প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩০

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩০
আদ্রিতা নিশি

সকাল দশটা বেজে ত্রিশ মিনিট। চৌধুরী নিবাসের সকল সদস্য ইতোমধ্যে ব্যস্ত হয়ে গেছে কাজকর্মে। বিয়ে বাড়ি বলে কথা একটু ব্যস্ততা তো থাকবেই। কিছুক্ষণ আগে পাত্র পক্ষের বাড়ি থেকে কল এসেছিল।তারা সকলে দুপুর দুইটায় উপস্থিত হবেন চৌধুরী নিবাসে। এরপর থেকে আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব পাত্রপক্ষের আপ্যায়ানের জন্য সবকিছু একদম সুনিপুণ ভাবে করছেন যেন পাত্র পক্ষের কোনো অসুবিধা না হয়। সাদাত এবং ইরফান লিভিং রুমে ফুল দ্বারা ডেকোরেশনের দিকটা কয়েকজন সার্ভেন্টকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। সারহান সকালে কোথাও বেড়িয়েছে। দুপুরের আগে ফিরে আসবে। সারহানের অনুপস্থিতিতে চৌধুরী বাড়িতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে কয়েকগুন।

অরিন গোসল করে নিজের রুমে আসল মাত্র। পরনে সাধারণ সুতির থ্রিপিস। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আনমনে চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত। মুখশ্রী অতিশয় মলিন। আনমনে ভেবে চলেছে প্রতারকটার কথা। ভাবারই কথা প্রায় তিন বছরের সম্পর্ক ছিল। গোপনে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। দেখা করা বাদে অন্য সময়ে ম্যাসেজে, হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়েছে। কত শত রাত জেগে মানুষটার সাথে প্রেম নিবেদন করল অথচ শেষ মুহুর্তে প্রতারনা করল। কয়েকদিন আগেও স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছিল মানুষটা। কিন্তু এখন যোগাযোগের কোনো রাস্তা রাখেনি। নাম্বার, ফেসবুক আইডি সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে। অরিন এখন বুঝছে সে বড় ভুল করেছে। এই ভুলের মাশুল দিতে হবে। নিজের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাক তবুও সে পরিবারের কাউকে বলবে না তার জীবনের সবচেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা। মানুষ ভুল করে আবার শুধরেও নেয়। সে শুধরে নিচ্ছে বাবা মায়ের সম্মতিতে বিয়ে করে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ অরিন আমি তোমাকে ভালোবাসি না। গত তিনবছর ধরে তোমাকে ভালোবাসার অভিনয় করে গিয়েছি। আজ থেকে তোমাকে আমি মিথ্যা ভালোবাসার মোহ থেকে মুক্তি দিলাম। ভালো থেকো আর আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো না। ” অরিনের ফোনে সপ্তাহখানেক আগে শেষ বারের মতো মানুষটার ম্যাসেজ এসেছিল। তারপর অনেকবার চেষ্টা করেছে মানুষটার সাথে যোগাযোগ করার কিন্তু পারেনি।তা হঠাৎ মনে পড়তেই তাচ্ছিল্য করে হাসল সে।
“ আপু রাহাত ভাইয়ার কথা ভেবে হাসছো? আহা এখুনি এতো প্রেম দুইদিন পর দেখা যাবে ভাইয়া ছাড়া কিছুই বোঝো না। ”
অরিত্রিকার খোঁচা মা*রা কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অরিনের হাসি সংকুচিত হয়ে আসে। ড্রেসিং টেবিলের ওপর চিরুনী রেখে সহসা পিছু ফিরে তাকায়। নিজেকে সামলে স্বাভাবিক ভাবে বলে ওঠে ;

“ তেমন কিছু না। একটা জোকারের কথা ভেবে হাসছিলাম। ”
অরিত্রিকা তন্দ্রাচ্ছন্ন ঢুলুঢুলু চক্ষুদ্বয় ডলে হেলেদুলে ধপ করে বাবু হয়ে বসে অরিনের বিছানায়। হামি তুলে বলে ওঠে ;
“ আমাকেও জোকারের কাহিনী শোনাও আপু। তোমার সাথে তাল মিলিয়ে আমিও একটু হাসি। আজ কাল মাথায় একজন ছাড়া অন্য কিছু আসছে না। ”
“ সেই একজনটা কে শুনি? ”
অরিনের সন্দেহবাতিক স্বর। ভ্রুযুগল বাঁকিয়ে অরিত্রিকার দিকে এগিয়ে আসে। অরিত্রিকা পিটপিটিয়ে চেয় ক্যাবলা মার্কা হেসে বলে ওঠে ;
“ কোন একজন? ”
“ একটু আগে বললি কেউ একজন ছাড়া অন্য কেউ মাথায় আসছে না। ”
“ আরে কেউ একজন বলতে লেভিকে বুঝিয়েছি। বেচারা তোমার বিয়ের কারণে শান্তি মতো বাড়িতে চলাফেরা করতে পারছে না। ”

“ কেন? তোর বিড়ালকে মেহমানরা ইভটিজিং করছে? ”
“ আমি কখন বললাম ইভটিজিং করছে? ”
অরিত্রিকা থতমত খেয়ে গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে বলল। অরিনের সন্দেহ গাঢ় হলো। এই মেয়ে ভাবসাব দুইদিন ধরে সন্দেহজনক লাগছে। নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা করছে। এই মেয়ে আবার প্রেম করছে না তো? তাই এমন উদ্ভট কান্ড করে বেড়াচ্ছে। সন্দেহবাতিক কন্ঠে বলে ওঠে ;
“ কার প্রেমে পড়েছিস? ”
অরিত্রিকার ঘুম উবে গেল। হচকচিয়ে গেল একটু। কোনো ভাবে তার মনে চলমান অনুভূতির ঠাওর করতে দেওয়া যাবে না। নিজেকে সামলে দৃঢ় কন্ঠে বলল ;

“ কই কার প্রেমে পড়েছি। তুমি তো আমাকে চেনো। আমার দ্বারা প্রেমে পড়া সম্ভব? ”
“ তোর দ্বারা যেহেতু বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করা সম্ভব সেহেতু প্রেমে পড়াও সম্ভব। এবার বল ছেলে কে? কোন গোলামের পুতের প্রেমে পড়েছিস? ”
অরিত্রিকার ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে তেমন অবস্থা হয়েছে। মুখশ্রী থমথমে হয়ে গেল। বিরবির করে বলল;
“ গোলামের পুত নয় আরশাদ চৌধুরীর পুত হবে আপু। ওই ব্যাডা তোমার ভোলাভালা ইনোসেন্ট বোনটাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেছে। এখন আমি প্রেমের পুকুর থেকে উঠতে পারছি না। কি করবো এখন? ”
অতঃপর নিজেকে স্বাভাবিক করে গোমড়া মুখে বলে উঠল ;

“ তুমি আমাকে মিথ্যা দোষারোপ করছো কিন্তু। ”
“ আমি কোনো মিথ্যা দোষারোপ করছি না। তোর চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তুই মিথ্যা কথা বলছিস? ”
“ আমার চোখে কি ভেসে উঠেছে আমি অমুকের পুতের প্রেমে পড়েছি। আজাইরা লজিক বাদ দাও। ”
অরিত্রিকা মেকি রাগ দেখিয়ে বলল। অরিন কিছু বলতে যাবে বোনকে এমন সময় ইসমা বেগম হাস্যরত অবস্থায় রুমে প্রবেশ করলেন। দুই বোনকে একসাথে দেখে বোধ হয় একটু বেশী ভালো লাগল।
ইসমা বেগম এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন। হাস্যরত কন্ঠে বললেন ;
“ দুই বোন দেখছি একসাথে। কি নিয়ে আলোচনা চলছিল দুজনের মধ্যে? ”
অরিত্রিকা একগাল হেসে উত্তর দেয় ;
“ বিয়ে নিয়ে। ”
“ ওহহ আচ্ছা। তো কি কি আলোচনা করলি দুজনে?”
“ তেমন কিছু না। এসব কথা বাদ দাও ফুপি। তুমি কোনো কাজে এসেছিলে? ”
অরিত্রিকা কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করল। ইসমা বেগম জিভ কেটে বললেন ;
“ দেখেছিস এইটুকু পথ আসতে গিয়ে ভুলে গিয়েছি। অরিন একটু পরেই পার্লার থেকে মানুষ আসবে তোকে সাজাতে। তুই ফ্রেশ হয়ে নে। ”

শেষোক্ত কথাটি অরিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন ইসমা বেগম। অরিন স্বভাবসুলভ মিষ্টি হেসে বলল ;
“ ফুপি মাত্র ফ্রেশ হয়ে আসলাম। ”
“ সকালের নাস্তা করেছিস? ”
“ হ্যা করেছি। বড় মা এসে খাইয়ে দিয়ে গেছে। ”
“ অরিত্রিকা তুই নাস্তা করেছিস? ”
অরিত্রিকা আড়মোড়া ভেঙে বলে উঠল ;
“ নাহ করিনি। মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম। ”
ইসমা বেগম অসন্তুষ্ট হলেন। অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন ;
“ দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নে আর লেভিকে খাবার দে। বেচারা কিচেনে গিয়ে ক্ষিদেতে ডাকছে। ”
“ লেভির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার বেবীটা গতকাল রাত থেকে খায়নি। ”
“ বিড়ালের বাচ্চা বেবী? আশ্চর্যের বিষয়?”
“ আশ্চর্যের বিষয় কেনো? ”

“বিয়ে না হতেই বিড়ালের বাচ্চাকে মানুষের বাচ্চার মতো পালছিস। ভাবছি অরিনের বিয়েটা হয়ে গেলে তোরও বিয়ে দিয়ে দেব। তাহলে বছর ঘুরতেই বাচ্চাকাচ্চা হয়ে যাবে। তখন নিজের বাচ্চাকে লালন পালন করবি। ”
অরিত্রিকা একটু লজ্জা পেয়ে বলল ;
“ তুমিও না ফুপি। আমার বয়স হয়নি বিয়ে করে বাচ্চা লালন পালন করার।
ইসমা বেগম হেসে বললেন ;
“ তোর বয়সে আমিও বলেছিলাম এই কথা। তারপর হঠাৎ করে বিয়ে হয়ে গেল। বছর ঘুরতেই ইরফান জন্ম নিলো। ”
“ ধ্যাত ফুপি কিসব বলো! আমার লজ্জা লাগছে তোমার কথা শুনে। আমি গেলাম নিচে। তুমি আপুকে শোনাও তোমার বিয়ের কাহিনী। ”
অরিত্রিকা লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে কারি বলে বিছানা থেকে নেমে ছুট লাগালো লিভিং রুমের দিকে। ইসমা বেগম এবং অরিন শব্দ করে হেসে উঠল তা দেখে।

সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়েছে। মেহমানরা সময় অনুযায়ী চৌধুরী নিবাসে দাওয়াত কবুল করতে এসেছে। বাহিরের তেমন কোনো মেহমান নেই বললেই চলে। আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেবের পরিচিত গুটি কয়েক লোক। অরিনের দুই ফ্রেন্ড, অরিত্রিকার চার ফ্রেন্ড, সারহানের পরিচিত কয়েকজন এবং ইনান, আবির। তমাকে সাথী বেগম ইনভাইট করেছে। তার কারণ হলো তমাকে তিনি দীর্ঘ দিন ধরে চেনেন।
অরিত্রিকা নিজের রুমের বিছানার ওপর বসে সাজগোছ করছে। পুরো বিছানায় সাজগোজের জিনিসপত্র ছড়ানো ছিটানো। সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। আগে সাজগোছ তারপর বিছানা পরিপাটি করা। সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে এসেছে কিছুক্ষণ পরে বরপক্ষ চলে আসবে। তাই সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি নিজের সাজ ঠিক করতে ব্যস্ত। অরিত্রিকা দীর্ঘক্ষণের সাজগোজের সমাপ্তি ঘটিয়ে সম্পূর্ণ তৈরী হয়েছে। শুধু লিপস্টিক দেওয়া বাকি। তার পরনের পাকিস্তানি থ্রিপিসের রঙের সাথে ম্যাচিং করে নুড পিংক কালারের লিপস্টিক ঠোঁটে দিল। অতঃপর নিজের বিছানার ওপরে ছড়িয়ে থাকা সাজগোজের জিনিস গুছিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে আসল।

“ অরিত্রিকা তোর সাজগোজ হলো? অরিন আপুর কিন্তু সাজা অলরেডি ডান। ”
ইশরা কথাটি বলতে বলতে ধপাধাপ পা ফেলে রুমে প্রবেশ করল। অরিত্রিকা পরনের ওড়না ঠিক করে বলল ;
“ আমারও হয়ে গেছে। রাহাত ভাইয়ারা রওনা দিয়েছে? ”
“ এখনো দেয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যে রওনা দিবে। ”
“ ওহহ। উমমম তোকে দেখতে হেব্বি লাগছে ইশু। ”
অরিত্রিকা ইশরাকে পরখ করে মৃদু হেসে বলে উঠল। ইশরার পরনে মেরুন রঙের পাকিস্তান থ্রিপিস। অরিত্রিকা এবং ইশরার ড্রেসের ডিজাইন প্রায় একরকম। গতবছর ঈদে আরশাদ সাহেব অরিন, ইশরা এবং অরিত্রিকাকে সেম ডিজাইনের ড্রেস কিনে দিয়েছিলেন। ইশরা উৎফুল্ল হয়ে বলল ;

“ তোকেও অসম্ভব সুন্দর লাগছে। তাড়াতাড়ি চল অরিত্রি বিয়ের গেট ধরব। ”
“ বইন, আকদ হচ্ছে।”
“ তাতে কি? গতকাল রাতে হলুদ, মেহেন্দি হয়েছে তাই আজকে গেটে রাহাত ভাইয়াকে ধরব তারপর টাকা নিয়ে মালামাল হয়ে যাবো। ওই যে হাউসফুল ফোর মুভির সং মালামাল সোরিঙে ওইগানে রাতে নাচব। ”
“ ঠিক আছে চল। আজকের মিশন টাকা লুট করার মিশন। ”
কথাটি বলে অরিত্রিকা হাসতে লাগল। অরিত্রিকার সাথে তাল মিলিয়ে হাসল ইশরাও।
“ দুই পেত্নি হাসা বাদ দিয়ে দ্রুত নিচে যা।”
সাদাতের কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই দুজনের হাসি তৎক্ষনাৎ থেমে গেল। উৎসুকভাব নিয়ে তাকাল রুমের দরজার দিকে। সাদাত অদ্ভুত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ইশরা কটমট করে বলল ;
“ তুই পেত্না। ”
সাদাত হতভম্ব হয়ে গেল। পেত্না এটা আবার কেমন জেন্ডার? কোনোদিন এমন নাম শোনেনি সে। বিস্মিত কন্ঠে বলে ওঠে;

“ পেত্না কী? ”
ইশরা মুখ বাঁকিয়ে বলল ;
“ পেত্নির মেইল ভার্সন।”
“ আগে আমি ভাবতাম তোর ব্যকারণে নাম্বার এতো কম কেন? মাথামোটা কথাটার। ”
“ সাদুর বাচ্চা। ”
“ টমেটো। ”
অরিত্রিকার মেজাজ বিগড়ে গেল। ধমকে বলল ;
“ চুপ কর নয়তো তোদের দুজনের মাথায় কাঁঠাল ভাঙব। ”
সাদাত মুখ গোমড়া করে বলল ;
“ কাঁঠাল এখনো পাকে নি।”

❝কতোদিন ভেবেছি শুধু দেখবো যে তোমায়,
ক্লান্তহীন তুমি ছিলে আমার কল্পনায়,
সেই ছবি উঠল ভেসে চোখেরই পাতায়,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায়। ❞
অরিত্রিকা আনন্দিত ভঙ্গিতে গুনগুন করে গান গাইছে। কিছুক্ষণ আগে ইশরাকে কৌশলে লিভিং রুমে পাঠিয়ে একেবারে লুকিয়ে চুরিয়ে ঢুকে পড়েছে সারহানের রুমে। আজকের দিনটা স্পেশাল আর স্পেশাল দিনে একটু স্পেশাল পারফিউম ইউজ করায় দোষ কী? তবে শর্ত একটাই, সেটা হতে হবে সকলের অগোচরে। তবেই না মজা!সারহানকে এতদিন সহ্য করতে পারেনি সে কিন্তু তার ড্রেসআপ আর পারফিউম সে তো বরাবরই অপছন্দ করতে পারেনি! বরং গোপনে বেশ পছন্দ করত। তবে সেটা প্রকাশ করলে মানসম্মান থাকে?আজ যেহেতু সারহান বাড়িতে নেই, ধরা পড়ার ভয়ও নেই। আর এটাই তো মোক্ষম সুযোগ! সুযোগ হাতছাড়া করা কি সাজে? অরিত্রিকা মজা নিতে নিতে হাত বাড়িয়ে নিয়ে নেয় “BLUE DE CHANEL” পারফিউম। জেন্টস পারফিউম হলেও এই তীব্র গন্ধ তার ভীষণ প্রিয়। নির্দ্বিধায় নিজের ড্রেসে উদারভাবে ছড়িয়ে দেয় সুবাস। কাজ শেষ হলে যত্ন করে ঠিক আগের জায়গাতেই পারফিউম রেখে দেয়। তারপর আয়নার সামনে এক ঝলক নিজেকে দেখে, মুচকি হাসে। অতঃপর চঞ্চল পায়ে দৌড়ে নিচে যাবে, দুকদম যেতেই থমকে দাঁড়ায়। ভয়ে হচকচিয়ে যায়। সামনে দন্ডায়মান সারহান প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে বক্ষে টান করে ভ্রুযুগল বাঁকিয়ে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

“ আমার রুমে পারমিশন বাদে ঢুকে আমার পারফিউম ইউজ করছিস? তোর সাহস বেশী হয়ে গেছে? ”
ভরাট কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অরিত্রিকা হচকচিয়ে। এদিক ওদিক তাকিয়ে মিনমিন করে বলে ;
“ আসলে আমার পারফিউম শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই ভাবলাম…। ”
“ ভাই ভাবলি আমার পারফিউম ইউজ করবি? ”
সারহান গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে বলে উঠল। অরিত্রিকা হাসার ভাণ করে বলল ;
“ একদম ঠিক ধরেছেন। ইশরা, অরিন আপুর সবার পারফিউম লেভি কোথাও ফেলে দিয়েছে। তাই আপনার রুমে এসেছিলাম পারফিউম ধার নিতে।? ”
সারহাত অতিব আশ্চর্যের সহিত তাকাল। এই মেয়ে বলে কি পারফিউম ধার নিতে এসেছে? বিরক্তিসূচক শব্দ করে দৃঢ় কন্ঠে বলল ;
“ আমাকে তোর গাধা মনে হয়। তুই লেভির নামে মিথ্যা অপবাদ দিবি, আমি সেটা বিশ্বাস করে নেবো? আর কি বললি পারফিউম ধার নিতে এসেছিলি! তোর মাথায় আদৌও ঠিক আছে নাকি মেন্টাল হয়ে গেছিস? ”
অরিত্রিকার মুখখানা চুপসে গেল। ভেবেছিল এই দফায় অন্তত রেহাই পাবে। কিন্তু তা আর হলো কই? এতো অপমান শোনার থেকে সত্যি বলে দেওয়া ভালো। মুখ গোমড়া করে বলল;

“ আমার নিজের পারফিউম ইউজ করতে ভালোলাগছিলো না। তাই আপনার পারফিউম ইউজ করতে এসেছিলাম। কারণ আপনার পারফিউমের সুবাস আমার ভালো লাগে? ”
“ আর আমাকে? ”
সারহান কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে অতি শান্ত এবং স্বাভাবিক কন্ঠে শুধায়। অরিত্রিকা চকিত দৃষ্টিতে তাকায় শ্যামমানবের দিকে। মানুষটি কেমন উৎসুক গাঢ় চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে একটু লজ্জা পায়। অন্যত্র তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলে ;
“ জানি না। ”

সারহান তার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে অরিত্রিকাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করছে। হালকা গোলাপি আর মেরুনের মিশেলে থ্রিপিস পরে আছে সে। মুখশ্রীতে কৃত্রিম সাজের মৃদু ছোঁয়া, খোলা চুল এলিয়ে আছে পিঠ বেয়ে। মেহেদির লালিমায় রাঙানো হাতখানি চুড়ির রিনিঝিনিতে সজীব, কানে ছোট স্টোনের দুল, গলায় সরু চেইন।সব মিলিয়ে যেন অনন্য শোভা ছড়িয়ে আছে মেয়েটির অস্তিত্বে।এই মেয়ের নিভৃতসুধার এমন আকস্মিক আবির্ভাবে সারহানের গলা শুকিয়ে আসছে। কেমন যেন বেসামাল লাগছে নিজেকে। মুহূর্তেই নিজের ভেতরে অস্থির ঢেউ খেলে যায়। দ্রুত চোখ বন্ধ করে নেয় সে, যেন সেই মোহময় বিভ্রম থেকে নিজেকে সামলে নিতে পারে। দীর্ঘ শ্বাস টেনে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে।এই মেয়েটার মোহনীয় সৌন্দর্য দেখে সে বেসামাল হয়ে যাচ্ছে!একটু আগেই মনে হয়েছিল, আরেকটু হলে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলত, উল্টাপাল্টা কিছু করে বসত! প্রেমিক মন কেন এতো ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে? সে শ্বাস টেনে নিলো। চক্ষুদ্বয় বন্ধ করল।

অরিত্রিকা সারহানের অস্বাভাবিক আচরণ দেখে কিঞ্চিৎ উদ্বেগ নিয়ে বলে ওঠে,
“সারহান ভাই, আপনি ঠিক আছেন?”
তার স্বরে চিন্তার ছোঁয়া স্পষ্ট। অথচ সারহান এখনো নিজের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে লড়ছে। মেয়েলী কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই চক্ষুদ্বয় খুলে ফেলে সারহান। অন্যত্র তাকিয়ে সংযত কন্ঠে বলে উঠল ;
“ হ্যা ঠিক আছি। নিচে যা তুই কুইক।”
“ সত্যি আপনি ঠিক আছেন তো?”
“ ঠিক আছি আমি। নিচে যা। ”
অরিত্রিকা সারহানের এমন অদ্ভুত ব্যবহার কারণ খুজে পেল না। নিচু স্বরে আচ্ছা বলে প্রস্থান করল রুম থেকে। সারহান পিছু ফিরে তাকায় না। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানার ওপর বসে। দুহাতে কৃষ্ণ বর্ণের চুলগুলো আঁকড়ে ধরে অশান্ত ভঙ্গিতে আওড়ায় ;
“ তোর থেকে দূরে থাকা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে ফাইরুজ। নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছি না। আই কান্ট কন্ট্রোল মাই সেল্ফ, মাই“ সিক্রেট অ্যামব্রোজিয়া। ”
:
দুপুর দুটো পেরিয়ে গেছে। বিয়ে উপলক্ষে যাদের ইনভাইট করা হয়েছিল তারা সকলে এসেছে। শুধু আসেনি অরিত্রিকার মামার বাড়ির লোকজন। হঠাৎ করে অরিত্রিকার মামাতো বোন অসুস্থ হওয়ায় আসতে পারেননি। অরিন এবং অরিত্রিকার বন্ধুমহল এসেছে। সকলে লিভিং রুমে বসে গল্প করছে। সকালের দিকে আবির ও ইনান এসেছে। তারা সাদাত এবং ইরফানের সাথে মেহমানদের আপ্যায়নে মনোযোগী। সারহান তাদের দুজনকে দায়িত্ব দিয়েছে। অরিত্রিকা ও ইশরা অরিনের দুপাশে বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বসে আছে। অরিনকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। পরনে লাল – খয়েরী রঙের শাড়ি, মাথায় আবৃত খয়েরী হিজাব, স্বর্ণের গহনা, হালকা সাজ সব মিলিয়ে নববধূ লাগছে।

আজমল সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়চারি করছেন । অনবরত কল করছে রাহাতের বাবাকে। বরপক্ষ দুপুর দুইটার মধ্যে আসার কথা থাকলেও এখনো আসেনি, ফোন তুলছে না। আরশাদ সাহেব বিজনেস পার্টনারকে অনবরত কল করছে কিন্তু ফোন ধরছে না। রাহাতের বড় বাবা যেহেতু তাদের কোম্পানির পার্টনারশিপে আছে সেইসুবাদে সহজেই খবর পাওয়ার কথা কিন্তু বরপক্ষের কেউ কল তুলছে না।
সারহান সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লক্ষ্য করে বাবা, চাচার চিন্তাগ্রস্ত বদন। পাঞ্জাবি হাতা গুটিয়ে নিয়ে শাণিত পায়ে এগিয়ে আসে তাদের দিকে। সরাসরি জিজ্ঞেস করে ;

“ কি হয়েছে? ”
আজমল সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন ;
“ রাহাতের বাড়ির কেউ ফোন রিসিভ করছে না। ”
সারহানের কপালের মাঝ বরাবর কয়েকটা ভাজ পড়ে কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে উঠে ;
“ হয়তো রওনা দিয়েছে। রাস্তায় আছে তাই কল রিসিভ করছে না। ”
“ আমার এমনটা মনে হচ্ছে না সারহান। ”
“ চাচা রাহাতের নাম্বারটা দিন। ”
আজমল সাহেব সারহানকে রাহাতের নাম্বার দিলেন। সারহান কল দেয় নাম্বারে। তিনবার কল দেওয়ার পর রিসিভ হয়। সারহান গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে ;
“ সারহান ইদায়াত চৌধুরী স্পিকিং। ”
ফোনের অপর পাশের মানুষটা হচকচিয়ে যায়। তুতলিয়ে বলে উঠল ;
“ আপনি? ”
“ কোথায় তুমি? ”
“ আমি আমি আমি….. ”
“ ম্যা ম্যা না করে বল কোথায় আছিস শুয়োরের বাচ্চা? ”
সারহান গর্জে উঠে চাপা স্বরে বলে উঠল। ক্রোধে কপালের রগ ফুটে উঠেছে। অপর পাশ হতে রাহাত কম্পনরত কন্ঠে উত্তর দেয় ;

“ আমি সুইজারল্যান্ড আছি। ”
“ সুইজারল্যান্ডে বসে বাংলাদেশী সিমে কথা বলছিস? ইউ ব্লাডি বাস্টার্ড। কোথায় আছিস তুই ঠিকানা বল দ্রুত। আদার ওয়াইজ আই ওয়ান্না কিল ইউ। ”
সারহান ক্রোধান্বিত কন্ঠে বলে উঠে। আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব এহেন আচরণে বিস্মিত হোন। তারা কৌতুহলবশত তাকায় সারহানের দিকে।
“ ব্লাডি বিচ, বিয়ে করবি না অথচ বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিস! আমার রাজত্বে এসে আমার সাথে বেইমানি করলি। তোর একটা ভুলের মাশুল তুই থেকে শুরু করে তোর পুরো পরিবার ভুগবে শুধু প্রহর গুনতে থাক আর তোকে একবার সামনে পাই নিজ হাতে জ্যান্ত পুঁতে দেবো শুয়ো*রের বাচ্চা। ”
সারহান রাগান্বিত ভঙ্গিতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল। চক্ষুদ্বয় ক্রোধে র*ক্তাভ বর্ণ ধারণ করেছে। ইচ্ছে করছে এখুনি রাহাতের কলিজা নিজ হাতে ছিন্ন করতে। সে কল কাটে। রাগে গমগম করতে থাকে। দীর্ঘ শ্বাস টেনে মেজাজ ঠান্ডা করার প্রয়াস চালায়।
আজমল সাহেব উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন ;

“ রাহাত কি বলল?”
সারহান ক্রোধান্বিত নিয়ন্ত্রণ করে ভরাট কন্ঠে বলল ;
“ কাপুরুষটা বিয়ে করবে না অরিনকে। ”
“ কী?”
আজমল সাহেব স্তব্ধ হয়ে গেলেন। দুকদম পিছিয়ে গেলেন। আরশাদ সাহেব এসে ভাইকে ধরলেন। গমগমে কন্ঠে বললেন ;
“ এসব কি বলছো? ”
“ বিয়ে করবে না তাই লুকিয়ে আছে। কাপুরুষ কোথাকার? ”
আজমল সাহেব থমকে গেছেন। মেয়ের বিয়ের দিন এমন কিছু শুনতে হবে তা কল্পনাতীত ছিল। তিনি মলিন মুখে তাকালেন লিভিং রুমের সোফায় বসা কনে সাজে অরিনের দিকে। পাশে এক চেয়ারে বসে আছেন কাজি সাহেব। বিয়ে হবে না ভাবতে বুকে অসহ্য যন্ত্রনা শুরু হলো। অতি কষ্টে বলে উঠলেন ;
“ আমার মেয়েটা এই খবর সহ্য করতে পারবে না আর মেহমানরা কী বলবে? ”
সারহান তুখোর বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। এমন বিগড়ে যাওয়া পরিস্থিতিতে কীভাবে শান্ত থাকতে হয় তা খুব ভালো করে জানে। সে কিছুক্ষণ মৌন রইল। অতঃপর দৃঢ় কন্ঠে বলল ;

“ আমার ওপর আপনার ভরসা আছে চাচা? ”
আজমল সাহেব থমকে যাওয়া মুখে তাকালেন সারহানের মুখপানে। নির্দ্বিধায় বললেন ;
“ তোকে নিজের থেকে বেশী ভরসা করি। ”
“ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি অরিনের বিয়ে আজকে এবং এই মুহুর্তে দেব। ”
“ কার সাথে?”
আজমল সাহেবের সন্দিহান স্বর। সারহান একপলক অরিনের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। পুনরায় বাবা – চাচার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল ;
“ আবিরের সাথে। ”
আজমল সাহেব আরেক দফা চমকে গেলেন। থমথমে গলায় সরাসরি জানালেন ;
“ রাজনীতিতে যুক্ত এমন ছেলের সাথে আমার মেয়েকে কখনো বিয়ে দেবো না। ”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২৯

“ তাহলে ইরফানের সাথে বিয়ে দিন। বাড়ির মেয়ে বাড়িতে থাকবে চোখের সামনে থাকবে সবারই ভালোলাগবে। ”
সারহান ফিচেল হেসে প্রতুত্তর করে। আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেবের মুখ নিগূঢ় অন্ধকারে ঢেকে যায়। দুজনে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন। আজমল সাহেব নিজের সিদ্ধান্তে অটল তিনি আবিরের সাথে কখনো বিয়ে দেবে না। রাজনীতি করা মানুষ পছন্দ হলেও মেয়ের জামাই হিসেবে পছন্দ নয়। দরকার হলে তার বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দিবে তাও আবিরের সাথে দিবে না।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩১