প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৩

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৩
আদ্রিতা নিশি

নিশীথের অতল আঁধারে ঢাকা চারদিক। অম্বরের বক্সে একফোঁটা চন্দ্রের আলো নেই। যেন কালো মেঘের গাঢ় চাদরে লুকিয়ে আছে সমস্ত অম্বর। বাতাসের মাঝে বইয়ে চলেছে অস্বস্তিকর শীতলতা।যা শরীরে কাটা দেয়ার মতো অনুভূতি সৃষ্টি করে। চারপাশ নিঃস্তব্ধ, তবে সেই নিস্তব্ধতার মাঝেই শোনা যায় কোথাও দূরে নিশাচরের গা শিউরে ওঠার ন্যায় ডেকে উঠছে। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফিসফিসে বাতাসের মৃদু শব্দ।রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্টগুলো যেন মৃতপ্রায়। হলুদ আলো অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশার অন্ধকারে। গভীর রাতে শহর যেন মানুষের কলরবের আবরণে মোড়ানো। দেয়ালের গায়ে ঝুলে থাকা পুরোনো পোস্টারগুলো বাতাসের ধাক্কায় কেঁপে উঠে যেন কোনো অদৃশ্য কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে কিছু বলতে চায়। দূরের কোথাও ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে টিক টিক শব্দ তুলছে, মনে করিয়ে দিচ্ছে রাত গভীর হতে চলেছে।

অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের গহব্বরে ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে মানব-মানবী।দুজনেই নীরব ভূমিকা পালন করছে অথচ চারপাশের শূন্যতা যেন তাদের নিস্তব্ধ কথোপকথনের প্রতিধ্বনি বয়ে আনছে। আকাশে চন্দ্র নেই, শুধু অসংখ্য তারা টিমটিম করে জ্বলছে, যেন সাক্ষী হয়ে আছে এই মুহূর্তের।ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটির চক্ষুদ্বয় গভীর এবং গাঢ় দৃষ্টি যেন রাতের সমুদ্রের মতো অতল। যেখানে না বলা অনেক প্রশ্নের পাহাড়, অনেক না বলা শব্দের আনাগোনা। তবুও সে নিশ্চুপ। বাতাসে ওড়ানো তার চুলের ফাঁকে স্নিগ্ধ চন্দ্রের আলো না থাকলেও দূরের কোনো ফিকে আলোর প্রতিবিম্ব এসে তার মুখের কঠোর রেখাগুলোকে আরও স্পষ্ট করে তুলছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নারীটি নৈঃশব্দ্যের আবরণে ঢাকা। তার ওড়না মৃদু বাতাসে উড়ছে সানন্দে। মানবী স্থিরচিত্তে তাকিয়ে রয়েছে মানবটির দিকে। লম্বা দম নিয়ে সে যেন কিছু বলতে চায় অথচ শব্দেরা ঠোঁটের কাছেই থমকে যায়।রাতের শীতল হাওয়ায় রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই দুই অবয়ব তারা কি একে অপরের কাছে এসেও দূরে? নাকি এই নীরবতা, এই অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের স্বাক্ষী হয়ে থাকা ছাদটাই তাদের গোপন গল্পের একমাত্র শ্রোতা? দূরের কোনো ঘড়ির কাঁটা ধীরে টিক টিক করে জানান দিচ্ছে সময়ের প্রবাহ, অথচ এই মুহূর্তে তাদের কাছে সময় যেন স্থির হয়ে আছে একটি সন্ধিক্ষণের মতো। যেখানে ভালোবাসা, দ্বন্দ্ব আর অনিশ্চয়তা একসঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
“ এমন ভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস?”

নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেসে এলো সারহানের শান্ত শীতল কন্ঠস্বর। অরিত্রিকার ভাবনার ছেদ ঘটে। সে একটু চমকায়। নিজেকে দ্রুত সামলে নেয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের গহব্বরে দাঁড়িয়ে দুজন মানব মানবী পুরনো অদৃশ্য দেওয়াল ভেঙে চলেছে। পূর্বে তা কখনো হয়নি। অরিত্রিকা দূরের অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রকৃতির দিকে তাকায়। শান্ত কন্ঠে বলে ;
“ কিছু না। ”
সারহান ও ব্যস্ত শহুরে দূরের রাস্তার দিকে তাকায়। অতঃপর দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠে ;
“ রুমে যা। ”
“ আপনি যাবেন না?”
“ নাহহ। ”
“ কেনো? ”
“ এমনি। ”
সারহানের এমন নির্লিপ্ত কন্ঠস্বর যেন অরিত্রিকার মনে গাঢ় প্রভাব ফেলল। মানুষটার আজ হলো কি? কেন এতো অশান্ত। কুণ্ঠিত ভাবে বলে ;

“ সারহান ভাই আপনার কি হয়েছে? এমন অদ্ভুত ব্যবহার কেন করছেন? ”
সারহান একটু নড়ে উঠল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিদ্বয় আরও তীক্ষ্ণ করল। প্রশ্ন উপেক্ষা করে অতি অস্বাভাবিক কন্ঠে বলল ;
“ ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য পরিবারের বিপক্ষে যেতে হয় এমন সময় আসলে কী করবি ফাইরুজ? ”
“ আমি তো কাউকে ভালোবাসিনি। তবে কেন পরিবারের বিপক্ষে যাব? ”
“ সত্যি ভালোবাসিস নি কাউকে? ”

সারহান অতি শান্ত কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে। অরিত্রিকা থমকায়। সত্যি কি কাউকে ভালোবাসেনি সে? কাউকে ভালো লাগেনি? লেগেছে তো সারহান ভাইকে তবে তা গোপনীয় থাক। এটা ভালোবাসা নাকি ভালোলাগা তা আগে অনুভব করা প্রয়োজন। কিন্তু সারহান ভাই তাকে কেন এমন প্রশ্ন করল?
“ ভালোবাসার মানুষকে পাওয়াকে পাওয়ার জন্য আমি কি করতাম জানিস? পরিবারের বিপক্ষে চলে যেতাম। তাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য যা কিছু করতে হয় করতাম। ইউ নো, আজ অব্দি শুধু মাত্র একজনের জন্য নিজের হাত র*ক্তে ডুবিয়েছি কিন্তু সেসব রয়ে গেছে সকলের অগোচরে। ”
সারহান অশান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠে। অরিত্রিকার মনে ভর করে নানা ভাবনা। সারহান ভাই তার জন্য বখাটেগুলোকে পিটিয়েছিল। বক্ষ কেঁপে উঠল যেন। আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করে ;

“ কার জন্য?”
সারহান স্মিথ হাসে ;
“ বুঝেও অবুঝ কেন হোস? ”
“ আমি মোটেও অবুঝ নই সারহান ভাই। ”
“ অবুঝ নস কিন্তু অবুঝ হওয়ার ভাণ করিস। ”
অরিত্রিকা মৌন রইল। কি বলবে ভেবে পেল না। তবে এতটুকু ঠাওড় করতে পারল সারহান ভাই কিছু নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। কিন্তু সেটা কি? সারহান ক্ষণকাল ভুলে সরাসরি প্রশ্ন করে ;
“ তোর হাতে মেহেদী দিয়ে আমার নাম কে লিখে দিয়েছে? ”
অরিত্রিকা এহেন কথায় ভড়কায়। মেহেদী দেওয়া হাত পেছনে লুকায়। আমতা আমতা করে বলে ;
“ আমার হাতে আপনার নাম লেখা নেই। ”
সারহান অরিত্রিকার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকায়। ভ্রুযুগল বাঁকিয়ে ভরাট কন্ঠে বলে ;

“ তাই। ”
“ হ্যা। ”
“ তাহলে হাত লুকিয়ে রেখেছিস কেন? ”
“ কই। ”
“ বাম হাত সামনে এগিয়ে দে। ”
“ উহু। ”
অরিত্রিকা মুখ বেজার করে বলল। সারহান বাঁকা হেসে বলে ;
“ স্পেশাল থেরাপির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? ”
অরিত্রিকা ভয় পেয়ে যায়। যন্ত্রমানবটা আবার সেদিনের মতো থেরাপি দিবে না তো? সে ঢোক গিলে। ভয়ার্ত ভঙ্গিতে দুই কদম পিছিয়ে দৌড়ে পালায়। সারহান তা দেখে ফিচেল হাসে। বক্ষে দুহাত গুঁজে হাসি বজায় রেখে কন্ঠে ক্রূরতা নিয়ে আওড়ায় ;
” আমার না হওয়া বিবিজান আপনি আমার কাছ থেকে পালাতে চাইছেন? পালান, যত দূর ইচ্ছে। কিন্তু মনে রাখবেন, আমি আপনাকে ফিরিয়ে আনবই নিজের করে, আগলে রাখব যত্ন করে। আপনি দূর থেকে আমাকে বড়ই অস্থির করে তুলছিলেন, তাই নিজস্ব কায়দায় আপনাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলাম। অথচ আপনি এতটাই বোকা যে, আমার পরিকল্পনার একটুকরো অংশও বুঝতে পারেননি। এমপির বিবিজান এতো বোকা হওয়া মানায় না। একটু বুদ্ধমতী হোন। ”

রাত এগারোটা বেজে দশ মিনিট। রাতের খাবার খেয়ে আবির অরিনের রুমে এসেছে। বিছানায় বসে ইনানকে মেসেজ করছে। আজ কল্লোল ফাউন্ডেশনের সকল তথ্য সারহানকে সেন্ট করার কথা রয়েছে। কিন্তু বিয়ের কারণে কারো সময় হয়ে ওঠেনি পরিদর্শক টিমের থেকে ডাটা কালেক্ট করার। ইনান মেসেজে জানিয়েছে এখনো পরিদর্শক টিম রিপোর্ট করেননি। আগামীকাল সন্ধ্যার সময় রিপোর্ট দেওয়ার কথা জানিয়েছে।

“ ঘুমাবেন না? ”
অরিন রুমে ঢুকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে আবিরকে। আবির ফোন স্কিনে নজর রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলে ;
“ ঘুমতে লেট হবে।তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। ”
অরিন এগিয়ে আসে আবিরের দিকে ফোন স্কিনের দিকে নজর দেয়। অতঃপর বলে ;
“ কাকে মেসেজ করছেন? ”
“ ইনানকে।”
“ ওহহ। ”
অরিন ছোট্ট প্রতুত্তর করে আবিরের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে বসে। স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে বলে ;
“ আমার একবার বলায় আপনি কেনো বিয়েতে রাজি হলেন? ”
আবির ফোনের স্কিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অরিনের মুখপানে তাকায়। ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্নাত্মক ভঙ্গিতে বলে ;
“ হঠাৎ এসব মাথায় কেন আসছে? ”

“ বলুন কেন বিয়েতে রাজি হলেন? অন্য কেউ হলে নিশ্চিত না করে দিতো।”
অরিনের কন্ঠে আকুলতা। আবির তা স্পষ্ট দেখতে পেল। দৃঢ় শান্ত কন্ঠে বলল ;
“ কারো কথা ফেলতে পারি নি তাই বিয়ে করেছি। এখন মনে হচ্ছে বিয়ে করে ভুল করিনি। এত্তো সুন্দর একটা পুতুলের মতো বউ পেয়েছি। ”
অরিন বিস্মিত হয়ে গেল। আবির কার কথা বলছে? তাহলে কী মানুষটা তাকে অন্য কারো কথায় বিয়ে করেছে? তার পুরো বিষয়টা গোলমেলে লাগছে। আবির অরিনের দিশেহারা ভাব বুঝতে পারে। স্বাভাবিক ভাবে বলে ;
“ তবে বিয়েটা আমি কারো মন রক্ষার্থে নয় নিজের মন থেকে করেছি। তবে সেই মানুষটির অবদান ছিল। তুমি যদি নিজ থেকে আমাকে বিয়ে করার কথা না বলতে তবুও তোমার বাবার কাছে নিজ ইচ্ছেতে প্রস্তাব রাখতাম। ”
অরিন এহেন কথায় অবাক হয়। বিস্মিত কন্ঠে বলে ;
“ কেনো প্রস্তাব দিতেন?”

“ তোমাকে আমি অনেক আগে থেকে চিনি। তুমি কেমন তা সম্পর্কে অধিকাংশ আমি অবগত। আমি জানি, তুমি ভালো মেয়ে। কিন্তু আবেগে ভুল করেছো এবং পস্তাচ্ছো। নিজ ভুল বুঝতে পেরেছো, মা বাবার কথা ভেবে বিয়ে করতে রাজি হয়েছো কিন্তু ভাগ্যে হয়তো রাহাত ছিল না আমি ছিলাম তাই আমাদের বিয়ে হয়েছে। তোমার আহাজারি, অশ্রুতে প্রথমবার আমার বক্ষ কেঁপে উঠেছিল। যা আগে কোনো মেয়ের করুণ অবস্থা দেখে হয়নি। পলিটিক্স করা মানুষ সহজে কোনো মেয়ের জন্য বিচলিত হয়না কিন্তু আমি হয়েছিলাম যেদিন তুমি ছাঁদে আমার সামনে কাঁদছিলে। ”

অরিন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল মানুষটার দিকে। আবির স্মিত হাসে ;
“ তোমার আমার বিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত নয় বরং পরিকল্পিত। ভাগ্য করে সারহানের মতো ভাই পেয়েছে বুঝলে। তুমি দ্বিতীয়বারের মতো ট্র্যাপে ফাঁসতে যাচ্ছিলে সারহান তোমায় বাঁচিয়ে দিয়েছে। রাহাত ছিল নয়ন তালুকদারের সিক্রেট এজেন্ডা। যে সারহানকে কাবু করতে তোমায় টার্গেট করেছিল। ”
আবির কিছুক্ষণ মৌন থেকে পুনরায় বলল ;
“ সারহানকে তোমার পাস্টের রিলেশন সম্পর্কে অবগত করেছিলাম। চিন্তা করো না তোমায় কিছু বলবে না কিন্তু তোমাকে যে চিট করেছে তাকে খুঁজে বের করবে এবং শাস্তি দেবে । এবার ঘুমাও তুমি। সারাদিনের এতো কাহিনীতে নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে গেছো। “
অরিন বিস্ময় ভরা মুখে তাকিয়ে আছে আবিরের দিকে। তার অগোচরে এতো কিছু হলো কিন্তু সে জানতেই পারল না? সারহান ভাই সব অবগত হয়েও চুপ ছিলেন? এটা যেন অবিশ্বাস্য লাগল। তারমানে সবকিছু প্লান অনুযায়ী হয়েছে অথচ সে ভাবল তার কথায় আবির বিয়ে করলো। রাজনীতিবিদ মানে কূটনীতিবিদ। এদের শিরায় উপশিরায় বুদ্ধি আর আর বুদ্ধি।

অরিত্রিকা দৌড়ে এসে নিজের রুম আটকে দিলো। ইশরা মাত্রই সিড়ি বেয়ে উপরের তলায় উঠেছিল অরিত্রিকার সাথে কিছু কথা বলার জন্য কিন্তু মেয়েটা তাকে দেখেও দরজা আটকে দিলো আশ্চর্য। এতো রাতে ছাদে একা কেন গিয়েছিল? এসব ভাবনায় বিভোর হয়ে সে অরিত্রিকা রুমের সামনে দাঁড়ায়। দরজা নক করবে এমন সময় কারো কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই থেমে গেল। ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকাল।
“ এতো রাতে না ঘুমিয়ে এখানে কী করছিস? ”
সাদাতের সন্দিহান স্বর। ইশরা স্বাভাবিক ভাবে বলে ;
“ অরিত্রিকার সাথে কিছু কথা ছিলো তাই এসেছিলাম। এতো রাতে কোথাও যাচ্ছিস? ”
ইশরা সাদাতের পরনে ব্লাক লেদার জেকেট এবং শার্ট, জুতা পড়ে কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করল। সাদাত এলোমেলো চুলগুলো একহাতে ঠেলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল ;

“ সারাদিন বাড়িতে থেকে শরীর কেমন যেন অসুস্থ লাগছে তাই বাইক রাইড করতে যাচ্ছি। ”
“ ওকে সাবধানে যাস। ”
ইশরা স্বাভাবিক ভাবে বলল। সাদাত মৃদু হেসে সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগল। ইশরা ডেকে বলল ;
“ শোন? ”
সাদাত থেমে যায়। ঘাড় বাঁকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। জিজ্ঞেস করে ;
“ বল। ”
“ আমিও যাব তোর সাথে। আমায় নিয়ে যাবি? ”
“ নিয়ে যেতে পারব না। ”
“ প্লিজ নিয়ে যা। বাড়িতে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছি। ”
ইশরা মুখ ভার করে বলল। সাদাত একমুহূর্ত দাঁড়াল না। গটগট করে সিড়ি বেয়ে নামতে লাগল। ইশরাকে উদ্দেশ্য করে বলল ;
“ পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে পার্কিং প্লেসে আসবি। ”
ইশরা লাফিয়ে উঠল অনাকাঙ্ক্ষিত উত্তর পেয়ে।
সিড়ি বেয়ে নেমে ছুটে গেল নিজের রুমের দিকে।

নগরীর বুক চিরে তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে বাইক। শহরের ব্যস্ততম রাস্তাগুলোয় ছড়িয়ে থাকা লাল-নীল আলো মুহূর্তে আছড়ে পড়ছে চলমান যানবাহনের ওপর, হর্নের কর্কশ শব্দে কেঁপে উঠছে বাতাস, অথচ সেই কোলাহলের মাঝেই গভীর নীরবতা বয়ে যাচ্ছে দুই মানব-মানবীর মাঝখানে।বাইকটির মানবের শরীর জুড়ে যেন দহন, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে এগিয়ে যেতে তাড়া করছে। হেলমেটের আড়ালে ঢাকা মুখের রেখাগুলো স্পষ্ট নয়। তবে তার দৃঢ় ভঙ্গিমায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে ভাবমূর্তি। রাতের বাতাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সে ছুটে চলেছে, যেন সময়ের পরোয়া নেই তার, গন্তব্যেরও নয়। মানবটির পেছনে বসে থাকা মানবীটি উড়ে যাওয়া চুল সামলানোরও সুযোগ পাচ্ছে না। দু’হাতে শক্ত করে আঁকড়ে আছে চালকের পোশাক এই ক্ষণস্থায়ী আশ্রয়টুকুই তার একমাত্র অবলম্বন। বাতাসের তীব্রতা তাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে, তবুও সে জানে, এই গতি থামবে না এখনই।সমস্ত নগরীর কোলাহলকে পেছনে ফেলে তারা ছুটে চলেছে অনন্ত অজানার দিকে।

সাদাত বাইক থামায় টি বাঁধের ভেতরে। মানুষের আনাগোনা এখনো দৃশ্যমান। ইশারা বাইক থামতেই নেমে দাঁড়াল একপাশে। সাদাত বাইক রাস্তার একপাশে রেখে নেমে দাঁড়ায়। হেলমেট খুলে বাইকের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে রাখে। দুজন এগিয়ে যায় টি বাঁধের মেইন পয়েন্টে। যেখান থেকে পদ্মা নদীসহ ভারতের বর্ডার দৃশ্যমান। ইশরা প্রফুল্ল মনে রাতের প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কোলাহল পূর্ণ স্থান দেখছে। সাদাত শাণিত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। শিমুলগাছের নিচে চারজন দাঁড়িয়ে কথা বলছে সাদাত সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। উচ্ছসিত ভঙ্গিতে বলে ওঠে ;

“ হোয়াটস আপ ডুড’স? ”
চারজন নিজেদের মধ্যে কথোপকথন বাদ দিয়ে পেছনে ফিরে তাকায়। তাদের মধ্যে দুজন ছেলে দুজন মেয়ে। তুহিন নামের ছেলেটি একগাল হেসে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল ;
“ এই তো ভালো। তোর আসতে এতো দেরী হলো কেনো? ”
সাদাত বলল ;
“ কাজিনের বিয়ে ছিলো। ”
“ তাই নাকি রোমিও সাহেব? ”
সুনয়না পিন্চ মেরে বলে উঠল। সাদাত মাথা চুলকে মৃদু হেসে বলল ;
“ হ্যা। ”
রাহিম খোঁচা দিয়ে বলল ;
“ তোদের রোমিওর বিশ্বাস নেই। হয়তো গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গিয়ে দেরী করে এসেছে। ”
“ আরেহ নাহ শ্লা। ”
তিহা নামের মেয়েটির দৃষ্টি পড়ল সাদাতের পেছনে লুকিয়ে থাকা অচেনা মেয়েটির দিকে। সে নজর ঘুরিয়ে হেসে বলল ;

“ তোর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি কে? তোর গার্লফ্রেন্ড?”
ইশরা লজ্জা পেল ভীষণ। সে নিজেকে যথাসম্ভব সাদাতের পেছনে নিজেকে আড়াল করার প্রয়াস চালালো। যদি জানতো সাদাত তার ফ্রেন্ড সার্কেলের সাথে দেখা করতে আসছে তাহলে আসতো না। ভেবেছিল হয়তো আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে চলে আসবে। উপস্থিত সকলের দৃষ্টি পড়ল সাদাতের পেছনে লুকিয়ে থাকা অচেনা মেয়েটির দিকে। সাদাত অপ্রস্তুত হলো। ঘাড় বাঁকিয়ে একপলক দেখল ইশরার লাজুক মুখ। অতঃপর গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলল ;
“মেয়েটি আমার কাজিন, গার্লফ্রেন্ড নয়। শ্লা তোরা যাকে আমার সাথে দেখবি তাকে গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে দিবি? ”
সকলে জিভ কাটল। বুঝতে পারল ভুলভাল বলে ফেলেছে। তিহা মেকি রাগ দেখিয়ে বলল ;

“ আগে বলবি তো? ”
সাদাত হতাশ হয়ে বলল ;
“ বলতে দিলি কই? ”
“ আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দে।”
“ ওকে। ”
সাদাত ইশারা হাত ধরে সকলের সামনে আনে। সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে ;
“ আমার কাজিনের নাম ইশরা শেখ। ”
সকলে একযোগে বলে উঠল ;
“ হাই ইশরা। ”
ইশরা হাসার ভাণ করে। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কোনোমতে বলে ;
“ আসসালামু আলাইকুম। ”
উপস্থিত সকলে একটু অবাক হয় নম্রতা দেখে। পরক্ষণে নিজেদের সামলে নেয়। সুনয়না ইশরার হাত চেপে হেসে বলল ;

“ চলো ফুচকা খাই। ”
ইশরা তড়িঘড়ি করে বলল ;
“ নাহহ আপু আমি কিছু খাবো না। ”
“ আরে লজ্জা পেয়ো না। চলো আমরা তিনজনে ফুচকা খাই আর ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখুক। ”
তিহা চঞ্চল ভঙ্গিমায় বলে উঠল। ইশরা মুখ ভার সরাসরি তাকাল সাদাতের দিকে। সাদাত চক্ষুদ্বারা ইশারা করল ওদের সাথে যাওয়ার জন্য। ইশরা ক্ষীণ কন্ঠে বলল ;
“ চলো আপু। ”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩২

তিনজন ফুচকা খেতে চলে গেল। সাদাত সেদিকে তাকিয়ে রইল। রাহিম ক্যাবলা মার্কা হেসে বলল ;
“ ভাই তোর কাজিনের নাম্বারটা দেওয়া যাবে? ”
সাদাত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয় ;
“ ওর দিকে তাকালে চোখ তুলে নেব। সো, বি কেয়ারফুল ডুড। ”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৪