প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৯
আদ্রিতা নিশি
অরিত্রিকা গুটিশুটি মেরে বসে রয় মেঝেতে। কান্নার তীব্রতা কিছুটা কমে এসেছে। ভেজা নেত্রপল্লবে অপলক চেয়ে রয়েছে তন্দ্রাঘোরে আচ্ছন্ন সারহানের মুখপানে। কতো প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে আছে মানুষটা। কাঠখোট্টা, বদমেজাজি মানুষকেও বুঝি ঘুমন্ত অবস্থায় নিস্পাপ লাগে? সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করতে থাকে সারহানকে।
মানুষটার মুখাবয়বের প্রতিটি রেখায় যেন গাম্ভীর্যের ছোঁয়া লেপ্টে আছে । কৃষ্ণাভ ত্বকের গভীর মসৃণতায় দেখতে অতি মাত্রায় সুদর্শন ও স্নিগ্ধ লাগছে। সুঠাম শরীরের প্রতিটি পেশিতে কঠোর পরিশ্রমের ছাপ স্পষ্ট লক্ষণীয়। অথচ তা শ্যামমানবকে রূঢ় নয় বরং প্রবল আকর্ষণীয় করে তুলেছে।কৃষ্ণকেশের গভীর অরণ্যে ডুবে থাকা তার মুখের কাঠামো স্পষ্ট ও শক্তপোক্ত চওড়া কপাল, সুগঠিত চোয়াল আর গভীর কালো চোখ দু’টি সম্মোহিত করার ক্ষমতা রাখে। তবে চক্ষুদ্বয় যা শব্দহীন তীব্র ভাষায় কথা বলে। কিন্তু সেই তীক্ষ্ণ চক্ষুদ্বয় তন্দ্রাঘোরে আচ্ছন্ন। গাল জুড়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ির সমাহার। দৃষ্টি আঁটকে যায় সেথায়। ইচ্ছে নিজ হাতে কল্প পুরুষের গাল ছুঁয়ে দিতে।
মসৃণ হাতে সযতনে হাত বুলিয়ে দিতে। আপাতত সে ভাবনা সমাপ্ত করল।নাসিক্যরন্ধ্র ছুঁয়ে যাচ্ছে পরিচিত সুগন্ধির তীব্র গন্ধ। নামীদামী ব্রান্ডের পারফিউম বলে কথা। অরিত্রিকা স্মিত হেসে দীর্ঘ শ্বাস টানে। মেয়েলী মনসত্তা বেসামাল হয়। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায় শীতল শিহরণ। অরিত্রিকা শুকনো ঢোক গিলে। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে অন্যত্র তাকায়। মনে মনে নিজেকে বকা দেয়। বেহায়ার মতো ঘুমন্ত পুরুষকে গিলে খাওয়ার অনুভূতি হয়। ছিহহ অরিত্রিকা তুই কবে থেকে এতো নির্লজ্জ হলি? মানুষটা যদি দেখত তুই হা করে তার দিকে তাকিয়ে অসভ্য চিন্তা ভাবনায় মত্ত হয়েছিস তাহলে আর রক্ষে থাকত না। নিশ্চিত লজ্জায় নেতিয়ে পড়ত নয়তো দৌড়ে গিয়ে কোথাও মুখ লুকাতো। কিন্তু তার কোনো দোষ নেই। সে সম্পূর্ণ নির্দোষ। মানুষটা এতো সুদর্শন কেন হওয়া লাগবে? একটু কম হলে কী খুব ক্ষতি হতো?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তার সারহান ভাই অন্যদের মতো ফর্সা নয় তবুও মানুষটার ব্যক্তিত্ব, ভাবভঙ্গি, শ্যামবর্ণের চেহারার তীক্ষ্ণতা অনায়াসে কোনো মেয়েকে ঘায়েল করতে সক্ষম। সে নিজেও তো এই গভীররাতে বেসামাল হয়েছে। অরিত্রিকা দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়। তবে মনের মাঝে আজ অভিমান জমেছে। ফোনে বিবিজান ডাকটা মধুর শোনালেও বাস্তবে কেমন যেন হিংসা হয়। নিজের মিথ্যাশ্রয়ী রুপে নিজেই জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। কিন্তু তা প্রকাশ করে না। আপাতত এগুলো অপ্রকাশিত থাকুক। অরিত্রিকা নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায় মেঝে থেকে। এসি চলছে রুমে। এর কারণে পুরো রুম অতিরিক্ত শীতল হয়ে গেছে। সে চঞ্চলা ভঙ্গিতে চোখ বুলিয়ে আশেপাশে কিছু খোঁজার চেষ্টা করে। কাঙ্খিত জিনিসটি বিছানার এককোণে দেখতে পায়। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে এসির রিমোট নেয় এবং এসি বন্ধ করে যথাস্থানে রেখে দেয়। অতঃপর বিছানার এককোণে থাকা কম্ফোর্টার সারহানের শরীরে জড়িয়ে দেয়।
কয়েক পা বাড়িয়ে এসে সারহানের মাথা বরারবর ল্যাম্পটি নিভিয়ে দেয়। রুম থেকে প্রস্থানের পূর্বে পুনরায় তাকায় সারহানের। মোহাচ্ছন্ন সেই চাহনি। মুহুর্তেই ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসির সঞ্চার হয়। অবাধ্য মন নিষিদ্ধ বায়না ধরে মানুষটার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির ভাজে হাত ছুঁইয়ে দেওয়ার। নিজের মনকে এই ক্ষণে বাঁধা দেয় না। এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে খানিকটা ঝুঁকে হাত দ্বারা ছুঁইয়ে গাল। মোহাবিষ্ট নয়নে তাকিয়ে বিরবির করে বলল ;
“আপনাকে ঘুমন্ত অবস্থায় এতটা দুর্বার আকর্ষণীয় কেন লাগে সারহান ভাই? আমার মতো শান্ত, ভদ্র মেয়ে আপনার এই নিস্পন্দ মুহূর্তের সুযোগ নিচ্ছে আঙুলের আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দিচ্ছে আপনার গাল। আপনার কারণেই মেয়ে হয়েও সীমা লঙ্ঘন করে ফেলছি। এর দায়ভার কে নেবে? বলে রাখলাম সব দায়ভার আপনার কল্প পুরুষ ।”
অরিত্রিকা একটু থেমে বিমোহিত হয়ে বলে ওঠে ;
“খুব শিগগিরই আপনাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেবো, আমি আপনার না-হওয়া বিবিজান। আমার ছোট্ট মস্তিষ্ক এতো লুকোচুরির ভার সহ্য করতে পারছে না। এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের মাঝে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকুক তা আমি চাই না।”
অরিত্রিকার হাত শিরশির করে ওঠে যেন অজানা বিদ্যুতে বিদ্যুতায়িত হয় সে। পুরুষালি গালের উষ্ণতা মিশ্রিত মসৃণতা তার আঙুলে ক্ষণস্থায়ী ছাপ ফেলে যায়। তবে সেই স্পর্শ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। মুহূর্তের ভেতরই সে হাত সরিয়ে নেয়। নিজের শরীর সোজা করে দাঁড়ায়। বুকের ভেতর অনুভব করে অনিয়ন্ত্রিত স্পন্দন যেন হৃৎস্পন্দনের তাল কেটে গেছে।লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়া দৃষ্টির আড়ালে অস্বস্তিকর গুঞ্জন খেলা করে। বুকের মাঝে তীব্র ঢেউ ওঠে। শ্বাসের তালে তাল মেলাতে ব্যর্থ হয় মন। সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকার অবকাশ নেই।সমস্ত সত্তার ব্যতিব্যস্ততায় দ্রুত পায়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায় অরিত্রিকা যেন দেরি হলে নিজেকে ধরে ফেলবে কোনো অনিবার্য দুর্বলতা।
অরিত্রিকার বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই সারহান হঠাৎ চক্ষুদ্বয় মেলে ধরে মুহূর্তের ভেতরেই সে তড়াক বেগে উঠে বসে বিছানায়। সেই হঠাৎ গতির প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতস্থানে চাপ লেগে যায়। ব্যথার তীব্রতায় চোখ-মুখ কুঁচকে ওঠে। কিন্তু সে নিজেকে সংযত রাখে যেন দুর্বলতা প্রকাশ মানেই আত্মসমর্পণ।স্থবির দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে রুমের দরজার দিকে। শূন্যতার মাঝেও কোথাও যেন অরিত্রিকার অস্তিত্বের ছায়া লেগে আছে। কিন্তু এখন আর মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে না। সেই শূন্যতা গভীরভাবে গ্রাস করে সারহানকে। বিস্ময়ে অভিভূত সে। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে যেন বুকের ভেতর জমে থাকা অস্থিরতা মুক্তি পেতে চায়। কৃষ্ণবর্ণ চুলের এলোমেলো গুচ্ছকে এক হাতে সরিয়ে সে স্বাভাবিকভাবে বসে পড়ে। এতোক্ষণ সে নীরবে শুয়ে থেকেও অনুভব করেছে প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি শব্দের অনুরণন। অরিত্রিকার পদচিহ্নহীন উপস্থিতিও যেন তার ইন্দ্রিয়কে নাড়া দিয়ে গেছে। কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ;
“ ভালোবাসি সারহান ভাই। ”
“ ভালোবাসি নেতা সাহেব। আপনার না হওয়া বিবিজান আপনাকে ভালোবাসে।”
“ অরিত্রিকা তুই কীভাবে পারলি সারহান ভাইকে চু*মু দিতে?”
অরিত্রিকা অসহায় মুখ করে নতজানু ভঙ্গিতে বসে আছে বিছানায়। মুখশ্রী অতিশয় ভার। অস্বস্তি যেন আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে তাকে। পাশে বসে আছে ইশরা। মুখাবয়বে ফুটে উঠেছে অবাকতার রেষ। অনাকাঙ্ক্ষিত পুরো ঘটনার সাক্ষী হয়েছে সে আর সাদাত। দুজনে মিনিট পনেরো আগে রুমে এসেছিল অরিত্রিকার খোঁজে কিন্তু পায় নি। পুরো বাড়ি হন্যে হয়ে খুঁজে না পেয়ে সাদাত আবিরকে জিজ্ঞেস করেছিল অরিত্রিকাকে কোথাও দেখেছে কি না? আবির উত্তর দিয়েছিলো সারহানের রুমে আছে অরিত্রিকার। ব্যস দুজনে গিয়ে যখন সারহানের রুমের দরজা খুলে উঁকি দিলো। দেখতে পেল অরিত্রিকা সারহানের হাতে ওষ্ঠ ছোঁয়াচ্ছে। তা দেখে দুজন মুর্তির ন্যায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো দরজার সামনে। ইশরার বিস্ময়ে ভরা কন্ঠস্বরে দোলাচলন দেখা গেল না। সে পূর্বের ন্যায় বসে রইল নীরব ভঙ্গিতে।
সাদাত চেয়ার টেনে অরিত্রিকার সম্মুখে বসেছে। এতোক্ষণ নিরব ভূমিকা পালন করলেও এখন চুপ থাকতে পারল না। গম্ভীর কণ্ঠে বলল ;
“ বেদ্দপ মাইয়া আমার ভাইয়ের ঘুমের সুযোগ নিয়ে ইজ্জত হরণ করে এখনো চুপ করে বসে আছিস? ওসব কিসুমিসু কেনো দিয়েছিস বল। ”
অরিত্রিকা আড় চোখে তাকায় সাদাতের দিকে। মুখ বাঁকিয়ে বলে ;
“ এমন ভাবে বলছিস মনে হচ্ছে তোর ভাইকে উল্টাপাল্টা কিছু করেছি। সামান্য ব্যান্ডেজের ওপর ঠোঁট ছুঁইয়েছি তাতেই এমন এলিগেশন লাগাচ্ছিস। ”
“ আমি স্পষ্ট দেখেছি তুই কিস করেছিস। ”
“ একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবি না। ”
“ উল্টাপাল্টা কথা বলি না আমি। ঠোঁট ছোঁয়ানো আর কিস এর মধ্যে পার্থক্য বোঝা আমাকে। ”
“ অনেক পার্থক্য আছে। ”
“ পার্থক্যগুলো বল আগে।”
অরিত্রিকা মেজাজ খারাপ হলো। তিরিক্ষি মেজাজে বলল ;
“ হাতে কিস করেছি ঠোঁটে তো কিস করিনি। এবার এসব টপিক বাদ দে। ”
সাদাত কিছু বলবে তার আগে ইশরা গমগমে কন্ঠে বলল ;
“ টপিক বাদ দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।কাহিনী কী তোর? দুজন একে অপরকে দেখতে পারিস না অথচ কিসমিস করছিস? ”
“ কাহিনী বলবো না। আসছে কোন ভালোর ঘরের মানিক রতন হুহ্। ”
“ কেনো বলবি না? আজ তোকে বলতেই হবে নয়তো বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দেবো।”
“ মেজাজ গরম করবি না ইশু। ”
অরিত্রিকা কটমট করে তাকিয়ে উচ্চস্বরে ধমকে বলল। মনের মাঝে চলমান সংকোচ, লজ্জা দুজনের সামনে ইচ্ছাকৃত প্রকাশ করল না। সে সারহানের হাতে চু*মু খেয়েছে ভাবতেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। গাল দুটো তখনি লাল বর্ণ ধারণ করল। অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্তটা কেন বদমাশ দুটোর চোখে পড়ল। এরা দুটো এই কারণে জ্বালিয়ে মার*বে। নিজের এহেন কাজে নিজেই বিব্রতবোধ করছে। ওমন লজ্জাজনক কাজ করা একদম উচিত হয় নি। সাদাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অরিত্রিকার ভাবভঙ্গি অবলোকন করলো। ত্যাছড়া কন্ঠে বলল ;
“ আমার ভাইয়ের যৌবন শুষে নিয়েছিস বেদ্দপ রমণী। আবার আমাদের ধমকাচ্ছিস? ”
অরিত্রিকা বিস্ফোরিত নয়নে তাকাল সাদাতের দিকে। এই ছেলে বলে কি সে যৌবন শুষে নিয়েছে! বিস্মিত কন্ঠে বলল ;
“ কী বললি তুই?”
“ সকাল হতে দে তারপর ভাইকে বলে দেবো তুই ভাইয়ের ঘুমানোর সুযোগ নিয়ে উল্টাপাল্টা করেছিস। ”
“ আরে ভাই চুপ কর। জানিস না দেয়ালেরও কান আছে। ”
“ চুপ থাকার মতো কোনো কাজ করিসনি। এবার বল কবে থেকে চলছে এসব?”
সাদাতের স্বর দৃঢ় শোনাল। অরিত্রিকা ভড়কে গেল। অবাক হয়ে শুধালো ;
“ কী কবে থেকে চলছে? ”
সাদাত অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল ;
“ ভাই আর তোর লুকাছুপি কাহিনী। ”
“ ভাই বিশ্বাস কর এমন কোনো কাহিনী দেই। আমি তো উনার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছিলাম। ”
“ মুখ দিয়েও যে ব্যান্ডেজ করা যায় আজ শুনলাম। ”
ইশরা খোঁচা দিয়ে কথাটা বলল। অরিত্রিকা অসহায় চাহনিতে তাকাল দুজনের দিকে। কী বলবে কী করবে বুঝতে পারল না। সে বুঝেছে এদের উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে কোনো লাভ হবে না। ভেবেই হতাশার শ্বাস ফেলল। সাদাত গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ;
“ ভালোবাসিস ভাইকে? ”
হঠাৎ এহেন প্রশ্নে চমকালো অরিত্রিকা। চকিত নয়ন জোড়া স্থির করল সাদাতের মুখপানে। তবে কী সাদাত বুঝে ফেলেছে সে সারহান ভাইকে ভালোবাসে। এ কথা যদি বাড়ির কাউকে বলে দেয় তুলকালাম বেঁধে যাবে। বক্ষ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে অজানা ভয়। ইশরা চক্ষুদ্বয় বড় বড় করে তাকাল সাদাতের দিকে। বিস্ময় ভরা কন্ঠে বলল ;
“ এসব কী বলছিস সাদাত! সারহান ভাইকে অরিত্রিকাকে কেন ভালোবাসবে? অরিত্রিকা তো সারহান ভাইকে অপছন্দ করে। ”
সাদাত হাসল ;
“ঘৃণার আগুন যতো প্রজ্জ্বলিত হয় ভালোবাসার পরিধি ততো দীর্ঘ হয়। ঘৃণা অপছন্দের মাঝে হঠাৎ কিছু পরিবর্তন আসে তখন হৃদয়ের গহীনে কোথাও অপছন্দের মানুষের জন্য অনুভূতি সৃষ্টি হয়। অবচেতন মন ভালোবেসে ফেলে নির্দিধায়।”
ইশরা বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। এইটুকু ছেলে ভালোবাসার বুলি ফোটাচ্ছে আশ্চর্যের বিষয়। অরিত্রিকা অবিশ্বাস্য চাহনিতে দেখল সাদাতকে। এই ছেলে সত্যি সাদাত নাকি অন্য কেউ বসে আছে। সাদাত পুনরায় জিজ্ঞেস করল ;
“ ভালোবাসিস ভাইকে?”
অরিত্রিকা মাথা নুইয়ে অস্ফুটস্বরে ক্ষুদ্র উত্তর দিলো;
“ ভালোবাসি সারহান ভাইকে। ”
“ কবে থেকে? ”
“ ভালোবাসা কী দিন বা সময় দেখে হয়? ”
“ একদম সঠিক বলেছিস। ভালোবাসা দিন বা সময় দেখে হয় না। ”
সাদাত অদ্ভুত হাসল। ইশরার মাথায় চক্কর দিচ্ছে এসব শুনে। দুজন দুই মেরুর মানুষ হয়ে কীভাবে ভালোবাসলো? সারহান ভাই ও কি ভালোবাসে অরিত্রিকাকে? এসব ভেবে তালগোল পাকিয়ে গেল তার। অরিত্রিকার ভীষণ লজ্জা লাগল। ইস নিজ মুখে কেউ ভালোবাসার কথা স্বীকার করে?
“ আমার ভাইকে যদি কষ্ট দিয়েছিস তোর খবর আছে বলে দিলাম। ”
সাদাতের এহেন কথায় বিস্মিত হলো অরিত্রিকা। সাদাত পুনরায় বলল ;
“ মনে থাকে যেনো।”
অরিত্রিকা গালে হাত দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে চুপচাপ বসে রইল। ইশরা হঠাৎ এমন কিছু শুনবে ভাবতে পারেনি। সে হতভম্ব হয়ে ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তখনি সাদাতের কন্ঠস্বর শোনা গেলো;
“ এই টমেটো কি হলো তোর? গরম লাগছে বাতাস করবো, মাথায় পানি ঢালবো। ”
“ এমপি সারহান ইদায়াত চৌধুরী নিজেকে ভীষণ চালাক ভাবিস তাই না? অরিনকে আমার প্ল্যানের গুটি হওয়া থেকে বাঁচিয়ে নিলি? ব্যাপার না। একজনকে বাঁচিয়েছিস আরেকজনকে কীভাবে বাঁচাবি?”
উক্ত কথাটি বলে এক পৈশাচিক হাসিতে মত্ত হলো ব্যক্তিটি। সেই হাসির মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে শীতল নিষ্ঠুরতা এবং একপ্রকার নিছক আনন্দ। যা অন্যের দুঃখে উপভোগ করা হয়।আভিজাত্যপূর্ণ রুমের বিলাসবহুল সোফায় আয়েশি ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে বসে আছে ব্যক্তিটি। দামি পোশাক তার রুচিশীল শীতল ব্যক্তিত্বের জানান দিচ্ছে। এক হাতে ধরা অর্ধখাওয়া সিগারেট থেকে ধোঁয়া ধীরগতিতে উঠে মিশে যাচ্ছে বাতাসে। মাঝে মাঝে সে সিগারেট ঠোঁটে চেপে টান দিচ্ছে আর সেই ধোঁয়ার মোড়কে তার চোখেমুখে ফুটে উঠছে রহস্যময় নিষ্ঠুরতা।বাদামী কালচে ওষ্ঠদ্বয়ের কোণে স্থায়ী হয়ে বসে আছে ক্রূর হাসি।যা কোনো মানবিক উষ্ণতার বহিঃপ্রকাশ নয় বরং এক অতৃপ্ত, নির্দয় আনন্দের ছাপ। নিকোটিনের গন্ধ মিশে আছে তার নিঃশ্বাসে আর চোখের গভীরতা বলে দিচ্ছে সে ব্যক্তি ভয়ঙ্কর।
ব্যক্তিটি হাসি থামিয়ে বিকৃত হেসে বলল ;
“ দুই বছর পাঁচ মাস বিশ দিন পনেরো ঘন্টা দশ মিনিট তোকে তর্পিয়েছি সারহান। ভালোবাসার মানুষের থেকে আলাদা করেছি। তবুও ঘুনাক্ষরে টের পাসনি। রাজনীতিতে মশগুল থাকলে কী আর অগোচরে রয়ে যাওয়া রহস্যের হদিস মিলে? ”
ব্যক্তিটি থামে। কিছুক্ষণ মৌন থেকে পুনরায় বলে ওঠে ;
“ দীর্ঘ দিনের এ বিচ্ছেদ সুখকর ছিল না তোর জন্য। বর্তমানের পূর্নতা ও সুখকর নয়। যাকে ভালোবেসে আগলে নিতে চাইছিস সত্যিটা জানার পর সেই ভালোবাসা থাকবে তো? নাকি জানালা দিয়ে পালাবে? ”
ব্যক্তিটি হাতে থাকা সিগারেট এক নিঃশ্বাসে শেষ করে অর্ধদগ্ধ টুকরোটা অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে মেঝেতে ফেলে দেয়। তারপর ধীরে ধীরে শরীর এলিয়ে দেয় ডিভানের নরম গদিতে।ক্লান্ত দেহ অথচ মস্তিষ্কে অবিরাম ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একের পর এক পৈশাচিক চিন্তার স্রোতে সে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছে আরও গভীরে। চোখের পাতা ভারী কিন্তু মনের গহীনে যেন অপরাধের পুরোনো নেশা নতুন করে সঞ্চারিত হচ্ছে।অপরাধ জগত আবারও হাতছানি দিচ্ছে। সেই পুরোনো টান সেই অন্ধকার জগতের বাঁধন যেন শেকলের মতো তাকে আকৃষ্ট করছে। একরকম নেশাগ্রস্তের মতো বুকের ভেতর কেবলই মনে হচ্ছে শুরুটা তো অনেক আগেই হয়ে গেছে, এবার থামার কোনো উপায় নেই! এরমাঝে প্রবেশ করল কালো পোশাকধারী একব্যক্তি। শরীরের গড়ন পাকাপোক্ত।
“ স্যার মিস্টার রাহাত কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন বন্ধ আছে। ওর বাড়িতে খোঁজ নিয়েছিলাম কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। ”
কালো পোশাকধারী ব্যক্তিটি নত মস্তকে যন্ত্রের ন্যায় হরহরিয়ে বলল কথাটি। উক্ত কথাটি ডিভানে বসা ব্যক্তিটির কর্ণকুহরে প্রবেশ করল। তড়িৎ বেগে উঠে বসল। কপাল কুঁচকে বলল ;
“ এসব কি বলছো ফিরোজ? গতকাল সকাল অব্দি রাহাতের সাথে কানেক্টেড ছিলাম আমি। তখন অব্দি সবকিছু ঠিকঠাক ছিলো। একটা জলজ্যান্ত মানুষ কীভাবে হঠাৎ উধাও হবে? ঠিকঠাক খবর নিয়েছো?”
“ জ্বি স্যার। মিস্টার রাহাত মিসিং। আমরা অনুমান করেছি উনাকে কেউ তুলে নিয়েছে। ”
“ ইউ ডাফার। তোমরা থাকতে কিভাবে রাহাতকে কেউ গায়েব করে দিলো?”
ব্যক্তিটি মুহুর্তে গর্জে উঠল। রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল ফিরোজ নামক মানুষটার দিকে। ফিরোজ ভয়ে থরথরিয়ে কেঁপে উঠে। ভয়ার্ত ভঙ্গিতে বলে ;
“ স্যার মিস্টার রাহাত আমাদের নিষেধ করেছিলো উনার ওপর নজর রাখতে। ”
ব্যক্তিটি ফুঁসে উঠল। ডিভানের পাশে রাখা ফ্লাওয়ার ভাস ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলল ;
“ চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে রাহাতকে জ্যান্ত চাই আমি। যতো দ্রুত পারিস খুঁজে বের কর আর এই মুহুর্তে চোখের সামনে দূর হো। ”
ফিরোজ ভীতিগ্রস্ত ভঙ্গিতে হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে যায় রুম থেকে। ব্যক্তিটি নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। তার নাকের ডগা দিয়ে কে রাহাতকে উধাও করল? সারহান কি এসবের পেছনে আছে? তার সন্দেহ ঠিক হলে রাহাত এখনো সারহানের কাছে আছে। এই মুহুর্ত থেকে আর দেরী করা চলবে না পরিকল্পনা মাফিক কাজ দ্রুত সম্পূর্ণ করতে হবে। ব্যক্তিটি পকেট হতে দ্রুত ফোন বের করে। ফোনের লক খুলে অরিনের নাম্বার খুঁজে বের করে। অতঃপর আঙুল বুলিয়ে কিছু লিখে ম্যাসেজে করে পাঠিয়ে দেয় নাম্বারে। এরপর ফোন ডিভানে ছুঁড়ে ফেলল। পুনরায় গা এলিয়ে ক্রূর হেসে গেয়ে উঠল ;
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৮
“ Ishq mein marjawn
Tu joh kahein oh karjawan…
Ishq mein marjawan
Tu job kahein oh karjawan ”
“ আই অ্যাম ব্যাক সারহান। ”
ব্যক্তিটি উদভ্রান্তের ন্যায় হাসতে লাগলো। চক্ষুদ্বয়ে ফুটে উঠলো প্রতিশোধের স্পৃহা।