প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২১

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২১
আদ্রিতা নিশি

মেহমুদ রঈসের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে সকাল সাড়ে দশটায়। রাজশাহী শহর সংলগ্ন একটা কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। সেই জানাজায় গুটি কয়েক মানুষ উপস্থিত ছিলো। সারহানও সেথায় সামিল হয়েছিল। বিরোধী দলের থেকে খবরটা যথাসম্ভব হাইড করে সম্পূর্ণ কার্যকলাপ সম্পূর্ণ করেছে। মুন হৈমীকে তার বাবার সাথে শেষ বারের মতো দেখা করাতে নিয়ে এসেছিল।
বাচ্চাটা বারবার অবুঝ কন্ঠে মেহমুদ রইসের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছে “ আন্টি আব্বু কতা বলছেনা কেনো? আব্বু শুয়ে আছে কেনো?”
মুন শুধু মলিনমুখে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ছিল কান্নারোধ করে। কিন্তু নিরবে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে চক্ষু বেয়ে। কন্ঠনালী রোধ করে রেখেছিল। কী বলবে সে? উত্তর দেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই।
বাচ্চাটা পুনরায় বলেছিল;

“ আন্টি আমি আব্বুর কোলে উঠবো। আব্বু আমায় কেনো কোলে নিচ্ছে না। চুপচাপ শুয়ে আছে কেনো? আব্বু সাদা জামা পড়ে আছে কেনো? জামাটা আব্বুর গায়ে ভালোলাগছে না৷”
আরও কত-শত কথা বলেছিল। হৈমী যখন দেখলো তার বাবা সাড়া দেয় না,কথা বলে না তখন চিৎকার দিয়ে কাঁদছিল। মুনও বাচ্চাটার কান্না দেখে নিজেও কেঁদে ফেলে। কীভাবে বলবে সে তার বাবা নেই। সারহান দূর থেকে নির্বিকারচিত্তে বাবা- মেয়ের হৃদয়বিদারক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে এগিয়ে এসেছিল হৈমীর দিকে। হৈমী তখন মানুষের কাঁধে ভর করে নিয়ে যাওয়া খাটিয়ার দিকে। কি নির্মম দৃশ্য।
হৈমী কেঁদে বলছিল ;
“ আমার আব্বুকে সবাই কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমিও যাবো আব্বুর সাথে। ও আব্বু আব্বু রে আমায় নিয়ে যাও তোমার সাথে। আমায় নিয়ে যাও। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সারহান অনুভূতি শূন্য চাহনিতে দেখছিল নিস্পাপ বাচ্চাটিকে। একমুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল। অনুতপ্ততার রেষ তার মুখাবয়বে ফুটে উঠেছিল। হৈমীর মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বলেছিল ;
“ তোমার আব্বুকে নতুন বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হৈমী। সেখানে তোমার আব্বু শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকতে পারবে। ”
হৈমী বাচ্চাসুলভ কথায় কেঁদে বলেছিল;
“ আমিও যাব। আব্বুর সাথে নতুন বাড়িতে থাকব। ”
সারহানের পাষাণ মন কেঁপে উঠেছিল। মলিন হেসে বলেছিল ;
“ উহু আজ যাওয়া যাবে না।অন্য একদিন নিয়ে যাব তোমার আব্বুর নতুন বাড়িতে। ”

হৈমী তবুও শান্ত হয়নি। ছোট বাচ্চাটা উচ্চস্বরে অঝোর নয়নে কাদছিল। কিছুক্ষণের ভেতরে মেহমুদ রঈসকে দাফন করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। মুন সেখানে আর থাকে না। হৈমীকে নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। সারহান ভাবে মেহমুদ রঈসের পাপ যেন মুহুর্তেই তার আগ্রাসী রুপ দেখিয়ে দিল। পাপ যে বাপকে ছাড়ে না তা প্রমাণিত হলো। এই পাপের দুনিয়ায় শুধু রেখে গেল এক নিস্পাপ ফুল। যার নাম এখন এতিমের খাতায় লিপিবদ্ধ।
সারহান অশান্ত ভঙ্গিতে বাড়িতে প্রবেশ করল। আজ পার্টি অফিসে যায়নি। সব মিটিং ক্যান্সেল করেছে। কারণ আজকে অরিনকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। সেখানে বড় ভাই হিসেবে উপস্থিত থাকা তার কর্তব্য। আবির এবং ইনান আজকে চৌধুরী বাড়িতে আসবে। তাদের দুজনকে আরশাদ সাহেব ইনভাইট করেছেন।
“ অরিত্রিকা চুড়িগুলো পছন্দ হয়েছে? ”

অরিত্রিকা নিজের রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। মন একটু উদাসীন। কেন হঠাৎ এমন হচ্ছে তার জানা নেই। একটু আগে তিশার কল এসেছিল। ভার্সিটিতে দুইদিন পর একটা প্রোগ্রাম আছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ আরও বিভিন্ন কর্মসূচি থাকবে। মেয়েদের শাড়ি এবং ছেলেদের পাঞ্জাবি পড়ে যেতে হবে।এটা ডিপার্টমেন্টের প্রধানদের সিদ্ধান্ত। এসব ভাবনার মাঝেই ইরফানের কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করে। সে তৎক্ষনাৎ পাশে তাকায়। দেখে ইরফান দাঁড়িয়ে আছে পাঞ্জাবি পড়ে।
অরিত্রিকা মৃদু হেসে উত্তর দেয় ;
“ হ্যা পছন্দ হয়েছে। ”
ইরফানের মুখাবয়বে উচ্ছ্বসিত ভাব ফুটে উঠল। শান্ত কন্ঠে বলল ;

“ চুড়ি পড়েছিলি? ”
“ হ্যা পড়েছিলাম গত রাতে। ”
“ ওহহ। কিছু নিয়ে চিন্তা করছিলি? ”
অরিত্রিকা ইরফানের দিকে তাকায়। ইতস্তত ভাব নিয়ে বলে ;
“ হ্যা। ”
ইরফান জানতে চাইল ;
“ কী নিয়ে চিন্তা করছিস? ”
“ দুইদিন পর ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম। সেই প্রোগ্রামে পার্টিসিপ্যান্ট করতে হবে। ফ্রেন্ডসরা নাচবে কিন্তু আমি কী করব বুঝতে পারছি না। ”
“ তুই ভালো গান গাইতে পারিস। আমার মতে তোর গান গাওয়া উচিত। ”
অরিত্রিকা একটু চমকালো বোধ হয়। সে যে টুকটাক গান গায় সেটা তো ইরফান ভাইয়ের জানার কথা না তাহলে জানল কীভাবে? কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করল ;

“ ইরফান ভাই আপনি কি করে জানলেন আমি ভালো গান গাই?”
ইরফান হাসল ;
“ দুই,তিনদিন আগে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে গান গাইছিলি তখন শুনেছিলাম। ”
“ লুকিয়ে লুকিয়ে গান শোনা খারাপ অভ্যাস ইরফান ভাই। ”
“ কিছু কিছু খারাপ অভ্যাস জীবনে থাকা দরকার বুঝলি। ”
“ আর কি কি খারাপ অভ্যাস আছে শুনি? ”
“ ভালোবাসা।”
ইরফানের কন্ঠস্বর দৃঢ় এবং শান্ত। চাহনি ভীষণ গভীর। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরিত্রিকার দিকে। অরিত্রিকা হতবাক হয়ে গেল। ইরফান ভাই এসব কী বলছে? তাহলে কি উনি কাউকে ভালোবাসেন? আগ্রহী হয়ে শুধায় ;
“ আপনি কী কাউকে ভালোবাসেন?”
ইরফান চওড়া হেসে বলে ;

“ ছোট হয়ে বড়দের পার্সোনাল বিষয়ে এতো জানতে নেই।”
“ আমি বড় হয়ে গেছি। বলুন কাউকে ভালোবাসেন? ”
“ হ্যা। একজনকে ভালোলাগে অথচ বলতে পারছি না। ”
অরিত্রিকা কিছুক্ষণ মৌন রইল। বড়দের মতো ভ্রুযুগল কুঁচকে কিছু একটা ভাবল। অতঃপর গড়গড় করে বলল ;
“ টিপস দিবো। ”
ইরফান কিছুক্ষণ স্থির নয়নে তাকিয়ে রইল অরিত্রিকার প্রাণবন্ত আমোদিত চেহারার দিকে। তার বুকের মাঝে অনুভূতিরা প্রজাপতির ন্যায় উড়ছে। অব্যক্ত অনুভূতি উগ্রে বাহিরে আসতে চাইছে। মায়াবী মুখখানা দেখে বক্ষ শীতল হয়ে আসছে। মন চাইছে এতোদিনের গোপন করে রাখা প্রণয়ের কথা বলে দিক। কিন্তু নাহ! এখন সঠিক সময় নয়। মেয়েটা তো এখনো তাকে ভালোবাসার নজরে দেখেনি। একটু সময় নেওয়া জরুরী। ঠিক সময় ছোট মামুর কাছে অরিত্রিকাকে নিজের করে নেওয়ার প্রস্তাবটুকু রাখবে।
ইরফান মনের মাঝে চলমান অনুভূতি দমিয়ে রেখে বলে ;

“ দরকার নেই। ”
অরিত্রিকা তো নাছোড়বান্দা। জেদ করে বলে উঠল ;
“ তাহলে মেয়েটার ছবি দেখান। আমি ভাবির ছবি দেখবো। ”
ইরফান হতাশাপূর্ণ চাহনিতে তাকায় মেয়েটার দিকে। যে মেয়েকে সে পছন্দ করে বলে জানালো। সেই মেয়েই নিজের অজান্তে তার ভালোবাসার মানুষটিকে ভাবি বলছে। যেদিন জানবে ভাবি আর কেউ নয় সে নিজেই তখন কি হবে?
ইরফান ভার মুখে বলে উঠে ;
“ অন্য কোনোদিন দেখাবো। ”
অরিত্রিকা কিছু বলবে এমন সময় সারহানকে সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে যায়। কন্ঠনালী হতে বেরোনো কথা গলদেশে আটকে যায়। ইরফান অরিত্রিকাকে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। সারহানকে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হচকচিয়ে উঠে। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় সে। হাসার ভাণ করে বলে উঠে ;

“ আরে সারহান কখন আসলি? ”
সারহান তৎক্ষনাৎ উত্তর দেয় না। আগের মতোই দাঁড়িয়ে থাকে স্থবির হয়ে। ইরফান অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলে উঠল ;
“ নিচে চাচা ডাকছে আমি তাহলে গেলাম। ”
ইরফান আর একমুহূর্ত দাঁড়াল না। সারহানকে ডিঙিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নিচে নেমে গেল। সারহানের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রইল। গাঢ় চাহনিতে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ করল ;
“ দশ মিনিটের মধ্যে আমার রুমে আসবি। ইটস্ মাই অর্ডার ফাইরুজ। ”
সারহান হনহনিয়ে চলে গেল রুমের দিকে। অরিত্রিকা হ্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে রইল সারহানের প্রস্থানের দিকে। কাহিনী কি হলো ঝড়ের গতিতে এলো আদেশ করল আবার টর্নেডোর মতো চলে গেল। অরিত্রিকাকে ভয় আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরল। এই জল্লাদ তাকে কেনো ডাকছে? নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে।

সারহান ফ্রেশ হয়ে রুমে আসে। মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে।মন মেজাজের অবস্থা ভালো নেই। বাড়িতে প্রবেশ করেই অরিত্রিকা আর ইরফানকে একসাথে দেখেছে। তাতেই মেজাজ বিগড়ে গেছে।কোনো মতো নিজেকে কন্ট্রোল করে সেখান থেকে চলে এসেছে। অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই পিটিয়ে আধ মরা করে হসপিটালে এডমিট করে দিতো। কিন্তু ভাই – ব্রাদার দের মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে ঝামেলা না করা ভালো। দুজনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল তাতে খারাপ কিছু নেই। কিন্তু ইরফানের বলা কথাগুলো শ্রবণ হতেই ক্রোধ ঠিকরে পড়ছে বক্ষে। ইরফান যে অরিত্রিকাকে আগে থেকে পছন্দ করে সেটা সে জানে। প্রেমিকদের অনুভূতি তার অগোচরে থাকা কখনো সম্ভব নেয়। সে মানুষের চাহনি দেখে বুঝতে পারে মানুষটার ভেতরে চলমান অব্যক্ত অসুখ। আর ইরফানের মনে চলছে অব্যক্ত প্রেমাসুখ। সারহান ভীষণ আশ্চর্যিত হয় অরিত্রিকার বোধবুদ্ধি নিয়ে। মেয়েটা যে এতোটা মাথামোটা হবে তার জানা ছিল না। একটা ছেলের মনে কি চলছে তা একটা মেয়ের থেকে ভালো কেউ বুঝতে পারেনা৷ এদিক দিয়ে অরিত্রিকা উল্টো। মাথামোটা মেয়েটা না ইরফানের মনের খবর জানে আর না তার। সারহান তো চায়নি অরিত্রিকাতে আসক্ত হতে। কিন্তু আসক্ত হয়ে গেছে। সে তো চায়নি মনের মাঝে কারো জন্য দুর্বলতা অনুভব করুক, তবুও সে করছে। সবসময় চেয়েছে দূরে থাকতে, তবুও কাছে আসছে। এই অবাধ্য অনুভূতি তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। যেখান থেকে বেরোনো ক্রমশ দুঃসাধ্য হয়ে যাচ্ছে।

অরিত্রিকা চোখ মুখ শক্ত করে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। আজ এসেছে সাহস সঞ্চার করে। যুদ্ধের আগে যেমন প্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নামে ঠিক তেমন ভাবে এসেছে। আজ এমন তেমন কিছু একটা করলে চুং চাং ফু মানে কুংফু ক্যারাটি স্টাইলে সারহানের সাথে লড়াই করবে। কিন্তু নিজের দিকে তাকিয়ে হতাশায় ডুবে যায়। এই চিকনা দেহ নিয়ে কীভাবে লড়াই করবে? দেখা যাবে সারহান ভাইয়ের এক ফুতে সে উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়বে। মেঝেতে পড়লে এবার নিশ্চিত কোমড় ভেঙে যাবে। এমন অবাস্তব ধারণায় ডুবে যায় সে।
“ দরজার সামনে সঙয়ের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে আয়। ”
অরিত্রিকার ভাবনা ঠুস করে উড়ে যায়। সারহানের কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতে সম্বিত ফিরে। চক্ষু টান টান করে তাকায় রুমের ভেতরে। দরজা আধখোলা থাকায় সরাসরি সারহানের সাথে চোখাচোখি হয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দৃষ্টি স্থির রাখার সাহস করে না। অপ্রস্তুত হয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। শুকনো ঢোক গিয়ে প্রবেশ করে রুমে। নিঃশব্দে এগিয়ে যায় সারহানের দিকে। সারহান একপলক অরিত্রিকার ভীতিগ্রস্ত মুখশ্রীতে তাকিয়ে ডিভানে গিয়ে বসল। পরক্ষণে নিস্তব্ধতা ভেঙে গমগমে কন্ঠে বলে ;

“ বস। ”
অরিত্রিকা আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খোঁজে। না পেয়ে মিনমিন করে বলে ;
“ কোথায় বসবো? ”
“ চোখের সামনে বসার যোগ্য আস্ত একটা বিছানা আছে সেটা চোখে পড়ছে না?”
“ বসলে যদি আপনার বিছানা নোংরা হয়ে যায়? ”
অরিত্রিকা একটু পিন্চ মেরে কথাটা বলল। সারহান তা অনায়াসে বুঝে ফেলল। তার ভ্রুযুগল বেঁকে গেল। গাম্ভীর্যতা এঁটে বলল ;
“ আজ বসলে নোংরা হবে না। ”
অরিত্রিকা কথা না বাড়িয়ে বিছানার এককোণে বসে। কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে তার। নত মস্তকে আঙুল দ্বারা ওড়নার একপাশ পেঁচাতে লাগল। সারহান শীতল চাহনিতে তাকায়। সেই চাহনিতে নেই কোনো ক্ষোভ, ঘৃণা।
“ ভার্সিটিতে যে ছেলে তোকে ফুলের বুকে এবং চিঠি দিয়েছিল সে এখন আমার কাছে আছে। ছেলেটাকে দুইটা থাপ্পড় দিতেই গড়গড় করে আসল কাহিনী বলে দিয়েছে। ”
অরিত্রিকা বিস্মিত হয়ে গেল। সরাসরি তাকাল শ্যামমানবের দিকে। থমথমে গলায় বলল ;
“ কী বলেছে? ”
“ বেশী কিছু বলেনি। শুধু বলেছে কেউ একজন তোকে ভালোবাসে। তার পক্ষ হতে উপহার গুলো তোর কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। ”

সারহানের অতি স্বাভাবিক আচরণে অরিত্রিকা ভড়কে যায়। কিছুটা ভয়ের আভা সঞ্চার হয় মন মাঝারে। আর এই কোন হারামখোর প্রেমিক টপকালো হঠাৎ। ওই বজ্জাত ব্যাটার জন্য সেদিন সারহানের হাতে দাবাং মার্কা থাপ্পড় খেয়ে ভস্কে গেছিলো। আহ! গালটা ব্যথায় এখনো টন টান করছে। সেসব আজগুবি চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে শুধায় ;
“ হারামখোর লোকটার খোঁজ পেয়েছেন? ”
সারহান বিদ্রুপাত্মক স্বরে বলল ;
“ কেনো? ওই বাস্টার্ডটার সাথে দেখা করবি?”
“ উহু থাপ্পড় মারব। আপনি যে থাপ্পড় মেরেছিলেন আমায় সেটার শোধ ওই হারামখোরকে মেরে নিবো। ”
“ তুই থাপ্পড় মারার আগেই আমি ওর জান নিয়ে নেবো। ”

অরিত্রিকা সংকুচিত নয়নে তাকায় সারহানের মুখপানে। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আরামসে ডিভানে গা এলিয়ে বসে আছে। আজকাল সারহানকে ভীষণ অন্যরকম মনে হয়। ভাবমূর্তি, কথাবার্তা, চাহনি ভীষণ অদ্ভুত। সেদিন রাতের কথা মনে আছে তার। এতটুকু ঠাওর করেছে সারহান ভাই বদলে যাচ্ছে। এই বদলানোর কারণ কি তবে সে? এমপি সাহেবের না হওয়া বিবিজান! এতোটুকু ভেবেই কেঁপে উঠল সে। তবে কী সারহান ভাই বুঝতে পেরেছে সে দুষ্টুমি করে ফোনে কথা বলতো। আর ভাবতে পারল না। সারহান ভাই আস্ত গোলক ধাঁধা তার কাছে। যার সমাধান জানা নেই।
অরিত্রিকা দুরুদুরু বুকে সাহস জুগিয়ে কোনো মতো বলে ;
“ আপনি আমাকে কেন ডেকেছেন সারহান ভাই? কিছু লাগলে বলতে পারেন এনে দেবো। ফটাফট বলে ফেলুন কী চাই আপনার?”

সারহান পায়ের ওপর পা তুলে সাহেবী ভঙ্গিতে বসে। ওষ্ঠ বাঁকিয়ে নির্বিকারচিত্তে বলে উঠে ;
“ তোকে চাই। পার্মানেন্টলি এনে দিতে পারবি? ”
অরিত্রিকার বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। মুহূর্তেই শরীরের সমস্ত রক্ত হিম হয়ে যায়। শরীরে প্রবাহিত রক্ত যেন ছকলে উঠে। সে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে কথার মানে বোঝার চেষ্টা করে। সারহানের কথাটা ঠিক কী মানে, সেটাই প্রথমে ঠাহর করতে পারে না সে। কিন্তু পরক্ষণেই বুকের ভেতর কেমন যেন শূন্যতা তৈরি হয়। সারহানের ওষ্ঠ জুড়ে চোরা হাসি খেলে যায়। চক্ষুদ্বয়ে নিখাদ সত্যের বহিঃপ্রকাশ।
অরিত্রিকারচোখ বড় হয়ে যায়।গলা শুকিয়ে আসে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন স্বরে বলে,
“আপনার মজা করার ধরণটা খুব অদ্ভুত, সারহান ভাই।”
সারহান একটুও নড়ল না। ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি রেখে বলল,

“আমি কি মজা করছি মনে হচ্ছে?”
“ হ্যা।”
অরিত্রিকার সহজসরল স্বীকারোক্তি। সারহান তপ্ত শ্বাস ফেলে। শান্ত কন্ঠে প্রতুত্তরে বলে ;
“যে অনুভূতিগুলো এতদিন অন্তরের গহীনে কঠোর শৃঙ্খলে বন্দি ছিল। সেগুলো তোর ছোঁয়ায় উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছে। সংযমের কারাগার ভেঙে তারা মুক্তির আর্তি জানাচ্ছে। বেপরোয়া হয়ে ছুটে আসতে চাইছে। তো, এখন আমি কী করব? এই অনুভূতিদের দমন করব, নাকি তাদের মুক্তির পথ দেখাব? ”
অরিত্রিকা বাকরুদ্ধ। সারহানের কন্ঠনালী হতে নিঃসৃত শব্দগুচ্ছ যেন বক্ষপিঞ্জরে তীরের ন্যায় উদ্দাম বেগে ছুটে এসে লাগল। সে বিমূঢ় চাহনিতে নিষ্পলক চেয়ে রইল। বক্ষে যেন অদৃশ্য ঝড় আছড়ে পরেছে। এক লহমায় কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। শিরদাঁড়া বেয়ে বইয়ে গেল শীতল স্রোত। শরীর কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে। সারহান ভাই তাকে পছন্দ করেন এটাই কী বোঝাতে চাইল! হয়তো। কিন্তু বোকা মন বেইমানী করল। এসব কথা বিশ্বাস করল না। এগুলো নিশ্চয়ই তাকে কাবু করার নতুন ট্রিকস।

“ আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”
এতোটুকু বলতেই অরিত্রিকার কন্ঠনালী জড়িয়ে এলো। কিছুটা কেঁপে উঠল সে। চাহনি নির্জীব প্রাণহীন। সারহান মৃদু হাসল। অনড় ভঙ্গিতে বলল ;
“”ভালোবাসার কথা প্রকাশ করা উচিত নয়, মেয়ে। কারণ অনুভূতির উন্মোচন কখনো কখনো ভালোবাসার মানুষকে আরও দ্রুত দূরে সরিয়ে দেয়। তাই তো আমি চেয়েছি আমার হৃদয়ের ভাষা নীরব থাকুক, আমার অনুভূতি নির্বাক হয়ে থাকুক। থাক না, এই ভালোবাসা অপ্রকাশিত, গোপন একান্তই আমার অন্তরে।”
“ আমি আপনাকে ভালোবাসি না সারহান ভাই। আমি আপনার মতো পাষাণ মানুষটাকে ভালোবাসি না। আমি চাই আপনি আমার থেকে দূরে থাকুন।”
অরিত্রিকা হঠাৎ উচ্চস্বরে বলে উঠল। তার চক্ষুদ্বয় ছলছল করে উঠল। তড়িৎ বেগে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ক্রোধ মিশ্রিত চাহনিতে তাকাল সারহানের দিকে।
সারহান বাঁকা হেসে বলে উঠল ;
“ তোর থেকে দূরে থাকা আর সম্ভব নয় ফাইরুজ। ”
অরিত্রিকার রাগে ক্ষোভে নাসিক্যের পাটাতন ফুলছে। সে ধপাধপ পা ফেলে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে লাগল দ্রুত। অকস্মাৎ পেছন থেকে সারহান হাত চেপে হেঁচকা টান দেয়। অরিত্রিকা নিজের ভারসাম্য সামলাতে না পেরে আছড়ে পড়ল পুরুষালী বক্ষে। চোখ মুখ খিঁচে এক হাতে আঁকড়ে ধরল সারহানের টিশার্ট। পুরুষালী ছোঁয়ায় দেহে কাঁপন ছড়িয়ে দিল।

“ আমার দিকে তাকা। ”
সারহানের ভরাট কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অরিত্রিকা মিইয়ে গেল। রাগ,ক্ষোভ কর্পূরের ন্যায় উড়ে গেল। শিউরে উঠল কিছুটা। শুকনো ঢোক গিলে নেত্রপল্লব মেলে দ্বিধা নিয়ে তাকাল। সারহান অপলক চেয়ে রয়েছে অরিত্রিকার ভয়াতুর মুখপাণে। মেয়েটির শরীর কাঁপছে, ওষ্ঠ তিরতির করে কাঁপছে। কপাল জুড়ে ছড়িয়ে আছে চুল। সারহান ফিচেল হাসে। ওষ্ঠপুট গোল করে ফু দেয় কপালে। অরিত্রিকা পুনরায় আরও শক্ত করে খামচে ধরল টিশার্ট। কোনো পুরুষের এতোটা সান্নিধ্যে এসে মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। দমবন্ধকর এমন শিহরণে কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেল। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে হাসফাস করতে লাগল।
অরিত্রিকা সারহানের দিকে না তাকিয়ে নিজেকে সামলে কম্পনরত কন্ঠে বলে;

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২০

“ আমার হাত সারহান ভাই। ”
সারহান অমসৃণ হাতের বাঁধন আরেকটু দৃঢ় হয়। দুরত্ব কিছুটা কমে যায়।অন্য হাতে অরিত্রিকার ওষ্ঠকোণ স্পর্শ করে। মাদকতা মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে;
“আমি তোর হাত ধরেছি শুধুমাত্র কিছু মুহূর্তের জন্য নয় বরং সারাজীবনের জন্য। তোকে হারানোর জন্য নয়, নিজের সবচেয়ে আপন করে রাখার জন্য। যতদিন আমার শ্বাস চলবে ততদিন তোকে ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। তুই আমার চিরদিনের জন্য। এটাই ভবিতব্য।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২২