প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪০

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪০
আদ্রিতা নিশি

ভোর পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। চৌধুরী বাড়ির ছেলেরা নামাজ শেষে দল বেঁধে বেরিয়ে গেছে মর্নিং ওয়াকের জন্য। বাড়ির মেয়েরা কেউ তখনও ঘুমিয়ে, কেউবা নামাজ পড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সকালবেলার কাজকর্মে। সার্ভেন্টরা ঘুম ভাঙতেই হাত লাগিয়েছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে, বাড়ির প্রতিটি কোণ ঝকঝকে করে তোলার তাগিদে।
অরিত্রিকা তখনও ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন। মাত্রই ঘুম থেকে উঠে এলোমেলো হাতে চোখ-মুখ ডলে বিছানা ছাড়ে। পায়ের নিচে মেঝের শীতলতা অনুভব করতেই হঠাৎ কর্ণকুহরে প্রবেশ করে পরিচিত শব্দ লেভির ক্ষীণ আওয়াজ।ঘুমু-ঘুমু চোখে সে সামনে তাকায়। দেখতে পায় লেভি মেঝেতে শুয়ে থেকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ছোট্ট প্রাণীটার দৃষ্টি আর অস্থির ভঙ্গি স্পষ্টতই কিছু বলতে চায়। অরিত্রিকা মুহূর্তেই বুঝতে পারে তার বাচ্চাটা ক্ষুধার্ত!আর দেরি করা ঠিক হবে না। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে সে বক্স থেকে ক্যাট ফুড বের করে একটা পাত্রে ঢালে। তারপর খানিকটা হম্বিতম্বির ভঙ্গিতে এসে খাবারটা লেভির সামনে রাখে যেন আদুরে ধমকের সুরেই বলছে “এই নাও, রাজকীয় খাবার এসে গেল!”

“ বেবি খাবার খাও। সব খাবার শেষ করবে কিন্তু নয়তো জল্লাদ মামুর কাছে রেখে আসবো। ”
অরিত্রিকা এতোটুকু বলেই খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। তার কথাটার মধ্যেই লুকিয়ে আছে দারুণ এক রসিকতা। ভাবা যায় সে কি-না তার বেবিকে ভয় দেখাচ্ছে সেই জল্লাদ মানুষটার নাম করে।
কিন্তু পরক্ষণেই যেন মন বিদ্রোহ করে উঠল। সারহান ভাই কি সত্যিই জল্লাদ? যদি সত্যিকারের জল্লাদ হতো তাহলে কি ভালোবাসার স্পর্শে তাকে আগলে রাখত? না কি পুরোনো সব অপরাধের শাস্তি দিতে এক মুহূর্তও দেরি করত না?”জল্লাদ হলে তোকে ভালো না বেসে শুলে চ’ড়াতো। আগে কি কম জ্বালিয়েছিস উনাকে?” মনসত্তা বিরোধীতা করে যেন বলে উঠল। এই চিন্তার সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে উঁকি দেয় বহুদিন আগের এক কাহিনি।তখন তার বয়স হয়তো পনেরো বা ষোলো। কিশোরী মন দুরন্ত উচ্ছ্বাস আর অজানা এক অভিমানের প্রকাশ করেছিল ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফেব্রুয়ারির শুরুতে শীতের দাপট ছিল চরমে। বাতাসে কুয়াশার চাদরে ঢাকা পুরো শহর। ঠান্ডার কামড়ে কাঁপছিল জনমানব। এমন সময় সাধারণত কেউ ঠান্ডা জাতীয় খাবারের ধারেকাছে যায় না কিন্তু অরিত্রিকা ছিল পুরোপুরি ব্যতিক্রম। শীত যত বাড়ত তার আইসক্রিম খাওয়ার নেশা ততই তীব্র হতো।যখন-তখন বাবার কাছে বায়না ধরত আইসক্রিমের জন্য। আজমল সাহেব কিন্তু তাতে মোটেই রাজি নন। শীতের দিনে মেয়েকে ঠান্ডা লাগিয়ে অসুস্থ করতে তিনি নারাজ। নানান বাহানায় ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন কিন্তু অরিত্রিকা ছিল নাছোড়বান্দা। সে আইসক্রিম চাইবেই।সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একরোখা জেদ ধরে কেঁদেছিল সে। অবশেষে আরশাদ সাহেব মেয়ে সমতুল্য অরিত্রিকার কান্না সহ্য করতে না পেরে আইসক্রিম এনে দিয়েছিলেন। সেই ছোট্ট বিজয়ে অরিত্রিকার আনন্দ আর ধরে না। খুশিমনে গলাগলি করে পুরো আইসক্রিম সাবাড় করে দিলো।পরদিনই স্বাভাবিক পরিণতি হলো ধুম জ্বর।তবে এতেও তার কার্যকলাপ কমল না। জ্বরজারি নিয়ে সবাই যখন তাকে নিয়ে চিন্তিত সে তখন নির্লজ্জের মতো লিভিংরুমের কোণায় বসে আবার আইসক্রিম খেতে ব্যস্ত।ঠিক সেই সময়েই সারহান ভার্সিটি থেকে ফিরে এলো। দরজায় পা রাখা মাত্রই চোখ পড়ল অরিত্রিকার সেই নির্লজ্জ কার্যকলাপের দিকে। মুহূর্তেই তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল।পরক্ষণেই তীব্র কণ্ঠে ধমক দিলো;

“তোর জ্ঞানশক্তি পুরোপুরি লোপ পেয়েছে নাকি ফাইরুজ? এত জ্বর নিয়েও আইসক্রিম খাচ্ছিস!”
অরিত্রিকা হতচকিত হয়ে তাকিয়েছিল মানুষটার দিকে। কিন্তু ভয়ে কোনো উত্তর দিতে পারেনি।
সারহান আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ায়নি। বিরক্তি আর রাগ মিশিয়ে অরিত্রিকাকে অপমানের সুরে আরও কিছু শুনিয়ে গম্ভীর মুখে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করেছিল। তার সহ্য হচ্ছিল না এমন বেয়াড়া জেদ। বেচারা অরিত্রিকা বদমেজাজি মানুষটার এমন আচরণে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল সে। সারহানের ধমক আর অপমান মনের ভেতর কাঁটার মতো বিঁধেছিল। রাগে, দুঃখে আর অভিমানে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলেছিল তখনই।কিন্তু কাঁদলেই তো হয় না প্রতিশোধও নিতে হবে।অপমানের জ্বালা মেটাতে চুপিসারে এক দুষ্টু ফন্দি এঁটেছিল সে।

সারহানের অগোচরে তার কালো শার্টে ছোট্ট নাকটা গুঁজে দিয়েছিল। সেটার মাঝে সর্দি মুছেছিল এবং রেখে দিয়েছিল যথাস্থানে। তার প্রতিশোধের ছাপ অমোচনীয় হয়েছিল সারহান ভাইয়ের কালো শার্টে।পরদিন সকালে সারহান যখন আলমারি খুলে কালো শার্টটি বের করেছিল তখনই চোখে পড়েছিল সেই ” জঘন্য দাগ”। প্রথমে হতভম্ব তারপর রাগে চোখ-মুখ লাল।সারহান রাগে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছিল।”অরিত্রিকা”সারহানের এক ডাকেই বুঝে গিয়েছিল আসন্ন বিপদ।ভয় পেয়ে দরজার খিল এঁটে গুটিসুটি মেরে বসে রয়েছিল সে। বাহিরে বের হলে দরজার ওপাশে বিশাল সারহান ভাই নামক দানব তাকে দেখলে মুহূর্তে গিলে ফেলবে।সারহানসেই মুহূর্তে যদি সে অরিত্রিকাকে সামনে পেতো, নিশ্চিতভাবেই গাল লাল করে দিতো।
অরিত্রিকা পুনরায় শব্দ করে হাসল। বিষাদে ভরা সেই হাসি। বিষন্ন কন্ঠে বলল ;

“ অতীতের সময়টা অনেক সুন্দর ছিল। সেসময়ে আমি ছিলাম চঞ্চলা কিশোরী আর আপনি ছিলেন গম্ভীর নির্দয় যুবক। দুজনেই ছিলাম প্রণয় নামক অনুভূতি থেকে অদূরে। পরমুহূর্তে ভালোবাসলেন আর আমি আপনাকে দহনে পু*ড়িয়ে বিদায় নিলাম। ”
অরিত্রিকা হাত দিয়ে চুলগুলো আলগোছে বেঁধে নিলো খোপা করে। নীরব ভঙ্গিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সেথায়। এর মাঝেই শোনা গেল ইশরার ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর।
“ তোর ডাইনী মার্কা হাসির আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে গেল অসভ্য মেয়ে। ”
অরিত্রিকা জিভ কাটল। সে ভুলে গিয়েছিল ইশরা গতকাল রাতে তার রুমে ঘুমিয়েছিল। অপরাধীর ন্যায় মুখ করে পেছনে তাকাল। দেখল ইশরা বিরক্তিরসহিত তার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিরবির করে কিছু বলছে। সে ক্যাবলা মার্কা হাসল। হাসি বজায় রেখে বলল ;

“ সরি ইশু বেবি। ভুলে গিয়েছিলাম তুই ঘুমিয়ে আছিস। ”
ইশরা হুড়মুড় করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। ওড়না ঠিক করে মুখ বাকিয়ে বলল ;
“ প্রেম নামক জংলা ভুতে ধরলে মানুষ সবকিছু ভুলে যায়। দুইদিন পর দেখা যাবে তুই আমাকে ভুলে গেছিস। ”
“ সকাল হতেই আবার খোঁচানো শুরু করলি? ”
“ তুই মিঙ্গেল হয়ে যাচ্ছিস আমার ভালোলাগছে না।”
“ তুই ও মিঙ্গেল হয়ে যা। ফুপিকে বলবো পাত্র দেখতে? ”
“ দরকার নেই। আমার এখন বিয়ে করার ইচ্ছে নেই।”
“ গোপন সূত্রে খবর পেলাম কোনো এক গোলামের পুতের সাথে তোর বিয়ের কথা চলছে। ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল দিলেই বিয়ে দিয়ে দিবে। ”
অরিত্রিকা এক গাল হেসে বলল। ইশরা চমকে গেল। মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেল। মুখ ভার করে বলল ;
“ আমাকে মিথ্যা কথা বলছিস? ”
অরিত্রিকা হাসি থামিয়ে বলল ;
“ সত্যি বলছি। আমার কী মনে হয় জানিস! তোর বিয়ের পর ইরফান ভাইকে বিয়ে দিবে।”
“ ধ্যাত কীসব শোনাচ্ছিস। আজ থেকে আমার ঘুম হারাম হয়ে গেল। ”
“ ওসব বাদ দে ইশু। চল বাগান থেকে ঘুরে আসি। ”
“ চল। ”
অরিত্রিকা আর ইশরা দুজন বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

“ কানে এসব কি গুঁজেছিস টমেটো? দেখতে রাক্ষসীর মতো লাগছে। ”
ইশরা ফুলের বাগানে বেঞ্চে একাকী বসে আছে। অরিত্রিকা বাড়ির পেছনের দিকটায় গিয়েছে বকুল ফুল কুড়ানোর জন্য। সে অপেক্ষা করছিল অরিত্রিকার জন্য। এর মাঝে দৃষ্টি স্থির হয়েছিল বাগানের হালকা গোলাপী রঙের গোলাপে। এক মুহুর্ত সময় ব্যয় না করে গোলাপটি তুলে গুঁজেছিলে কানে। অতঃপর আনমনা ভঙ্গিতে কিছু একটা ভাবছিল। হঠাৎ সাদাতের কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই চমকে যায় ইশরা। দ্রুত সামনে তাকায়। কিছুটা সাদাত দাঁত কেলিয়ে হেসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এ হাসি দেখে যেন রাগ হলো ইশরার।
সাদাত কিছুটা এগিয়ে আসে বাগানের ভেতরে। ঠাস করে বসে পরে ইশরার পাশে। পুনরায় হেসে বলে ;
“ কানে গোলাপফুল গুঁজেছিস। সুন্দর লাগছে তবে তোকে না গোলাপফুল কে। টমেটো তোর কানে শুধু টমেটোর ফুল ভালো লাগবে অন্য কোনো ফুল মানাবে না। ”
ইশরা কটমট করে তাকিয়ে বিগড়ে যাওয়া মেজাজে বলল ;

“ আমার কানে গোলাপ ভালো লাগবে নাকি অন্য কোনো ফুল লাগবে সেটা বলার তুই কে? সকাল সকাল তোর সাথে ঝগড়া করে নিজের মুড নষ্ট করতে চাই না। ”
“ তোর সাথে কখন ঝগড়া করলাম আজব? ”
“ তোর ভরসা নেই। এখন খোঁচা দিয়ে কথা বলছিস একটু পর চুল টানাটানি করে ঝগড়া করবি। ”
“ মেয়েরা চুল টানাটানি করে ঝগড়া করে টমেটো। ”
“ আমাকে ঝগড়ুটে বললি? ”
ইশরা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিল্লিয়ে বলল। সাদাত অবাক হয়ে বলল ;
“ কখন ঝগড়ুটে বললাম? ”
ইশরা ফুঁসে উঠে বলল ;
“ একটু আগেই তো বললি। ”
সাদাত হতাশ হয়ে বলল ;
“ কথার কথা বলেছি পাগলী। ”
“ আবার পাগলী বললি? ”
“ ভালোবেসে পাগলী বলেছি তাতেও রাগ? ”

সাদাত কপাল চাপড়ে হতাশাপূর্ণ কন্ঠে উত্তর দিল। ইশরা সরু চোখে তাকাল সাদাতের দিকে। এই ছেলে ভালোবেসে পাগলী ডেকেছে? ভালোবেসে কেউ কাউকে পাগলী বলে ডাকে? কিছুটা অদ্ভুত লাগল বিষয়টা। মনের ভেতর কেমন যেন সন্দেহের সৃষ্টি হচ্ছে। নিজের ভেতর চলমান ভাবনা বুঝতে না দিয়ে মেকি রাগ দেখিয়ে চাপা স্বরে বলল ;
“ তোর মাথা ঠিক আছে? ”
সাদাত একগাল হেসে বলল ;
“ আমার মাথার কী হবে? ”
“ কিছু না। কোথায় গিয়েছিলি? ”
“ বাড়ির সব ছেলে মিলে মর্নিং ওয়াকে গিয়েছিলাম। ”
“ তোকে একাই দেখছি। বাকীরা সবাই কোথায়?”
ইশরা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করল। সাদাত দৃঢ় কন্ঠে বলল ;
“ সবাই বাড়ির ভেতরে। ”
ইশরা হাসার ভাণ করে বলল ;
“ আসলে আমি খেয়াল করিনি। ”
“ অন্য ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকলে খেয়াল করা যায় নাকি? ”

ইশরার মন ভার হয়ে এলো। সাদাতের কথার কোনো উত্তর দিলো না। অরিত্রিকা সকালে যা বলেছিল তা নিয়ে এখনো ভেবে চলেছে। চিন্তায় মাথা ব্যথা করছে। সত্যি কি তাকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিবে নাকি মিথ্যা বলল মেয়েটা? যদি সত্যি হয় তখন কী হবে। এসব দুশ্চিন্তায় পড়ে মন বিষন্ন লাগছে।
“ মন খারাপ? ”
সাদাতের শান্ত স্বর। ইশরা অস্ফুটস্বরে উত্তর দিল ;
“ হ্যা।”
সাদাতের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হলো। উদ্বিগ্ন ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করল ;
“ কী হয়েছে? কোনো সিরিয়াস কিছু? ”
ইশরা মলিন মুখে বলল ;
“ হ্যা সিরিয়াস বিষয়। ”
“ কি হয়েছে বল? ”
“ বলবো না। ”
“ আরে বল। বললে মন শান্ত হবে। ”
“ গোপনে মা আমার বিয়ে ঠিক করছে। ”
“ হোয়াট? কে বললো? ”
“ অরিত্রিকা। ”
ইশরা বিষন্ন মুখে বলল। সাদাত উত্তর শুনে হু হা করে হেসে দিল। অতঃপর বলল ;

“ তোকে বোকা বানিয়েছে গাধা। ”
ইশরা চোখ মুখ কুঁচকে বলল ;
“ একদম মজা নিবি না। এই জন্য তোকে বলতে চাই নি। ”
“ তোরা মেয়েরাও পারিস বাবাহ! বিয়ের কথা চলছে তা শুনে চিন্তায় হার্টএ্যাটাক করিস। আমরা ছেলেরা বিয়ের কথা শুনলে খুশি হই। ”
“ মেয়েরা বিয়ের পর শশুর বাড়ি চলে যায় সারাজীবনের জন্য। এটার কষ্ট তোরা ছেলেরা কীভাবে বুঝবি বুদ্ধু? ”
“ এই কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় আছে।”
ইশরা আগ্রহী হয়ে বলল ;
“ কীভাবে? ”
সাদাত ভ্রু নাচিয়ে শান্ত কন্ঠে উত্তর দিলো ;
“ কাজিনকে বিয়ে করে। ”

“ একদম ফালতু আইডিয়া। কাজিনদের বিয়ে করা মানে সারাজীবন চুলোচুলি করা। ”
“ তাহলে আর কি এক্ষুনি বিয়ে করে দ্রুত বিদায় হো এ বাড়ি থেকে। শোন, আজ থেকে আমার সামনে একদম আসবি না। ভুল করে যদি সামনে চলে আসিস তোর খবর আছে। ”
সাদাত গমগমে কন্ঠে বলল। ইশরা বিস্মিত হলো সাদাতের ভাবমূর্তি দেখে। একটু আগেও তো ঠিকঠাক ভাবে কথা বলছিল এখন হঠাৎ রেগে গেল কেনো? সে তো রাগ হওয়ার মতো কোনো কিছু বলেনি। সাদাত ক্রোধান্বিত ভঙ্গিতে উঠে পড়ল। ইশরার দিকে র*ক্তাক্ত দৃষ্টিতে তাকাল। ইশরার কানের পাশ হতে গোলাপটি টান দিয়ে নিয়ে নিল। তারপর হাতের মুঠোবন্দী গোলাপ পিষে মাটিতে ফেলে হনহনিয়ে প্রস্থান করে সেখান থেকে। ইশরা হতভম্ব হয়ে যায় সাদাতের অদ্ভুত আচরণে। ছেলেটার হঠাৎ হলো কী? কোনো বিষয় নিয়ে কী চিন্তিত? সে কিছু না ভেবে ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে ছুটল পিছু পিছু।

অরিত্রিকা গুটি কয়েক শিউলী ফুল দু’হাতের তালু একসাথে মেলে বাগানের কাছে এসে বেঞ্চের দিকে তাকাতেই দেখল ইশরা নেই। সে কয়েক কদম এগিয়ে আশেপাশে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে খোঁজার প্রয়াস চালালো। কিন্তু পেল না। বুঝতে পারল মেয়েটা সুযোগ বুঝে চম্পট দিয়েছে। তবে কী তখনকার কথাটা বলার শোধ নিলো? অরিত্রিকা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বাগানের ভেতরের দিকটা এসে ধপ করে বসল। ভাবল ইশরাটা একটু বোকা। মেয়েটা বুঝল না বিয়ের বিষয়টা আসলে মজা করে বলেছে। অতঃপর হাতে থাকা ফুল গুলো রাখল বেঞ্চে। সকালের স্নিগ্ধ নির্মল বাতাস লম্বা শ্বাস টেনে অনুভব করতে লাগল। গেট খোলার কর্কশ শব্দে সেদিক টায় তাকাল অরিত্রিকা। সারহান অ্যাথলেটিক ওয়্যার পরিহিত। কানে ইয়ারপড গুজে গম্ভীরমুখে কথা বলতে বলতে বাড়ির সদর দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেখতে অত্যাধিক সুদর্শন লাগছে। সে গালে হাত গুঁজে বিমোহিত নয়নে তাকিয়ে রইল।
“ আজকের প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় আশেপাশে খেয়াল রেখো আর আজাদ সাহেবের সাথে সন্ধ্যা সাতটায় মিটিংয়ের ব্যবস্থা করো। ”

ইনান কল কেটে দিলো।সারহান ফোনটা পকেটে রেখে আশপাশে একবার তাকাল। তারপর বাড়ির ভেতরে প্রবেশের জন্য পা বাড়াল। কিন্তু ঠিক তখনই দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল বাগানের ভেতরের বেঞ্চির দিকে।সেখানে বসে আছে এক রমণী। এক গালে হাত দিয়ে অপলক চাহনিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।মনে হলো বাগানের রঙিন ফুলের মাঝে বসে থাকা রমণী যেন আরেকটি সদ্য ফোটা পুষ্প। তার চারপাশের রঙিন ফুলের সৌন্দর্যকে যেন ছাপিয়ে গেছে আপন মহিমায়।
সারহানের চক্ষুদ্বয় এক মুহূর্তের জন্য মুগ্ধতায় আবদ্ধ হয়ে গেল। বুকের ভেতর অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে এলো। অন্তঃকোণ শীতল হয়ে এলো। এতোক্ষণের চিন্তায় ডুবন্ত মন শান্ত হয়ে উঠল। সারহান ক্ষীণ হেসে পা বাড়াল সেদিকটায়। শাণিত পদযুগল ফেলে বাগানের ভেতরে প্রবেশ করে দুরত্ব বজায় রেখে বসল বেঞ্চে। বসার মৃদু শব্দে অরিত্রিকার ধ্যান ভাঙল। হচকচিয়ে উঠে পাশে তাকিয়ে মিনমিন করে বলল ;

“ আপনি এখানে কখন আসলেন? ”
সারহানের ভ্রুযুগল বেঁকে গেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল ;
“ তুই যখন আমার দিকে ছাগলের মতো তাকিয়ে ছিলি তখন। ”
“ আপনি আমাকে ছাগল বললেন সারহান ভাই। ”
“ ছাগলকে ছাগল না বলে কী গাধা বলবো? ”
“ আপনি আবার অপমান করছেন? ”
“ সত্যি কথা বললে অপমান হয়ে যায়?”
সারহান ভরাট কন্ঠে বলল। অরিত্রিকার রোমাঞ্চকর মুহুর্তের তেরোটা বেজে গেল। কল্পনায় কতো সুন্দর রোমান্টিক মুহুর্ত সাজিয়েছিল মুহুর্তেই সব শেষ। এই মানুষটা এতোটা অনুভূতিহীন কেন? সাধে কী আর যন্ত্রমানব বলে সে। অরিত্রিকা তোর পোড়া কপাল। এমন যন্ত্রমানব নিরামিষ মানুষটাকে ভালোবেসেছিস। কবে যে সুন্দর মিষ্টি করে কথা বলেছে ধমকের চোটে তা ভুলে গেছে।
অরিত্রিকা বিরস মুখে বলল ;

“ সারহান ভাই আপনি কী কখনো আমার সাথে ভালো করে কথা বলবেন না? সবসময় এতো অপমান করেন কেন?”
সারহানের কপাল কুঁচকে গেল। দৃঢ় কন্ঠে শুধালো ;
“ ভালো করে কথা বলতে হয় কীভাবে? ”
অরিত্রিকা একগাল হেসে গরগর করে বলল;
“ দাঁড়ান শিখিয়ে দিচ্ছি। এই ভাবে বলবেন “ফাইরুজ কেমন আছিস, সকালে ব্রেকফাস্ট করেছিস, সাবধানে থাকবি, ভদ্র মেয়ের মতো চলাচল করবি, একটু ভালো বাসবি, লেভিকে যত্ন করে রাখবি, মাঝে মাঝে আমার পারফিউম ইউজ করবি,পড়াশোনা করবি, তাড়াতাড়ি ঘুমাবি। ”

সারহান তির্যক দৃষ্টিতে অবলোকন করল অরিত্রিকাকে। মেয়েটার মাথায় যে ভালোবাসার ভুত চড়ে গিয়েছে তা বুঝতে পারল। সে নিজের ওপর বিরক্ত হলো। এতো দ্রুত কনফেস করা উচিত হয়নি। এখন দেখা যাবে অরিত্রিকা মাথায় তাকে নিয়ে উল্টোপাল্টা ভেবে অদ্ভুত কান্ড করবে। সে তপ্ত শ্বাস ফেলে। অতঃপর পুরূ কন্ঠে বলল ;
“ একটু ভালোবাসবি আর মাঝে মাঝে আমার পারফিউম ইউজ করবি? এটা…”
সারহানের কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে অরিত্রিকা মাথা নত করে লাজুক ভঙ্গিতে বলল ;
“ আচ্ছা। আপনার কথা আজ থেকে ভদ্র মেয়ের মতো মেনে চলবো। ”
সারহান আশ্চর্য হলো কথা শুনে। এই মেয়েকে সে যতোটা বোকা মনে করেছিল ততোটা নয়। শুধু তার সামনে বোকার মতো আচরণ করে। সে একটু বিরক্ত বোধ করল। ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ;

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৯

“ ভালোবাসার আউল ফাউল চিন্তা মাথায় কীভাবে আসলো? ”
অরিত্রিকা মুখ ফসকে বলল ;
“ আপনার কারণে এসব চিন্তা সারহান ভাই। আমার মতো ভদ্র নম্র মেয়েকে অভদ্র না বানালেও পারতেন। গতকাল রাতে.. ”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪১