প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫৫

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫৫
আদ্রিতা নিশি

অনামিশায় ডুবন্ত প্রহরকে বিদায় জানিয়ে সকাল হয়েছে। সূর্যের সোনালী রশ্মিতে আলোকিত হয়েছে প্রকৃতি। বৈশাখ মাসের শেষ। সকালের শীতল ভাব মিলিয়ে গিয়ে উষ্ণীষ ভাবের বহিঃপ্রকাশ লক্ষণীয়। এক কথায়, তীব্র গরমে অসহনীয় পরিস্থিতি। বাহিরের প্রকৃতি সূর্যের তাপে উত্তপ্ত। অপরদিকে, চৌধুরী বাড়িতেও উত্তপ্ত পরিস্থিতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সকাল নয়টা বেজে দশ মিনিট। ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছে সকলে। কিন্তু কোনো কারণবশত বাড়ির বড়রা খাবার খাচ্ছে না। ইসমা বেগম অনুপস্থিত। বাড়ির কর্তাদের মুখ অতিশয় গম্ভীর এবং শক্ত। চোখ মুখে ফুটে উঠেছে চিন্তিতভাব।

বাড়ির গিন্নিরা নিরবচিত্তে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। সেসব দিকে নজর না দিয়ে বাকীরা খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অরিত্রিকা রাগান্বিত ভঙ্গিতে পরোটা দিয়ে ডিম ভাজি খাচ্ছে। মেজাজে যাতা অবস্থা একদম।খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আড় চোখে তাকাচ্ছে টেবিলের অপর পাশে বসে থাকা চার বজ্জাতের দিকে। চারজন খাওয়া বাদ দিয়ে ইশারায় তাকে এবং সারহানকে ইশারা করে কিছু বলছে আর মিটিমিটি হাসছে। এসব কার্যকলাপ দেখে মেজাজ যেন সপ্তম আকাশে উঠে গেছে। বেয়াদব গুলো শান্তি মতো খেতেও দেবে না। গতরাতের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। ইশরা, তিশা এবং রাহা তার রুমে শুয়েছিল। তিনজনে মিলে সারারাত তাকে জ্বালিয়ে মেরেছে। ভালোবাসা বিষয়ক হাজারের মতো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে তার ঘুমের তেরোটা বাজিয়েছে। তিন হস্তিনী জ্বালিয়ে ফজরের আজানের পর ঘুমিয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এদের জন্য মাথাও ব্যথা করছে। অরিত্রিকা চোখ পাকায়। সাদাত, ইশরা, রাহা এবং তিশার মিটিমিটি হাসির মাত্রা বেড়ে যায়। সে বিরক্ত হয়। অতঃপর চোখ ফিরিয়ে তাকায় আড় চোখে তাকায় পাশের চেয়ারে বসে থাকা গম্ভীর, বদমেজাজি, যন্ত্রমানব মানুষটার মুখপানে। সারহান ভাই আজও কায়দা করে তার পাশে বসেছে। তা বুঝতে বাকী নেই আর। অন্তঃকোণে একরাশ ভালোলাগার আগমন ঘটতে গিয়েও লেজগুটিয়ে পালায়। দৃষ্টি পড়ে সারহানের প্লেটে থাকা খাবারের দিকে। আধা সিদ্ধ করা সবজি এবং সালাদে পরিপূর্ণ প্লেট। মনে হচ্ছে সবুজ গাছপালার স্তুপ পড়েছে । সবজির ভেতরে দৃশ্যমান করলা। অরিত্রিকার তা দেখে মুখটা কুঁচকে আসে। নাক সিটকায় সে। এসব শাক পাতা খেয়ে কোনো মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। সে খেলে তো দুদিনও বেঁচে থাকতে পারে না। তার চঞ্চল মন আন্দাজ করে ফেলে করলা ও তেঁতো জাতীয় খাবার খাওয়ার কারণে মানুষটার মুখে মিষ্টি কথা নেই। যা বলে সব তেঁতো লাগে। এই জন্য হয়তো প্রেমময় বাক্যের স্থানে করলার মতো কথা বলে। সে হতাশ হয়। কাকে ভালোবাসলো সে? এ জীবনে প্রেমময় বাক্য কি শুনতে পাবে? তার মনে সংশয় গাঢ় হয়।

“রাহাতের বাবা সকালে কল দিয়েছিল সারহান।”
আরশাদ সাহেব নিরবতা ভেঙে খানিকটা উঁচু কন্ঠে বললেন। সারহান খাওয়া থামিয়ে বাবার দিকে ভ্রুযুগল কুঁচকে তাকাল। তীক্ষ্ণ, প্রগাঢ় চাহনি স্থির করল সামনে বসে থাকা পিতা এবং পিতৃসম চাচার দিকে। আগ্রহী মনোভাব প্রকাশ পেল তার মাঝে। আরশাদ ছেলের নিরবতাকে বুঝলেন। তিনি নিজের মাঝে উদ্বিগ্ন ভাব কমিয়ে আনলেন। শান্ত কন্ঠে বললেন;
“রাহাতকে আজ ভোর পাঁচটায় তাদের বাড়ির সামনে আধম*রা অবস্থায় পাওয়া গেছে। ওয়াচম্যানের ভাষ্যমতে, একটা কালো রঙের মাইক্রোতে রাহাতকে নিয়ে এসে বাড়ির সামনে ফেলে গেছে। কারা ফেলে গেছে তা এখনো জানা যায়নি।”
অরিত্রিকা দৃষ্টি সরিয়ে বড়বাবার দিকে বিস্মিত নয়নে তাকায়। এতোদিন পর রাহাতকে পাওয়া গেল? এতোদিন কোথায় ছিল? কারা অপ*হরণ করেছিল — সবকিছু ধোঁয়াশা লাগল। উপস্থিত সকলে আচানক এমন খবরে বেশ অবাক। সারহান মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনে। কপালে ভাজ ফেলে বিরক্তির সহিত ভরাট কন্ঠে জবাব দেয়;
“আমাকে হঠাৎ এসব কথা বলছেন কেনো?”

“বলার কারণ অবশ্যই আছে। আমার মনে হয় রাহাতের নি*খোঁজের পেছনে তোমার কোনো সম্পৃক্ততা আছে এবং তুমি বা তোমার ছেলেপুলে ওকে পি*টিয়ে আধম*রা করেছো। ”
“আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে আমি রাহাতের এমন অবস্থার জন্য দায়ী।”
“নাহ কোনো প্রমাণ নেই। তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি রাহাতের নি*খোঁজ হওয়ার পেছনে আছো।”
“একদম সঠিক ভেবেছেন আপনি। এই না হলো আমার বাবা! শুনুন, আমি রাহাতকে কিড ন্যাপ করিয়েছিলাম। আধম*রা করার অর্ডার আমি দিয়েছিলাম। সেটা বাস্তবায়ন করেছে আবির এবং আমার ছেলেপুলেরা।”
সারহান নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল। উপস্থিত সকলে চমকাল, থমকাল। আরশাদ সাহেবের মুখ থমথমে হয়ে গেল। তিনি আন্দাজে কথা দিয়ে তীর ছুড়েছিলেন। এভাবে যে নিশানায় লেগে যাবে জানতেন না। আজমল সাহেবের মুখটা বাংলার পাঁচের মতো হয়ে গেল। কি দুর্ধর্ষ দুইটা মেয়ে জামাই হয়েছে তার। দুই জামাইয়ের কার্যকলাপে জীবনটা হালুয়া হয়ে যাবে। বুড়ো বয়সে এসে নিজেকে নিয়ে চিন্তা না করে জামাইদের নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে জীবন অতিবাহিত করতে হবে। তিনি কপাল চাপড়ালেন। রাজনীতি তিনি ছাড়লেও রাজনীতিবিদরা তার পিছু ছাড়েনি। সারহান বাবা এবং চাচার মুখখানা খেয়াল করল। দুই ভাইয়ের মুখ দেখার মতো। সে বাঁকা হাসল। ওষ্ঠকোণে হাসি বজায় রেখে বলল;

“আমার পরিবারকে নিঃশেষ করার জন্য যারা ষড়যন্ত্র করে তাদের কীভাবে ছেড়ে দেই! রাহাত দুঃসাহস করেছিল আমাদের বাড়ির জামাই হয়ে চৌধুরী পরিবারটাকে তিলে তিলে শেষ করার।তাই আমি ওর দুঃসাহসিক কাজের জন্য সামান্য আপ্যায়ন করেছি।”
আজমল সাহেব মুখ খুললেন। গলা খাঁকড়ি দিয়ে কটাক্ষ করে বললেন;
“আগেই বোঝা উচিত ছিল, তুমি রাহাতকে সরিয়েছো। রাজনীতি করো তোমরা, তোমাদের দ্বারা সবকিছু করা সম্ভব।”
“রাজনীতি আপনিও করেছেন চাচা অথচ রাজনীতি নিয়ে কটাক্ষ করছেন।”
“আমি রাজনীতি ছেড়েছি পনেরো বছর হয়ে গেছে।”
“রাজনীতি ছেড়েছেন কিন্তু আপনার নাম এখনো রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে আলোচিত। প্রতিটা দলীয় অনুষ্ঠানে এবং সমাবেশে আপনাকে ইনভাইট করা হয় কিন্তু আপনি সেসব ভুলে যাতা বকে চলেন। ”
“রাজনীতি নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। সেসব কথা আপাতত বাদ দাও। জরুরী কথা বলার ছিল সবাইকে। বলবো?”

আজমল সাহেব সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন। সারহান কথা বাড়ালো না। চুপ হয়ে গেল। বুঝতে পারল রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে হবু শশুড়মশাই কথা বাড়াতে আগ্রহী নয়। সকলে খাওয়া থামিয়ে আগ্রহী হলো কী কথা বলবে তা শোনার জন্য। আরশাদ সাহেব বললেন ;
“দ্রুত বলে ফেলো।”
আজমল সাহেব মাথা নাড়ালেন। অতঃপর সবাই উদ্দেশ্যে করে বললেন;

“সবদিক বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি — আগামী শুক্রবার সারহান এবং অরিত্রিকার আকদ করিয়ে রাখা হবে। মাস দুয়েক পর অরিত্রিকার অনার্স প্রথম বর্ষের সেমিস্টার ফাইনালের পর রিসিপশন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে উঠিয়ে দেওয়া হবে। ততদিন দুজন দুজনের মতো নিজেদের পড়াশোনা এবং কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।”
সারহানের মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেল না। ভাবভঙ্গি নির্লিপ্ত এবং নির্বিকার। সে দৃষ্টি সরিয়ে সূক্ষ্ণ চাহনিতে তাকাল পাশে বসা ইরফানের দিকে। ইরফানের মুখশ্রী ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে। চক্ষুদ্বয়ে লালচে আভার ছাপ। মুখাবয়ব অতিশয় শক্ত এবং দৃষ্টি নিবদ্ধ অরিত্রিকার দিকে। আহত চাহনি, বক্ষপিঞ্জরে অসহনীয় যন্ত্রণা দুর্বিনীত অবস্থা অথচ সবার সামনে নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছে। অরিত্রিকা বাবার মুখে অপ্রত্যাশিত বাক্য শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকাল আজমল সাহেবের দিকে। সাথী বেগম এবং তানিয়া বেগমের মুখে আনন্দের হাসি। অবশেষে সব ঝামেলার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে সুন্দর সিদ্ধান্তের দেখা মিলেছে। খুশির আমেজ প্রতিফলিত হলো সাদাত, তিশা ও রাহার মাঝে। তাদের ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসির রেখা। তিনজনে উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে আছে সারহান এবং অরিত্রিকার দিকে। ইশরার সংবাদটা শুনে খুশি হওয়ার কথা থাকলেও হলো না। বিরস মুখে তাকাল ইরফানের দিকে। ভাইয়ের মনে চলমান অবস্থা বুঝতে পেরে মন টা খারাপ হলো। রাহার মতো বলতে ইচ্ছে হলো — মানুষ কেন ভুল মানুষকে ভালোবাসে? যাকে কখনো পাবে না তাকে ঘিরে স্বপ্ন কেন দেখে?

“তোমরা সবাই আকদের জন্য শপিং করা আজ থেকে শুরু করে দাও। দুইদিন পর শুক্রবার। আমাদের হাতে সময় নেই বেশী। ডেকোরেশনের বিষয়টা আমি এবং ভাইসাব দেখে নিচ্ছি।”
আজমল সাহেব পুনরায় বলে উঠলেন। সারহান ও অরিত্রিকার আকদের কথা সহ্য হলো না ইরফানের। অসহনীয় যন্ত্র*ণায় ভেতরটা হাস ফাঁস করে উঠল। তিক্ততায় মন বিষিয়ে উঠল। ভালোবাসার মানুষটির অন্যকারো সাথে বিয়ের কথা মেনে নিতে পারছে না প্রেমিক পুরুষের মন। সে শব্দ করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। খাবার খাওয়া বাদ দিয়ে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করল। সকলে দেখল কিন্তু কিছু বলল না। কি বলবে? কোনো কিছু বলে স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা নেই। ইশরা ভাইয়ের মনোভাব বুঝতে পেরে খাবার ছেড়ে ছুটে গেল পিছু পিছু। তানিয়া বেগম এবং সাথী বেগমের মন ভার হয়ে গেল। ছেলেটার জন্য বড্ড খারাপ লাগছে। আরশাদ সাহেব তপ্ত শ্বাস ফেললেন। তিনি ডাইনিং টেবিলে ছেড়ে উঠে গিয়ে বেসিনে হাত ধুলেন অতঃপর ইরফানের রুমের দিকে গেলেন।
“তিশা ইরফান ভাইয়া অনেক কষ্ট পেয়েছে। উনার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে অরিত্রিকা ভীষণ ভালোবাসেন।”
রাহা মুখ ভার করে ক্ষীণ কন্ঠে বলল। তিশা ও তাল মিলিয়ে বলল;

“তুই একদম ঠিক বলেছিস। ইরফান ভাইয়া সত্যি অরিত্রিকাকে ভালোবাসে। তবে সারহান ভাইয়ার থেকে কম।”
রাহা ম্লান হাসল;
“সারহান ভাইয়ার মতো অরিত্রিকাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না। অরিত্রিকার ভাগ্য অনেক ভালো বুঝলি। ভাগ্য গুনে সারহান ভাইয়ের মতো সুপুরুষ পেয়েছে।”
সারহান টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে পানি খেয়ে যথাস্থানে রাখল। অতঃপর নিঃশব্দে চেয়ার থেকে উঠে চলে গেল সেখান থেকে। অরিত্রিকা থম মে*রে বসে আছে। কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে ভেবে পেল না। তার খুশি হওয়ার কথা কিন্তু পরিবারের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য মোটেও খুশি হতে পারছে না। তবে সারহানের নির্লিপ্ত ভঙ্গিমা তাকে ভাবুক করে তুলল। মানুষটা কী আকদের কথা শুনে খুশি নয়?

“সারহান ভাই আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
তপ্ত দুপুরের সূর্যের লেলিহান দাবালনের ন্যায় গ্রাস করছে। তীব্র গরমে জনমানসের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পালাক্রমে বাড়ছে তাপদাহ। মধ্যাহ্নের ভেপসা গরমে অতিষ্ঠ সবাই। শহুরে জনজীবনে এর প্রভাব পড়েছে প্রতিনিয়ত।সারহান দাঁড়িয়ে আছে পার্কিং প্লেসের সামনে। দাঁড়িয়ে থেকে কাউকে কল মেসেজ করে যাচ্ছে। অরিত্রিকা বান্ধবীদের বিদায় দিয়ে মেইন গেট পেরিয়ে আসতেই নজর পড়ল শ্যামমানবের দিকে। এতো গরমের ভেতর অসময়ে মানুষটা কোথায় যাচ্ছে? সে দোদুল্যমান মন নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল। কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করল অসময়ে কোথায় যাচ্ছে। সারহান তখন মেসেজ টাইপিংয়ে ব্যস্ত। ফোন স্কিনের দিকে নজর রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলল;
“আবিরকে দেখতে যাচ্ছি।”
অরিত্রিকা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে চাইল দন্ডায়মান পৌরুষের দিকে। কাজল কালো আঁখিযুগল মুগ্ধতায় ডুবে গেল। পরণের শুভ্র রঙা শার্ট যেন শ্যামমানবের সৌন্দর্য দ্বিগুন বাড়িয়ে তুলেছে। স্নিগ্ধ এবং অতুলনীয় লাগল। হঠাৎ মনে হলো — এই সুদর্শন শুদ্ধ পুরুষ তার একান্তই নিজের। যার হাতে হাত রেখে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়ার সময় নিকটে এসেছে। আর মাত্র দুইদিন। তারপর তার কল্প পুরুষ বাস্তব রুপে আবর্তিত হবে। কথাগুলো ভাবতেই শিরশির করে উঠল সমস্ত শরীর। ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসির সঞ্চার হলো। তার মন পুলকিত হয়ে গেল। খেয়াল করল সারহান তার দিকে না তাকিয়ে ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে। সকালে ডাইনিং টেবিলেও এহেন ব্যবহার করেছে। তাতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। কিঞ্চিৎ রাগও হয়েছিল। কিন্তু সেসময় প্রকাশ করেনি। হাসিতে মত্ত মুখশ্রী পরক্ষণে গম্ভীর হয়ে উঠল। ভ্রু উঁচিয়ে গমগমে কন্ঠে বলল;

“আপনি আমায় ইগনোর করছেন সারহান ভাই।”
সারহান মেসেজ লেখা বন্ধ করে দিয়ে সরাসরি শীতল চাহনিতে চাইল অরিত্রিকার মুখপাণে। মুখাবয়ব স্বাভাবিক। তীক্ষ্ণ চক্ষুদ্বয় ঢেউহীন সাগরের ন্যায় শান্ত। তবুও সেই চক্ষুদ্বয়ে একবার তাকালে যেন অমীমাংসিত সাগরের অতল গহ্বরের রহস্যে হারিয়ে যায়। অরিত্রিকা খেয়াল করল শ্যামমানবের চাহনি। সে ওষ্ঠদ্বয় উল্টালো। অভিমানমিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠল;

“আপনি আমায় সকাল থেকে কেন ইগনোর করছেন সারহান ভাই? আব্বু আমাদের সম্পর্ক মেনে নিল এবং আকদের দিন ঠিক করল অথচ আপনি শুনেও প্রতিক্রিয়াহীন ছিলেন। আমাদের আকদের কথা শুনে আপনি খুশি হননি?”
সারহান সূক্ষ্ম চাহনিতে অবলোকন করল নিভৃতসুধার অভিমানে জর্জরিত ফর্সা মুখশ্রী। দ্বিধায় জড়িয়ে যাওয়া কাজল কালো চক্ষুদ্বয়। সেই চক্ষুদ্বয়ে টইটম্বুর করছে অশ্রু। অভিমানিনী প্রেয়সীর উত্তর না দিলে হয়তো এক মুহুর্ত দেরী না করে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়বে গাল বেয়ে। কেন যেন কাঁদো কাঁদো মুখখানা দেখে আদুরে বাচ্চার মতো লাগল। সে কয়েকদম এগিয়ে দুরত্ব খানিকটা কমিয়ে আনল। স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে জবাব দিলো;
“তোকে উপেক্ষা করার সাধ্য আমার নেই।”
অরিত্রিকার অভিমান দৃঢ় হলো। মুখ ফুলিয়ে বলল;
“তাহলে কেন আমার সাথে কথা বলছেন না?”
“ইরফানের বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। এতো দ্রুত সবকিছু মেনে নেওয়ার ছেলে ইরফান নয়। তবে কেন দ্রুত সব মেনে নিলো?”

“কারণ তিনি জানেন, লড়াই ঝগড়া করেও আপনার থেকে আমায় আলাদা করতে পারে না।”
“ আমার সেসব মনে হয় না। ইরফান একজন বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ মানুষ। সে হয়তো সামনের কোনো ঘোলাটে পরিস্থিতি অনুমান করে নিরব হয়ে গেছে।”
“ হয়তো। একটা কথা বলব? ”
অরিত্রিকা আমতা আমতা করে করে বলল। সারহান স্বাভাবিক ভাবে বলল ;
“বল।”
অরিত্রিকা আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ আসছে কি না। কারো উপস্থিতি না পেয়ে পরক্ষণে দ্বিধান্বিত মনে সাহস সঞ্চার করে নিচু স্বরে আবদার করল;
“আমিও আপনার সাথে যেতে চাই সারহান ভাই। আমায় নিয়ে যাবেন আপনার সাথে?”
সারহান কিছুক্ষণ মৌন থেকে পরখ করল অরিত্রিকাকে। পরমুহূর্তে কিছু একটা ভেবে দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিল ;
“ঠিক আছে। চল। ”
অরিত্রিকা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল উত্তর জানার জন্য। অপ্রত্যাশিত উত্তরটি পেয়ে খুশি হয়ে গেল। প্রসন্নতার হাসির রেখা ফুটে উঠল ওষ্ঠকোণে। প্রফুল্লচিত্তে বলে উঠল;
“আপনি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি রেডি হয়ে আসছি।”
কথাটা শেষ করে একমুহুর্ত দেরী না করে দৌড়ে গেল বাড়ির ভেতরে। সারহান সেথায় দাঁড়িয়ে রইল। দৃষ্টি জোড়া স্থির হয়ে রয়েছে সদর দরজার দিকে। হঠাৎ গম্ভীর মুখে হাসি ফুটল। বিরবির করে বলল;
“ চঞ্চলা হরিণী আমার।”

“ভাইয়া বড় মামু তোমায় ডাকছে।”
ইরফান মাথা নিচু করে বসে আছে নিজ কক্ষের ডিভানে। তার ভাবমূর্তি একদম নীরব, নিশ্চল। কেমন যেন নড়চড়হীন জড়বস্তুর ন্যায় বসে আছে। রুম জুড়ে নিস্তব্ধতা যেন তার ক্লান্ত মনের প্রতিবিম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইরফানের চক্ষুদ্বয়ে কোনো বিরহের দৃশ্য নেই অথচ ভিতরে চলেছে চিন্তার অবিরাম ঝড়। কিন্তু তা মনের ভেতরে তালাবদ্ধ এবং লুকায়িত। পুরুষালী মন বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন। ঘন কালো মেঘে ঢাকা এক অবসন্ন অম্বরের ন্যায়। অন্তঃকোণ এবং মেজাজ চঞ্চল নয়। বরং অবরুদ্ধ ক্ষোভ, হতাশা আর এক ধরনের নির্বাক যন্ত্রণার সম্মিলন। যা চোখেমুখে নিদারুণ যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলছে।এ যেন এক ভগ্নহৃদয়ের নিঃশব্দ অপেক্ষা।যার চাওয়া অপূর্ণ,ভালোবাসা উপেক্ষিত,স্বপ্ন রিক্ত।ইরফানের কাঁধদুটো ঝুলে আছে। মাথা নত এবং দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। মনে হচ্ছে, এ অসহনীয় যন্ত্রণার ভার আজ নিজেই বইতে পারছেন না এ মুহুর্তে। বক্ষপিঞ্জর অশান্ত হয়ে উঠেছে হঠাৎ তান্ডবে।
ইশরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে । তার অতিশয় ভার মুখ ভার, চক্ষুদ্বয়ে বিষন্নতার ছাপ।সে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এক নিমেষেই বুঝে ফেলে ইরফানের অন্তরজুড়ে কতখানি অন্ধকার জমে উঠেছে।তার বক্ষস্থল কেঁপে ওঠে। আপনজনের নীরব ভাঙাচোরা অবস্থা দেখে হৃদয় যেন ভারে নুয়ে পড়ে।রুমের নিস্তব্ধতা, নিরবতা ভেদ করে ইশরার নিঃশব্দ পা এসে থামে ইরফানের পাশে।সে শব্দ না করে ডিভানে বসে পড়ে একই উচ্চতায় যেন সমব্যথী হয়ে।
তার দৃষ্টিতে নেই কৌতূহল, নেই প্রশ্ন কেবল অপার মমতা আর একরাশ নীরব সহমর্মিতা। সে তপ্ত শ্বাস ফেলে। নরম কন্ঠে ডেকে উঠে ;

“ভাইয়া!”
ইরফানের কর্ণকুহরে প্রবেশ করল বোনের কোমলপ্রাণ স্বর। তার ভারাক্রান্ত মনটায় শীতল হাওয়ার স্পর্শ লাগল। বিরস মুখশ্রী উঁচিয়ে ঘাড় বাকিয়ে তাকাল ছোট বোনের দিকে। কষ্ট লুকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“কিছু বলবি?”
ইশরা মাথা নাড়িয়ে হ্যাসূচক ইশরা করল। অতঃপর বলল;
“ বড় মামু তোমায় ডেকেছে।”
“মামুকে গিয়ে বল আমি ঘুমিয়েছি।”
“তুমি মামুর সাথে দেখা করবে না?”
“পরে দেখা করব।”
“এখুনি দেখা করবে তুমি।”
ইশরা মেকি রাগ দেখিয়ে বলল। ইরফানের ইচ্ছে করছে না কারো সাথে কথা বলতে। তবুও মনের ভাব চেপে বলল;
“শরীরটা ভালোলাগছে না চড়ুই। মামুর সাথে পরে কথা বলব।”
“চড়ুই”এই ডাকনামটা ইরফানেরই দেওয়া।
শৈশবে যখন ইশরা পায়ে লেগে লেগে ঘুরে বেড়াত,যখন তার হাসির শব্দে ঘর জুড়ে উড়ত পাখির পালকের মতো কোলাহল তখনই আদরে, স্নেহে, হাসিমুখে ভাই তাকে ডাকত “আমার চড়ুইপাখি”।বড় হওয়ার পর সেই ডাক কমেছে,

জীবনের ব্যস্ততা, সময়ের দূরত্ব আর অনুভূতির ভাঁজে চাপা পড়ে গেছে অনেক কিছু।তবু, আজ অনেকদিন পরেইরফানের মুখে হঠাৎ সেই পুরনো ডাকনামটি ভেসে এল “চড়ুই”।শুনেই ইশরার বক্ষস্থল কেঁপে উঠল।চক্ষুদ্বয়ের কোণে অচেনা কাঁপন ছড়িয়ে দিলো। হৃদয়ে গুমরে উঠল উষ্ণ ঢেউ।সমস্ত শরীর যেন থেমে গিয়ে ফিরে গেল শৈশবের কোনো কোমল দুপুরে।যেখানে ইরফানের কাঁধে মাথা রেখে সে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ত।সেই এক শব্দে আজ এতগুলো আবেগ যেন হু-হু করে ফিরে এলো।ইশরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে।চোখের সামনে ভেসে ওঠে শতরঙা স্মৃতি আর হৃদয়ের গভীরে প্রতিধ্বনিত হয়
ভাইয়ের স্নেহে মোড়া সেই প্রিয় নাম।যা ছিল কেবল তার জন্যই বরাদ্দ।
“ভাইয়া, মন খারাপ করে থেকো না। তুমি আগের মতো হয়ে যাও প্লিজ। তোমাকে বিষন্ন অবস্থায় দেখতে আমার ভালো লাগছে না।”
ইশরা আবেগাপ্লুত হয়ে বলল। ইরফান মৃদু হাসল। বোনের মাথায় আদুরে হাত বলিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল;
“আমি আগের মতোই আছি চড়ুই।”

ইশরা মানল না। বিরস মুখে বলল;
“উহু তুমি আগের মতো নেই। অরিত্রিকাকে ভালোবেসে তুমি পাল্টে গিয়েছো আর এখন ওকে না পেয়ে আরো পাল্টে যাচ্ছো। তোমার আচরণ কেমন যেন রাগী,গম্ভীর লাগছে। আমি বুঝতে পেরেছি অরিত্রিকার কারণে তুমি বদলে গেছো।”
“আমি আগের মতো আছি। অরিত্রিকার জন্য আমি বদলে যাইনি।”
“আচ্ছা মেনে নেব একটা শর্তে।”
“কী শর্ত?”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫৪

“আমি একটা কিউট গলুমলু ভাবী চাই। যদি এ শর্ত মানো তাহলে মেনে নেব তুমি বদলে যাও নি।”
ইশরা একগাল হেসে বলল। ইরফানের মুখখানা গম্ভীর হয়ে গেল। সে শান্ত চাহনিতে তাকিয়ে রইল বোনের দিকে। ইশরার হাসি থেমে গেল। সে মুখটা গম্ভীর করল। বিজ্ঞদের মতো করে বলল;
“ভাইয়া, যদি সত্যিই ভালো থাকতে চাও তবে অরিত্রিকাকে ভুলে যাও। ওর স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে থাকলে তুমি কখনোই নিজের জীবনে এগিয়ে যেতে পারবে না। যতদিন ও তোমার মনে থাকবে ততদিন তুমিও অস্থির থাকবে, কষ্ট পাবে। আর তোমার এই কষ্ট আমার আর মায়ের মনকেও কষ্ট দিবে। অন্তত আমাদের কথা একবার ভাবো, আমাদের শান্তির জন্য হলেও নিজেকে মুক্ত করো অতীতের সেই বন্ধন থেকে।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫৬