প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫০

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫০
আদ্রিতা নিশি

সময় এগারোটা বেজে দশ মিনিট। চৌধুরী বাড়ি জুড়ে নিস্তব্ধ, নিস্তরঙ্গ। পরিবেশ থমথমে! পিনপিনে নিরবতা। মনে হচ্ছে কোনো এক ভুতুড়ে বাড়ি। অরিত্রিকা বিছানায় শুয়ে আছে অদ্ভুত ভঙ্গিমায়। মাথা বিছানায় কিন্তু পা উঁচিয়ে দেয়ালে লাগানো। দৃষ্টি স্থির সিলিংয়ের দিকে। অপলক চেয়ে যেন প্রহর গুনছে। খোলা চুল পুরো বিছানায় ছড়ানো। মন ভালো নাকি খারাপ বোঝার উপায় নেই। মস্তিকে জুড়ে সারহান ভাইয়ের বলা প্রতিটি কথা দাবানল সৃষ্টি করছে। ক্ষণে ক্ষণে বুঝিয়ে দিচ্ছে কল্প পুরুষ তাকে ইচ্ছাকৃত দূরে সরিয়ে দেয়নি। উক্ত ঘটনার পেছনে নিশ্চয়ই বাবা এবং ফুপির কোনো কারসাজি আছে। শুধু মাঝখান থেকে ফেঁসে গেছে বেচারা ইরফান ভাই।
“ ফাইরুজ। ”

পুরুষালি পরিচিত কন্ঠ আচমকা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে অরিত্রিকা হচকচিয়ে গেল। উল্টো শোয়া থেকে ধুম ধারাক্কা উঠে পড়ল। কিছুটা দূরে অবহেলায় পড়ে থাকা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দেখল সারহান এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে একখানা খাবার সাজানো প্লেট। প্লেটখানা দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে গেল। সারহান ভাই তার জন্য খাবার এনেছে ভেবে আবেগাপ্লুত হয়ে গেল। চকচক করল চক্ষুদ্বয়। বত্রিশটা দাঁত কপাটি মেলে হাসল।
“ মঞ্জুলীকার মতো হাসা বাদ দিয়ে সাইড দে। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সারহানের কন্ঠস্বর গম্ভীর। অরিত্রিকার হাস্যজ্জ্বল মুখখানা চুপসে গেল। কাঠখোট্টা, বদমেজাজি মানুষটা এতো খারাপ কেন? সে মুখ বাঁকিয়ে দরজার সামনে থেকে সরে ধপাধপ পা ফেলে বিছানায় গিয়ে মুখ গোমড়া করে বসল। সারহান প্লেট হাতে প্রবেশ করল ভেতরে। ধীরজ পায়ে এগিয়ে গিয়ে অরিত্রিকার পাশে প্লেট খানা রাখল। পাশে অরিত্রিকার পড়ার জন্য টেবিল -চেয়ার রাখা। সেখানে হাত বাড়িয়ে চেয়ার খানা টেনে বসল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অবলোকন করল অরিত্রিকাকে। গতকাল রাত থেকে অতিরিক্ত চিন্তায় ভুলে বসেছিল সিক্রেট আমব্রোজিয়ার কথা। তেমন নজরে রাখা হয়নি। শুনেছে গতকাল দুপুর থেকে খাওয়া দাওয়া করেনি— কথাটা তানিয়া বেগম ছেলের কানে দিয়েছেন। শোনা মাত্র রেগে গিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণে রাগ ভুলে শান্ত হয়েছিল। ছোট্ট মেয়েটার ওপর দিয়ে গতকাল থেকে ভীষণ চাপ যাচ্ছে। মন এবং মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। তাই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করেছে। সে প্লেট হাতে নেয়। ছোট চামচ দ্বারা ভাত ও সবজি মাখিয়ে খাবার তুলে অরিত্রিকাকে উদ্দেশ্য করে দৃঢ়জ গলায় বলল;
“ হা কর। ”

অরিত্রিকা স্তম্ভিত হয়ে গেল। মনে মনে ভাবল, এ আমি কাকে দেখছি! সারহান ভাই তাকে খাবার খাইয়ে দিবে? কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। কিন্তু সবজি দেখে তার মুখ কুঁচকে গেল। তার সবজি একদম পচ্ছন্দ নয়। সকালে গন্ধ পেয়েছে রুম থেকে মাংসের। ভেবেছিল সকলের অগোচরে লুকিয়ে মাংস দিয়ে ভাত খাবে। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। সার্ভেন্ট আর বাড়ির মানুষরা কিচেনের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। ভাবনা অসমাপ্ত রাখল। ধমক খাওয়ার থেকে সবজি দিয়ে ভাত খাওয়া ঢের ভালো। চোখ মুখ কুঁচকে হা করে খাবারটা মুখে পুড়ে নিল। অতি কষ্টে চিবাতে লাগল।
সারহান খাবার মাখাতে মাখাতে জিজ্ঞেস করল;

“ গতকাল দুপুর থেকে না খেয়ে আছিস কেনো?”
অরিত্রিকা অদ্ভুত চোখে তাকাল। ভাতটুকু গিলে মুখ ফসকে বলল ;
“ কে বলেছে না খেয়ে আছি! আমি সবার অগোচরে লুকিয়ে দুপুরে ডিম পোঁচ দিয়ে খেয়েছি, রাতে মাছ দিয়ে খেয়েছি। শুধু সকালে মাংস দিয়ে খাওয়ার চান্স পাইনি। ভাত, সবজি আনলেন কিন্তু মাংস আনলেন না কেন সারহান ভাই! দুঃখ পেয়েছি।”
গরগর করে কথাটুকু বলে জিভ কাটল। হায় কপাল! সে গোপন সব কথা ফাঁস করে দিলো? এখন কী হবে! সারহান তাজ্জব বনে গেল। মেয়েটা মোটেও স্বাভাবিক ধাঁচের নয়। একদম অন্য প্রকৃতির। সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। পুরূ কন্ঠে বলল;

“তোর দ্বারা উদ্ভট কর্মকান্ড করা সম্ভব। হা কর। ”
অরিত্রিকা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। মৃদু হেসে খাবারটুকু নিল। দ্রুত খাবার টুকু শেষ করে বলল;
“ আব্বু এবং ফুপি কী করেছিল আপনার সাথে?”
“তোর বাপ আর তোর ফুপিকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।”
“রেগে যাচ্ছেন কেন? বলুন না কি করেছিল? ”
অরিত্রিকা কোমল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল। সারহানের ভ্রুযুগল বেঁকে গেল। ভরাট কন্ঠে বলল;
“তোর হিটলার বাপকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।”
অরিত্রিকা মুখ গোমড়া করে বলল;
“ বুঝেছি বলবেন না। আপনি অনেক সাহসী, বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ মানুষ তবুও কেন দুবছর চুপ ছিলেন?”
“ একই প্রশ্ন যদি ঘুরিয়ে তোকে বলি! দুবছর আগে কেন বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলি? চাচার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এতো বড় ইস্যু ক্রিয়েট করার সাহস তোর নেই। তবে কেন সামান্য বিষয় নিয়ে এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলি? আসল কারণ কী?”

“ কোনো কারণ নেই।”
“ মিথ্যা বলা সহ্য করতে পারি না আমি।”
“ সত্যি বলছি।”
অরিত্রিকা থতমত খেয়ে বলল। সারহান প্লেট বিছানার ওপর রেখে দিল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল ;
“ সত্যিটা জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু বলিসনি। এমন না হয় সত্যিটা বলতে তোর না দেরী হয়ে যায়।”
অরিত্রিকা শুকনো ঢোক গিলল। বিরবির করে বলল;
“ আপনাকে জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভয় হয় সত্যিটা জানলে যদি আপনি আমায় ভুল বুঝেন? আপনাকে হারাতে চাই না আমি..। ”
সারহান কি শুনতে পেল কথাগুলো? বোধ হয় না। অরিত্রিকা নিজেকে সামলে মেকি রাগ দেখিয়ে বলল;
“ কী ভাবছেন নেতা সাহেব! ভাবনা চিন্তা বাদ রেখে খাইয়ে দিন ক্ষিধে পেয়েছে।”
সারহান ভ্রুযুগল গুটালো ;

“ হঠাৎ নেতা সাহেব বলে ডাকলি কেনো?”
“ ভালো লাগে তাই ডেকেছি। আরেকটা নিকনেম রেখেছি আপনার। ”
“ নিক নেম? ”
“ হ্যা। ”
“ বল শুনি কি উদ্ভট নাম রেখেছিস। ”
সারহানের ভরাট কন্ঠস্বর। অরিত্রিকা লাজুক হেসে মিনমিন করে বলল ;
“কল্প পুরুষ। ”
সারহান শান্ত চাহনিতে তাকাল। মৃদু হাসল। অরিত্রিকা অনিমেষ চেয়ে রইল সারহানের দিকে। শ্যামমানবের হাসি স্নিগ্ধ! তার কল্প পুরুষ এতো সুদর্শন কেন? ভাবতেই বক্ষস্থল ধক ধক করে উঠে। বিমোহিত নয়নে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে উঠে;
“ আপনাকে এতো সুদর্শন হতে কে বলেছে সারহান ভাই? আমি তো বেসামাল হয়ে যাচ্ছি। একটু কম সুদর্শন হলে কী খুব ক্ষ*তি হতো? ”
সারহান তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল। সরু ভ্রযুগল দ্বিগুন বেঁকে গেল। ভরাট কন্ঠে বলল ;
“ লাভ – ক্ষতি হিসাব করা বাদ দিয়ে পুষ্টিকর খাবার খা— ব্রেন সুস্থ থাকবে। ”
“ ধ্যাত ভালোলাগে না এসব শুনতে।”
“ আমায় দেখতে ভালোলাগে?”
সারহান দৃঢ় কন্ঠে বলল। অরিত্রিকা লজ্জা পেল। লাজুক হেসে অন্যত্র তাকাল। সারহান হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রইল অপলক।

আজমল সাহেব আধশোয়া হয়ে বসে আছেন বিছানায়। আজ অফিসে যাননি। শরীর এবং মন সকাল থেকে ভালো নেই। সকাল থেকে বাড়িতে হুলুস্থুল কান্ড মন, মস্তকে শান্ত থাকতে দিচ্ছে না। কী করবেন বা কী করা উচিত এসব যেন মস্তিস্কে জেঁকে ধরেছে। অতিরিক্ত চিন্তায় বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কী করা প্রযোজন তা যেন ভুলে বসেছেন। প্রতিনিয়ত অপরাধ নামক এক অদৃশ্য ভুল যেন দিশেহারা করছে। বক্ষস্থল অপরাধবোধ নামক তীর যেন বিদ্ধ হচ্ছে। বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে সারহানের অনুভূতি জানার পরে অরিত্রিকা এবং ইরফানের বিয়ে ঠিক করা সম্পূর্ণ অনুচিত হয়েছিল। আরেকটু সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলে বর্তমান উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। জীবনে প্রথমবার বড়সড় ভুল করে ফেলেছেন তিনি।নিজের মেয়ের কাছে একজন নিষ্ঠুর বাবা হয়ে যাচ্ছেন।

পরিবারের সকলে বর্তমান সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট। বোনের আবদার রাখতে গিয়ে সকলের চোখে খারাপ হচ্ছেন। দুবছর আগে সারহানের অনুভূতি সম্পর্কে অবগত করেছিলেন ইসমা বেগম। তিনি অবাক হয়েছিলেন বেশ। পরক্ষণে ইসমা বেগম নিজে ছেলের জন্য অরিত্রিকাকে চাইলেন। আকুতি মিনতি করলেন। ছোট বোনের আবদার ফেলতে পারলেন না রাজি হয়ে গেলেন। সেসময় অরিত্রিকা এবং সারহানের মাঝে নিরব দ্বন্দ্ব চলমান ছিল। তিনি জানতেন মেয়েটা সারহানকে পছন্দ করেন না। তাই আগ পিছ না ভেবে সবাইকে ডেকে বিয়ে ঠিক করেছিলেন। সেদিন সারহান নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় দেখেছিল সবটা। কেন চুপ ছিল? ভয় নাকি সম্পর্ক রক্ষার্থের স্বার্থে! ইসমা বেগম সারহানের রাজনীতি এবং তার সমাবেশে গু*লি লাগার বিষয় নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করেছিলেন ও বুঝিয়েছিলেন যেন সারহান অরিত্রিকার জীবন নষ্ট করতে না পারে — এটা বলেছিলেন। ভাবনার মাঝে প্রবেশ করলেন সাথী বেগম। তিনি স্ত্রীর দিকে তাকালেন। খেয়াল করলেন, স্ত্রীর মুখ অতিশয় ভার। মন খারাপ করে আছে হয়তো। তিনি দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। কোমল কন্ঠে ডাকলেন ;

“ সাথী! এদিকে এসো কথা আছে। ”
সাথী বেগম আলমারীতে জামা কাপড় ভাজ করে রাখছিলেন। স্বামীর নরম এবং শান্ত স্বরে অবাক হলেন। ঘাড় বাকিয়ে আড় চোখে তাকালেন অথচ কথা বললেন না। আজমল সাহেব পুনরায় বললেন ;
“ সাথী! রাগ না করে কথাগুলো শুনে যাও। ”
সাথী বেগম নিরবতা ভাঙলেন।গমগমে কন্ঠে বললেন ;
“ আপনার কথা শোনার ইচ্ছে আমার নেই।”
“ আরে লক্ষীটি! রাগ করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ”
“ আপনি মানুষটা সকলের জন্য ক্ষতিকর। ”
“ আচ্ছা মানলাম। এদিকে এসো অরিত্রিকার বিয়ের বিষয়টা নিয়ে কথা আছে।”
সাথী বেগম তিরিক্ষি মেজাজে বললেন;
“ আপনার কথা শুনতে ইচ্ছুক নই।”
আজমল সাহেব শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন;

“ মেয়ের জামাই হিসেবে সারহানকে পছন্দ হয়েছে? নাকি এটাকেও রিজেক্ট করবে? রিজেক্ট করতে পারো সমস্যা নেই। কিন্তু সারহান জেদি, একরোখা ছেলে তোমার এবং আমার অনুমতি ব্যতিত আমাদের মেয়েকে বিয়ে করে ফেলবে আর আমরা নিরব দর্শক হয়ে দেখব।”
সাথী বেগম জামা কাপড় বিছানার ওপর রেখে এগিয়ে আসলেন। হতবাক হয়ে বললেন ;
“ এসব কী বলছেন?”
আজমল সাহেব সাথী বেগমের হাত টেনে পাশে বসালেন। হাতটা মুঠোতে বন্দি করে মোলায়েম কন্ঠে বললেন;
“ তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার জন্য দুঃখিত সাথী। হঠাৎ এমন পরিস্থিতি তৈরী হওয়ায় মাথা ঠিক ছিল না। ”
“ অরিত্রিকার বাবা, আপনার মনে কি চলছে বলুন তো? আপনাকে অস্বাভাবিক লাগছে কেন? ”
“ আমি নিজের কাজে অনুতপ্ত সাথী। সারহান অরিত্রিকা কে ভালোবাসতো জেনেও ইরফানের সাথে বিয়ে ঠিক করেছিলাম। ভেবেছিলাম,ছেলেটা হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য অরিত্রিকাকে পছন্দ করেছে। কিন্তু আমি সম্পূর্ণ ভুল। দুবছর পরে এসে আমায় ভুল প্রমাণিত করল। ছেলেটা আমাদের মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসে — স্বচক্ষে তা দেখতেও পেলাম। ”

“ আপনি সত্যিটা জেনেও কেন ভুল করলেন? আমি, আপনি এবং বাড়ির সবাই জানি সারহান কেমন! ছেলেটা রাগী স্বভাবের হলেও বর্তমান সময়ের ছেলেদের তুলনায় অনেক ভালো। ”
“ মস্ত বড় ভুল করেছি। দুবছর আগে সারহান অরিত্রিকা কে ভালোবাসতো কিন্তু বর্তমানে দুজনে একে অপরকে ভালোবাসে। আমার এমুহুর্তে কী করা উচিত বুঝতে পারছিনা। একদিকে, সারহান এবং অরিত্রিকা। অপরদিকে, ইসমা এবং ইরফানকে দেওয়া ওয়াদা। সবকিছু আমায় বেড়াজালে জড়িয়ে দিচ্ছে। ”
আজমল সাহেব থেমে পুনরায় অধৈর্যের সহিত বললেন ;
“ সারহান রাজনীতি তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। তবে আমি ইসমা এবং ইরফানের কাছে ওয়াদাবন্ধ — সেটা আমায় অশান্ত করে তুলছে।”
আজমল সাহেব উত্তেজিত হয়ে বললেন। সাথী বেগম বললেন;
“ শান্ত হোন আপনি। মাথা ঠান্ডা করে ভাবুন কী করা যায়। ”
আজমল সাহেব খানিকটা শান্ত হলেন;

“ আমি কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করিনি সাথী। কিন্তু এই প্রথম বার ওয়াদা ভঙ্গ করতে হবে৷ ইরফানের কথা ভেবে খারাপ লাগছে। কী জবাব দেবো ছেলেটাকে?”
“ যা হওয়ার হয়ে গেছে। আপনি শুধু ভাবুন ইরফানকে কীভাবে বোঝাবেন। ”
“ আজকে রাতে ইরফানের সাথে কথা বলবো আমি। কথা বলে দেখি কী বলে। ”
“ ইসমা আপাকে সারহান নিচে কথাগুলো কেন বলল? ”
“ জানিনা। আমার মনে হয়, দুবছর আগে ইসমা আমায় বলেছিল সারহান যদি অরিত্রিকাকে বিয়ে করতে চায় তাহলে রাজি না হতে আরও বলেছিল রাজনীতি করা ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দিলে জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। এটা হয়তো জানতে পেরেছে তাই কথাগুলো বলেছে। ”

“ আপনার কানে কুমন্ত্রণা দিয়ে নিজের ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব রেখেছিল আর আপনি রাজি হয়ে গিয়েছিলেন বাহ! কীভাবে পারল আপনার বোন সারহানের মনের কথা জেনেও এমনটা করতে? সারহান হয়তো চেয়েছিল অরিত্রিকা বড় হলে আপনাকে সরাসরি বলতে কিন্তু তার আগেই আপনারা পন্ডিতি করেছেন। এবার ঠেলা সামলান। আমার মনে হয় এসবের পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে। আপনার বোন কোনো কিছু লুকাচ্ছে আমাদের থেকে।”
“ অন্য কারণ কি থাকতে পারে? ”
“ আপনার বোনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন।”
সাথী বেগম রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন। আজমল সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে রইলেন। সব কিছু কেমন যেন ধোঁয়াশা লাগছে।

বিকেল চারটা পাঁচ মিনিট। লিভিং রুমে পরিপাটি হয়ে বসে আছে সারহান। ভাবমূর্তি গম্ভীর এবং কঠিন। পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিমায় কিছু একটা ভেবে চলেছে। রাতে প্রাক্তন এমপির সাথে জরুরী মিটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজনৈতিক আঙ্গনে উত্তপ্ত পরিস্থিতি এবং কে. ফাউন্ডেশনের ট্র্যাজেডি — এটি বর্তমানে শীর্ষ সমস্যার উৎস। দলের শীর্ষ নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। পুলিশি অভিযান চলমান রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংখ্যক তথ্যদি এবং প্রমাণ পাওয়া গেছে। শীঘ্রই আসল কালপ্রিটকে ধরা যাবে বলে আশাবাদী তারা। দুপুরে আবির কল দিয়ে জানিয়েছে মেহমুদ রঈসের মৃ*ত্যু স্বাভাবিক নয় বরং অস্বাভাবিক। ফরেনসিক তদন্তের ফলাফলে স্পষ্ট বিষাক্ত ক্যামিকেল ইনজেক্ট করা হয়েছিল শরীরে। বিষাক্ত ক্যামিকেল দ্রুত মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ায় মৃ*ত্যু হয়েছে। কিন্তু হসপিটাল কতৃপক্ষ বানোয়াট খবর দিয়েছে। মেহমুদ রঈসের মৃ*ত্যু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং কিডনি বিকল হওয়ার কারণে হয়েছে। সব ঘটনা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং রাজনৈতিক দাঙ্গার প্রতিফল হিসেবে ধরা হচ্ছে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে এসব ঘটনা তাকে টেনে হিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামানোর চাল মাত্র। নিস্তব্ধতা ভেঙে ফোনের রিংটোন বেজে উঠল সারহানের। সে ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে ফোন পকেট থেকে বের করল। অতঃপর রিসিভ করতেই আবিরের উৎকন্ঠিত ভাঙা কন্ঠস্বর শোনা গেল ;

“ সারহান, পার্টি অফিসের বাহিরে আমাদের ছেলেপুলেদের ওপরে নয়ন তালুকদারের পোষা কুত্তারা হামলা করেছে…. পাঁচ ছয়জনের অবস্থা আশংকাজনক। ওদের হসপিটালে এডমিট করিয়েছি। আমার হাতে আঘাত লেগেছে.. আমি পার্টি অফিসের সামনে আছি… তুই চলে আয়। ”
আবির কথাটুকু বলেই কল কাটল। সারহান দুশ্চিন্তাগ্রস্থ বদনে হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে গেল বাড়ি থেকে। কয়েকজন গার্ডকে নিয়ে সাথে করে গাড়িতে রওনা দিলো পার্টি অফিসের উদ্দেশ্যে।

রাজশাহী মেডিকেলের সামনে থেমে থাকা নিজস্ব গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নয়ন তালুকদার। মুখাবয়ব অতিশয় শক্ত এবং ক্রোধান্বিত। কিছুক্ষণ আগে খবর পেয়েছে বিরোধী দলের পার্টি অফিসের সামনে এমপি সারহান ইদায়াত চৌধুরী তাদের দলের কিছু পোলাপানকে বেধড়ক পিটিয়েছে। সবার অবস্থা আধম*রা প্রায়। খবরটা শুনে ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে। কিন্তু পার্টি অফিসের সামনে পৌছে অবাক হয়ে যান। সেখানে তাদের দলের পোলাপানরা রাস্তায় পড়ে থেকে চিল্লাচিল্লি করছে, আর্তনাদে এবং আহাজারিতে পরিবেশ ভারী করে তুলেছিল। সকলের শরীরে মারের কালসিটে দাগ এবং চামড়া ছিড়ে রক্তাক্ত ক্ষতের দাগ। কি ভয়াবহ দৃশ্য! যেন সকল রাগ ক্ষোভ মিটিয়েছে মানব শরীরের ওপর। দূর থেকে মানুষজন দেখছিল কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। পার্টি অফিসের দিকে খেয়াল করে দেখেছিলেন দরজায় তালা লাগানো। রাগে ফেটে পড়েছিলেন। সেমুহুর্তে ইচ্ছে করছিল এমপিকে জানে মে*রে দিতে। কিন্তু ক্ষোভ মনে পুষে রাখেন। উপায়ন্তর না পেয়ে নিজস্ব গাড়িতে করে ছেলেপুলেদের হসপিটালে এডমিট করিয়েছেন।

“ তোমার হুকুমে ছেলেপুলেরা এমপির ছেলেদের গায়ে হাত দিয়েছিল এবং ঝামেলা করেছিল। ভেবেছিলে আকস্মিক হামলায় তোমার ছেলেদের কেউ কিছু করতে পারবে না। কিন্তু তুমি ভুল প্রমাণিত হলে বাবা। এমপি নিজেই তোমার দলের ছেলেদের মেরে আধম*রা করে দিয়েছে। ”
ইলহামের বিদ্রুপাত্মক কন্ঠস্বর। নয়ন তালুকদার রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালেন ছেলের দিকে। গমগমে কন্ঠে বললেন;
“ মেজাজ খারাপ করে দিও না ইলহাম। ”
ইলহাম দু’পকেটে হাত গুজে বাবার সামনে দাঁড়ায়। ক্ষীণ হেসে বলে;
“ শুনলাম এমপির ছেলেপুলে মেডিকেলে এডমিট আছে। এই সুযোগে দুই শত্রুর মুলাকাত হওয়ার সম্ভবনা আছে। ”
“ তুমি চুপ করবে?”

“ চুপ থাকতে পারছি না আমি। বলেছিলাম সারহানের সাথে লাগতে যেও না। কিন্তু তুমি শুনলে না। এখন পকেটের কচকচে নোট গুলো তোমার লেওড়া মার্কা ছেলেপুলেদের চিকিৎসার জন্য খরচ করো।”
“ আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সারহানের পক্ষে আছো তুমি! তাই আমার কাজে বারবার বাঁধা দিচ্ছো। ”
“ শত্রুতা মেটানোর চেষ্টা করছি বাবা। সারহানের কাজিনের কথা মনে আছে? মেয়েটার নাম অরিত্রিকিকা। দেখতে ভীষণ মিষ্টি। ওকে মনে ধরেছে, বিয়ে করতে চাই। তাই তোমাদের সাপে নেউলে সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটাতে চাইছি। আফটার অল সারহান আমার শ্যালক হতে চলেছে। ”
ইলহাম গা গুলিয়ে হেসে বলল। নয়ন তালুকদার বিরক্ত হলেন। গমগমে কন্ঠে বললেন;
“ ওই মেয়ের সাথে তোমায় বিয়ে দেবো না। তাই মাথা থেকে ওসব চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলো। ”
ইলহাম হাসে;

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪৯

“ দেখা যাক কি হয়! তবে শুনে রাখো অরিত্রিকা শুধু আমার।”
নয়ন তালুকদার ছেলের বেয়ারাপোনায় বিরক্ত। তিনি সেখানে এক মুহুর্ত দেরী না করে হসপিটালের ভেতরে প্রবেশ করলেন। ইলহাম মাথার চুলগুলো একহাতে ঠেলে দেয় পেছনে। ওষ্ঠকোণে বিরাজ করে প্রাণ খোলা হাসি। প্রেমিক পুরুষের ন্যায় আনমনা ভাবে প্রিয় মানুষটির কথা। বিরবির করে আওড়ায়;
“ তোমাকে একপলক দেখার ইচ্ছে জেগেছে মনে সুইট গার্ল। কবে তোমার দেখা পাব? ”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫১