প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২৯
আদ্রিতা নিশি
ছাদের কোণের অন্ধকারে স্তব্ধ বসে আছে সাদাত। তার চোখের তারায় অনির্বচনীয় শূন্যতা আর মনোভূমির গহীনে বিশৃঙ্খল ঝড়। আবিরের ইঙ্গিতপূর্ণ কথাগুলো যেন তার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোণে বিস্তৃত দুরূহ ধাঁধার চাবিকাঠি ছুড়ে দিয়েছে।সে জানে, অরিত্রিকা কখনো সারহানের প্রতি গভীর অনুরাগের প্রকাশ ঘটায়নি। তার ব্যবহার, তার প্রতিক্রিয়া সবই ছিল অদৃশ্য দূরত্বের রেখায় সীমাবদ্ধ। তবু, কীভাবে দুই বিপরীত মেরুর প্রাণ দুটো একে অপরের প্রতি আকর্ষিত হলো? কেন সারহানের দৃষ্টিতে সে এত স্পষ্ট দেখতে পেল এমন অনুভূতির ছায়া। যা একান্তই হৃদয়ের গভীরে জন্ম নেয়?আর এই সত্যটা সাদাতের জন্য ভয়ানক দুর্বিষহ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ সে জানে, তার ভাইয়ের ভাগ্যে অরিত্রিকা নেই। নিয়তির খসড়া বহু আগেই দুজনের পথ আলাদা করে লিখে দিয়েছে। তবে কেন সারহান সেই অনিশ্চিত পথে পা বাড়িয়েছে? কেন স্বেচ্ছায় নিজেকে দহনযন্ত্রণা উপহার দিচ্ছে?
সাদাতের মনে হয়, হয়তো এই ভালোবাসারও এক নিজস্ব ভাষা আছে।যা উচ্চারিত হয় না, শুধু অনুভূত হয়। কিন্তু অনুভূতিরও এক সীমা আছে, যেখানে দাঁড়িয়ে মানুষকে বেছে নিতে হয় আত্মসংযমের কঠিন পথ কিংবা ধ্বংসের পথ। তার ভাই কোনটা বেছে নেবে?নিশ্ছিদ্র নীরবতায় ছাদজোড়া রাত নেমে আসে আর সাদাতের ভাবনার ভারে বাতাসও যেন কিছুটা গাঢ় হয়ে ওঠে। তবুও কেন এমন ভুল করছে তার ভাই? কেন জেনেশুনে আগুনে পা বাড়াচ্ছে?সাদাতের মনে এই প্রশ্নের দাবদাহ জ্বলে ওঠে। সে জানে, এর উত্তর তাকে পেতেই হবে। নিঃশর্ত ভালোবাসা যখন নিশ্চিত পরাজয়ের দিকে ধাবিত হয় তখন তা আর কেবল প্রেম থাকে না। তা হয়ে ওঠে এক আত্মঘাতী মোহ। যা ধীরে ধীরে মানুষকে গ্রাস করে। আর সে কোনোভাবেই তার ভাইকে এই ধ্বংসের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে দিতে পারে না। ছোট হয়ে বড় ভাইকে রক্ষা করতে হবে, পথভ্রষ্ট মনটাকে সত্যের দিকে ফেরাতে হবে। কিন্তু কেমন করে? কীভাবে সে সারহানকে বুঝিয়ে দেবে যে কিছু ভালোবাসা কেবল হৃদয়ের গহীনে রেখে দিতে হয়, ভাগ্যে লেখা না থাকলে জোর করে পাওয়া যায় না?চিন্তার ভারে দগ্ধ হতে হতে সাদাত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে রেলিঙে হাত রাখে। এক অজানা ভারে তার বুকটা চেপে আসে। সামনে অনামীশার চাদরে মোড়ানো নিঃসীম অন্ধকার, দূরে অস্পষ্ট শহরের জ্বলা-নেভা বাতিগুলো, আর তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক দিশেহারা মন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সন্ধ্যার আবীর রঙে রাঙানো ছাদ যেন এখনো মেহেদীর স্নিগ্ধ সুবাস ধরে রেখেছে। হলুদ সন্ধ্যা ও মেহেদীর আয়োজনের রেশ মিলিয়ে গেলেও পরিবেশে স্নিগ্ধতা লেগে রয়েছে।অরিন এবং অন্যান্য বান্ধবীরা প্রোগ্রাম শেষে যার যার গন্তব্যে চলে গেছে। আবিরও ফিরে গেছে নিজের বাড়িতে। সারহান প্রথমে থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাড়া দেখিয়ে সরে পড়েছে। শুধু তমা রয়ে গেছে, অরিত্রিকা আর ইশরার হাতে মেহেদী দেওয়ার জন্য।এখন ছাদে বসে আছে অরিত্রিকা, ইশরা, সাদাত, আর তমা। মৃদু বাতাস বয়ে চলেছে। সারাদিনের কোলাহল শেষে প্রকৃতি একটু অবসর নিচ্ছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু দূর থেকে ভেসে আসছে শহরের আবছা গুঞ্জন।
সারহান নিজের রুমে গেছে কোনো জরুরি মিটিংয়ে ব্যস্ত। অথচ সাদাতের মনে হচ্ছে, সে হয়তো নিজের মনের সঙ্গেই মিটিং করছে। কিছু না বলেও সারহানের আচরণ তার মধ্যে প্রশ্নের ঝড় তোলে। কী এমন তাড়া ছিল, যে থাকতে চেয়েও থাকা হলো না?সাদাত ছাদ থেকে রেলিঙের ওপার তাকিয়ে থাকে। অন্ধকার আকাশের নিচে আলোকিত শহরটা বড় বেশি নিঃসঙ্গ মনে হয়। আর সেই নিঃসঙ্গতার ভিড়ে কোথায় যেন অজানা অস্থিরতা জমাট বাঁধতে থাকে।
“ কীরে ডিজিটাল যুগের দেবদাস! মন খারাপ করে চিপাচাপায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আবার কী তোর গার্লফ্রেন্ড ছ্যাকা দিয়েছে? ”
ইশরা ব্যঙ্গাতক স্বর টেনে সাদাতের পাশে দাঁড়াল। হাতে মুঠোবন্দী হলুদ লুকালো পেছনের দিকে। মুখশ্রীতে ফুটে উঠেছে হাসি। সাদাত ইশরার দিকে তাকায় না। তার ইচ্ছে করছে না সেদিকে তাকাতে। মন মেজাজ খারাপ। কখন উল্টাপাল্টা বলে ফেলবে তখন দেখা যাবে আজকের সুন্দর একটা দিনে কেঁদেকুটে একাকার করেছে। দৃষ্টি অন্ধকার গহীনে রেখে ভরাট কন্ঠে বলল ;
“ আমাকে জ্বালাস না ইশরা। ”
ইশরা একটু অবাক হলো। যে ছেলে টমেটো ছাড়া কথা বলে না সে তাকে নাম ধরে ডাকছে? অতি আশ্চর্যের ব্যাপার স্যাপার। এই ছেলে কী তবে আবার ছ্যাকা খেল? হতেই পারে এটা কোনো অস্বাভাবিক কিছু নয়। নিঃশব্দে হেসে গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলল ;
“ সত্যি বল, এবারও ছ্যাকা খেয়েছিস? তোকে তো বলেছিলাম এসব মেয়ের চক্করে পড়ে নিজের লাইফ বরবাদ করিস না। কিন্তু তুই তো শুনলি না। ”
সাদাত অন্ধকার অনামিশার গহ্বর হতে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ঘাড় বাঁকিয়ে শান্ত, দৃঢ় চাহনি নিক্ষেপ করে ইশরার দিকে। ছাঁদের লাইটিংয়ের রঙ বেরঙের আলোয় ইশরার হাসির রেখা স্পষ্ট দেখে। আজ রাগ দেখানোর ইচ্ছে হলো না। শুধু ছোট্ট করে নিচু স্বরে উত্তর দিলো ;
“ তেমন কিছু নয়। ”
“ তাহলে মন খারাপ কেন? তখন বলেছিলি তুই স্পেশাল ডান্স করবি কিন্তু পরে করলি না। আমার মন বলছে আমি যা সন্দেহ করছি তা ঠিক। ”
“ গার্লফ্রেন্ড ছ্যাকা দিলেই বুঝি মন খারাপ থাকে? অন্য কারণ থাকতে পারে না। ”
“ উহু অন্য কারণ থাকতে পারেনা। ”
“ আমার চোখের সামনে থেকে সর নয়তো ছাঁদ থেকে ফেলে দেবো? ”
“ ও মা গো, ভয় পেয়ে গেলাম। ”
কথাটি বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল ইশরা। সেই হাসি প্রতিধ্বনিত হলো চারিপাশ। নিঃশব্দতা ভেঙে গেল নিমেষে। সাদাত বিরক্তিসূচক শব্দ করল। এই মেয়ে সিরিয়াস সময়ে হাসে। কপাল কুঁচকে ধমকে বলল ;
“ চুপ কর। ”
ইশরা বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে তাকাল সাদাতের দিকে। ভ্রু নাচিয়ে বলল ;
“ ঠিক আছে চুপ করলাম। ”
সাদাত একপলক ইশরার দিকে তাকিয়ে পুনরায় দৃষ্টি স্থির করল প্রকৃতির দিকে। ইশরা বিস্মিত হলেও নিজেকে সামলে নিলো। দুষ্টুমি বুদ্ধি মাথায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল এতোক্ষণ। তাই এখনই সুযোগ সময়টা কাজে লাগানোর। লুকানো হাত ধীরে সামনে নিয়ে আসল। মুঠোবন্দী হলুদ সতর্কতার সহিত আশেপাশে নজর বুলিয়ে আচমকা সাদাতের ডান গালে মাখিয়ে দিলো। অতঃপর উচ্চস্বরে হেসে উঠল। সাদাত অকস্মাৎ এহেন কান্ডের হতবিহ্বল হয়ে যায়। দ্রুততার সহিত তাকায় ইশরার দিকে। ইশরা সেই চাহনি দেখে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বিধি বাম! সাদাত ইশরার হাত ধরে ফেলে। হেঁচকা টান দিয়ে নিজের সম্মুখে দাঁড় করায়। ইশরা হচকচিয়ে যায়। হাসির রেখা ধীরে ধীরে নিভে আসে। শঙ্কিত বদনে তাকায় সাদাতের দিকে।
“ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম ভালোলাগেনি? ”
সাদাতের দৃঢ় কন্ঠস্বর। ইশরা একটু কেঁপে উঠে। তবুও নিজের শঙ্কিত ভাব বুঝতে না দিয়ে বলল ;
“ হলুদ লাগিয়েছি তাই কী হয়েছে? তোর গাল হলুদের ছোঁয়ায় ক্ষয়ে গেছে নাকি? ”
“ হলুদের ছোঁয়ায় না তোর ছোঁয়ায় ক্ষয়ে গেছে টমেটো। তুই আমার গালে হলুদ লাগিয়েছিস, এখন মুছে দে। ”
“ পারব না। ”
“ যতক্ষণ মুছে না দিবি ততক্ষণ তোকে ছাড়বো না। ”
সাদাত রুঢ় গলায় বলে উঠল। ইশারা পড়েছে ফ্যাসাদে। ভেবেছিল হলুদ লাগিয়ে ভূত বানিয়ে দিয়ে পগারপার হবে। তার আগেই ধারা খেল। হঠাৎ বুদ্ধি আসল মাথায়। এক গাল হেসে বলল ;
“ আমাকে ছেড়ে দে। দ্রুত গিয়ে টিস্যু নিয়ে আসি।”
সাদাত গম্ভীর কণ্ঠে বলল ;
“ তোকে আমার বিশ্বাস নেই। ”
“ তাহলে কিভাবে হলুদ মুছে দিবো? ”
“ তোর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দে। ”
সাদাতের নির্লিপ্ত কন্ঠস্বর। ইশরার মেজাজ গরম হলো। এতো সাধের শাড়ির আঁচল দিয়ে নাকি বাদরের মুখ মুছিয়ে দিবে হুহ্। কাটকাট স্বরে বলল ;
“ পারব না। ”
সাদাত বাঁকা হাসে। অন্য হাত দ্বারা গালে অবশিষ্ট লেগে থাকা হলুদ মাখিয়ে নেয়। অতঃপর ইশরার নরম তুলতুলে গালে লেপ্টে দেয়। ইশরা চমকে উঠে এহেন কান্ডে। বিমূঢ় চাহনিতে তাকায় সাদাতের দিকে। সাদাত ওষ্ঠ কোণে হাসি বজায় রেখে গলা খাদে নামিয়ে বলে উঠে ;
“ সাদাত কারো ঋণ পেন্ডিং রাখে না। ”
একটু থেমে পুনরায় বলে উঠে ;
“ শুনেছি বিয়ে উপলক্ষে যে হলুদ বর কিংবা কনে কে ছোঁয়ায় সেই হলুদ যদি অবিবাহিত বিবাহযোগ্য কোনো ছেলে বা মেয়েকে ছোঁয়ানো হয় তাদের দ্রুত বিয়ে হয়।”
ইশরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকায় সাদাতের দিকে। মুখশ্রী থমথমে হয়ে যায়। ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠে ;
“ একদম আজেবাজে কথা বলবি না। ”
সাদাত গা গুলিয়ে হাসে ;
“ আজেবাজে কথা নয় টমেটো। এটা প্রচলিত কথা। এই যে তোকে হলুদ ছুঁইয়ে দিলাম। আই থিংক তোর বিয়ে দ্রুত হয়ে যাবে। ”
“ তাহলে তোরও দ্রুত বিয়ে হবে। ”
“ তোর মুখে ফুল চন্দন পরুক টমেটো। মনে মনে ভাবছিলাম আর কতোদিন প্রেম করবো। এবার বিয়ে করে সংসার করাটা গুছিয়ে অতঃপর বাচ্চা পয়দা করবো। ”
সাদাতের আমোদিত স্বর। ইশরা মুখ কুঁচকে বলে উঠল ;
“ তোর বয়স হয়েছে বিয়ে করার? ”
সাদাত ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দেয় ;
“ এখনো হয়নি। তবে খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। ”
কথাটা শেষ করে আচমকা ইশরার শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে সাদাত। অতঃপর ইশারার হাত ছেড়ে দিয়ে প্রস্থান করে। ইশরা হতভম্ব হয়ে যায়। শাড়ির আঁচলের দিকে নজর যেতেই চিৎকার দিয়ে উঠে ;
“ অসভ্য সাদুর বাচ্চা আমার শাড়ি নষ্ট করে দিলি। ”
এতটুকু বলেই ক্রোধে ক্ষোভে নাকের জল চোখের জল এক করতে লাগল। স্টেজের ওপরে বসে থাকা অরিত্রিকা এবং তমা দুজনেই দেখল দুটোর কান্ড। বসে দুইজনেই কপাল চাপড়ালো। এরা দুজন ভালো হবে না আর।
ছাদ থেকে কিছুক্ষণ আগে নিচে এসেছে সকলে। যে যার মতো ফ্রেশ হয়ে এতোক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাড়ির বড়ো’রা সকলে আদেশ করেছে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার জন্য। আগামীকাল যেহেতু আকদ সেহেতু বাড়িতে অল্প বিস্তর মেহমানের চাপ থাকবে। ভোরে দিকে রান্নাসহ বিয়ে বাড়ির সকল কাজ গুছিয়ে রাখতে হবে। এতোমধ্যে বাড়ির বড়ো’রা গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে গিয়েছে।
অরিত্রিকা চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে ভয়ে। কোনো মতো নিজের মেহেদী রাঙা হাত সকলের থেকে লুকিয়ে রাখছে যথাসম্ভব। ফ্রেশ না হয়ে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় পায়চারি করছে মিনিট দশেক ধরে। বিরবির করে বকে চলেছে তমা এবং আবিরকে। দুজনকে যত গালমন্দ করছে ততই কম হচ্ছে। এই দুজনের জন্য কেস খেয়ে যাবে বাড়ির সকলের সামনে তখন কী হবে? নিশ্চয়ই তার বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিবে। এসব নিয়ে আর ভাবতে পারলো না। মাথা ব্যথা করছে, ক্ষুধা লেগেছে সব মিলিয়ে অসহ্য লাগছে। অরিত্রিকা ধপ করে বসে পড়ে বিছানা। ডান হাত উঁচিয়ে দৃষ্টি স্থির করে সেই হাতে। তমা ভীষণ সুন্দর করে হাত ভরে মেহেদী দিয়ে দিয়েছে। দেখতে চমৎকার লাগছে। মেহেদী শুকিয়ে এসেছে প্রায়। যেহেতু অর্গানিক মেহেদী দিয়েছে সেহেতু এখন ধুয়ে ফেলা যাবে না। সে সুক্ষ্ম নজরে পুরো হাতের মেহেদীর ডিজাইন দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হঠাৎ নজর আঁটকে যায় হাতের তালুতে মেহেদী দিয়ে গোলাকৃতি বৃত্তের দিকে। মাঝ বরাবর সুস্পষ্ট ভাবে লেখা ইংরেজী অক্ষরের নামের দিকে। সেথায় জ্বলজ্বল করছে “SARHAN ” নামটি। একটু কেঁপে উঠে সে। লজ্জায় গাল গরম হয়ে আসল। কেন যে তমা আপু আবির ভাইয়ার কথায় নামটা লিখে দিলো?
তমা কিছুক্ষণ আগে অরিত্রিকা এবং ইশরার হাতে মেহেদী দেওয়া কমপ্লিট করে নিজের গন্তব্যে পাড়ি জমিয়েছে। যাওয়ার আগ মুহুর্তে অরিত্রিকার হাতের তালুর মাঝখানে সারহানের নাম লিখে দিয়েছে। অরিত্রিকা বিস্মিত হয়েছিল। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল কেন নামটা লিখলে তমাপু। তখন তমা মিষ্টি হেসে বলেছিল আবির ভাইয়া লিখতে বলেছে আর সে সারহানের গান গাওয়ার সময়ের দুজনের খুনসুটির দৃশ্য লক্ষ্য করেছিল। এতেই বুঝেছিল কিছু একটা চলছে তাদের মাঝে। এহেন কথায় অপ্রস্তুত হয়েছিল অরিত্রিকা। তখন ইশরা রুমে না থাকায় দুজনের মাঝে কথাগুলো চাপা আছে। তমা বাড়িতে যাওয়ার আগে অরিত্রিকার গালে হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে বলেছিল ;
“ বিয়ের কনের হলুদ ছুঁইয়ে দিলাম, দেখবে তোমার বিয়ে দ্রুত হয়ে গেছে। ”
অরিত্রিকা শুধু হতবাক হয়ে দেখছিল। কন্ঠনালী হতে যেন কোনো কথা বের হচ্ছিল না। একের পর এক বিস্ময়ের ঘটনা তাকে বাকরুদ্ধ করে দিচ্ছিল। সারহান ভাই থেকে শুরু করে সকলে তাকে বিস্মিত করছিল। ইরফান এবং সাদাতের নজর আজকে অন্যরকম ছিল। কেমন যেন গোয়েন্দার ন্যায় তাকিয়েছিল তার দিকে। হঠাৎ কেন ওমন ভাবে তাকিয়ে ছিল বুঝল না। অরিত্রিকা সেসব ভাবনা সাইডে রেখে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। এখন খেতে হবে, ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে এটা ভাবতে ভাবতে চঞ্চল পায়ে ছুটলো কিচেনের দিকে।
“ আজকে আবারও কিচেনে এসেছিস? ”
গুরুগম্ভীর পুরুষালী কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অরিত্রিকা চমকে গেল। ভয়ার্ত ভঙ্গিতে তাকাল কিচেনে দাঁড়িয়ে থাকা মানবটির দিকে। সারহান গ্যাসের চুলার সামনের দিকটায় দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীর মুখে। অরিত্রিকা শুকনো ঢোক গিলে ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো কিচেনের ভেতরে। সারহানকে উপেক্ষা করে উঁকি দিলো চুলার দিকে। চুলাতে পাত্রে পানি গরম হচ্ছে। সে বুঝল হয়তো কফি বানাচ্ছে মানুষটা। অরিত্রিকা মিনমিন করে বলে উঠল ;
“ এমনি ঘুরতে এসেছিলাম কিচেনে। ”
সারহানের তীক্ষ্ণ চক্ষুদ্বয় নিবদ্ধ অরিত্রিকার ভীতিগ্রস্ত মুখশ্রীতে। মেয়েটার আজব উত্তর শুনে কপাল কুঁচকে গেল।পুরূ কন্ঠে বলে উঠল ;
“ কিচেন কি চিড়িয়াখানা? যেখানে পশুপাখি দেখার জন্য ঘুরতে আসবি? ”
অরিত্রিকা থতমত খেয়ে গেল। বুঝতে পারল উত্তরটা যুক্তিসঙ্গত হয়নি। আড় চোখে তাকিয়ে পুনরায় বলল ;
“ আসলে কিচেন থেকে শব্দ আসছিল তাই দেখতে এসেছিলাম কে রান্না করছে। ”
“ কে রান্না করছিল দেখতে এসেছিলি নাকি আমাকে দেখতে এসেছিলি কোনটা?”
সারহান গম্ভীর কণ্ঠে শুধায়। অরিত্রিকার মুখ হা হয়ে যায়। লজ্জা ও পেল। তবে তা খুব চতুরতার সহিত আড়াল করল। এই মানুষ কথাটা আকাশ থেকে পাতালে নিয়ে যাচ্ছে। তার ভুল হয়েছে মিথ্যা বলা। সত্যি বললে এতোকিছুর উত্তর দিতে হতো না। আমতা আমতা করে বলল ;
“ তেমন কিছু না। ”
সারহান চুলা অফ করে দেয়। বুকে দুই হাত গুজে নিরব চিত্তে তাকায় তার একান্ত নিভৃতসুধার মুখপানে। ফর্সা মুখখানি লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। মায়াবী মুখখানা দেখে অন্তঃকোণ শান্ত হয়ে গেল। নিভে গেল স্বভাবসিদ্ধ রুক্ষতা। মনের গহীনে যেন ভালোলাগার স্নিগ্ধ পরশ ছড়িয়ে পড়ল। সে ভেবে পায় না এই ভীতিগ্রস্ত মুখশ্রী তাকে তীব্রভাবে কেন দিশেহারা করে দেয়। মন চায় নিজের বাহ্যিক রুপের খোলস ছিঁড়ে ফেলে ভেতরের প্রেমিকসত্তাকে বাহিরে আনতে। প্রেয়সী ছোট্ট, কোমল দেহ খানাকে নিজের বক্ষে আগলে নিতে। কপালের মাঝ বরাবর ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিতে। দুই বছর যাকে নিজ ইচ্ছেতে পরিবারের কথা ভেবে দূরে ঠেলে দিয়েছিল তাকে পুনরায় কাছে টানতে। প্রেমিক পুরুষ তার প্রণয়িনীকে বোঝাতে চায় দূরে থেকে দহনে পোড়া প্রেমিকসত্তাকে একটু ভালোবাসো বোকা মেয়ে। তোমার বিরহে সে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তুমি প্রেমিক পুরুষের অব্যক্ত যন্ত্রণা বোঝো। সারহান এসব ভেবে একটু অন্যমনষ্ক হয়। সম্বিত ফিরে অরিত্রিকার গালে লেগে থাকা হলুদের দিকে তাকিয়ে।
“ হলুদ কে লাগিয়েছে তোর গালে? ”
সারহানের সন্দিহান স্বর। অরিত্রিকা তড়িঘড়ি করে বলে উঠল ;
“ তমাপু। ”
“ তমা কেন হঠাৎ তোকে হলুদ লাগাবে?”
“ সত্যি বলছি তমা আপু হলুদ লাগিয়ে দিয়েছে। গালে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে কি বলেছিল জানেন? কনের হলুদ লাগালে নাকি দ্রুত বিয়ে হয়। আমারও নাকি তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাবে।”
অরিত্রিকা গরগর করে সব কথা বলে ক্ষ্রান্ত হলো। পরক্ষণে কি বলেছে ভাবতে জিভ কাটল। লজ্জায় আশেপাশে তাকাতে লাগল। সারহানের ওষ্ঠকোণে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে উঠে ;
“ আয় তোর বিয়ের শখ পূরণ করে দেই। ”
অরিত্রিকা হতচকিত দৃষ্টিতে তাকায় সারহানের মুখপানে। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলে উঠে ;
“ আমি কখন বললাম আমার বিয়ের শখ হয়েছে? ”
“ গালের হলুদ কী তার স্পষ্ট প্রমাণ নয়!”
“ আসলে আমি মুছতে ভুলে গেছি। এখুনি মুখ ধুয়ে ফেলছি। ”
সারহান দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল ;
“ দরকার নেই। ”
অরিত্রিকার মন ভীষণ অশান্ত। কেমন যেন নার্ভাস লাগছে। লজ্জা, অস্বস্তি যেন তাকে জেঁকে ধরছে। সারহান ভ্রুযুগল বাঁকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে উঠল ;
“তোর এক গালে হলুদের প্রলেপ এতটা ভালো লাগছে না, ফাইরুজ। তবে অন্য গালে যদি আমি আমার মতো করে হলুদ ছুঁইয়ে দিই, তাহলে বোধ হয় তোকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগবে।”
অরিত্রিকা ড্যাবড্যাব করে তাকাল মানুষটার দিকে। সারহান চক্ষুদ্বয়ে নিখাদ গভীরতা ও ওষ্ঠকোণে দুর্বোধ্য হাসি ঝুলিয়ে দু কদম এগিয়ে আসে। একটু ঝুঁকে অরিত্রিকার হলুদ ছোঁয়ানো গালে গাল ছুইয়ে দেয়। অকস্মাৎ এহেন কান্ডে অরিত্রিকার বক্ষে ছলাৎ করে উঠে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির মৃদু আঘাতে শরীর শিরশির করে উঠে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে বইতে থাকে শিহরণ। চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। হাত পা ঠান্ডায় জমে আসছে। অজানা শঙ্কায় শঙ্কিত হলো। পরক্ষণে সারহান তখনি থেমে যায় নি। তার গালে লেপ্টে থাকা সামান্য হলুদ আঙুলের ডগায় নিয়ে ছুঁইয়ে দেয় অরিত্রিকার ওপর নাসিক্যে। অতঃপর কানের কাছে মুখ এনে শান্ত কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে;
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২৮
“ নাউ ইউ আর লুকিং সো প্রিটি মাই “সিক্রেট অ্যামব্রোজিয়া”।
অরিত্রিকার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে সারহানের শান্ত কন্ঠে বলা “সিক্রেট অ্যামব্রোজিয়া”।” অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় বন্ধ অবস্থায় আওড়ায় সেটি।