প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৭

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৭
আদ্রিতা নিশি

“ইউটিউবে কোন রাধুনীর রান্না দেখে পায়েস রান্না করতে গিয়েছিলি?”
অরিত্রিকা সারহানের রুমে বিছানায় গুটিশুটি মে*রে বসে আছে। শরীরটা ক্লান্ত, অবস্থা মোটেও ভালো নয়। একটুখানি পায়েস খেয়ে যে এত বিপদে পড়তে হবে সেটা কখনো কল্পনাও করেনি। আধাঘণ্টা ধরে ওয়াশরুমে আটকে ছিল। পেটের ভেতরের অবস্থা একদম উলটে-পালটে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কিছুতেই আজ বেঁচে ফিরবে না। নিজের বানানো জঘন্য পায়েস খেয়ে অক্কা পাবে। সে পায়েস বানানো মনোযোগ সহকারে দেখে রান্না করেছিল। রান্নার পর এতটা খারাপ অবস্থা হবে, তা ভাবেনি।

নিজের প্রতি এক ধরনের হতাশা কাজ করছে।যেমন একজন পরাজিত সৈনিক যুদ্ধ ছেড়ে চলে যায়। এতটা কষ্ট করে পায়েসটা বানিয়েছিল সবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, কিন্তু ভাগ্য খারাপ, কেউ খেতে পারল না। ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পর সারহান তাকে রুমে নিয়ে এসেছিল। কিছু সময় বিশ্রাম নিল। তারপর সবাই যখন চিন্তা করে দেখতে এসেছিল, তখন ধীরে ধীরে উঠে বসেছিল।সবাই অনেক চিন্তিত।কিন্তু সারহান একদম শান্ত ভাবে বলেছিল, “পায়েসের কারণে হয়েছে, চিন্তা করার কিছু নেই।” এভাবেই একপ্রকার সবাইকে শান্ত করেছিল। অরিত্রিকা কিছুটা সান্ত্বনা পেল। মনে হল, যতটা না শরীরের ক্লান্তি, তার থেকে বেশি মনের শান্তি দরকার ছিল। এতোক্ষণ বসে নিজের গর্দভের ন্যায় কর্মকান্ডের স্মৃতি চারণ করছিল। হঠাৎ পুরুষালি গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতেই ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়া ডাগর আঁখিযুগল মেলে ডিভানে বসা সারহানের দিকে তাকাল। চুপসে যাওয়া মুখখানা শুকিয়ে গেল। ঝিমিয়ে ওঠা কন্ঠ নিয়ে বলল;

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“বিখ্যাত রাধুনী কেকা ফেরদৌসীর।”
সারহানের ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল রাধুনীর নামটা শুনে। সে এই নামটা শুনেছে এবং সোশাল মিডিয়াতে মহিলার আজব রান্নার সমালোচনা দেখেছে। সে হঠাৎ অসহায়বোধ করে। বউয়ের হাতের রান্না খাওয়ার ইচ্ছে উবে যায়। সে তর্জনী আঙ্গুল কপালে ঘষে। শুকিয়ে যাওয়া মেয়েলী মুখশ্রীতে তাকিয়ে থমথমে গলায় বলে;
“তোর রান্না করার দরকার নেই ফাইরুজ। মা, চাচী উনারা রান্নার দিকটা দেখে নিবে। তুই আর পাকনামো করে কেকা আন্টির রেসিপি রান্না করিসনা। তোর স্পেশাল রান্না খেয়ে পেট খারাপ করতে চাই না।”
অরিত্রিকা নেত্রপল্লব ঝাপটালো। নিবিড় চাহনিতে পরখ করল বসে থাকা মানুষটিকে। হঠাৎ ক্লান্তি ভাব ভুলে ত্যাড়া কন্ঠে বলল;

“আমি এতোটাও খারাপ রান্না করি না যে খাবার খেলে পেট খারাপ হয়ে যাবে।”
“তাই! তাহলে সামান্য পায়েস খেয়ে উল্টে পড়ে আছিস কেন?”
“কই উল্টে পড়ে আছি? এই দেখুন একদম সুস্থ শরীরে বসে আছি।”
“তোর রান্না করা ভালোবাসা মিশ্রিত পায়েস কিন্তু এখনো আছে। এনে খাইয়ে দিবো?”
“না.. না।”
অরিত্রিকা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে আঁতকে উঠে বলল।সারহান পুরূ কন্ঠে বলল;
“তোর ভালোবাসা মিশ্রিত পায়েসের অনেক পাওয়ার। যে খাবে তার উইকেট পড়বে।”
অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় ছোট হয়ে গেল। মানুষটা তাকে অপমান করল? এর শোধ তুলবে। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে গমগমে কন্ঠে বলল;

“আপনি আমায় ইন্ডাইরেক্টলি অপমান করছেন?”
“উহু!ডাইরেক্টলি অপমান করছি। তেতো কফি, বিশ্রি স্বাদের পায়েস দেখে তোর হাতের রান্না খাওয়ার শখ পালিয়ে গেছে।”
“এখন তো আমার সব কাজ খারাপ লাগবেই।”
“আমি কখন বললাম তোর সব কাজ খারাপ লাগবে?”
“এখনই তো বললেন আমার হাতের রান্না খাওয়ার শখ পালিয়েছে।”
অরিত্রিকা ওষ্ঠ উল্টে অভিমানী কন্ঠে বলল। সারহান দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। মেয়েটা বয়স উনিশ বছর অথচ বাচ্চামিতে এক ধাপ এগিয়ে। সে ডিভান থেকে উঠে আসে। দূরত্ব মিটিয়ে অরিত্রিকার শরীর ঘেষে বসে। একহাত বাড়িয়ে মেয়েলী শরীরটা সন্নিকটে টেনে অন্য হাত অভিমানিনীর গালে স্পর্শ করে কোমল কন্ঠে বলে;

“সামান্য কথায় কেউ মন খারাপ করে?”
অরিত্রিকার অভিমান গাঢ় হয়। মুখখানা ভার করে নাক টেনে ভেজা কন্ঠে প্রতিত্তোর করে;
“আপনার কাছে সামান্য কথা হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে সামান্য কথা না। আপনি জানেন, আমি কতো কষ্ট করে পায়েস বানিয়েছিলাম।”
“আমি জানি। তোর কোনো দোষ নেই। সব দোষ কেকা আন্টির।”
“হু! ”
“শরীর সুস্থ লাগছে? অসুস্থ লাগলে বল ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব।”
“ডক্টরের কাছে যাওয়া লাগবে না। শরীর সুস্থ লাগছে।”

অরিত্রিকা সারহানের কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে রিনরিনে কন্ঠে বলল। সারহানের মনটা শান্ত হলো। অরিত্রিকার হঠাৎ ওমন অবস্থা দেখে তার মনে যেন ঝড় বইছিল। বক্ষপিঞ্জরে শঙ্কায় প্রতীয়মান হয়েছিল। আরেকটু হলে দুশ্চিন্তায়, আতংকে তার অবস্থা বেগতিক হয়ে যেত। সামান্য অসুস্থতা তার কঠিন মনকে টলিয়ে দিয়েছে। সেখানে যদি আরও গুরুতর কিছু হয় তখন কিভাবে নিজেকে সামলাবে তা নিয়ে ভয় হয়।
“শালিকা, তুমি নাকি পারমানবিক পায়েস বানিয়েছো?”
আবিরের কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই অরিত্রিকা সারহানের নিকট থেকে ছিটকে দূরে চলে গেল। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। মুখখানা কাচুমাচু করে চাইল সামনে। আবির হেলেদুলে প্রবেশ করল রুমে। দাঁত কেলিয়ে হেসে বন্ধুর পাশে বসে কৌতুকপূর্ণ কন্ঠে বলল;

“শ্লা! রুমের দরজাটা অন্তত বন্ধ করতে পারতিস।”
সারহানের কপালের মধ্যাংশে ভাজ পড়ল। বিরক্তিপ্রকাশ বলল;
“কারো রুমের আসার আগে নক করতে হয় জানিস না?”
আবিরের হাসির মাত্রা বাড়ল ;
“ভুলেই গেছিলাম, বন্ধু আমার নতুন বিবাহ করিয়াছে।”
অরিত্রিকা অতি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। সারহান আবিরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। প্রশ্নাত্মক কন্ঠে বলল ;
“কেন এসেছিস আগে বল?”
“দুইদিন পরে জনসভার ডেট ফিক্সড করা হয়েছে আর পুলিশের ডিআইজি তোর সাথে এখনই কথা বলতে চান সেটা জানাতে এসেছি।”

“ওই বিচকে পেয়েছে?”
“বিচ কে না পেলেও অন্যকিছু পেয়েছে। উনার সাথে দ্রুত কথা বল।”
“হুমম।”
সারহান গম্ভীর স্বর তুলে বলল। অতঃপর বিছানা থেকে উঠে ফোনটা নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। আবির অরিত্রিকার দিকে তাকাল। রসিকতা করে বলল;
“শালিকা, পারমানবিক পায়েস খেয়ে কেমন বোধ করছো?”
অরিত্রিকা লাজুক ভাব আড়াল করে আমতা আমতা করে বলল;
“এই তো ক্লান্ত, দুর্বল অনুভব করছি। আপনার জন্য কিন্তু আলাদা করে পায়েস উঠিয়ে রেখেছি। যাওয়ার আগে অবশ্যই খেয়ে যাবেন।”

“না না আমি খাবো না। তুমি বরং আমার ভাগের পারমানবিক পায়েসটা তোমার দুষ্ট বরকে ভালোবেসে খাইয়ে দিও। এতে পারমানবিক বোমার মতো তোমাদের ভালোবাসা শক্তিশালী হবে।”
“শুধু আমরা কেন? আপনার আর,অরিন আপুরও ভালোবাসা শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন আছে।”
“বিয়ের পর ভালোই কথা বলতে শিখেছো দেখছি। বন্ধুর হাওয়া লেগেছে বুঝতে পেরেছি।”
কথাটি বলে শব্দ করে হাসল আবির। অরিত্রিকা মৃদু হাসল। আবির বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা সারহানের দিকে এক তাকিয়ে অরিত্রিকাকে উদ্দেশ্য করে চাপা স্বরে বলল;
“শালিকা! দুলাভাই হিসেবে একটা কথা বলি?”
অরিত্রিকা হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলল;

“বলুন।”
“তোমার বরটাকে চোখে চোখে রেখো।”
“কেন?”
অরিত্রিকা কৌতূহলী ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করল। আবির হাসি থামাল। মুখখানা সিরিয়াস করে নিচু স্বরে জবাব দিলো;
“সারহানের বিয়ের খবরটা সোশ্যাল মিডিয়াতে ঝড় তুলেছে। হঠাৎ ইয়াং এমপির বিয়ে হওয়াটা অনেকে মেনে নিতে পারছেনা। তাদের মধ্যে প্রথম শাড়িতে আছে অবিবাহিত মেয়েরা। কতো আহাজারি, কষ্ট নিয়ে দুঃখের পোস্ট দিচ্ছে। এদিকে পার্টি অফিসের সামনেও মেয়েরা দাঁড়িয়ে থাকছে। কি একটা অবস্থা!”
অরিত্রিকার মুখখানা থমথমে হয়ে গেল। আবিরের বলা কথাগুলো সত্যি মনে হলো। চঞ্চলা মনটা খারাপ হয়ে গেল। তা আড়াল করে আগ্রহী কন্ঠে বলল;

“আপনি সত্যি বলছেন ভাইয়া?”
“আরেহ হ্যা। গত এক সপ্তাহ ধরে ভার্সিটির ক্লাসমেট, জুনিয়র মেয়েদের কল আসায় ফোনটা আমার স্টোক করেছে।”
“আপনার বন্ধুর জন্য এতো মেয়েরা পাগল? বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।”
“ভার্সিটিতে যখন পড়তো তখন থেকেই মেয়েরা পাগল। সারহান তো ভদ্র ছেলে। মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। জানো, এক জুনিয়র মেয়ে সারহানকে ভালোবাসতো, গোপনে ছবি তুলতো। এমনকি চিঠি, গিফট পাঠাতো।”

“এসব কি বলছেন ভাইয়া? কোন মেয়ে সারহান ভাইকে চিঠি, গিফট দিতো?”
অরিত্রিকা চমকে উঠে বলল। বুকের ভেতর অসহনীয় যন্ত্রণায় মুচড়ে যাচ্ছে। কোনো মেয়ে যে সারহানকে ভালোবেসে চিঠি, গিফট দিতো সেটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। আবির অরিত্রিকার উদ্বিগ্ন ভাব বুঝতে পেরে স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“শালিকা! মেয়েটা বেঁচে নেই। যদি জীবিত থাকতো তাহলে তোমার সাথে চুলোচুলি বাঁধতো আমি শিউর।”
অরিত্রিকার মন কিছুটা শান্ত হলো। কিন্তু মেয়েটা মা*রা গেছে জেনে মনে খারাপ লাগা কাজ করল। সে আবিরের দিকে তাকাল। রাখঢাক না করে সরাসরি জানতে চাইল;

“মেয়েটার নাম কি ভাইয়া।”
আবির সাবলীল ভাবে বলল ;
“তাজিয়া তালুকদার।”
অরিত্রিকা হতভম্ব হয়ে গেল। বিস্ময়াভিভূত কন্ঠে আওড়ালো;
“তাজিয়া.. তালুকদার। ইলহাম.. তালুকদার।”

দুপুর তিনটা। চৌধুরী বাড়ির প্রতিদিনের নিয়ম অনুযায়ী এ সময়টা সবাই বিশ্রামে থাকে। সারা বাড়ি নীরবতায় ডুবে থাকার কথা। কিন্তু আজ সে নীরবতায় ছেদ পড়েছে। অরিত্রিকার রুম থেকে ভেসে আসছে উচ্চস্বরে গান। গানটাও যেন একটু অদ্ভুত রকমের। কখনও তীব্র সুরে গলা ফাটানো চিৎকার, কখনও আবার এলোমেলো তাল। গানের সঙ্গে মিশে আছে চেঁচামেচির শব্দ। ওমন গান শুনলে মনে হবে কেউ ভেতরে অস্থির কিছু অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে।সেই রুমের আশেপাশে থাকা কারও পক্ষেই বোঝা অসম্ভব নয় অরিত্রিকার রুমে কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটছে। সারহান পার্টি অফিস থেকে বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্র গানের তীব্র শব্দ শুনতে পেল। তার চোখ মুখ কুচকে গেল। বেশ বিরক্তিবোধ করল। সে লিভিংরুমে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শব্দের উৎসস্থল খুঁজতে লাগল। অবশেষে বুঝতে পারল গানের শব্দ তার বিবিজানের রুম থেকে আসছে। সে আর সেথায় না দাঁড়িয়ে দাম্ভিক ভঙ্গিমায় সিঁড়ি বেয়ে অরিত্রিকার রুমের দিকে গেল।

রুমের সামনে এসে দাঁড়াল সারহান। গানের উচ্চশব্দ বাড়ছে। সেই সঙ্গে হৈ হুল্লোড় বাড়ছে। দরজার সামনে দাঁড়ানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। কানের পর্দা যেন ফেটে যাবে এমন অবস্থা। সে চোয়াল শক্ত করল। চোখে মুখে গাম্ভীর্যতা ছেয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে দরজায় কয়েকবার নক করল। কিন্তু দরজা খুলল না। সে হাত নামিয়ে নিতে গিয়েও নিলো না। কিছু একটা মনে করে দরজাটা ধাক্কা দিলো। মুহূর্তেই দরজাটা পুরোটা খুলে গেল। সে বিরক্তির সহিত তাকাল রুমে। রুমের অবস্থা এবং ভেতরে থাকা তিনজনের সাজসজ্জা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।

❝বাংলা মাল ছেড়ে হাতে শরবত নিয়াছি
বৈরাগ দিয়ে কপালে তিলক লাগাইছি
মাইয়ার পিছন ছাইড়া দিয়া মন্টু হইয়াছি
পাপের জন্য গঙ্গা জলে ডুব দিয়াছি
সবকিছু ছাইড়া আমি সাধু হইয়াছি
প্রেমে আগুন জ্বালাইছি ও প্রেমের বিদায় জানাইছি
প্রেমের গুষ্টি মেরেছি ও প্রেমে আগুন জ্বালাইছি❞

বেপরোয়া ভঙ্গিতে উরাধুরা নাচছে অরিত্রিকা এবং ইশরা। গানের তালে তালে লুঙ্গি ধরে কোমড় দুলিয়ে হাত পা ছুঁড়ে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় নাচছে। মাঝে মাঝে রাহাকে টেনে জোর করে নাচাচ্ছে। হাতে পানির বোতল নিয়ে লাল পানির খাচ্ছে এমন ভাব করছে। এমন পাগলামি- অদ্ভুত ধরনের ভঙ্গি যে কেউ দেখলে টাস্কি খাবে। নাচে মত্ত থাকা অবস্থায় হঠাৎ শব্দ করে দরজা খুলে যেতেই তারা চমকে দাঁড়িয়ে গেল। ধরফরিয়ে উঠে তখনি নাচ থামিয়ে দরজার দিকে তাকাল। এতোক্ষণের প্রাণোচ্ছল প্রাণবন্ত মুখখানা চুপসে গেল। রাহা বসেছিল। সারহানকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দৌড়ে গিয়ে মিনি বক্সটা বন্ধ করে মুখ কাচুমাচু করে এক পাশে দাঁড়াল।
“এসব কি হচ্ছে?”

মিনিট খানেকের মধ্যে বাঘের মতো গর্জন শোনা গেল। রুমে থাকা তিনজন ভয়ে কেঁপে উঠল। শঙ্কিত বদনে একে অপরের দিকে তাকাল। অসময়ে সারহান ভাইকে বাড়িতে একদম আশা করেনি। এই মাত্রই নাচার ঝুল উঠেছিল। কিন্তু সেটা আর হলো কই? সারহান তির্যক চাহনিতে পরখ করল অরিত্রিকাকে। মেয়েটার শরীরে তার সাদা শার্ট! পরনে কালো রঙের লুঙ্গি, গলার দুইপাশে গামছা ফেলে রাখা অবলীলায়। চুলগুলো ছেলেদের মতো ছোট করে বাঁধা। ঠোঁটের ওপরে মার্কারের কালি দিয়ে গোঁফ বানানো। চোখে কালো চশমা। দেখতে কেমন যেন বখাটে ভাব। সে আশ্চর্য হয় সকালেও যে দুর্বলতায় দাঁড়াতে পারছিলো না সে এখন তিড়িং বিড়িং করে লুঙ্গি, শার্ট পড়ে নাচছে। সে এবার রাহা ও ইশরার দিকে তাকায়। দুজনের একই সাজ!

“ফাইরুজ! এদিকে আয়।”
পুরুষালি কন্ঠের গর্জনে কিডনিসহ সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে। ভীতিগ্রস্ত চাহনিতে সারহানের পানে তাকায়। এ উদ্ভট পোশাকে সামনে যেতে জড়তা কাজ করে। তবুও তা উপেক্ষা করে আস্তে ধীরে এগিয়ে যায় সারহানের দিকে। সারহান মেয়েটা মাথা থেকে পা অব্দি পরখ করে। অতঃপর পূর্বের ন্যায় জিজ্ঞেস করে ;
“এসব কি হচ্ছে।”
অরিত্রিকা কি উত্তর দিবে ভাবতে থাকে। এ মুহুর্তে স্বামী নামক পুরুষটিকে মিথ্যা বলতে মন সায় দেয় না। তাই মাথাটা মেঝেতে নিবদ্ধ করে মিনমিন করে জবাব দিলো ;

“পার্টি হচ্ছিল।”
সারহানের ভ্রুযুগল বেঁকে যায়। কি উপলক্ষে পার্টি হচ্ছে শুনতে আগ্রহী হয়। গম্ভীর কণ্ঠে পুনরায় শুধায় ;
“কি উপলক্ষে পার্টি?”
অরিত্রিকা ওষ্ঠ ভিজিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল;
“ইরফান ভাই আর রাহার কট ম্যারেজ উপলক্ষে পার্টি।”
সারহান কিংকর্তব্যবিমূঢ়! স্তম্ভিত নয়নে চায় অরিত্রিকার পানে। এটা কি আদৌও তার বউ ভেবেই বক্ষস্থল ধরফর করে উঠে। তখনই উপস্থিত হয় ইরফান এবং সাদাত। সারহানকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পিছু থেকে এক যোগে বলে উঠে ;

“কি হয়েছে?”
অরিত্রিকা দরজার দিকে চেপে নিজেকে লুকানোর প্রয়াস চালায়। সারহান যান্ত্রিক কন্ঠে জবাব দেয় ;
“রুমের ভেতরে তাকা তাহলে বুঝতে পারবি।”
দুজনে রুমের ভেতরে তাকায়। তিনজনের উদ্ভট সাজ দেখে কথা বলতে ভুলে যায়। ইশরা ও রাহা করুণ চোখে তাকায় একে অপরের দিকে। নিজেদের মান সম্মান চলে যাওয়ায় মনটা ভার হয়ে যায়। রাহা ইরফানকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিব্রতবোধ করে৷ নিজেকে অসহায় মনে হয়। কেন যে অরিত্রিকা ইশরার কথা মেনে এমন সাজলো! ইশরা সাদাতের চাহনি দেখে লজ্জা পায়। তার গাল দুটো টমেটোর মতো লাল হয়ে যায়। তাদের পরনের সবকিছু সারহান ভাই, ইরফান ভাই এবং সাদাতের।

“এই টমেটো! আমার লুঙ্গি, শার্ট পড়ে এসব কি সেজেছিস?”
সাদাত হঠাৎ চিল্লিয়ে বলল। বাকীদের ধ্যান ভাঙল। ইশরা লজ্জায় যেন পুঁতে পড়ল। ইরফান খেয়াল করে দেখল রাহা তার শার্ট, লুঙ্গি পড়ছে। অবাক হয়, আবার হতাশ হয় বাচ্চামিতে। সে বিস্ময়ভাব গিলে নেয়। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে ডাকে;
“রাহা এদিকে আসো।”
রাহা ভোঁতা মুখ নিয়ে আস্তেধীরে এগিয়ে আসে। ইরফান হঠাৎ মেয়েলী হাতটা ধরে বলে;
“আমার সাথে চলো।”

রাহা ভদ্র মেয়ের মতো ইরফানের সাথে চলে যায়। ইশরা এখানে থাকার মতো ভুল করে না। সে দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। দৌড়ে বের হওয়ার সময় সাদাতের সাথে ধাক্কা লাগে। সাদাত মৃদু চিৎকার দিয়ে বলল ;
“এই টমেটোর বাচ্চা! আমার শার্ট, লুঙ্গি না দিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? আমার একমাত্র লুঙ্গি! ”
কথাটা বলতে বলতে ছুটলো সাদাত। অরিত্রিকা এতোক্ষণ সবকিছু চুপচাপ দেখছিল। সাদাত, ইশরা এখান থেকে যেতেই বিরবির করে বলে উঠল;

“কট ম্যারেজ সেলিব্রেশন করতে গিয়ে কট খেয়ে যাবো ভাবতেই পারিনি।”
কথাটা শেষ করে সারহানের দিকে তাকায়। ওমন সূঁচালো চাহনি দেখে ভড়কে যায়। তুতলিয়ে কোনোমতে বলে;
“সারহান ভাই ওমন করে তাকিয়ে আছেন কেন?”
সারহান প্যান্টের পকেটে দুহাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়ায়। সূঁচালো চাহনি নিক্ষেপ করে ত্যাছড়া কন্ঠে বলে;
“তোর রুপ বের হয়েছে তাই দেখছি।”
“এ মুহুর্তে আমার রুপ দেখাতে ইচ্ছুক নই। ”
বলেই তাড়াতাড়ি করে দরজা বন্ধ করে দিলো। সারহান এহেন আচরণে অবাক হয়ে গেল। মেয়েটার সাহস দেখে তন্দা খেয়ে গেল।

“এমপি সারহান ইদায়াত চৌধুরীর ওপর দুই দফা হত্যাচেষ্টা, অরিত্রিকা ফাইরুজ চৌধুরীকে ব্ল্যাকমেইল, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হেনস্তা করায় সম্পৃক্ততা থাকা এবং চৌধুরী পরিবারের সম্পত্তি অবৈধভাবে আত্মসাৎ করার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে ইসমা শেখকে গ্রেফতার করা হলো।”

ঘড়ির কাটায় সাতটা। সন্ধ্যা নেমেছে ধরণীতে। চৌধুরী বাড়ির গিন্নিরা মেহমান আপ্যায়নের জন্য রান্নায় মশগুল ছিল। বাড়ির কর্তারা অফিস ছুটির প্রহর গুনছিল। বাড়ির ছেলে – মেয়েরা লিভিং রুমে বসে ছোট্ট করে আড্ডার আসর জমিয়েছিল। কেউ বা মা – বাবা আসার খবরে চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছিল। কিন্তু সেসবকে ছাপিয়ে নতুন এক চমক পেল। চৌধুরী বাড়িতে প্রথমবার পুলিশ এলো। নতুন করে তৈরী হলো অস্থিরতা, উৎকন্ঠা। সোফায় বসা সবাই আইনের লোকদের দেখে বিস্মিত হলো। বাড়ির গিন্নিরা রান্না ছেড়ে ছুটে এলো লিভিং রুমে। সার্ভেন্ট এবং দেহরক্ষীরা গুঞ্জন তুলল। ইসমা বেগম লিভিং রুমে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেসময় তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা এসে সম্মুখে দাঁড়াল। তাদের মধ্যে একজন মহিলা পুলিশ শক্ত কন্ঠে বলল।

“আমি সারহানকে হ*ত্যাচেষ্টা করিনি। আপনারা আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ তুলছেন।”
ইসমা বেগম ভয়ার্ত ভঙ্গিতে সহসা বললেন। তার শরীর কাঁপছে। আতংকিত হওয়ায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে কপালে। মহিলা পুলিশটি গমগমে কন্ঠে বলল;
“আপনার নামে এরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে। আমাদের সাথে থানায় চলুন তারপর সত্য, মিথ্যা বেরিয়ে আসবে।”
ইসমা বেগম শুকনো ঢোক গিলে। হঠাৎ এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে নার্ভাস হয়ে যান। ইরফান দৌড়ে এসে মাকে আগলে নেয়। পুলিশের দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল;
“আপনাদের কোনো ভুল হয়েছে। আমার মা কখনো কাউকে খু*ন করার কথা ভাবতেই পারে না। আগে সঠিক ইনফরমেশন জানুন।”

“ইনফরমেশন একদম সঠিক আছে। আপনার মা একজন বিচক্ষণ অ*পরাধী।”
“আমার মায়ের সম্পর্কে একটা বাজে কথা বলবেন না। সাদাত, সারহানকে কল কর।”
শেষোক্ত কথাটি চিল্লিয়ে সাদাতকে উদ্দেশ্য করে বলল। সাদাত দ্রুত পকেট থেকে ফোনটা করে ভাইকে কল দিলো। ইশরা দৌড়ে এসে ইসমা বেগমকে ধরে কাঁদতে লাগল। রাহা নির্বাক! মূল কাহিনী ধরে অক্ষম। অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় বড় করে ফুপির দিকে তাকিয়ে আছে। সে স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ। তারমানে সারহান ভাইকে হ*ত্যাচেষ্টা এবং তার সাথে যা কিছু ঘটেছে সবকিছুর পেছনে মা সমতুল্য ফুপি ছিলো? এসব ভেবে মস্তিষ্ক অচল প্রায়। তানিয়া বেগম দৌড়ে গেলেন নিজের রুমে। আজমল সাহেবকে কল দিয়ে জানাতে হবে। সাথী বেগম নিজেকে সামলে পুলিশের সাথে কথা বলতে এলেন। অরিনের মাথায় যেন বাজ পড়েছে। সে করুণ চাহনিতে চাইল ছোট বোনের দিকে। পুলিশের বলা অভিযোগ যদি সত্যি হয় তবে এ পরিবার, সম্পর্কে ফাটল ধরবে। তার ফুপি তো স্বার্থপর, সুবিধাভোগী ছিল না। তাহলে এমন অভিযোগ কেন করল?

কিছুক্ষণের মধ্যেই সারহান এবং আবির হন্তদন্ত হয়ে লিভিং রুমে ঢুকল। তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। সারহান গাম্ভীর্যতা নিয়ে জবাব দিয়ে তিনজনের সামনে এসে দাঁড়াল। অরিত্রিকা এলোমেলো পায়ে ছুটে এসে সারহানের বাহু ধরল। নিশ্চল, প্রাণহীন চাহনিতে তাকিয়ে নিস্পৃহ কম্পনরত কন্ঠে বলল;
“সারহান ভাই! উনারা ফুপির বিরুদ্ধে কি সব বলছে? ফুপি আপনাকে মা*রার চেষ্টা… এটা হতে পারেনা। কারণ উনি আপনাকে ছেলের মতো ভালোবাসে। আমাদের র*ক্ত কখনো বেইমানি করবে না। উনারা হয়তো ভুল খবর পেয়েছেন।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৬ (২)

সারহানের বুকটা কেঁপে উঠে। সে শীতল চাহনিতে তাকায় অরিত্রিকার উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত মুখপানে। মেয়েটা সত্যটা মেনে নিতে পারছে না বুঝতে পারে। তবুও এ মুহুর্তে তার কিছু করার নেই। সে সরাসরি তাকায় ইসমা বেগমের দিকে। কাঠিন্যেতা এঁটে শক্ত কন্ঠে বলে;
“টাকা, সম্পত্তির কাছে রক্তের সম্পর্ক ফিকে হয়ে যায়।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৭ (২)