাবে।তোমাদের হট ফিগার দেখে কন্ট্রোল করতে পারছি না। ”
অরিত্রিকার গা গুলিয়ে উঠল। রাগে, ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে সে। হাত থাকা ফুলের বুকেটা ছুঁড়ে মারলো বখাটে তিনজন ছেলের দিকে। দুরত্ব বেশী না হওয়ায় সরাসরি একজনের মাথায় গিয়ে পড়ল। ছেলেটা মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠল। তিনজনেই হতচকিত হয়ে গেল মুহুর্তে। তিশা একটু চমকে উঠল। ভয়ার্ত কন্ঠে বলল;
“ বইন এইটা তুই কি করলি? পা লা দ্রুত। ”
অরিত্রিকার মন চাচ্ছে ছেলে গুলোকে জুতার বারি মা’রতে। কিন্তু এখন আর এক মুহুর্ত দাঁড়ানো যাবে না। দাড়ালেই ঝামেলাতে পড়তে হবে। সে তিশার হাত ধরে দ্রুত হাঁটতে লাগল। এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন অরিত্রিকার হাত চেপে ধরেছে। আতংকিত দৃষ্টিতে ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে তাকায়। রাগান্বিত ভঙ্গিতে বখাটেদের একজন এসে তার হাত ধরেছে।
বখাটে ছেলেটি রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল;
“ তোর এতো সাহস? আমার বন্ধুর গায়ে ফুলের বুকে ছুঁড়ে মেরেছিস? ”
তিশার শরীর থরথর করে কাঁপছে। ভয় তার সমস্ত সত্তা গ্রাস করে ফেলেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গলা থেকে এক ফোঁটা শব্দও বের হবে না। সে চারপাশে তাকায় কিন্তু তেমন কাউকে দেখতে পায় না। জায়গাটা এমনিতেই নির্জন থাকে আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।অরিত্রিকা নিজের শিরদাঁড়া সোজা রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ভিতরে ভিতরে ভয় যেন বরফের মতো জমে যাচ্ছে তার শিরায়-উপশিরায়। কিন্তু সে তা প্রকাশ করবে না। তার চোখ তীক্ষ্ণ মাথা কাজ করছে দ্রুত। পালানোর কোনো উপায় আছে কি? কেউ কি আসছে দূরে?সে শক্ত করে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু ছেলেটা তার মুঠি আরও দৃঢ় করল। এবার জোরে টান দিয়ে অরিত্রিকাকে আমবাগানের দিকে টেনে নিতে লাগল। তার কুৎসিত ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এলো বিষাক্ত হিসহিসে স্বর;
“তোর সাহস আজ আমরা দেখবো, শা*লি কোথাকার!”
অরিত্রিকা ব্যথায় কুঁচকে যাওয়া মুখে তিরিক্ষি মেজাজে বলল ;
“ আমি কিন্তু চিৎকার করব। ”
“ কর।”
অরিত্রিকার অবস্থা বেহাল। কি করবে সে বুঝতে পারছে না। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে ধরনীতে। অথচ কি এক ফ্যাসাদে জড়িয়ে গেল। সে তিশার দিকে তাকাল। ইশারা করল চিৎকার করার জন্য। তিশা সেই ইশারা বুঝতে পারল। চিৎকার করতে যাবে এমন সময় আরেকজন ছেলে এসে সামনে দাঁড়াল। সেই ছেলেটির হাতে চকচক করছে চাকু। অরিত্রিকা আর ইশরা দুজনেই চমকে উঠল। অরিত্রিকার হাত পা ছুঁড়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। কেন যে এই কুত্তা গুলোর সাথে লাগতে গিয়েছিল। তিশার কথা কেন যে শুনলো না। শুনলে হয়তো এই মুসিবত আসতো না। এসব চিন্তা ভাবনার মাঝেই চাকু হাতে ছেলেটি কারো শক্তপোক্ত হাতের মা*র খেয়ে লুটিয়ে পড়ল রাস্তায়। চাকু ছুটে গিয়ে পড়ল কিছুটা দূরে। অরিত্রিকার আর তিশা আঁতকে উঠল। দ্রুততার সহিত সামনে তাকাল। দৃষ্টি স্থির হলো এক অচেনা মানবের দিকে। দৃষ্টি কঠোর এবং রক্তাভ। চোয়াল অতিশয় শক্ত।
এতোমধ্যে অরিত্রিকার হাত থরথরিয়ে কেপে উঠে ছেড়ে দিয়েছে ছেলেটি। আতংকিত দৃষ্টি তাকিয়ে ছুট লাগল পেছনের দিকে। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারল না তার আগেই অচেনা মানবটি বখাটে ছেলেটার শার্ট পেছন থেকে ধরে সামনে ঘুরিয়ে বেদম কেলানি দিতে লাগল। অরিত্রিকা আর ইশরা ভয়ে সিঁটিয়ে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। হতভম্বের ন্যায় সামনে ঘটে যাওয়া কাহিনী দেখছে। এসব কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। অচেনা মানবটি রাস্তায় ব্যথায় চিৎকারকৃত ছেলে দুটোকে উদভ্রান্তের মতো লাথি মার*ছে। ছেলেগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। ব্যথায় গুঙিয়ে গুঙিয়ে উঠছে। নাক মুখে ফেটে র*ক্ত গলগলিয়ে পড়ছে।অচেনা মানবটি হঠাৎ শান্ত হয়ে যায়। হাত দ্বারা ইশারা করে কাউকে। চারজন লোক ছুটে আসে দ্রুত। আহত দুজন বখাটেকে ধরে কোথাও নিয়ে যেতে থাকে। মানবটি আশেপাশে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আরেকজনকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু পায় না খুঁজে। বুঝতে পারে পালিয়েছে। ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সে অনেকটা হাঁপিয়ে গেছে। ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে ফিরে এগিয়ে যায় অরিত্রিকার আর তিশার দিকে।
মানবটি এসে দাঁড়ায় দুজনের সামনে। বুকে দুই হাত গুঁজে শান্ত কন্ঠে বলে উঠে;
“ আপনারা ঠিক আছেন? ”
অরিত্রিকা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে মিনমিন করে বলল;
“ আমরা ঠিক আছি। ”
মানবটি অদ্ভুত হাসল। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল ;
“ সাবধানে চলাচল করবেন মিস। বলা যায় না কখন কোন অঘটন ঘটে যেতে পারে। আজ আমি না আসলে আপনাদের কী হতো ভাবতে পারছেন?”
অরিত্রিকা দ্বিধাগ্রস্ত মুখশ্রীতে ভালোভাবে তাকাল দন্ডায়মান মানবটির দিকে। চেহারা এবং পোশাকে আভিজাত্যের ভাজ ফুটে উঠেছে। এক কথায় সুদর্শন বলা যায়। দেখে মনে হচ্ছে কোনো ভদ্র পরিবারের ছেলে।
মানবটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অবলোকন করল অরিত্রিকা আর তিশাকে। দুজনেই অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শিত করছে। তা দেখে ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুললো। শান্ত কন্ঠে নিজের পরিচয় দিলো;
“ আমার নাম ইলহাম তালুকদার। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র। ”
অরিত্রিকা ইতস্তত ভাব নিয়ে বলল ;
“ ওহহ।”
“ আপনাদের নাম?”
তিশা একগাল হেসে উত্তর দেয়;
“ আমার নাম তিশা আর আমার ফ্রেণ্ডের নাম অরিত্রিকা। ”
ইলহাম হাসল ;
“ নাইস নেম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে আপনাদের বাড়ি ফেরা উচিত। ”
অরিত্রিকা কোনমতে বলল;
“ আমাদের হেল্প করার জন্য ধন্যবাদ। ”
অরিত্রিকা কথা শেষ করে তিশার দিকে তাকাল। তিশা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ইলহামের দিকে। কেমন বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছে অচেনা মানুষটার দিকে। অরিত্রিকা চটে গেল। সে ইলহামের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হেসে তিশার হাত ধরে টেনে তড়িঘড়ি করে প্রস্থান করল।
“ ইলহাম তালুকদার কি হ্যান্ডসাম রে! প্রথম দেখায় ক্রাশ খেয়ে গেলাম। ইশ! আরেকটু যদি উনাকে দুই নয়ন ভরে দেখতে পারতাম! ”
দুজনে হাঁটছে। এরমাঝেই তিশার বিমোহিত কন্ঠে বলে উঠা কথায় অরিত্রিকার শরীর জ্বলে গেল। সে কটমট করে তাকিয়ে বলল;
“ তোর ক্রাশ এখনো দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। তুই ছুটে গিয়ে উনার গলায় ঝুলে পড় নির্লজ্জ মেয়ে। ”
তিশা মুখ বাঁকিয়ে বলে;
“ হিরোর মতো আমাদের বাঁচালো তাই তো ক্রাশ খেয়েছি। ক্রাশ খেলে চোখ ভালো থাকে। ”
অরিত্রিকার চোয়াল তুলে যাওয়ার জোগাড়। বিস্ময় ভাব কাটিয়ে কোনো মতে বলল;
“ কী!ক্রাশ খেলে চোখ ভালো থাকে? এটা কোন বইয়ে লেখা আছে?”
“ বইয়ে লিখা নেই কিন্তু আমার মনে লিখা আছে। যত ক্রাশ খাবি, ততই তোর চোখ ভালো থাকবে।”
অরিত্রিকা হতভম্ব হয়ে গেল। এই মেয়ের মাথা ইলহাম তালুকদারকে দেখে গেছে। আজ নিশ্চয়ই সারারাত না ঘুমিয়ে জেগে জেগে ক্রাশের স্বপ্ন দেখবে।
ইলহাম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরিত্রিকার চলে যাওয়ার পথে। মেয়েটা দ্রুত পা চালিয়ে সামনে এগোচ্ছে কিন্তু ইলহামের চোখ এখনো সেই মুহূর্তেই আটকে আছে। যখন সে প্রথমবার মেয়েটাকে দেখেছিল।দূর থেকে দেখে ভেবেছিল হয়তো সাধারণ কোনো মেয়ে। কিন্তু সামনে এসে দেখল না, এটা সাধারণ সৌন্দর্য নয়। এ একেবারে দহন করা রূপ।আগুন সুন্দরী।ইলহাম তালুকদার নামক মানুষটা এক মুহূর্তে যেন ঝলসে গেল। মেয়েটার চোখে ছিল ভয়, মুখশ্রীতে আতংক কিন্তু সেসবের মাঝেও একটা দুর্নিবার আকর্ষণ লুকিয়ে আছে। কী যেন আছে ওর ভেতরে। যা এক নজরে দেখেই বুকের গভীরে ছাপ ফেলে দেয়।ইলহাম ঠোঁট কামড়ে হাসল।এমপি সাহেবের চয়েজ আছে বলতে হবে।এতদিন এমপি সাহেবের পছন্দ করা মেয়েকে নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি। কিন্তু এবার ব্যাপারটা আলাদা। এই মেয়েটাকে একবার দেখেই ওর মধ্যে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি খেলা করছে।সে গভীরভাবে শ্বাস নিল। আপাতত তার একটাই কাজ অরিত্রিকার ডিটেইলস বের করা।
“ইউ আর সো বিউটিফুল, অরিত্রিকা। আই ওয়াজ মেজমেরাইজড বাই ইয়োর বিউটি অ্যাট ফার্স্ট সাইট। দিস ইলহাম তালুকদার ইজ গেট-টিং অ্যাডিক্টেড টু ইউ। আই ওয়ান্ট ইউ বিউটিফুল গার্ল। অ্যাট এনি কস্ট, আই ওয়ান্ট ইউ।”
ইলহাম রহস্যময় ভঙ্গিতে আনমনে হেসে উঠে। চুলগুলো একহাতে ঠেলে প্যান্টের পকেটে হাতগুজে নিঃসংকোচ ভঙ্গিতে হাঁটতে থাকে রাস্তা দিয়ে।
কিছুটা দূরে ফোন হাতে এতোক্ষণে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা ভিডিও করছিলো একজন। ইলহাম প্রস্থান করতেই লোকটি দ্রুত ভিডিও সেভ করে নেয়। তারপর নির্দিষ্ট নম্বরে পাঠিয়ে দেয়।
সময় এগারোটার দিকে। আভিজাত্যপূর্ণ গাড়িটি চলছে ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে গন্তব্য চৌধুরী নিবাস। সারহান পার্টি অফিস থেকে ফিরছে। এমপি হওয়ার সাথে সাথে দায়িত্ব বেড়েছে বহুগুন। কাজের চাপে দিকবিদিকশুন্য হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতির গ্যারাকলে পড়ে জীবনটা তিক্ততায় ভরে গেছে। বেশ কিছুদিন ধরেই চিন্তিগ্রস্থ সময় পার করছে। আশেপাশের কাজকর্ম, সন্দেহজনক গোপন তথ্য যেন মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি করছে। সব তথ্য ইঙ্গিত করছে সামনে হয়তো কোনো বড় অঘটন ঘটবে। গোপন সূত্রে খবর পাওয়া গেছে নয়ন তালুকদার নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
সারহান গাড়িতে বসে আছে চুপচাপ। দৃষ্টি তার বাহিরের দিকে। সে আজ অস্বাভাবিক শান্ত। পার্টি অফিসে মিটিংয়ের সময় তেমন একটা কথা বলেনি। প্রায় সময়ই ছিল চুপচাপ। গম্ভীর, বদমেজাজি মানুষ হঠাৎ শান্ত হয়ে গেলে সন্দেহজনক মনে হয়। আবির সারহানের দিকে তাকিয়ে আছে নীরব দৃষ্টি ফেলে। পার্টি অফিসে অবস্থানরত সময়ে সে সারহানকে পরখ করেছে। আজ বন্ধুর শান্ত স্বভাবে সে বিস্মিত হয়েছে। মন বারবার বলছে কী হলো সারহানের?
“ সারহান? ”
সারহান বাহিরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শান্ত কন্ঠে প্রতিত্তোর করে ;
“ বল।”
আবির একটু নড়েচড়ে বসল।সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠল ;
“ কোনো কাহিনী ঘটেছে? ”
“ নাহ।”
“ তুই এতো চুপচাপ কেনো? কাহিনী কি ব্রো?”
“ কোনো কাহিনী নেই।”
আবির এহেন জবাবে অশান্ত হয়ে গেল। পুনরায় জানতে চাইল ;
“ ভাই কী হয়েছে বল। ”
সারহান ঘাড় বাঁকিয়ে আবিরের দিকে তাকায়। দৃঢ় কন্ঠে বলে ;
“ পার্টির কেউ একজন আমার সাথে গেম খেলছে আবির। আই অ্যাম শিউর সেই মানুষটা আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের পার্সোনাল ইনফরমেশন ট্রান্সফার করছে। ”
“ এটা নিয়ে টেনশনে আছিস? ”
“ নাহহ।”
“ তাহলে?”
“ আমার ফ্যামিলিকে নিয়ে টেনশনে আছি। আমি কখনো চাইবো না আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য ফ্যামিলির কেউ একজন ওদের ট্র্যাপে পরুক। ”
“ টেনশন করছিস কেনো? আমাদের লোকজন সবাইকে সুরক্ষিত রাখার জন্য সেট করে রাখা আছে।”
সারহার চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে সিটে গা এলিয়ে দেয়। আজকাল কেন জানি ভীষণ অশান্ত লাগে। তার জীবনে যে হঠাৎ করে ঝড় তুফান বইবে তা সে বুঝতে পারছে।
অরিত্রিকা বইয়ের ভেতর মুখ গুঁজে আধশোয়া হয়ে পড়ছে। পড়ছে বললে ভুল হবে চোখ বুলাচ্ছে। প্রায় আধাঘন্টা ধরে এক পৃষ্ঠা আঁটকে আছে সে। এক লাইন দশ-বারো বার করে গুনগুন করে পড়ছে। কিন্তু মাথায় এসব কিছু ঢুকছে না। অরিত্রিকার বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে যায়। সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকায় ইশরার দিকে। ইশরা ও চুপচাপ তার পড়া শেষ করতে ব্যস্ত। ইশরার পাশেই লেভি শুয়ে একটা ভাজ করা কাগজ নিয়ে খেলতে ব্যস্ত। সেই কাগজটাই হলো লাভ লেটার। যেটা আজ ভার্সিটিতে পেয়েছিল।
অরিত্রিকা ধপ করে বই বন্ধ করল। ঠাস করে বিছানায় বইটি অবহেলায় রেখে দিল। হতাশায় জর্জরিত কন্ঠে বলে উঠল ;
“ প্রেম করে বিয়ে করার বয়সে পড়াশোনা করতে হচ্ছে। এই জন্য পড়াশোনাটা ঠিকঠাক মতো হচ্ছে না। ”
ইশরা ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। শব্দ করে হেসে বলল ;
“ আজকে যে লাভ লেটার দিয়েছে তার সাথে প্রেম কর। তারপর না হয় বিয়ের কথা ভাবা যাবে।”
অরিত্রিকা মুখ ভার করে বলল;
“ ওইসব লেখা দেখে তোর কোন অ্যাঙ্গেল থেকে লাভ লেটার মনে হচ্ছে। যে চিঠিটা লিখেছে সে একটা আস্ত শালার ব্যাটা। ছিঁড়ি নাই চিঠি লেখার তাও লিখেছে। আমার মনে হয় ওই ব্যাটা ভয়েই সামনে আসেনি। ভেবেছে যদি চিঠি পড়ে দুই চারটা জুতার বারি দেই।”
“ আমারও তাই মনে হচ্ছে। চিঠিটা পড়ে আমার বদলে হজম হয়ে গিয়েছিল। ”
“ আমারও।”
“ চিঠিটা দে তো আরেকবার পড়ি। ”
“ আচ্ছা।”
অরিত্রিকা চিঠিটা খুঁজতে লাগল বিছানার ওপর। হন্নে হয়ে খুঁজেও পেলো না। অরিত্রিকা পড়ার মাঝে খেয়াল করেছিল লেভির কাছে একটা ভাজ করা কাগজ ছিল। তারমানে চিঠিটা লেভির কাছে আছে।
অরিত্রিকা তড়িঘড়ি করে বলল ;
“ লেভি কোথায়? ”
ইশরা আশেপাশে তাকিয়ে বলল ;
“ আমার পাশেই তো বসে ছিল। ”
অরিত্রিকা এক লাফে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। চিঠিটা যদি লেভির কাছে থাকে তাহলে সে আজ শেষ। নিশ্চিত বাড়ির কারো হাতে পড়বে। লেভির একটা বদঅভ্যেস আছে সেটা হলো কোনো কিছু পেলে মুখে করে নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেরোনো। অরিত্রিকা তার পুরো রুম এবং বেলকনিতে লেভিকে খুঁজলো কিন্তু পেলো না। ইশরাকে বলল নিচ তলায় গিয়ে খুঁজতে আর সে উপরের তলায় খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
অরিত্রিকার উপর তলার সবার রুম খোঁজা শেষ। শুধুমাত্র একটা রুম বাকি আছে। সেটা হলো সারহান ভাইয়ের রুম। সে দুরুদুরু বুকে রুমের সামনে দাঁড়াল। মুখাবয়বে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। বুকের মাঝে ধপাস ধপাস করছে। মনে হচ্ছে হৃদয় ফেটে হাতে চলে আসবে। দীর্ঘ দুই বছরের অধিক সময় পর এই রুমটায় পা দিবে। মনে মনে চাইছে সারহান ভাই যেন রুমে না থাকে। দরজা আধ খোলা। অরিত্রিকা চোরের ন্যায় ধীর পায়ে ঢুকল রুমে। মনে হচ্ছে এটা তার নিজের বাড়ি নয় বরং অন্য কারো বাড়ি। যেখানে সে চুরি করতে এসেছে। বুকে ফু দিয়ে সতর্কতার সহিত আশেপাশে তাকিয়ে লেভিকে খুঁজতে লাগল। আলমারি, টেবিল, ডিভানের আশেপাশে খুঁজলেও পেলো না। সে আরেকটু এগিয়ে গেল। উঁকি দিল বিছানার ওপাশে। লেভিকে মেঝেতে বসে চিঠিটা নিয়ে খেলতে দেখে চোখ মুখ চকচক করে উঠল অরিত্রিকার। দৌড়ে গিয়ে লেভিকে কলে তুলে নিলো।
অরিত্রিকা লেভিকে উদ্দেশ্য করে ধীর কন্ঠে বলে উঠল ;
“ আর কোনো রুম পাসনি? সোজা বদমেজাজি মানুষটার রুমে চলে এসেছিস। যদি এসে দেখতো তুই উনার রুমে বসে চিঠি নিয়ে খেলছিস তখন দুজনেরই অবস্থা খারাপ করে দিত। নিশ্চিত আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিতো। ”
লেভি অরিত্রিকার দিকে অবুঝ নয়নে তাকিয়ে “ম্যাও ” করে উঠল। অরিত্রিকা দাঁতে দাঁত চেপে বলল;
“ চুপ কর। ”
অরিত্রিকা রুম থেকে প্রস্থান করবে এমন সময় তার দৃষ্টি আঁটকে গেল ড্রেসিং টেবিলের ওপর সাজানো পারফিউমে। সে সাহস সঞ্চার করে সেদিকে পা বাড়ালো। একহাতে পারফিউমটি তুলে নিলো। পারফিউমের গায়ে লেখা নামটি আওড়ায়;
“Bleu de Chanel । ”
অরিত্রিকা বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইল। বিদেশি ব্যান্ডেড পারফিউম এটা। দামও বেশ চড়া। বাপরে সারহান ভাই এ-ই ব্যান্ডের পারফিউম ইউজ করে। সে একটু হতাশ হয়। ভেবেছিল জেন্টস পারফিউম হলেও কিনবে। বাড়িতে গায়ে মাখিয়ে বসে থাকবে। কিন্তু তা আর হলো কই? এতো দাম দিয়ে পারফিউম কেনার সামর্থ্য নেই তার। মুখ ভার করে পারফিউটা রেখে দিতে গিয়ে দেয় না। এক গাল হেসে পারফিউমটা জামায় লাগাতে শুরু করল। বিরবির করে বলল ;
“ যখন হাতের কাছে পারফিউমটা পেয়েছি ইচ্ছে মতো ইউজ করি। লেভি তোকেও দিয়ে দেই ওয়েট। ”
অরিত্রিকা লেভিকেও ইচ্ছেমতো দিয়ে দিলো। তারপর জায়গামতো রেখে দিল পারফিউমটা। তখনি ওয়াশরুমের দরজা খট করে খোলার শব্দ হলো। অরিত্রিকা চমকে ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেথায়। অরিত্রিকা তুই আজ শেষ। পেছন থেকে তখনি ভেসে এলো রাশভারী কন্ঠস্বর।
“ আমার রুমে তুই কি করছিস? ”
অরিত্রিকা রাশভারী কন্ঠে চমকে উঠল। মুখ খিঁচে রইল কিয়ৎ সময়। ভয়ে যেন জান জমে গেছে। সে ভয়ার্ত ভঙ্গিতে পেছনে তাকায়। চোখ বন্ধ করে মিনমিন করে বলে উঠে ;
“ সারহান ভাই আসলে লেভি আপনার রুমে এসেছিল। তাই নিতে এসেছিলাম। ”
সারহান রক্তচক্ষু চাহনিতে অরিত্রিকার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসল। চোয়াল শক্ত করে করে বলল;
“ আমার অনুমতিব্যতিত পারফিউম ইউজ করেছিস?”
অরিত্রিকা হচকচিয়ে গেল। এবার কি হবে তার। এখান থেকে নিজেকে কোনোরকম বাঁচিয়ে পালাতে হবে। সে গরগর করে মিথ্যা বলল ;
“ আমি পারফিউম ইউজ করিনি, লেভি ইউজ করেছে।”
“ হোয়াট?”
“ হ্যা হ্যা। লেভি আমাকে বলেছিল আপনার পারফিউম তার পছন্দ হয়েছে। তাই সে মাখতে চায়। আমার কথা বিশ্বাস না হলে লেভিকে জিজ্ঞেস করুন। লেভি বেবি মামুকে বলো তুমি পারফিউম গায়ে মাখবে বলে আবদার করেছিলে।”
শেষোক্ত কথাটি শুনে সারহানের মেজাজ বিগড়ে গেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠল ;
“ আমাকে লেভির মামু বলা বন্ধ কর নয়তো থাপ্পড় মে*রে মুখ উল্টাপাল্টা বলার সাধ মিটিয়ে দেব। ”
অরিত্রিকা ঢোক গিলে পিটপিট করে চাইল সারহানের পানে। রক্তাভ বর্ণের দুটো চোখ তার দিকে নিবদ্ধ। হাত পা কাঁপতে লাগল তার। ভালোভাবে তাকাতেই খেয়াল করল সারহান উন্মুক্ত শরীরে শুধু তোয়ালে পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন অবতারে দেখে বাকরূদ্ধ। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল সে। একহাতে তড়িঘড়ি করে চোখ চেপে ধরে উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠল;
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ১৪
“ এমন অর্ধনগ্ন সেক্সি অবতারে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে লজ্জা করছে না আপনার। এই ছোট্ট জীবনে আপনার জীবন যৌবন সব দেখে ফেললাম। দ্রুত যৌবন ঢাকুন সারহান ভাই। ”
অরিত্রিকার চিৎকারে লেভি ভয়ে লাফ দিয়ে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সারহানের ক্রোধ যেন আরও তুঙ্গে। সে এক একদম এগিয়ে এসে অরিত্রিকার সামনে দাঁড়ালো।