প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২৮

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২৮
আদ্রিতা নিশি

রাত দশটা বেজে বিশ মিনিট। রাতের গভীরতা বেড়ে চলেছে। চৌধুরী বাড়ির ছাদে হলুদ সন্ধ্যার অনুষ্ঠান চলমান। আনন্দ আমেজে চলছে অনুষ্ঠানের কার্যক্রম। কিছুক্ষণ পূর্বে অরিনের বান্ধবী লিনা ও প্রভা নেচেছে। তারপরে অরিত্রিকার জোরাজুরিতে রাহা ও তিশা নেচেছে। নাচতে চায়নি তবুও বান্ধবীর মন রক্ষার্থে নাচতে হয়েছে। তারা এখন ক্লান্ত ভঙ্গিতে চুপচাপ বসে আছে। অল্প নেচেই কাহিল অবস্থা। ইরফান ছাদের এককোণে মুখ ভার করে বসে আছে। দৃষ্টি অরিত্রিকার দিকে। মনের মাঝে ভর করেছে বিষন্নতা। মনের গহীনে ভালোবাসার পরিবর্তে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। হঠাৎ কেন যেন মনে হচ্ছে অরিত্রিকার কাছে তার মনে চলমান অনুভূতির কথা ব্যক্ত করলে ফিরিয়ে দেবে। অরিত্রিকা এবং ইশরা দুজনে কোনো কিছু নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা করছে। কিছুক্ষণ পরে দুজনে নাচবে তাই গান সিলেক্ট করছে। তাদের কিছুটা দূরে সারহান গম্ভীরমুখে চেয়ারে বসে ফোন স্ক্রোল করতে ব্যস্ত। আশেপাশে কী হচ্ছে সেদিকে বিন্দুমাত্র মনোযোগ নেই। সাদাত বেশ ভাব নিয়ে বক্স অপারেটিং করছে। অরিন ও তমা স্টেজে বসে আছে। অরিনের মন মেজাজ ভালো নেই তবুও সেসব চাপা রেখে অতি কষ্টে স্বাভাবিক ভাবে বসে আছে।
অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সাদাত বিরক্ত চোখে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠল,

“তোদের দুজনের গান সিলেক্ট করা হলো?”
অরিত্রিকা মুখ বাঁকিয়ে দিকে তাকায়। কথোপকথনের মাঝখানে এই ছেলেটার অনাহূত হস্তক্ষেপ একদমই সহ্য হচ্ছে না। কপালে ভাঁজ ফেলে তেজ দেখিয়ে সটান জবাব দেয়,
“নাহ, হয়নি।”
সাদাত ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“তাহলে তোদের দুজনের ডান্স করার দরকার নেই।”
অরিত্রিকা বিরক্তির সহিত বলে উঠল ;
“আমরা ডান্স করবো তাতে তোর কী?”
সাদাত কাঁধ ঝাঁকিয়ে মজা লুকোনো কণ্ঠে বলল,
“তোদের জন্য আমার স্পেশাল ডান্স ঝিংগালা লা হু হু করতে পারছি না। দ্রুত গান সিলেক্ট কর, কচ্ছপের নানী!”
“ তুই চুপ কর সাদুর বাচ্চা। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সাদাতের কথা কর্ণপাত হতেই ইশরা তেতে উঠল। সাদাত কিছু বলবে এমন সময় আবির ঝগড়া থামানোর জন্য সকলের মাঝ বরাবর অবস্থান করল। হাত নাড়িয়ে সাদাতকে ইশারায় চুপ করতে বলল। সাদাত তৎক্ষনাৎ থেমে গেল। আবির গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলে উঠল ;
“ অরিত্রিকা ও ইশরা দুজনের যেহেতু গান সিলেক্ট করা হয়নি সেহেতু অন্য একজন পারফরম্যান্স করলেই হয়। সাদাত তুমি তোমার স্পেশাল ডান্স করো। ”
সাদাত নড়েচড়ে উঠল। মুখ ভার করে বলল ;
“ আমি সবার শেষে উরাধুরা ডান্স করবো। ”
“ তাহলে ইরফান? ”
ইরফান এতোক্ষণ ভাবনায় বিভোর ছিল। নিজের পারফরম্যান্স করার কথা শুনে অপ্রস্তুত হলো। তড়িঘড়ি করে বলল ;
“ আমি ডান্স পারি না। ”
“ তাহলে গান গাও। ”
“ গান পারি না আমি। ”

ইরফান মুখ বেজার করে বলল। আবির একটু আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। দৃষ্টি স্থির হলো সারহানের দিকে। সবাই নেচে – গেয়ে আনন্দ করছে। নাচ গান উপভোগ করছে আর ব্যাটা ফোনের মধ্যে ডুবে আছে। আজকে সুযোগ বুঝে সিক্রেট ফাঁস করা যাক। এই সিক্রেট ট্যালেন্টকে কাজে লাগিয়ে যদি অরিত্রিকার মনে জায়গা করে নিতে পারে তাহলে তো ভালো হয়।কিছু একটা ভেবে আবির ওষ্ঠধরে হাসি ফুটিয়ে বলল ;
“ এখন আমাদের মাঝে গান পরিবেশন করবে তরুন প্রজন্মের আইডল, রাজশাহী এক আসনের নবনির্বাচিত এমপি সারহান ইদায়াত চৌধুরী। ”
উক্ত কথাটি সকলের কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই উচ্ছসিত হয়ে গেল অনেকে। বেশ অবাক ও হলো বটে। অতঃপর হাত তালিতে মুখরিত হয়ে উঠল পরিবেশ। সাদাত চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত হয়ে শিষ বাজিয়ে উঠল। চৌধুরী বাড়ির উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আটকালো সারহানের দিকে। অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে আছে তারা। তাদের কারোর বিশ্বাস হচ্ছে না সারহান গান গাইবে। সারহান ফোন স্ক্রোল করা বন্ধ করে কপাল কুঁচকে তাকায় আবিরের দিকে। গলায় গম্ভীরতা মিশিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠে ;

“ আমাকে এসবের মধ্যে টানছিস কেনো? ”
আবির পাঞ্জাবির কলার টেনে ভাব নেয়। দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল ;
“ তোকে টানতে ভালো লাগে। ”
সারহানের মুখাবয়ব অতিশয় গম্ভীর হয়ে আসে। দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠে ;
“ তুই জানিস, আমি গান গাইতে পারি না তাও এতো কাহিনী করছিস কেনো? ”
“ গান গাইতে পারিস না! মিথ্যাবাদী কোথাকার। ভার্সিটিতে ক্যাফেটেরিয়াতে বসে গিটার বাজিয়ে কে গান গাইতো? তুই নাকি তোর ভূত! ”
“ আমার গান গাওয়ার ইচ্ছে নেই। ”
“ অরিত্রিকাসহ বাকীরা সারহানের গান শুনতে চাও। ”

আবির সারহানের কথা উপেক্ষা করে চিৎকার করে বলল। অরিত্রিকা অপলক বিস্ময়াবিষ্ট চাহনিতে তাকিয়ে আছে সারহানের মুখপানে। থমকানো, চমকানো সেই চাহনি। সারহান ভাই যে গান গাইতে পারে তার জানা ছিলো না। হঠাৎ এমন কিছু শুনবে প্রস্তুত ছিল না। এই মানুষটা আসলেই অরিত্রিকার অচেনা। যার ভেতর এবং বাহিরের রুপ সম্পূর্ণ আলাদা। বদমেজাজি, রুক্ষ মানুষটার যে এতোটা নরম প্রতিভা আছে তা কখনো কাউকে জানতে দেয়নি। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে উবু ডুবু অবস্থা। শ্যামমানব কেন এতো রহস্যময় যেন গোলকধাঁধা। এরমাঝে নিজের নাম আবিরের মুখে শুনে বিব্রতবোধ করল। ভীতি ভোগী দৃষ্টিতে তাকাল আশেপাশে। সামনে তাকাতেই দেখল ইরফান গম্ভীরমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু শঙ্কিত হলো তার মন। এতোমধ্যে সকলে উচ্চস্বরে বলে উঠল ;
“ আমরা সবাই এমপি সাহেবের গান শুনতে চাই। ”অরিত্রিকা দ্রুততার সহিত দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। অতঃপর তাকায় সারহানের দিকে।

সারহান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে। কৌতুহলী চাহনিতে দূর হতে তাকায় অরিত্রিকার দিকে। অরিত্রিকা তার দিকে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তাকিয়ে আছে। যেন হঠাৎ কোনো বিস্ময়ভরা তথ্য পেয়েছে। সারহানের মুখাবয়ব স্বাভাবিক হয়ে আসে। ভার্সিটিতে বন্ধু মহলের সাথে বিকেল হলে গিটার বাজিয়ে সকলে মিলে গান গাইত, আড্ডা দিতো। স্টুডেন্ট লাইফে গান গাওয়া টা খুব ভালো করে আয়ত্ব করেছিল। কিন্তু ভার্সিটির ফ্রেন্ডরা বাদে অন্য কেউ জানতো না এমন কি পরিবারের কেউ অবগত ছিলো না। আজ আবির সকলের সামনে বলে দিলো। এতে খারাপ লাগছে না। আবিরের উক্ত কথাটা যেন সারহানের প্রণয় পথ প্রশস্ত করল। গান দ্বারা ভালোবাসার মানুষকে মনের কথা বলা যায়। সে না হয় আজ নিজের লুক্কায়িত সত্তাকে তার প্রণয়িনীর সামনে উজার করবে। গান গেয়ে ভালোবাসার মানুষকে তার প্রণয়ের পরিধি বোঝাবে। শুধু চাওয়া, বোকা মেয়ে বুঝুক তার বিরহে পুড়ছে প্রেমিক নামক পুরুষের মন।

“ সাদাত গিটার নিয়ে আয়। ”
সারহান কঠুপষ্ঠ কন্ঠে বলে উঠল। সাদাত এতোক্ষণ মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। ভেবেছিল ভাইয়ের গান শোনা হবে না। অপ্রত্যাশিত কথা শুনে যেন লাফিয়ে উঠল। উৎফুল্লিত হয়ে বলে উঠল ;
“ আনছি ভাই। ”
সাদাত দৌড়ে নিজের রুমের দিকে যায় গিটার আনতে। আবির বিশ্বজয়ের হাসি হাসে৷ কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে সারহানের পাশে বসে কাঁধ চাপড়ে দেয়। হাস্যরত কন্ঠে বলে উঠে ;
“ ব্যাটা আমাকে তোর কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। ”
সারহান অরিত্রিকার দিক হতে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। প্রগাঢ় ভাজ পরে কপালের মধ্যাংশে। স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে বলল ;
“ কেনো? ”
“ তোকে রোমান্টিক বানানোর চেষ্টা করছি। ”
“ কীভাবে?”
“ সিনেমাতে দেখেছি নায়ক নায়িকাকে ইমপ্রেস করার জন্য গান গায়। নায়িকা সেই গান শুনে হাবুডুবু খায় নায়কের প্রেমে। ”
“ তুই আর তোর মাথা দুটোই বোকা *দা।”

আবির যেন গায়ে মাখলো না অপমানটুকু। মাছি তাড়ানোর মতো হুস হাস করে বলল ;
“ তোর সেটিং করিয়ে দিতে মাঠে নেমেছি আর তুই আমায় অপমান করছিস? ”
সারহান বাঁকা হেসে বলল ;
“ অপমান করেছি এটা বোঝার বোধবুদ্ধি হয়েছে তাহলে ? ”
“ ভেজাল করিস না তো বা*ল। ভাবী পটা দ্রুত। আটাশ বছরের জীবনে আজ পর্যন্ত ভাবী ডাকতে পারলাম না। ”
আবির হা হুতাশ করে বলল। সারহান ভ্রুযুগল কুঁচকে রং তামাশা দেখলো শুধু। কিছুক্ষণ মৌন থেকে অতি শান্ত কন্ঠে আওড়ায় ;
“অরিত্রিকার কাজল কালো আঁখিতে আমি আমার নিঃশেষের প্রতিচ্ছবি দেখেছি। প্রণয়িনী নামক আমার একান্ত নিভৃতসুধা আমাকে বেসামাল বানিয়েছে। আজ তার চোখে আমি দেখেছি সেই অনুভূতি যা সদ্য উদিত প্রণয়ের রশ্মি হয়ে আমায় ধ্বংসের সংকেত পাঠিয়েছে।”

আবিরের কর্ণকুহরে কথাটা প্রবেশ করে। সে মৃদু হাসে। যেন কিছু অজানা অনুভূতি তার অন্তরালে সঞ্চারিত হলো। সে জানে, সারহানকে সে খুব কাছ থেকে দেখেছে এবং ভালোভাবে চিনেছে। এই দুই বছরের মধ্যে সারহান নিজের অন্তর্গত অনুভূতিগুলিকে গভীর সংকোচে আবদ্ধ রেখেছিল। ভালোবাসার মানুষকে সে ইচ্ছাকৃতভাবে দূরে সরিয়ে রেখেছিল নিঃশব্দ চেষ্টায়।যাতে তার সংস্পর্শে এসে অরিত্রিকার জীবনে কোনো দুঃখ বা তিক্ততা না ঢুকে পড়ে। সারহান চাইত না অরিত্রিকা তার জীবনের অন্ধকারে একরকম অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঢুকে পড়ুক। তার নিজের বিষাক্ত জীবন, তার অন্তরের তীব্র শূন্যতা সে সব কিছু থেকেই অরিত্রিকাকে দূরে রাখতে চেয়েছিল।কিন্তু প্রেমিক পুরুষের অন্তর্গত মন তো কোনো দিনও শান্ত থাকতে পারে না। হৃদয়ের গভীরে উথাল-পাথাল প্রেমের অনুভূতিতে, সেই মন অবাধ্য হয়ে ওঠে। ভালোবাসার মানুষটিকে আর দূরে রাখতে পারে না। সে আবারও সেই একই তীব্র আকুলতায় বিভোর হয়ে ওঠে তার ভালোবাসাকে ফিরে পাওয়ার জন্য।

সাদাত একমুহূর্ত দেরী না করে তার রুম থেকে গিটার নিয়ে ছাঁদে এসেছে। সিঁড়ি বেয়ে হন্তদন্ত হয়ে আসতে হাঁপিয়ে গিয়েছে। হাঁপাতে হাঁপাতে দ্রুত পায়ে উৎফুল্লতার সহিত গিটার হাতে এগিয়ে যায় সারহানের সামনে। আমোদিত ভাব নিয়ে গিটার এগিয়ে দিয়ে বলে উঠে ;
“ আমি অনেক এক্সাইটেড ভাই দ্রুত গান শুরু করো। ”
সারহান বসারত অবস্থায় সাদাতের হাত থেকে গিটার নেয়। প্রতুত্তরে শুধু কাঁধ চাপড়ে দেয়। সাদাত উচচ্ছিস ভঙ্গিতে চেয়ারে গিয়ে বসে পরে। ক্ষীণ হেসে আগ্রহী হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকায়। অরিত্রিকা আর ইশরা অরিনের দুপাশে বসে আছে সিরিয়াস ভঙ্গিতে। অরিত্রিকা বেশ উৎকন্ঠিত ভাব নিয়ে আগ্রহের সহিত সারহানের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেছে। অপেক্ষার প্রহর গুনছে মানুষটার কন্ঠে গান শোনার। অরিন ও মৃদু হাসি বজায় রেখে গান শোনার প্রহর গুনছে। সকলের হাবভাব বেশ উচ্ছসিত। সারহান দুহাতে গিটার প্রফেশনাল ভাবে ধরে। আঙুল দ্বারা টুংটাং গিটারের আওয়াজ তোলে। কিয়ৎ সময় পর পুরুষালী কন্ঠনালী হতে সুমধুর গানের কয়েক লাইন উচ্চারিত হয়।

❝ দূরে দূর বহুদূর শুধু তুই চলে যাস,
তাও দেখ আমারই পথে থমকে দাঁড়াস।
গায়ে কাটা দিতেই মন হাঁটা দিলো,
তোর দেশে, তোর গাঁয়ে,তোর পাড়ায়….
সারহানের শান্ত, গভীর দৃষ্টি অরিত্রিকার পাণে নিবদ্ধ হয়ে রইল। তার চোখে অমোঘ টান যেন প্রতিটি সুর, প্রতিটি কথা একে অপরকে অব্যক্তভাবে সম্পৃক্ত করছে। প্রণয়িনীর মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে তার অন্তর থেকে উদয় হওয়া প্রণয় যেন গানের মাঝে উগ্র হয়ে উঠছে।
সারহানের হৃদয়স্পর্শী কণ্ঠ এক-একটি শব্দ যেন অরিত্রিকার ভেতর প্রবাহিত হচ্ছে। সেই কন্ঠস্বর যেন বিচলিত করে তুলছে। অরিত্রিকার বক্ষস্থল কেঁপে উঠছে অজানা অনুভূতিতে। শান্ত মন যা এক সময় স্থির ছিল এখন অশান্ত হয়ে উঠছে। তার অন্তঃকোণ কেঁপে উঠছে গভীর চাহনি এবং নিখাদ গানের সুরে যেন কিছু অমোঘ অনুভূতি জাগিয়ে তুলছে তার মনের গহীনে। যা সে কখনো অনুভব করেনি।
সারহান কৃত্রিম আলোয় অরিত্রিকা দোলাচল পরখ করল। গান গাওয়া অবস্থায় মৃদু হাসে। বিমোহিত নয়নে অবলোকন করে গিটার বাজিয়ে সুর টেনে গেয়ে উঠে;

❝ ভুলে গিয়ে দোষ, করে নে আপোস
আমার সাথে তুই, যদি রাজি হোস।
মাঝে মাঝে তোর ভাঙাবো আদর,
ভুলে গিয়ে রাত, ভুলে গিয়ে ভোর..
অরিত্রিকা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। শ্যামমানবের গাওয়া গানের শব্দগুলো তাকে অজানা সুখের সাক্ষাৎ করাচ্ছে এসব ভেবে লাজুক আভা ছড়িয়ে পড়ল মুখাবয়বে। কান দিয়ে গরম আভা বেরোতে লাগল। হাসফাস করে উঠল সে। চঞ্চল দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে গেল। সারহান গিটার বাজিয়ে চলেছে। দৃষ্টি স্থির অরিত্রিকার দিকে। মেয়েটার স্নিগ্ধ চাহনি, লজ্জায় নেতিয়ে পড়া হাবভাব দেখে ওষ্ঠ কামড়ে হাসে। পুনরায় গেয়ে উঠল ;

❝ কথা মতো, যদি হতো, একদিন সেরকম সে নরম…
আশা দে তুই,ভালোবাসা দে তুই
সাত রঙা আকাশের মতো মন
গায়ে কাটা দিতেই মন হাঁটা দিলো
তোর দেশে, তোর গাঁয়ে, তোর পাড়ায়
ভুলে গিয়ে দোষ, করে নে আপোষ
আমার সাথে তুই, যদি রাজি হোস
মাঝে মাঝে তোর ভাঙাবো আদর
ভুলে গিয়ে রাত, ভুলে গিয়ে ভোর…

ছাঁদে উপস্থিত সকলে বিস্মিত হয়ে সারহানের গান শুনে চলেছে। এতোটা সুন্দরভাবে কেউ গান গাইতে পারে! ইরফান সারহান এবং অরিত্রিকার দিকে তাকাচ্ছে। দুজনের ভাবভঙ্গি সুবিধার লাগছে না। তবুও উত্তেজনা চাপা রেখে নজর রাখছে। ইরফান মনকে বুঝ দিলো সারহান হয়তো ক্যামেরাম্যানের দিকে তাকিয়ে গান গাইছে। ক্যামেরাম্যান ভিডিও রেকর্ড করছে তাই নজর ওদিকে দিতেই হবে। অরিত্রিকা লজ্জায়, ভালোলাগায় মুর্ছা যাচ্ছে। মানুষটা যে গানের মাধ্যমে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করছে তা বুঝতে সময় নিলো না। অদ্ভুত অনুভূতিরা প্রজাপতির ন্যায় উড়ছে বক্ষপিঞ্জরে। বিমোহিত নয়ন জোড়া থমকে গেছে শ্যামমানবে। শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থা গিটার হাতে গান গাইছে দেখতে সুদর্শন লাগছে। এই নতুন প্রেমিক রুপ যেন অরিত্রিকাকে দিশেহারা করে দিল। এভাবেও বুঝি ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশ করা যায়। সারহান গিটার বাজানো অবস্থায় মৃদু হেসে দুষ্ট ইশারা করে অরিত্রিকাকে। অরিত্রিকা যেন এতে আরও মিইয়ে যায়। লজ্জায় জর্জরিত হয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে নিজেকে আড়াল করার প্রয়াস চালায়।
সারহানের গান গাওয়া শেষ হতেই করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠে পরিবেশ। সারহানের ধ্যান ভাঙে সেই শব্দে। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি সরিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বসে যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেনা। সাদাত মনোযোগ দিয়ে গান শুনলেও নজর ছিল সারহান এবং অরিত্রিকার দিকে। তার তুখোড় বুদ্ধিমত্তা বলছে ডাল মে কুচ কালা হে।
সাদাতের পেট যেন গড়বড় করছে। যা ভেবেছে তাই যদি সত্যি হয় তাহলে তো বাড়িতে তুলকালাম বেঁধে যাবে। এতোক্ষণ চুপচাপ লক্ষ্য করলেও এখন মনে হচ্ছে তার ভাই নিজের বাড়ির জামাই হওয়ার জন্য প্রহর গুনছে। অশান্ত ভঙ্গিতে চেয়ার থেকে উঠে সারহানের সামনে আসলো। কোনো রকম ভণিতা না করে উত্তেজিত হয়ে চাপা স্বরে বলল ;

“ ভাই তুমি কি কাউকে ভালোবাসো? ”
সারহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সাদাতের দিকে। এ চাহনিতে সাদাতের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে। তবুও পুনরায় উদ্বিগ্ন হয়ে বলে ;
“ ভাই তুমি কি তোমার ভালোবাসার মানুষকে গানটা ডেডিকেট করে গাইছিলে? ”
সাদাতের পেটের ভেতর মনে হচ্ছে টেনশনে ঝড় তুলেছে। মনে মনে চাইছে তার সন্দেহ যেন ভুল হয়। কিন্তু সাদাতের সন্দেহ সঠিক হলো। আবির ওষ্ঠ এলিয়ে হেসে ধীর কন্ঠে উত্তর দিলো ;
“ভালোবাসা কি আর সাদামাটা ভালোবাসা? তোমার ভাই যে তলিয়ে যাচ্ছে গভীর স্রোতে! এই যে প্রাণ খুলে গান ধরল, জানো কাকে উৎসর্গ করে গাইল? তোমার হবু ভাবিকে!”
সাদাতের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে গেল। এসব কি শুনছে সে। তার ভাই প্রেমে পড়েছে। উৎকন্ঠা চেপে বলল ;

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২৭

“ হবু ভাবী মানে আমি যাকে ভাবছি সে?”
আবির ঘাড় নাড়িয়ে বলল ;
“ হ্যা। ”
সাদাত হতভম্ব হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকায় সারহানের দিকে। সারহান পায়ের ওপর পা তুলে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দুজনের কথোপকথন শুনছে।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২৯