প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৬

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৬
আদ্রিতা নিশি

রাজশাহী শহরের মেইন পয়েন্ট সংলগ্ন দুইশত নম্বর ফ্ল্যাটের চতুর্থ তলার দরজা খুলেই নির্বাক ভঙ্গিতে দাঁড়াল সারহান। মুহূর্তখানেক নিঃশব্দে ভেতরের চারপাশ পরখ করল সরু দৃষ্টিতে। তারপর ধীরপায়ে প্রবেশ করল ভেতরে। তার পিছু পিছু ঢুকল আবির ও কয়েকজন দেহরক্ষী।ফ্ল্যাটের ভেতরের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন এবং পরিপাটি।তবু কোথাও যেন একরকম শূন্যতা বিরাজ করছে। আসবাব বলতে হাতে গোনা কয়েকটি বস্তু।এই ফ্ল্যাটটি আরশাদ সাহেব লিখে দিয়েছেন তানিয়া বেগমের নামে। অথচ প্রথমে পরিকল্পনা ছিল সম্পত্তির একটি অংশ সারহান ও সাদাতের নামেও যাবে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি।সারহান গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে নির্বাক চোখে চারপাশ ঘুরে দেখল। দেহরক্ষীরা সারহানের থেকে অনুমতি নিয়ে ছুটলো একটা রুমের দিকে।
“ সারহান জানো*য়ারটা বেঁচে আছে তো?”
আবিরের শঙ্কিত কৌতুহলী কন্ঠস্বর। সারহান ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় আবিরের দিকে। ভ্রুযুগল উঁচিয়ে ভরাট কন্ঠে বলল ;

“ আমি কাউকে এতো সহজে মৃ’ত্যু দেইনা। ”
আবির হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। তবুও কোনো বিষয় নিয়ে বেশ চিন্তিত দেখাল। সারহান তা পরখ করল। অতঃপর বলল ;
“ ভেতরে গিয়ে নিজ চোখে দেখে আয়। ”
আবির ভড়কে গেল। সংকুচিত নয়নে তাকাল সারহানের দিকে। সারহান ইশারা করল যাওয়ার জন্য। আবির আদেশ উপেক্ষা করল না। মাথা দুলিয়ে রুমের দিকে পা বাড়াল দ্রুত। আবির সেখান থেকে প্রস্থান করতেই সারহান কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল জানালার সামনে। হাত দ্বারা খুলে দিলো জানালার গ্লাস। বিকেলের মিষ্টি রোদ সুযোগ বুঝে ফ্ল্যাটে ঢুকল। স্নিগ্ধ প্রকৃতির মৃদু বাতাস ছুঁয়ে গেল পুরুষালী দেহ। সারহান এক দৃষ্টে তাকিয়ে রয় ব্যস্ত নগরীর দিকে। মন কিছুটা অশান্ত, বিচলিত। কিছুক্ষণ আগে খবর পেয়েছে বাড়ির গোপন বৈঠকের মূল উদ্দেশ্যের। হয়তো এই শঙ্কা আগে থেকে আচ করতে পেরেছিল প্রেমিক সত্তা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাই গতরাতে তার একান্ত নিভৃতসুধাকে এক পলক দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সারহানের নিজেকে নিয়ে কোনো পরোয়া করেনা। কিন্তু অরিত্রিকার জন্য ভীষণ চিন্তিত। মেয়েটা যখন জানবে পরিবারের সিদ্ধান্ত তখন মেয়েলী মনে সদ্য জন্ম নেওয়া অনুভূতি ঝড়ো হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাবে। প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে এসে প্রণয়ের সমাপ্তি ঘটবে। সারহান তো চায়নি তার প্রণয়িনী প্রণয়ের বিরহে পুড়ে ছারখার হয়ে যাক! সে চেয়েছিল নিজের অব্যক্ত অনুভূতির প্রকাশ করে অরিত্রিকার মনে নিজের জন্য ফুল স্বরুপ প্রণয় বৃক্ষ রোপন করতে, ভালোবাসার পুষ্প ফোটাতে। তবে সে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সময় যেন বেইমানী করল। বেইমানী করল নাকি প্রতিশোধ নিচ্ছে এক প্রেমিক পুরুষকে দহনে পোড়ানোর? সারহান তপ্ত শ্বাস ফেলে। সে চায় না অরিত্রিকা তার মতো দহনে পুড়ে অঙ্গার হোক। মেয়েটা যেন তার ন্যায় কষ্ট না পাক। এই নশ্বর দুনিয়ায় যে যা মন থেকে চায় তা সহজে পায় না। হয়তো সামনে এমন কিছু অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।
সারহান পাঞ্জাবির পকেট হতে ফোন বের করে। তীক্ষ্ণ নজরে ফোন স্কিনে কাঙ্খিত নাম্বার খুজতে থাকে। অবশেষে আঙুল বুলিয়ে নাম্বার খুঁজে বের করে। ফোন স্কিনে ইংরেজি অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে নামটি ;“ MY SECRET AMBROSIA. ”

তার ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসির সঞ্চার হয়। হঠাৎ স্মৃতির পাতায় ধরা দেয় সুন্দর মুহুর্ত। প্রথম যেদিন কৌতুহলবশত মেয়েটা কে হতে পারে জানার জন্য নিজ থেকে কল করেছিল। কিন্তু প্রথমে সে ভয়েজটা চিনতে পারেনি। হয়তো মেয়েটা কোনো কারসাজি করে ভয়েজ চেঞ্জ করেছিল। নাম্বারও নতুন হওয়ায় তার ফোনেও সেভ করা ছিলো না। তাই চিনতে একটু অসুবিধা হয়েছে।তবে পরক্ষণে কাজের চাপে ভুলে বসেছিল। কিন্তু মস্তিষ্ক জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল কৌতুহল, আগ্রহ। সেই অচেনা স্বরের রমনীকে কেন যেন খুব পরিচিত মনে হচ্ছিল। অরিত্রিকা যেদিন গভীররাতে কল করে ডিস্টার্ব করেছিল সেদিন সারহান শিউর ছিলো পরিচিত কেউ তাকে ইচ্ছাকৃত তাকে জ্বালাতন করছে। বিরক্তি নিয়ে নাম্বার ট্রেস করার জন্য আবিরকে বলতে চেয়েছিল। কিন্তু তার প্রয়োজন হয়নি। চতুর, তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠেছিল। অচেনা নাম্বারটি বেয়াদব মেয়ে দিয়ে সেভ করে হোয়াটসঅ্যাপে নাম্বারটি সার্চ করেছিল। ব্যাস! এতটুকু নিজের অনিচ্ছা সত্বেও করেছিল।

কিন্তু কে জানতো হোয়াটসঅ্যাপের ডিপি দেখে থমকে যাবে? লাল টুকটুকে শাড়ি পরিহিত হাস্যজ্জ্বল পরিচিত মেয়ের ছবি দেখে বিস্মিত হবে? নিভৃতসুধা নামক মানুষটা জ্বালাতন করছিলো অথচ সে বুঝতে পারেনি । সারহানের হাসি প্রশস্ত হয়। ফাইরুজ যে আসলেও বোকা তা প্রতিটি পদক্ষেপে প্রমাণিত হয়।
সারহান গভীর শ্বাস টানল জোরে।বক্ষ মাঝারে জমে থাকা ভারী অনুভূতিগুলো নিজ ভঙ্গিমাশ সামলে নিতে চাইল। ভাবল, ব্যস্ততার শত আড়ালেও এক মুহূর্তের জন্যও অরিত্রিকাকে মন থেকে সরিয়ে রাখতে পারছে না। অথচ দুই বছর! ঠিক দুই বছর সে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল মেয়েটির কাছ থেকে। দূরে থেকেছে, সম্পর্কের সব অনুজ্জ্বল স্মৃতি মুছে ফেলার বৃথা চেষ্টা করেছে। নিজের অনুভূতির থেকে পলায়ন করেছে।

কিন্তু তবুও, ফেলে আসা সময় কি সত্যিই শেকল কেটে মুক্তি দেয়?দুই বছর পর প্রথমবারের মতো তাদের দেখা হয়েছিল ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়ায়। তবে সেদিনও সারহান তার কঠিন আবরণ ভেদ করে প্রেমিক সত্তার প্রকাশ হতে দেয়নি। নিজের অনুভূতিকে শাসন করেছিল, চোখে যেন অদৃশ্য দেয়াল তুলে রেখেছিল। কিন্তু সেই দেয়াল কি সত্যিই স্থায়ী?অবচেতনেই আঙুল চলে গেল ফোনের স্ক্রিনে। দৃষ্টি স্থির করে নম্বরটি খুঁজে বের করল। এক মুহূর্ত দ্বিধাদ্বন্দের দেয়ালে যেন আটকে পড়ল। তারপর কিছু একটা ভেবে ডায়াল করল। রিং বাজল, বাজতেই থাকল। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে কোনো সাড়া এলো না।দুইবার কল করার পরও যখন অরিত্রিকা রিসিভ করল না। তখন যেন অজানা অস্থিরতা স্নায়ুর গা বেয়ে নেমে এলো। সারহান আবারও কল দিল। আঙুলের ডগা এবার একটু বেশি দৃঢ়, মনে যেন প্রচ্ছন্ন আশা নাকি অধিকারবোধ?

“ এমপি সাহেব? ”
মিনিট একেক পর কল রিসিভ করল অরিত্রিকা। ফোনের ওপর পাশ হতে ভেসে এলো মেয়েলী দ্বিধায় জড়ানো ক্ষীণ কন্ঠস্বর। সারহানে অস্থিরতা কমে এলো। অস্বাভাবিক মুখে স্বাভাবিক হয়ে এলো। নিঃশব্দে হাসল সে। অতঃপর স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে বলল ;
“ কেমন আছেন আমার না হওয়া বিবিজান। ”
মেয়েটি বোধ হয় একটু অপ্রস্তুত হলো। কোনো মতো বলল ;
“ ভা..লো। আপনি কেমন আছেন? ”
“ আমিও ভালো আছি। কি করছেন এখন? ”
“ বসে আছি। আপনি কি করছেন? ”
“ আপনাকে মিস করছি। ”
সারহান অতি শান্ত স্বাভাবিক কন্ঠে বলল। অরিত্রিকা হচকচিয়ে গেল। বুক ধরফর করে উঠল তার। অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দগুচ্ছ প্রতিধ্বনিত হলো বারংবার। ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল। সারহান ফোন স্পষ্ট শুনতে পেল অনবরত শ্বাস নেওয়ার আওয়াজ। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল ;

“ আপনি ঠিক আছেন আমার না হওয়া বিবিজান? ”
অরিত্রিকা নিজেকে সামলে নেয়। স্বাভাবিক ভাবে বলে ;
“ আপনি আমার নাম, পরিচয় জানেন না অথচ বিবিজান বলে ডাকছেন? ”
“ আপনার নাম, পরিচয় জেনে কি করব? ”
“ একটা অচেনা মেয়েকে কল দিচ্ছেন, বিবিজান বলছেন কিন্তু পরিচয় জানার প্রয়োজন মনে করছেন না? ওহহ বুঝেছি টাইম পাস করছেন? ”
“ বিগত কয়েকদিনে কল করেছি?”
“ নাহ।”
“ তাহলে টাইমপাস করছি এটা বলার রাইট নেই আপনার। ”
অরিত্রিকা থতমত খেল। তবুও দমলো না। তার ভীষণ রাগ হচ্ছে বাড়িতে তাকে পটিয়েছে আবার বাহিরে বিবিজানকে পটানোর চেষ্টা করছে। লেডি কিলার রোমিও কোথাকার! রাজনীতিবিদরা দুমুখো কেন হয়? এসব ভেবে মন খারাপ হলো। তবুও মিনমিন করে বলল ;
“ এতোদিন পর কেনো কল করেছেন? ”
সারহান অরিত্রিকার মনোভাব বুঝল। তার ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসির সঞ্চার হলো। স্বভাবসুলভ গম্ভীরতার ভাণ করে বলল ;

“ বললাম তো মিস করছিলাম।”
অরিত্রিকা স্তব্ধ হয়ে গেল। একটা অচেনা মেয়েকে অবলীলায় কীভাবে বলে মিস করছিলাম? রাগে, দুঃখে কান্না পেল। নিজের ডাবল রুপে হিংসা হলো। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে কম্পনরত কন্ঠে বলল;
“ ভালোবাসেন আমাকে? ”
“ ভালোবাসি না কিন্তু মিস করি। ”
“ হেঁয়ালি করছেন? ”
“ হেঁয়ালি করার সময় নেই আমার। ”
“ আপনি আসলেই একটা যন্ত্রমানব। ”
অরিত্রিকা তিরিক্ষি মেজাজে গমগমে কন্ঠে বলল। সারহান বাঁকা হাসল। অরিত্রিকা যে জেলাস তা বুঝতে সময় লাগল না। হাসি বজায় রেখে গলা খাদে নামিয়ে বলল ;
“ আপনার ভালোবাসার অভাবে যন্ত্রমানব হয়ে যাচ্ছি মাই উডবি ওয়াইফি। ”
অরিত্রিকার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। এই মানুষটা তার সাথে ফ্লার্ট করছে? চাপা স্বরে বলল ;
“এমপি হয়ে দেশের মহিলা নাগরিকের সাথে ফ্লার্ট করছেন? পরবর্তী নির্বাচনে এর শোধ তুলবো। আপনাকে ভোট দিবো না।”

“ ওহহ রিয়েলি। ”
“হ্যা।”
“ আপনার কষ্ট করে ভোট দেওয়ার দরকার নেই। নিজেদের ঘরে রাজনীতি নিয়ে টানাটানি না করা ভালো। এতে সম্পর্ক খারাপ হয়। ”
“ মানে। ”
“ সময় হলে জেনে যাবেন।”
“ এখন বলুন। ”
“ আপনার নাম কী মাই উডবি ওয়াইফি? ”
সারহান ব্যস্ত নগরীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন উপেক্ষা করে স্বাভাবিক ভাবে জানতে চাইল। অকস্মাৎ এহেন প্রশ্নে চমকে উঠল অরিত্রিকা। কি বলবে কি করবে বুঝতে পারছেনা। চিন্তিত ভঙ্গিতে ভাবতে লাগল। আসল নাম বলা যাবে না। বেশ কিছুক্ষণ মৌন থাকার পর নিজেকে ধাতস্থ করে বলল ;
“ আপনাকে কেনো বলবো? ”
সারহান পুরূ কন্ঠে বলল ;

“ ত্যাড়ামো না করে দ্রুত নাম বলুন আমার না হওয়া বিবিজান। নয়তো আপনার বাসায় গিয়ে আপনার সহ পুরো চৌদ্দ গোষ্ঠীর নামের লিষ্ট করে নিয়ে আসবো। ”
“ আমার নাম হৃদিস্মিতা চৌধুরী। ”
“ নাইস নেইম। হৃদিস্মিতা নামের অর্থ কি বলুন? ”
“ জানি না। আপনি এমপি হয়ে টিচারদের মতো বিহেভ কেনো করছেন? ”
অরিত্রিকা নাক মুখ কুঁচকে বিরক্তিরসহিত বলল। সারহান নিঃশব্দে হাসল;
“ যা জানতে চেয়েছি উত্তর দিন। ”
“ আমি জানি না। কল কেটে দিলাম। আপনার সাথে এমপি টিচাররুপী মানুষের সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই। ”
“ কল কাটলে আপনার খবর আছে। ”
সারহান ঠান্ডা স্বরে হুমকি দিল। অরিত্রিকার নিজের ওপর রাগ উঠছে। কেন যে ওমন কঠিন নাম বানিয়ে বলল? এখন নিজের চালে নিজেই ফেঁসে গেছে। বিরক্তিভাব আড়াল মুখ ভার করে বলল ;
“ আপনি জানলে বলুন। ”
সারহান ভরাট কন্ঠে প্রতুত্তর করল ;

“ হৃদিস্মিতার অর্থ হলো হৃদয়ের হাসি। ইংরেজিতে বলা হয় “ Smiling heart ”।
“ ওহহ আচ্ছা। আমি আপনার নামের অর্থ জানি। ”
“ বলুন। ”
“ সারহান এর মূল অর্থ বন্য শিকারী। আরেকটা অর্থ আছে।সেটি হলো শান্ত ও নির্জন। ”
সারহান বিস্মিত হয়। মেয়েটা তার নাম নিয়ে রিসার্চ করে ফেলেছে? কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল ;
“ আপনি আমার নাম নিয়ে রিসার্চ শুরু করে দিয়েছেন? ”
অরিত্রিকা একটু শিউরে উঠল। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইল। অতঃপর মুখ বাঁকিয়ে উত্তর দেয় ;
“ আমার কাজ নেই আপনার নাম নিয়ে রিসার্চ করবো। তবে একটা জিনিস খেয়াল করলাম আপনার নামের অর্থের সাথে আপনার মিল আছে। একদম বন্য শিকারীর ন্যায় আপনি। ”
“ একদম সঠিক বলেছেন। আপনি ব্যতিত সকলের কাছে আমি নামক মানুষটা বন্য শিকারী। শুধু আপনার কাছে আমি শান্ত ও নির্জন হয়ে থাকতে চাই। এর কারণ নিশ্চয়ই জানেন? ”

“ উহু। ”
“ মাই উডবি ওয়াইফি, একটু ভালোবাসার নজরে দেখুন আমায়। নিজের বক্ষপিঞ্জরে বন্দি ভালোবাসার অনুভূতি অনুভব করুন। তাহলে আমার উক্ত কথার মর্মার্থ বুঝতে সক্ষম হবেন। ”
অরিত্রিকা যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। শরীর স্থির হয়ে গেল যেন বুকের ভেতর ঝড় বইছে।সারহান ভাই কি তবে তার লুকানো অনুভূতি বুঝে ফেলেছেন? তবে কি “না হওয়া বিবিজান” নামক সেই মিথ্যা পরিচয়ের আড়ালে থাকা মানুষটাকেই ভালোবেসে ফেলেছেন তিনি?সবকিছু কেমন ধোঁয়াশা লাগছে। কথার আড়ালে যেন অসংখ্য ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে।অথচ একটিও স্পষ্ট নয়!সারহানের কণ্ঠে যে অনুভূতি তাতে মনে হচ্ছে তিনি তার ফাইরুজকেই বলছেন কথাগুলো। কিন্তু কেন? আর কেনই বা ‘আপনি’ সম্বোধন? এটি কি শুধুই অভ্যেস, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে রাখা ধোঁয়াশার পর্দা?অরিত্রিকার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। প্রশ্নগুলো যেন একসঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে তাকে।তবে কী শ্যামমানব সারহান ভাই সত্যিই তার আসল পরিচয় জেনে গেছেন? নাকি অন্য কিছু?
“আপনি আমায় গোলকধাঁধায় ফেলতে এসেছিলেন। কিন্তু এখন নিজেই আমি নামক প্রহেলিকায় হারিয়ে যাচ্ছেন। আপনার অস্তিত্ব ধীরে ধীরে আমার মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে অথচ আপনি সেটা উপলব্ধি করতে অক্ষম।”
সারহান শান্ত দৃঢ় কন্ঠে বলল। ওষ্ঠকোণে বাঁকা হাসি বিরাজ করছে। মেয়েটা নিজেকে অনেক বুদ্ধিমতী ভাবে তা নাহলে নিজের আসল নাম লুকিয়ে অন্য নাম বলে? ফোনের ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। হয়তো স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। সারহান পুনরায় বলল ;

“ একজন রাজনীতিবিদের বিবিজান এতো বোকা কেন? এখনো সময় আছে চালাক এবং বুদ্ধিমতী হোন। ”
অরিত্রিকা অস্ফুটস্বরে বলল;
“ হু?”
“ সারহান! ”
পরিচিত এক মেয়েলি কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই সারহান ভ্রু কুঁচকে পেছনে ফিরে তাকাল। দরজার কাছে মুন ও হিমি দাঁড়িয়ে আছে। সে নিঃশব্দে হাত তুলে ইশারা করল ভেতরে আসার জন্য। মুন ও হিমি ধীরপায়ে রুমের ভেতরে প্রবেশ করল।ওদিকে, ফোনের ওপারে শুয়ে থাকা অরিত্রিকার কানে ভেসে এলো সেই মেয়েলি কণ্ঠস্বর। মুহূর্তেই বিস্ময়ে তার চোখ বড় হয়ে গেল। কী! উনার সাথে কোনো মেয়ে? কিন্তু এ কেমন করে সম্ভব! তার জানা মতে, সারহান মেয়েদের সাথে তো কথাই বলে না, সেখানে তাদের সান্নিধ্যে থাকা তো দূরের কথা! তাহলে মেয়েটি কে?কৌতূহল দমন করতে না পেরে সে দুরুদুরু বুকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল;

“এমপি সাহেব, মেয়েটি কে?”
সারহান ঠোঁট চেপে চাপা স্বরে বলল,
“আল্লাহ হাফেজ।”
তারপর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে কল কেটে ফোনটি পকেটে রেখে দিল। অরিত্রিকা স্তব্ধ হয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক হয়ে আছে।তার কন্ঠনালী হতে কোনো শব্দ বের হলো না। এক ধরনের শূন্যতা যেন বুকের ভেতর জমাট বাঁধছে।সে ধীরে ধীরে হাত থেকে ফোনটা পাশে নামিয়ে রাখল। চোখেমুখে অদ্ভুত বিরক্তি, অভিমান আর অপূর্ণ কৌতূহলের মিশেল। কথাটা কি ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেল সারহান ভাই? নাকি তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনই মনে করল না?চুপচাপ বসে রইল অরিত্রিকা। মন বলছে, কিছু একটা ঠিক নেই। কিন্তু কী সেটা বোঝার উপায় নেই! অজানা আতংকে বক্ষ ভার হয়ে এলো তার।

“ তুই এখানে কী করছিস? ”
সারহান মুনের সামনে দাঁড়িয়ে ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করল। মুন একটু নড়ে উঠল। অতঃপর স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“ তোর সাথে জরুরী কথা বলার ছিলো সারহান। ”
সারহান মুনের পেছনে লুকিয়ে থাকা হিমিকে খেয়াল করল। ছোট্ট মেয়েটা বোধ হয় তার কথায় ভয় পেয়েছে। সে পুনরায় মুনের দিকে তাকাল। শান্ত কন্ঠে বলল ;
“ সেকেন্ড ফ্লোরে গিয়ে বস আমি আসছি। ”
“ তুই হঠাৎ এখানে কেনো এসেছিস? ”
“ ইম্পর্ট্যান্ট কাজে এসেছি। হিমিকে নিয়ে নিচে যা। ”
“ ঠিক আছে। ”

মুন ধীরপদে হিমিকে কোলে তুলে নেয়। এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।
সারহান এক দণ্ড সেখানে দাঁড়ায় না। দ্রুত পাশের একটি কক্ষের দিকে পা বাড়ায়। রুমের ভেতরে নির্জন এক কোণে নিঃশব্দে বসে আছে রাহাত। মাথা নিচু, শরীর নিস্তেজ এবং ভঙ্গিটা আশ্চর্যরকম নিষ্পাপ! গালের একপাশে লালচে দাগ, থাপ্প*ড়ের চিহ্ন স্পষ্ট। চোখেমুখে ভয়ের ছাপ, আর দু’হাত শক্ত করে বাঁধা দড়িতে। তার পরনের পাঞ্জাবি বিধ্বস্ত কুঁচকে গেছে, ধুলো মেখে জীর্ণ দেখাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, আকদ করতে যাওয়ার পথেই কেউ তাকে অপহরণ করেছে। আর এখন এখানে বন্দী!রুমে আবিরসহ আরও দু’জন দাঁড়িয়ে। আবির চুপচাপ তাকিয়ে আছে রাহাতের দিকে, চোখে বিস্ময়ের ছাপ। যেন ভাবছে, ‘আহারে! বেচারার কী দুর্ভাগ্য! বিয়ের দিনই হবু শালার হাতে কিডন্যাপ
“ ইয়ে মানে রাহাত তোর হবু বউকে গতকাল বিয়ে করেছি। আমাদের জন্য দোয়া করিস। ”
আবির হাসার ভাণ করে গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলল। রাহাত তৎক্ষনাৎ অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকাল আবিরের দিকে। এসব কি শুনছে সে অরিনকে আবির বিয়ে করছে? বন্ধুকে বোনের বর বানানোর জন্য সারহান তাকে এখানে আঁটকে রেখে গতকাল মিথ্যা কথা বলিয়েছে।সে রেগে গেলো। রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল ;

“ কি বললি তুই? ”
“ যা শুনেছিস তাই বলেছি। ”
“ তোর সাহস কি করে হলো অরিনকে বিয়ে করার। ”
“ আমার ইচ্ছা হয়েছে বিয়ে করেছি। শুনেছিস, এবার চুপ থাক।”
রাহাত রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলল;
“আমি একবার এখান থেকে মুক্ত হই তারপর তোদের দুজনকে দেখে নেবো। আমার বউকে তুই বিয়ে করেছিস এর শোধ আমি তুলব। ”
আবির ভয় পাওয়ার ভাণ করে বলল ;
“ পুলিশে দিবি? প্লিজ রাহাত পুলিশে দিস না। পুলিশকে টাকা খাইয়ে জেল থেকে বের হওয়ার মতো টাকা নেই। ”
“ একদম নাটক করবি না। ”
“ আরে আরে নাটক কখন করলাম? ”

“ তোদের দুজনকে অপহ*রণের মামলা দিবো। তোদের জন্য আমার বিয়ে হয়নি। ”
“ আরে শ্লা! বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিস দেখছি। ”
“ তুই আমার সুন্দরী বউ বিয়ে করে নিয়েছিস। তোকে আমি ছাড়বো না। ”
আবির ভ্রুযুগল কুঁচকে দাঁতে দাঁত চেপে বলল ;
“ বিয়ের উত্তেজনা কি মাথায় উঠে গেছে? তোর বা* মার্কা মুখে আমার বউকে নিয়ে কথা শুনতে চাই না আর একটা কথা বললে মুখ সেলাই করে দেবো। ”
রাহাত রাগে ফুঁসে উঠল ;
“ তুই আমার হবু বউকে বিয়ে করে আবার চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছিস?”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৫

“ তোর হবু বউ গতকাল বিকাল অব্দি ছিলো এখন সে আমার ওয়াইফ। তাই বারবার হবু বউ বলা বন্ধ কর। ”
রাহাতের দৃষ্টিতে তীব্র আগুন। ক্ষোভে দীপ্ত চোখজোড়া নিবদ্ধ আবিরের দিকে যেন মুহূর্তেই বিদ্ধ করবে তাকে। অথচ আবির নির্বিকার। তার ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসির রেখা। রাহাতের ক্রোধ যেন তাকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারছে না। বরং সে উপভোগ করছে এই ক্ষিপ্র আগুনের দহন।ধীর পদক্ষেপে আবির রুমের দরজার দিকে চোখ ফেরাল। ঠিক তখনই সেখানে ভেসে উঠল পরিচিত এক অবয়ব সারহান! মুহূর্তেই আবিরের ঠোঁটের হাসি গভীর হলো যেন এই উপস্থিতির প্রতীক্ষাতেই ছিল সে। সারহানকে দেখে রাহাতের মুখ আরও কঠিন হয়ে উঠল।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৭