প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭২

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭২
আদ্রিতা নিশি

রাত নয়টা দশ মিনিট। সবাই রাতের খাবার শেষ করে বসার ঘরে একত্রিত হয়ে আড্ডায় মেতে উঠেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আয়নাল সাহেব। তিনি সারহানের দাদার সময়কার একজন বিশ্বস্ত মানুষ। সেই বিশ্বাস ও আস্থার কারণেই বাড়িটির সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব অনেক আগেই তাকে দিয়েছেন আরশাদ সাহেব।প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এই বাড়ির দেখাশোনা করছেন আয়নাল সাহেব। তিনি এখানে স্ত্রী এবং দুই মেয়েকে নিয়ে বসবাস করেন। তার বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর আগে। সে সময় বিয়ের খরচের অর্ধেক অংশ বহন করেছিলেন আরশাদ সাহেব এবং তার ভাই আজমল সাহেব। বর্তমানে তার একমাত্র ছোট মেয়ে বিবাহযোগ্য বয়সে পৌঁছেছে। সম্ভবত খুব শিগগিরই তার বিয়ের আয়োজনও সম্পন্ন হবে।

সারহানের সাথে টুকটাক কথা বলার এক ফাঁকে আয়নাল সাহেব চোখ ফেরালেন পাশে বসা সাদাত এবং ইরফানের দিকে। সাদাতকে তিনি জন্মের পর মাত্র একবারই দেখেছিলেন—ছোট্ট এরপর আর কখনও দেখার সুযোগ হয়নি। তাই প্রথম দেখে যেন অচেনা কাউকে দেখার মতোই লাগছিল।তবে ইরফানের সাথে তার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। সারহানের সাথে গ্রামে আসার সময় ইরফান প্রায়ই সঙ্গে থাকত। সেই সুবাদে ইরফানের সাথে তার একটা ভালো পরিচয় গড়ে উঠেছে। ইরফানও বেশ নম্র-ভদ্র ছেলে। তিনি তাকালেন ইরফানের দিকে। সাবলীলভাবে জিজ্ঞেস করলেন;

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“বাবা!তুমি বিয়ে করোনি এখনো?”
রাহা, অরিত্রিকা ও ইশরা চেয়ারে বসে ছিল। এহেন প্রশ্নে তারা সরাসরি তাকাল ইরফানের দিকে। সারহান নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে থাকলেও সাদাত আগ্রহী হয়ে তাকাল পাশে বসা ভাইটার দিকে। ইরফান অপ্রস্তুত হলো। ইতস্তত বোধ করল। তবে তা প্রকাশ না করে স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“বিয়ে করার কথা এখনো ভাবিনি।”
“এটা কেমন কথা? বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। তোমার মামাতো ভাই বিয়ে করে সংসারি হয়ে গেল অথচ তুমি এখনো বিয়ে করোনি। মেয়ে খুঁজে দেবো? ”
“বাড়ি থেকে মেয়ে দেখছে। কাউকে পছন্দ হলে বিয়ে করে নেবো। আপনার মেয়ে খোঁজার দরকার নেই।”
“দ্রুত বিয়েটা সেড়ে নাও বাবা।”

আয়নাল সাহেব উপদেশমূলক কণ্ঠে কথা বললেন। ইরফান শুধু মাথা নাড়িয়ে তার কথায় সায় দিল কিন্তু মুখে কিছু বলল না। পরিস্থিতি এমন ছিল যে সবার সামনে তাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও মিথ্যা বলতে হলো। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। ইরফানের মতো একজন শান্ত, সৎ ছেলের মুখে মিথ্যা শুনে কেউ বিশ্বাস করতে পারলো না।তবে সারহান নীরবে হাসল। সবার অগোচর হলো সেই হাসি।তার মনে পড়ল ছেলেটা একসময় বিপদে পড়লে কিংবা ভুল করে ফেললে তারা দুজন মিলে দিব্যি সত্যি সত্যি ভাব দেখিয়ে মিথ্যা বলে পার পেয়ে যেত।আজ সেই ইরফান নিজেকে কথার বেড়াজাল থেকে বাঁচাতে মিথ্যা বলে দিল। সারহান ইরফানের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর হালকা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল। ছোটবেলার বন্ধুর সাথে এখন মন খুলে কথা বলা হয় না, কোনো কিছু শেয়ার করা হয়না। ভালোবাসাকে নিজের করে নিতে গিয়ে সে আজ বন্ধুত্ব নামক পবিত্র সম্পর্কে ফাটল ধরিয়ে ফেলেছে। সে চায়নি এমন হোক— চায়নি ইরফান কষ্ট পাক। কিন্তু কীভাবে যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল।
চিন্তায় ডুবে যেতে যেতে সারহানের মনে বিষাদ নেমে এলো। সে এক তপ্ত শ্বাস ফেলে চোখ তুলল আয়নাল সাহেবের দিকে। ওষ্ঠকোণের হাসি লুকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল;

“ ইরফানের বিয়েটা খুব শীঘ্রই দিয়ে দেবো। নাটোর থেকে ফিরে বিবাহ অভিযান শুরু করা হবে।”
ইরফান তাকাল সারহানের দিকে। আয়নাল সাহেব হেসে বললেন;
“শুভ কাজে দেরী করতে নেই। তোমরা গল্প করো আমি একটু আসছি।”
আয়নাল সাহেব সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন। তখনি সাদাত গোয়েন্দার মতো ভাব নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল ;
“ইরফান ভাই! তুমি আমাদের সামনে মিথ্যা বলতে পারলে?”
ইরফান হাসল;
“তাহলে কি বলতাম? আমার বলার মতো কিছুই ছিল না সাদাত।”
“তোমায় দেখে মাঝে মাঝে অবাক হই। তোমার ভাবসাব দেখে মনে হয় সারহান ভাইয়ের ভূত তোমার ওপর ভর করেছে।”

“বন্ধুর ঘাড়ের ভূত আরেক বন্ধুর ঘাড়ে ভর করতেই পারে।”
“কিন্তু আমি কেন তোদের বন্ধুত্ব এখন আর দেখতে পাই না? তোমরা দুজনে দেখা হলেও কথা বলো না।”
“কথা না বললে বন্ধুত্ব নষ্ট হয় না। বন্ধুত্বের সম্পর্কটা রক্তের সম্পর্কের থেকে গভীর। এটা আত্মার সম্পর্ক! সামান্য বিষয়ে বন্ধুত্ব শেষ হবে না। যদি হয় তবে ভাববি সে তোর বন্ধুই ছিল না।”
ইরফান এবং সাদাতের কথোপকথনের মাঝে সারহান বিরস কন্ঠে বলে উঠল। ইরফান সমর্থন করে বলল;
“সারহান ঠিক বলেছে। একটা বিষয় নিয়ে দুজনের মধ্যে মনমালিন্য হয়েছিল। তবে আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়নি সাদাত।”
সাদাত সন্দেহবাতিক কন্ঠে বলল;

“তাহলে দুজন কথা বলো না কেন?”
“কে বলেছে কথা বলি না? টুকটাক কথা হয় আমাদের। বিশ্বাস না হলে সারহানকে জিজ্ঞেস কর।”
ইরফান বেশ জোর দিয়ে বলল। সাদাত সারহানকে উদ্দেশ্য করে বলল ;
“ তোমাদের বন্ধুত্ব আগের মতো হয়ে গেছে ভাই?”
সারহান পাশে বসা ইরফানের কাঁধ চাপড়ে স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কের কবে কি হয়েছিল? সব আগের মতোই আছে।”
সাদাত চোখ দুটো সংকুচিত করে বলল;
“দুজনেই মিথ্যাবাদী, পল্টিবাজ। ”

সারহান ও ইরফান চোখ গরম করে তাকাল। অরিত্রিকা, ইশরা ও রাহা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। সাদাত ও তাল মিলিয়ে হাসল। কতোদিন পর সবাই আগের মতো মন খুলে হাসছে। মনে হচ্ছে সেই অতীতে ফিরে যাচ্ছে। অরিত্রিকা হাসি বজায় রেখে খোঁচা দিয়ে বলল;
“তোর বড় ভাই আগে থেকেই পল্টিবাজ। উনাকে আমি একবার গার্ডদের সামনে পল্টিবাজ বলে ডেকেছিলাম। তখন উনার মুখ দেখার মতো ছিল।”
এ কথা শুনে পুনরায় সবাই হাসল। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে যোগ দিল ইরফান। সারহানকে জ্বালাতে হাস্যরত অবস্থায় বলল;

“ভাই তুই পল্টিবাজ — এটা তোর বউ অব্দি আগে জেনে গিয়েছিল। গার্ডদের সামনে যখন পল্টিবাজ বলে ডেকেছিল তখন কেমন লেগেছিল ব্রো? ”
সারহান জ্বলন্ত চাহনি তাকাল ইরফানের দিকে। ইরফান চাহনি দেখেও হেসে যাচ্ছে। অরিত্রিকা কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলল;
“জানেন ইরফান ভাই! সারহান ভাইকে পল্টিবাজ কেন বলেছিলাম? উনি প্রথমে বলেছিল গোলাপফুল পছন্দ করেন। পরে পল্টি মে*রে বলেন উনার গোলাপফুল পছন্দ না। তাই সুন্দর, ইউনিক নামটা রেখেছিলাম।”
ইরফানের হাসির মাত্রা বাড়ল ;

“পল্টিবাজ সারহান! নাইস নেইম।”
সারহানের বিরক্তির মাত্রা বাড়ল। এতোদিন আবির, অরিত্রিকা জ্বালিয়ে মে*রেছে। এখন তাদের সাথে যোগ দিয়েছে ইরফান! এখানে আর এক মুহুর্ত থাকলে নিশ্চিত মেজাজ বিগড়ে যাবে। সে বিরক্তির সহিত চ বর্গীয় উচ্চারণ করে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। ভরাট কন্ঠে বলল;
“অনেক রাত হয়েছে। পাগলের মতো হাসা বাদ দিয়ে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে যা।”
ব্যস এতটুকু বলে সারহান চলে গেল। তা দেখে সবাই হাসল। কিছুক্ষণ পরে সাদাত, ইরফান নিজেদের বরাদ্দকৃত রুমে চলে গেল। ইশরা ও রাহা হাসি থামিয়ে হাঁটা শুরু করল। অরিত্রিকার মন মেজাজ ফুরফুরে। মনটা ভীষণ শান্ত। তার ঘুরতে আসাটা মোটেও বৃথা যায়নি বলে মনে হলো। সারহান এবং ইরফানের মাঝে নিরব দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটল। সে তৃপ্ত শ্বাস ফেলল। চেয়ার থেকে উঠে রুমের দিকে যেতে লাগল।

রাত কেটে সকাল হয়েছে। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। চারপাশে স্নিগ্ধ, শীতল আবহাওয়া। প্রকৃতির এই শান্ত-নির্জন পরিবেশে অন্যরকম প্রশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে। ঘড়ির কাটায় তখন সাড়ে সাতটা। তারা বেগম নামাজ আদায় করে মাটির উনুনে রান্না শুরু করেছিলেন। অতিথিদের আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখার পাত্র নন তিনি। গত দুই ঘণ্টা ধরে পরিশ্রম করে একের পর এক সুস্বাদু পদ রান্না করেছেন ভুনা খিচুড়ি, গরুর মাংস, আলু-বেগুনের চাপ ভাজি পায়েস।সবই নিজের হাতে প্রস্তুত। রান্না শেষে একে একে সব খাবার সাজিয়ে রাখলেন ডাইনিং টেবিলে।
আয়নাল সাহেবও সকালেই বেরিয়ে পড়েছিলেন বাজারে টাটকা মাছ, মাংস আর সবজি কিনতে। বাড়িতে অতিথি এসেছে, তাই মেহমানদারিতে যেনো কোনো ঘাটতি না হয় সে ব্যাপারে তিনি সদা সতর্ক। বের হওয়ার আগে সবাইকে বলে গেছেন যেন ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে নাস্তা করে নেয়।

অরিত্রিকা ইতোমধ্যেই ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে ফিরে এসেছে। নিচে সবাই উপস্থিত শুধু সারহান নেই। তার অনুপস্থিতি অরিত্রিকার মনে অস্বস্তি জাগায়। সারহান ভাই তো এই সময়ের মধ্যে উঠে পড়ার কথা তাহলে এখনো উঠল না কেন?চিন্তিত মনে সে দ্রুত পায়ে হেঁটে সারহানের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজাটি হালকা চাপানো সম্পূর্ণ বন্ধ নয়। কোনো কিছু না ভেবে অরিত্রিকা আলতোভাবে দরজার পাল্লা ঠেলে নিঃশব্দে রুমে প্রবেশ করল।
রুমটা হালকা অন্ধকার। কাঠের জানালার পাল্লার ফাঁকফোকর দিয়ে ক্ষীন আলোয় আশপাশ কিছুটা স্পষ্ট। সে সাবধানী পায়ে ধীরস্থিরে এগিয়ে যায় বিছানার দিকে। সেদিকে তাকাতেই দেখতে পায় সারহান শার্ট বিহীন শরীরে কাঁথা জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। সে মৃদু স্বরে বেশ কয়েকবার ডাকল। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পেল না। অরিত্রিকা ক্ষীণ আলোয় ঘুমন্ত মানুষটার অবয়ব দেখতে পেল। সে খানিকটা ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে পুরুষালি বাহু ঝাকি দিল। মৃদু কন্ঠে বলল;

“উঠুন সারহান ভাই! আর কতোক্ষণ ঘুমাবেন? নাস্তা করার জন্য ডাকছে আন্টি।”
সারহান নড়েচড়ে উঠল। চক্ষুদ্বয় বন্ধ রেখে ঘুম আচ্ছন্ন কন্ঠে বলল;
“ডোন্ট ডিস্টার্ব মি জান!”
অরিত্রিকা ঠাস করে বসে পড়ল বিছানায়। সারহান ভাই তাকে জান বলে ডাকলেন! ভাবতেই মস্তিষ্ক অচল হয়ে গেল। শরীর শিরশির করে উঠল। তন্দ্রাচ্ছন্ন কন্ঠস্বর যেন প্রতিধ্বনি হতে লাগল। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল সারহানের দিকে। এটা কি আদৌও সারহান ভাই নাকি অন্য কেউ? অচল হওয়া মস্তিষ্ক নিয়ে কিয়ৎ সময় থম মেরে বসে রইল। ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে অতি শান্ত কন্ঠে ডাকল;

“উঠুন।”
সারহান নিশ্চুপ! অরিত্রিকা পুনরায় ঘুমন্ত মানুষটার বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে ডাকল। তখনি তড়িৎ বেগে একটা পুরুষালি শক্তপোক্ত হাত এসে মেয়েলী বাহু ধরে হেঁচকা টান দিলো। অরিত্রিকা আচানক এমন হওয়ায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল সারহানের নগ্ন বুকে। সে থমকে গেল! সম্পূর্ণ শরীর কেঁপে উঠল। মাথা উঁচিয়ে হতবিহ্বল হয়ে আবছা অবয়বের দিকে তাকাল। সারহানের ঘুম উবে গেছে। এক দৃষ্টি তাকিয়ে আছে মেয়েলী মুখশ্রীতে। তার ইস্পাত দৃঢ় হাত দুটো মেয়েলী কোমড় ছুঁয়েছে।
“ডিস্টার্ব করতে নিষেধ করেছিলাম।”

সারহানের কন্ঠস্বর শীতল শোনাল। অরিত্রিকা থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসল। পুরুষালি প্রশস্ত বুকের উষ্ণতা অনুভব করতেই দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। দৃষ্টি নিচু করে হাঁপানি রোগীর ন্যায় বলল;
“আপনাকে নিচে ডাকছে।”
সারহান উপলব্ধি করল অরিত্রিকার কাঁপন। সে আস্তে করে অরিত্রিকাকে বিছানার এক প্রান্তে শুয়ে দিয়ে এক হাতে ভর করে ঝুকে ওষ্ঠ কামড়ে হাসল। অরিত্রিকার মুখের ওপর পড়ে থাকা এলোমেলো চুল গুলোতে ফু দিয়ে বলল;
“আমাকে কেন ডাকছে?”
“না..স্তা করতে।”
“এই মুহুর্তে নাস্তা করতে ইচ্ছে করছে না।”
“কেন?”

“মুড চেঞ্জ হয়েছে। এখন অন্য কিছু করতে ইচ্ছে করছে।”
সারহান দুষ্টস্বরে বলল।অরিত্রিকার চক্ষুদ্বয় বড় হয়ে গেল যেন হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটল। মন শঙ্কিত হলো। সে শুকনো ঢোক গিলে। দুহাতে প্রশস্ত শরীরটা দুহাতে ঠেলে হটানোর প্রয়াস করে কম্পনরত কন্ঠে বলল;
“কি করতে ইচ্ছে করছে?”
সারহান হাসি থামিয়ে কন্ঠ খাদে নামিয়ে সুগভীর কন্ঠে বলল;
“গভীর ভাবে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে।”
“আপনি এসব কি বলছেন? সকাল হয়ে গেছে অথচ আপনার ঘুমের ঘোর কাটেনি।”
“ঘুমের ঘোর কেটে গেছে অনেক আগে। কিন্তু তোর ঘোর কাটছে না। বাহিরে বৃষ্টি পড়ছে। রোমান্টিক ওয়েদার। একদম পারফেক্ট সময়।”

“রাতে বলেছিলাম সেই কথাটার জন্য প্রতিশোধ নিচ্ছেন?”
“ভালোবাসা যদি প্রতিশোধ হয়! তাহলে সেই প্রতিশোধ নিতে সদা প্রস্তুত আমি।”
সারহান অন্যহাতে অরিত্রিকার নরম গাল স্পর্শ করে বলল। অরিত্রিকার ইচ্ছে করল বিছানায় মিশে যেতে। তার মস্তিষ্কশূন্য! কি করা উচিত এসময়? সে ঘাড় বাকিয়ে পাশে তাকাল। দেখল দরজা আধ খোলা! সে পুনরায় দৃষ্টি ফেরালো। ওষ্ঠ ভিজিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল;

“দরজা খোলা। কেউ চলে আসবে। ছাড়ুন আমায়।”
সারহান বিরক্তি সূচক চাহনিতে তাকিয়ে রুঢ় কন্ঠে বলল;
“বিয়ে করেও শান্তি নেই। তোর কাছে আসলেই দরজা খোলা, কেউ দেখে ফেলবে এসব বাহানা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করিস অথচ অন্য সময় যন্ত্রমানব, নিরামিষ বলে আখ্যা দিস! এটা কি আদৌও ঠিক করিস?”
“না বুঝে ওসব বলেছি আর কখনো বলব না। এবার ছাড়ুন।”
“ছাড়ব! তবে আমার একটা শর্ত আছে।”
“কি শর্ত?”
“আই ওয়ান্ট অ্যা ডিপ কিস!”

অরিত্রিকার কর্ণদ্বয় ঝাঝা করে উঠল। লজ্জায় গাল দুটো গরম হয়ে আসলো। মানুষটা এসব কি বলছে? সরাসরি নির্লজ্জের মতো বলতে পারল। সে নিজেকে গুটিয়ে নিল। অস্বস্তি, লাজুক কন্ঠে বলল;
“পারব না।”
সারহান পূর্বের ন্যায় বলল;
“তাহলে আমার কাছে থেকে ছাড়া পাওয়ার কথা ভুলে যা। বিয়ে করে বউয়ের সামনে ভদ্র সেজে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।”
“অসভ্য!”
“সভ্য আর থাকতে দিচ্ছিস কই? আমার কথা মানবি নাকি…”
“আচ্ছা মানছি।”
“গুড! ”

সারহান বিশ্বজয়ের হাসি হাসল। অরিত্রিকা অসহায় চাহনিতে তাকাল। মুখশ্রীতে ভর করে লাজুকতা। অন্তঃকোণ হাস ফাঁস করে উঠছে। অজানা অনুভূতিতে দিশেহারা লাগছে। সে কম্পনরত হাত উঁচিয়ে সারহানের ঘাড় কাছে রাখল। নরম হাতে আলতো করে টানল। সারহান অতিব আশ্চর্যিত হলো। সে অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকাল আবছা মেয়েলী অবয়বে। মেয়েটা সত্যি তার কথা মানল? কেমন যেন সন্দেহ জাগল। অরিত্রিকা তখন মাথাটা উঁচায়। পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে তার ওষ্ঠদ্বয় সারহানের গালে ছুঁইয়ে সুযোগ বুঝে হন্তদন্ত হয়ে বিছানা থেকে এক লাফে নেমে দূরে গিয়ে দাঁড়াল। সারহান হতভম্ব হয়ে উঠে বসল।
“ভাইয়া আপনাকে বাবা ডাকছে।”

মেয়েলী কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই সারহান এবং অরিত্রিকা দরজার দিকে তাকাল। একটা মেয়েকে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সারহান শরীরে কাঁথা জড়িয়ে হতভম্ব ভাব ভুলে গম্ভীর কন্ঠে বলল;
“চাচাকে গিয়ে বলো আমি আসছি। “
মেয়েটা মাথা নাড়িয়ে বলল;
“আচ্ছা।”
বলে চলে গেল। অরিত্রিকার কাছে মেয়েটা অচেনা মনে হলো। সে তাকাল সারহানের দিকে। লাজুক ভাব আড়াল করে জিজ্ঞেস করল ;
“মেয়েটা কে?”
সারহান বিছানা থেকে নেমে জবাব দিল;
“ আয়নাল চাচার ছোট মেয়ে তানহা।”
অরিত্রিকার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। সে কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল আর সারহান ফ্রেশ হতে চলে গেল।

সকালের নাস্তা শেষে সবাই বাড়ির পেছনের পুরনো পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। শানবাঁধানো পুকুরটি প্রায় দুইশো বছরের পুরনো। চারপাশে নীরব। কেবল পাখির কিচিরমিচির আর হালকা বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে। পরিবেশটা এতটাই নিবিড় ও মনোরম যে অল্প সময়েই মন ও মস্তিষ্ক প্রশান্ত হয়ে ওঠে।পুকুরটির পানি উপচে পড়ার মতো ভরা আর গভীরতাও চোখে পড়ে। পাড়ে বসে ইশরা এক দৃষ্টিতে পানির দিকে তাকিয়ে আছে চুপচাপ, ভাবনায় ডুবে। তার পাশেই রাহা বসে আছে নীরব সঙ্গী হয়ে। একটু দূরে ইরফান দাঁড়িয়ে কারও সঙ্গে কথোপকথনে ব্যস্ত। অন্যদিকে, পুকুরপাড়ের একটু উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে সাদাত সবার অলক্ষ্যে ক্যামেরা ইশরার ছবি তোলায় ব্যস্ত।অরিত্রিকা ও সারহান কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে।দুজনে চুপচাপ পানির দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।
ইরফান কথা বলা শেষ করে এসে সারহানের পাশে দাঁড়াল। পুকুরের দিকে তাকিয়ে বলল;

“চল! পুকুরে নামি। এই সুযোগে একটা সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতা হয়ে যাবে।”
সারহান পানিতে দৃষ্টি স্থির রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“আজ নয় অন্য একদিন।”
“হেরে যাওয়ার ভয় পাচ্ছিস?”
“সারহান কখনো হারে না।”
“তাহলে পুকুরে নামতে চাইছিস না কেন?”
ইরফান প্রশ্ন করল। সারহান স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“ইচ্ছে করছে না।”
ইরফান কিছু বলল না। সে পুকুরের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। অরিত্রিকা গভীর ভাবনায় বিভোর হয়ে জিজ্ঞেস করল;

“পুকুরে কি কুমির থাকে? ”
সারহানের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ল। ত্যাছড়া কন্ঠে বলল;
“পুকুরে ছাগল, গরু, হাতি, কুমির সব আছে।”
“আপনি এমন কেন? যা বলেছি সেটার উত্তর দিন।”
“দুইশ বছর পুরনো পুকুরে কুমির না থাকলেও কঙ্কাল থাকতে পারে।”
“সত্যি!”
অরিত্রিকা হতবাক হয়ে বলল। সারহান মেজাজ সংবরণ করে বিরবির করে বলল;
“ষ্টুপিড।”

অরিত্রিকা বিস্ময়ে চমকে উঠে চক্ষুদ্বয় বড় করে পুকুরের দিকে তাকিয়ে রইল। পুকুরের নিস্তরঙ্গ পানিতে কুমিরসদৃশ একটি প্রাণী ধীরে ধীরে সাঁতার কেটে চলেছে। দৃশ্যটা যেন অবিশ্বাস্য! সে স্তব্ধ হয়ে রইল মূর্তির মতো অনেকক্ষণ ধরে অপলক দৃষ্টিতে সেই দৃশ্য দেখে যেতে লাগল। খানিক পরে লাফিয়ে উঠে উচ্ছসিত ভাব নিয়ে বলল;
“সারহান ভাই! ওই দেখুন কুমির।”
সারহান বিস্ময়ে অভিভূত হলো খবরটা শুনে। পুকুরে কুমির! এমনটা কীভাবে সম্ভব? সংশয় আর কৌতূহলে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুকুরের দিকে তাকাল। চোখে পড়ল হলুদ আর কালো রঙের সাঁতার কাটা প্রাণীর দিকে।সেটা ধীরে ধীরে পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যটা স্পষ্ট হতেই তার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল, মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠল। অরিত্রিকার দিকে তাকিয়ে রুঢ় গলায় বলল;

“ষ্টুপিড! ওটা কুমির না গুইসাপ।”
সারহানের কথা শেষ হতেই পেছন থেকে সাদাত চিৎকার দিয়ে বলল;
“গ্রামে সান্ডা কোথায় থেকে এলো? এই সান্ডা তো সাঁতার কাটতে পারে। গাইস চলো সবাই সান্ডা ধরে কপিলকে দিয়ে আসি।”
ইশরা এবং রাহা ভয়ে বসা থেকে উঠে পড়ল। তারা দৌড়ে উপরে চলে আসল। দুজনে ভয়াতুর ভঙ্গিতে বলে উঠল ;
“কোথায় সান্ডা?”
সাদাত দুজনকে হাত দিয়ে ইশারা করে পানিতে ঘুরে বেড়ানো গুইসাপকে দেখিয়ে বলল;
“ওই যে সান্ডা মনের সুখে সাঁতার কাটছে।”

সারহান হতাশ হয় ওদের কথাবার্তা শুনে। এরা এতোটা অবোধ কেন? সান্ডা আরবের মরুভূমিরতে পাওয়া যায় আর কুমির পাওয়া যায় নদীতে। ইরফান কথোপকথন শুনে শব্দ করে হেসে বলল;
“ওটা সান্ডার মামাতো ভাই গুইসাপ।”
সারহান এবং ইরফান বাদে সবার উচ্ছসিত ভাব ধপ করে নিভে গেল। তাদের মুখ গুলো চুপসে ছোট্ট হয়ে গেল। সারহান বিরক্তিপ্রকাশ করে বলল;
“এরা আদৌও পৃথিবীতে বাস করে নাকি ভিন্নগ্রহে বসবাস করে?”
ইরফান বলল;
“শহর নামক ভিন্নগ্রহে বসবাস করে। এলিয়েন এরা।”
রাহার কথাটা গায়ে লাগল। গমগমে কন্ঠে বলল;
“আপনি আমাদের এলিয়েন বললেন?”
“হ্যা বলেছি।”

“আপনি কি জানেন? শহরের রাস্তা ঘাটে ফেলে রাখা নষ্ট ইয়ারফোন।”
ইরফান কিছু বলতে যাবে তখনি ইশরা বিস্মিত কন্ঠে বলল;
“তুমি আমার ভাইকে নষ্ট ইয়ারফোন বললে?”
রাহা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল;
“ইয়েস।”
ব্যস এতটুকু কথা নিয়ে তিনজনের কথা বাড়তে লাগল। সাদাত উপায়ন্তর না পেয়ে রেফারির দায়িত্ব পালন করতে লাগল। অরিত্রিকা তিনজনের অদ্ভুত ঝগড়া দেখে কপাল চাপড়ালো। এভাবে কেউ ঝগড়া করে? সে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। হতাশ হয়ে তাকিয়ে সারহানকে উদ্দেশ্য করে বলল;
“রাহা ইরফান ভাইকে ভালোবাসে! এখন ঝগড়া দেখে মনেই হচ্ছে না।”
সারহান শান্ত কন্ঠে বলল ;

“ দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়া থেকে প্রণয়ের সূচনা হয়। আমাদের ক্ষেত্রেও তেমনটায় হয়েছে।”
অরিত্রিকা জিভ কাটল। রাহা যে ইরফান ভাইকে ভালোবাসে সেটা সারহান ভাইকে বলে দিল? এখন কি হবে? সে অসহায় চাহনিতে তাকাল মানুষটির দিকে। সারহান অরিত্রিকার মুখশ্রী দেখল। স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে বলল;
“আমি জানি, রাহা ইরফানকে ভালোবাসে। তাই এনগেজমেন্ট না করে পালিয়ে এসেছে। এটা অবশ্য তুই এবং আমি ব্যতিত আরও একজন জানে। তিনি হলেন রাহার বাবা।”
অরিত্রিকা বিস্ময়াভিভূত কন্ঠে বলল;

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭১

“আপনি আর আংকেল কিভাবে জানলেন?”
“রাহা আমাকে বলেছে আর আমি ওর বাবাকে বলেছি।”
“এই মেয়ের এতো সাহস?”
“ভালোবাসলে প্রকাশ এবং স্বীকার করার সাহস থাকতে হয়।”
“ইরফান ভাই তো রাহাকে ভালোবাসে না?”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৩