প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২৬
আদ্রিতা নিশি
সূর্য অস্তমিত হয়েছে দীর্ঘক্ষণ হয়ে গেছে। অনামিশায় ছেয়ে আছে চারিদিক। ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে রাত। এখন রাত প্রায় গভীর হয়ে এসেছে। তবে আবহাওয়া তার নতুন রুপকে স্বাগত জানিয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষটা শুরু হয়েছে ঝড় বৃষ্টির তান্ডবে। ব্যস্ত শহর আজ প্রকৃতির হঠাৎ পরিবর্তনে বৃষ্টিস্নাত রাতের শহরে পরিনত হয়েছে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে ধরণীতে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝিলকে উঠছে। মৃদুমন্দ দমকা হাওয়া বইছে প্রকৃতিতে। শান্ত স্থির প্রকৃতি অশান্ত হয়ে উঠেছে। শহুরে মানুষজন নিজেদের কাজ কর্ম ফেলে ছুটছে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
শান্ত প্রকৃতি যেমন খেই হারিয়েছে বৃষ্টির সহিত দমকা হাওয়ার মিশ্রণে।
তেমনি আজ এক মানবীর হৃদয় খেই হারিয়েছে তার বিপরীত ধর্মী মানবের প্রতি। বিমোহিত হয়ে ক্ষণকাল ভুলে এক ধ্যানে ভেবে চলেছে। মেয়েলী মনসত্তা আজ ভীষণ অশান্ত। বক্ষের ভেতরে চলছে মনের সাথে মস্তিষ্কের নিরব দ্বন্দ্ব। এই শব্দহীন দ্বন্দ্বের সংমিশ্রণে অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ সহজ নয় বরং ভীষণ জটিল। মনের মাঝে চলমান অজানা অনুভূতির ঢেউ এবং মস্তিষ্কে চলমান আবেগহীন শব্দগুচ্ছের ভান্ডার। যেখানে মন ও মস্তিষ্ক বিরোধীতা করছে। বারবার ইচ্ছে করছে মানবটির ভাবনা থেকে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসুক। কিন্তু বারবার চক্ষুপটে ভেসে উঠছে উদ্বিগ্ন, উত্তেজিত চাহনি। সেই চাহনিতে অদ্ভুত অনুভূতির দোলাচলন দেখা গিয়েছে বক্ষপিঞ্জরে। অরিত্রিকা নিজেকে যতোটা বোকা ভাবে তার মেয়েলী মন ততোটা বোকা নয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পুরুষের চাহনি, বাচনভঙ্গি, কথোপকথন, আচরণ সবকিছু বোঝার হুসটুকু আছে। কিন্তু তবুও কিছু কিছু অনুভূতির হদিস পেলেও মন কেন যেন মানতে চায় না। উক্ত কারণ বশত উপেক্ষা করে বসে অন্য মানুষের প্রতি জন্মানো বিশ্বাসটুকু। এই যে সারহানের হঠাৎ উগ্র আচরণ, অদ্ভুত কথাবার্তা, শান্ত ব্যবহার, অনুভূতি মিশেল কথা এগুলো খুব কাছ হতে লক্ষ্য করেছে। তার চুলে ফুল গুঁজে দেওয়া, উক্ত সময়ের শান্ত চাহনি, ছোট্ট – ছোট্ট প্রশংসা আরও অনেক কিছু লক্ষ্য করেছে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে কখনো গভীরভাবে ভেবে দেখেনি। ইচ্ছে করে ভেবে দেখার ইচ্ছে করেনি। তবে আজকে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। অরিত্রিকা নিজের রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। ওষ্ঠ জুড়ে বিরাজ করছে লাজে রাঙা হাসি। দৃষ্টি বাহিরের বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির দিকে।
কি স্নিগ্ধ প্রকৃতি! কি সুন্দর পরিবেশ। মন প্রাণ যেন শীতল হয়ে যাচ্ছে। অরিত্রিকার হঠাৎ স্মৃতি রোমন্থন করে। সারহান প্রথম যেদিন সাথী বেগমের থেকে অনুমতি নেয় এবং তাকে হাতের জন্য ড্রেসিং করাতে নিয়ে যায়। সেদিন ফেরার পথে বায়না করেছিল ফুল কেনার। অনেকটা পথ পেরিয়ে আসার পর পুনরায় ফ্লাওয়ার শপে উদ্দেশ্যে নিয়ে গিয়েছিল। ভার্সিটিতে বখাটেগুলো তাকে ডিস্টার্ব করেছিল তাই তাদের মে*রে আধ ম*রা করেছিল। আরও অনেক স্মৃতি চক্ষু পটে ভাসছে। এগুলো কী তবে সারহান ভাইয়ের তার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিল! ভাবতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। শিহরণ খেলে গেল রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বক্ষে ধুকপুক করছে তার। লজ্জায় নেতিয়ে পড়া লতার ন্যায় নেতিয়ে পড়ল।
অরিত্রিকা অশান্ত দোদুল্যমান মন নিয়ে কৌতুহল বশত তাকায় পাশের বেলকনির দিকে। বেলকনিতে হালকা হলদেটে বাল্ব জ্বলছে, দরজা খোলা। রুমের ভেতরে তেমন একটা দেখা যায় না। তবে ভেতরে লাইট জ্বলছে এতটুকু বুঝতে পারল। তারমানে সারহান ভাই জেগে আছে। সকালে মানুষটার সম্মুখীন হবে কী করে? ভেবে একটু শঙ্কিত হলো। অরিত্রিকা দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিজেকে সামলে নেয়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় আর কোনো কিছু ভাববে না। সবার সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে হবে। বিশেষ করে সারহান ভাইয়ের সামনে।
“ অরিত্রিকা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কোন ভুতের নানার সাথে কথা বলছিস? ”
রুমের ভেতর থেকে ভেসে এলো ইশরার গমগমে কন্ঠস্বর। অরিত্রিকা চমকে যায়। মেজাজও গরম হয়ে যায় একটু। ওষ্ঠকোণের হাসি মিলিয়ে যায় তৎক্ষনাৎ। মুখাবয়বে ফুটে ওঠে ক্রোধ। তিরিক্ষি মেজাজে উত্তর দেয় ;
“ দিলি তো আমার ভাবনার মাঝে ডান পা চালিয়ে। বেদ্দপ মাইয়া। ”
তখনি হাস্যরত কন্ঠের কথা ভেসে এলো ;
“ কার ভাবনায় বিভোর তুমি ওহে রমনী। ”
“ তোকে বলা যাবে না। বললে দেখা যাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে সবাইকে বলে বেড়াবি! ”
“ তাড়াতাড়ি ভেতরে আয়। ”
“ কেন। ”
“ আরে শাড়ি সিলেক্ট করতে হবে। ”
“ আসছি। ”
অরিত্রিকা পুনরায় বেলকনির দিকে তাকিয়ে একপলক অবলোকন করে তড়িঘড়ি করে ছুটলো নিজের রুমের দিকে।
সকাল থেকে চৌধুরী নিবাসে তোড়জোড় চলছে। বাড়ির সবাই আজকে সবাই ব্যস্ত। দুইদিন পর অরিনের আকদের কথা থাকলেও পাত্রপক্ষ আজ সকালে জানিয়েছে আগামীকাল দুপুর পর আকদ করাবেন। রাহাত পরশুদিন ঢাকায় ফিরবে তাই এতো তাড়াহুড়ো। আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব ছেলের বাবাকে আর বারণ করেননি। যেহেতু এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গিয়েছে আকদ করিয়ে রাখলে মন্দ হবে না। ছোট পরিসরে ঘরোয়া ভাবে অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আজকে রাতে মেহেন্দী, হলুদের অনুষ্ঠান ছাঁদে করা হবে। সারহান যেহেতু আজ সকালেই কল্লোল ফাউন্ডেশন নামক প্রতিষ্ঠানে গিয়েছে সেহেতু সব কাজের দায়িত্ব ইরফান এবং সাদাতের ওপর পড়েছে। সকাল থেকে দুজন ছাঁদে স্টেজ সাজানোর দিকটা দেখাশোনা করছে। আরশাদ সাহেব নিজেদের পরিচিত কয়েকজনকে ইনভাইট করেছে। আজমল সাহেব অরিত্রিকার মামা মামীকে আসতে বলেছেন। উনারা ছেলেমেয়ে সহ আসতে চেয়েছেন। ঘরোয়া ভাবে অনুষ্ঠান হলেও গেস্ট বেশী থাকবে। তানিয়া বেগম, সাথী বেগম এবং ইসমা বেগম রান্নার কাজে ব্যস্ত। দুপুরে কয়েকজন মেহমান আসবে তাদের আপ্যায়ন করতে হবে তাই হাত চালিয়ে কাজ করছেন। সার্ভেন্টরা পুরো বাড়ি ক্লিন করছে।
অরিন নিজের রুমের বিছানায় উদাসীন ভঙ্গিতে বসে আছে। হাতের মুঠোয় তার ফোনটা অনবরত বেজে চলেছে। কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল নেই মেয়েটার। কেমন অনুভূতিহীন নীতিবিবর্জিত ভঙ্গিতে বসে আছে। মনে হচ্ছে কোনো সমুদ্রের জলে ডুবে গেছে। এর মাঝেই অরিত্রিকা এবং ইশরা চঞ্চল পায়ে প্রবেশ করে। অরিনকে মন খারাপ করে থাকতে দেখে তাদেরও মন খারাপ হয়। দুজন গিয়ে বসে বোনের পাশে।
অরিত্রিকা মুখ ভার করে জিজ্ঞেস করে ;
“ আপু!”
অরিনের হুস ফিরে। মলিন মুখে তাকায় অরিত্রিকা এবং ইশরার দিকে। অতি কষ্টে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলল ওষ্ঠকোণে। নিদারুণ যন্ত্রণা আড়াল করে বলল ;
“ তোদের শাড়ি ঠিক করা হয়েছে। কোন কালার শাড়ি পড়বি? লাল নাকি হলুদ? ”
অরিত্রিকা বোধ হয় একটু অবাক হলো। অরিনের থেকে এমন কথা আশা করেনি। তবুও স্বাভাবিক ভাবে বলল ;
“ সি গ্রিন কালার শাড়ি পড়ব। ”
“ ওমা হলুদ আর মেহেন্দিতে কে সিটি গ্রিন কালারের শাড়ি পড়ে?”
“ আমরা পড়ি। ”
ইশরা দ্রুত উত্তর দিল। অরিন ম্লান হাসল। অরিত্রিকার কপাল কুঁচকে গেল। সন্দেহবাতিক কন্ঠে বলল ;
“ আপু তুমি ঠিক আছো? ”
অরিন ম্লান হেসে প্রতিত্তোর করল ;
“ আমার কী হবে? ”
“ গতকাল থেকে তোমাকে স্বাভাবিক লাগছে না। এই বিয়েতে তোমার মত আছে তো?”
“ মত কেন থাকবে না পাগলী? বাবা মা কী আমার খারাপ চাইছে যে মত থাকবে না? ”
“ রাতে কেন না খেয়ে ঘুমিয়েছিলে? কতোবার ডাকলাম দরজা নক করলাম অথচ তুমি খেতে আসলে না। ”
“ তোরা আমায় ডাকতে এসেছিলি? আসলে শরীরটা হঠাৎ খারাপ লাগছিল তাই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ডেকেছিস অথচ শুনতে পাই নি।”
অরিন পুরোটা মিথ্যা বলল। সে গতকাল রাতে নির্ঘুম কাটিয়েছে। বারবার মনে পড়েছে প্রতারক মানুষটার কথা। যাকে ভালোবেসে সে আজ এলোমেলো হয়ে গেছে। এতো সহজে কী ভোলা যায় তিন বছরের সম্পর্ক। কি নিখুঁত অভিনয় করেছিল মানুষটা তাকে ভালোবাসার। ভাবতেই অশ্রুকণা ভীড় করে চোখের কোণে। অরিত্রিকা এক ধ্যানে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝল অরিন মিথ্যা বলছে। সে ভেবে পায় না মানুষ কীভাবে ভালোবাসার কথা গোপন রাখে এবং সেই ভালোবাসার মানুষটার জন্য পরবর্তীতে কষ্ট পায়।
ইশরা গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলল ;
“ আপু আমরা মেহেন্দি আর্টিস্টকে আজকে সন্ধ্যায় আসতে বলেছি।”
অরিন একটু রাগ দেখিয়ে বলল ;
“ এসবের কী দরকার ছিলো? অরিত্রিকা তো ভালো মেহেন্দি দিতে পারে। ”
“ অরিত্রিকা কীভাবে দিয়ে দিবে মেহেন্দি? ওর তো হাত পুড়ে গেছে। ”
“ কই দেখি। ”
অরিত্রিকা হাত উঁচিয়ে অরিনকে দেখালো। অরিন দেখল হাতে ফোঁসা পড়েছে। পোড়া স্থানে পানি জমেছে। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল ;
“ কীভাবে পুড়েছে? ”
অরিত্রিকা মুখ ভার করে বলল;
“ চা বানাতে গিয়ে।”
“ চা বানানোর সময় মন কই থাকে? ”
“ চায়ের দিকেই তো ছিল। ”
অরিন চক্ষুদ্বয় সংকুচিত করে তাকাল। অরিত্রিকার অসভ্য মন বলতে চাইছিল “ আমার মন তো ছিল সারহান ভাইয়ের দিকে। ” কিন্তু বলল না। এসব কথা মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেলে ভীষণ বিপদ। তখন আর রক্ষে থাকবে না। এর মাঝেই সাথী বেগম প্রবেশ করলেন রুমে। হাতে খাবারের প্লেট এবং গ্লাস। অরিনকে ভাত খাইয়ে দিতে এসেছেন। মেয়েটা রাতেও খায়নি, সকালেও নিচে নামেনি।
সাথী বেগম পানির গ্লাসটা বিছানার পাশে ছোট টেবিলের ওপরে রাখেন। তারপর হাত দিয়ে ভাত মাখাতে লাগলেন। অরিনকে উদ্দেশ্য করে আদুরে কন্ঠে বললেন ;
“ হা কর। ”
অরিনের মন ভালো হয়ে গেল নিমেষে। মন খারাপ মুহুর্তে পলায়ন করল তার মন থেকে। তবুও তিক্ত ভাবনা ভাবতেই বুক ভারী হয়ে আসছে আগামীকাল তার বিয়ে হয়ে যাবে। এই বাড়ি পর হয়ে যাবে। মা বাবা বড় বাবা – বড় মা, ফুপু, ফুপাতো ভাই বোন, সারহান ভাই এবং সাদাতের সাথে এক বাড়িতে থাকা হবে না। কান্না দলা পাকিয়ে ভেতর থেকে উগ্রে আসতে চাইছে। তবুও নিজেকে সামলে নিল। হা করতেই সাথী বেগম অরিনকে খাইয়ে দিতে লাগল।
অরিত্রিকা সাথী বেগমের দিকে তাকাল। অভিমানী কন্ঠে বলল ;
“ বড় মেয়েকে এতো ভালোবাসো আর আমার বেলায় ছাই। আমি কী দোষ করেছি? কেউ ভালোবাসে না কেউ খাইয়ে দেয় না। আমি কোথায় যাবো এই দুঃখে। ”
ইশরা ও তাল মিলিয়ে হা হুতাশ করে বলে উঠল ;
“ ছোট মামী অরিন আপুকে ভালোবাসে। আমাদের ভালোবাসে না। ”
সাথী বেগম চোখ রাঙিয়ে বলল ;
“ তোদের নাটক দেখলে বাচি না। বদমাশ দুটো এদিকে আয় খাইয়ে দেই। ”
অরিত্রিকা ইশরা হেসে উঠল। অরিন ও হেসে ফেলল বোন দুটোর বাচ্চামো দেখে। এরা দুজন মোটেও শুধরানোর নয়। সাথী বেগম মৃদু হেসে তিন মেয়েকে খাইয়ে দিতে লাগল। তিনি ইশরাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসে। বাহিরের কেউ দেখলে বলবে তিনটাই তার মেয়ে। সাথী বেগমের কোনো ছেলে নেই এতে কোনো দুঃখ নেই। সারহান, সাদাত এবং ইরফান তার কাছে সন্তানের মতো। বাচ্চাগুলো কখনো তাকে অসম্মান করে না। ইশ! অরিত্রিকার জেলের কারণে এই বাড়ি থেকে দূরে থেকেছে। তখন ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। আর কোনোদিন যেন ওমন পরিস্থিতি তাদের পরিবারে না আসে এটাই চান তিনি।
সন্ধ্যা নেমেছে ধরণীতে। চারিদিকে ধু ধু অন্ধকার। দূর হতে ভেসে আসছে নিশাচর প্রাণীর ডাক। প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আছে পাশে। আজ আবহাওয়া স্বাভাবিক। বৃষ্টি হওয়ার কোনো চান্স নেই। অম্বর একদম পরিষ্কার। হালকা হাওয়া বইছে প্রকৃতিতে।
চৌধুরী বাড়ির ছাঁদে লাইটিং করা হয়েছে। কৃত্রিম ফুল দ্বারা ছাঁদের চারিপাশে সাজানো হয়েছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে দেখতে। মৃদু আওয়াজে বক্সে গান চলছে। স্টেজ সাজানো হয়েছে গাদা ফুল এবং গোলাপ দিয়ে। মেহেন্দি আর হলুদ যেহেতু ছোট পরিসরে হচ্ছে সেহেতু তেমন রাজকীয় ভাবে সাজানো হয়নি। স্টেজে বসে আছে অরিন। মুখশ্রীতে ফুটে উঠেছে বিষন্নতার ছাপ। অনড় অনুভূতিহীন ভঙ্গিতে বসে আছে নিরবে। পরনে কমলা লাল পেরে শাড়ি। মুখে ভারী সাজের ছোঁয়া। গলায় হাতে কানে মাথায় গোলাপ আর রজনীগন্ধা ফুলের গহনা। এতোটুকু সাজের ছোঁয়ায় যেন সৌন্দর্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অরিনের দুইপাশে বসে আছে প্রভা ও লিনা। দুজনে অরিনির বেস্ট ফ্রেন্ড। বান্ধবীর হঠাৎ বিয়ের এবং হলুদের ইনভিটিশন পেয়ে চলে এসেছে। ইফা স্টেজ থেকে কিছুটা দূরে বসে আছে বিরক্তিভাব নিয়ে। অনবরত কল করে যাচ্ছে মেহেদী আর্টিস্টকে। কিন্তু কল তুলছে না। এখনো আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়নি। তবে কিছুক্ষণের মাঝে হবে। সাদাত এবং ইরফান ছুটোছুটি করছে এদিকে সেদিকে। বাড়ির পেছনের দিকটায় সকলের জন্য রান্না করা হচ্ছে। সেখানে আজমল সাহেব এবং আরশাদ সাহেব তদারকি করছেন।
অরিত্রিকা লাল রঙের শাড়ি পড়েছে আজ। চুলগুলো খোলা রেখেছে। মুখে হালকা সাজ স্পষ্ট। সাজ বলতে ডাগর আঁখিদ্বয়ে কাজল এবং ওষ্ঠে লাল – খয়েরি রঙের লিপস্টিক। গহনা বলতে রজনী গন্ধটা ও গোলাপ ফুলের তরতাজা গহনা। তেমন আহামরি সাজেনি তবুও ফর্সা শরীরে শাড়ি সাজসজ্জা ভীষণ করে মানিয়েছে। দেখতে মনোমুগ্ধকর লাগছে। অরিত্রিকা ওষ্ঠ উল্টে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। শাড়ি ঠিকঠাক আছে কিনা দেখছে সে। বিছানার ওপর বসে আছে তিশা। প্রায় বিশমিনিট ধরে ধৈর্য ধরে বান্ধবীর রংঢং দেখতে ব্যস্ত। দেখে মনে হচ্ছে এই মেয়ের বিয়ে।
অরিত্রিকা তার বন্ধুমহলকে ইনভাইট করেছিল। তিশা আর রাহা আসলেও রুহান এবং রুদ্র আসেনি। তারা দুজন আগামীকাল আসবে। সারহান যে অরিত্রিকার কাজিন এটা সকলে জানে। অরিত্রিকা তার বন্ধুমহলকে বলেছে কয়েকদিন আগে।
তিশার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। এই মেয়ের এতো ঢং সহ্য হচ্ছে না। অধৈর্য্যে সহিত বলে উঠল ;
“ আর কতো সাজবি? ”
অরিত্রিকা আয়নায় নিজেকে পরখ করতে করতে ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল ;
“ সাজছি কোথায়? নিজেকে আয়নায় দেখছি । ”
“ তখন তো বললাম সুন্দর লাগছে। এবার চল। ”
“ রাহা ওয়াশরুম থেকে বের হোক তারপর একসাথে যাচ্ছি।
“ আচ্ছা। ”
তিশা মুখ গোমড়া করে বলল। রাহা ওয়াশরুম থেকে বেরোলো। অরিত্রিকার সাজ দেখে প্রশংসাসূচক বাক্য ছুড়ল ;
“ বাহহ। তোকে দেখতে ঝাক্কাস লাগছে অরিত্রিকা। কোনো ছেলে দেখলে একদম ফিদা হয়ে যাবে। ”
অরিত্রিকা পিছু ফিরে তাকায়। মুখ বাঁকিয়ে বলে ;
“ পাম কম দে। ”
“ আরে পাম না সত্যি। ”
“ হয়েছে। চল এবার। ”
“ হাতে চুড়ি না পড়ে যাবি? ”
অরিত্রিকা জিভ কেটে বলল ;
“ ভুলে গেছি।”
অরিত্রিকা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা চুড়ির বক্স খুলে লাল চুড়ি খুঁজতে থাকে। দ্রুত খুঁজেও পায়। হাতে চুড়ি গুলো পড়তে গিয়ে পড়ে না। মনে পড়ে সারহানের বলা কথাগুলো। তার হাতে নাকি লাল চুড়ি মানায় না। অরিত্রিকা হতাশ হয় ভীষণ। চোখ বুলিয়ে অন্য ডিজাইনের চুড়ি খুঁজতে থাকে। গতবছর কেনা লাল চুড়ির ওপর গ্লিটারযুক্ত ছোট ছোট নকশার চুড়িতে দৃষ্টি স্থির হয়। আর কিছু না ভেবে ফটাফট চুড়ি গুলো পড়ে নেয়।
“ অরিত্রিকা তোকে দেখতে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে কোনো পরী নেমে এসেছে। ”
অরিত্রিকা ছাঁদের রেলিঙ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে। হাতে থাকা ফোনটা নিয়ে অনবরত কল করে যাচ্ছে মেহেদী আর্টিস্টকে। এই লেট লতিফা মহিলা এখনো কেনো আসছে না সেই টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে। এতো দেরী করে কেউ আজব। তমা আপু কোথায় গিয়ে আঁটকে আছে কে জানে। এসব ভাবনায় মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ইরফানের কন্ঠ হতে নিঃসৃত কথাগুলো শুনে রাগ তরতর করে বাড়লো। বিরক্তিতে কুঁচকে যাওয়া মুখ নিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল পেছনে। ইরফান দাঁড়িয়ে আছে হাস্যজ্জ্বল ভঙ্গিতে। পরনে হালকা আকাশী রঙা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির হাতা কনুই অব্দি গুটানো।
অরিত্রিকা ত্যাড়া কন্ঠে বলে উঠল ;
“ আকাশ থেকে পরী নামে এটার প্রমাণ আপনার কাছে আছে ইরফান ভাই? ”
ইরফান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কি বিচ্ছু মেয়েরে বাবা! এসব কথার আবার প্রমাণ খোঁজে। একটু সাহস করে প্রশংসাটুকু করেছিল কিন্তু সেই প্রশংসায় এক বালতি পানি ঢেলে দিল। হাত দ্বারা চুল ঠিক করল। অতঃপর হাসার ভাণ করে বলল ;
“ ছোট বেলা থেকে শুনেছি আকাশ থেকে পরী নামে। ”
“ আমি তো শুনেছি কৃষ্ণচূড়া গাছে পরী থাকে। কিন্তু গাছের দিকে তাকিয়ে থেকে কোনোদিন দেখতে পেলাম না। এসব কথার কোনো লজিক নেই বুঝেছেন। ”
অরিত্রিকার স্বর গমগমে শোনাল। ইরফান থতমত খেল। একটু হতাশায় জর্জরিত হলো বটে। অরিত্রিকা ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে পুনরায় বলল ;
“ এইভাবে কোনো মেয়ের প্রশংসা করলে কখনো পটবে না। ”
ইরফান কেশে উঠল। বিস্মিত নয়নে তাকাল মেয়েটার দিকে। এসব কি বলছে! আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে নিশ্চয়ই কথা শোনাবে তাই এখান থেকে সটকে পড়া ভালো।
“ বড় মামা ডাকছে আমি আসছি। ”
এতোটুকু বলে ছুটলো ইরফান। অরিত্রিকার ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হলো নিমেষে।ইরফানের দৌড়ানো দেখে ফিকফিক করে হেসে দিল। এহ আসছে প্রশংসা করতে। সারহান ভাই ইংরেজিতে প্রশংসা করেন তা চলনসই কিন্তু ইরফান ভাই কীসব প্রশংসা করে? এর মাঝেই অরিত্রিকার ফোন বেজে উঠল। হাতে থাকা ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল মেহেদী আর্টিস্ট কল দিয়েছে। সে দ্রুততার সহিত কল রিসিভ করল।
“ তমা আপু আপনি কোথায় আছেন? এখনো আসছেন না কেনো? ”
“ অরিত্রিকা আমি তোমাদের বাড়ির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। গার্ডসরা ঢুকতে দিচ্ছে না ভেতরে। ”
“ আচ্ছা তুমি থাকো ওখানে আমি আসছি। ”
“ ঠিক আছে এসো। ”
অরিত্রিকা কল কেটে দেয়। দ্রুততার সহিত হাঁটতে শুরু করে। তখনি বাঁধে বিপত্তি। শাড়িতে পা বেঁধে যাচ্ছে হাঁটার সময়। কোনো মতো শাড়ি একহাতে আলগোছে ধরে ছাঁদ থেকে দ্রুত নেমে যায়।
অরিত্রিকা মেহেন্দী আর্টিস্টকে ছাঁদে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিয়ে নিজের রুমে এসেছে। পোড়া স্থানে জ্বলছে ভীষণ। কিছুক্ষণ আগে শাড়িতে পা বেঁধে হোচট খেয়ে সদর দরজা বাবাজীর সাথে ধাক্কা লেগেছিল। তখনই হাত সোজা গিয়ে লেগেছিল দরজায়। আঙুলে লেগে ফোঁসা গলে বিচ্ছিরি অবস্থা হয়েছে। র*ক্ত বেরিয়ে গেছে একদম। হাতের আঙুলে চিনচিনে ব্য*থা অনুভূত হচ্ছে। প্রায় দশ মিনিট ধরে এক হাতে কোনো মতো ব্যান্ডেজ করেছে। ফার্স্টএইড বক্সটা বিছানা থেকে নেমে গিয়ে টেবিলের ওপর রাখল৷ এর মাঝে বক্সে উচ্চশব্দে গান বেজে উঠল। তারমানে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। অরিত্রিকা শাড়ির কুঁচি অন্য হাতে আলগোছে ধরে হম্বিতম্বি করে ছুটল ছাঁদের দিকে।
সারহান কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে ফিরেছে। শরীর ভীষণ ক্লান্ত কেমন যেন মেজমেজ করছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে হয়তো ভালো লাগতো। কিন্তু এখন বিশ্রামের সময় নেই। বিয়ের বাড়ির আমেজ লেগেছে। ছোট বোনের বিয়ে উপলক্ষে বড় ভাইয়ের দায়িত্ব আছে অনুষ্ঠানের প্রতিটি বিষয়ে তদারকি করা। সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে এখন থেকে। সারহান ফ্রেশ হয়ে সাদা পাঞ্জাবি পরেছে। চুল ব্রাশ করে, পারফিউম ইউজ করে। ঘড়ি পরতে পরতে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ঘড়ি পড়া শেষ করে ছাদের সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই কারো সাথে ধাক্কা লাগল সারহানের।
অরিত্রিকা সিঁড়িতে পা রাখবে এমন সময় কারো সাথে ধাক্কা খেল। ভারসাম্য হারিয়ে পরে যাওয়ার উপক্রম সে। চোখ মুখ খিঁচে আতংকে চিৎকার করে উঠে। তৎক্ষনাৎ পুরুষালী বলিষ্ঠ হাত জাপটে ধরে অরিত্রিকার কোমড়। অরিত্রিকা ও নিজেকে বাঁচাতে মানবটির বাহু আঁকড়ে ধরল। মানবটি আরও দৃঢ় মেয়েটিকে ধরল যেন না পড়ে যায় মেঝেতে। অরিত্রিকা শিউরে উঠল খানিকটা। নাসিক্যে পরিচিত পারফিউমের গন্ধ প্রবেশ করতেই ঝিমঝিম করে উঠল মাথা। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে পিটপিট করে চাইল মানবটির দিকে। সারহান গম্ভীরতর মুখে শান্ত স্থির চাহনিতে তাকিয়ে আছে অরিত্রিকার দিকে। তীক্ষ্ণ ধারালো চক্ষুদ্বয়ে বিরাজ করছে একরাশ মুগ্ধতা। বিমোহিত নয়নে তার প্রণয়িনীকে দেখতে ব্যস্ত প্রেমিক পুরুষ।
অরিত্রিকার মাঝে লজ্জা হানা দিলো । চক্ষুদ্বয় সন্তর্পণে নামিয়ে নেয়। অস্বস্তি, লজ্জায় মিইয়ে যায়। সারহান অরিত্রিকার ভাবমূর্তি পর্যবেক্ষণ করে। দৃঢ়ভাবে আরেকটু মিশিয়ে নেয় তার মাঝে। অরিত্রিকা ভয় পেয়ে যায়। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে। পুরুষালী গাঢ় স্পর্শে বিচলিত হয়ে যায় অন্তঃকোণ।
সারহান অপলক চেয়ে রয় অরিত্রিকার লজ্জা, অস্বস্তিভরা মুখপানে। আবেশিত মদ্যক কন্ঠে বলে উঠে ;
“ তোর ভুবনমোহিনী রুপে আমাকে মে*রে ফেলতে চাইছিস ফাইরুজ?”
এহেন প্রশ্নে অরিত্রিকা চমকালো, থমকালো। হতবিহ্বল হয়ে তাকাল শ্যামমানবের দিকে। অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে নেত্রপল্লব ঝাপটালো। সারহান অতি শান্ত কন্ঠে পুনরায় বলে উঠল ;
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২৫
“ তোকে দ্বিতীয়বার শাড়ি পরে দেখে আবার থমকে গেলাম। প্রথমবারে আমার মনের গহীনে অনুভূতিরা বেসামাল হয়েছিল এইবার আমি পুরোটা বেসামাল হয়ে গেলাম। ”
অরিত্রিকার বক্ষস্থল কেঁপে উঠল। কিছুটা দিশেহারা হয়ে গেল। তীব্র বেগে বক্ষ ধুকপুক করতে লাগল। সারহানের মাঝে কোনো দোলাচলন দেখা গেল না।